বৌ-ঠাকুরাণীর হাট/পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ।

 বসন্তরায় চলিয়া গেলেন। তখন সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে। বিভা প্রাসাদের ছাদের উপর গেল। ছাদের উপর হইতে দেখিল, পাল্কী চলিয়া গেল। বসন্তরায় পাল্কীর মধ্য হইতে মাথাটি বাহির করিয়া একবার মুখ ফিরাইয়া পশ্চাতে চাহিয়া দেখিলেন। সন্ধ্যার অন্ধকারের মধ্যে চোখের জলের মধ্য হইতে পরিবর্ত্তনহীন অবিচলিত, পাষাণহৃদয় রাজবাটীর দীর্ঘ কঠোর দেয়ালগুলা ঝাপ্সা ঝাপ্সা দেখিতে পাইলেন। পাল্কী চলিয়া গেল, কিন্তু বিভা সেইখানে দাঁড়াইয়া রহিল। পথের পানে চাহিয়া রহিল। তারাগুলি উঠিল, দীপ গুলি জ্বলিল, পথে লােক রহিল না। বিভা দাঁড়াইয়া চুপ করিয়া চাহিয়া রহিল। সুরমা তাহাকে সারাদেশ খুঁজিয়া, কোথাও না পাইয়া অবশেষে ছাদে গিয়া উপস্থিত হইল। বিভার গলা ধরিয়া স্নেহের স্বরে কহিল, “কি দেখিতেছিস্ বিভা?” বিভা নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, “কে জানে ভাই!” বিভা সমস্তই শূন্যময় দেখিতেছে, তাহার প্রাণে সুখ নাই। সে, কেন যে ঘরের মধ্যে যায়, কেন যে ঘর হইতে বাহির হইয়া আসে, কেন শুইয়া পড়ে, কেন উঠিয়া যায়, কেন দুই প্রহর মধ্যাহ্নে বাড়ির এ ঘরে ও ঘরে ঘুরিয়া বেড়ায়, তাহার কারণ খুঁজিয়া পায় না। রাজবাড়ি হইতে তাহার বাড়ি চলিয়া গেছে যেন, রাজবাড়িতে যেন তাহার ঘর নাই। অতি ছেলেবেলা হইতে নানা খেলাধূলা, নানা সুখ দুঃখ, হাসি কান্নায় মিলিয়া রাজবাটীর মধ্যে তাহার জন্য যে একটি সাধের ঘর বাঁধিয়া দিয়াছিল, সে ঘরটি একদিনে কে ভাঙিয়া দিল রে! এঘর ত আর তাহার ঘর নয়! সে, এখন গৃহের মধ্যে গৃহহীন, তাহার দাদামহাশয় ছিল, গেল, তাহার ——চন্দ্রদ্বীপ হইতে বিভাকে লইতে কবে লােক আসিবে? হয়ত রামমােহন মাল রওনা হইয়াছে, এতক্ষণে তাহারা না জানি কোথায়! বিভার সুখের এখনো কিছু অবশিষ্ট আছে। তাহার অমন দাদা আছে, তাহার প্রাণের সুরমা আছে, কিন্তু তাহাদের সম্বন্ধেও যেন একটা কি বিপদ ছায়ার মত পশ্চাতে ফিরিতেছে। যে বাড়ির ভিটা ভেদ করিয়া একটা ঘন ঘাের গুপ্ত রহস্য অদৃশ্য ভাবে ধূমায়িত হইতেছে সে বাড়িকে কি আর ঘর বলিয়া মনে হয়?

 উদয়াদিত্য শুনিলেন কর্ম্মচ্যুত হইয়া সীতারামের দুর্দ্দশা হইয়াছে। একে তাহার এক পয়সার সম্বল নাই, তাহার উপর তাহার অনেক গুলি গলগ্রহ জুটিয়াছে। কারণ যখন সে রাজবাড়ি হইতে মােটা মাহিয়ানা পাইত, তখন তাহার পিসা, সহসা স্নেহের আধিক্য বশত কাজ কর্ম্ম সমস্ত ছাড়িয়া দিয়া তাহার স্নেহাস্পদের বিরহে কাতর হইয়া পড়িয়াছিল; মিলনের সুব্যবস্থা করিয়া লইয়া আনন্দে গদগদ হইয়া কহিল যে, সীতারামকে দেখিয়াই তাহার ক্ষুধা তৃষ্ণা সমস্ত দূর হইয়াছে। ক্ষুধা তৃষ্ণা দূর হওয়ার বিষয়ে অনেক প্রমাণ আছে, কিন্তু কেবল সীতারামকে দেখিয়াই হইত কি না, সে বিষয়ে কোন প্রমাণ নাই। সীতারামের এক দূর সম্পর্কের বিধবা ভগিনী তাহার এক পুত্রকে কাজ কর্ম্মে পাঠাইবার উদ্যোগ করিতেছিল, এমন সময়ে সহসা তাহার চৈতন্য হইল যে, বাছাকে ছােট কাজে নিযুক্ত করিলে বাছার মামাকে অপমান করা হয়, এই বুঝিয়া সে বাছার মামার মান রক্ষা করিবার জন্য কোনমতে সে কাজ করিতে পারিল না। এইরূপে সে মান রক্ষা করিয়া সীতারামকে ঋণী করিল ও তাহার বিনিময়ে আপনার প্রাণরক্ষার বন্দোবস্ত করিয়া লইল। ইহার উপর সীতারামের বিধবা মাতা আছে ও এক অবিবাহিতা বালিকা কন্যা আছে। এদিকে আবার সীতারাম লোকটি অতিশয় সৌখিন, আমোদ প্রমোদটি নহিলে তাহার চলে না। সীতারামের অবস্থার পরিবর্ত্তন হইয়াছে, অথচ তাহার সঙ্গে সঙ্গে আনুষঙ্গিক পরিবর্ত্তন কিছুই হয় নাই। তাহার পিসার ক্ষুধাতৃষ্ণা ঠিক সমান রহিয়াছে; তাহার ভাগিনেয়টির যতই বয়স বাড়িতেছে, ততই তাহার উদরের প্রসর ও মামার মান অপমানের প্রতি দৃষ্টি অধিক করিয়া বাড়িতেছে। সীতারামের টাকার থলি ব্যতীত আর কাহারো উদর কমিবার কোন লক্ষণ প্রকাশ করিতেছে না। সীতারামের অন্যান্য গলগ্রহের সঙ্গে সখটিও বজায় আছে, সেটি ধারের উপর বর্দ্ধিত হইতেছে, সুদও যে পরিমাণে পুষ্ট হইতেছে, সেও সেই পরিমাণে পুষ্ট হইয়া উঠিতেছে। উদয়াদিত্য সীতারামের দারিদ্র্যদশা শুনিয়া তাহার ও ভাগবতের মাসিক বৃত্তি নির্ধারণ করিয়া দিলেন। সীতারাম টাকাটা পাইয়া অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া পড়িল। মহারাজার নিকট উদয়াদিত্যের নাম করিয়া অবধি সে নিজের কাছে ও উদয়াদিত্যের কাছে নিতান্ত অপরাধী হইয়া আছে। উদয়াদিত্যের টাকা পাইয়া সে কাঁদিয়া ফেলিল। এক দিন যুবরাজের সাক্ষাৎ পাইয়া তাহার পা জড়াইয়া ধরিয়া তাঁহাকে ভগবান্, জগদীশ্বর, দয়াময় সম্বোধন করিয়া বিস্তর ক্ষমা চাহিল। ভাগবত লোকটা অত্যন্ত ঠাণ্ডা প্রকৃতির! সে সতরঞ্চ খেলে, তামাক খায় ও প্রতিবেশীদিগকে স্বর্গ নরকের জমী বিলি করিয়া দেয়। সে যখন উদয়াদিত্যের টাকা পাইল, তখন মুখ বেঁকাইয়া নানা ভাব ভঙ্গীতে জানাইল যে, যুবরাজ তাহার যে সর্ব্বনাশ করিয়াছেন, এ টাকাতে তাহার কি প্রতিশোেধ হইবে! টাকাটা লইতে সে কিছুমাত্র আপত্তি করিল না।

 যুবরাজ কর্ম্মচ্যুত প্রহরীদ্বয়কে মাসিক বৃত্তি দিতেছেন, একথা প্রতাপাদিত্যের কানে গেল। আগে হইলে যাইত না। আগে তিনি উদয়াদিত্যকে এত অবহেলা করিতেন যে উদয়াদিত্য সম্বন্ধে সকল কথা তাঁহার কানে যাইত না। মহারাজ জানিতেন যে, উদয়াদিত্য প্রজাদের সহিত মিশিতেন, এবং অনেক সময়ে প্রজাদের পক্ষ অবলম্বন করিয়া তাঁহার বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছেন, কিন্তু সেগুলি প্রায় এমন সামান্য ও এমন অল্পে অল্পে তাহা তাঁহার সহিয়া আসিয়াছিল যে, বিশেষ একটা কিছু না হইলে উদয়াদিত্যের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তাঁহার মনোযােগ আকর্ষণ করিতে পারিত না। এইবার উদয়াদিত্যের প্রতি তাঁহার একটু বিশেষ মনােযােগ পড়িয়াছে, তাই উপরি-উক্ত ঘটনাটি অবিলম্বে তাঁহার কানে গেল। শুনিয়া প্রতাপাদিত্য অত্যন্ত রুষ্ট হইলেন। উদয়াদিত্যকে ডাকাইয়া আনিলেন, ও কহিলেন, “আমি যে সীতারামকে ও ভাগবতকে কর্ম্মচ্যুত করিলাম, সে কি কেবল রাজকোষে তাহাদের বেতন দিবার উপযুক্ত অর্থ ছিল না বলিয়া? তবে যে তুমি নিজের হইতে তাহাদের মাসিক বৃত্তি নির্ধারণ করিয়া দিয়াছ?”

 উদয়াদিত্য ধীরে ধীরে কহিলেন, “আমি দোষী। আপনি তাহাদের দণ্ড দিয়া আমাকে দণ্ডিত করিয়াছেন। আমি আপনার সেই বিচার অনুসারে মাসে মাসে তাহাদের নিকট দণ্ড দিয়া থাকি।”

 ইতিপূর্ব্বে কখনই প্রতাপাদিত্যকে উদয়াদিত্যের কথা মনোেযােগ দিয়া শুনিতে হয় নাই। উদয়াদিত্যের ধীর গম্ভীর বিনীত স্বর ও তাঁহার সুসংযত কথাগুলি প্রতাপাদিত্যের নিতান্ত মন্দ লাগিল না। উদয়াদিত্যের কথার কোন উত্তর না দিয়া প্রতাপাদিত্য কহিলেন, “আমি আদেশ করিতেছি, উদয়, ভবিষ্যতে তাহাদের যেন আর অর্থ সাহায্য না করা হয়।”

 উদয়াদিত্য কহিলেন, “আমার প্রতি আরাে গুরুতর শাস্তির আদেশ হইল।” কিন্তু হাত যােড় করিয়া কহিলেন, “কিন্তু এমন কি অপরাধ করিয়াছি, যাহাতে এত বড় শাস্তি আমাকে বহন করিতে হইবে? আমি কি করিয়া দেখিব, আমার জন্য আট নয়টি ক্ষুধিত মুখে অন্ন জুটিতেছে না, আট নয়টি হতভাগা নিরাশ্রয় হইয়া পথে পথে কাঁদিয়া বেড়াইতেছে; অথচ আমার পাতে অন্নের অভাব নাই? পিতা, আমার যাহা কিছু সব আপনারই প্রসাদে। আপনি আমার পাতে আবশ্যকের অধিক অন্ন দিতেছেন, কিন্তু আপনি যদি আমার আহারের সময় আমার সম্মুখে আট নয়টি ক্ষুধিত কাতরকে বসাইয়া রাখেন, অথচ তাহাদের মুখে অন্ন তুলিয়া দিতে বাধা দেন, তবে সে অন্ন যে আমার বিষ!”

 উত্তেজিত উদয়াদিত্যকে প্রতাপাদিত্য কথা কহিবার সময় কিছুমাত্র বাধা দিলেন না, সমস্ত কথা শেষ হইলে পর আস্তে আস্তে কহিলেন, “তােমার যা বক্তব্য তাহা শুনিলাম, এক্ষণে আমার যা বক্তব্য তাহা বলি। ভাগবত ও সীতারামের বৃত্তি আমি বন্ধ করিয়া দিয়াছি, আর কেহ যদি তাহাদের বৃত্তি নির্দ্ধারণ করিয়া দেয়, তবে সে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধাচারী বলিয়া গণ্য হইবে।” প্রতাপাদিত্যের মনে মনে বিশেষ একটু রােষের উদয় হইয়াছিল। সম্ভবতঃ তিনি নিজেও তাহার কারণ বুঝিতে পারেন নাই, কিন্তু তাহার কারণ এই “আমি যেন ভারি একটা নিষ্ঠুরতা করিয়াছি, তাই দয়ার শরীর উদয়াদিত্য তাহার প্রতিবিধান করিতে আসিলেন। দেখি তিনি দয়া করিয়া কি করিতে পারেন! আমি যেখানে নিষ্ঠুর, সেখানে আর যে কেহ দয়ালু হইবে, এত বড় আস্পর্ধা কাহার প্রাণে সয়!”

 উদয়াদিত্য সুরমার কাছে গিয়া সমস্ত কহিলেন। সুরমা কহিল, “সে দিন সমস্ত দিন কিছু খাইতে পায় নাই, সন্ধ্যাবেলায় সীতারামের মা, সীতারামের ছােট মেয়েটিকে লইয়া আমার কাছে আসিয়া কাঁদিয়া পড়িল। আমি সেই সন্ধ্যাবেলায় কিছু দিই, তবে তাহারা সমস্ত পরিবার খাইতে পায়। সীতারামের মেয়েটি দুধের মেয়ে, সমস্ত দিন কিছু খায় নাই, তাহার মুখপানে কি তাকান যায়। ইহাদের কিছু কিছু না দিলে ইহারা যাইবে কোথায়?”

 উদয়াদিত্য কহিলেন, “বিশেষত, রাজবাটী হইতে যখন তাহারা তাড়িত হইয়াছে, তখন পিতার ভয়ে অন্য কেহ তাহাদের কর্ম্ম দিতে বা সাহায্য করিতে সাহস করিবে না, এ সময়ে আমরাও যদি বিমুখ হই, তাহা হইলে তাহাদের আর সংসারে কেহই থাকিবে না। সাহায্য আমি করিবই, তাহার জন্য ভাবিও না সুরমা, কিন্তু অনর্থক পিতাকে অসন্তুষ্ট করা ভাল হয় না, যাহাতে এ কাজটা গােপনে সমাধা করা যায়, তাহার উপায় করিতে হইবে।”

 সুরমা উদয়াদিত্যের হাত ধরিয়া কহিল,“তােমাকে আর কিছু করিতে হইবে না, আমি সমস্ত করিব, আমার উপরে ভার দাও।” সুরমা নিজেকে দিয়া উদয়াদিত্যকে ঢাকিয়া রাখিতে চায়। এই বৎসরটা উদয়াদিত্যের দুর্ব্বৎসর পড়িয়াছে। অদৃষ্ট তাঁহাকে যে কাজেই প্রবৃত্ত করাইতেছে, সবগুলিই তাঁহার পিতার বিরুদ্ধে; অথচ সে গুলি এমন কাজ যে, সুরমার মত স্ত্রী প্রাণ ধরিয়া স্বামীকে সে কাজ হইতে নিবৃত্ত করিতে পারে না। সুরমা তেমন স্ত্রী নহে; স্বামী যখন ধর্ম্মযুদ্ধে যান, তখন সুরমা নিজের হাতে তাঁহার বর্ম্ম বাঁধিয়া দেয়, তাহার পর ঘরে গিয়া সে কাঁদে। সুরমার প্রাণ প্রতিপদে ভয়ে আকুল হইয়াছে, অথচ উদয়াদিত্যকে সে প্রতিপদে ভরসা দিয়াছে। উদয়াদিত্য ঘাের বিপদের সময় সুরমার মুখের দিকে চাহিয়াছেন, দেখিয়াছেন, সুরমার চোখে জল, কিন্তু সুরমার হাত কাঁপে নাই, সুরমার পদক্ষেপ অটল।

 সুরমা তাঁহার এক বিশ্বস্তা দাসীর হাত দিয়া, সীতারামের মায়ের কাছে ও ভাগবতের স্ত্রীর কাছে বৃত্তি পাঠাইবার বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন। দাসী বিশ্বস্তা বটে, কিন্তু মঙ্গলার কাছে একথা গােপন রাখিবার সে কোন আবশ্যক বিবেচনা করে নাই। এই নিমিত্ত মঙ্গলা ব্যতীত বাহিরের আর কেহ অবগত ছিল না।