ব্রজবিলাস/তৃতীয় উল্লাস

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় উল্লাস।


কিছু দিন হইল, নলডাঙ্গার চেঙনা রাজা বিধবার বিবাহ দিতে আরম্ভ করিয়াছেন। বিধবাবিবাহ শাস্ত্রনিষিদ্ধ কর্ম ও দেশাচারবিরুদ্ধ ধর্ম্ম; তিনি সে বিষয়ে হাত দিয়াছেন; এজন্য, তাঁহাকে জব্দ করা আবশ্যক বিবেচনা করিয়া, শ্রীমতী যশোহরহিন্দুধর্ম্মরক্ষিণী সভার ধর্ম্মপরায়ণ বিচক্ষণ সভ্য মহোদয়েরা, নবদ্বীপের প্রধান স্মার্ত্ত শ্রীমান্ ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন প্রভৃতি লম্বোদর খুড় মহাশয়দিগকে, সভায় আহ্বান করিয়াছিলেন। বিদ্যারত্ন খুড়, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসিদ্ধ নহে, এই মর্মে এক ব্যবস্থা লিখিয়া, সমবেত সভ্যগণ সমক্ষে, পাঠ করিয়াছেন। ঐ ব্যবস্থা দেখিয়া, আমি যৎপরোনাস্তি আহলাদিত ও চমৎকৃত হইয়াছি। ব্যবস্থা দিবার সময় বচন কচন দেখা যায় না, পূর্ব্বে তাঁহার চাঁদমুখে এই যে অতি প্রশংসনীয় কমনীয় সাধু ভাষা শুনিয়াছিলাম, ঐ ব্যবস্থা সর্ব্বাংশে তদনুষায়িনী হইয়াছে, ইহা দেখাইবার নিমিত্তই, আমার এই উদ্যোগ ও আড়ম্বর।

 সর্ব্বপ্রধান সমাজের সর্ব্বপ্রধান স্মার্ত্ত শ্রীমান্ বিদ্যারত্ন খুড়, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রবিরুদ্ধ কর্ম্ম, ইহা প্রতিপন্ন করিবার নিমিত্ত, কোমর বাঁধিয়াছেন। এ বিষয়ে বিদ্যাসাগরের প্রচারিত পুস্তক খানি, একবার, মন দিয়া, আগাগোড়া দেখা তাঁহার পক্ষে নিতান্ত আবশ্যক ছিল। ইহা যথার্থ বটে বিদ্যাসাগর, তাঁহাদের মত, বেহুদা পণ্ডিত নহেন; তাঁহাদের মত, বেয়াড়া ধৰ্মনিষ্ঠ নহেন; তাঁহাদের মত, সাধুসমাজের অনুগতও আজ্ঞানুবর্ত্তী নহেন; তাঁহাদের মত, সাধুসমাজের অভিমত নির্ম্মল সনাতন ধর্ম্মের রক্ষা বিষয়ে তৎপর ও অগ্রসর নহেন। এমন কি, পবিত্র সাধুসমাজের প্রাতঃ স্মরণীয়, বহুদর্শী, বিচক্ষণ চাঁই মহোদয়েরা তাঁহাকে খৃষ্টান পর্যন্ত বলিয়া থাকেন। সুতরাং, তিনি শ্রীমান্ ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন খুড় প্রভৃতি, সাধুসমাজে প্রতিষ্ঠিত, মহামহোপাধ্যায়, মহাপুরুষদিগের সঙ্গে গণনীয় হইবার যোগ্য ব্যক্তি নহেন। কিন্তু, ইহাও দেখিতে ও শুনিতে পাওয়া যায়, বিদ্যাসাগর লিখিতে পড়িতে এক রকম বেস মজবুত; যখন যাহা লিখেন, তাহা সহসা কেহ অগ্রাহ্য করিতে পারেন না। যাঁহাদিগকে সকলে, বাস্তবিক ভাল লোক বলিয়া, প্রশংসা করিয়া থাকেন, তাদৃশ পণ্ডিতগণের মুখে শত সহস্র বার শুনিয়াছি, বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ বিষয়ে যে পুস্তক লিখিয়াছেন, তাহাতে দোষারোপ করিবার পথ নাই। বিদ্যারত্নের ব্যবস্থা দেখিয়া, স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে, ঐ অপবিত্র পুস্তক, কস্মিন্ কালেও, তাঁহার পবিত্র দৃষ্টিপথে পতিত হয় নাই। অথবা, তিনি সর্ব্বপ্রধান সমাজের সর্ব্বপ্রধান স্মার্ত্ত। স্মৃতি শাস্ত্রে তাঁহার অবিদিত কি আছে। সমুদায় স্মৃতি শাস্ত্র, তাঁহার দিব্য চক্ষুর উপর, সর্ব্ব ক্ষণ, নৃত্য করিতেছে। এমন স্থলে, স্মৃতি শাস্ত্র সংক্রান্ত কোনও বিষয়ে, বিদ্যাপ্রকাশ আবশ্যক হইলে, বিদ্যাসাগরের পুস্তক চুলায় যাউক, কোনও পুস্তক দেখিবার কোনও দরকার করে না। ধন্য সর্ব্বপ্রধান সমাজ নবদ্বীপ! ধন্য ক্ষণজন্মা ব্রজনাথ! ধন্য দেবদুর্লভ বিদ্যারত্ন উপাধি!

 আমি, এ যাত্রায়, শ্রীমান্ বিদ্যারত্ন খুড়র সঙ্গে রীতি মত বিচার করিতে প্রবৃত্ত নহি। যদি কোনও মুখআলগা লোক, অগ্র পশ্চাৎ না ভাবিয়া, অম্লান বদনে, বলিয়া বসেন, তবে তুমি ভয় পাইয়াছ। তাঁহার প্রতি আমাযর বক্তব্য এই, আমি বড় ডাঙপিটে, কোনও কারণে ভয় পাইবার ছেলে নই। উপযুক্ত ভাইপো, খুড়র সঙ্গে, বিচার করিতে পিছপাঁও হইবেন, যদি কেহ, ভুল ভ্রান্তিতেও, সেরূপ ভাবেন, তিনি যত বড় ধনী, যত বড় মানী, যত বড় বিদ্বান্, যত বড় বুদ্ধিমান্, যত বড় হাকিম, যত বড় আমলা, যত বড় তেঁদড়া, যত বেদড়া বেড় হউন না কেন, তাঁহার মনোহর গাল, বসরাই গোপাপের মত টুকটুকেই হউক, আর রামছাগলের মত চাঁপদাড়িতে সুসজ্জিত ও সুশোভিতই হউক, ঠাস ঠাস করিয়া, দশ বার জোড়া চড় মারিয়া, সেই বেআদবকে, চিরকালের জন্যে, দুরন্ত করিয়া দিব। ইহার জন্যে যদি, শ্রীমতী যশোহরহিন্দুধর্মরক্ষিণী সভা দেবীর সূক্ষ্ম বিচারে, ও অকাট্য ফয়তা অনুসারে, ক্রমান্বয়ে ছয় মাস, ফাঁসি যাইতে হয়, তাহাও মঞ্জর। আমি যে কেবল মুখে আক্ষালন করিতেছি, কেহ যেন তাহা না ভাবেন। ইতিপূর্ব্বে, শ্রীমান্ তর্কবাচস্পতি খুড়র সঙ্গে কেমন হুড়হুড়ি করেছি, তাহা কি আপনারা জানেন না, না কখনও শুনেন নাই। এ যাত্রায়, খুড়র কাছে দুই চারিটি প্রশ্ন করিব। ঐ সকল প্রশ্নের উত্তর পাইলে; রীতিমত বিচারে প্রবৃত্ত হইব। যদি উপেক্ষা করিয়া, অথবা ভয় পাইয়া, অথবা আর কোনও নিগুঢ় কারণের বশবর্ত্তী হইয়া, খুড় মহাশয় উত্তর দানে বিমুখ হন, দুও দুও বলিয়া, হাততালি দিয়া, ইয়ারবর্গ লইয়া, কিয়ৎ ক্ষণ, আনন্দ মৃত্য করিব পরে, রীতিমত বিচারে প্রবৃত্ত হইয়া, মড় মড় করিয়া, খুড়র ঘাড় ভাঙিয়া ফেলিব।

 যদি বলেন, খুড়র ঘাড় ভাঙিলে, খুড় মরিয়া যাইবেন। তাহার উত্তর এই, খুড়র ঘাড় বড় মজবুদ, সহজে ভাঙে, কার সাধ্য। আর, যদি ভাঙিয়াই যায়, তাহাতে আমি নাচার। আমি মনকে বুঝাইব, খুড়র কপালে লেখা ছিল, উপযুক্ত ভাইপোর হস্তে সদগতি হইবেক, তাহাই ঘটিয়াছে; বিধিনির্ব্বন্ধ অতিক্রম করে, কার সাধ্য। আর, ইহাও বুঝিয়া দেখা আবশ্যক, যদি, ভাগ্য ক্রমে, উপযুক্ত ভাইপোর চেষ্টা ও যত্নে, খুড়র সদগতিলাভ হয়, তাহাতে উতয়েরই প্রশংসা, উভয়েরই জন্ম সার্থক। যদি বলেন, খুড়র ঘাড় ভাঙ্গিলে তোমার পাপ জন্মিবে। তাহার উত্তর এই, পাপের জন্য আমার তত দুর্ভাবনা নাই। এ দেশে কোন কর্ম্ম করিলে, পাপস্পর্শ বা জাতিপাত ঘটিয়া থাকে। ছেলে ৰেলায়, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের এবং পবিত্র-সাধুসমাজের বিচক্ষণ বহুদর্শা চাঁই মহোদেয়দিগের মুখে, কখনও কখনও শুনিতাম, অপেয়পানে, অতক্ষভক্ষণে, অগম্যাগমনে পাপম্পৰ্শ ও জাতিপাত হয়। এখন, সে সকল কথা ভণ্ডামি বা প্রতারণা, অথবা মিছা ভয় দেখান বা পরিহাস করা মাত্র বোধ হইতেছে। পাপজনক রা জাতিপাতকর হইলে, এ দেশের বিশুদ্ধ সাধুসমাজে, ঐ সকল কর্ম্মের অনুষ্ঠান বা অনুমোদন চর্ম্মচক্ষে দেখা যাইত না। সচরাচর দৃষ্ট হইতেছে, সুরাপানে পাপ ও জাতিপাত হেইতেছে না; সাহেবদের মত খানা খাইলে পাপস্পর্শ ও জাতিপাত হইতেছে না; বিষয়াপন্ন লোকে, গাড়ীতে হাড়ি ও মুসলমান পাচক নিযুক্ত করিয়া, গোমাংস, শূকরমাংস প্রভৃতি বিশুদ্ধ বস্তু পাক করাইয়া খাইলে, পাপস্পর্শ ও জাতিপাত হইতেছে না; বেশ্যালয়ে, সদ্য মাংস সেবন পুর্ব্বক, আমোদ আহলাদ করিয়া, রাত্রি কাটাইলে, পাপস্পর্শ ও জাতিপাত হইতেছে না। ফলকথা এই, এ দেশে অপেয়পানে, অভক্ষ্যভক্ষণে, অগম্যাগমনে পাপস্পর্শ ও জাতিপাত হয়, তাহার কোনও নজির বা নিদর্শন পাওয়া যায় না[১]। এমন স্থলে, উপযুক্ত ভাইপো খুড়র ঘাড় ভাঙিলে, পাপস্পর্শ বা জাতিপাত হইবেক, ইহা, কোনও ক্রমে, আমার, অন্তঃকরণে লইতেছে না। যদিই, উপযুক্ত ভাইপোর কপালগুণে, খুড়র ঘাড় ভাঙিলে পাপস্পর্শ ও জাতিপাত ঘটে, তাহার কি আর নিষ্কৃতি নাই। খুড়র ঘাড় ভাঙিলে, হয় গোহত্যার, নয় ব্রহ্মহত্যার, পাতক হইবেক। শুনিয়াছি, এ উভয়েরই যথোপযুক্ত প্রায়শ্চিত্তবিধান আছে। যদি স্পষ্ট বিধান না থাকে, বিদ্যাবাগীশ খুড় মহাশয়েরা চিরঞ্জীবী হউন, মনের মত তৈলবট সামনে ধরিলে, তাঁহারা একবারে অসামাল ও দিগ্বিদিক‍্জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়িবেন, এবং প্রফুল্ল চিত্তে, হয় বচন গড়িয়া, নয় মজুদ বচনের ঘাড় ভাঙিয়া, অম্লান বদনে, নিখরকিচ ব্যবস্থা লিখিয়া দিবেন; তাহা হইলেই, সাধুসমাজে আর কোনও ওজর আপত্তি থাকিবেক না।

 এ স্থলে উল্লেখ করা নিতান্ত আবশ্যক, ‘এ দেশে কোন কর্ম্ম করিলে; পাপস্পর্শ ও জাতিপাত হইয়া থাকে’, ইতিপূর্ব্বে, সামান্যকারে, এই যে নির্দ্দেশ করিয়াছি, তাহা প্রকৃত প্রস্তাবে ঠিক হয় নাই। কারণ, বিধবা বিবাহ দিলে, বিধবা বিবাহ করিলে, অথবা বিধবাবিবাহের সংশ্রবে থাকিলে, পাপস্পর্শ ও জাতিপাত হইয়া থাকে। এজন্যই, তাদৃশ ব্যক্তিরা পবিত্র সাধুসমাজে পরিগৃহীত হইতেছে না। সাধুসমাজ কাহাকে বলে, ঘটকচূড়ামণি শ্রীমান্ জনমেজয় বিদ্যাবাগীশ খুড়কে জিজ্ঞাসা করিলে, সবিশেষ জানিতে পারিবেন। যদি বলেন, ইনি কে। ইনি এক্ষণে শ্রীমতী যশোহরহিন্দুধর্ম্মরক্ষিণী সভা দেবীর এক প্রধান নায়ক। আগে, ইঁহাকে, এক জন আধকামারিয়া উকীল বলিয়া জানিতাম; এখন দেখিতেছি, ইনি সর্ব্ব শাস্ত্রের অদ্বিতীয় ভূঁইফোঁড় মীমাংসাকর্ত্তা; শ্রীমান্ ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন, তথা শ্রীমান্ ভুবনমোহন বিদ্যারত্ন, তথা শ্রীমান্ রামধন তর্ক পঞ্চানন প্রভৃতি প্রসিদ্ধ প্রাচীন খুড় মহাশয়েরা আর ইঁহার কাছে কলিকা পান না।

কালে ক্কিং বা ন দৃশ্যতে।
কালে কি বা না দেখা যায়।

 যাহা হউক, এই প্রশংসনীয় দেশের অতি প্রশংসনীয় সাধুসমাজের অভিমত, নিরতিশয় প্রশংসনীয়, নির্মল, সনাতন ধর্ম্মের অপার মহিমা!!! বোধ করি, এমন নিরেট, টনটনিয়া, নিখিরকিচ ধর্ম্ম ভুমণ্ডলে আর নাই। ইঁহার ক্ষমাগুণ ও হজমশক্তি অতি অদ্ভুত। ইনি অপেয়পান, অভক্ষ্যভক্ষণ, অগম্যাগমন. প্রভৃতি অনায়াসে ক্ষমা করিতেছেন, হজম করিতেছেন। এইরূপ অদ্ভূতক্ষমতাশালী হইয়াও, কি কারণে ঠিক বলিতে পারি না, কেবল একটি অকিঞ্চিৎকর বিষয়ে, অর্থাৎ বিধবাবিবাহে, ইনি কিঞ্চিত অংশে দুর্ব্বলতা ও অক্ষমতা দেখাইতেছেন। ইহাতে কেহ কেহ বলিতে পারেন, সাধুসমাজের অভিমত নির্ম্মল সনাতন ধৰ্ম লোক ভাল, তার সন্দেহ নাই। কিন্তু, তিনি বড় পক্ষপাতী; পুরুষজাতির উপর, তিনি যত সদয়, স্ত্রীজাতির উপর, তিনি তত সদয় নহেন। আমার বিবেচনায় কিন্তু, তাঁহার উপর এ অপবাদ প্রবর্ত্তিত হইতে পারে না। কারণ, তিনি স্ত্রীজাতির উপরেও বেয়াড়া সদয়। দিব্য চক্ষে ঘর ঘর দেখিয়া লও, তিনি স্ত্রীজাতির ব্যভিচার, ভ্রূণহত্যা, বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন প্রভূতি, অকাতরে, বিনা ওজরে, ক্ষমা করিতেছেন, হজম করিতেছেন। তবে, তাহাদের পুনর্ব্বার বিয়ে, যে যৎকিঞ্চিৎ গোলযোগ করিতেছে, তাহা, ধরাধরি করিতে গেলে, একপ্রকার দোষের কথা বটে। আমি কিন্তু, এই সামান্য দোষ ধরিয়া, তাঁহার উপর রুষ্টিতে চাই না। কারণ, ইহা সর্ব্ববাদিসম্মত স্থির সিদ্ধান্ত

এক আধারে সকল গুণ বর্তে না;

এবং সুপ্রসিদ্ধ বিচারসিদ্ধ কথাও আছে,

গাধা সকল আর বইতে পারেন,
কেবল ভাতের কাঠিটি সইতে পারেন না।

এই সমস্ত অনুধাবন করিয়া দেখিলে, সাধুসমাজের অভিমত নির্ম্মল সনাতন ধর্ম্মের এই আংশিক দুর্ব্বলতা বা পক্ষপাতিতা দেখিয়া, অসন্তুষ্ট হওয়া কদাচ উচিত নহে। এ দেশের সাধুসমাজের সম্বুদ্ধি, সদ্বিবেচনা, সৎপ্রবৃত্তি প্রভৃতির পূর্ব্বপর যেরূপ অপুর্ব্ব পরিচয় পাওয়া যাইতেছে, এবং, সেই প্রশংসনীয় সাধুসমাজের অভিমত নির্ম্মল সনাতন ধর্ম্মের অপার মহিমা, অহরহঃ, যেরূপ প্রত্যক্ষ হইতেছে, তাহাতে এ উভয়কে যুক্তকণ্ঠে অকপট সাদুবাদ প্রদান করা সর্ব্বদেশীয় সর্ব্ববিধ ব্যক্তি মাত্রের সর্ব্বতোভাবে অবশ্যকর্ত্তব্য কর্ম্ম; যিনি না করিবেন, তিনি, শ্রীমর্তী যশোহরহিন্দুধর্ম্মরক্ষিণী সভা দেবীর অকাট্য কয়তা অনুসারে,ধর্ম্মদ্বারে পতিত হইবেন।

 যাঁহারা আমাকে জানেন, তাঁহারা মনে করেন, আমি বড় চতুর, চালাক, বুদ্ধিক্ষ্ণীবী জন্তু। তাঁহারা কেন আমাকে ওরূপ ভাবেন, তা আমি ঠিক জানি না। বোধ হয়, আমি বড় ফাজিলচালাক, তাঁহাদের চক্ষে ধুলিপ্রক্ষেপ করিয়া, অন্ধ করিয়া রাখিয়াছি, তাই তাঁহারা ওরূপ মনে করেন, স্পষ্ট কথা বলিতে গেলে, আমি বিদ্যাবাগীশ খুড়দের মত, গর্দ্দভচুড়ামণি; নতুবা, অকারণে, এত ফেচফেচ করিতেছি ও অগড়ম বগড়ম বকিতেছি কেন। অখবা, যাঁহারা এইরূপ করেন, তাঁহারা, এ দেশের সাধুসমাজে, বড় আদরণীয় ও প্রশংসনীয় হন, ইহা দেখিয়া, বিষম লোভে পড়িয়া, অসামাল হইয়া, এরূপ করিতে আরম্ভ করিয়াছি। শ্রীল যুক্ত ঘটকচূড়ামণি জনমেজয় বিদ্যাবাগীশ খুড় মহাশয় এ বিষয়ের জাজ্বল্যমান জলজিয়ন্ত দৃষ্টান্ত। এই খুড় মহাশয়, বিধাবা বিবাহের অশাস্ত্রীয়তা ও অযৌক্তিকতা বিষয়ে, এক বিচিত্র বক্তৃতা লিখিয়া, শ্রীমতী বশোহরহিন্দুধর্ম্মরক্ষিণী সভা দেবীর চতুর্থ সাংবৎসরিক অধিবেশনে, পাঠ করিয়াছেন। সভাস্থ মহামহোপাধ্যায় বিদ্যাবাগীশের পাল, ঐ বক্তৃতা শ্রবণে মাত হইয়া, ঘটকচুড়ামণিকে শত শত বার ধন্যবাদ ও কপিরত্ন[২] এই উপাধি দিয়াছেন; এবং শ্রীমতী সভা দেবীও, প্রিয়তম নায়কের বক্তৃতারসে গলিয়া গিয়া, দেশের ধর্ম্মরক্ষার দোহাই দিয়া, ঐ অদ্ভূত বক্তৃতা পুস্তকাকারে মুদ্রিত ও প্রচারিত করিয়াছেন। দেখুন, শ্রীমান্ জনমেজয় খুড় মহাশয়, ধর্ম্মশাস্ত্র বিষয়ে, বর্ণজ্ঞানানবচ্ছিন্ন হইয়াও, নিরবচ্ছিন্ন ফেচফেচ ও ফাজিলচালাকি করিয়া, কেমন ধন্যবাদ মারিয়াছেন। ইহা দেখিয়া, লোভসংবরণ করা, যাহাদের ফাজিলচালাকি করা রোগ আছে, তাহাদের পক্ষে, সহজ ব্যাপার নহে। ধন্যবাদের বাজার এত সভা দেখিয়া, কেইবা ফেচফেচ ও ফাজিলচালাকি করিতে ছাড়িবেক।

 যাহা হউক, এরূপ চমৎকারিণী, চিত্তাহারিণী বক্তৃতার সমুচিত সমালোচনা হওয়া, সর্ব্বতোভাবে, উচিত ও আবশ্যক। কিন্তু, এই বিদকুটে সমালোচনা যার তার কর্ম্ম নহে। যেমন গ্রন্থকর্ত্তা, তেমনই সমালোচক চাই। যেমন বুনো ওল, তেমনই বাঘা তেঁতুল, অথবা, সাধুভাষায় বলিতে গেলে, যেমন কুকুর তেমনই মুগুর, না হইলে, বিশিষ্টরূপ ফলদায়ক হইয়া উঠে না। ফলকথা এই, আমার মত ফাজিল, চালাক, হুঁসিয়ার লোক ভিন্ন, অন্য কোনও মহামহোপাধ্যায় এই গ্রন্থের, প্রকৃত প্রস্তাবে, সমালোচনা করিতে পারিবেন, ইহা কোনও মতে সম্ভব নহে। সুতরাং, অগত্যা, আমাকেই এই গ্রন্থের সমালোচনা ব্রতে দীক্ষিত হইতে হইবেক। ইহাতে আমি কিছুমাত্র ক্লেশবোধ ৰা লোকসানজ্ঞান করিব না; কারণ, এই অপূর্ব্ব গ্রন্থের সমলোচনায় প্রবৃত্ত হইলে, যত মজা, যত আমোদ পাইব, বোধ হয়, এ জন্মে আর আমার ভাগ্যে সেরূপ ঘটা সম্ভব নহে। শ্রীমান্ বিদ্যারত্ন খুড়র নিকট যে কয়টি প্রশ্ন করিতেছি, ঐ সকল প্রশ্নের উত্তর পাইলেই, এক ক্ষুরে দুই খুড়র মাখা মুড়াইব; কারণ, দুই খুড়রই বিদ্যাপ্রকাশ একই রকমের। অর্থাৎ,

এ পিঠ ও পিঠ দুই পিঠ সমান।

সুতরাং, এক উদ্যোগেই, উভয় খুড়র সম্মান ও সদগতিদান হইবেক, স্বতন্ত্র অনুষ্ঠানের প্রয়োজন থাকিবেক না।

তেনৈব চ সপিগুত্বৎ তেনৈবাব্দিকমিষ্যতে।

 এক অনুষ্ঠানেই সপিণ্ডীকরণ ও একোদ্দিষ্ট সম্পন্ন হইয়া যায়।

ইতি শ্রীব্রজবিলাসে মহাকাব্যে কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য কৃতৌ

তৃতীয় উল্লাসঃ।

  1. যদি বলেন, এ স্থলে তুমি মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, জুয়াচুরি, বাটপাড়ি, জাল সাক্ষী, জাল মোকদ্দমা, প্রভৃতির উল্লেখ করিলে না কেন। তাহার কারণ এই ঐ সমস্ত, পবিত্র সাধুসমাজের নিরন্তর অনুষ্ঠান ও আন্তরিক অনুমোদন দ্বা রা, বহু কাল হইল, সদাচার বলিয়া প্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছে। ঐ সকল সাধুসমাজসম্মত সদাচারকে যে অর্ব্বাচীন নরাযধম দোষ বলিয়া উল্লেখ করিবেক, তাহার ইহকালও নাই, পরকালও নাই। এবিষয়ে, আমি শ্রীমতী যশোহরহিন্দুধর্ম্মরক্ষিণী সভা দেবীকে সাক্ষিনী করিতেছি।
  2. প্রথম পরিশিষ্ট দেখ।