ব্যঙ্গকৌতুক/নূতন অবতার

উইকিসংকলন থেকে

নূতন অবতার

প্রথম অঙ্ক

নন্দকৃষ্ণ মুখােপাধ্যায়

 (স্বগত) তুমি রুদ্দুর বক্‌শি ব্রাহ্মণের ব্রহ্মোত্তর পুষ্করিণীটি কেড়ে নিয়ে খিড়কির পুকুর ক’রেচো! আচ্ছা দেখা যাবে তুমি ভােগ করো কেমন ক’রে! ঐ পুকুরে দু-বেলা ছত্রিশ জাতকে স্নান করাবো। তবে আমি ব্রাহ্মণের ছেলে! (সমাগত প্রতিবেশিবর্গের প্রতি) তা, তােমরা তো সব শুনেচো দেখ্‌চি! সে স্বপ্নের কথা মনে হ’লে এখনো গা শিউরে উঠে। ভাই, উপ্‌রি উপ্‌রি তিন রাত্তির স্বপ্ন দেখ্‌লুম— মা গঙ্গা মকরের উপর চ’ড়ে আমার শিয়রের কাছে এসে বল্লেন, ওরে বেটা নন্দ, তাের কুবুদ্ধি ধ’রেছিলো তাই তুই রুদ্দুর বক্‌শির সঙ্গে পুষ্করিণী নিয়ে মামলা ক’র্‌তে গিয়েছিলি! রুদ্দুর বক্‌শি কে তা জানিস্? সত্য যুগে যে ছিল ভগীরথ সেই আজ বক্‌শির ঘরে আবির্ভাব ক’রেচে। হুগ্‌লি পুলের উপর দিয়ে যেদিন থেকে গাড়ি চ’লেচে সেই দিন থেকে আমিও তােদের ঐ পুষ্করিণীতে এসে অধিষ্ঠান ক’রেচি।—তখন আমার মনে হ’লো, ওরে বাপ রে! কী কাণ্ডই ক’রেচি। যিনি স্বয়ং কলিযুগের ভগীরথ তাঁরই সঙ্গে কি না গঙ্গার দখল নিয়ে আদালতে মকদ্দমা! এমন পাপও করে! এখন বুঝ্‌তে পারচি মকদ্দমায় কেন হার হ’লো এবং তােমরা পাড়ার সকলেই বা আদালতে হলফ্‌ নিয়ে কেন পরিষ্কার মিথ্যে সাক্ষী দিয়ে এলে! এ সমস্তই দেবতার কাণ্ড! তােমাদের মুখ দিয়ে অনর্গল মিথ্যে কথা একেবারে যেন গােমুখী থেকে গঙ্গাস্রোতের মতাে বেরােতে লাগ্‌লো—আমি নিতান্ত মূঢ়মতি পাপিষ্ঠ ব’লে প্রকৃত তত্ত্ব তখনো বুঝ্‌তে পারলুম না— মায়াতে অন্ধ হ’য়ে রইলুম এবং টাকাগুলাে কেবল উকিলে লুটে খেলে! (অশ্রুবিসর্জ্জন। এবং ভক্তিবিহ্বল নরনারীগণের হরিধ্বনি সহকারে কলিযুগের ভগীরথ দর্শনে গমন।)

দ্বিতীয় অঙ্ক

রুদ্রনারায়ণ বক্‌শি।

 (স্বগত) তাই বটে!—ছেলেবেলা থেকে বরাবর অকারণে কেমন আমার একটা ধারণা ছিল, যে, আমি বড়ো কম লােক নই। এতাে দিনে তা’র কারণটা বােঝা যাচ্চে। আর এ-ও দেখেচি ব্রাহ্মণের ঐ পুষ্করিণীটির প্রতি আমার অনেক দিন থেকে লােভ প’ড়েছিলাে—থেকে থেকে আমার কেবলই মনে হ’তো ও পুকুরটা কোনােমতে ঘিরে না নিতে পার্‌লে মেয়ে-ছেলেদের ভারি অসুবিধে হ’চ্চে! একেবারে সাফ মনেই ছিল না, যে, আমি ভগীরথ, আর মা গঙ্গা এখনো আমাকে ভুল্‌তে পারেন নি। উঃ, সে জন্মে যে তপিস্যেটা ক’রেছিলুম এ জন্মেকার মিথ্যে মকদ্দমাগুলাে তা’র কাছে লাগে কোথায়!

 (ভক্তমণ্ডলীর প্রতি ঈষৎ সহাস্যে) তা কি আর আমি জান্‌তেম না? কিন্তু তােমাদের কাছে কিছু ফাঁস করি নি—কী জানি পাছে বিশ্বাস না কর। কলিকালে দেবতা ব্রাহ্মণের প্রতি তাে কারো ভক্তি নেই। তা ভয় নেই, আমি তােমাদের সব অপরাধ মাপ ক’র লুম!—কে গো তুমি? পায়ের ধূলো? তা এই নাও! (পদ প্রসারণ) তুমি কী চাওগা? পদোদক? এসো, এসো! নিয়ে এসো তােমার বাটি—এই নাও—খেয়ে ফেলো! ভােরবেলা থেকে পদোদক দিতে দিতে আমার সর্দ্দি হ’য়ে মাথা ভার হ’য়ে এলো।—বাছা, তােমরা সব এসাে, কিছু ভয় নেই! এতোদিন আমাকে চিন তে পার নি সে তাে আর তােমাদের দোষ নয়। আমি মনে ক’রেছিলুম কথাটা তােমাদের কাছে প্রকাশ ক’র বো না; যেমন চ’ল চে এম নিই চল বে—তােমরা আমাকে তােমাদের মাধব ব শির ছেলে রুদ্দুর বক্‌শি বলেই জান বে! (ঈষৎ হাস্য) কিন্তু মা গঙ্গা যখন স্বয়ং ফাঁস ক’রে দিলেন তখন আর নুকোতে পার লুম না। কথাটা সর্ব্বত্রই রাষ্ট্র হয়ে গেচে! ও আর কিছুতে ঢাকা রইলাে না। এই দেখো না হিন্দুপ্রকাশে কী লিখেচে। ওরে তিনকড়ে, চট ক’রে সেই কাগজখানা নিয়ে আয় তো! এই দেখাে—“কলিযুগের ভগীরথ এবং ফজুগঞ্জের ভাগীরথী”—লােকটার রচনাশক্তি দিব্য আছে। আর সেই পর্শু দিনকার বঙ্গতােষিণীখানা আন্ দেখি, তা’তেও বড়াে বড়ো দুখানা চিঠি বেরিয়েচে। কী! খুজে পাচ্চিস্ নে? হারিয়েচিস্ বুঝি? হারায় যদি তাে তাের দুখানা হাড় আস্ত রাখ্‌বো না, তা জানিস্! সেদিন যে তাের হাতে দিয়ে ব’লে দিলুম আল্‌মারীর ভিতর তুলে রেখে দিস্! পাজি বেটা, নচ্ছার বেটা! হারামজাদা বেটা! কোথায় আমার কাগজ হারালি বের ক’রে দে! দে বের ক’রে! যেখান থেকে পাস্ নিয়ে আয় নইলে তােকে পুঁতে ফেল্‌বো বেটা!-ওঃ, তাই বটে, আমার ক্যাশবাক্সের ভিতরে তুলে রেখেছিলুম। ওহে হরিভূষণ, পড়ে শুনিয়ে দাও তাে, আমার আবার বাংলা পড়াটা ভালো অভ্যেস নেই।—কে গা? মতি গয়লানী বুঝি? তা এসো এসাে—আমি পায়ের ধূলো দিচ্চি—দুধের দা ম নিতে এসেচো?—এখনো শােনাে নি বুঝি? নন্দ মুখুয্যেকে মা গঙ্গা কী স্বপন দিয়েছেন সে সব খবর রাখো না! বেটি, তুই আমার পুকুরের জল দুধের সঙ্গে মিশিয়ে আমাকে বিক্রি ক’রেচিস্ —সে জলের মাহাত্ম্য জানিস্? কেমন? সবার কাছে কথাটা শুন্‌লি তো? এখন হিসেবটা রেখে পায়ের ধূলাে নিয়ে আমার খিড়কির ঘাটে চট ক’রে একটা ডুব দিয়ে আয়গে যা!—

 এই এখনি যাচ্চি। বেলা হয়েছে সে কি আর জানিনে? ঠাণ্ডা হ’য়ে গেল? তা কী ক’ব্ব বলাে? লােকজন সব অনেক দূর থেকে একটু পায়ের ধূলাের প্রত্যাশায় এসেছে, এরা কি সব নিরাশ হ’য়ে যাবে? আচ্ছ। উঠি। ওরে তিনকড়ে তুই এখানে হাজির থাকিস্— যারা আমাকে দেখতে আস্‌বে সব বসিয়ে রাখিস্ আমি এলুম ব’লে। খবরদার দেখিস্ যেন কেউ দর্শন না পেয়ে ফিরে না যায়! বলিস্ ভগীরথ ঠাকুরের ভােগ হ’চ্চে। বুঝলি? আমি দুটো ভাত মুখে দিয়েই এলুম ব’লে।

 রেধো, তুই যে একেবারে সীধে খাড়া হ’য়ে দাঁড়িয়ে রইলি? তাের কি মাথা নােয় না না কি? তাের তাে ভারি অহঙ্কার দেখচি! বেটা তাের ভক্তির লেশমাত্র নেই! পাজি বেটা তােকে জুতাে মেরে বিদায় ক’রে দেবো তা জানিস্! সবাই আমাকে ভক্তি ক’র্‌চে আর তুই বেটা এতাে বড়ো খৃষ্টান্ হ’য়েচিস্ যে, আমাকে দেখে প্রণাম করিস্ নে! তাের পরকালের ভয় নেই? বেরাে আমার বাড়ি থেকে!

 ছি বাবা উমেশ, তােমার এতো বয়স হ’লো, তবু কার সঙ্গে কী রকম ব্যবহার ক’র্‌তে হয় শিখ্‌লে না? যে ভগীরথ মর্ত্ত্যে গঙ্গা এনেছিলেন তাঁর গল্প মহাভারতে প’ড়েচো তো? ভুল ক’র্‌চো—ঐরাবত নয়, সে ভগীরথ। আমাকে সেই ভগীরথ ব’লে জেনো! বুঝেচো? মনে থাক্‌বে তো? ভগীরথ,—ঐরাবত নয়। সেই জায়গাটা মাষ্টারের কাছে প’ড়ে নিয়ো! এসো বাবা, তোমার মাথায় পায়ের ধূলাে দিয়ে দিই।

 কই! ভাত কই! আমি আর সবুর ক’র্‌তে পার্‌চিনে—দেশদেশান্তর থেকে সব লােক আস্‌চে! কী গাে গিন্নি, এতাে রাগ কিসের? হ’য়েচে কী? খিড়কির পুকুরে লােকজনের ভিড় হ’য়েচে? নাওয়া, কাপড় কাচা, বাসন মাজা, জলতােলা সমস্ত বন্ধ হ’য়েচে? কী ক’র্‌বাে বলো! আমি স্বয়ং ভগীরথ হ’য়ে গঙ্গা থেকে তাে কাউকে বঞ্চিত ক’র্‌তে পারিনে। তা হ’লে আমি এতো তপিস্যে ক’রে এতাে কষ্ট করে গঙ্গা আন্‌লুম কেন? তােমাদের ময়লা কাপড় কাচবার জন্যে—বটে! যখন ব্রাহ্মণের সঙ্গে মকদ্দমা ক’র্‌ছিলুম তখন তােমরা সেই আশায় ব’সেছিলে, আসল কথাটা কেবল আমি জানতুম আর মা গঙ্গাই জান্‌তেন! —কী! এতাে বড়ো আস্পর্দ্ধা—তুই বিশ্বাস করিস্‌নে! জানিস্‌, তােকে বিয়ে ক’রে তাের চোদ্দপুরুষকে আমি উদ্ধার ক’রেচি! বাপের বাড়ি যাবে! যাও না! মরবার সময় আমার এই গঙ্গায় আস্‌তে দেবো না! সেটা মনে রেখো? ভাত আর আছে তাে? নেই? আমি যে তােমাকে বেশি ক’রে রাঁধতে ব’লে দিয়েছিলুম! আমার প্রসাদ নিয়ে যাবে ব’লে যে দেশ বিদেশ থেকে লােক এসেচে! যা রেঁধেচো, এর একটা একটা ভাত খুঁটে দিলেও যে কুলবে না! রান্নাঘরে যতো ভাত আছে সব নিয়ে এসো—তােমরা সব চিঁড়ে আন্‌তে দাও— পুকুর থেকে গঙ্গাজল এনে ভিজিয়ে খেয়ো! কী ক’র্‌বাে বলো! দূর থেকে নাম শুনে প্রসাদ নিতে এসেচে তাদের ফেরাতে পার্‌বো না! কী ব’ল্লে? আমার হাতে পড়ে তােমার হাড় জ্বালাতন হ’য়ে গেল? কী ব’ল্‌বো তুমি মূর্খু মেয়েমানুষ; ঐ কথাটা একবার দেশের ভালো ভালো পণ্ডিতদের কাছে বলো দেখি! তা’রা তখনি মুখের উপর শুনিয়ে দেবে, ষাটহাজার সগরসন্তান জ্ব’লে ভস্ম হয়ে গিয়েছিলো, সেই ভস্মে যিনি প্রাণ দিয়েচেন, তিনি যে তােমার হাড় জ্বালাবেন একথা কোনো শাস্ত্রের সঙ্গেই মিল্‌চে না! তুমি গাল দাও, আমি আমার ভক্তদের কাছে চল্লুম! (বাহিরে আসিয়া) দেরি হ’য়ে গেল। বাড়ির মধ্যে এঁয়ারা সব আবার কিছুতেই ছাড়েন না, পায়ের ধূলাে নিয়ে পূজো ক’রে বেলা ক’রে দিলেন। আমি বলি, থাক্ থাক্ আর কাজ নেই—তা’রা কি ছাড়ে!—এসাে, তােমরা একে একে এসো—যার যার ধূলো নেবার আছে নিয়ে বাড়ি যাও!-কিহে বিপিন? আজ মকদ্দমার দিন? তা তো যেতে পার্‌চিনে। দর্শন ক’র্‌তে সব লােকজন আস্‌চে। একতরফা ডিক্রি হবে? কী ক’র্‌বাে বলো! আমি উপস্থিত না থাক্‌লে এখানেও যে একতরফা হয়। বিপ্‌নে-! তুই যাবার সময় প্রণাম ক’রে গেলিনে? এম্‌নি করেই অধঃপাতে যাবে! আয়, এইখানে গড় কর্, এই নে, ধূলাে নে! যা!

তৃতীয় অঙ্ক

 ওহে মুখুয্যে, মা গঙ্গা ঠিক আমার এই খিড়কির কাছটায় না এসে আর রসি দুয়েক তফাতে এলেই ভালাে ক’র্‌তেন। তুমি তাে দাদা স্বপ্ন দেখেই সার্‌লে, আমাকে যে দিনরাত্তির অসহ্য ভােগ ভুগ্‌তে হ’চ্ছে। এক তাে, পুকুরের জল দুধে বাতাসায় ডাবে আর পদ্মের পাতায় প’চে দুর্গন্ধ হয়ে উঠেচে―গাছগুলো ম’রে ম’রে উঠ্‌চে—যেদিন দক্ষিণের বাতাস দেয় সেদিন মনে হয় যেন নরককুণ্ডুর দক্ষিণের জান্‌লা দরজাগুলো সব কে খুলে দিয়েচে—সাতজন্মের পেটের ভাত উঠে আস্‌বার জো হয়। ছেলেগুলো যে কটা দিন ছিল কেবল ব্যামােয় ভুগেচে; কলিযুগের ভগীরথ হ’য়ে ডাক্তারের ফি দিতে দিতেই সর্ব্বস্বান্ত হ’তে হলাে—তা’রা সব যমদূত, ভক্তির ধার ধারে না, স্বয়ং মা গঙ্গাকে দেখতে এলে পূরােভিজিট আদায় ক’রে ছাড়ে। সে ও সহ্য হয়—কিন্তু খিড়কির ধারে ঐ যে দেশবিদেশের মড়া পুড়তে আরম্ভ হ’য়েচে ঐটেতে আমাকে কিছু কাবু ক’রেচে। অহর্নিশি চিতা জ্ব’ল্‌চে—কাছাকাছি যে সমস্ত বসতি ছিল সে সমস্তই উঠে গেচে—রাত্তিরে যখন হরিবােল হরিবােল শব্দ ওঠে এবং শেয়ালগুলো ডাক্‌তে থাকে তখন রক্ত শুকিয়ে যায়। স্ত্রী তাে বাপের বাড়ি চ’লে গেচেন। বাড়িতে চাকরদাসী টিঁক্‌তে পারে না। ভূতের ভয়ে দিনে দুপরে দাঁতকপাটি খেয়ে খেয়ে পড়ে। চারটি রেঁধে দেয় এমন লােক পাইনে। রাত্তিরে নিজের পায়ের শব্দ শুন্‌লে বুকের মধ্যে দুড়দুড় ক’র্‌তে থাকে—বাড়িতে জনমানব নেই—গঙ্গাযাত্রীর ঘর থেকে কেবল থেকে থেকে তারকব্রহ্ম নাম শুনি, আর গা ছম্‌ছম্ ক’র্‌তে থাকে! আবার হ’য়েছে কী—ছেড়েও যেতে পারি নে। আমার ভগীরথ নাম চতুর্দ্দিকেই রাষ্ট্র হ’য়ে গেচে—সকলেরই দর্শন ক’রতে ইচ্ছা হয়—সেদিন পশ্চিম থেকে দু-জন এসেছিলাে তাদের কথাই বুঝতে পারিনে। বেটারা ভক্তি ক’র্‌লে বটে কিন্তু আমার থালাবাটিগুলো চুরিও ক’রে গেচে! এখান থেকে উঠে গেলে হয় তো ঠিকানা না পেয়ে অনেকে ফিরে যেতে পারে। এদিকে আবার বিষয় কর্ম্ম দেখতে সময় পাচ্চিনে—আমার পত্তনী তালুকটার খাজানা বাকি প’ড়েচে; শুনেচি জমিদার অষ্টম ক’র্‌বে। শরীর ভয়ে অনিয়মে এবং ব্যামােয় রােজ শুকিয়ে যাচ্ছে। ডাক্তারে ভয় দেখাচ্চে এ জায়গা না ছাড়লে আমি আর বেশি দিন বাঁচবো না। কী করি বলাে তাে দাদা! রুদ্দুর বক্‌শি ছিলুম, সুখে ছিলুম, কোনো ল্যাঠাই ছিল না—ভগীরথ হ’য়ে কোনাে দিক সাম্‌লে উঠতে পার্‌চিনে—আমার সােনার পুরী একেবারে শ্মশান হ’য়ে গেচে। আবার কাগজগুলো আজকাল আমার সঙ্গে লেগেচে—তা’রা বলে সব মিথ্যে। তাদের নামে লাইবেল আন্‌বার জন্যে উকিলের পরামর্শ নিতে গিয়েছিলুম—উকিল ব’ল্লে, তুমিই যে ভগীরথ সেটা প্রমাণ ক’র্‌তে গেলে সত্য যুগ থেকে সাক্ষী তলব ক’র্‌তে হয়—স্বয়ং ব্যাসদেবের নামে শমন জারি ক’র্‌তে হয়। শুনে আমার ভরসা হ’লাে না। এখানকার লােকের মনেও ক্রমে সন্দেহ জন্মে গেচে;—মতি গয়লানীর সঙ্গে একরকম ঠিক হ’য়েছিলো আমি পদোদক দেবো আর সে দুধ দেবে—আজ দু-দিন থেকে সে মাগী আবার তা’র হিসেব নিয়ে এসে উপস্থিত হ’য়েচে। ভাবে গতিকে স্পষ্ট বুঝতে পারচি টাকার বদলে আমি তাকে পায়ের ধূলো দিতে গেলে সে-ও আমার উপরে পায়ের ধূলো ঝেড়ে যাবে, ভয়ে কিছু ব’ল্‌তে পার্‌চিনে। পুকুরটা তো গেচেই, আমার স্ত্রী পুত্র কন্যারাও ছেড়ে গেচে, চাকর দাসী ও পালিয়েছে, প্রতিবেশীরাও গ্রাম ছেড়ে নতুন বসতি করেচে,আমার ভগীরথ নামটাও টেঁকে কি না সন্দেহ, কেবল কি একা মা গঙ্গা আমাকে কিছুতেই ছাড়বেন না? মা গঙ্গাকে নিয়ে কি আমার সংসার চ’ল্‌বে? রাস্তায় বেরােলে আজকাল ছেলেগুলো ঠাট্টা ক’র্‌তে আরম্ভ ক’রেচে যে রুদ্দুর বক্‌শির গঙ্গাপ্রাপ্তি হ’য়েছে।— এই তো বিপদে পড়া গেচে! দাদা, আবার একবার তােমাকে স্বপন দেখ্‌তে হচ্চে! দোহাই তােমার, দোহাই মা গঙ্গার, হুগ্‌লির পুলের নীচে যদি তাঁর বাসের অসুবিধে হয়, দেশে বড়ো বড়ো ঝিল খাল দীঘি র’য়েচে, স্বচ্ছন্দে থাক্‌তে পার্‌বেন। আমার ঐ পুকুরের জল যে রকম হ’য়ে এসেচে আর দু-দিন বাদে তাঁর মকরটা তা’র শুঁড়সুদ্ধ ম’রে ভেসে উঠবে; আমার মতাে ভগীরথ ঢের মিল্‌বে কিন্তু ব্রাহ্মণ কায়স্থের ঘরে অমন বাহন আর পাবেন না। এই নতুন গঙ্গার ধারে তাঁর স্নেহের ভগীরথও যে বেশি দিন টিঁক্‌বে কোনাে ডাক্তারেই এমন আশা দেয় না। সত্যযুগের নামটার জন্যে মায়া হয় বটে, কিন্তু আমি বেশ ক’রে ভেবে দেখেচি,দাদা, এই কলিযুগের প্রাণটার মায়াও ছাড়্‌তে পারিনে! তাই স্থির করেচি পুষ্করিণীটি তােমাকেই ফিরিয়ে দেবো, কিন্তু গঙ্গা-মাতাকে এখান থেকে একটু দূরে বসৎ ক’র্‌তে হবে।