বেল্লিক রামায়ণ/রাজাবাবুর বিরহ বর্ণন

উইকিসংকলন থেকে

রাজাবাবুর বিরহ-বর্ণনা।

এদিকেতে রাজাবাবু নেশা ছুটে গেলে।
ঘর শূন্য দেখিয়ে যে হাত দেয় গালে॥
বুঝিতে না পারে কিছু কি যে সংঘটিল।
পাঁতি পাঁতি করি বাড়ী খুঁজিতে লাগিল॥
কোথা কিন্তু পাবে তারে খুঁজিয়ে বা আর।
একেবারে হইয়াছে সে পগার পার॥

কিষ্কিন্ধ্যানগরে গিয়ে হৈল উপনীত।
কে আর সম্মুখে তারে করে উপস্থিত॥
ঘরেতে পালকমাতা যে নারী আছিল।
দ্রুতপদে গিয়ে রাজা তারে সুধাইল॥
বলে, “কোথা কন্যা তব বল শীঘ্র করি।
নতুবা বিরহে তার আমি যে রে মরি॥
সামান্য বিরহ এ তো নহেক কখন।
সাক্ষাৎ ইন্দ্রের বজ্র বক্ষেতে পতন॥
সামান্য ত ভালবাসা নহেক আমার।
ঠিক যেন চাক্ষুষ্ সে ফল্‌স নায়েগ্রার॥
প্রাণের মধ্যেতে তার হয় ত উচ্ছ্বাস।
বাহিরে নিশ্বাসে কিন্তু দেখ তা প্রকাশ॥
শব্দেতে বধির কর্ণ যে জন নিকটে।
নিশীথে নিদ্রা সে তার ঘটে কি না ঘটে॥
ভাবিয়ে আকুল সেও কি হয় কি হয়।
আমার ত বাহ্যজ্ঞান গেছেই নিশ্চয়॥
বাঁচিয়েও মৃতকল্প হয়েছি যে আমি।
কোথা “মৃত সঞ্জীবনী” দাও শীঘ্র তুমি॥
তোমারি কন্যা সে ‘মৃতসঞ্জীবনী’ মম।
দাও শীঘ্র আনি তারে, হয়ো না নির্ম্মম॥
তুমি যদি মমতায় না হও গলিত।
নাহি আনি দাও তারে হয়ে ত্বরান্বিত॥

কি হয় উপায় মাের কেমনেতে বাঁচি।
আছি যে এখনাে, শুদ্ধ তারি আশে আছি॥
সে যদি না কাছে মাের এখনি আসিবে।
দেখিবে এখনি প্রাণ বাহিরিয়ে যাবে॥
গেলে এ পরাণ আর কে খেলে এ খেলা।
কে আর বসায় হেথা এ রসের মেলা॥
ঘর বড়ী আত্মজন ত্যজেছি সকলি।
তােমারি কন্যারে সার করিয়াছি খালি॥
বেচিয়ে আপন বাড়ী আপন বাগান।
তার এ বাগান-বাড়ী করেছি নির্ম্মাণ॥
মা-মাসী আত্মীয়জন যে যথায় ছিল।
তারে দিতে গহনা সবার সােণা গেল॥
দেহ মান জাতি প্রাণ সকল সঁপিয়ে।
একান্তে তাহারি ধ্যানে আছি ত ধরিয়ে॥
এতটা যে ভালবাসা এতটা যে টান।
তাহারি কি হয় হায় এই প্রতিদান।॥
ভাসায়ে অকূলে হেন যায় পলাইয়ে।
কেমনে বল না আমি থাকিব বাঁচিয়ে॥
ওগো ও পালকমাতা ধরি তব পায়।
বল না কেমনে আমি পাব পুনঃ তায়॥
পাই যদ্যপি তারে, বলো খুলেখালে।
প্রাণ দিব এখনি গো তব পদতলে॥

তুমিই জুটায়ে তারে দিলে মাের সনে।
তুমিই বলিলে ভালবাসে সে অধীনে॥
না পেলে আমারে সেই না রাখিবে প্রাণ।
তুমিই এ কথা মােরে বলেছ প্রমাণ॥
এখন এমন ধারা কেন তবে হয়।
বল দেখি খুলে মােরে করিয়ে নিশ্চয়॥”
এই বলি কাঁদে রাজা হইয়ে আকুল।
অকূল চিন্তায় তার নাহি মিলে কূল॥
বুড়ীটী পালকমাতা বলে হেসে হেসে।
“কোথা পেলে এত রস এ অল্প বয়সে॥
লুকায়ে কন্যারে মাের আপনা হইতে।
আপনি পুনশ্চ তারে এসেছ খুঁজিতে॥
মরি মরি সােণার চাঁদ রে যাদুমণি।
বটে সত্য তুমি ঠিক লােকটী এমনি॥
ভাজা মাছ উল্টায়ে না জান তুমি খেতে।
ভাল ন্যাকা সাজিয়াছ তুমি ন্যাকামিতে॥
আমিও তােমারে সােজা দিতেছি বুঝায়ে।
অচিরে তাহারে তুমি দাও ত মিলায়ে॥
নতুবা সহজে নাহি ছাড়িব তােমায়।
দেখাব কত সে মজা হয় কতটায়॥
একমাত্র কন্যা মাের বার্দ্ধক্য সম্বল।
আছি যে বাঁচিয়ে তারি ভর্সায় কেবল॥

রােজ্‌গার করিবার শক্তি এবে আর।
একটুও এ নিশ্চয় নাহিক আমার॥
তারি রােজগারে প্রাণ ধরি হে এখন।
সে আশার বৃক্ষ তুমি করিলে ছেদন॥
কি নিষ্ঠুর বল দেখি তুমি এ ভুবনে।
ফাঁকি দিতে চাও মােরে এ কন্যা রতনে॥
খুন করিতে যে তুমি পারহ নিশ্চয়।
তােমার মতন খুনে ভুবনে কে হয়॥
এ বুড়ো বয়সে মােরে কর অসহায়।
বল দেখি আর মম আছে কি উপায়॥”
এত বলি পুলিশে সে চায় ছুটে যেতে।
নিষেধ করেন রাজা হস্ত-সঙ্কেতেতে॥
বলে “বুড়ী কি অনর্থ বাধাও এমনে।
মিছামিছি তােমা আমা বিসম্বাদ কেনে॥
একান্ত যদ্যপি তুমি নাহি কিছু জান।
ভাল এক যুক্তি মম তবে তুমি শুন॥
নিশ্চয় রাত্রিতে কোন চোর এসেছিল।
সেই সে কন্যারে তব নিয়া পলাইল॥”
বুড়ী বলে, “দুয়ারেতে রয় দরােয়ান।
কেমনেতে চোর সেই করিল পয়াণ॥
অবশ্য তােমার কোন লােক না হইলে।
কেমনে সহজে সেই যেতে পারে চলে॥

তোমারি ইয়ার-বন্ধু-ভিতরে এ কাজ।
অপরের সাধ্য কিবা পশে এর মাঝ॥”
রাজারো অন্তরে সন্দ হয় সমুদিত।
“অবশ্য এ কার্য্য কোন ইয়ারের কৃত॥
কিন্তু কেবা সে পাষণ্ড করিল এমন।
কে আছে এমন শত্রু করিবে এমন॥
জ্ঞানে ত অনিষ্ট কারু আমি করি নাই।
কি পাপে ভাগ্যেতে মোর ঘটে এ বালাই॥
ভাল ভেবে চিন্তে খোঁজ নিয়ে অতঃপর।
অবশ্য বাহির করিব সে কোন্ নর?
আমার চক্ষেতে ধূলা দেবে সাধ্য কার।
অচিরেই প্রতিশোধ নিব ত ইহার॥
নিযুক্ত করিব চর চারিদিকে আমি।
তুমিও সতর্ক হয়ে থাক দিনমণি॥
শীঘ্রই ধরিব চোর কি ভাবনা ইথে।
কেমনেতে ধূলা সেই দিবেক চক্ষেতে॥
এই ত কজন মাত্র ইয়ার আমার।
করিয়াছে একজন মধ্যেতে ইহার॥
করিবই কথা বার যেমনেতে পারি।
তার পর শাস্তি যাহা দিব ত তাহারি॥
অল্পে কি ছাড়িয়ে দিব মনেও করো না।
তেমন ছেলেই আমি নই কি জান না॥

একবার অঙ্কুশে জানিলে পরে হয়।
প্রত্যক্ষ দেখিবে তুমি করিব প্রলয়॥”
এইরূপ বলি তারে বুঝায়ে সুঝায়ে।
শীঘ্রগতি বাটী হতে যায় বাহিরিয়ে॥
যথা দর্পনারায়ণ তথা ক্রমে যায়।
গিয়ে চুপি চুপি তারে এইটি সুধায়॥
“ভাই রে, তুমি যে মম ইয়ার প্রধান।
নাহিক বান্ধব আর তােমার সমান॥
জেনেছ সকলি তুমি ঘটেছে যা মাের।
দুঃখের আমার নাহি নিরখি ত ওর॥
কি করি কি হয় ভাই, কহ ত উপায়।
নতুবা পরাণ মাের দেখ বাহিরায়॥
কোথা মনােমমাহিনী সে পরাণ আমার।
সে বিনে সকলি আমি হেরি যে আঁধার॥
পার যদি তুমি ভাই অন্বেষিতে তারে।
করিব সন্তুষ্ট তােমা যােগ্য পুরস্কারে॥
অগ্রিম যদ্যপি চাও তাও বরং দিব।
কিছুতে পশ্চাৎপদ আমি নাহি হব॥”
শুনি দর্পনারায়ণ হাসে মনে মন।
ভাবে, “ভাল দাঁও এই হয় ত ঘটন॥
গাছের তলার,—দুই নিব ত এবার।
এমন সৌভাগ্য বল ঘটে আর কার॥

মম সম ভাগ্যবান্ কেবা আর আছে?
হেলায় সুযোগ কেন খোয়াইব মিছে॥”
মনে মনে এইরূপ করি আন্দোলন।
ধীরে ধীরে নৃপবরে করি সম্ভাষণ॥
কহে ধীরে ধীরে এই সুমধুর বাণী।
আহা বাণী নয়, যেন মিছরির খনি!!
“শুন রাজা, তবে তুমি মম শ্রীমুখেতে।
পাবে মোহিনীরে তুমি যেই প্রকারেতে॥
গিয়াছে সে কিষ্কিন্ধ্যার কোন এক স্থানে।
বলিব না নাম এবে কোন বাবু সনে॥
একটী হাজার টাকা মোরে যদি দিবে।
অবশ্য আনিয়ে আমি দিব তোমা তবে॥
তাও সে অগ্রিম মোরে পার যদি দিতে।
তবেই যাইব আমি তাহারে আনিতে॥”
রাজা কয়, “ভাল, ভাল, তাই দিব তোমা।
তোমার গুণের আমি নাহি পাই সীমা॥
এত বলি বাড়ী গিয়ে কোন গতিকেতে।
জোগাড় করিল সেই টাকা দিনেকেতে॥
করিয়ে দর্পের করে করিল প্রদান।
ধরিতে বেল্লিকে দর্প কিষ্কিন্ধ্যায় যান॥
সঙ্গেতে পুলিস সাজাইয়ে দশজনে।
উপনীত ত্বরা গিয়া হয় সেই স্থানে॥

বেল্লিকের রামায়ণ অতি চমৎকার।
একদণ্ডে করে যাহে চিত্তের বিকার॥
পাঠমাত্রে দিব্যজ্ঞান যত জীব পায়।
তিন সাতে একুশ পুরুষ স্বর্গে যায়॥