বেল্লিক রামায়ণ/বাল্যলীলা

উইকিসংকলন থেকে

বাল্যলীলা।

একদিন দুই দিন এমতি করিয়ে।
ক্রমশই কাটে কাল বাধা না মানিয়ে॥
বাড়িতে লাগিল শিশু সুড়্ সুড়্ সুড়।
বাড়ে যথা ঝপাঝপ্ কলার তেউড়॥
অথবা বাঁশের কোঁড়া যেমতি বাড়ায়।
ঝাঁ ঝাঁ করি বাড়ে শিশু কি আনন্দময়॥
দুঃখিনী জননী ভিক্ষা করি সেই তার।
কোনরূপে খা(ও)য়া পরা চালায় সবার॥
অতি লক্ষী মেয়ে সেই, যে দেখে সে খুসী।
সকলেরি সাথে তার ভালবাসাবাসি॥
যে যা কিছু দেয় শুধু তাহারেই দেখে।
সকলেই দয়াপূর্ণ তাহার সে দুখে॥
সবারি বাসন, দুঃখ ঘুচাইতে তার।
কিসে এ দুর্দ্দিন শীঘ্র কাটয়ে তাহার॥
করি পরামর্শ দশে ডাকি অভারামে।
কহিল “যদ্যপি কোন চাক্‌রী কোনক্রমে॥
দিতে পারি জুটাইয়ে কর কি না কর।
বল দেখি মনােগত ভাব কিবা ধর॥”
কহিল বেল্লিক-পিতা অভারাম তবে।
“যদ্যপি তােমরা দয়া করি কার্য্য দিবে॥

কেন না করিব তাহা, অবশ্য করিব।
তবে কথা, জানি না, পারিব না পারিব॥
বিদ্যা ত অগাধ মাের সমুদ্র-বিশেষ।
ডুবুরী নামালে নাহি পায় ত উদ্দেশ॥
ক অক্ষর ভগবতী-মাংস সম, হায়!
এ বি সি ডি, সে ত বহুদূরে স্থান পায়॥
কালির অক্ষর আঁখি-বালি সম জ্ঞানে।
আছিল সে এতদিন কেবা নাহি জানে॥
অতএব সুধাই কেমনে কাজ করি।
করিতে ইচ্ছা ত বটে, কিসে কিন্তু পারি॥”
বলিল সকলে “ভাল, ভয় নাই ভাই।
এমন চাকরী দিব, বিদ্যা যাতে নাই॥
সাহেবের সাথে কথা না হবে কহিতে।
বাঙ্গালী-বাড়ীতে কাজ দিব সে গদীতে॥
গদীয়ান বাবু যত আছয় সহরে।
দিব সে চাকরী এক তাঁহাদের ধােরে॥
বাজার-সর্‌কারী কর্ম্ম হইবে করিতে।
বল দেখি এইবার কিবা মত ইথে॥”
“ভাত খাবি সেধো রে?—না, ধুয়ে আছি হাত!”
নতশিরে অভারাম, মানিল বরাত॥
বলিল, “এখনি আমি আছি ত প্রস্তুত।
নিয্যশ্ এ কাজে আমি করিব ত জুত্॥”

অতঃপর গদীর চাকরী এক পেয়ে।
আনে বেশ দশ টাকা অভা খুসী হয়ে॥
একটি দুইটি কোরে আরো ছেলেপুলে।
হইতে লাগিল অভারামের কপালে॥
পতিপ্রাণা অভাপত্নী গোছ্‌গাছ করি।
চালায় সংসার বেশ ভিতরে তাহারি॥
ছেলেতে মেয়েতে মোটেমাটে ছটি হলো।
বেল্লিক সবার বড় বয়েসেতে ষোলো॥
বাড়ীর নিকটে এক স্কুল ছিল সেথা।
পড়াশুনো করিছে বেল্লিকরাম তথা॥
বিনা বেতনেতে পড়ে নাহি কিছু ব্যয়।
কাগজ কলম বই দশে মিলে দেয়॥
সবে বলে পড়াশুনাে করে না কি ভাল।
পাড়ার মধ্যেতে বড় সুখ্যাতি উঠিল॥
পুত্রের সুখ্যাতি শুনি মাতা খুসী মনে।
খুসীর বান সে যেন ডাকে পিতৃপ্রাণে॥
ভাবে অভা, যা কষ্ট পাবার, পাইয়াছি।
নিশ্চয় আর না কষ্ট পাব জানিতেছি॥
মুখ তুলে ভগবান্ চেয়েছে এবার।
দুঃখের সাগরে দেখি পাই কি না পার॥
শায় জগৎ চলে কেবা নাহি জানে।
দিন দিন বাড়ে আশা আভার পরাণে॥

ভাবে এইবার অভা যদি এই ছেলে।
দিতে পারে পাশ্ দুটী একটী কপালে॥
তা হলে আর কি থাকি কারু হয়ে দ্বারী।
যত শীঘ্র পারি, ছেড়ে দিই এ চাকরী॥
হইয়ে ধনীর পুত্র, থেকে আগে ধনী।
শেষে এত কষ্ট ভােগ কম কি জ্বলনি॥
সামান্য বাজার-সরকার হয়ে আছি।
এর চেয়ে মরিলেই যেন এবে বাঁচি॥
এ বলে, “হ্যাদে রে অভা, এটা এনে দে ত।”
ও বলে, “জল্‌দি গিয়ে বাজার কর্ ত॥
তীক্ষ্ণ বেল্‌কার যেন পরাণেতে বেঁধে।
অথবা সালের কাঁটা গাঁথে গিয়ে হৃদে॥
ছট্‌ফট্ ছট্‌ফট, অন্তরে সদাই।
সদাই এ চিন্তা হৃদে কিসে ছাড়ান্ পাই॥
ছাড়িলে চাকরী, নাহি চলে উদরান্ন।
কাজেই উপায় আর নাহি ইহা ভিন্ন॥
ধন্য হয়ে আছি এই চাক্‌রীই নিয়ে।
কাটে দিনরাত শুধু পুত্র-মুখ চেয়ে॥
জ্যেষ্ঠ পুত্র রাম মাের অতি গুণধাম।
সবাই বলিছে ভাল, সবে গায় নাম॥
দেখি ফেরে কি না দিন পুনঃ এ কপালে।
দেখি সে সুদিন পুনঃ মেলে কি না মেলে॥

এইরূপ চিন্তা তার হৃদয়ে যখন।
চতুর্থ শ্রেণীতে রাম পড়িছে তখন॥
ইংরাজী স্কুলেতে পড়ে নহে সে বাঙ্গালা।
বাঙ্গালায় পাশ সেই দেছে ছােটবেলা॥
যখন বয়স তার হইবেক বারো।
বাঙ্গালা ছাত্তর-বৃত্তি পাশ সে করিল॥
পাড়াময় ঢিঢি পড়ে গেল সেই কালে।
অভাপুত্র পাশ দিল সকলেতে বলে॥
কিন্তু এক দোষ বল কিম্বা বল গুণ।
এই বয়সেই তাতে লাগে যেন ঘুণ॥
পরের দ্রব্যেতে তার হয় বড় লােভ।
না পাইলে মনে মনে জন্মে মহা ক্ষোভ॥
কারু গাছে আম লিচু কারু বা কাঁঠাল॥
কারু গাছে পিয়ারা সে কারু গাছে তাল॥
তেঁতুল আমড়া কুল, কলা আদি কোরে।
কিছু নাহি চক্ষে তার বাদ কভু পড়ে॥
পড়েছে চক্ষেতে কি তা, করেছে হরণ।
ঠিক যেন রাহুরূপী বেল্লিক তখন॥
বলে, “আহা ঐ গাছ কত কষ্ট পায়।
এত ফলভার ওতে সহে কি হে হায়!
দয়া কোরে আমি যদি না ঘুচাই দুখ।
কে আর তা হলে বলো চাহে ওর মুখ॥

ধন্য হে বেল্লিক রাম অতি সাধু তুমি।
কিবা শক্তি তব গুণ বর্ণিব বা আমি॥
এইরূপে বাল্যকাল করেন যাপন।
পর-উপকারে রত ধর্ম্মপথে মন॥
লুকায়ে লুকায়ে ক্রমে কারু কারু চালে।
দিয়া আসে অগ্নিযােগ করি নিশাকালে॥
পাবক অগ্নির নাম কহে অভিধান।
এরূপে পবিত্র তাই করে সেই স্থান॥
অধিক খােলার চালে রহে নীচ জন।
এক দণ্ড ধর্ম্মে তারা নাহি দেয় মন॥
বিশেষতঃ নােংরামিতে বড় তারা রত।
সদা বদ্‌গ্যাস তথা ওঠে অবিরত॥
তেঁই সে লাগায়ে অগ্নি আনে পবিত্রতা।
হেন উপকারী আর বল কেবা কোথা?
পথে যেতে যেতে যদি দেখে বেশ্যাবাড়ী।
ছােড়ে ইট চালে চালে কোরে তাড়াতাড়ি॥
হইলে ইষ্টকালয় বারান্দাতে তার।
ছােড়ে সেই ব্রহ্ম-অস্ত্র যত্নে অনিবার॥
গালি দেয় তারা বটে অকথ্যভাষায়।
কি করিবে, এ কাজেতে আছে হেন, হায়॥
নিতাই উদ্ধার হেতু জগাই মাধায়ে।
কি কষ্ট না পান, কলসীর কাণা খেয়ে॥

তথাপি আদরে তারে দেন কোলে স্থান।
কষ্টে কষ্ট জ্ঞান নাই, আনন্দিত প্রাণ॥
বলে মন্দ বলিবে, দুর্জ্জন যারা হয়।
দুর্জ্জনের কথা কেবা গ্রাহ্য বা করয়॥
পরহিতে ব্রতী হলে হয়ত সহিতে।
আছেই দুর্নাম ভােগ পরের কার্য্যেতে॥
কাজে কাজে প্রভু রাম, প্রতিজ্ঞা অটল।
দুর্জ্জন-দমনে তিনি রত অবিরল॥
চরিত্র তাঁহার হয় অতি অপরূপ।
পাঠমাত্রে উথলিত যাহে ভাবকূপ॥
বাল্যলীলা এইরূপে কতবিধ হয়।
কাহার শকতি তাহা বর্ণে সমুদয়॥
সকলি তাজ্জব এর আজব্ কার্খানা।
একমুখে কদাপি না হয় ত বর্ণনা॥
ষােল বৎসরের ক্রমে হলেন যখন।
আরো কত অপরূপ হয় সংঘটন॥
ক্রমশ প্রকাশ্য ভাই রহ ধৈর্য্য ধােরে।
কি জানি কি ঘটে বা, শুনিলে একেবারে॥
হয় ত অমনি জীবন্মুক্তি বা ঘটয়।
কে আর তা হলে ইহা শ্রবণ করয়॥