বৌ-ঠাকুরাণীর হাট/চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ।

 যখন রামমােহন চন্দ্রদ্বীপে ফিরিয়া গিয়া একাকী যোড়হস্তে অপরাধীর মত রাজার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল, তখন রামচন্দ্র রায়ের সর্ব্বাঙ্গ জ্বলিয়া উঠিল। তিনি স্থির করিয়াছিলেন,বিভা আসিলে পর তাহাকে প্রতাপাদিত্য ও তাহার বংশ সম্বন্ধে খুব দুচারিটা খরধার কথা শুনাইয়া তাঁহার শ্বশুরের উপর শােধ তুলিবেন। কি কি কথা বলিবেন, কেমন করিয়া বলিবেন, কখন্ বলিবেন, সমস্ত তিনি মনে মনে স্থির করিয়া রাখিয়াছিলেন। রামচন্দ্র রায় গোঁয়ার নহেন, বিভাকে যে কোন প্রকারে পীড়ন করিবেন, ইহা তাঁহার অভিপ্রায় ছিল না। কেবল বিভাকে তাহার পিতার সম্বন্ধে মাঝে মাঝে খুব লজ্জা দিবেন এই আনন্দেই তিনি অধীর ছিলেন। এমন কি, এই আনন্দের প্রভাবে তাঁহার মনেই হয় নাই যে, বিভার আসিবার পক্ষে কোন বাধা থাকিতে পারে। এমন সময়ে রামমােহনকে একাকী আসিতে দেখিয়া রামচন্দ্র রায় নিতান্ত বিস্মিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “কি হইল, রামমােহন?”

 রামমােহন কহিল, “সকলি নিষ্ফল হইয়াছে!”

 রাজা চমকিয়া উঠিয়া কহিলেন, “আনিতে পারলিনে?”

 রামমােহন—“আজ্ঞা, না মহারাজ! কুলগ্নে যাত্রা করিয়াছিলাম!”

 রাজা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “বেটা তােকে যাত্রা করিতে কে বলিয়াছিল? তখন তােকে বার বার করিয়া বারণ করিলাম, তখন যে তুই বুক ফুলাইয়া গেলি, আর আজ—”

 রামমােহন কপালে হাত দিয়া ম্লান মুখে কহিল, “মহারাজ, আমার অদৃষ্টের দোষ!”

 রামচন্দ্র রায় আরো ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, “রামচন্দ্র রায়ের অপমান! তুই বেটা আমার নাম করিয়া ভিক্ষা চাহিতে গেলি, আর প্রতাপাদিত্য দিল না। এত বড় অপমান আমাদের বংশে আর কখন হয় নাই।”

 তখন রামমােহন নতশির তুলিয়া ঈষৎ গর্ব্বিতভাবে কহিল, “ও কথা বলিবেন না। প্রতাপাদিত্য যদি না দিত, আমি কাড়িয়া আনিতাম। আপনার কাছে তাহা ত বলিয়াই গিয়াছিলাম। মহারাজ, যখন আপনার আদেশ পালন করিতে যাই, তখন কি আর প্রতাপাদিত্যকে ভয় করি? প্রতাপাদিত্য রাজা বটে, কিন্তু আমার রাজা ত সে নয়।”

 রাজা কহিলেন, “তবে হইল না কেন?”

 রামমােহন অনেক ক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, তাহার চোখে জল দেখা দিল।

 রাজা অধীর হইয়া কহিলেন, “রামমােহন, শীঘ্র বল্।”

 রামমােহন যােড় হাতে কহিল—“মহারাজ—”

 রাজা কহিলেন—“কি বল্।”

 রামমােহন—“মহারাজ, মা-ঠাকরুণ আসিতে চাহিলেন না।” বলিয়া রামমােহনের চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। বুঝি এ সন্তানের অভিমানের অশ্রু। বােধ করি এ অশ্রুজলের অর্থ—“মায়ের প্রতি আমার এত বিশ্বাস ছিল যে সেই বিশ্বাসের জোরে আমি বুক ফুলাইয়া, আনন্দ করিয়া মাকে আনিতে গেলাম, আর মা আসিলেন না; মা আমার সম্মান রাখিলেন না।” কি জানি কি মনে করিয়া বৃদ্ধ রামমােহন চোখের জল সামলাইতে পারিল না।

 রাজা কথাটা শুনিয়াই একেবারে দাঁড়াইয়া উঠিয়া চোখ পাকাইয়া বলিয়া উঠিলেন, “বটে—” অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাঁহার আর বাক্যস্ফূর্তি হইল না

 “আসিতে চাহিলেন না বটে! বেটা, তুই বেরো, বেরে আমার সুমুখ হইতে এখনি বেরো।”

 রামনােহন একটি কথা না কহিয়া বাহির হইয়া গেল! সে জানিত তাহারি সমস্ত দোষ, অতএব সমুচিত দণ্ড পাওয়া কিছু অন্যায় নহে।

 রাজা কি করিয়া যে ইহার শােধ তুলিবেন কিছুতেই ভাবিয়া পাইলেন না। প্রতাপাদিত্যের কিছু করিতে পারিবেন না, বিভাকেও হাতের কাছে পাইতেছেন না। রামচন্দ্র রায় অধীর হইয়া বেড়াইতে লাগিলেন।

 দিন দুয়েকের মধ্যে সংবাদটা নানা আকারে নানা দিকে রাষ্ট্র হইয়া পড়িল। এমন অবস্থা হইয়া দাঁড়াইল যে, প্রতিশােধ না লইলে আর মুখ রক্ষা হয় না। এমন কি, প্রজারা পর্য্যন্ত প্রতিশােধ লইবার জন্য ব্যস্ত হইল। তাহারা কহিল, “আমাদের মহারাজার অপমান!” অপমানটা যেন সকলের গায়ে লাগিয়াছে! একে ত প্রতিহিংসা-প্রবৃত্তি রামচন্দ্র রায়ের মনে স্বভাবতই বলবান্ আছে, তাহার উপরে তাঁহার মনে হইতে লাগিল, প্রতিহিংসা না লইলে প্রজারা কি মনে করিবে, ভৃত্যেরা কি মনে করিবে, রমাই ভাঁড় কি মনে করিবে? তিনি যখন কল্পনায় মনে করেন, এই কথা লইয়া মাই আর একজন ব্যক্তির কাছে হাসি টিটকারী করিতেছে, তখন তিনি অত্যন্ত অস্থির হইয়া পড়েন।

 একদিন সভায় মন্ত্রী প্রস্তাব করিলেন, “মহারাজ, আপনি আর একটি বিবাহ করুন!”

 রমাই ভাঁড় কহিল, “আর প্রতাপাদিত্যের মেয়ে তাহার ভাইকে লইয়া থাকুক!”

 রাজা রমাইয়ের দিকে চাহিয়া হাসিয়া কহিলেন, “ঠিক বলিয়াছ রমাই।”

 রাজাকে হাসিতে দেখিয়া সকল সভাসদই হাসিতে লাগিল। কেবল ফর্ণাণ্ডিজ বিরক্ত হইল, সে হাসিল না। রামচন্দ্র রায়ের মত লােকেরা সম্ভ্রম রক্ষার জন্য সততই ব্যস্ত, কিন্তু সম্ভ্রম কাহাকে বলে ও কি করিয়া সম্ভ্রম রাখিতে হয় সে জ্ঞান তাহাদের নাই!

 দেওয়ানজি কহিলেন, “মন্ত্রী মহাশয় ঠিক বলিয়াছেন। তাহা হইলে প্রতাপাদিত্যকে ও তাঁহার কন্যাকে বিলক্ষণ শিক্ষা দেওয়া হইবে।”

 রমাই ভাঁড় কহিল—“এ শুভকার্য্যে আপনার বর্ত্তমান শ্বশুর মহাশয়কে একখানা নিমন্ত্রণ পত্র পাঠাইতে ভুলিবেন না, নহিলে কি জানি তিনি মনে দুঃখ করিতে পারেন!” বলিয়া রমাই চোখ টিপিল। সভাস্থ সকলে হাসিতে লাগিল; যাহারা দূরে বসিয়াছিল, কথাটা শুনিতে পায় নাই, তাহারাও না হাসিয়া কিছুতেই থাকিতে পারিল না।

 রমাই কহিল, “বরণ করিবার নিমিত্তে এয়ােস্ত্রীদের মধ্যে যশােরে আপনার শ্বাশুড়ীঠাকুরুণকে ডাকিয়া পাঠাইবেন। আর মিষ্টান্নমিতরেজনাঃ, প্রতাপাদিত্যের মেয়েকে যখন একথাল মিষ্টান্ন পাঠাইবেন, তখন তাহার সঙ্গে দুটো কাঁচা রম্ভা পাঠাইয়া দিবেন।”

 রাজা হাসিয়া অস্থির হইলেন। সভাসদেরা মুখে চাদর দিয়া মুখ বাঁকাইয়া হাসিতে লাগিল। ফর্ণাণ্ডিজ অলক্ষিতভাবে উঠিয়া চলিয়া গেল।

 দেওয়ানজি একবার রসিকতা করিবার চেষ্টা করিলেন, কহিলেন, “মিষ্টান্নমিতরে জনাঃ, যদি ইতর লােকের ভাগ্যেই মিষ্টান্ন থাকে, তাহা হইলে ত যশােহরেই সমস্ত মিষ্টান্ন খরচ হইয়া যায়, চন্দ্রদ্বীপে আর মিষ্টান্ন খাইবার উপযুক্ত লােক থাকে না!”

 কথাটা শুনিয়া কাহারও হাসি পাইল না। রাজা চুপ করিয়া গুড়গুড়ি টানিতে লাগিলেন, সভাসদেরা গম্ভীর হইয়া রহিল, রমাই দেওয়ানের দিকে একবার অবাক হইয়া চাহিল, এমন কি, একজন অমাত্য বিষণ্ণভাবে জিজ্ঞাসা করিল—“সে কি কথা দেওয়ানজি মহাশয়? রাজার বিবাহে মিষ্টান্নের বন্দোবস্ত কি এত কম হইবে?” দেওয়ানজি মহাশয় মাথা চুলকাইতে লাগিলেন।

 বিবাহের কথা সমস্ত স্থির হইয়া গেল।