ব্রজবিলাস/দ্বিতীয় উল্লাস

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় উল্লাস।


শুনিয়াছিলাম, নবদ্বীপ গৌড় দেশের সর্ব্বপ্রধান সমাজ। মা ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন খুড় সেই সর্বপ্রধান সমাজের সর্বপ্রধান আর্ত্ত। সুতরাং, এ দেশে, স্মৃতিশাস্ত্র বিষয়ে, বিদ্যারত্ন খুড়র জুড়ি নাই। তিনি যে ব্যবস্থা দেন, তাহা, বেদবাক্যের ন্যায়, অভ্রান্ত ও অকাট্য; কেহ, সাহস করিয়া, তাহাতে দোষারোপ করিতে অগ্রসর হয় না। তাঁহার বিষয়ে অনেক প্রশংসার কথা শুনিতাম। এবং, শুনিয়া গুনিয়া, তাঁহার উপর বেয়াড়া ভক্তি জন্মিয়াছিল। কিন্তু, কখনও তাঁহাকে পাপচক্ষে নিরীক্ষণ করি নাই। এজন্য, সদা সর্ব্বাদা মতলব কৱিতাম, যেরূপে পারি, একবার শ্রীমান্ নদিয়ার চাঁদকে নয়নগোচর করিয়া, মানবজন্ম সফল করিব। দৈবযোগে, এক দিন, অশুভ ক্ষণে, বিনা চেষ্টায়, তাঁহাকে দেখিতে পাইলাম। দেখিয়া কিন্তু, আমার পূর্ব্বসঞ্চিত ভক্তিভাব উড়িয়া গেল। অবাক ও হতজ্ঞান হইয়া, ভাবিতে লাগিলাম, ও মা! ইনিই ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন; ইনিই এ দেশের সর্ব্বপ্রধান সমাজের সর্ব্বপ্রধান স্মার্ত্ত; ইঁহারই এত প্রশংসা শুনিতাম; ইঁহাকেই এত দিন এত ভক্তি করিতাম। বলিতে কি, আমার মনটা বেয়াড়া খারাপ হইয়া গেল।

 আমি পূর্ব্বে কখনও বিদ্যাসাগরকে দেখি নাই। এক দিন ইচ্ছা হইল, সকলে লোকটার এত প্রশংসা করে, অতএব, ইনি কিরূপ জানোয়ার, আজ একবার দেখিয়া আসিব। তাঁহার আবাসে উপস্থিত হইলাম। অবারিত দ্বার, কেহ বারণ করিল না; একবারে উপরে উঠিয়া, তাঁহার ঘরে প্রবিষ্ট হইলাম; দেখিলাম, লোকারণ্য। এক টেবিলের চারিদিকে, সাত আট জন বসিয়া আছেন; আর এক দিকে, প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ জন দাঁড়াইয়া আছেন। তাঁহাদের এক জনকে জিজ্ঞাসা করাতে, তিনি কহিলেন, ঐটি বিদ্যাসাগর, ঐটি ভাটপাড়ার আনন্দচন্দ্র শিরোমণি, ঐটি নবদ্বীপের প্রধান স্মার্ত্ত ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন। শ্রবণমাত্র, এক উদ্যোগে দুই মনস্কামনা পূর্ণ হইল, এই ভাবিয়া, আহলাদে গদগদ হইলাম। বিদ্যারত্ন ও বিদ্যাসাগর, উভয় জানোয়ারকেই, কিয়ৎ ক্ষণ, অনিমিষ নয়নে, নিরীক্ষণ করিলাম। দেখিলাম, শ্রীমান্ বিদ্যারত্ন খুড়, উকীলের মত, বক্তৃতা করিতেছেন; বিদ্যাসাগর বাবাজী, জজের মত, তাঁহার বক্তৃতা শুনিতেছেন। উপবিষ্ট বিষয়ী লোক গুলি বিদ্যারত্নকে লইয়া আসিয়াছেন। দণ্ডায়মান লোকগুলি বিদ্যাসাগরের নিকটে আসিয়াছিলেন; আজ আপনারা যান বলিয়া, তিনি তাঁহাদিগকে বিদায় দিয়াছেন; তাঁহারা, চলিয়া না গিয়া, দাঁড়াইয়া তামাসা দেখিতেছেন। প্রায় দুই ঘণ্টা কাল, যাহা দেখিলাম, শুনিলাম, ও বুঝিলাম; পাঠক বর্গের অবগতি জন্য, সে সমস্ত সংক্ষেপে .উল্লিখিত হইতেছে।

 সাতক্ষীরার জমীদার বাবু প্রাণনাথ চৌধুরীর মৃত্যু হইয়াছে। তাঁহার দুই স্ত্রী ও চারি, পৌত্র বিদ্যমান। দুই স্ত্রীর গর্ভজাত দুই পুত্র, দুই দুই পুত্র রাখিয়া, পিতার জীবদ্দশায়, প্রাণত্যাগ করিয়াছেন। এক পুত্রের দুটি ঔরশ পুত্র, এক পুরে দুটি দত্তক পুত্র। ঔরস পৌত্রের উপনয়ন হয় নাই, দত্তক পৌত্রের উপনয়ন হইয়াছে। প্রাণনাথ বাবুর শ্রাদ্ধ কে করিবেন, এ কথা উপস্থিত হইল, তাঁহাদের গুরুদেব প্রসিদ্ধ পণ্ডিত জানকীজীবন ন্যায়রত্ন ব্যবস্থা দেন, উপনীত দত্তক পৌত্র শ্রাদ্ধ করিবেন। তদনুসারে, দত্তক পৌত্র, চতুর্থ দিবসে, প্রাণনাথ বাবুর শ্রাদ্ধ করিলেন। শ্রাদ্ধসভায়, অনেক বড় বড় বিদ্যাবাগীশ খুড়, উপস্থিত থাকিয়া, কার্য্য সম্পন্ন করেন, এবং, এই অন্ধ শাস্ত্রের বিধি অনুসারে অনুষ্ঠিত হইল, এই মর্ম্মের এক ব্যবস্থাপত্রে স্ব স্ব নাম স্বাক্ষর করিয়া, বিদায় লইয়া চলিয়া গেলেন।

 অনুপনীত পৌত্রের পিতামহী, সপত্নীর পৌত্র শ্রাদ্ধ করিল, তাঁহার পৌত্র শ্রাদ্ধ করিতে পাইল না, ইহাতে অতিশয় অসন্তুষ্ট হইলেন, এবং দত্তক পৌত্রের কৃত শ্রাদ্ধ শাস্ত্রসিদ্ধ হয় নাই, ইহা প্রমাণ দ্বারা প্রতিপন্ন করিবার নিমিত্ত, বড় বড় বিদ্যাবাগীশ খুড়দিগকে ডাকাইলেন। ইহা কাহারও অবিদিত নাই বিদ্যাবাগীশ খুড় মহাশয়েরা ব্যবস্থা বিষয়ে কল্পতরু। কল্পতরুর নিকটে যে যাহা প্রার্থনা করে, সে তৎক্ষণাৎ তা প্রাপ্ত হয়। সেইরূপ, বিদ্যাবাগীশ খুড়দের নিকটে যে যেরূপ ব্যবস্থা চায়, সে তাহা পায়, কেহ কখনও বঞ্চিত হয় না। তবে একটু বিশেষ এই, কষ্পতরুর নিকট তৈলবট দাখিল করিতে হয় না; বিদ্যাবাগীশ খুড়রা, বিমা তৈলবটে, কাহারও উপর নেক নজর করেন না। যাহা হউক, তাঁহাদের দয়াগুণে ও উপদেশবলে, একাদশ দিবসে, পুনরায় প্রাণনাথ বাবুর শান্ধ হইল। অনেকের ভাগ্যে একটা শ্রদ্ধই জুটিয়া উঠে না; প্রাণনাথ বাবুর কি সৌভাগ্য, তিনি অনায়াসে, উপর্য্যুপরি, দুইটা শ্রাদ্ধ ভোগ করিলেন। এই শ্রাদ্ধসভাতেও, বড় বড় বিদ্যাবাগীশ খুড় মহাশয়েরা, উপস্থিত থাকিয়া, কার্য শেষ করিয়া, বিদায় লইয়া চলিয়া গেলেন।

 শ্রদ্ধের পরেই, প্রাণনাথ বাবুর সমস্ত বিষয় চব্বিশ পরগণার কালেক্টর সাহেবের হস্তে গেল। দুই শ্রাদ্ধই, বাজারে দেনা করিয়া, সম্পাদিত হইয়াছিল; এজন্য, উভয় পক্ষকেই, শ্রাদ্ধের খরচের জন্য, কালেক্টর সাহেবকে জানাইতে হইল। তিনি কহিলেন, এক বাটীতে এক ব্যক্তির দুই শ্রাদ্ধ কেন হইল, ইহার কারণ না জানাইলে, তিনি টাকা দিতে পারিবেন না। দত্তকপক্ষীয়েরা, বিদ্যাসাগরের নিকটে গিয়া, যাহাতে তাঁহারা টাকা পান, তাহার উপায় করিয়া দিতে বলিলেন। বিদ্যাসাগর, সবিশেষ সমস্ত অবগত হইয়া, কহিলেন, আপনাদের টাকা পাইবার কোনও প্রতিবন্ধক দেখিতেছি না। আপনারা যথাশাস্ত্র কার্য্য করিয়াছেন। আপনারা কালেক্টর সাহেবকে জানাইবেন, গুরুদেব জানকীজীবন ন্যায়রত্ন আদেশ করিয়াছিলেন; তদনুসারে, আপনারা চতুর্থ দিবসে শ্রাদ্ধ কার্য্য সম্পন্ন করিয়াছেন। ইহাতেও যদি তিনি ওজর করেন, আমায় বলিবেন, আমি উপায় করিয়া দিব। তাঁহারা, বিদ্যাসাগরের উপদেশ অনুসারে, কালেক্টর সাহেবকে জানাইলেন।

 প্রথম শ্রাদ্ধ শাস্ত্র অনুসারে হয় নাই, এজন্য আমাদিগকে, একাদশ দিবসে, পুনরায় শ্রাদ্ধ করিতে হইয়াছে, ইহা ভিন্ন দ্বিতীয় পক্ষের আর জবাব দিবার পথ ছিল না। সুতরাং, প্রথম শ্রাদ্ধ অসিদ্ধ, দ্বিতীয় শ্রাদ্ধ শাস্ত্র অনুসারে হইয়াছে, এই মর্ম্মের ব্যবস্থাপত্র সংগ্রহ আবশ্যক হইয়া উঠল। তাঁহারা অধমতারণ ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন খুড়র শরণাগত হইলেন। বিদ্যারত্ন তাদৃশ ব্যবস্থা দিতে সম্মত হইলেন, এবং তাঁহাদের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের নিকটে আসিয়া কহিলেন, আমি একটি ব্যবস্থার কথা বলিব, শুনিয়া আপনাকে সম্মতি দিতে হইবেক। বিদ্যাসাগর কহিলেন, আপনকার যাহা বক্তব্য আছে, বলুন। তদনুসারে, বিদ্যারত্ন বিদ্যাপ্রকাশ করিতে আরম্ভ করিলেন।

 কিয়ৎ ক্ষণ পরে, বিদ্যারত্ন এমন একটি বচন আবৃত্তি করিলেন যে, তাহা দ্বারা, প্রথম শ্রাদ্ধ অসিদ্ধ ও দ্বিতীয় শ্রাদ্ধ শাস্ত্রসিদ্ধ বলিয়া, বোধ হইতে পারে। এই বচন শুনিয়া, বিদ্যাসাগর বিদ্যারত্নকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি ও পক্ষের ব্যবস্থা কি দেখিয়াছেন। বিদ্যারত্ন অম্লানবদনে উত্তর করিলেন, দেখিয়াছি কি, আমি ঐ ব্যবস্থায় নাম স্বাক্ষর করিয়াছি। বিদ্যাসাগরের বোধ ছিল, বিদ্যারত্ন ঐ ব্যবস্থায় সম্মত নহেন, এজন্য বিপরীত পক্ষের সমর্থন করিতেছেন। বিদ্যারত্ন পূর্ব্ব ব্যবস্থায় নাম স্বাক্ষর করিয়াছেন, এখন আবার ঐ ব্যবস্থায় দোষারোপ করিয়া, বিপরীত পক্ষের পোষকতা করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। ইহা বুঝিতে পারিয়া, তিনি কিয়ৎক্ষণ হতবুদ্ধির মত হইয়া রইিলেন, অনন্তর বিদ্যারত্নকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, আপনি চান কি; আপনি ত বড় মজার লোক; পূর্ব্বে যে ব্যবস্থায় স্বাক্ষর করিয়াছেন, এখন আবার, ঐ ব্যবস্থা শাস্ত্রবিরুদ্ধ বলিয়া, বিচার করিতে বসিয়াছেন। আপনাকে জিজ্ঞাসা করি,যখন পূর্ব্ব ব্যবস্থায় স্বাক্ষর করেন, তখন কি এ বচনটি আপনার উপস্থিত হয় নাই। বিদ্যারত্ন, সহাস্য বদনে, উত্তর করিলেন, ব্যবস্থা দিবার সময় কি অত বচন ফচন দেখা যায়। এই অদ্ভুত কথা শুনিয়া, বিদ্যাসাগর কহিলেন, বিদ্যারত্ন মহাশয়, ও কথা উচ্চৈঃ স্বরে কহিবেন না। ঐ দেখুন, ন্যূনাধিক পঞ্চাশ জন ভদ্র লোক দাঁড়াইয়া কৌতুক দেখিতেছেন। হঁহারা নানা স্থানের লোক। এখান হইতে বহির্গত হইয়াই, বলিতে আরম্ভ করিবেন, নবদ্বীপের প্রধান স্মার্ত্ত আপন মুখে কবুল দিলেন, ব্যবস্থা দিবার সময় বচন ফচন দেখা যায় না। ব্যবস্থা দেওয়া আপনকার জীবিকা; কিন্তু, এ কথা সর্ব্বত্র প্রচারিত হইলে, আপকানার জীবিকার হানি হইবেক। এই বলিয়া, বিদ্যাসাগর দণ্ডায়মান লোক গুলির দিকে চাহিয়া কহিলেন, আমি আপনাদের নিকট এই ভিক্ষা চাহিতেছি, আপনারা এ কথা কোথাও ব্যক্ত করিবেন না; করিলে, ব্রাহ্মণের অন্ন মারা যাইবেক।

 ইহা কহিয়া, বিদ্যাসাগর বিদ্যারত্ন কে বলিলেন, বিদ্যারত্ন মহাশয়, আপনিও কিছু লেখা পড়া শিখিয়াছেন, আমিও কিছু শিখিয়াছি। আপনি যদি পণ্ডিত বলিয়া পরিচয় দিতে পারেন, আমিও পারি। কিন্তু, ওরূপ পরিচয় দেওয়া দুরে থাকুক, যদি কেহ আমাকে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ভাবে, তাহাতে আমার যৎপরোনান্তি অপমান বোধ হয়। বলিতে কি, আপনাদের আচরণের জন্যে, ব্রাহ্মণজাতির মান একবারে গিয়াছে। আর আপনাকার বিদ্যাপ্রকাশের প্রয়োজন নাই; যথেষ্ট হইয়াছে; স্বস্থানে প্রস্থান করুন। এই বলিয়া, বিদ্যাসাগর তাঁহাকেও তাঁহার সমভিব্যাহারী মহাশয়দিগকে বিদায় করিয়া দিলেন। আমরাও সকলে, দেখিয়া শুনিয়া, অবাক্ হইয়া, চলিয়া গেলাম।

 নবদ্বীপ এ দেশের সর্ব্বপ্রধান সমাজ; বিদ্যারত্ন সেই সর্ব্বপ্রধান সমাজের সর্ব্বপ্রধান স্মার্ত বলিয়া গণ্য ও মান্য; তাঁহার চাঁদমুখে স্বকর্ণে শুনিলাম, ব্যবস্থা দিবার সময়, বচন ফচন দেখা যায় না। জানকীজীবন ন্যায়রত্ন যথাশাস্ত্র ব্যবস্থা দিয়াছিলেন। বিদ্যারত্ন খুড় পূর্ব্বে ঐ ব্যবস্থায় নাম স্বাক্ষর করিয়াছেন; কিন্তু, অপর পক্ষের নিকট হইতে, পছন্দসই তৈলবট হস্তগত করিয়া, আজ আবার ঐ ব্যবস্থা অব্যবস্থা বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে প্রবৃত্ত। এ দেশের মুখে ছাই; এ দেশের সর্ব্বপ্রধান সমাজের মুখে ছাই; এ দেশের সর্ব্বপ্রধান সমাজের সর্ব্বপ্রধান স্মার্ত্তের মুখে ফুল চন্দন। যাঁহাদের এরূপ ব্যবহার, তাঁহাদের সহিত কিরূপ ব্যবহার করা উচিত ও আবশ্যক, এ হতভাগা দেশের হতভাগা লোকের সে বোধও নাই, সে বিবেচনাও নাই।

ইতি শ্রীব্রজবিলাসে মহাকাব্যে কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য কৃতৌ

দ্বিতীয় উল্লাসঃ