বৌ-ঠাকুরাণীর হাট/একত্রিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

একত্রিংশ পরিচ্ছেদ।

 উদয়াদিত্যের নৌকা খাল অতিক্রম করিয়া নদীতে গিয়া পৌঁছিল, তখন সীতারাম নৌকা হইতে নামিয়া সহরে ফিরিয়া আসিল। আসিবার সময় যুবরাজের নিকট হইতে তাঁহার তলােয়ারটি চাহিয়া লইল।

 উদয়াদিত্যের তিনখানি পত্র একটি লােকের হাত দিয়া সীতারাম প্রাসাদে প্রেরণ করিয়াছিল বটে, কিন্তু সে চিঠি কয়খানি কাহারাে হাতে দিতে তাহাকে গােপনে বিশেষরূপে নিষেধ করিয়াছিল। নৌকা হইতে প্রাসাদে ফিরিয়া আসিয়া সীতারাম সেই চিঠি কয়খানি ফিরাইয়া লইল। কেবল মহিষী ও বিভার চিঠিখানি রাখিয়া বাকি পত্রখানি নষ্ট করিয়া ফেলিল।

 তখন আগুন আরাে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছে। রাত্রে শয্যা হইতে উঠিয়া কৌতুক দেখিবার জন্য অনেক লোক জড় হইয়াছে। তাহাতে নির্ব্বাণের ব্যাঘাত হইতেছে বই সুবিধা হইতেছে না।

 এই অগ্নিকাণ্ডে যে সীতারামের হাত ছিল, তাহা বলাই বাহুল্য। উদয়াদিত্যের প্রতি আসক্ত কয়েকজন প্রজা ও প্রাসাদের ভৃত্যের সাহায্য সে এই কীর্ত্তি করিয়াছে। সন্ধ্যাবেলায় একেবারে পাঁচ ছয়টা ঘরে যে বিনা কারণে আগুন ধরিয়া উঠিল, ইহা তখন দৈবের কর্ম্ম নহে, এতক্ষণ এত চেষ্টা করিয়া আগুন নিবিয়াও যে নিবিতেছে না, তাহারাে কারণ আছে। যাহারা আগুন নিবাইতে যােগ দিয়াছে, তাহাদের মধ্যেই দুই এক জন করিয়া সীতারামের লােক আছে। যেখানে আগুন নাই তাহারা সেইখানে জল ঢালে, জল আনিতে গিয়া আনে না, কৌশলে কলসী ভাঙিয়া ফেলে, গোলমাল করিয়া এ ওর ঘাড়ের উপর গিয়া পড়ে। আগুন আর নেবে না।

 এদিকে যখন এইরূপে গোলযোগ চলিতেছে, তখন সীতারামের দলস্থ লোকেরা উদয়াদিত্যের শূন্য কারাগারে আগুন লাগাইয়া দিল। একে একে জানালা দরজা, কড়ি, বরগা, চৌকাঠ, কাঠের বেড়া প্রভৃতিতে আগুন ধরাইয়া ছিল। সেই কারাগৃহে যে, কোন সূত্রে আগুন ধরিতে পারে, ইহা সকলের স্বপ্নেরও অগোচর, সুতরাং সে দিকে আর কাহারো মনোযোগ পড়ে নাই। সীতারাম ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, আগুন বেশ রীতিমত ধরিয়াছে। কতকগুলা হাড় মড়ার মাথা, ও উদয়াদিত্যের তলোয়ারটি সীতারাম কোন প্রকারে উদয়াদিত্যের সেই ঘরের মধ্যে ফেলিয়া দিল।

 এদিকে যাহারা প্রহরী-শালার আগুন নিভাইতেছিল, কারাগারের দিক হইতে সহসা তাহারা এক চীৎকার শুনিতে পাইল। সকলে চমকিয়া একবাক্যে বলিয়া উঠিল—“ও কি রে!” একজন ছুটিয়া আসিয়া কহিল—“ওরে, যুবরাজের ঘরে আগুন ধরিয়াছে!” প্রহরীদের রক্ত জল হইয়া গেল, দয়াল সিংহের মাথা ঘুরিয়া গেল। কলসী হাত হইতে পড়িয়া গেল, জিনিষ পত্র ভূমিতে ফেলিয়া দিল। এমন সময়ে আর এক জন, সেই দিক হইতে ছুটিয়া আসিয়া কহিল;—“কারাগৃহের মধ্য হইতে যুবরাজ চীৎকার করিতেছেন শুনা গেল!”—তাহার কথা শেষ না হইতে হইতেই সীতারাম ছুটিয়া আসিয়া কহিল—“ওরে তোরা শীঘ্র আয়! যুবরাজের ঘরের ছাদ ভাঙিয়া পড়িয়াছে, আর ত তাঁহার সাড়া পাওয়া যাইতেছে না।” যুবরাজের কারাগৃহের দিকে সকলে ছুটিল। গিয়া দেখিল গৃহ ভাঙিয়া পড়িয়াছে—চারিদিকে আগুন—ঘরে প্রবেশ করিবার উপায় নাই। তখন সেই খানে দাঁড়াইয়া পরস্পর পরস্পরের প্রতি দোষারোপ করিতে লাগিল। কাহার অসাবধানতায় এই ঘটনাটি ঘটিল, সকলেই তাহা স্থির করিতে প্রবৃত্ত হইল। ঘােরতর বিবাদ বাধিয়া উঠিল, পরস্পর পরস্পকে গালাগালি দিতে লাগিল, এমন কি, মারামারি হইবার উপক্রম হইল।

 সীতারাম ভাবিল, গৃহদাহে যুবরাজের মৃত্যু হইয়াছে, এই সংবাদ রাষ্ট্র করিয়া আপাতত কিছু দিন নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিব। যখন সে দেখিল, ঘরে বেশ করিয়া আগুন লাগিয়াছে, তখন সে মাথায় চাদর বাঁধিয়া আনন্দ মনে তাহার কুটীরাভিমুখে চলিল; প্রাসাদ হইতে অনেক দূরে আসিল। তখন রাত্রি অনেক, পথে লােক নাই, চারিদিকে স্তব্ধ-বাঁশগাছের পাতা ঝর্ ঝর্ করিয়া মাঝে মাঝে দক্ষিণা বাতাস বহিতেছে;— সীতারামের সৌখীন প্রাণ উল্লাসিত হইয়া উঠিয়াছে, সে একটি রস-গর্ভ গান ধরিয়াছে। সেই জনশূন্য স্তব্ধ পথ দিয়া একাকী পান্থ মনের উল্লাসে গান গাহিতে গাহিতে চলিল। কিছু দূর গিয়া তাহার মনের মধ্যে এক ভাবনা উপস্থিত হইল। সে ভাবিল, যশোহর হইতে ত সপরিবার পালাইতেই হইবে, অমনি বিনা মেহনতে কিঞ্চিৎ টাকার সংস্থান করিয়া লওয়া যাক্ না। মঙ্গলা পােড়ামুখী ত মরিয়াছে—বালাই গিয়াছে—একবার তাহার বাড়ি হইয়া যাওয়া যাক্— বেটির টাকা আছে ঢের—তাহার ত্রিসংসারে কেহই নাই—সে টাকা আমি না লই ত আর একজন লইবে,—তায় কাজ কি, একবার চেষ্টা করিয়া দেখা যাক্! এইরূপ সাত পাঁচ ভাবিয়া সীতারাম রুক্মিণীর বাড়ির মুখে চলিল—প্রফুল্ল মনে আবার গান ধরিল। যাইতে যাইতে পথে একজন অভিসারিণীকে দেখিতে পাইল। সীতারামের নজরে এ সকল কিছুই এড়াইতে পায় না। দুইটা রসিকতা করিবার জন্য তাহার মনে অনিবার্য আবেগ উপস্থিত হইল—কিন্তু সময় নাই দেখিয়া সে আবেগ দমন করিয়া হন্ হন্ করিয়া চলিল।

 সীতারাম রুক্মিণীর কুটীরের নিকটে গিয়া দেখিল, দ্বার খােলাই আছে। হৃষ্টচিত্তে কুটীরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া একবার চারিদিকে নিরীক্ষণ করিল। ঘােরতর অন্ধকার, কিছুই দেখা যাইতেছে না। এক বার চারিদিক হাতড়াইয়া দেখিল। একটা সিন্ধুকের উপর হুঁচট খাইয়া পড়িয়া গেল, দুই একবার দেয়ালে মাথা ঠুকিয়া গেল। সীতারামের গা ছম্‌ছম্‌ করিতে লাগিল। মনে হইল, কে যেন ঘরে আছে। কাহার যেন নিশ্বাস প্রশ্বাস শুনা যাইতেছে—আস্তে আস্তে পাশের ঘরে গেল। গিয়া দেখিল, রুক্মিণীর শয়নগৃহ হইতে আলো আসিতেছে। প্রদীপটা এখনাে জ্বলিতেছে মনে করিয়া সীতারামের অত্যন্ত আনন্দ হইল। তাড়া তাড়ি সেই ঘরের দিকে গেল। ও কে ও! ঘরে বসিয়া কে! বিনিদ্র নয়নে চুপ করিয়া বসিয়া কেও রমণী থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। অর্দ্ধাবৃত দেহে ভিজা কাপড় জড়ানো, এলােচুল দিয়া ফোঁটা ফোঁটা করিয়া জল পড়িতেছে। কাঁপিতে কাঁপিতে তাহার দাঁত ঠক্ ঠক্ করিতেছে। ঘরে একটি মাত্র প্রদীপ জ্বলিতেছে। সেই প্রদীপের ক্ষীণ আলাে তাহার পাংশু বর্ণ মুখের উপর পড়িতেছে—পশ্চাতে সেই রমণীর অতি বৃহৎ এক ছায়া দেয়ালের উপর পড়িয়াছে। ঘরে আর কিছুই নাই—কেবল সেই পাংশু মুখশ্রী—সেই দীর্ঘ ছায়া আর এক ভীষণ নিস্তব্ধতা! ঘরে প্রবেশ করিয়াই সীতারামের শরীর হিম হইয়া গেল। দেখিল ক্ষীণ আলােক, এলোচুল, ভিজা কাপড়ে সেই মঙ্গলা বসিয়া আছে। সহসা দেখিয়া, তাহাকে প্রেতনী বলিয়া মনে হইল। অগ্রসর হইতেও সীতারামের সাহস হইল না—ভরসা বাঁধিয়া পিছন ফিরিতেও পারিল না! সীতারাম নিতান্ত ভীরু ছিল না; অল্পক্ষণ স্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া অবশেষে একপ্রকার বাহ্যিক সাহস ও মৌখিক উপহাসের স্বরে কহিল—“তুই কোথা হইতে! মাগী, তাের মরণ নাই না কি!” রুক্মিণী কট্ মট্‌ করিয়া খানিকক্ষণ সীতারামের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল—তখন সীতারামের প্রাণটা তাহার কণ্ঠের কাছে আসিয়া ধুক্‌ধুক্‌ করিতে লাগিল। অবশেষে রুক্মিণী সহসা বলিয়া উঠিল, “বটে! তােদের এখনাে সর্ব্বনাশ হইল না; আর আমি মরিব!” উঠিয়া দাঁড়াইয়া হাত নাড়িয়া কহিল, “যমের দুয়ার হইতে ফিরিয়া আসিলাম! আগে, তােকে, আর যুবরাজকে চুলায় শুয়াইব, তোদের চুলা হইতে দু মুটা ছাই লইয়া গায়ে মাখিয়া দেহ সার্থক করিব—তার পরে যমের সাধ মিটাইব—তাহার আগে যমালয়ে আমার ঠাঁই নাই।”

 রুক্মিণীর গলা শুনিয়া সীতারামের অত্যন্ত সাহস হইল। সে সহসা অত্যন্ত অনুরাগ দেখাইয়া রুক্মিণীর সহিত ভাব করিয়া লইবার চেষ্টা। করিতে লাগিল। খুব যে কাছে ঘেঁসিয়া গেল, তাহা নহে, অপেক্ষাকৃত কাছে আসিয়া কোমল স্বরে কহিল,—“মাইরি ভাই, ঐ জন্যই ত রাগ ধরে! তােমার কখন্ যে কি মতি হয়, ভাল বুঝিতে পারি না! বল্‌ত মঙ্গলা, আমি তাের কি করেছি! অধীনের প্রতি এত অপ্রসন্ন কেন? মান করেছিস্ বুঝি ভাই? সেই গানটা গাব?”

 সীতারাম যতই অনুরাগের ভাণ করিতে লাগিল রুক্মিণী ততই ফুলিয়া উঠিতে লাগিল—তাহার আপাদমস্তক রাগে জ্বলিতে লাগিল—সীতারাম যদি তাহার নিজের মাথার চুল হইত, তবে তাহা দুই হাতে পট্‌পট্‌ করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিতে পারিত, সীতারাম যদি তাহার নিজের চোখ হইত, তবে তৎক্ষণাৎ তাহা নখ দিয়া উপাড়াইয়া পা দিয়া দলিয়া ফেলিতে পারিত। চারিদিকে চাহিয়া দেখিল, কিছুই হাতের কাছে পাইল না! দাঁতে দাঁতে লাগাইয়া কহিল,“একটু রোস; তােমার মুণ্ডপাত করিতেছি” বলিয়া থর্‌থর্‌ করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে বঁটির অন্বেষণে পাশের ঘরে চলিয়া গেল। এই কিছুক্ষণ হইল—সীতারাম গলায় চাদর বাঁধিয়া রূপক অলঙ্কারে মরিবার প্রস্তাব উত্থাপিত করিয়াছিল, কিন্তু রুক্মিণীর চেহারা দেখিয়া তাহার রূপক ঘুরিয়া গেল, এবং চৈতন্য হইল যে, সত্যকার বঁটির আঘাতে মরিতে এখনাে সে প্রস্তুত হইতে পারে নাই—এই নিমিত্ত অবসর বুঝিয়া তৎক্ষণাৎ কুটীরের বাহিরে সরিয়া পড়িল। রুক্মিণী বঁটি হস্তে শূন্য গৃহে আসিয়া ঘরের মেজেতে সীতারামের উদ্দেশে বারবার আঘাত করিল।

 রুক্মিণী এখন “মরিয়া” হইয়াছে। যুবরাজের আচরণে তাহার দুরাশা একবারে ভাঙিয়া গিয়াছে—তাহার সমস্ত উপায় সমস্ত উদ্দেশ্য একবারে ভূমিসাৎ হইয়াছে। এখন রুক্ষ্মিণীর আর সেই তীক্ষ্ণ-শাণিত হাস্য নাই, বিদ্যুদ্বর্ষী কটাক্ষ নাই, তাহার সেই ভাদ্র মাসের জাহ্নবীর ঢলঢল তরঙ্গ-উচ্ছ্বাস নাই—রাজবাটির যে সকল ভৃত্যেরা তাহার কাছে আসিত, তাহাদের সহিত ঝগড়া করিয়া, তাহাদিগকে গালাগালি দিয়া ভাগাইয়া দিয়াছে। দেওয়ানজির জ্যেষ্ঠ পুত্রটি সে দিন পান চিবাইতে চিবাইতে তাহার সহিত রসিকতা করিতে আসিয়াছিল, রুক্মিণী তাহাকে ঝাঁটাইয়া তাড়াইয়াছে। এখন আর কেহ তাহার কাছে ঘেঁসিতে পারে না। পাড়ার সকলেই তাহাকে ভয় করে।

 সীতারাম কুটীর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া ভাবিল—মঙ্গলা যুবরাজের পলায়ন বৃত্তান্ত সমস্তই অবগত হইয়াছে। অতএব ইহার দ্বারাই সব ফাঁস হইবে—সর্ব্বনাশীকে গলা টিপিয়া মারিয়া আসিলাম না কেন! যাহা হউক—আমার আর যশােহরে এক মুহূর্ত্ত থাকা শ্রেয় নয়। আমি এখনই পালাই। সেই রাত্রেই সীতারাম সপরিবারে যশােহর ছাড়িয়া রায়গড়ে পালাইল।

 শেষ রাত্রে মেঘ করিয়া মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হইল—আগুনও ক্রমে নিবিয়া গেল। যুবরাজের মৃত্যুর জনরব প্রতাপাদিত্যের কানে গেল। শুনিয়া তৎক্ষণাৎ প্রতাপাদিত্য বহির্দ্দেশে তাঁহার সভাভবনে আসিয়া বসিলেন। প্রহরীদের ডাকাইয়া আনিলেন, মন্ত্রী আসিল, আর দুই এক জন সভাসদ আসিল। একজন সাক্ষ্য দিল, যখন আগুন ধু ধু করিয়া জ্বলিতেছিল, তখন সে যুবরাজকে জানালার মধ্য হইতে দেখিয়াছে। আর কয়েক জন কহিল, তাহারা যুবরাজের চীৎকার শুনিতে পাইয়াছিল। আর একজন, যুবরাজের গৃহ হইতে তাঁহার গলিত দগ্ধ তলােয়ারের অবশিষ্টাংশ আনিয়া উপস্থিত করিল। প্রতাপাদিত্য-জিজ্ঞাসা করিলেন—“খুড়া কোথায়?” রাজবাটী অনুসন্ধান করিয়া তাঁহাকে খুঁজিয়া পাইল না। কেহ কহিল—“যখন আগুন লাগিয়াছিল, তখন তিনিও কারাগারে ছিলেন।” কেহ কহিল—“না, রাত্রেই তিনি সংবাদ পাইয়াছিলেন যে, গৃহদাহে যুবরাজের মৃত্যু হইয়াছে ও তাহা শুনিয়াই তিনি তৎক্ষণাৎ যশাের ত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছেন।” প্রতাপাদিত্য এইরূপে যখন সভায় বসিয়া সকলের সাক্ষ্য শুনিতেছেন, এমন সময়ে গৃহদ্বারে এক কলরব উঠিল। একজন স্ত্রীলােক ঘরে প্রবেশ করিতে চায়, কিন্তু প্রহরীরা তাহাকে নিষেধ করিতেছে। শুনিয়া প্রতাপাদিত্য তাহাকে ঘরে লইয়া আসিতে আদেশ করিলেন। একজন প্রহরী রুক্মিণীকে সঙ্গে করিয়া আনিল। রাজা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন—“তুমি কি চাও?” সে হাত নাড়িয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিল, “আমি আর কিছু চাই না—তােমার ঐ প্রহরীদিগকে, সকলকে একে একে ছয় মাস গারদে পচাইয়া ডালকুত্তা দিয়া খাওয়াও এই আমি দেখিতে চাই। ওরা কি তােমাকে মানে, না তােমাকে ভয় করে!” এই কথা শুনিয়া প্রহরীরা চারিদিক্ হইতে গােল করিয়া উঠিল। রুক্মিণী পিছন ফিরিয়া চোখ পাকাইয়া তীব্র এক ধমক দিয়া কহিল, “চুপ কর মিন্সেরা। কাল যখন তোদের হাতে পায় ধরিয়া, পই পই করিয়া বলিলাম—ওগো তােমাদের যুবরাজ তােমাদের রায়গড়ের বুড় রাজার সঙ্গে পালায়—তখন যে তােরা পােড়রমুখােরা আমার কথায় কান দিলে নে? রাজার বাড়ি চাক্‌রি কর, তােমাদের বড় অহঙ্কার হইয়াছে, তোমরা সাপের পাঁচ পা দেখিয়াছ! পিপড়ের পাখা উঠে মরিবার তরে!”

 প্রতাপাদিত্য কহিলেন, “যাহা যাহা ঘটিয়াছে সমস্ত বল।”

 রুক্মিণী কহিল, “বলিব আর কি! তােমাদের যুবরাজ কাল রাত্রে বুড় রাজার সঙ্গে পালাইয়াছে।”

 প্রতাপাদিত্য জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঘরে কে আগুন দিয়াছে জান?”

 রুক্মিণী কহিল—“আমি আর জানি না! সেই যে তােমাদের সীতারাম। তােমাদের যুবরাজের সঙ্গে যে তার বড় পীরিত—আর কেউ যেন তাঁর কেউ নয় সীতারামই যেন তাঁর সব। এ সমস্ত সেই সীতাৱামের কাজ। বুড়া রাজা, সীতারাম, আর তােমাদের যুবরাজ, এই তিন জনে মিলিয়া পরামর্শ করিয়া ইহা করিয়াছে—এই তোমাকে স্পষ্ট বলিলাম!”

 প্রতাপাদিত্য অনেকক্ষণ ধরিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিলেন! জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এসব কি করিয়া জানিতে পারিলে?” রুক্মিণী কহিল— “সে কথায় কাজ কি গা! আমার সঙ্গে লােক দাও, আমি স্বয়ং গিয়া তাহাদের খুঁজিয়া বাহির করিয়া দিব। তােমার রাজবাড়ির চাকররা সব ভেড়া—উহারা এ কাজ করিবে না।”

 প্রতাপাদিত্য রুক্মিণীর সহিত লােক দিতে আদেশ করিলেন ও প্রহরীদিগের প্রতি যথাবিহিত শাস্তির বিধান করিলেন। একে একে সভাগৃহ শূন্য হইয়া গেল। কেবল মন্ত্রী ও মহারাজ অবশিষ্ট রহিলেন। মন্ত্রী মনে করিলেন, মহারাজ অবশ্য তাঁহাকে কিছু বলিবেন। কিন্তু প্রতাপাদিত্য কিছুই বলিলেন না, স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিলেন। মন্ত্রী একবার কি বলিবার অভিপ্রায়ে অতি ধীরস্বরে কহিলেন “মহারাজ!” মহারাজ তাহার কোন উত্তর করিলেন না। মন্ত্রী ধীরে ধীরে উঠিয়া গেলেন।

 সেই দিনই সন্ধ্যার পূর্ব্বে প্রতাপাদিত্য একজন জেলের মুখে উদয়াদিত্যের পলায়ন সংবাদ পাইলেন। নৌকা করিয়া নদী বাহিয়া উদয়াদিত্য চলিয়াছিলেন সে তাঁহাকে দেখিয়াছিল। ক্রমে ক্রমে অন্যান্য নানা লােকের মুখ হইতে সংবাদ পাইতে লাগিলেন। রুক্মিণীর সহিত যে লোকেরা গিয়াছিল, তাহারা এক সপ্তাহ পরে ফিরিয়া আসিয়া কহিল—যুবরাজকে রায়গড়ে দেখিয়া আসিলাম। রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, “সেই স্ত্রীলােকটি কোথায়?” তাহারা কহিল, “সে আর ফিরিয়া আসিল না, সে সেইখানেই রহিল।”

 তখন প্রতাপাদিত্য মুক্তিয়ার খাঁ নামক তাঁহার এক পাঠান সেনাপতিকে ডাকিয়া তাহার প্রতি গোপনে কি একটা আদেশ করিলেন। সে সেলাম করিয়া চলিয়া গেল।