বিষয়বস্তুতে চলুন

বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ/প্রথম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ

প্রথম পরিচ্ছেদ

সূচনা

 ১৮৬২ সালের জানুয়ারি মাসে একদিন রয়াল ভৌগোলিক সমিতির গৃহে এক বিরাট সভা বসিল। সমুৎসুক শ্রোতৃবৃন্দ সভাপতির উদ্দীপনাপূর্ণ বক্তৃতা শ্রবণ করিতে করিতে উত্তেজিত হইয়া উঠিল। ঘন ঘন করতালি ও প্রশংসাবাক্যে সভাগৃহ মুখরিত হইল। আসন পরিগ্রহণ করিবার পূর্ব্বে সভাপতি বলিলেন:

 “ভৌগোলিক তত্ত্বানুসন্ধানে ইংলণ্ডই পৃথিবীমধ্যে শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছে। ইংলণ্ডের সেই গৌরব ডাক্তার গুর্সন্ কর্ত্তৃক অচিরে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইবে। যদি তাঁহার চেষ্টা ফলবতী হয়—(শ্রোতাদিগের মধ্যে একজন কহিল ‘অবশ্যই হ’বে’) তাহা হইলে আফ্রিকার অসম্পূর্ণ মানচিত্র সত্বরেই পূর্ণাঙ্গ হইয়া দেখা দিবে। আর যদি তাঁহার উদ্যম ব্যর্থ হয়, তাহা হইলেও তাঁহার পরাজয় ইহাই প্রমাণিত করিবে যে, মনুষ্য বুদ্ধিকৌশলে একান্ত দুঃসাহসিক কার্য্যেও হস্তক্ষেপ করিতে পরাঙ্মুখ নহে।”

 বক্তৃতা শেষ হইতে না হইতেই ফার্গুসনের জয়নিনাদ ধ্বনিত হইতে লাগিল। তৎক্ষণাৎ চাঁদা সংগৃহীত হইতে আরম্ভ হইল। দেখিতে দেখিতে তাঁহার অভিযানের জন্য ৩৭৫০০ মুদ্রা সংগৃহীত হইয়া গেল। ভৌগোলিক সমিতির একজন সদস্য সভাপতিকে কহিলেন:

 “ডাক্তার ফার্গুসন্ কি একবার আমাদের সামনে বাহির হ’বেন না?”

 “কেন হবেন না? সকলের ইচ্ছা হ’লে তিনি এখনই এখানে আসতে পারেন।”

 সভাগৃহের চতুর্দ্দিকে হইতে সকলেই বলিতে লাগিল “আমরা ফার্গুসন্কে চাই।” একজন কহিল, “ফার্গুসন্ নামে কোন লোকই নাই—ওসব বাজে কথা।” আর একজন বলিল “বুঝ্তে পারছ না, এ সবই ফাঁকি।”

 তখন সভাপতি বলিলেন, “ডাক্তার ফার্গুসন্ আপনি অনুগ্রহ করে' একবার বাহিরে আসুন।”

 অবিলম্বে চল্লিশবর্ষবয়স্ক ধীর স্থির গম্ভীর একজন ভদ্রলোক গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন। শ্রোতৃবৃন্দ আনন্দে করতালি দিতে লাগিল। ফার্গুসন্ বক্তার মঞ্চোপরি আসিয়া দণ্ডায়মান হইলেন। সকলে দেখিল তাঁহার দেহ সুগঠিত, শরীর সুদৃঢ়, নাসিকা দীর্ঘ, নয়নদ্বয় কোমল ও তীক্ষ্ণবুদ্ধিব্যঞ্জক। তাঁহার বাহুযুগল দীর্ঘ, চরণদ্বয় দেখিলেই বুঝিতে পারা যায় যে, তিনি পদব্রজে অতি দীর্ঘ পথ পর্য্যটন করিতেও কাতর নহেন। ফার্গুসন্ বক্তার মঞ্চোপরি আরোহণ করিবামাত্রই আনন্দকোলাহল বাড়িয়া উঠিল। তিনি হস্তদ্বারা ইঙ্গিত করিয়া সকলকে শান্ত হইতে বলিলেন এবং পরক্ষণেই দক্ষিণ হস্তের তর্জ্জনি উর্দ্ধে উত্তোলন করিয়া কহিলেন—“ভগবানের ইচ্ছা পূর্ণ হোক।”

 তাঁহার এই একটা কথায় শ্রোতৃমণ্ডলী যেরূপ উত্তেজিত হইয়া উঠিল, কব্ডেন বা ব্রাইটের শত বক্তৃতাতেও সেরূপ কখনো হয় নাই। যিনি এক মুহূর্ত্তে সহস্র লোকের হৃদয় অধিকার করিয়া ফেলিলেন, তিনি কে? ফার্গুসনের পিতা ইংরাজ-নৌসেনা-বিভাগের একজন সাহসী সেনাধ্যক্ষ ছিলেন। বালক পুত্রকে লইয়া তিনি সাগরে সাগরে পরিভ্রমণ করিতেন। তাহাকে লইয়াই জলযুদ্ধে গমন করিতেন—শত বিপদের মধ্যেও পুত্রকে সর্ব্বদা সঙ্গে রাখিতেন। পুত্র তখন হইতেই বিপদ্কে তুচ্ছ জ্ঞান করিতে শিখিয়াছিল। বালক ফার্গুসন্ বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া দিবারাত্রি ভ্রমণকাহিনী পাঠ করিতেন। পর্যটকদিগের শত-সহস্র বিপদ্ মানস-নয়নে দর্শন করিয়া উৎকণ্ঠিত হইতেন, আবার তাঁহাদিগের অপূর্ব্ব উদ্ধার-কৌশল দেখিয়া পুলকিত হইতেন। ভাবিতেন তেমন অবস্থায় পতিত হইলে তিনিও নিশ্চয়ই আরো সহজ উপায়ে উদ্ধার লাভ করিতে পারিতেন। পুত্রের মনোগত ভাব বুঝিয়া পিতা তাহাকে বল-বিজ্ঞান, জলতত্ত্ব, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতিষ, ভৈষজ্যতত্ত্ব প্রভৃতি শিক্ষা দিয়াছিলেন।

 পিতার মৃত্যুর পর ফার্গুসন্ সৈনিকের ব্রত গ্রহণ করিয়া বাঙ্গালায় আসিলেন, কিন্তু উহা তাঁহার ভাল লাগিল না। তিনি অল্পকাল মধ্যেই তরবারি পরিত্যাগ করিয়া পর্য্যটক হইলেন এবং ভারতবর্ষ-ভ্রমণে বাহির হইলেন। তাঁহার পর্য্যটন-স্পৃহা এতই প্রবলা ছিল যে, একদিন প্রভাতে উঠিয়া কলিকাতা হইতে পদব্রজে সুরাট যাত্রা করিলেন এবং ক্রমে ক্রমে অষ্ট্রেলিয়া, রুষিয়া ও আমেরিকা পরিভ্রমণ করিয়া আসিলেন। কিছুতেই তাঁহার ক্লেশ হইত না । অল্পাহারে বা অনাহারে তিনি কষ্টানুভব করিতেন না। নিদ্রাদেবী তাঁহার দাসী হইয়াছিল। সময়ে হউক অসময়ে হউক, সুবিধায় হউক অসুবিধায় হউক—সঙ্কীর্ণ স্থানে হউক কিংবা প্রশস্ত স্থানে হউক, যখন যতটুকু আবশ্যক তিনি ততটুকু নিদ্রা যাইতে পারিতেন।

 ফার্গুসন্ কোনো সমিতির সদস্য ছিলেন না বটে, কিন্তু “ডেইলি টেলিগ্রাফ” নামক সুবিখ্যাত সংবাদপত্রে সর্ব্বদাই তাঁহার কৌতূহলপূর্ণ ভ্রমণকাহিনী লিখিতেন বলিয়া সকলের নিকট সুপরিচিত ছিলেন। তিনি কোনো সভা-সমিতির সহিত যোগদান করিতেন না। ভাবিতেন যতক্ষণ সভায় বসিয়া বৃথা তর্ক বিতর্ক করিব, ততক্ষণ কোনো একটা তথ্য আবিষ্কারের চেষ্টা করিলে কাজ হইবে। পর্য্যটক ফার্গুসন্ যাহা দেখিতেন, তাহার অন্তস্তল পর্য্যন্ত না দেখিয়া ছাড়িতেন না। তিনি অদৃষ্টলিপির উপর আস্থাবান্ ছিলেন। এবং সর্ব্বদাই বলিতেন, ‘দেশভ্রমণ আমার কপালের লেখা—সে লেখা মুছিয়া দিবার সাধ্য কাহারো নাই।’

 একদিন ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্র লিখিল:—

 “নির্জ্জন আফ্রিকার নীরবতা এতদিনে ভঙ্গ হইবে। ছয় সহস্র বর্ষেও যে সন্ধান লাভ ঘটে নাই, এখন তাহা ঘটিবে। নীলনদীর জন্মস্থান আবিষ্কারের চেষ্টা এতদিন একান্ত অসম্ভব ও বাতুলের চেষ্টা বলিয়া পরিচিত ছিল। দীর্ঘ দিনের পরিশ্রমে অন্ধকার অরণ্যতুল্য আফ্রিকার তিনটিমাত্র প্রবেশ-পথ মুক্ত হইয়াছিল। ডেন্‌হাম্ ও ক্ল্যাপার্টনের আবিষ্কৃত পথে ডাক্তার বার্থ সুদানে গমন করিয়াছিলেন, ডাক্তার লিভিংস্টোন বহু আয়াসে উত্তমাশা অন্তরীপ হইতে জেম্বেজী পর্য্যন্ত গিয়াছিলেন এবং কাপ্তান গ্রাণ্ট ও কাপ্তান স্পিক্ একটি ভিন্ন পথ অবলম্বন করিয়া আফ্রিকার কয়েকটি হ্রদ আবিষ্কার করিয়াছিলেন। এই তিনটি পথ যে স্থানে মিলিত হইয়াছে, তাহাই আফ্রিকার কেন্দ্রস্থল। ফার্গুসন্ সত্বরই আফ্রিকার এই ত্রিবেণী-সঙ্গমে যাত্রা করিবেন। তিনি স্থির করিয়াছেন যে, ব্যোমযানে আরোহণ করিয়া আফ্রিকার পূর্ব্ব প্রান্ত হইতে পশ্চিম প্রান্ত পর্য্যন্ত গমন করিবেন। আমাদের সংবাদ সত্য হইলে, তিনি জান্‌জিবার দ্বীপে বেলুনে উঠিয়া বরাবর পশ্চিম মুখে গমন করিতে মনস্থ করিয়াছেন। এই যাত্রা যে কোথায় এবং করূপে শেষ হইবে, একমাত্র ভগবান্‌ই তাহা বলিতে পারেন।”

 ‘ডেইলি টেলিগ্রাফে'র প্রবন্ধ প্রচারিত হইবামাত্র দেশমধ্যে একটা বিষম হৈ চৈ পড়িয়া গেল। অনেকেই বলিল “এ অসম্ভব কথা—এমন করে’ কি কখনো বেলুনে যাওয়া যায়! ফার্গুসন্ টার্গুসন্ কেহই নাই। ‘ডেইলি টেলিগ্রাফে’র সম্পাদক অমনি একটা হুজুগ তুলে’ একবার আমেরিকার মাথা খেয়েছিলেন, আবার দেখছি ইংলণ্ডেরও মাথা খেতে বসেছেন!” তখন অন্যান্য সংবাদপত্রে 'ডেইলি টেলিগ্রাফ'কে বিদ্রূপ করিয়া নানাবিধ প্রবন্ধ বাহির হইতে লাগিল। ফার্গুসন্ নীরব রহিলেন।

 কিছুকাল পর যখন সকলে শুনিল যে, সত্য সত্যই লায়ন্‌ কোম্পানী ফার্গুসনের বেলুন-প্রস্তুতের ভার লইয়াছেন এবং ইংরাজ-গবর্ণমেণ্ট ‘রেজলিউট’ নামক অর্ণবপোতখানি ফার্গুসনের ব্যবহারের জন্য নিযুক্ত করিয়াছেন, তখনই সকল সন্দেহ দূর হইয়া গেল। চতুর্দ্দিকে ধন্য ধন্য রব উঠিল।

 ইংলণ্ডের নানাস্থানে তখন বাজী ধরা আরম্ভ হইয়া গেল। সত্য সত্যই ফাুর্গুসন্ নামে কেহ আছেন কি না, সে জন্য বাজী ধরা হইল; এমন একটা অসম্ভব ও দুঃসাহসিক পর্য্যটন ব্যাপারে সত্যই কেহ প্রবৃত্ত হইবে কি না, তাহার উপর বাজী চলিল; পর্য্যটন সফল হইবে কি না, ফার্গুসন্ আর ইংলণ্ডে ফিরিতে পারিবেন কি না, তাহার জন্যও বাজী ধরা হইতে লাগিল।

 প্রতিদিন দলে দলে লোক আসিয়া ফার্গুসন্কে নানাবিধ প্রশ্ন করিতে লাগিল, কেহ কেহ বা তাঁহার সহযাত্রী হইবার জন্যও ইচ্ছা প্রকাশ করিল। তিনি প্রত্যেক প্রশ্নের সদুত্তর দিয়া সকলকে ফিরাইয়া দিলেন। কাহাকেও সঙ্গে লইতে সম্মত হইলেন না।