ব্যবহারকারী:Subrata Roy/শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত/আদিলীলা/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
- শ্রীচৈতন্য-প্রসাদেন
- তদ্রূপস্য বিনির্ণয়ম্।
- বালোহপি কুরুতে শাস্ত্রং
- দৃষ্ট্বা ব্রজবিলাসিনঃ।।১
অন্বয়ঃ।- বালোহপি (অত্যন্ত অজ্ঞ বালকেও) শাস্ত্রং দৃষ্ট্বা (শাস্ত্র দেখিয়া) শ্রীচৈতন্যপ্রসাদেন (শ্রীচৈতন্যদেবের অনুগ্রহে) ব্রজবিলাসিনঃ তদ্রূপস্য (ব্রজবিলাসী শ্রীকৃষ্ণরূপের বা শ্রীগৌরাঙ্গরূপের) বিনির্ণয়ং কুরুতে (বিশেষরূপে নির্ণয় করিতে পারে)।
অনুবাদ।- বালকেও শাস্ত্র দেখে শ্রীচৈতন্যের কৃপায় শ্রীকৃষ্ণস্বরূপ চৈতন্যের তত্ত্ব জানিতে পারে।।১।।
- জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় নিত্যানন্দ।
- জয়াদ্বৈতচন্দ্র জয় গৌরভক্তবৃন্দ।।
- চতুর্থ শ্লোকের অর্থ কৈল শুন দিয়া মন।।
- মূল শ্লোকের অর্থ করিতে প্রকাশ।
- অর্থ লাগাইতে আগে কহিয়ে আভাস (১)।।
- চতুর্থ শ্লোকের অর্থ এই কৈল সার।
- প্রেম নাম প্রচারিতে এই অবতার।।
- সত্য এই হেতু কিন্তু এহো বহিরঙ্গ।
- আর এক হেতু শুন আছে অন্তরঙ্গ।।
- পূর্ব্বে যেন পৃথিবীর ভার হরিবারে।
- কৃষ্ণ অবতীর্ণ হৈলা শাস্ত্রেতে প্রচারে।।
- স্বয়ং ভগবানের কর্ম্ম নহে ভার হরণ।
- স্থিতিকর্ত্তা বিষ্ণু করে জগৎ পালন।।
- কিন্তু কৃষ্ণের যেই হয় অবতার কাল।
- ভারহরণ কাল তাতে হইল মিশাল।।
- পূর্ণ ভগবান্ অবতরে যেই কালে।
- আর সব অবতার তাতে আসি মিলে।।
(১) আভাস - অভিপ্রায়। অর্থাৎ কি অভিপ্রায়ে শ্লোক বলা যাইতেছে তাহা।
- নারায়ণ (২) চতুর্ব্যূহ মৎস্যাদ্যবতার।
- যুগমন্বন্তরাবতার যত আছে আর।।
- সবে আসি কৃষ্ণ অঙ্গে হয় অবতীর্ণ।
- ঐছে অবতরে কৃষ্ণ ভগবান্ পূর্ণ।
- অতএব বিষ্ণু তখন কৃষ্ণের শরীরে।
- বিষ্ণুদ্বারে (৩) কৃষ্ণ করে অসুর সংহারে।।
- আনুষঙ্গ কর্ম্ম এই অসুর মারণ।
- যে লাগি অবতার কহি সে মূল কারণ।।
- প্রেমরস নির্য্যাস (৪) করিতে আস্বাদন।
- রাগমার্গ-ভক্তি (৫) লোকে করিতে প্রচারণ।।
- রসিক-শেখর কৃষ্ণ পরম করুণ।
- এই দুই হেতু হৈতে ইচ্ছার উদ্গম।।
- ঐশ্বর্য্য-জ্ঞানেতে সব জগৎ মিশ্রিত।
- ঐশ্বর্য্যশিথিল প্রেমে নাহি মোর প্রীত।।
- আমারে ঈশ্বর মানে আপনাকে হীন।
- তার প্রেমে বশ আমি না হই অধীন।।
- আমারে ত যে যে ভক্ত ভজে যেইভাবে।
- তারে সে সে ভাবে ভজি এ মোর স্বভাবে।।
(২) নারায়ণ - পরব্যোমনাথ। চতুর্ব্যুহ - বাসুদেব, সঙ্কর্ষণ, প্রদ্যুম্ন, অনিরুদ্ধ। মৎস্যাদ্যবতার - মৎস্য, কুর্ম্ম, বরাহ প্রভৃতি অবতার।
(৩) বিষ্ণুদ্বারে - স্বশরীর-লীন বিষ্ণুর দ্বারায়।
(৪) নির্য্যাস - সার।
(৫) অভিলষিত বস্তুতে যে স্বাভাবিকী আবেশ-পরাকাষ্ঠা, তাহার নাম রাগ।
- তথাহি - গীতায়াং (৪।১১)
- যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে
- তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।
- মম বর্ত্মানুবর্ত্তন্তে
- মনুষ্যাঃ পার্থ! সর্ব্বশঃ।।২
অন্বয়ঃ।- হে পার্থ (হে অর্জ্জুন) যে যথা (যাহারা যে প্রকারে) মাং প্রপদ্যন্তে (আমার ভজনা করে) অহং তথৈব (আমিও সেই প্রকারে) তান্ ভজামি (তাহাদিগকে অনুগ্রহ করিয়া থাকি)। মনুষ্যাঃ (মনুষ্যেরা) সর্ব্বশঃ (সর্ব্বপ্রকারে) মম বর্ত্ম (আমার ভজনমার্গের) অনুবর্ত্তন্তে (অনুসরণ করিয়া থাকি)।
অনুবাদ।- হে অর্জ্জুন! যে যেমন ভাবে আমাকে ভজনা করে আমি তাকে সেই ভাবেই অনুগ্রহ করি। সমস্ত ভাবেই মানুষে আমার ভজন-পথের অনুসরণ করে (মূলতঃ আমিই সব ভজন-পন্থার লক্ষ্য)।।২।।
- মোর পুত্র মোর সখা মোর প্রাণপতি।
- এই ভাবে যেই মোরে করে শুদ্ধ ভক্তি।।
- আপনারে বড় মানে - আমারে সম হীন।
- সর্ব্বভাবে আমি হই তাহার অধীন।।
- তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে (১০।৮২।৪৪)
- ময়ি ভক্তিহি ভূতানা-
- মমৃতত্বায় কল্পতে।
- দিষ্ট্যা যদাসীম্মৎস্নেহো
- ভবতীনাং মদাপনঃ।।৩
অন্বয়ঃ।- ময়ি ভূতানাং (আমাতে - শ্রীকৃষ্ণে প্রাণিগণের) ভক্তিঃ হি (ভক্তিই) অমৃতত্বায় কল্পতে (নিত্যপার্ষদত্ব বা অমৃতত্ব লাভের যোগ্যা হয়) ভবতীনাং মদাপনঃ (তোমাদের মৎপ্রাপক) মৎস্নেহঃ (আমার প্রতি যে স্নেহ জন্মিয়াছে) যৎ তৎ দিষ্ট্যা (তাহা সৌভাগ্যবশেই হইয়াছে)।
অনুবাদ।- ভগবদ্ভক্তি প্রাণীকে অমৃতত্ব দান করে। আমাকে আপন করে নিতে পারে যে স্নেহ সে স্নেহ তোমাদের আছে, এতো সৌভাগ্য।।৩।।
- মাতা মোরে পুত্রভাবে করেন বন্ধন।
- অতি হীনজ্ঞানে করে লালন পালন।।
- সখা শুদ্ধ সখ্যে করে স্কন্ধে আরোহণ।
- তুমি কোন্ বড় লোক তুমি আমি সম।।
- প্রিয়া যদি মান করি করয়ে ভৎর্সন।
- বেদস্তুতি হৈতে হরে সেই মোর মন।।
- এই শুদ্ধভক্ত লঞা করিব অবতার।
- করিব বিবিধবিধ অদ্ভুত বিহার।।
- বৈকুণ্ঠাদ্যে (১) নাহি যে-যে লীলার প্রচার।
- সে-সে লীলা করিব যাতে মোর চমৎকার।।
- মো বিষয়ে গোপীগণের উপপতিভাবে (২)।
- যোগমায়া করিবেক আপন প্রভাবে।।
- আমিহ না জানি তাহা - না জানে গোপীগণ।
- দোহার রূপ-গুণে দোঁহার নিত্য হরে মনে।।
- ধর্ম্ম ছাড়ি রাগে দোঁহে করায় মিলন।
- কভু মিলে, কভু না মিলে - দৈবের ঘটন।।
- এই সব রস নির্য্যাস করিব আস্বাদ।
- এই দ্বারে করিব সর্ব্ব ভক্তেরে প্রসাদ (৩)।।
- ব্রজের নির্ম্মল রাগ শুনি ভক্তগণ।
- রাগমার্গে ভজে যেন ছাড়ি ধর্ম্ম কর্ম্ম।।
(১) বৈকুণ্ঠাদ্যে - বৈকুণ্ঠে ও তদুপরি গোলোকে।
(২) উজ্জ্বলনীলমণি মতে - অনুরাগ হেতু ধর্ম্ম উল্লঙ্ঘন করিয়া যে পরকীয় রমণীতে আসক্ত হয় এবং সেই রমণীর প্রেমই যাহার সর্ব্বস্ব জ্ঞান হয় সেই উপপতি। [এইরূপ উপপতি এক ব্রজবনিতাগণের শ্রীকৃষ্ণ ভিন্ন আর কোথাও সম্ভবে না। গোপীগণ শ্রীকৃষ্ণকে পতিভাবে ভজন না করিয়া উপপতিভাবে ভজন করিলেন এই জন্য যে, পতিভাবে বিধির প্রাধান্য, কিন্তু উপপতিভাবে সর্ব্বতোভাবে অনুরাগেরই প্রাধান্য। জাগতিক হিসাবে উপপতিভাব অবৈধ, কারণ মানবের ঐরূপ ভাব 'আত্মেন্দ্রিয়-প্রীতি-ইচ্ছা'-জনিত অর্থাৎ কামসম্ভূত; কিন্তু গোপীগণের অনুরাগ 'কৃষ্ণেন্দ্রিয়-প্রীতি-ইচ্ছা'-জনিত, সুতরাং তাহা বিশুদ্ধ প্রেম। অতএব তাঁহাদের বিষয়ে জাগতিক বৈধত্বাবৈধত্বের প্রশ্ন উঠিতে পারে না। আবার এ জগতে দেখা যায় মানুষের মধ্যেও যাঁহারা অতিমানুষ তাঁহারা সব সময় মানব-সমাজের বিধিনিয়মের বশবর্ত্তী থাকেন না (যেমন মহাকবিগণ ও ঋষিগণ অনেক স্থলে ব্যাকরণের নিয়ম লঙ্ঘন করিয়া শব্দাদির প্রয়োগ করেন)। সুতরাং শ্রীভগবান্ যদি বিমল অপ্রাকৃত গোপী-প্রেমের আস্বাদন জন্য এবং তাহার মহিমা প্রকাশের জন্য প্রাকৃতজগতের বিধিনিষেধ উল্লঙ্ঘন করেন তাহাতে সাধারণ মানবের ন্যায় তাঁহাতে আদৌ দোষস্পর্শ হইতে পারে না]।
(৩) প্রসাদ - অনুগ্রহ।
- গঙ্গাজল তুলসী-মঞ্জরী অনুক্ষণ।
- কৃষ্ণ-পাদপদ্ম ভাবি করেন সমর্পণ।।
- তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে (১০।৩৩।৩৬)
- অনুগ্রহায় ভক্তানাং
- মানুষং দেহমাশ্রিতঃ।
- ভজতে তাদৃশীঃ ক্রীড়া
- যাঃ শ্রুত্বা তৎপরো ভবেৎ।।৪
অন্বয়ঃ।- [ভগবান্] ভক্তানাম অনুগ্রহায় মানুষং দেহম্ আশ্রিতঃ (মানুষ দেহ গ্রহণ করিয়া) তাদৃশীঃ ক্রীড়া ভজতে (ভক্তগণকে অনুগ্রহ করিবার জন্য সেই সেই ক্রীড়া করিয়া থাকেন) যাঃ শ্রুত্বা (যাহা শ্রবণ করিয়া) তৎপরঃ (তদ্বিষয়ে শ্রদ্ধাবান্) ভবেৎ (হইয়া থাকে)।
অনুবাদ।- ভক্তদের প্রতি অনুগ্রহ বশতঃই মানুষের দেব গ্রহণ করে তিনি এমন লীলা প্রকাশ করেছিলেন যেন তা শুনে লোকে ভগবৎপরায়ণ হয়।।৪।।
- ভবেৎ ক্রিয়া বিধিলিঙ্, সেই ইহা কয় -
- কর্ত্তব্য অবশ্য এই, অন্যথা প্রত্যবায়।। (১)
- এই বাঞ্ছা যৈছে কৃষ্ণের প্রাকট্য কারণ।
- অসুর সংহার আনুষঙ্গ প্রয়োজন।।
- এই মত চৈতন্যকৃষ্ণ পূর্ণ ভগবান্।
- যুগধর্ম্ম প্রবর্ত্তন নহে তাঁর কাম।।
- কোন কারণে যবে হৈল অবতারে মন।
- যুগধর্ম্ম-কাল হৈল সে কালে মিলন।।
- দুই হেতু (২) অবতরি লঞা ভক্তগণ।
- আপনে আস্বাদে প্রেম নাম সংকীর্ত্তন।।
- সেই দ্বারে আচণ্ডালে কীর্ত্তন সঞ্চারে।
- নাম-প্রেমমালা গাঁথি পরাইল সংসারে।।
(১) ব্যাকরণানুসারে 'অবশ্যকর্ত্তব্য' অর্থে বিধিলিঙের প্রয়োগ হয়। পূর্ব্বোক্ত 'অনুগ্রহায় ভক্তানাম্' ইত্যাদি শ্লোকে 'ভবেৎ' ক্রিয়াতেও এই অর্থেই বিধিলিঙ্ হইয়াছে অর্থাৎ 'ভবেৎ' ক্রিয়ার প্রয়োগ দ্বারা ইহাই সূচিত হইতেছে যে শ্রীকৃষ্ণের লীলা শ্রবণ দ্বারা তঃৎপ্রতি অনুরাগযুক্ত হইয়া অবশ্যকর্ত্তব্য, না করিলে প্রত্যবায় আছে।
(২) দুই হেতু - শ্রীরাধায় ভাবকান্তি গ্রহণপূর্ব্বক স্বমাধুর্য্য আস্বাদন ও নাম-প্রেম-প্রচারণ।
- এইমত ভক্তভাব করি অঙ্গীকার।
- আপনি আচরি ভক্তি করিল প্রচার।।
- দাস্য সখ্য বাৎসল্য আর যে শৃঙ্গার।
- চারি ভাবের চতুর্ব্বিধ (৩) ভক্তই আধার।।
- নিজ নিজ ভাব সবে শ্রেষ্ঠ করি মানে।
- নিজ ভাবে করে কৃষ্ণসুখ-আস্বাদনে।।
- তটস্থ (৪) হইয়া মনে বিচার যদি করি।
- সব রস হৈতে শৃঙ্গারে অধিক মাধুরী।।
- অতএব মধুর রস কহি তার নাম।
- স্বকীয়া (৫) পরকীয়া-ভাবে দ্বিবিধ সংস্থান।।
(৩) চতুর্ব্বিধ ভক্ত - দাসগণ, সখ্যগণ, মাতাপিতা ও প্রেয়সীগণ। আধার - আশ্রয়।
(৪) তটস্থ হইয়া - অর্থাৎ মগ্ন না হইয়া; কারণ যিনি যাহাতে মগ্ন হয়েন তাহাই তাঁহার নিকট ভাল বলিয়া মনে হয়; কোন্টি বেশী ভাল কোন্টি কম ভাল এই তারতম্যের বোধ তাঁহার থাকে না।
(৫) স্বকীয়া - যাঁহারা বিধি অনুসারে বিবাহিতা ও পতির আজ্ঞা প্রতিপালনে তৎপরা এবং পাতিব্রত্য হইতে অবিচলিতা, সেই নায়িকাদিগের নাম স্বকীয়া। যথা - শ্রীকৃষ্ণের রুক্মিণী, সত্যভামা প্রভৃতি।
- তথাহি - ভক্তিরসামৃতসিন্ধৌ দক্ষিণবিভাগে স্থায়িভাবলহর্য্যাং ২২শঃ শ্লোকঃ -
- যথোত্তরমসৌ স্বাদ-
- বিশেষোল্লাসময্যপি।
- রতির্ব্বাসনয়া স্বাদ্বী
- ভাসতে কাপি কস্যচিৎ।।৫
অন্বয়ঃ।- অসৌ রতিঃ (ঐ চতুর্ব্বিধা রতি) যথোত্তরং স্বাদবিশেষোল্লাসময়ী অপি (উত্তরোত্তরক্রমে স্বাদবিশেষে উল্লাসের আধিক্যযু্ক্ত হইলেও) বাসনয়া কা অপি কস্যচিৎ স্বাদ্বী ভাসতে (বাসনাভেদে কোনটি কাহারও নিকট স্বাদু বলিয়া প্রতীয়মান হয়)।
অনুবাদ।- দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর রতি উত্তরোত্তর স্বাদুতর হ'লেও ব্যক্তিবিশেষের বাসনা অনুসারে যে কোনটি তার কাছে সর্ব্বাপেক্ষা স্বাদু হয়ে ওঠে।।৫।।
- পরকীয়াভাবে (১) অতি রসের উল্লাস।
- ব্রজ বিনা ইহার অন্যত্র নাহি বাস।।
- ব্রজবধূগণের এই ভাব নিরবধি।
- তার মধ্যে শ্রীরাধায় ভাবে অবধি (২)।।
- প্রৌঢ় নির্ম্মল ভাব প্রেম সর্ব্বোত্তম (৩)।
- কৃষ্ণের মাধুরী আস্বাদনের কারণ।।
- অতএব সেই ভাব অঙ্গীকার করি।
- সাধিলেন নিজ বাঞ্ছা গৌরাঙ্গ শ্রীহরি।।
(১) পরকীয়া - যাঁহারা অনুরাগে আত্মা অর্পণ করিয়াছেন এবং ইহলোক ও পরলোকের অপেক্ষা করেন না, আর ধর্ম্ম অর্থাৎ বিবাহবিধি অনুসারে গৃহীতা নহেন, তাঁহারাই পরকীয়া; যথা - শ্রীকৃষ্ণের ব্রজদেবীগণ।
(২) অবধি - শেষ সীমা, চরম উৎকর্ষ।
(৩) শ্রীরাধিকার প্রৌঢ় (পরমোৎকর্ষপ্রাপ্ত) নির্ম্মল (ঐশ্বর্য-গন্ধহীন) ভাবই (পরকীয়া ভাবই) সর্ব্বোত্তম প্রেমের হেতু।
- তথাহি - স্তবমালায়াং শ্রীচৈতন্যদেবস্য ১ম স্তবে ২য়ঃ শ্লোকঃ
- সুরেশানাং দুর্গং গতিরতিশয়েনোপনিষদাং,
- মুনীনাং সর্ব্বস্বং প্রণতপটলীনাং মধুরিমা।
- বিনির্য্যাসঃপ্রেম্নো নিখিলপশুপালাম্বুজদৃশাং,
- স চৈতন্যঃ কিং মে
- পুনরপি দৃশোর্যাস্যতি পদম্।।৬
অন্বয়ঃ।- সুরেশানাং (ইন্দ্রাদি লোকপালগণের) দুর্গম্ (অভয়স্থান) উপনিষদাং (শ্রুতিশিরোভাগের) অতিশয়েন গতিঃ (একমাত্র লক্ষ্যস্থল) মুনীনাং সর্ব্বস্বং (মুনিগণের সর্ব্বস্ব) প্রণতপটলীনাং (ভক্তসমূহের) মধুরিমা (মাধুর্য্যনিকেতন) নিখিলপশুপালাম্বুজদৃশাং (সকল ব্রজবনিতাগণের) প্রেম্নঃ বিনির্য্যাসঃ (প্রেমের সার) স চৈতন্যঃ পুনঃ অপি কিং মে দৃশোঃ পদং যাস্যতি (সেই শ্রীচৈতন্যদেব কি পুনরায় আমার দৃষ্টিগোচর হইবেন)?
অনুবাদ।- শ্রীচৈতন্যদেব কি আবার আমার লোচনপথে আসবেন? তিনিই তো দেবতাদের অভয় আশ্রয়, উপনিষদের পরমা গতি, মুনিদের সর্ব্বস্ব, প্রণতজনের মধুরিমা ও গোপীপ্রেমের নির্য্যাস।।৬।।
- স্তবমালায়াং শ্রীচৈতন্যদেবস্য ২য় স্তবে তৃতীয়ঃ শ্লোকঃ
- অপারং কস্যাপি প্রণয়িজনবৃন্দস্য কুতুকী
- রসস্তোমং হৃত্বা মধুরমুপভোক্তুং কমপি যঃ।
- রুচিং স্বামাবব্রে দ্যুতিমিহ তদীয়াং প্রকটয়ন্
- স দেবশ্চৈতন্যাকৃতিরতিতরা নঃ কৃপয়তু।।৭
অন্বয়ঃ।- কুতুকী (কৌতুহলী) যঃ (যিনি) কস্য অপি প্রণয়িজনবৃন্দস্য (কোনও প্রণয়িজনসমূহের) কমপি (কোনও অনির্ব্বচনীয়) অপারং মধুরং (অপরিসীম মধুর) রসস্তোমং হৃত্বা উপভোক্তুং (রসসমূহকে হরণ করিয়া তাহা আস্বাদন করিবার জন্য) ইহ তদীয়াং দ্যুতিং প্রকটয়ন্ (জগ তদীয় কান্তি প্রকটন পূর্ব্বক) স্বাং রুচিম্ আবব্রে (স্বকীয় কান্তিকে আবৃত করিয়াছেন) স চৈতন্যাকৃতিঃ দেবঃ (সেই চৈতন্যাকৃতি দেব) নঃ অতিতরাং কৃপয়তু (আমাদিগকে অতিশয় কৃপা করুন)।
অনুবাদ।- ভগবান্ শ্রীচৈতন্য আমাদের অপার কৃপা করুন। কৌতুকী তিনি প্রণয়িনীদের অনির্ব্বচনীয় অপার মধুর প্রেমসম্ভার হরণ ক'রে উপভোগ করেছেন আপন শ্যামকান্তি তাদের স্বর্ণকান্তিতে আবৃত ক'রে।।৭।।
- ভাব-গ্রহণ হেতু কৈল ধর্ম্ম স্থাপন (৪)।
- মূল হেতু আগে শ্লোকে করি বিবরণ।।
- "ভাব-গ্রহণের এই শুনহ প্রকার।
- তা লাগি পঞ্চম শ্লোকের করিয়ে বিচার।।
- এইত পঞ্চম শ্লোকের কহিল আভাস।
- এবে করি সেই শ্লোকের অর্থ প্রকাশ"।।
(৪) ভাবগ্রহণের হেতু ও ধর্ম্মস্থাপন কহিল অর্থাৎ ভাবগ্রহণের হেতু কহিলাম, ধর্ম্মস্থাপনের কথাও কহিলাম। এইবার মূল শ্লোকের বিবরণ করি। কেন শ্রীরাধার ভাবই গ্রহণ করিলেন সেই মূল কারণ অগ্রবর্ত্তী শ্লোকে বিবৃত হইয়াছে।
- তথাহি - শ্রীস্বরূপগোস্বামী-কড়চায়াং শ্লোকঃ
- রাধাকৃষ্ণপ্রণয়বিকৃতিহর্লাদিনীশক্তিরস্মাদেকা-
- ত্মানাবপি ভুবি পুরা দেহভেদং গতৌ তৌ।
- চৈতন্যাখ্যং প্রকটমধুনা তদ্দুয়ঞ্চৈক্যমাপ্তং,
- রাধাভাবদ্যুতিসুবলিতং নৌমি কৃষ্ণস্বরূপম্।।৮
অন্বয় ও অনুবাদ প্রথম পরিচ্ছেদে ৫ম শ্লোকে দ্রষ্টব্য।
- রাধাকৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ ধরি।
- অন্যোন্যে বিলাসে রস আস্বাদন করি।।
- সেই দুই এক এবে চৈতন্য গোঁসাঞি।
- ভাব আস্বাদিতে দোঁহে হৈলা এক ঠাঁই।।
- ইতে লাগি আগে করি তাহার বিবরণ।
- যাহা হৈতে হয় গৌরের মহিমা কথন।।
- রাধিকা হয়েন কৃষ্ণের প্রণয় বিকার।
- স্বরূপশক্তি-হলাদিনী (১) নাম যাঁহার।।
- হলাদিনী করায় কৃষ্ণে আনন্দাস্বাদন।
- হলাদিনী-দ্বারায় করে ভক্তের পোষণ।।
- সচ্চিদানন্দ-পূর্ণ কৃষ্ণের স্বরূপ।
- একই চিচ্ছক্তি তাঁর ধরে তিন রূপ।।
- আনন্দাংশে হলাদিনী সদংশে সন্ধিনী (২)।
- চিদংশে সম্বিৎ (৩) যারে জ্ঞান করি মানি।।
(১) শক্তিমাত্রেই জড়, কিন্তু ভগবানের চিচ্ছক্তি সেরূপ নহে, উহা ভগবানের স্বরূপ। চিচ্ছক্তির নামান্তর স্বরূপ শক্তি। হলাদিনী - ভগবান্ স্বয়ং আহ্লাদস্বরপ হইয়াও যে শক্তিদ্বারা স্বয়ং আহ্লাদিত হয়েন এবং ভক্তদিগকে আহ্লাদিত করেন, তাহার নাম হলাদিনী।
(২) সন্ধিনী - ভগবান্ সত্তারূপ হইয়াও যে শক্তিদ্বারা স্বয়ং সত্তাধারণ করেন এবং পরকে ধারণ করান।
(৩) সম্বিৎ - ভগবান্ জ্ঞানরূপ হইয়াও যে শক্তিদ্বারা আপনি জানেন ও পরকে জানান।
- তথাহি - শ্রীবিষ্ণুপুরাণে ১ম অংশে ১২ অঃ ৬৯ শ্লোকঃ
- হলাদিনী সন্ধিনী সংবি-
- ত্ত্বয্যেকা সর্ব্বসংস্থিতৌ।
- হলাদতাপকরা মিশ্রা
- ত্বয়ি নো গুণবর্জ্জিতে।।৯
অন্বয়ঃ।- [শ্রীধ্রুব ভগবানকে বলিতেছেন-] একা হলাদিনী সন্ধিনী সংবিৎ (মুক্যা হলাদিনীশক্তি ও তৎপরে সন্ধিনী ও সংবিৎশক্তি) সর্ব্বসংস্থিতৌ (সকলের আশ্রয়ভূত) ত্বয়ি অস্তীতি শেষঃ (তোমাতে অবস্থান করিতেছেন) হলাদতাপকরী (আনন্দজনয়িত্রী সাত্ত্বিকী ও বিষয়বিয়োগাদিতে তাপকরি তামসী) [মিশ্রা শক্তিঃ] (এতদুভয়মিশ্রিতা রাজসী শক্তি) গুণবর্জ্জিতে ত্বয়ি নাস্তি (গুণবর্জ্জিত তোমাতে নাই)।
অনুবাদ।- সকলের আশ্রয়স্বরূপ তুমি - তোমার স্বরূপশক্তি হলাদিনী, সন্ধিনী ও সংবিৎ। গুণবর্জ্জিত তুমি - তোমাতে স্বখদুঃখমিশ্রিত কোনো গুণ থাকতে পারে না।।৯।।
- সন্ধিনীর সার অংশ শুদ্ধ সত্ত্ব নাম।
- ভগবানের সত্তা হয় যাহাতে বিশ্রাম।।
- মাতা পিতা স্থান গৃহ শয্যাসন আর।
- এ সব কৃষ্ণের শুদ্ধ সত্ত্বের বিকার।।
- তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে ৪।৩।২১ শ্লোকঃ
- সত্ত্বং বিশুদ্ধং বসুদেবশব্দিতং
- যদীয়তে তত্র পুমানপাবৃতঃ।
- সত্ত্বে চ তস্মিন্ ভগবান্ বাসুদেবো
- হ্যধোক্ষজো মে মনসা বিধীয়তে।।১০
অন্বয়ঃ।- [শ্রীশিব সতীদেবীকে বলিতেছেন] - বিশুদ্ধং সত্ত্বং (অন্তঃকরণ বা সত্ত্বগুণ) বসুদেবশব্দিতং (বসুদেব নামে কথিত হয়) যৎ তত্র অপাবৃতঃ পুমান্ (যেহেতু তাহাতে অনাবৃতভাবে সেই পুরুষ) ঈয়তে (প্রকাশ পাইয়া থাকেন)। তস্মিন্ সত্ত্বে ভগবান্ বাসুদেবঃ চ মে মনসা বিধীয়তে (সেই সেই সত্ত্বস্বরূপ বসুদেবে প্রকাশিত বাসুদেবই আমার মনের দ্বারা সেবিত হইয়া থাকেন) হি অধোক্ষজঃ (যেহেতু তিনি সমস্ত ইন্দ্রিয়জ্ঞানের অতীত)।
অনুবাদ।- বিশুদ্ধ সত্ত্বের নাম বসুদেব। এই বিশুদ্ধ সত্ত্বেই পরমপুরুষ প্রকাশিত হন। এই জন্যই তাঁর নাম বাসুদেব। ইন্দ্রিয়ের অগোচর তিনি। তাঁকে অন্তর দিয়েই জানতে হয়।।১০।।
- কৃষ্ণের ভগবত্তা জ্ঞান সংবিতের সার।
- ব্রহ্মজ্ঞানাদিক সব তার পরিবার।।
- হলাদিনীর সার প্রেম, প্রেম-সার ভাব।
- ভাবের পরমকাষ্ঠা (১) - নাম মহাভাব।।
- মহাভাবস্বরূপা শ্রীরাধা ঠাকুরাণী।
- সর্ব্বগুণ-খনি কৃষ্ণ-কান্তা-শিরোমণি।।
(১) "পরমকাষ্ঠা" - চরম সীমা।
- শ্রীমদুজ্জ্বলনীলমণৌ শ্রীমদ্বৃন্দাবনেশ্বরী-প্রকরণে ২য় অঙ্কেঃ-
- তয়োরপ্যুভয়োর্মধ্যে রাধিকা সর্ব্বথাধিকা।
- মহাভাবস্বরূপেয়ং গুণৈরতিবরীয়সী।।১১
অন্বয়ঃ।- তয়োঃ উভয়োরপি মধ্যে রাধিকা সর্ব্বথা অধিকা (শ্রীরাধিকা ও চন্দ্রাবলী উভয়ের মধ্যে রাধিকাই সর্ব্বপ্রকারে শ্রেষ্ঠা মহাভাবস্বরূপা) ইয়ং গুণৈঃ অতিবরীয়সী (ইনি অর্থাৎ শ্রীরাধিকাই গুণে অতিপ্রধানা এবং মহাভাবস্বরূপা)।
অনুবাদ।- রাধা ও চন্দ্রাবলীর মধ্যে রাধাই সব রকমে শ্রেষ্ঠা। অতুলনগুণশালিনী ইনি মহাভাবস্বরূপা।।১১।।
- কৃষ্ণপ্রেম ভাবিত যার চিত্তেন্দ্রিয় কায়।
- কৃষ্ণ নিজশক্তি রাধা ক্রীড়ায় সহায়।।
- তথাহি - ব্রহ্মসংহিতায়াং ৫।৩৭
- আনন্দ চিন্ময়রস-প্রতিভাবিতাভি-
- স্তাভি র্য এব নিজরূপতনয়া কলাভিঃ।
- গোলোক এব নিবসত্যখিলাত্মভূতো
- গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি।।১২
অন্বয়ঃ।- অখিলাত্মভূতঃ য এব (গোলোকবাসিগণের আত্মাস্বরূপ যিনি অর্থাৎ শ্রীগোবিন্দ) আনন্দ-চিন্ময়রসপ্রতিভাবিতাভিঃ (আনন্দচিন্ময়রস অর্থাৎ প্রেম-প্রতিভাবিত) নিজরূপতনয়া কলাভিঃ (নিজ পত্নীরূপে প্রসিদ্ধা হলাদিনীশক্তিরূপা) তাভিঃ (সেই গোপীগণসহ) গোলোক এব নিবসতি (গোলোকে বাস করিতেছেন) তম্ আদিপুরুষং গোবিন্দম্ অহং ভজামি (সেই আদিপুরুষ শ্রীগোবিন্দদেবকে আমি ভজনা করি)।
অনুবাদ।- আদিপুরুষ গোবিন্দ, আমি তাঁর ভজনা করি। সর্ব্বভূতের আত্মা তিনি গোলোকে বাস করেন। তাঁর সঙ্গিনী হলাদিনীশক্তিরূপা গোপীগণ, যাঁরা তাঁরই আনন্দচিন্ময় রস থেকে জাত।।১২।।
- কৃষ্ণেরে করায় যৈছে রস আস্বাদন।
- ক্রীড়ার সহায় যৈছে শুন বিবরণ।।
- কৃষ্ণ-কান্তাগণ দেখি ত্রিবিধ প্রকার।
- লক্ষ্মীগণ এক - পুরে মহিষীগণ আর।।
- ব্রজাঙ্গনা রূপ আর কান্তাগণ সার।
- শ্রীরাধিকা হৈতে কান্তাগণের বিস্তার।।
- অবতারী যৈছে কৃষ্ণ করে অবতার।
- অংশিনী রাধা হৈতে তিন গণের বিস্তার।।
- লক্ষ্মীগণ (২) তাঁর বৈভববিলাসাংশরূপ।
- মহিষীগণ বিভব প্রকাশ স্বরূপ।।
- আকার-স্বভাব-ভেদে ব্রজদেবীগণ।
- কায়ব্যূহ-রূপ (৩) তাঁর রসের কারণ।।
- বহু কান্তা বিনা নহে রসের উল্লাস।
- লীলার সহায় লাগি বহুত প্রকাশ।।
- তার মধ্যে ব্রজে নানা ভাব রস ভেদে (৪)।
- কৃষ্ণকে করায় রাসাদিক-লীলা-স্বাদে।।
- গোবিন্দানন্দিনী রাধা - গোবিন্দ-মোহিনী।
- গোবিন্দ-সর্ব্বস্ব সর্ব্ব-কান্তা-শিরোমণি।।
(২) 'লক্ষ্মীগণ' ইত্যাদি - যেমন শ্রীকৃষ্ণের বিলাসমূর্ত্তি পরব্যোমনাথ নারায়ণ, সেইরূপ পরব্যোমনাথ নারায়ণের কান্তা শ্রীলক্ষ্মীও শ্রীরাধিকার বিলাসমূর্ত্তি।
(৩) 'কায়ব্যূহ' - একশরীরীর বহুতর শরীর প্রকট করণের নাম কায়ব্যূহ। ব্রজদেবীগণ শ্রীরাধার কায়ব্যূহরূপ। একই শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্ণকে রসবিশেষ আস্বাদন করাইবার নিমিত্ত শ্রীমদ্ব্রজদেবীরূপে বহু হইয়াছেন।
(৪) 'তার মধ্যে' - বহুকান্তার মধ্যে। 'নানাভাব রস ভেদে' - স্বপক্ষ বিপক্ষ সুহৃৎপক্ষ ও তটস্থপক্ষ প্রভৃতির ভাবভেদে ও রসভেদে এবং অনুরাগভেদে।
- তথাহি - বৃহদ্গৌতমীয়তন্ত্রে-
- দেবী কৃষ্ণময়ী প্রোক্তা রাধিকা পরদেবতা।
- সর্ব্বলক্ষ্মীময়ী সর্ব্ব-কান্তিঃ সম্মোহিনী পরা।।১৩
অন্বয়ঃ।- রাধিকাদেবী কৃষ্ণময়ী (শ্রীরাধিকাদেবী কৃষ্ণময়ী অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের সহিত একাত্মভূতা) পরদেবতা সর্ব্বলক্ষ্মীময়ী সর্ব্ব-কান্তিঃ পরা সম্মোহিনী প্রোক্তা (তিনি সর্ব্বশ্রেষ্ঠা দেবতা, সর্ব্বলক্ষ্মীময়ী, সর্ব্বশোভাময়ী এবং সর্ব্বশ্রেষ্ঠা সম্মোহিনী বলিয়া কথিত হন)।
অনুবাদ।- আনন্দদায়িনী পরম দেবতা রাধিকা কৃষ্ণস্বরূপা। ইনিই নিখিলশ্রী, বিশ্বকান্তি ও দিব্যরূপা সম্মোহিনী।।১৩।।
- দেবী কহি দ্যোতমানা পরম সুন্দরী (১)।
- কিম্বা কৃষ্ণপূজা ক্রীড়ার বসতি নগরী।।
- কৃষ্ণময়ী কৃষ্ণ যাঁর ভিতরে বাহিরে।
- যাঁহা যাঁহা নেত্র পড়ে তাঁহা কৃষ্ণ স্ফুরে।।
- কিম্বা প্রেমরসময় কৃষ্ণের স্বরূপ।
- তাঁর শক্তি তাঁর সহ হয় একরূপ।।
- কৃষ্ণবাঞ্ছা-পূর্ত্তি-রূপ করে আরাধনে।
- অতএব রাধিকা নাম পুরাণে বাখানে।।
- শ্রীমদ্ভাগবতে - ১০।৩০।২৮
- অনয়ারাধিতো নূনং ভগবান্ হরিরীশ্বরঃ।
- যন্নো বিহায় গোবিন্দঃ প্রীতো যামনয়দ্রহঃ।।১৪
অন্বয়ঃ।- অনয়া (ইঁহার দ্বারাই) হরিঃ ভগবান্ নূনম্ আরাধিতঃ (ভগবান ঈশ্বর নিশ্চিতভাবে আরাধিত হইয়াছিলেন) যৎ গোবিন্দঃ প্রীতঃ নঃ (যেহেতু শ্রীগোবিন্দ প্রীত হইয়া আমাদিগকে অর্থাৎ অন্য গোপীগণকে) বিহায় যাং রহঃ অনয়ৎ (ত্যাগ করিয়া ইঁহাকে নির্জ্জনে লইয়া আসিয়াছিলেন)।
অনুবাদ।- ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণকে নিশ্চয়ই ইনি সেবায় প্রীত করেছেন, কেননা গোবিন্দ আমাদের পরিত্যাগ ক'রে এঁকে নিয়ে প্রীতমনে নির্জ্জনে গিয়েছেন।।১৪।।
- অতএব সর্ব্বপূজ্যা পরম দেবতা।
- সর্ব্বপালিকা সর্ব্ব জগতের মাতা।।
- সর্ব্বলক্ষ্মী শব্দ পূর্ব্বে করিয়াছি ব্যাখ্যান (২)।
- সর্ব্বলক্ষ্মীগণের তিহোঁ হয় অধিষ্ঠান।।
- কিম্বা সর্ব্বলক্ষ্মী কৃষ্ণের ষড়্বিধ ঐশ্বর্য্য (৩)।
- তাঁর অধিষ্ঠাত্রী শক্তি - সর্ব্ব-শক্তিবর্য্য (৪)।।
- সর্ব্ব সৌন্দর্য্য-কান্তি বসয়ে যাঁহাতে।।
- সর্ব্ব লক্ষ্মীগণের শোভা হয় যাঁহা হৈতে।।
- কিম্বা কান্তি শব্দে কৃষ্ণের সব ইচ্ছা কহে।
- কৃষ্ণের সকল বাঞ্ছা রাধাতেই রহে।।
- রাধিকা করেন কৃষ্ণের বাঞ্ছিতপূরণ।
- সর্ব্বকান্তি শব্দের এই অর্থ বিবরণ।।
- জগতমোহন কৃষ্ণ তাঁহার মোহিনী।
- অতএব সমস্তের পরা (৫) ঠাকুরাণী।।
- রাধা পূর্ণশক্তি কৃষ্ণ পূর্ণশক্তিমান্।
- দুই বস্তু ভেদ নাহি শাস্ত্রে পরমাণ।।
- মৃগমদ তার গন্ধ যৈছে অবিচ্ছেদ।
- অগ্নি জ্বালাতে যৈছে নাহি কভু ভেদ।।
- রাধাকৃষ্ণ ঐছে সদা একই স্বরূপ। (৬)
- লীলা-রস আস্বাদিতে ধরে দুইরূপ।।
(২) 'লক্ষ্মীগণ তাঁর বৈভব বিলাসাংশ রূপ'। পূর্ব্বোক্ত এই পয়ারেই সর্ব্বলক্ষ্মীময়ী শব্দের ব্যাখ্যা প্রদত্ত হইয়াছে।
(৩) 'কৃষ্ণের ষড়্বিধ ঐশ্বর্য্য', - (১) ঐশ্বর্য্য, সর্ব্ববশীকারিত্ব; (২) বীর্য্য, মণিমন্ত্রমহৌষধির ন্যায় অলৌকিক প্রভাব; (৩) শ্রী, সর্ব্বপ্রকার সম্পত্তি; (৪) যশঃ, রূপগুণাদির খ্যাতি; (৫) জ্ঞান, পরতত্ত্বানুভূতি; (৬) বৈরাগ্য, প্রপঞ্চ বস্তুতে অনাসক্তি - ষড়ৈশ্বর্য্যের অধিষ্ঠাত্রী শক্তি সর্ব্বলক্ষ্মীময়ী শব্দের দ্বিতীয়ার্থ।
(৪) সর্ব্ব-শক্তিবর্য্য - সব শক্তির শ্রেষ্ঠ।
(৫) পরা - শ্রেষ্ঠা।
(৬) মৃগমদ হইতে তাহার গন্ধকে এবং অগ্নি হইতে তাহার দাহিকা শক্তিকে পৃথক্ করা যায় না, সুতরাং অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ হেতু উভয়ে একাত্মক। রাধা-কৃষ্ণ সেইরূপ অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধে একাত্মক।
- প্রেমভক্তি শিখাইতে আপনে অবতরি।
- রাধাভাব কান্তি দু্ই অঙ্গীকার করি।।
- শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য রূপে কৈল অবতার।
- এইত পঞ্চম (১) শ্লোকের অর্থ পরচার।।
- ষষ্ঠ শ্লোকের (২) অর্থ করিতে প্রকাশ।
- প্রথমে কহিয়ে সেই শ্লোকের আভাষ।।
- অবতরি প্রভু প্রচারিলা সংকীর্ত্তন।
- এহো বাহ্যহেতু পূর্ব্বে করিয়াছি সূচন।।
- অবতারের আর এক আছে মূখ্যবীজ (৩)।
- রসিক শেখর কৃষ্ণের সেই কার্য্য (৪) নিজ।।
- অতি গূঢ় হেতু সেই ত্রিবিধ প্রকার।
- দামোদর স্বরূপ হৈতে যাহার প্রচার।।
- স্বরূপ গোসাঞি প্রভুর অতি অন্তরঙ্গ।
- তাহাতে জানেন প্রভুর এ সব প্রসঙ্গ।।
- রাধিকার ভাব মূর্ত্তি প্রভুর অন্তর।
- সেই ভাবে সুখ দুঃখ উঠে নিরন্তর।।
- শেষ লীলায় প্রভুর কৃষ্ণবিরহ - উন্মাদ।
- ভ্রমময় চেষ্টা আর প্রলাপময় বাদ।।
- রাধিকার ভাব যৈছে উদ্ধব দর্শনে।
- সেই ভাবে মত্ত প্রভু রহে রাত্রিদিনে।।
- রাত্রে বিলাপ করেন স্বরূপের কণ্ঠ ধরি।
- আবেশে আপন ভাব কহেন উঘাড়ি (৫)।।
- যবে যেই ভাব উঠে প্রভুর অন্তর।
- সেই গীতি শ্লোকে সুখ দেন দামোদর।।
- এবে কার্য্য নাহি কিছু এসব বিচারে।
- আগে ইহা বিবরিব করিয়া বিস্তারে।।
(১) পঞ্চম শ্লোকের - রাধা কৃষ্ণপ্রণয়বিকৃতিঃ ইত্যাদি শ্লোকের।
(২) ষষ্ঠ শ্লোকের - "শ্রীরাধায়াঃ প্রণয়মহিমা" ইত্যাদি শ্লোকের।
(৩) 'বীজ' - মূল কারণ।
(৪) 'সেই কার্য্য' - মহাভাবরসাস্বাদানরূপ যে কার্য্য।
(৫) 'উঘাড়ি' - উদ্ঘাটন করিয়া।
- পূর্ব্বে ব্রজে কৃষ্ণের ত্রিবিধ বয়োধর্ম্ম।
- কৌমার পৌগণ্ড আর কৈশোর অতিমর্ম্ম (৬)।।
- বাৎসল্য আবেশে কৈল কৌমার সফল।
- পৌগণ্ড সফল কৈল লঞা সখাবল।।
- রাধিকাদি লঞা কৈল রাসাদি-বিলাস।
- বাঞ্ছা ভরি আস্বাদিল রসের নির্য্যাস।।
- কৈশোর বয়স, কাম, জগত-সকল।
- রাসাদি লীলায় তিন করিল সফল।।
(৬) 'অতিধর্ম্ম' - কৈশোর বয়সে শ্রীকৃষ্ণ পরম প্রেমময়ী শ্রীব্রজগোপিকাগণের সহিত প্রেমময় বিলাস করেন বলিয়া কৈশোরকালকে 'অতিধর্ম্ম' বলিলেন।
- শ্রীবিষ্ণুপুরাণে (৫।১৩।৫৯)
- সোহপি কৈশোরকবয়ো মানয়ন্মধুসূদনঃ।
- রেমে স্ত্রীরত্নকূটস্থঃ ক্ষপাসু ক্ষপিতাহিতঃ।।১৫
অন্বয়ঃ।- ক্ষপিতাহিতঃ (সমস্ত অমঙ্গলকে দূরীভূত করিয়া) সঃ অপি মধুসূদনঃ (সেই মধুসূদন) কৈশোরকবয়ঃ মানয়ন্ (কৈশোর বয়স সফল করিয়া) স্ত্রীরত্নকূটস্থঃ সন্ (স্ত্রীরত্নসমূহের মধ্যস্থ হইয়া) ক্ষপাসু রেমে (শরৎকালের যামিনীতে বিহার করিয়াছিলেন)।
অনুবাদ।- সেই মধুসূদনও কৈশোরের মান রেখে সুন্দরী রমণীদের মধ্যবর্ত্তী হ'য়ে যামিনী যাপন করেছিলেন ও সমস্ত অকল্যাণ নাশ করেছিলেন।।১৫।।
- তথাহি - ভক্তিরসামৃতসিন্ধৌ দক্ষিণবিভাগে প্রথমলহর্য্যাং (১২৪)
- বাচা সূচিতশর্ব্বরীরতিকলা-
- প্রাগল্ভ্যয়া রাধিকাং
- ব্রীড়াকুঞ্চিতলোচনাং বিরচয়-
- ন্নগ্রে সখীনামসৌ।
- তদ্বক্ষোরুহচিত্রকেলিমকরী-
- পাণ্ডিত্যপারং গতঃ
- কৈশোরং সফলীকরোতি কলয়ন্
- কুঞ্জে বিহারং হরিঃ।।১৬
অন্বয়ঃ।- সখীনাম্ অগ্রে সূচিতশর্ব্বরীরতিকলা-প্রাগল্ভ্যয়া বাচা (সখীদিগের সম্মুখে রাত্রির রাতিকলার প্রগল্ভতা প্রকাশক বাক্যের দ্বারা) রাধিকাং ব্রীড়াকুঞ্চিত-লোচনাং বিরচয়ন্ (শ্রীরাধিকাকে ব্রীড়াকুঞ্চিত-লোচনা করিয়া) তদ্বক্ষোরুহচিত্রকেলিমকরী-পাণ্ডিত্যপারংগতঃ (তাঁহার স্তনদেশে কেলিমকরীর চিত্রনির্ম্মাণে নৈপুণ্য প্রদর্শন পূর্ব্বক) অসৌ হরিঃ কুঞ্জে বিহারং কলয়ন্ কৈশোরং সফলীকরোতি (এই শ্রীহরি কুঞ্জে বিহার করতঃ কৈশোর বয়সকে সফল করিতেছেন)।
অনুবাদ।- কৈশোরবয়সকে সফল ক'রে কৃষ্ণ কুঞ্জে বিহার করছেন। রাধিকার বুকে পত্ররচনায় চমৎকার নৈপুণ্য দেখিয়েছেন তিনি এবং রজনীর রতিকলায় শ্রীরাধা কেমন প্রগল্ভা হয়েছিলেন - সখীদের সামনেই সেই কথা ব'লে রাধিকাকে কেমন লজ্জানিমীলিতলোচনা করেছেন।।১৬।।
- তথাহি - শ্রীবিদগ্ধমাধবে (৭।৮)
- হরিয়েষ ন চেদবাতরিষ্যন্মথুরায়াং
- মধুরাক্ষি রাধিকা চ।
- অভবিষ্যদিয়ং বৃথা বিসৃষ্টির্মকরাঙ্কস্তু
- বিশেষতস্তদাত্র।।১৭
অন্বয়ঃ।- [শ্রীপৌর্ণমাসী বৃন্দাদেবীকে বলিতেছেন] - মধুরাক্ষি! এষ রাধিকা চ মথুরায়াং চেৎ ন অবাতরিষ্যৎ (হে মধুরনয়নে! এই হরি ও শ্রীরাধিকা যদি মথুরামণ্ডলে অবতীর্ণ না হইতেন) তদা ইয়ং বিসৃষ্টিঃ বৃথা অভবিষ্যৎ, অত্র মকরাঙ্কস্তু বিশেষতঃ (তাহা হইলে এই বৈশিষ্ট্যময়ী সৃষ্টি এবং বিশেষতঃ কামদেবের অস্তিত্ব বৃথাই হইত)।
অনুবাদ।- হে মধুরনয়নে, কৃষ্ণ যদি মথুরায় অবতীর্ণ না হ'তেন - অবতীর্ণ না হ'তেন রাধিকা, সৃষ্টিই তা হ'লে বিফল হ'ত, বিশেষ ক'রে বিফল হ'ত মকরহেতু।।১৭।।
- এই মত পূর্ব্বে কৃষ্ণ রসের সদন।
- যদ্যপি করিল রস নির্য্যাস চর্ব্বণ (১)।।
- তথাপি নহিল তিন বাঞ্ছিত পূরণ।
- তাহা আস্বাদিতে যদি করিল যতন।।
- তাহার প্রথম বাঞ্ছা করিয়ে ব্যাখ্যান।
- কৃষ্ণ কহে আমি হই রসের নিধান।।
- পূর্ণানন্দময় আমি চিন্ময় পূর্ণ তত্ত্ব।
- রাধিকার প্রেমে আমায় করায় উন্মত্ত।।
- না জানি রাধার প্রেমে আছে কত বল।
- যে বলে আমারে করে সর্ব্বদা বিহ্বল।।
- রাধিকার প্রেম গুরু, আমি শিষ্য নট।
- সদা আমা নানা নৃত্যে নাচায় উদ্ভট।।
(১) 'চর্ব্বণ' - আস্বাদন।
- তথাহি - শ্রীগোবিন্দলীলামৃতে (৮।৭৭)
- "কস্মাদ্বৃন্দে প্রিয়সখি" "হরেঃ
- পাদমূলাৎ" "কুতোহসৌ"
- "কুণ্ডারণ্যে" "কিমিহ কুরুতে"
- "নৃত্যশিক্ষাং" "গুরুঃ কঃ।"
- "তং ত্বন্মূর্ত্তিঃ প্রতিতরুলতাং
- দিগ্বিদিক্ষু স্ফুরন্তী
- শৈলূষীব ভ্রমতি পরিতো
- নর্ত্তয়ন্তী স্বপশ্চাৎ"।।১৮
টীকা - [শ্রীরাধা ও বৃন্দাদেবীর উক্তিপ্রত্যুক্তি] "হে বৃন্দে! কস্মাদাগতা?" (হে প্রিয়সখি বৃন্দে! কোথা হইতে আসিলে?) "হরেঃ পাদমূলাৎ।" (শ্রীহরির পাদমূল হইতে)। "অসৌ কুতঃ" (তিনি কোথায় আছেন?) "কুণ্ডারণ্যে।" (শ্রীরাধার কুণ্ডের অরণ্যে)। "ইহ কিং কুরুতে?" (সেখানে কি করিতেছেন?) "নৃত্যশিক্ষাং" (নৃত্য শিক্ষা করিতেছেন)। "গুরুঃ কঃ?" (তাহাতে গুরু কে?) প্রতিতরুলতাং, দিগ্বিদিক্ষু শৈলূষীব স্ফুরন্তী ত্বন্মূর্ত্তিঃ তং স্বপশ্চাৎ নর্ত্তয়ন্তী পরিতঃ ভ্রমতি (দিগ্বিদিকের প্রতিতরুলতায় উত্তম নটীর ন্যায় স্ফুরিতা তোমার মূর্ত্তি তাঁহাকে স্বীয়পশ্চাতে নাচাইয়া ভ্রমণ করিতেছে)।
অনুবাদ।- কোথা থেকে এলে প্রিয়সখি?
- - কৃষ্ণের পাদমূল হ'তে এসেছি আমি।
- - কৃষ্ণ কোথায়?
- - রাধাকুণ্ডবনে।
- - সেখানে কি করছেন তিনি?
- - নৃত্য শিক্ষা করছেন।
- - গুরু কে?
- - দিকে দিকে প্রতি তরু-লতার তলে তোমার যে মূর্ত্তি স্ফুরিত হচ্ছে প্রধানা নটীর মত - তারই পিছু পিছু তিনি নেচে চলেছেন।।১৮।।
- নিজ প্রেমাস্বাদে মোর হয় যে আহ্লাদ।
- তাহা হৈতে কোটিগুণ রাধাপ্রেমাস্বাদ।।
- আমি যৈছে পরস্পর বিরুদ্ধ-ধর্ম্মাশ্রয় (১)।
- রাধাপ্রেম তৈছে সদা বিরুদ্ধ ধর্ম্মময়।।
- রাধা-প্রেম বিভু যার বাঢ়িতে নাই ঠাঞি।
- তথাপি সে ক্ষণে ক্ষণে বাঢ়য়ে সদাই।।
- যাহা বই গুরুবস্তু নাহি সুনিশ্চিত।
- তথাপি গুরুর ধর্ম্ম গৌরব-বর্জ্জিত (৩)।।
- যাহা হৈতে সুনির্ম্মল দ্বিতীয় নাহি আর।
- তথাপি সর্ব্বদা বাম্য-বক্র-ব্যবহার (৪)।।
(১) সর্ব্বব্যাপী হইয়াও মাতৃ-ক্রোড়স্থিত, আপ্তকাম হইয়াও স্তন্যার্থে রোদনরত, স্বতন্ত্র হইয়াও প্রেমপরতন্ত্র ইত্যাদি বিরুদ্ধধর্ম্মের আমি যেমন আশ্রয়।
(২) 'বিভু' - ব্যাপক; সম্পূর্ণ।
(৩) 'গৌরব-বর্জ্জিত' - মমত্বময় মধুস্নেহোত্থ বলিয়া ঐশ্বর্য্যগন্ধহীনতা নিমিত্ত কাহারও নিকট গৌরবও চাহেন না এবং নিজেও গৌরব করেন না।
(৪) তুলনা করুন - "অহেরিব গতিঃ প্রেম্নঃ স্বভাব-কুটিলা ভবেৎ" (উজ্জলনীলমণিঃ)।
- তথাহি - দানকেলিকৌমুদ্যাং (২)
- বিভুরপি কলয়ন্ সদাভিবৃদ্ধিং
- গুরুরপি গৌরবচর্য্যয়া বিহীনঃ।
- মুহুরুপচিতবক্রিমাপি শুদ্ধো
- জয়তি মুরদ্বিষি রাধিকানুরাগঃ।।১৯
অন্বয়ঃ।- বিভুরপি (সম্পূর্ণ হইয়াও) সদা অভিবৃদ্ধিং কলয়ন্ (সর্ব্বদা সর্ব্বদিকে বৃদ্ধিপ্রাপ্তিশীল) গুরুরপি গৌরবচর্য্যয়া বিহীনঃ (গুরু হইয়াও গৌরবচর্য্যাবিহীন) মুহুঃ উপচিতবক্রিমা অপি (প্রতিক্ষণে কৌটিল্য বৃদ্ধি পাইলেও) শুদ্ধঃ (অতিশয় সরল) মুরদ্বিষি রাধিকানুরাগঃ জয়তি (মুরারির প্রতি শ্রীরাধিকার অনুরাগ জয়যুক্ত হউক)।
অনুবাদ।- শ্রীকৃষ্ণে রাধার অনুরাগ জয়লাভ করুক। রাধার অনুরাগ - সর্ব্বব্যাপী হয়েও প্রতিমুহূর্ত্তে বর্দ্ধনশীল, গৌরবান্বিত হয়েও অনুদ্ধত, নব নব বিলাসে কুটিল হয়েও নির্ম্মলপ্রেমে ঋজু।।১৯।।
- সেই প্রেমার শ্রীরাধিকা পরম আশ্রয়।
- সেই প্রেমার আমি হই কেবল বিষয়।।
- বিষয় জাতীয় সুখ আমার আস্বাদ।
- আমা হৈতে কোটিগুণ আশ্রয়ের (৫) আহ্লাদ।।
- আশ্রয় জাতীয় সুখ (৬) পাইতে মন ধায়।
- যত্নে আস্বাদিতে নারি কি করি উপায়।।
- কভু যদি এই প্রেমের হইয়ে আশ্রয়।
- তবে এই প্রেমানন্দের অনুভব হয়।।
- এত চিন্তি রহে কৃষ্ণ পরমকৌতুকী।
- হৃদয়ে বাঢ়য়ে প্রেম-লোভ ধক্ধকি।।
- এই এক শুন আর লোভের প্রকার।
- স্বমাধুর্য্য দেখি কৃষ্ণ করেন বিচার।।
- অদ্ভুত অনন্ত পূর্ণ মোর মধুরিমা।
- ত্রিজগতে ইহার কেহ নাহি পায় সীমা।।
- এই প্রেমদ্বারে নিত্য রাধিকা একলি।
- আমার মাধুর্য্যামৃত আস্বাদে সকলি।।
- যদ্যপি নির্ম্মল রাধার সৎপ্রেম দপণ।
- তথাপি স্বচ্ছতা তার বাঢ়ে ক্ষণে ক্ষণ (৭)।।
- আমার মাধুর্য্যের নাহি বাঢ়িতে অবকাশে।
- এ দর্পণের আগে নব নব রূপে ভাসে।।
- মোর মাধুর্য্য রাধাপ্রেম দোঁহে - কেহ নাহি হারি।।
- আমার মাধুর্য্য নিত্য নব নব হয়।
- স্ব স্ব প্রেম অনুরূপ ভক্তে আস্বাদয়।।
- দর্পণাদ্যে দেখি যদি আপন মাধুরী।
- আস্বাদিতে লোভ হয় আস্বাদিতে নারি।।
- বিচার করিয়ে যদি আস্বাদ উপায়।
- রাধিকা স্বরূপ হৈতে তবে মন ধায়।।
(৫) 'আশ্রয়ের' - তাদৃশ প্রেমের পরমাশ্রয় শ্রীরাধিকার।
(৬) 'আশ্রয় জাতীয় সুখ' - শ্রীরাধিকার যে জাতীয় সুখ।
(৭) 'যদ্যপি নির্ম্মল ...... বাড়ে ক্ষণে ক্ষণ' - শ্রীরাধার সৎ-প্রেমদর্পণে মালিন্যের গন্ধমাত্রও নাই; সুতরাং মলাপসরণের দ্বারা তাহার স্বচ্ছতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা আদৌ নাই; তথাপি ক্ষণে ক্ষণে স্বচ্ছতা বাড়িতেছে। এই শ্রীরাধাপ্রেমের বিরুদ্ধধর্ম 'সৎপ্রেম' - ঐশ্বর্য্যজ্ঞান-গন্ধহীন প্রেম।
(৮) 'হোড় করি' - প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিয়া।
- তথাহি - শ্রীললিতামাধবে (৮।৩২)
- অপরিতলিতপূর্ব্বঃ কশ্চমৎকারকারী
- স্ফুরতি মম গরীয়ানেষ মাধুর্য্যপূরঃ।
- অয়মহমপি হন্ত প্রেক্ষ্য যং লুব্ধচেতাঃ
- সরভসমুপভোক্তুং কাময়ে রাধিকেব।।২০
অন্বয়ঃ।- অপরিতলিতপূর্ব্বঃ (অদৃষ্টপূর্ব্ব) চমৎকারকারী গরীয়ান মাধুর্য্যপূরঃ কঃ এব মম স্ফুরতি (চমৎকারকারী গৌরবশালী এই মাধুর্য্যস্বরূপ কে আমার নিকট প্রকাশ পাইতেছে?) অয়ম্ অহমপি যং প্রেক্ষ্য (এই আমি যে সৌন্দর্য্য দেখিয়া) লুব্ধচেতাঃ সন্ হন্ত সরভসং রাধিকা ইব উপভোক্তুং কাময়ে (লুব্ধচিত্ত হইয়া শ্রীরাধিকার ন্যায় আনন্দসহকারে ইঁহাকে উপভোগ করিবার ইচ্ছা করিয়াছি)।
অনুবাদ।- কে এই অপূর্ব্ব চমৎকারিত্বজনক মহিমময় পরিপূর্ণমাধুর্য্যস্বরূপ আমার সম্মুখে স্ফুরিত হচ্ছে? হায়! মুগ্ধমন আমিও একে দেখে পরম আবেগে রাধার মতনই উপভোগ করতে উৎসুক হ'য়েছি।।২০।।
- কৃষ্ণ মাধুর্য্যের এক স্বাভাবিক বল।
- কৃষ্ণ আদি নর নারী করয়ে চঞ্চল।।
- শ্রবণে দর্শনে আকর্ষয়ে সর্ব্বমন।
- আপনা আস্বাদিতে কৃষ্ণ করয়ে যতন।।
- এ মাধুর্য্যামৃত পান সদা যেই করে।
- তৃষ্ণা শান্তি নহে, তৃষ্ণা বাঢ়ে নিরন্তরে।।
- অতৃপ্ত হইয়া করে বিধিরে নিন্দন।
- অবিদগ্ধ (১) বিধি ভাল না জানে সৃজন।।
- কোটি নেত্র নাহি দিল সবে দিল দুই।
- তাহাতে নিমেষ কৃষ্ণ কি দেখিব মুঞি।।
(১) অবিদগ্ধ - অনিপুণ, অরসিক, মুর্খ।
- তথাহি- শ্রীমদ্ভাগবতে (১০।৮২।৩৯)
- গোপ্যশ্চ কৃষ্ণমুপলভ্য চিরাদভীষ্টং
- যৎ-প্রেক্ষণে দৃশিষু পক্ষ্মকৃতং শপন্তি।
- দৃগ্ভির্হৃদীকৃতমলং পরিরভ্য সর্ব্বা-
- স্তদ্ভাবমাপুরপি নিত্যযুজাং দুরাপম্।।২১
অন্বয়ঃ।- [শ্রীশুকদেব পরীক্ষিৎকে কহিতেছেন] - সর্ব্বাঃ গোপ্যঃ চ যৎ-প্রেক্ষণে (গোপীগণ যাঁহার দর্শনকালে) দৃশিষু পক্ষ্মকৃতং শপন্তি (নয়নের নিমেষ সৃষ্টিকারী বিধাতাকে অভিসম্পাত করিয়া থাকেন) 'তম' চিরাৎ উপলভ্য দৃগ্ভিঃ হৃদীকৃতম্ অলং পরিরভ্য (সেই অভীষ্টকে বহুকাল পরে প্রাপ্ত হইয়া দৃষ্টির দ্বারা হৃদয়ের মধ্যে আনয়নপূর্ব্বক দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গন করিয়া) নিত্যযুজাম্ অপি দুরাপং তদ্ভাবম্ আপুঃ (তাঁহাতে যাঁহারা নিত্যযুক্ত তাঁহাদেরও দুষ্প্রাপ্য তদ্ভাব প্রাপ্ত হইলেন)।
অনুবাদ।- কৃষ্ণের সঙ্গে যে ঐকাত্ম্য রুক্মিণী প্রভৃতির পক্ষেও দুর্লভ ছিল সেই ঐকাত্ম্য গোপীরা পেয়েছিলেন। যে কৃষ্ণ তাঁদের হৃদয়ে নিত্যবিরাজিত ছিলেন - ছিলেন চির-ঈপ্সিত, যাঁর সৌন্দর্য্যদর্শনকালে নিমেষপাতকেও তাঁরা অসহনীয় ব'লে বোধ করতেন - সেই শ্রীকৃষ্ণকে বহুদিন পরে কুরুক্ষেত্রে পেয়ে গোপীর তাঁকে দৃষ্টি দিয়েই পরিপূর্ণ আলিঙ্গন করলেন।।২১।।
- তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে (১০।৩১।১৫)
- অটতি যদ্ভবানহ্নি কাননং
- ত্রুটির্যুগায়তে ত্বামপশ্যতাম্।
- কুটিলকুন্তলং শ্রীমুখঞ্চ তে
- জড় উদীক্ষতাং পক্ষ্মকৃদ্দৃশাম্।।২২
অন্বয়ঃ।- ভবান্ অহ্নি যৎ কাননং অটতি (হে শ্রীকৃষ্ণ যখন তুমি দিবসে বনে ভ্রমণ কর) 'তদা' ত্বাম অপশ্যতাং 'ব্রজজনানাং' ত্রুটিঃ (তখন তোমার অদর্শনে অতি অল্পকালও) যুগায়তে (যুগের ন্যায় প্রতীত হয়) তে কুটিলকুন্তলযুক্ত শ্রীমুখৎ চ উদীক্ষতাং (তোমার কুটিলকুন্তলযুক্ত শ্রীমুখ দর্শনকারীর) দৃশাং পক্ষ্মকৃৎ জড়ঃ (নয়নের নিমেষস্রষ্টা বিধাতা জড় অর্থাৎ বিচার-বুদ্ধিহীন)।
অনুবাদ।- তুমি যখন দিবাভাগে কাননে কাননে ভ্রমণ কর তখন তোমাকে না দেখে মুহূর্ত্তও যুগ হ'য়ে ওঠে। তোমার কুঞ্চিত-অলক-শোভিত শ্রীমুখ দেখার সময় যে নয়নে নিমেষপাত হয় তার জন্য জড় সৃষ্টিকর্ত্তাই দায়ী।।২২।।
- কৃষ্ণাবলোকন বিনা নেত্রে ফল নাহি আন।
- যেই জন কৃষ্ণ দেখে সেই ভাগ্যবান্।।
- তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে (১০।২১।৭)
- অক্ষণ্বতাং ফলমিদং ন পরং বিদামঃ
- সখ্যঃ পশূননুবিবেশয়তোর্বয়স্যৈঃ।
- বক্ত্রং ব্রজেশসুতয়োরনুবেণুজুষ্টং
- যৈর্বৈ নিপীতমনুরক্তকটাক্ষমোক্ষম্।।২৩
অন্বয়ঃ।- হে সখ্যঃ অক্ষণ্বতাম্ ইদং ফলং (সখিগণ! নেত্রশালিগণের ইহাই ফল) পরম্ ন বিদামঃ (এতদপেক্ষা অন্য কোনও শ্রেষ্ঠ ফলের বিষয় আমরা অবগত নহি)। বয়স্যৈঃ সহ পশূন্ অনুবিবেশয়তঃ ব্রজেশসুতয়োঃ (বয়স্যগণের সহিত গাভীগুলিকে বনে প্রবেশ করাইতেছেন এই অবস্থায় ব্রজেন্দ্র-নন্দনদ্বয়ের) অনুবেণুজুষ্টম্ অনুরক্তকটাক্ষমোক্ষং বক্ত্রং যৈঃ বৈ নিপীতং (অনুকূল বংশীযুক্ত ও অনুরাগযুক্ত কটাক্ষ মোচনকারী বদন ইঁহারা নিঃশেষে পান করিয়া থাকেন)।
অনুবাদ।- হে সখীগণ! সখাদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম গাভীদের বনভূমিতে নিয়ে চলেছেন - মুখে তাঁদের বেণু, অপাঙ্গে অনুরাগ। এ দৃশ্য যারা নয়ন দিয়ে পান করেছে - তাদেরই নয়ন সফল - এর চেয়ে বেশী আর কোন সুফল নয়ন পেতে পারে?২৩।।
- তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে (১০।২৪।১৪)
- গোপ্যস্তপঃ কিমচরন্ যদমুষ্য রূপং
- লাবণ্যসারমসমোর্দ্ধমনন্যসিদ্ধম্।
- দৃগ্ভিঃ পিবন্ত্যনুসবাভিনবং দুরাপ-
- মেকান্তধাম যশসঃ শ্রিয় ঐশ্বরস্য।।২৪
অন্বয়ঃ।- গোপ্যঃ কিং তপঃ অচরন্ (গোপীগণ কি তপস্যাই না করিয়াছিলেন?) যং অমুষ্য লাবণ্যসারম্ অসমোর্দ্ধম্ অনুসবাভিনবং (যাহাতে ইহারা এই শ্রীকৃষ্ণের লাবণ্যসার, অসমোর্দ্ধ - অর্থাৎ যাঁহার সমানও নাই এবং যাঁহার শ্রেষ্ঠও নাই - স্বাভাবিক সুন্দর, প্রতিক্ষণে নূতন) দুরাপং যশসঃ শ্রিয়ঃ ঐশ্বরস্য একান্তধাম রূপম্ নন্যসিদ্ধম্ দৃগ্ভিঃ পিবন্ত্যি (দুর্লভ, যশ শ্রী ও ঐশ্বর্য্যের একমাত্র আশ্রয়ভূত রূপ নেত্রসমূহের দ্বারা পান করেন)।
অনুবাদ।- শ্রীকৃষ্ণের রূপ-লাবণ্যের সার, তুলনাবিহীন, স্বভাবসুন্দর, প্রতিক্ষণেই নূতন, দুর্লভ, মাধুর্য্যের, সৌন্দর্য্যের ও ঐশ্বর্য্যের একান্ত আশ্রয়। গোপীরা কোন্ তপস্যা করেছিলেন যে এমন রূপ নয়ন ভরে পান করেন!২৪।।
- অপূর্ব্ব মাধুরী কৃষ্ণের অপূর্ব্ব তার বল।
- যাহার শ্রবণে মন হয় টলমল।।
- কৃষ্ণের মাধুরী কৃষ্ণের উপজায় লোভ।
- সম্যক্ আস্বাদিতে নারে মনে রহে ক্ষোভ।।
- এইত দ্বিতীয় হেতুর কৈল বিবরণ।
- তৃতীয় হেতুর এবে শুনহ লক্ষণ।।
- অত্যন্ত নিগূঢ় এই রসের সিদ্ধান্ত।
- স্বরূপ গোঁসাঞি মাত্র জানেন একান্ত।।
- যেবা কেহ অন্যে জানে সেহো তাঁহা হৈতে।
- চৈতন্য গোঁসাঞির তেহো অত্যন্ত মর্ম্ম যাতে।।
- গৌপীগণের প্রেম অধিরূঢ় ভাব (১) নাম।
- বিশুদ্ধ নির্ম্মল প্রেম কভু কহে কাম।।
(১) যে মহাভাবে সাত্ত্বিকভাবের উদ্দীপন হয় তাহাই অধিরূঢ়ভাব।
- তথাহি - গৌতমীয়তন্ত্রে
- প্রেমৈব গোপরামাণাং
- কাম ইত্যগমৎ প্রথাম্।
- ইত্যুদ্ধবাদয়োহপ্যেতং
- বাঞ্ছন্তি ভগবৎপ্রিয়াঃ।।২৫
অন্বয়ঃ।- গোপরামাণাং প্রেমা এব (ব্রজগোপীদিগের প্রেমই) কাম ইতি প্রথাম্ অগমৎ (কাম নামে খ্যাতি লাভ করিয়াছিল)। ইতি উদ্ধবাদয়োহপি ভগবৎ-প্রিয়াঃ (এইজন্য উদ্ধব প্রমুখ ভক্তগণ) এতম্ বাঞ্ছন্তি (ইহা লাভের আকাঙ্ক্ষা করিয়া থাকেন)।
অনুবাদ।- গোপীদের প্রেমই কাম নামে অভিহিত হয়ে থাকে। উদ্ধব প্রভৃতি মহাভাগবতেরাও এই প্রেমকে পেতে চান।।২৫।।
- কাম প্রেম দোঁহাকার বিভিন্ন লক্ষণ।
- লৌহ আর হেম যৈছে স্বরূপে বিলক্ষণ।।
- আত্মেন্দ্রিয়-প্রীতি ইচ্ছা তারে বলি কাম।
- কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা-ধরে প্রেম নাম।।
- কামের তাৎপর্য্য (১) নিজ সম্ভোগ কেবল।
- কৃষ্ণ-সুখ তাৎপর্য্য হয় প্রেম ত প্রবল।।
- লোকধর্ম্ম বেদধর্ম্ম দেহধর্ম্ম কর্ম্ম।
- লজ্জা ধৈর্য্য দেহসুখ আত্মসুখ মর্ম্ম।।
- দুস্ত্যজ আর্য্যপথ (২) নিজ পরিজন।
- স্বজনে করয়ে যত তাড়ন ভৎর্সন।।
- সর্ব্বত্যাগ করি করে কৃষ্ণের ভজন।
- কৃষ্ণ-সুখ হেতু করে প্রেম-সেবন।।
- ইহাকে কহিয়ে কৃষ্ণে দৃঢ় অনুরাগ।
- স্বচ্ছ ধৌতবস্ত্রে যৈছে নাহি কোন দাগ।।
- অতএব কাম প্রেমে বহুত অন্তর।
- কাম অন্ধতম প্রেম নির্ম্মল ভাস্কর।।
- অতএব গোপীগণে নাহি কামগন্ধ।
- কৃষ্ণ-সুখ লাগি মাত্র কৃষ্ণে সে সম্বন্ধ।।
(১) 'তাৎপর্য্য' - উদ্দেশ্য।
(২) 'আর্য্যপথ' - পাতিব্রত্য ধর্ম্ম।
- তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে (১০।৩১।১৯)
- যত্তে সুজাতচরণাম্বুরুহং স্তনেষু
- ভীতাঃ শনৈঃ প্রিয় দধীমহি কর্ক্কশেষু।
- তেনাটবীমটসি তদ্ব্যথতে ন কিংস্বিৎ
- কূর্পাদিভির্ভ্রমতি ধীর্ভবদায়ুষাং নঃ।।২৬
অন্বয়ঃ।- হে প্রিয়! ভীতাঃ তে যৎ সুজাতচরণাম্বুরুহং (হে প্রিয় - আমরা তোমার যে সুকোমল চরণকমল) কর্ক্কশেষু স্তনেষু শনৈঃ দধীমহি (আমাদিগের কঠিন স্তনসমূহে অতি ধীরে ধীরে ধারণ করিয়া থাকি) তেন অটবীম্ অটসি (সেই চরণের দ্বারা যখন তুমি বনে ভ্রমণ করিয়া বেড়াও) তং চরণং কূর্পাদিভিঃ কিংস্বিৎ ন ব্যথতে (তখন কি তাহা সূক্ষ্ম প্রস্তরখণ্ডাদির দ্বারা ব্যথা প্রাপ্ত হয় না)? ভবদায়ুষাং নঃ ধীঃ ভ্রমতি (ত্বদ্গতপ্রাণ - আমাদিগের উহা ভাবিয়া বুদ্ধি ভ্রান্ত হইয়া পড়ে)।
অনুবাদ।- হে প্রিয়! আমাদের কঠিন উরসে তোমার সুকোমল পদ-কমল - ভীরু আমরা - ধীরে রেখেছিলাম - পাছে ব্যথা পাও। এখন তুমি সে পায়ে অরণ্যে ভ্রমণ করছ, কঠিন কঙ্করে কি পায়ে ব্যথা লাগছে না - এ কথা ভেবে তোমাগতপ্রাণ আমরা বিভ্রান্ত হয়েছি।।২৬।।
- আত্ম সুখে দুঃখে গোপীর নাহিক বিচার।
- কৃষ্ণসুখ হেতু চেষ্টা মনোব্যবহার।।
- কৃষ্ণ লাগি আর সব করি পরিত্যাগ।
- কৃষ্ণসুখ হেতু করে শুদ্ধ অনুরাগ।।
- তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে (১০।৩২।২১)
- এবং মদর্থোজ্ঝিতলোকবেদ-
- স্বানাং হি বো ময্যনুবৃত্তয়েহবলাঃ।
- ময়া পরোক্ষং ভজতা তিরোহিতং
- মাসূয়িতুং মার্হথ তৎ প্রিয়ং প্রিয়াঃ।।২৭
অন্বয়ঃ।- [গোপ-প্রতি শ্রীকৃষ্ণবাক্য] হে অবলাঃ মদর্থোজ্ঝিতলোক-বেদস্বানাং (হে অবলাগণ! তোমরা আমার জন্য ইহলোকের লৌকিক ব্যবহার, বেদনির্দ্দিষ্ট ধর্ম্মপথ এবং নিজ নিজ আত্মীয় স্বজনকে পরিত্যাগ করিয়াছ)। বঃ হি ময়ি অনুবৃত্তয়ে (তোমাদের আমার প্রতি এই ভাব বৃদ্ধির জন্যই) পরোক্ষং ভজতা ময়া তিরোহিতং (পরোক্ষে তোমাদিগের ভজনা করিলেও আমি যে তিরোহিত হইয়াছিলাম) তৎ হে প্রিয়াঃ, প্রিয়ং মা অসূয়িতুং মা অর্হথ (তাহার জন্য হে প্রিয়াগণ আমার দোষ দর্শন করা তোমাদের উচিত হয় না)।
অনুবাদ।- আমার প্রেমে তোমরা সংসার ত্যাগ করেছ, ধর্ম্মাচার ত্যাগ করেছ - ত্যাগ করেছ আপনজনকে। তোমাদের নিরন্তর অনুরাগ আস্বাদনার (বা বৃদ্ধির) জন্য আমি তিরোহিত হয়েছিলাম। তোমরা আমার প্রিয়া - আমি তোমাদের প্রিয়, আমাকে নিরপরাধ মনে কোরো।।২৭।।
- তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে (১০।৪৬।৩৪)
- তা মন্মনস্কা মৎপ্রাণা
- মদর্থে ত্যক্ত-দৈহিকাঃ।
- মামেবং দয়িতং প্রেষ্ঠম্
- আত্মানং মনসা গতাঃ।।২৮
অন্বয়ঃ।- [শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধবকে বলিতেছেন] তা মন্মনস্কাঃ (সেই গোপীগণ - সকলেই মদ্গতচিত্ত) - মৎপ্রাণাঃ মদর্থে ত্যক্তদৈহিকাঃ (মদ্গতপ্রাণা এবং আমার জন্য সমস্ত দৈহিক সুখ বিসর্জ্জন করিয়া) তাঃ দয়িতং প্রেষ্ঠম্ আত্মানং মামেবং মনসা গতাঃ (তাঁহারা তাঁহাদের দয়িত, প্রিয়তম এবং আত্মস্বরূপ আমাকেই মনের দ্বারা প্রাপ্ত হইয়াছেন)।
অনুবাদ।- আমাকে তারা মন সমর্পণ করেছে, প্রাণ সমর্পণ করেছ। দৈহিক সব কিছুই সমর্পণ করেছে। আমি তাদের দয়িত, তাদের প্রিয়তম, আত্মস্বরূপ - আমাকে তারা অন্তরেই একান্ত ক'রে পেয়েছে।।২৮।।
- কৃষ্ণের প্রতিজ্ঞা এক আছে পূর্ব্ব হৈতে।
- যে যৈছে ভজে কৃষ্ণ তারে, ভজে তৈছে।।
- শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতায়াং (৪ অঃ ১২)
- যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।
- মম বর্ত্মানুবর্ত্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্ব্বশঃ।।২৯
ইহার অন্বয়াদি চতুর্থ পরিচ্ছেদে দ্বিতীয় শ্লোকে দ্রষ্টব্য।।২৯।।
- সে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হৈল গোপীর ভজনে।
- তাহাতে প্রমাণ কৃষ্ণ শ্রীমুখ বচনে।।
- তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে (১০।৩২।২১)
- ন পারয়েহহং নিরবদ্যসংযুজাং
- স্বসাধুকৃত্যং বিবুধায়ুষাপি বঃ।
- যা মাভজন্ দুর্জ্জরগেহশৃঙ্খলাঃ
- সংবৃশ্চ্য তদ্বঃ প্রতিযাতু সাধুনা।।৩০
অন্বয়ঃ।- [শ্রীকৃষ্ণ গোপীদিগকে বলিতেছেন] অহং নিরবদ্যসংযুজাং বঃ (অনিন্দ্যভাবে মিলন-পরায়ণা - তোমাদের) স্বসাধুকৃত্যং (স্বীয় সাধুকৃত্য) বিবুধায়ুষা অপি (অমরের আয়ু লাভ করিয়াও) ন পারয়ে (আমি শোধ দিতে সমর্থ নহি) যাঃ দুর্জ্জরগেহ-শৃঙ্খলাঃ সংবৃশ্চ্য (যেহেতু তোমরা দুশ্ছেদ্য গৃহশৃঙ্খল ছিন্ন করিয়াও) মা অভজন্ (আমাকে ভজনা করিয়াছ) বঃ তৎ তদ্বঃ সাধুনা প্রতিযাতু (অতএব তোমাদের এই সাধু-কৃত্যের দ্বারাই তাহার পরিশোধ হউক)।
অনুবাদ।- নির্ম্মলপ্রেমা তোমাদের প্রেমের ঋণ দেবতার আয়ু দিয়েও পরিশোধ করতে পারব না। দুশ্ছেদ্য গৃহবন্ধন ছিন্ন করে আমাকেই তোমরা চেয়েছ। তোমাদের প্রেমেই তাহার পরিশোধ হোক।।৩০।।
- তবে যে দেখিয়ে গোপীর নিজ দেহে প্রীত।
- সেহোত কৃষ্ণের লাগি জানিহ নিশ্চিত।।
- এই দেহ কৈল আমি কৃষ্ণে সমর্পণ।
- তাঁর ধন তাঁর ইহা সম্ভোগ সাধন।।
- এ-দেহ-দর্শন-স্পর্শে কৃষ্ণসন্তোষণ।
- এই লাগি করে দেহের মার্জ্জন ভূষণ।।
- তথাহি - গোপীপ্রেমামৃতে শ্রীকৃষ্ণবাক্যম্
- নিজাঙ্গমপি যা গোপ্যো
- মমেতি সমুপাসতে।
- তাভ্যঃ পরং ন মে পার্থ
- নিগূঢ়প্রেমভাজনম্।।৩১
অন্বয়ঃ।-নিজাঙ্গম্ অপি মম ইতি সমুপাসতে (হে পার্থ যে গোপীরা তাঁহাদের নিজ নিজ অঙ্গকেও আমার বলিয়া সম্যক্ভাবে উপাসনা করেন) তাভ্যঃ পরং মম নিগূঢ়প্রেমভাজনং ন (তাঁহাদিগের হইতে কেহই আমার নিগূঢ় প্রেমভাজন নহেন)।
অনুবাদ।- আপন দেহকেও যে গোপীরা কৃষ্ণের বস্তু মনে ক'রে প্রসাধিত করতেন সেই গোপীরা ছাড়া - হে অর্জ্জুন - আমার পরমপ্রেমভাজন আর কেউ নেই।।৩১।।
- আর এক অদ্ভুত গোপী ভাবের স্বভাব।
- বুদ্ধির গোচর নহে যাহার প্রভাব।।
- গোপীগণ করে যবে কৃষ্ণ-দরশন।
- সুখ বাঞ্ছা নাহি সুখ হয় কোটি গুণ।।
- গোপিকা দর্শনে কৃষ্ণের যে আনন্দ হয়।
- তাহা হৈতে কোটিগুণ গোপী আস্বাদয়।।
- তাঁ সবার নাহি নিজ সুখ অনুরোধ (১)।
- তথাপি বাঢ়য়ে সুখ পড়িল বিরোধ।।
- এ বিরোধের এক এই দেখি সমাধান।
- গোপিকার সুখ কৃষ্ণসুখে পর্য্যবসান।।
- গোপিকা দর্শনে কৃষ্ণের বাঢ়ে প্রফুল্লতা।
- সে মাধুর্য্য বাঢ়ে যার নাহিক সমতা।।
- আমার দর্শনে কৃষ্ণ পাইল এত সুখ।
- এই সুখে গোপীর প্রফুল্ল অঙ্গ মুখ।।
- গোপীশোভা দেখি কৃষ্ণের শোভা বাঢ়ে যত।
- কৃষ্ণশোভা দেখি গোপীর শোভা বাঢ়ে তত।।
- এই মত পরস্পর পড়ে হুড়াহুড়ি (২)।
- পরস্পর বাঢ়ে কেহ মুখ নাহি মুড়ি (৩)।।
- কিন্তু কৃষ্ণের সুখ হয় গোপী রূপ গুণে।
- তাঁর সুখে সুখ বৃদ্ধি হয় গোপীগণে।।
- অতএব সেই সুখ কৃষ্ণ সুখ পোষে।
- এই হেতু গোপীপ্রেমে নাহি কাম দোষে।।
(১) 'অনুরোধ' - আগ্রহ।
(২) 'হুড়াহুড়ি' - পরস্পরকে জয় করিবার দৌড়ঝাঁপ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
(৩) অধোবদন হয় না, অর্থাৎ হারে না।
- যথোক্তং শ্রীরূপগোস্বামিনা স্তবমালায়াং কেশবাষ্টকে ৮ম শ্লোকে
- উপেত্য পথি সুন্দরীততিভিরাভিরভ্যর্চ্চিতং
- স্মিতাঙ্কুরকরম্বিতৈর্ন টদপাঙ্গভঙ্গীশতৈঃ।
- স্তনস্তবকসঞ্চরন্নয়নচঞ্চরীকাঞ্চলং
- ব্রজে বিজয়িনং ভজে বিপিনদেশতঃ কেশবম্।।৩২
অন্বয়ঃ।- আভিঃ সুন্দরীততিভিঃ উপেত্য স্মিতাঙ্কুরকরম্বিতৈঃ (এই ব্রজবধূগণ আসিয়া মৃদুমন্দ হাস্য ও রোমাঞ্চযুক্ত) নটদপাঙ্গভঙ্গীশতৈঃ (নৃত্যশীল অসংখ্য কটাক্ষভঙ্গীর দ্বারা) পথি অভ্যর্চ্চিতং (যাহাকে পথিমধ্যে পূজা করিতেছেন) স্তনস্তবকসঞ্চরন্নয়নচঞ্চরীকাঞ্চলং (যাঁহার নয়নভৃঙ্গ সেই ব্রজসুন্দরীদিগের স্তনপুষ্পস্তবকে সঞ্চারিত হইতেছে) বিপিনদেশতঃ ব্রজে বিজয়িনং কেশবং ভজে (বনপ্রদেশ হইতে গোষ্ঠে আগমনকারী সেই কেশবকে আমি ভজনা করি)।
অনুবাদ।- আমি কেশবকে ভজনা করি। কেশব বন থেকে ব্রজে ফিরছেন - তাঁকে ব্রজরূপসীরা অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন স্মিতহাসি আর অপাঙ্গভঙ্গি দিয়ে। তাঁদের বক্ষকুসুমে লগ্ন হ'য়ে আছে তাঁরই নয়নভৃঙ্গ।।৩২।।
- আর এক গোপী প্রেমের স্বাভাবিক চিহ্ন।
- যে প্রকারে হয় প্রেম কামগন্ধহীন।।
- গোপীপ্রেমে করে কৃষ্ণ মাধুর্য্যের পুষ্টি।
- মাধুর্য্য বাঢ়ায় প্রেম হঞা মহাতুষ্টি।।
- প্রীতিবিষয়ানন্দে তদাশ্রয়ানন্দ (১)।
- তাঁহা নাহি নিজ-সুখ-বাঞ্ছার সম্বন্ধ।।
- নিরুপাধি প্রেম (২) যাঁহা তাঁহা এই রীতি।
- প্রীতি বিষয় সুখে আশ্রয়ের প্রীতি।।
- নিজ প্রেমানন্দে কৃষ্ণ সেবানন্দ বাধে।
- সে আনন্দের প্রতি ভক্তের হয় মহাক্রোধে।।
(১) প্রীতির বিষয় শ্রীকৃষ্ণ, তদাশ্রয় অর্থাৎ প্রীতির আশ্রয় শ্রীরাধা, তাঁহার অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের আনন্দে শ্রীরাধার আনন্দ হয়।
(২) 'নিরুপাধি' - নিহেতু, বাসনাশূন্য।
- তথাহি - ভক্তিরসামৃতসিন্ধৌ পশ্চিম-বিভাগে ২য়-লহর্য্যাং ২৪ শ্লোকঃ-
- অঙ্গস্তম্ভারম্ভমুত্তুঙ্গয়ন্তং
- প্রেমানন্দং দারুকো নাভ্যনন্দৎ।
- কংসারাতের্বীজনে যেন সাক্ষা-
- দক্ষোদীয়ানন্তরায়ো ব্যধায়ি।।৩৩
অন্বয়ঃ।- দারুকঃ অঙ্গস্তম্ভারম্ভম্ উত্তুঙ্গয়ন্তং (শ্রীকৃষ্ণসারথি দারুকদেহে জড়তার উৎপত্তিজনক বা বর্দ্ধনকারী) প্রেমানন্দং ন অভ্যনন্দৎ (প্রেমানন্দকে অভিনন্দন করেন নাই)। যেন কংসারাতেঃ (কারণ উহা দ্বারা কংসারি শ্রীকৃষ্ণের) সাক্ষাৎ বীজনে (সাক্ষাৎ চামর-সেবনে) অক্ষোদীয়ান্ অন্তরায়ঃ ব্যধায়ি (অধিকতর বিঘ্ন উৎপন্ন হইয়াছিল)।
অনুবাদ।- উদীয়মান প্রেমানন্দে দারুকের অঙ্গ স্তম্ভিত হ'ল। তিনি কৃষ্ণকে ব্যজন করছিলেন - অঙ্গ স্তম্ভিত হওয়ায় সাক্ষাৎভাবে সেবায় অধিকতর বিঘ্ন ঘটল। তাই দারুক সেই প্রেমঘন আনন্দকেও নিন্দা করলেন।।৩৩।।
- ভক্তিরসামৃতসিন্ধৌ দক্ষিণবিভাগে ৩য়-লহর্য্যাং ৩২ শ্লোকঃ
- গোবিন্দপ্রেক্ষণাক্ষেপিবাষ্পপূরাভিবর্ষিণম্।
- উচ্চৈরনিন্দদানন্দমরবিন্দবিলোচনা।।৩৪
অন্বয়ঃ।- অরবিন্দবিলোচনা (কমললোচনা) গোবিন্দপ্রেক্ষণাক্ষেপি-বাষ্পপূরাভিবর্ষিণং (শ্রীকৃষ্ণ-দর্শনের বিঘ্নকারী নেত্রজলবর্ষী) আনন্দম্ উচ্চৈঃ অনিন্দৎ (আনন্দকে উচ্চৈঃস্বরে নিন্দা করিয়াছিলেন)।
অনুবাদ।- সেই কমললোচনা আপন আনন্দকেও অত্যন্ত নিন্দা করলেন, কারণ গোবিন্দদর্শনজনিত আনন্দে নয়ন দিয়ে যে অশ্রু ঝরছিল সেই অশ্রুই গোবিন্দদর্শনের বাধা হয়ে উঠল।।৩৪।।
- আর শুদ্ধ ভক্ত কৃষ্ণ প্রেম সেবা বিনে।
- স্বসুখার্থ সালোক্যাদি না করে গ্রহণে।।
- তথাহি শ্রীমদ্ভাগবতে (৩।২৯।১১-১২)
- মদ্গুণশ্রুতিমাত্রেণ ময়ি সর্ব্বগুহাশয়ে।
- মনোগতিরবিচ্ছিন্না যথা গঙ্গাম্ভসোহম্বুধৌ।।৩৫।।
- লক্ষণং ভক্তিযোগস্য নির্গুণস্য হ্যুদাহৃতম্।
- অহৈতুক্যব্যবহিতা যা ভক্তিঃ পুরুষোত্তমে।।৩৬।।
অন্বয়ঃ।- মদ্গুণশ্রুতিমাত্রেণ (আমার গুণ শ্রবণমাত্রে) সর্ব্বগুহাশয়ে (সকলের অন্তঃকরণে অবস্থিত) ময়ি পুরুষোত্তমে (পুরুষোত্তমরূপী আমাতে) অম্বুধৌ (মহাসমুদ্রে) গঙ্গাম্ভসো যথা (গঙ্গাপ্রবাহের যেরূপ) (তথা) অবিচ্ছিন্না মনোগতিঃ (অবিচ্ছিন্না মনের গতি) (সা হি) নির্গুণস্য ভক্তিযোগস্য (তাহাই নির্গুণ ভক্তিযোগের) লক্ষণম্ উদাহৃতং (লক্ষণরূপে কথিত হয়) - যা ভক্তিঃ অহৈতুকী, অব্যবহিতা (এই ভক্তি কারণান্তর-শূন্যা এবং অন্যব্যবধানরহিতা)।
অনুবাদ।- সমুদ্র অভিমুখে গঙ্গার গতি যেমন নিরন্তরা তেমনি আমার গুণশ্রবণে আমার প্রতিও ভক্তজনের নিরন্তরা মনোগতি হয়। পুরুষোত্তমে অকারণ ও অব্যবহিত এই ভক্তিকেই তাই নিষ্কাম ভক্তিযোগ বলে।।৩৫-৩৬।।
- তথাহি শ্রীমদ্ভাগবতে (৩।২।১৩)
- সালোক্যসার্ষ্টি সারূপ্যসামীপ্যৈকত্বমপ্যুত।
- দীয়মানং ন গৃহ্নন্তি বিনা মৎসেবনং জনাঃ।।৩৭।।
অন্বয়ঃ।- জনাঃ মৎসেবনং বিনা দীয়মানং উত (আমার সেবা বিনা আমি দিতে চাহিলেও) সালোক্যসার্ষ্টি সারূপ্যসামীপ্যৈকত্বম্ অপি ন গৃহ্নন্তি (সালোক্য, সার্ষ্টি, সারূপ্য, সামীপ্য এবং সাযুজ্য এই পঞ্চবিধ মুক্তিও গ্রহণ করেন না)।
অনুবাদ।- আমার সেবা যারা চায় তারা সালোক্য, সার্ষ্টি, সারূপ্য, সামীপ্য ও সাযুজ্য - এই পঞ্চধা মুক্তি পেলেও গ্রহণ করে না।।৩৭।।
- তত্রৈব শ্রীমদ্ভাগবতে ৯।৪।৬৭ শ্লোকঃ
- মৎসেবয়া প্রতীতং তে
- সালোক্যাদি-চতুষ্টয়ম্।
- নেচ্ছন্তি সেবয়া পূর্ণাঃ
- কুতোহন্যং কালবিপ্লতম্।।৩৮
অন্বয়ঃ।- সেবয়া পূর্ণাঃ তে (আমার সেবার দ্বারা পরিপূর্ণকাম আমার ভক্তগণ) মৎসেবয়া প্রতীতং (আমার সেবার দ্বারা লদ্ধ) সালোক্যাদিচতুষ্টয়ং ন ইচ্ছন্তি (সালোক্যাদি চারিপ্রকার মুক্তিও চাহেন না) কালবিপ্লতং (কালপ্রভাবে ধ্বংসশীল) অন্যং কুতঃ (অন্য কিছু কেনই বা চাহিবেন?)
অনুবাদ।- আমার সেবায় পরিপূর্ণচিত্ত তারা সালোক্যাদি চতুর্বিধ মুক্তিই গ্রহণ করে না - কালে বিনাশশীল স্বর্গাদি তো দূরের কথা।।৩৮।।
- কামগন্ধ হীন স্বাভাবিক গোপীপ্রেম।
- নির্ম্মল উজ্জ্বল শুদ্ধ যেন দগ্ধহেম।।
- কৃষ্ণের সহায় গুরু বান্ধব প্রেয়সী।
- গোপিকা হয়েন প্রিয়া শিষ্যা সখী দাসী।।
- গোপিকা জানেন কৃষ্ণের মনের বাঞ্ছিত।
- প্রেমসেবা পরিপাটি ইষ্ট সমীহিত (১)।।
(১) 'ইষ্ট-সমীহিত' - কৃষ্ণ যাহা ভালবাসেন সেইরূপ শারীরিক ব্যবহার।
- তথাহি - গোপীপ্রেমামৃতে।
- সহায়া গুরুবঃ শিষ্যা
- ভুজিষ্যা বান্ধবাঃ স্ত্রিয়ঃ।
- সত্যং বদামি তে পার্থ
- কিং গোপ্যঃ মে ভবন্তি ন।।৩৯
- মন্মাহাত্ম্যং মৎসপর্য্যাং
- মৎশ্রদ্ধাং মন্মনোগতম্।
- জানন্তি গোপিকাঃ পার্থ
- নান্যে জানন্তি তত্ত্বতঃ।।৪০
অন্বয়ঃ।- হে পার্থ! তে সত্যং বদামি (তোমাকে সত্যই বলিতেছি) গোপ্যঃ মে সহায়াঃ গুরুবঃ শিষ্যাঃ ভুজিষ্যাঃ বান্ধবাঃ 'স্যুঃ' (গোপীরা আমার সহায়, গুরু, শিষ্যা, ভোগ্যা, বান্ধব ও পত্নী হইতেছেন)। 'অতস্তাঃ' মে কিং ন ভবন্তি (অতএব তাঁহারা আমার সর্ব্বস্ব)। হে পার্থ! গোপিকাঃ মন্মাহাত্ম্যং মৎসপর্য্যাং মৎশ্রদ্ধাং মন্মনোগতং জানন্তি (গোপিকারাই আমার মাহাত্ম্য, আমার সেবা, আমার প্রতি শ্রদ্ধা ও আমার মনোগত অভিপ্রায় অবগত আছেন)। অন্যে তত্ত্বতঃ ন জানন্তি (অন্য কেহ তাহা স্বরূপতঃ জানেন না)।
অনুবাদ।- সত্য অর্জ্জুন! গোপীরা আমার কি নয়! তারা আমার সহায়, গুরু, শিষ্যা, ভোগ্যা, বন্ধু ও ভার্য্যা। আমার মর্য্যাদা, আমার সেবা, আমার শ্রদ্ধা ও আমার অভিলাষ - সেই গোপীরাই জানে, আর কেউ নয়।।৩৯-৪০।।
- সেই গোপীগণ মধ্যে উত্তমা রাধিকা।
- রূপে গুণে সৌভাগ্যে প্রেমে সর্ব্বাধিকা।।
- তথাহি পদ্মপুরাণে
- যথা রাধা প্রিয়া বিষ্ণো-
- স্তস্যাঃ কুণ্ডং প্রিয়ং তথা।
- সর্ব্বগোপীষু সৈবৈকা
- বিষ্ণোরত্যন্তবল্লভা।।৪১
অন্বয়ঃ।- রাধা যথা প্রিয়া বিষ্ণোঃ প্রিয়া কুণ্ডং তথা প্রিয়ং (শ্রীরাধিকা যেমন শ্রীকৃষ্ণের প্রিয়া তাঁহার কুণ্ডও সেইরূপ প্রিয়) সর্ব্বগোপীষু সা এব একা বিষ্ণোঃ অত্যন্তবল্লভা (সকল গোপীর মধ্যে একমাত্র তিনিই শ্রীকৃষ্ণের অতিশয় আদরণীয়া)।
অনুবাদ।- রাধা যেমন কৃষ্ণের প্রিয়তমা, রাধাকুণ্ডও তেমনি কৃষ্ণের প্রিয়স্থান। রাধাই সর্ব্ব গোপীদের মধ্যে কৃষ্ণের সর্ব্বাধিক প্রিয়া।।৪১।।
- তথাহি গোপীপ্রেমামৃতে
- ত্রৈলোক্যে পৃথিবী ধন্যা
- যত্র বৃন্দাবনং পুরী।
- তত্রাপি গোপিকাঃ পার্থ
- যত্র রাধাভিধা মম।।৪২
অন্বয়ঃ।- হে পার্থ! যত্র বৃন্দাবনং পুরী সা পৃথিবী ত্রৈলোক্যে ধন্যা (বৃন্দাবন নামে পুরী আছে যেখানে সেই পৃথিবী ত্রিলোকের মধ্যে ধন্যা) তত্রাপি গোপিকাঃ যত্র মম রাধাভিধা প্রিয়া বর্ত্ততে (সেইস্থলেও গোপিকাগণ ধন্যা, যাদের মধ্যে আমার রাধা নাম্নী প্রিয়া বর্ত্তমান আছেন)।
অন্বয়ঃ।- ত্রিলোকে পৃথিবীই ধন্য, কারণ সেখানে বৃন্দাবনপুরী আছে। বৃন্দাবনেও গোপীরাই ধন্য, কারণ তাদের মধ্যে আছে আমার রাধা।।৪২।।
- রাধাসহ ক্রীড়ারস বৃদ্ধির কারণ।
- আর সব গোপীগণ রসোপকরণ (১)।।
- কৃষ্ণের বল্লভা রাধা কৃষ্ণপ্রাণধন।
- তাঁহা বিনু সুখ হেতু নহে গোপীগণ।।
(১) রসোপকরণ - যেমন অন্নের উপকরণ ব্যঞ্জন।
- শ্রীগীতগোবিন্দে ৩য় সর্গে ১ম শ্লোকে শ্রীজয়দেববাক্যম্
- কংসারিরপি সংসারবাসনাবদ্ধশৃঙ্খলাম্।
- রাধামায় হৃদয়ে তত্যাজ ব্রজসুন্দরীঃ।।৪৩
অনুবাদ।- কংসারিঃ অপি সংসারবাসনাবদ্ধশৃঙ্খলাম্ (সমস্ত লীলার সারভূতা রাসলীলার বাসনার দৃঢ় শৃঙ্খলরূপা) রাধাং হৃদয়ে আধায় (রাধারাণীকে হৃদয়ে ধারণ করিয়া) ব্রজসুন্দরীঃ তত্যাজ (অন্যান্য ব্রজসুন্দরীদিগকে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন)।
অন্বয়ঃ।- রাসলীলার শ্রীবিলাস-স্বরূপা সেই রাধাকে হৃদয়ে গ্রহণ করে শ্রীকৃষ্ণও ব্রজরূপসীদের পরিত্যাগ করলেন।।৪৩।।
- সেই রাধার ভাব লঞা চৈতন্যাবতার।
- যুগধর্ম্ম নাম প্রেম কৈল পরচার।।
- সেই ভাবে নিজ বাঞ্ছা করিল পূরণ।
- অবতারের এই বাঞ্ছা মূল যে কারণ।।
- শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য-গোঁসাঞি ব্রজেন্দ্র-কুমার।
- রসময় মূর্ত্তি কৃষ্ণ-সাক্ষাৎ শৃঙ্গার।।
- সেই রস আস্বাদিতে কৈল অবতার।
- আনুষঙ্গে কৈল সব রসের প্রচার।।
- তথাহি - শ্রীগীতগোবিন্দে ১ম সর্গে ১২ শ্লোকে শ্রীজয়দেববাক্যম্
- বিশ্বেসামনুরঞ্জনেন জনয়-
- নন্নানন্দমিন্দীবর-
- শ্রেণী-শ্যামলকোমলৈরুপনয়-
- ন্নঙ্গৈরনঙ্গোৎসবম্।
- স্বচ্ছন্দং ব্রজসুন্দরীভিরভিতঃ
- প্রত্যঙ্গমালিঙ্গিতঃ
- শৃঙ্গারঃ, সখি মূর্ত্তিমানিব মধৌ
- মুগ্ধো হরিঃ ক্রীড়তি।।৪৪
- ব্যঞ্জনাদির দ্বারা অন্নের যেরূপ স্বাদ বৃদ্ধি হয়, সেইরূপ শ্রীকৃষ্ণের অন্য গোপিকাগণ-সঙ্গ দ্বারা শ্রীরাধা সহ ক্রীড়ারসের স্বাদুতা বৃদ্ধি হয়।
অনুবাদ।- হে সখি, অনুরঞ্জনেন (হে সখি! অনুরঞ্জনের দ্বারা বা অধিকতর প্রীতিদানের দ্বারা) বিশ্বেসাং (তাঁহাদিগের সকলের) আনন্দং জনয়ন্ (আনন্দ জন্মাইয়া) ইন্দীবরশ্রেণীশ্যামলকোমলৈঃ অঙ্গৈঃ অনঙ্গোৎসবং স্বচ্ছন্দম্ উপনয়ন্ (এবং নীলকমলতুল্য শ্যামবর্ণ কোমল অঙ্গসমূহের দ্বারা স্বচ্ছন্দে অনঙ্গ উৎসব সম্পাদনপূর্ব্বক) ব্রজসুন্দরীভিঃ অভিতঃ প্রত্যঙ্গম্ আলিঙ্গিতঃ মুগ্ধঃ হরিঃ মূর্ত্তিমান্ শৃঙ্গারঃ ইব (ব্রজসুন্দরীদিগের দ্বারা প্রতি অঙ্গে আলিঙ্গিত হইয়া মূর্ত্তিমান্ শৃঙ্গাররসের ন্যায় মুগ্ধ হরি) মধৌ ক্রীড়তি (বসন্তকালে ক্রীড়া করিতেছেন)।
অন্বয়ঃ।- সমস্ত গোপীদের অনুরঞ্জন করছেন শ্রীকৃষ্ণ - সুনীল পদ্মের মতন তাঁর কোমল ও শ্যামল অঙ্গ দিয়ে ইচ্ছামত অনঙ্গ উৎসব জাগিয়েছেন চার পাশের ব্রজরূপসীদের মধ্যে। তারা তাঁকে অঙ্গে অঙ্গে আলিঙ্গন করছে। সখি! মূর্ত্তিমান্ শৃঙ্গারের মতন মধুমাসে মুগ্ধ শ্রীকৃষ্ণ ক্রীড়ায় মত্ত হয়েছেন।।৪৪।।
- শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য গোঁসাঞি রসের সদন।
- অশেষ বিশেষে কৈল রস আস্বাদন।।
- সেই দ্বারে (১) প্রবর্ত্তাইল কলিযুগ ধর্ম্ম।
- চৈতন্যের দাসে জানে সেই সব মর্ম্ম।।
- অদ্বৈত আচার্য্য নিত্যানন্দ শ্রীনিবাস।
- গদাধর দামোদর মুরারি হরিদাস।।
- আর যত চৈতন্যকৃষ্ণের ভক্তগণ।
- ভক্তিভাবে শিরে ধরি সবার চরণ।।
- ষষ্ঠ শ্লোকের এই কহিল আভাস।
- মূল শ্লোকের অর্থ শুন করিয়ে প্রকাশ।।
(১) 'সেই দ্বারে' - মধুর-রসাস্বাদন দ্বারা।
- তথাহি - শ্রীস্বরূপগোস্বামিনঃ শ্লোকঃ।
- শ্রীরাধায়াঃ প্রণয়মহিমা কীদৃশো বানয়ৈবা-
- স্বাদ্যো যেনাদ্ভুতমধুরিমা কীদৃশো বা মদীয়ঃ।
- সৌখ্যঞ্চাস্যা মদনুভবতঃ কীদৃশৎ বেতি-
- লোভাত্তদ্ভাবাঢ্যঃ সমজনি শচীগর্ভসিন্ধৌ হরীন্দুঃ।।৪৫
এই শ্লোকের অন্বয় ও অনুবাদ ১ম পরিচ্ছেদে ৬ষ্ঠ শ্লোকে দ্রষ্টব্য।।৪৫।।
- এ সব সিদ্ধান্ত গূঢ় কহিতে না জুয়ায়।
- না কহিলে কেহ ইহার অন্ত নাহি পায়।।
- অতএব কহি কিছু করিঞা নিগূঢ় (২)।
- বুঝিবে রসিক ভক্ত না বুঝিবে মূঢ়।।
- হৃদয়ে ধরয়ে যে চৈতন্য নিত্যানন্দ।
- এ সব সিদ্ধান্তে সেই পাইবে আনন্দ।।
- এ সব সিদ্ধান্ত-রস আম্রের পল্লব (৩)।
- ভক্তগণ কোকিলের সর্ব্বদা বল্লভ (৪)।।
- অভক্ত উষ্ট্রের ইথে না হয় প্রবেশ (৫)।
- তবে চিত্তে হয় মোর আনন্দ বিশেষ।।
- যে লাগি কহিতে ভয় সে যদি না জানে।
- ইহা বই কিবা সুখ আছে ত্রিভুবনে।।
- অতএব ভক্তগণে করি নমস্কার।
- নিঃশঙ্কে কহিয়ে সভার হউক চমৎকার।।
- কৃষ্ণের বিচার এক আছয়ে অন্তরে।
- পূর্ণানন্দ পূর্ণরস-স্বরূপ কহে মোরে।।
- আমা হৈতে আনন্দিত হয় ত্রিভুবন।
- আমাকে আনন্দ দিবে ঐছে কোন্জন।।
- আমা হইতে যার হয় শত শত গুণ।
- সেইজন আহ্লাদিতে পারে মোর মন।।
- আমা হৈতে গুণী বড় (৬) জগতে অসম্ভব।
- একলি রাধাতে তাহা করি অনুভব।।
- কোটি কাম জিনি রূপ যদ্যপি আমার।
- অসমোর্দ্ধ (৭) মাধুর্য্য সাম্য নাহি যার।।
(২) 'করিঞা নিগূঢ়' - গোপন করিয়া।
(৩) 'আম্রের পল্লব' - আম্রমুকুল।
(৪) 'বল্লভ' - প্রিয়।
(৫) উষ্ট্রের রসনায় আম্রমুকুলের আস্বাদ গ্রহণ করিবার শক্তি নাই, কিন্তু কণ্টকচর্ব্বণে মুখ ক্ষত হইলেও উষ্ট্র তাহা ত্যাগ করিতে পারে না। এইরূপ অভক্তগণের হৃদয়ে ভক্তিরসের আস্বাদনের শক্তি নাই, তাহাদের হৃদয় নানা দুর্ব্বাসনায় সর্ব্বদা ব্যথিত, তথাপি তাহা ত্যাগ করিতে পারে না বলিয়া কবিবর উষ্ট্রের সঙ্গে অভক্তের তুলনা দিলেন।
(৬) 'গুণী বড়' - রূপাদি মাধুর্য্য-গুণে অধিক।
(৭) অসমোর্দ্ধ - যাহার সমান এবং যাহা হইতে অধিক নাই।
- মোর রূপে আপ্যায়িত করে ত্রিভুবন।
- রাধার দর্শনে মোর জুড়ায় নয়ন।।
- মোর বংশী-গীতে আকর্ষয়ে ত্রিভুবন।
- রাধার বচনে হরে আমার শ্রবণ।।
- যদ্যপি আমার গন্ধে জগৎ সুগন্ধ।
- মোর চিত্ত প্রাণ হরে রাধা অঙ্গ গন্ধ।।
- যদ্যপি আমার রসে জগৎ সরস।
- রাধার অধর রসে আমা করে বশ।।
- যদ্যপি আমার স্পর্শ কোটীন্দু শীতল (১)।
- রাধিকার স্পর্শে আমা করে সুশীতল।।
- এইমত জগতের সুখে আমি হেতু।
- রাধিকার রূপগুণ আমার জীবাতু (২)।।
- এই মত অনুভব আমার প্রতীত।
- বিচারি দেখিয়ে যদি সব বিপরীত।।
- রাধার দর্শনে মোর জুড়ায় নয়ন।
- আমার দর্শনে রাধা সুখে আগেয়ান।।
- পরস্পর বেণু-গীতে হরয়ে চেতন (৩)।
- মোর ভ্রমে তমালেরে করে আলিঙ্গন।।
- কৃষ্ণ আলিঙ্গন পাইনু জনম সফলে।
- সেই সুখে মগ্ন রহে বৃক্ষ করি কোলে।।
- অনুকূল বাতে (৪) যদি পায় মোর গন্ধ।
- উড়িয়া পড়িতে চাহে প্রেমে হঞা অন্ধ।।
- তাম্বূল চর্ব্বিত যবে করে আস্বাদনে।
- আনন্দ সমুদ্রে মগ্ন কিছুই না জানে।।
- আমার সঙ্গমে রাধা পায় যে আনন্দ।
- শত মুখে কহি যদি নাহি পাই অন্ত।।
(১) 'কোটীন্দু শীতল' - কোটী চন্দ্র হইতেও স্নিগ্ধ।
(২) 'জীবাতু' - জীবনৌষধি।
(৩) 'পরস্পর ...... চেতন' - শ্রীরাধিকার আমাতে এতই প্রীতি যে, আমি যে বেণুবাদ্য করিয়া থাকি, সেই বেণু জাতি অর্থাৎ বেড়্বাঁশের ঝাড়ে পরস্পর সঙ্ঘর্ষণে যে শব্দ হয়, তৎশ্রবণে তাঁহার চৈতন্য থাকে না। সাক্ষাৎ বেণুরবের কথা আর কি বলিব?
(৪) 'অনুকূল বাতে' - শ্রীকৃষ্ণের দিক্ হইতে শ্রীরাধার দিকে যে বায়ুপ্রবাহ আসে তাহাতে।
- লীলা অন্তে (৫) সুখে ইঁহার যে অঙ্গ-মাধুরী।
- তাহা দেখি সুখে আমি আপনা পাসরি।।
- দোঁহার যে সম রস ভরত-মুনি মানে।
- আমার ব্রজের রস সেই নাহি জানে।।
- অন্যোন্য সঙ্গমে আমি যত সুখ পাই।
- তাহা হৈতে রাধা-সুখ শত অধিকাই (৬)।।
(৫) 'লীলা অন্তে' - নির্জ্জনে কৃত লীলার শেষে।
(৬) রসশাস্ত্রের আদিগুরু ভরত মুনির মতে অনুরাগযুক্ত নায়ক নায়িকার পরস্পরের সঙ্গমে উভয়েরই সমান সুখ হয়। কিন্তু ব্রজলীলার নায়ক শ্রীকৃষ্ণ ও নায়িকা শ্রীরাধিকার সুখ সমান হয় না; পরন্তু শ্রীরাধিকার সুখ বহুপরিমাণে অধিক হয়।
কংসহরস্য (শ্রীকৃষ্ণস্য) রূপে লব্ধনয়নাং (কংসহর শ্রীকৃষ্ণের রূপের মাধুর্য্যে তোমার নয়ন লব্ধ) 'শ্রীকৃষ্ণস্য' স্পর্শে অতিহৃষ্যত্ত্বচম্ (শ্রীকৃষ্ণের স্পর্শে তুমি অতিশয় আনন্দে রোমাঞ্চগাত্রী), ' শ্রীকৃষ্ণস্য' বাণ্যাম্ উৎকলিতশ্রুতিং (তাঁহার বাণী শুনিতে তোমার কর্ণ উৎকণ্ঠিত) 'শ্রীকৃষ্ণস্য' পরিমলে সংহৃষ্টনাসাপুটাং (তাঁহার অঙ্গগন্ধে তোমার নাসাপুট অতিশয় প্রফুল্ল) 'শ্রীকৃষ্ণস্য' অধররসে আরজ্যদ্রসনাং (তাঁহার অধর-সুধা-পানে তোমার রসনা অতিশয় অনুরাগুক্তা) ন্যঞ্চন্মুখাম্ভোরুহাং (তোমার মুখপদ্ম লজ্জায় নম্র) বহিরপি দম্ভোদ্গীর্ণমহাধৃতিং প্রোদ্যদ্বিকারাকুলাম্ (তুমি কপট মহা ধৈর্য্যশালিনী হইলেও বাহিরের স্পষ্ট বিকার দ্বারা আকুলা) 'রাধাম্ আলোকয়ম্' (সেই তোমাকে আমি স্মরণ করিতেছি)।
অনুবাদ।- হে কল্যাণি! তোমারি বিম্বাধর অমৃতের মাধুর্য্যপরিমলকেও জয় করেছে; জয় করেছে তোমার মুখ পদ্মের সৌরভকে, কোকিলের কাকলির গৌরবকে জয় করেছে তোমার বাণী। অঙ্গ তোমার চন্দনের চেয়ে শীতল, তনু তোমার সর্ব্বসৌন্দর্য্যময়। রাধে! তোমার সঙ্গে মিলনে আমার ইন্দ্রিয়কুল আকুল হয়ে অনুক্ষণ আনন্দিত।
কৃষ্ণের রূপে রাধার নয়ন লব্ধ, স্পর্শে ত্বক্ রোমাঞ্চিত, কথায় শ্রবণ ব্যাকুল, সৌরভে নাসা আনন্দে বিভোর, অধররসে রসনা প্রলোভিত। তবু তিনি কপটছলে কোনোমতে মুখপদ্ম নত করে গর্ব্বভরে মনোভাব গোপন করেছেন কিন্তু দেহের বিকারে আকুলা হ'য়ে আছেন।।৪৬-৪৭।।
- তাতে জানি মোতে আছে কোন একরস।
- আমার মোহিনী রাধা তারে করে বশ।।
- আমা হৈতে রাধা পায় যে জাতীয় সুখ।
- তাহা আস্বাদিতে আমি সদাই উন্মুখ।।
- নানা যত্ন করি আমি নারি আস্বাদিতে ।
- সে সুখ মাধুর্য্য ঘ্রাণে লোভ বাড়ে চিত্তে।।
- রস আস্বাদিতে আমি কৈল অভতার।
- প্রেমরস আস্বাদিল বিবিধ প্রকার।।
- রাগমার্গে ভক্ত ভক্তি করে যে প্রকারে।
- তাহা শিখাইল লীলা আচরণ দ্বারে।।
- এই তিন তৃষ্ণ মোর নহিল পূরণ।
- বিজাতীয় (১) ভাবে নহে তাহা আস্বাদন।।
- রাধিকার ভাব-কান্তি অঙ্গীকার বিনে।
- সেই তিন সুখ কভু নহে আস্বাদনে।।
- রাধাভাবে অঙ্গীকরি ধরি তার বর্ণ।
- তিন সুখ আস্বাদিতে হব অবতীর্ণ।।
- সর্ব্বভাবে কৈল কৃষ্ণ এইত নিশ্চয়।
- হেনকালে আইল যুগাবতার সময়।।
- সেইকালে শ্রীঅদ্বৈত করেন আরাধন।
- তাঁহার হুঙ্কারে কৈল কৃষ্ণ আকর্ষণ।।
- পিতা মাতা গুরুগণে আগে অবতারি।
- রাধিকার ভাব-বর্ণ অঙ্গীকার করি।।
- নবদ্বীপে শচী-গর্ভ শুদ্ধ দুগ্ধসিন্ধু।
- তাহাতে প্রকট হৈলা কৃষ্ণ পূর্ণ ইন্দু।।
- এইত করিল ষষ্ঠ শ্লোকের ব্যাখ্যান।
- স্বরূপ গোঁসাঞির পাদপদ্ম করি ধ্যান।।
- এই দুই শ্লোকের আমি যে করিলু অর্থ।
- শ্রীরূপ গোঁসাঞির শ্লোক প্রমাণ সমর্থ।।
(১) 'বিজাতীয় ভাব' - শ্রীরাধার ভাব ব্যতীত অন্য জাতীয় ভাব।
- তথাহি - স্তবমালায়াং ২য়ে স্তবে ৩ শ্লোকঃ
- অপারং কশ্যাপি প্রণয়িজনবৃন্দস্য কুতুকী
- রসস্তোমং হৃত্বা মধুরমুপভোক্তুং কমপি যঃ।
- রুচং স্বামাবব্রে দ্যুতিমিহ তদীয়াং প্রকটয়ন্
- স দেবশ্চৈতন্যাকৃতির তিতরাং নঃ কৃপয়তু।।৪৮
এই শ্লোকের অন্বয়ঃ ও অনুবাদ ৪র্থ পরিচ্ছেদে ৭ম শ্লোকে দ্রষ্টব্য।।৪৮।।
- মঙ্গলাচরণং কৃষ্ণ-চৈতন্যতত্ত্বলক্ষণম্।
- প্রয়োজনঞ্চাবতারে শ্লোকষট্কৈর্নিরূপিতম্।।৪৯
অনুবাদ।- ছটি শ্লোকে নির্ণীত হল মঙ্গলাচরণ শ্রীকৃষ্ণ-চৈতন্যলক্ষণ এবং অবতারের প্রয়োজন।।৪৯।।
- শ্রীরূপ রঘুনাথ পদে যার আশ।
- চৈতন্যচরিতামৃত কহে কৃষ্ণদাস।।
ইতি শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে আদিলীলায়াং চৈতন্যাবতার-মূল-প্রয়োজনকথনং নাম চতুর্থঃ পরিচ্ছেদঃ।