ব্রাহ্মধর্ম্মের মত ও বিশ্বাস/চতুর্থ উপদেশ

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্থ উপদেশ।


ঈশ্বর সত্য-স্বরূপ।

 সত্য কাহাকে বলে? সত্যের প্রতিরূপ বস্তু কোথায়? কোন্ বিষয় এমন আছে যাহাকে সত্য বলা যাইতে পারে? সত্য কি বস্তু ও সত্যের স্বরূপ ও লক্ষণ কি? এই অনুসন্ধানে মনোনিবেশ করিলে প্রতীতি হইবে যে ঈশ্বর যিনি তিনিই সত্য, এবং সত্যই ঈশ্বর।

 ঈশ্বর হইতে সত্য ভিন্ন নহে, এবং সত্য হইতে ঈশ্বর ভিন্ন নহেন। ঈশ্বরেতেই সত্য শব্দ সম্পূর্ণ সংলগ্ন হয়। তিনি ভিন্ন আর কিছুতেই হয় না। জড় বস্তুকে কি সত্য বলা যাইতে পারে? যখন দেখি জড় বস্তুর চেতন নাই। জড় বস্তু মৃত বস্তু; জড় বস্তু আপনাকে আপনি জানে না। তখন তাহাকে সত্যের যোগ্য বস্তু বলিয়া বোধ হয় না। সত্যের যে ভাব, তাহার সঙ্গে চেতন-শূন্য মৃত বস্তুর মিল হয় না। আমরা জীবিত মনুষ্যকে যে প্রকার সত্য মনে করি, তাহার মৃত শরীরকেও কি সেই প্রকার জ্ঞান করিয়া থাকি? এই যে সন্মুখে অচল অটল স্তব্ধ মৃতুর রূপ প্রাচীর দেখা যাইতেছে, ইহা কি সত্য? না আমি যে প্রাচীরকে দেখিতেছি, সেই সত্য পদার্থ? জড় যদি সত্য না হয়, তবে কি আমাদের জীবাত্মাই সত্য? জড় হইতে জীবাত্মা সত্য, কেন না জীবাত্মার জ্ঞান আছে, চেতন আছে। কিন্তু জীবাত্মার জ্ঞানও আছে, অজ্ঞানও আছে—জীবাত্মা কতক দেখিতেছে, কতক দেখিতে পায় না—জীবাত্মা কখন জাগ্রৎ, কখন নিদ্রিত -জীবাত্মা এক সময়ে ছিল না এবং যে পূর্ণ-পুরুষের আশ্রয়ে থাকিয়া জীবিত রহিয়াছে, তাঁহার ইচ্ছা হইলে পরেও থাকিবেক না। জীবাত্মার সকল বিষয়েরই সীমা আছে,পরিমাণ আছে। এই প্রকার সীমাবিশিষ্ট পরিমিত বস্তু যে আমাদের জীবাত্মা, তাহাকে যদি সত্য বলা যাইতে পারে, তবে পূর্ণ জ্ঞান ঈশ্বর কেমন সত্য! যিনি সর্ব্বজ্ঞ—যিনি আন্তর্যামী—যিনি ভূত ভবিষ্যৎ বর্ত্তমান সকল কালের প্রতিই সমান রূপ দৃষ্টি করিতেছেন; সেই সত্য পুরুষের তুলনায় আমারদের এই জীবাত্মাকেও সত্য বসিয়া বোধ হয় না। ঈশ্বর যিনি তিনিই সত্য—সত্য যিনি তিনিই ঈশ্বর।

 কিন্তু সত্য বস্তু—জ্ঞান বস্তু, প্রাণবিশিষ্ট কি প্রাণশূন্য, জীবিত কি মৃত? পূর্ণ-জ্ঞান-স্বরূপের জ্ঞানই প্রাণ। তিনি সত্যস্বরূপ- তিনি পূর্ণ-জ্ঞান; অথচ তিনি প্রাণ-শূন্য মৃত বস্তু; এ দুই পরস্পর বিরুদ্ধ বাক্য। যিনি সত্যস্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ, তাঁহার প্রাণ জগতের প্রাণ। তিনি জীবিত বস্তু—মৃত বস্তু নহেন। তাঁহার জীবন এক সময় আরম্ভও হয় নাই, তাঁহার জীবনের কখন শেষও হইবেক না, তিনি অমৃত। তাঁহার প্রাণের হ্রাস নাই, বৃদ্ধি নাই; ব্যয় নাই, ক্ষয় নাই—তিনি অমৃত। তিনি জ্ঞানস্বরূপ, চেতনাবান্, স্বপ্রকাশ। তিনি মৃত্যুর বিপরীত বস্তু—তিনি প্রাণ।

 সত্য যে বস্তু, তাহা কি কিছুকাল স্থায়ী, কি অনন্তকাল স্থায়ী? অন্তবৎ বস্তু আর অনন্ত বস্তু, ইহার মধ্যে কাহাকে সত্য বলা যায়? আমরা ঐন্দ্রজালিক ব্যাপারে যে সকল অদ্ভুত ব্যাপার প্রত্যক্ষ করি, তাহাকে মিথ্যা কেন বলি। তাহার এক প্রধান হেতু এই যে তাহা অতি অল্প কাল স্থায়ী। অন্তবৎ বস্তুর সঙ্গে সত্য ভাবের সম্পূর্ণ মিলন হয় না। আমরা চতুর্দ্দিকে যে সমস্ত বস্তু বিরাজমান দেখিতেছি, সে সকল যদিও সৃষ্টিকাল হইতে বর্ত্তমান রহিয়াছে; তথাপি সৃষ্টির পূর্ব্বে তাহার কিছুই ছিল না এবং ঈশ্বরের ইচ্ছা হইলে পরেও থাকিবেক না; এই জন্য এ সমুদয়কে ঠিক সত্য বলা যায় না। যিনি অনন্ত—যিনি নিত্য—যিনি দেশ কালের অতীত পদার্থ— যিনি পূর্ব্বেও ছিলেন, অদ্যও আছেন, পরেও থাকিবেন; তিনিই সত্য। সত্যের ভাব কেবল সেই অনন্ত স্বরূপেতেই আছে। জড় বস্তু আদ্যন্তবৎ, আমাদের জীবাত্মাও আদ্যন্তবৎ, এই জন্য ইহারা তেমন সত্য নহে।

 যাহা কিছু সত্য বলা যায়, তাহা নার সঙ্গে যোগ থাকিলে হইবেক না। এত কাল আছে, এত কাল নাই— সত্যের স্বরূপ এ প্রকার নয়। এতটুকু দেশে আছে, এত টুকু দেশে নাই—এ প্রকার বস্তু সত্য নহে। কতক জ্ঞান, কতক অন—কতক সদ্ভাব কতক অসদ্ভাব—কতক শক্তি কতক ত্রুটি; এপ্রকার জ্ঞান-বস্তুও সত্য নহে। অভাববিশিষ্ট পদার্থ প্রয়োগ হইলে সৎ শব্দের অর্থই হয় না। পূর্ণ বস্তুই সত্য। এই হেতু ঈশ্বর ভিন্ন সত্যের সঙ্গে আর কোন বস্তুরই মিল পাওয়া যায় না। কতক আছে, কতক নাই—আছে আর নাই—এই দুই একত্র হইলে, সকল বস্তু সীমাবদ্ধ হয়। এ বস্তু এক সময় আছে, এক সময় ছিল না; ইহা বলিলেই তাহার কালেতে সীমা হইল। এ ব্যক্তির কতক জ্ঞান, কতক অজ্ঞান; ইহা বলিলে তাহার জ্ঞানেতে সীমা হইল। যিনি দেশেতে অনন্ত, কালেতে অনন্ত, মঙ্গল ভাবে অনন্ত—যাঁহার অনন্ত জ্ঞান, অনন্ত প্রাণ, তিনিই একমাত্র সত্য পদার্থ। তিনিই সত্যের বিষয়—সত্যের আয়তন—সত্যের ভূমি। এই এক সত্য শব্দ তাঁহার সকল তত্ত্বের সমষ্টি-স্থান। সত্য ভাব পরিস্ফুটিত হইলে তাঁহার সকল স্বরূপ প্রকশ পায়। সত্যের মধ্যে জ্ঞান—প্রাণ— অনন্ত ভাব অন্তর্ভুত রহিয়াছে। তিনি সত্য স্বরূপ—তাঁহার কতক সাধু ভাব, কতক অসাধু ভাব; কতক মঙ্গল ভাব, কতক অমঙ্গল ভাব; এমত নহে; তিনি পরিপূর্ণ মঙ্গল স্বরূপ। বিনি নির্দ্দোষ, নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক, পবিত্র-স্বরূপ, তাঁহার অপেক্ষা, সুন্দর বস্তু আর কি আছে। তিনিই “সত্যং শিবং সুন্দরং”।

 সত্য শব্দ ঈশ্বরেতেই সম্পূর্ণ সংলগ্ন হয়। সত্যের সঙ্গে অন্যান্য বস্তুর কোন বিষয়ে মিল দেখিয়া তাহাকে সত্য। বলি। জড় বস্তুর অস্তিত্ব এবং শক্তিমাত্র দেখিয়া তাহাকে সত্য বলি। জীবাত্মার জ্ঞান ও চেতন শক্তি দেখিয়া জীবাত্মাকে সত্য বলি। কিন্তু এসমুদয় বস্তুরই আদি আছে, অন্ত আছে। দেশ, কাল, গুণ, সকল বিষয়েই জীবাত্মার সীমা করা যায়। কিন্তু যিনি অনাদনন্ত পূর্ণ-জ্ঞান—পূর্ণ-মঙ্গল তিনিই সত্য। এই সমুদয় জগৎ সংসারকে আপেক্ষিক সত্য বলা যাইতে পারে,কিন্তু ঈশ্বরই কুটস্থ সত্য। এ সমুদয় আপেক্ষিক সত্য, কেন না অল্পকাল স্থায়ী বস্তু অপেক্ষা দীর্ঘ কাল স্থায়ী বস্তু সত্য; জড় বস্তু অপেক্ষা জ্ঞান বস্তু সত্য; মৃত বস্তু অপেক্ষা সচেতন বস্তু সত্য। কিন্তু পারমার্থিক সত্য পদার্থ কেবল তিনিই। এই বলিয়াই যে জগৎসংসার ভ্রান্তি-মূলক মিথ্যা, তাহা নহে। এসমুদায় মায়াও নহে, স্বপ্নও নহে। যেহেতু ইহার মূল যিনি, তিনি সত্য। এই জগৎ সংসার সত্য-মূলক। আমারদিগের বুদ্ধিতে জগতের অস্তিত্ব, জীবাত্মার অস্তিত্ব, এবং পরমাত্মার অস্তিত্ব প্রকাশ পাইতেছে, ইহার মধ্যে যদি কোন এক অস্তিত্বকে স্বপ্নের প্রতীয়মান বস্তুবৎ মিথ্যা বলা হয়। তবে অন্য অন্য সকল অস্তিত্বকেই তাহার ন্যায় মিথ্যা বলিতে হয়। মূল সত্য হইতে নিঃসৃত জগৎকে মিথ্যা না বলিয়া আপেক্ষিক সত্য বলা উচিত। এই সমুদয় জগৎ সকল সময়েতেই যে বিদ্যমান আছে, তাহা নহে—এক সময়ে ছিল না; যদি ঈশ্বরের ইচ্ছা হয়, তবে এক সময়ে থাকিবেক না। যাঁহার অস্তিত্ব সকল অস্তিত্বের মূলীভূত, তিনিই পরম সত্য নিত্য পদার্থ। আমরা এখানে যে কোন পদার্থ দেখিতে পাই, সকলই আশ্রিত পরিমিত অন্তবৎ পদার্থ। কিন্তু যিনি সর্ব্বশ্রয় অপরিমেয় অনন্ত পদার্থ, তিনিই সত্য। সকল সৃষ্ট বস্তুরই কোন না কোন বিষয়ে অভাব আছে, কিন্তু যাঁহার অভাব নাই, যিনি পরিপূর্ণ, তিনিই পারমার্থিক সত্য বস্তু। ঈশ্বরের প্রতি লক্ষ্য করিয়াই সত্য বলা উচিত। এই এক শব্দে তাঁহার সকল তত্ত্বের উদ্বোধন হয়। সত্যের ভাব সকলেরই বুদ্ধি-ভূমিতে নিহিত আছে—সেই ভাব পরিস্ফুটিত হইলে দেখা যায় যে কেবল একমাত্র ঈশ্বরই সেই সত্য ভাবের বিষয়; ঈশ্বর ভিন্ন আর কোথাও সত্য শব্দ সংলগ্ন হয় না—সত্যের পর্যাপ্তি হয়। আমরা সত্যের যে সকল লক্ষণ প্রাপ্ত হইতেছি, তাহার সমুদয় লক্ষণ কেবল ঈশ্বরেতেই প্রাপ্ত হইতেছি।

 সত্য যে বস্তু, তাহা কখন জড়বৎ মৃত বস্তু নহে; অতএব অমৃত চেতা ঈশ্বরই সত্য। সত্য যে বস্তু, তাহা কোন সময়ে আছে, কোন সময়ে নাই, এমত নহে; অতএব নিত্য পরমেশ্বরই সত্য। সত্য যে বস্তু তাহার উপরে কালের অধিকার নাই; কালেতে করিয়া তাহার ক্ষয় হয় না, তাহার পরিবর্ত্তন হয় না; অতএব অপরিবর্ত্তনীয় ধ্রুব ঈশ্বরই সত্য। সত্যের উপরে দেশের অধিকার নাই, দেশ তাঁহাকে সীমাবদ্ধ করিতে পারে না; অতএব সর্ব্বব্যাপী তাপরিসীম ঈশ্বরই সত্য। সত্য যে বস্তু, তাহা কতক ভাল কতক মন্দ,তাহার কতক সদ্ভাব কতক অসদ্ভাব, এপ্রকার নহে; অতএব পূর্ণ-মঙ্গল-ভাব পরমেশ্বরই সত্য। সত্য যে বস্তু, তাহা আশ্রিত ও পরতন্ত্র বস্তু নহে, তাহ। কাহারও ইচ্ছার অধীন নহে; তাহার জনকও নাই, নিয়স্তাও নাই; অতএব স্বপ্রকাশস্বরূপ স্বতন্ত্র পরমেশ্বরই সত্য। সত্যের সঙ্গে অভাবের সঙ্গে যোগ নাই; অতএব পরিপূর্ণ ঈশ্বরই সত্য। সত্যের যে মহান্ ভাব আমারদের বুদ্ধিতে নিহিত আছে; তাহা সেই পূর্ণ পুরুষ ভিন্ন আর কোথাও চরিতার্থ হয় না। আমাদের বুদ্ধিতে যে ধর্ম্মের ভাব আছে, তাহার মত যেমন ধার্ম্মিক পাওয়া যায় না; সেই প্রকার আমারদের সত্য ভাবের সহিত দৃশ্যমান কোন বস্তুরই ঐক্য দেখা যায় না। ঈশ্বরের লক্ষণ এবং সত্যের লক্ষণে সম্পর্ণ ঐক্য দেখিয়া ঈশ্বরকেই সত্য বলি। তিনি “সত্যজ্যোতীরসোহমৃতং।”