বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ/ষড়্বিংশ পরিচ্ছেদ
ষড়্বিংশ পরিচ্ছেদ
তালিবা দস্যু
বেলা প্রায় ১১টা বাজিল। দস্যুগণ তখনো বেলুনের সঙ্গে সঙ্গেই চলিতেছিল। আকাশে একটু সামান্য মেঘ দেখিলেই প্রতিকূল বায়ুর আগমন-শঙ্কায় ফার্গুসন্ চিন্তিত হইতেছিলেন।
বেলুন অল্পে অল্পে নিম্নগামী হইতেছিল। তখনো সেনেগাল তীর প্রায় ১২ মাইল দূরে ছিল। বেলুন যেরূপ ধীরে ধীরে যাইতেছিল, তাহাতে আরো ৩ ঘণ্টার কমে নদীতীরে উপনীত হইবার সম্ভাবনা ছিল না।
তালিবাদিগের জয়ধ্বনি ফার্গুসনের কর্ণে আসিয়া পৌঁছিবামাত্র তিনি তাহার কারণ বুঝিতে পারিলেন।
কেনেডি জিজ্ঞাসা করিলেন—“আমরা ক্রমেই নেমে যাচ্ছি না?”
“হাঁ, নামছি।”
পনের মিনিটের মধ্যেই বেলুন প্রায় ৬০০ ফিট নামিয়া আসিল। নিম্নে অপেক্ষাকৃত প্রবল বায়ু থাকায় উহা বেগে চলিতে লাগিল। গুড়ুম্ গুড়ুম্! তালিবাগণ আপন অপান অশ্বের জিনের উপর দণ্ডায়মান হইয়া একসঙ্গে গুলি করিল।
জো বিদ্রূপ করিয়া কহিল—“তালিবার গুলি এতদূর আসে না।” সে আপন বন্দুক তুলিল এবং নিমেষে সর্ব পূরোবর্ত্তী তালিবাকে নিহত করিল। সঙ্গীর এই আকস্মিক মৃত্যু-দর্শনে অন্যান্য তালিবাগণ অশ্বের বেগ সংযত করিয়া কিয়ৎক্ষণের জন্য স্থির হইয়া দাঁড়াইল। বেলুন সেই অবসরে খানিকটা দূর অগ্রসর হইল।
ফার্গুসন্ বলিলেন—“যদি বেলুন নেমে পড়ে, ওদের হাতে পড়তেই হ’বে। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ! ফেল—পেমিকান্ “ফেল!”
ইতোমধ্যেই বেলুন অনেক নামিয়া গিয়াছিল, পেমিকান্ নিক্ষিপ্ত হইলে পর কিছুদূর উপরে উঠিল।
তালিবাগণ ভীমনাদে গর্জ্জন করিতে লাগিল।
অর্দ্ধ ঘণ্টা গেল। ভিক্টোরিয়া পুনরায় দ্রুতবেগে নিম্নগামী হইল। রেশমের বহিরাবরণ দিয়া তখন সোঁ সোঁ করিয়া গ্যাস বাহির হইতেছিল।
বেলুন নামিল। আরো নামিল। আরো—আরো——শেষে দোলনা আসিয়া ভূমি স্পর্শ করিল!
উত্তেজিত উল্লসিত তালিবাগণ বেগে বেলুনের দিকে ধাবিত হইল।
ভূমি স্পর্শ করিবামাত্রই বেলুন এক লম্ফে আবার খানিকটা উপরে উঠিল এবং প্রায় এক মাইল দূরে গিয়া পুনরায় ভূপৃষ্ঠে আশ্রয় লইল।
ফার্গুসন্ হাঁকিলেন—
“ব্রাণ্ডিটুকু ফেলে দাও, জো—যন্ত্রগুলো ফেল। যা কিছু পার সব ফেলে নোঙ্গরটাও ফেলে দাও।”
বায়ুমান-যন্ত্র তাপমান-যন্ত্র প্রভৃতি সমস্তই নিক্ষিপ্ত হইল বটে, কিন্তু কোন ফল হইল না। বেলুন কয়েক হস্ত উঠিয়াই নামিয়া পড়িল।
তালিবাগণ ভীম বেগে অগ্রসর হইতেছিল। ফার্গুসন্ বলিলেন——“ফেল ফেল—এবার বন্দুক ফেলে দাও!”
কেনেডি আপন বন্দুক লইয়া কহিলেন—
“না মেরে ফেলছি না।”
দেখিতে দেখিতে কেনেডির গুলিতে ৪ জন তালিবা মৃত্যুমুখে পতিত হইল। অন্যান্য তালিবাগণ রোষে হুঙ্কার করিয়া উঠিল।
বেলুন আবার উঠিল— কিছুদূর গিয়া আবার পড়িল। রবারের গোলা যেমন সজোরে ভূপৃষ্ঠে পতিত হইবা মাত্রই লাফাইয়া লাফাইয়া চলে, ভিক্টোরিয়াও কিছুদূর তেমনি করিয়া চলিতে লাগিল।
পুনঃ পুনঃ আঘাতে সোঁ সোঁ করিয়া গ্যাস বাহির হইতে লাগিল। বেলুনের বহিরাবরণ নানাস্থানে টোল খাইল।
কেনেডি কহিলেন—
“আর উপায় নাই। বেলুন ছাড়া যাক।”
জো নির্ব্বাক্ হইয়া ফার্গুসনের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। তিনি কহিলেন— “এখনি ছাড়বে? এখনো আমরা একমণ পঁয়ত্রিশ সের ভার ফেলতে পারি।”
কেনেডি ভাবিলেন ফার্গুসনের হঠাৎ বুদ্ধিভ্রংশ হইয়াছে। নহিলে সে বলে কি!
তাই তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন—
“কি বল্লে, ফার্গুসন্?”
“একমণ পঁয়ত্রিশ সের ভার! দোলনাটা ফেলে দাও! বেলুনের রশি ধরে ঝুলে থাক। ফেল— ফেল —”
তাঁহারা অবিলম্বে বহিরাবরণের বাহিরের জাল বাহিয়া উঠিলেন। জো কৌশলে বন্ধন কাটিয়া দিল। বেলুন তখন নীচে নামিতেছিল, কিন্তু দোলনাটা খুলিয়া পড়ায় প্রায় ৩০০ ফিট উপরে উঠিয়া গেল।
উপরে বায়ু-প্রবাহ প্রবল ছিল। ভারমুক্ত বেলুন অতিশয় বেগে ধাবিত হইল। তালিবাদিগর অশ্ব ক্রমেই পশ্চাতে পড়িতে লাগিল। নিকটেই একটা অনুচ্চ পর্ব্বত ছিল। বেলুন উহার শৃঙ্গের উপর দিয়া অনায়াসে পার হইয়া গেল। কিন্তু উহা তালিবা অশ্বারোহিদিগের গতি রোধ করিল। পর্ব্বতটী বেড়িয়া না আসিলে তাঁহাদিগের আসিবার আর উপায় ছিল না। তাঁহারা তাই উত্তর মুখে ধাবিত হইলেন।
পর্ব্বত অতিক্রম করিয়াই ফার্গুসন্ বলিলেন—
“ওই যে নদী—ওই যে নদী দেখা যায়।”
সত্যই তাঁহারা নদীর নিকটবর্ত্তী হইয়াছিলেন। দুই মাইল মাত্র দূরে সেনেগালের স্থির বারিরাশি মধ্যাহ্নতপন-কিরণে ঝক্ মক্ করিতেছিল।
ফার্গুসন্ কহিলেন—
“বেশী নয়—আর ১৫ মিনিট—তা’ হ’লেই আমরা রক্ষা পাব!” বেলুন ১৫ মিনিট চলিল না! উহা ধীরে ধীরে নামিয়া পড়িল। নামিবা মাত্রই ধাক্কা খাইয়া আবার ঊর্দ্ধে উঠিল। আবার পড়িল—আবার একটু উঠিল। শেষে নিকটস্থ বৃক্ষের শাখায় বেলুনের জাল জড়াইয়া গেল।
বন্ধুত্রয় অবিলম্বে অবতরণ করিলেন এবং বেগে নদীর দিকে ধাবিত হইলেন। তাঁহারা যতই নিকটে আসিতে লাগিলেন, ততই একটী গুরুগম্ভীর জলোচ্ছ্বাস-রব কর্ণগোচর হইতে লাগিল। ফার্গুসন্ বলিলেন—
“আমরা গুইনা প্রপাতের নিকট এসেছি।”
নদীতীরে কোন প্রকার তরণী, মান্দাস কি ডোঙ্গা কিছুই ছিল না।
দেড় মাইল বিস্তৃত জলধারা কিয়দ্দূর ভীমবেগে অগ্রসর হইয়া প্রায় ১৫০ ফিট নিম্নে পতিত হইতেছিল। কাহার সাধ্য উহা অতিক্রম করে!
কেনেডি হতাশ হইয়া বসিয়া পড়িলেন। ফার্গুসন্ তাঁহাকে উৎসাহিত করিয়া কহিলেন—
“এখনো ভরসা আছে— এখনো উপায় আছে!”
তিনি সঙ্গীদ্বয়কে সেই পরিত্যক্ত বেলুনের নিকট লইয়া গেলেন। তথায় কতকগুলি শুষ্ক তৃণ পড়িয়াছিল। ফার্গুসন্ কহিলেন—“দস্যুরা এখানে আসতে এখনো প্রায় এক ঘণ্টা লাগবে। যত পার তৃণ কুড়াও। তা’ হ’লেই আমরা বাঁচবো!”
“তৃণ? ঘাস? ঘাস কি হ’বে?”
“বেলুনেতে গ্যাস নাই! গ্যাসের বদলে গরম বাতাস পূরে নদী পার হ’ব!”
জো এবং কেনেডি ক্ষিপ্রহস্তে তৃণ সংগ্রহ করিতে লাগিলেন।
ফার্গুসন্ ছুরিদ্বারা বেলুনের তলদেশে একটী অপেক্ষাকৃত বৃহৎ ছিদ্র করিলেন। বেলুনে যতটুকু গ্যাস ছিল, সব বাহির হইয়া গেল। তিনি তখন নিম্নে সঞ্চিত তৃণে অগ্নি সংযোগ করিলেন। ক্রমেই বেলুনের গর্ভে উষ্ণ বায়ু প্রবেশ করিতে লাগিল এবং অল্পকাল মধ্যেই উহা পুনরায় ফুলিতে আরম্ভ করিল।
বেলা যখন প্রায় ১টা তখন তাঁহারা দেখিলেন, দুই মাইল দুরে দস্যুদিগের অশ্ব দেখা যাইতেছে।
কেনেডি বলিলেন—
“ওরা বোধ হয় ২০ মিনিটের মধ্যে এসে পড়বে।” ফার্গুসন্ তিলমাত্র বিচলিত না হইয়া কহিলেন—
“আসুক না ওরা। জো আরো তৃণ দাও—আরো—আরো দশ মিনিটের মধ্যেই আমরা সরে’ পড়তে পারবো!
তখন বেলুনের প্রায় অর্দ্ধেক অংশ উষ্ণ বায়ুতে পূর্ণ হইয়াছিল। ফার্গুসন্ বলিলেন—
“বন্ধুগণ, একবার যেমন করে বেলুনের জাল ধরে’ এসেছিলে, তেমনি করে যাবার জন্য প্রস্তুত হও।”
তাঁহারা প্রস্তুত হইলেন। বেলুনের নিম্নে শুষ্ক তৃণ পুড়িতে লাগিল। ছিদ্র মুখে বেলুন গর্ভে উষ্ণ বায়ু প্রবেশ করিতে লাগিল। বেলুন উড়িবার মত হইল।
দস্যুগণ তখন ৫০০ শত হস্ত মাত্র দূরে ছিল। তাহারা সকলে একত্রে বন্দুক ছুড়িয়া জয়ধ্বনি করিয়া উঠিল।
ফার্গুসন্ অগ্নি মধ্যে আরো কিছু তৃণ দিয়া উচ্চকণ্ঠে কহিলেন—“হুসিয়ার—খুব শক্ত করে জাল ধর।”
দেখিতে দেখিতে বেলুন সেই বৃক্ষের মাথায় উঠিল। তালিবাগণ পুনরায় গুলি করিল। একটা গুলি জো’র স্কন্ধের নিকট দিয়া সোঁ করিয়া চলিয়া গেল। কেনেডি এক হস্তে জাল ধরিয়া অপর হস্তে বন্দুক ছুড়িলেন। একজন দস্যু ধরাশায়ী হইল। বেলুন তখন প্রায় ৮০০ ফিট্ উপরে উঠিয়াছিল। দস্যুগণ ভীষণ চীৎকার করিতে লাগিল।
উপরে বেগশালী বায়ু-প্রবাহ ছিল। ভিক্টোরিয়া ভয়ানক দুলিতে দুলিতে বায়ু চালিত হইয়া অগ্রসর হইতে লাগিল। ফার্গুসন্ দেখিলেন, পদনিম্নে সেই ভীষণ জলপ্রবাহ বিশাল শব্দে ১৫০ ফিট্ নিম্নে ঢলিয়া পড়িতেছে।
দশমিনিট মধ্যেই বেলুন জলপ্রপাত পার হইল এবং তীরের নিকটেই বারি মধ্যে পতিত হইবামাত্র ফার্গুসন্ বন্ধুদ্বয় সহ বেলুন হইতে ঝম্প প্রদান করিলেন।
নিকটবর্ত্তী ফরাসী উপনিবেশের কয়েক জন সৈনিক একান্ত বিস্মিত ও ভীত হইয়া এই ব্যাপার নিরীক্ষণ করিতেছিল। তাহারা জলে নামিয়া পর্য্যটকদিগকে ধরিয়া তুলিল। ভিক্টোরিয়া তখন খরস্রোতে ভাসিতে ভাসিতে নিমিষে গুইনা-প্রপাত মধ্যে অদৃশ্য হইল!
ফরাসী লেফ্টেনাণ্ট সাগ্রহে হস্ত প্রসারণ করিয়া ফার্গুসন্কে কহিলেন—
“আপনিই কি, ডাক্তার ফার্গুসন্?”
“আমিই ফার্গুসন্। এঁরা আমার সহযাত্রী—আমার বন্ধু।”
“চলুন, দুর্গে যাই! আপনাদের এই দুঃসাহসিক পর্য্যটনের কথা আমি আগেই সংবাদ পত্রে পড়েছি।”
বন্ধুগণ সহ ফার্গুসন্ ফরাসী দুর্গে গমন করিলেন।
সমাপ্ত