ব্রাহ্মধর্ম্মের মত ও বিশ্বাস/নবম উপদেশ

উইকিসংকলন থেকে

নবম উপদেশ।

মুক্তি।

 ঈশ্বরের উপাসনা কি নিমিত্তে? যে ব্যক্তি উত্তর করে, সুখ সম্পদ পাইবার নিমিত্তে, সে বালকের ন্যায় উত্তর করে। তাহার যথার্থ লক্ষ্য স্থান এখনো হৃদয়ে আইসে নাই। এখানে সুখ দুঃখের সর্ব্বদাই পরিবর্ত্তন হইতেছে। আমাদের শিক্ষার নিমিত্তে, পরীক্ষার নিমিত্তে, ঈশ্বর আমাদিগের নিকটে বিপদ প্রেরণ করিতেছেন। বিষয়-মুখ কখনই ঈশ্বরোপাসনার প্রকৃত লক্ষ্য নহে। তবে ঈশ্বরের উপাসনা কি নিমিত্তে? যে ব্যক্তি উত্তর করে, মুক্তি লাভের নিমিত্তে; সেই পণ্ডিতের ন্যায় উত্তর করে। মুক্তিই আমাদের যথার্থ লক্ষ্য স্থান—তাহার আনুসঙ্গিক যাহা কিছু উপকারী, তাহাই আমাদের প্রার্থনার যগ্য। মুক্তির পথে দণ্ডায়মান হইয়া ঈশ্বরের নিকট স্বভাবতঃ আমাদের এই প্রকার প্রার্থনা যায়, যে হে পরমাত্মন! আমাকে পাপ হইতে মুক্ত কর, আমার আত্মাতে পবিত্রতা বিস্তার কর; তুমি আমার নিকটে প্রকাশিত হও; তোমার সহবাসে আমাকে নিরন্তর রক্ষা কর। মুক্তি যদি আমাদের লক্ষ্য হয়, তবে আমরা মধ্য দেশে থাকি। সমুদায় সংসারের কার্যই পরিধি হয়, আর আমরা মধ্যের বিন্দুতে অবস্থিতি করি। এই মধ্য দেশে থাকিলে সকলের সঙ্গেই আমাদের সম্বন্ধ থাকে, কিছুই বিচ্ছিন্ন ভাবে থাকে না। মুক্তি যদি আমাদের লক্ষ্য হয়, তবে আমরা এমত স্থানে আছি, যে সেখান হইতে সমুদয় সংসার আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়— আমরা মধ্য পথে থাকি, আর সমুদায়ই আমারদিগকে আবেষ্টন করিয়া থাকে। শরীর-রক্ষা যে এমত নীচ কার্য্য তাহা অবধি আর আত্মার উৎকর্ষ সাধন পর্য্যন্ত, সকলই আমাদের কর্ত্তব্যের মধ্যে আইসে। মুক্তির প্রতি যাহার লক্ষ্য থাকে তাহার নিকটে সমুদয় নিঃস্বার্থ ধর্ম্ম-কার্য্য নিঃশ্বাসের ন্যায় সহজ হইয়া আইসে। তর্কের উপর লোকবাক্যের উপর, দেশাচারের উপর নির্ভর করিয়া তাঁহার ধর্ম্ম শিক্ষা করিতে হয় না। আপনাকে পবিত্র করিবার জন্য তাঁহার প্রাণগত যত্ন থাকে, কেননা পবিত্রস্বরূপকে লাভ করাই তাঁহার উদ্দেশ্য। মুক্তির দিকে যাঁহার লক্ষ্য থাকে, তাঁহার হৃদয়-গ্রন্থি সমুদয় ভিদ্যমান হয়। আমাদের হৃদয়-গ্রন্থি কি? না মোহ, অজ্ঞান, স্বার্থপরতা। এই সকল গ্রন্থিই আমাদিগকে সংসারপাশে, মৃত্যুর পাশে, বদ্ধ করিয়া রাখে। মুক্তির প্রতি যাঁহার দৃষ্টি থাকে, তিনি পুণ্য পদবীতে সহজেই আরোহণ করিতে থাকেন। আমাদের এমন সকল সঙ্কট-সময় উপস্থিত হয়, এ প্রকার গুরুতর ভার আমাদের উপর চতুর্দ্দিক্ দিয়া পতিত হয় যে, সেই সময় সেই সকল অবস্থায় আমাদের কর্ত্তব্য কি কিছুই স্থির করিতে পারা যায় না এমন সূক্ষ্ম স্থল এক এক সময়ে উপস্থিত হয়, যাহা গ্রন্থ মধ্যে কেহ কখন উল্লেখ করেন নাই, যাহা অন্যের উপদেশে কখনো শ্রবণ করা যায় নাই; সেই সেই স্থলে কি কর্ত্তব্য তাহা অবধারণ করা কেমন কঠিন। এই সকল স্থলে কি কর্ত্তব্য? শত শত গ্রন্থ মধ্যে শত শত লোকের নিকট হইতে আমরা যে উপদেশ পাই না, এক বার ঈশ্বরের প্রতি দৃষ্টি করিয়া সেই সকল বিষয় আলোকের ন্যায় স্পষ্ট দেখিতে পাই, সেই পরম গুরু হইতে শিক্ষা লাভ করি। মুক্তির প্রতি লক্ষ্য থাকিলে ঈশ্বরের সঙ্গে আমাদের সকল কর্ম্মেই যোগ থাকে। অন্যেরা যেখানে রাশি রাশি কর্ত্তব্য ভাবে আচ্ছন্ন হইয়া পড়ে, আমাদের নিকটে সে সকল কর্ত্তব্য একীভাব ধারণ করে। অন্যেরা যে স্থলে কর্ত্তব্য কি ভাবিয়াই স্থির করিতে পারে না, সেই সকল স্থানে ঈশ্বরের প্রতি দৃষ্টি করিয়া আমরা যথা উপদেশ প্রাপ্ত হই। অন্যেরা যেখানে একাকী আপন ক্ষুদ্র বলে পাপের সহিত সংগ্রাম করিতে প্রবৃত্ত হয়, সেখানে আমরা ঈশ্বরকেই সহায় পাই—তাঁহার নিকটে আপনাকে সমর্পণ করিয়া চতুর্গুণ বল প্রাপ্ত হই। অন্যেরা যখন একবার পতিত হইয়া নিরাশ-নীরে পতিত হয়, ঈশ্বর স্বীয় ক্রোড় বিস্তার করিয়া দিলেও তাঁহাকে আশ্রয় করতে যায় না; আমরা সে সময়ে সেই পতিত-পাবনের শরণাপন্ন হইয়া আবার উদ্ধার হই। যাহাতে আমরা সকল বিঘ্ন অতিক্রম করিয়া পুনর্ব্বার তাঁহার নিকটে যাইতে পারি, তিনি এই প্রকার শুভ বুদ্ধি প্রেরণ করেন, বলবীর্য্য প্রদান করেন।

 মুক্তি কি? না সংসার বন্ধন হইতে মুক্ত হওয়া। মৃত্যুর পাশ হইতে প্রমুক্ত হইয়া অমৃতের দিকে অগ্রসর হওয়া। বিষয়াকর্ষণ হইতে বিমুক্ত হইয়া বিষয়ের অতীত পদার্থকে আশ্রয় করা। যত কাল আমরা সংসার বন্ধনেই বদ্ধ থাকি, তত দিন আমাদের বদ্ধ ভাব। যত দিন বিষয়ের সঙ্গে জড়িত থাকি, তত দিন মৃতুর পাশেই বদ্ধ হইয়া থাকি। আমরা অন্তরে মুক্ত না হইলে মুক্তির ভাব বুঝিতে পারি না। আমরা এখানে মৃত্যু আর অমৃতের সন্ধিস্থলে রহিয়াছি। মৃত্যু হইতে অমৃতের দিকে যত যাইতে থাকি, ততই আমাদের মুক্তভাব উপলব্ধি হইতে থাকে। আমাদের জ্ঞান ও ভাব ও ইচ্ছা সকলকেই একত্র করিয়া ঈশ্বরেতে যতই সমর্পণ করিতে পারিব, ততই আমরা মুক্তির অবস্থা প্রাপ্ত হইতে থাকিব। যখন ঈশ্বরের সঙ্গে আর আমাদের বিবাদ থাকিবে না, তখনই আমাদের যথার্থ মোক্ষাবস্থা হইবে।

 ঈশ্বরের সঙ্গে বিবাদ কি? দ্যুলোক, ভূলোক, চন্দ্র, সূর্য্য, পৃথিবী, সকলই যাঁহার এক রাজ-দণ্ডের উপর চলিতেছে, তাঁহার সহিত বিবাদ কে করিতে পারে? কেবল মনুষ্যই কর্ত্তৃত্ব ভার প্রাপ্ত হইয়া অকৃতজ্ঞ ও অসৎ পুত্রের ন্যায় তাঁহার আদিষ্ট ধর্ম্ম-পথের বিপরীত দিকে চলিতে যায় ও শাস্তি ভোগ করে। আমাদের ইচ্ছা কখনো তাঁহার মঙ্গলময়ী ইচ্ছার অনুগামিনী হয়, কখনো বা বিরোধিনী হয়। তাঁহার সহিত কখনো আমাদের সন্ধি থাকে, কখনো বিবাদ থাকে। এই স্বাধীনতা শক্তি মনুষ্যের প্রতি ঈশ্বরের এক অমূল্য দান। মনুষ্যকে এই অধিকার দিয়া তিনি তাহাকে বলিয়া দিয়াছেন, যে তুমি আপনা হইতে আমার পথে আইস। সকলেই সেই সর্ব্বনিয়ন্তার কার্য্য করিতেছে কিন্তু মনুষ্য কেবল জানিয়া শুনিয়া তাঁহার কার্য্য সম্পন্ন করিতেছে। সমস্ত জগৎ, সমস্ত ঘটনা, তাঁহার মঙ্গল অভিপ্রায় সিদ্ধ করিতেছে; কিন্তু আমরা আপন ইচ্ছাতে সেই অভিপ্রায়ে যোগ দিতেছি। আমরা আপনা হইতে তাঁহাকে সর্ব্বস্ব দান করি, আমারদিগকে স্বাধীন করিবার তাঁহার অভিপ্রায় এই। এস্থলে অনুরোধ, ভয়, বাধ্যতা, এ সকল কিছুই নাই। আমরা আপনা হইতে তাঁহাকে প্রীতি করি, তিনি এই চাহেন। তাঁহার ইচ্ছা এ প্রকার নয় যে আমরা বাধ্য হইয়া তাঁহাকে পূজা করি। তাঁহার শাসন এ প্রকার নয় যে ভয়ে ভয়ে তাঁহাকে মান্য করিতেই হইবে। তিনি এ প্রকার রাজা নহেন, যে আমরা সকলেই তাঁহার ক্রীত দাস। আমরা বিনা অনুরোধে বিনা ভয়ে তাঁহার প্রীতি, তাঁহার মঙ্গলভাব, প্রতীতি করিয়া আপনা হইতে তাঁহাকে যে পূজা অর্পণ করি, সেই তাঁহার যথার্থ পূজা এবং সেই তাঁহার প্রিয় অভিপ্রায়। আমরা তাঁহার যন্ত্র আর তিনি আমাদের যন্ত্রী, আমাদের সহিত তাঁহার এ প্রকার ভাব নহে।

 এই প্রকার স্বাধীন করিয়া দিয়াই তিনি আমাদিগকে মুক্তি লাভের অধিকারী করিয়াছেন। তিনি যদি আমাদিগাকে এ প্রকার করিয়া দিতেন যে যন্ত্রের ন্যায় তাঁহার কার্য্য করিয়াই যাইব, তাহা হইলে আমরা মুক্তির কোন অর্থই পাইতাম না। তিনি আমাদের সকল শক্তির নেতা রূপে আমাদিগকে একটি কর্ত্তৃত্ব শক্তি দিয়াছেন। এই কর্ত্তৃত্ব শক্তি হইতেই আমরা মুক্তির ভাব বিশেষ বুঝিতেছি। আমরা তাঁহাকে আশ্রয় করিয়া মুক্তি লাভ করিব, তাঁহার যদি এই অভিপ্রায় না থাকিত, তবে আমাদের কর্ততৃত্ব থাকার বিশেষ অভিসন্ধি প্রকাশ পাইত না। আমাদের দিয়া কি সংসারের উন্নতি হইবে? সুখ-প্রবাহ বৃদ্ধি হইবে? সভ্যতা বিস্তার হইবে? জন-সমাজের শ্রীবিদ্ধি হইবে? এই উদ্দেশে কি তিনি আমাদিগকে কর্ত্তৃত্ব দিয়াছেন। তিনি যদি কর্ত্তৃত্ব না দিয়া আমাদিগকে যন্ত্র করিয়া নির্ম্মাণ করিতেন, তাহা হইলেও কি সেই সকল উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইত না। তিনি যদি আমাদের স্বার্থপরতাকে আরো দূরদর্শী করিয়া দিতেন, আমাদের লোকানুরাগ-প্রবৃত্তি আরো তেজস্বিনী করিয়া দিতেন, তাহা হইলে কি জন-সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষা হইত না? সুখই যদি আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য হইত, তাহা হইলে কি তিনি আরো প্রচুররূপে সুখ বর্ষণ করিতে পারিতেন না? তিনি আমাদিগকে কর্ত্তৃত্ব দিয়াছেন বলিয়া বরং আমরা অনেক সময়ে বিষয়-সুখ হইতে বঞ্চিতই হইতেছি। সুখই যদি আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য হইত, তাহা হইলে কি তিনি আমাদিগকে পশুর ন্যায় প্রকৃতির অধীন করিয়া সুখী করিতে পারিতেন না। আমরা কর্ত্তৃত্ব পাইয়া এই দেখিতেছি, যে বিষয় সুখের প্রতিকূলেই অনেক সময়ে যাইতে হয়। আমরা বিষয়াকর্ষণ অতিক্রম করিয়া তাঁহার প্রদর্শিত পুণ্য পথে যাইতে পারি, এখানকার সমুদয় শিক্ষার তাৎপর্য্যই এই। আমরা এখান হইতেই মুক্তির আস্বাদন প্রাপ্ত হইতেছি। বিষয়ের প্রতিকূলে―লোকের প্রতিকূলে—পাপের প্রতিকূলে আমাদের কর্ত্তৃত্ব যত চিন্তার করিতে পারি, ততই আমাদের মুক্ত ভাব উপলব্ধি করিতে পারি। আমরা এখানে আমাদের কুপ্রবৃত্তিকে যেমন একবার পরাজয় করিতে পারি, ভরিষ্যতের জন্য ততটুকু বল পাই—পরে পরে আরো সহজে তাহাকে অতিক্রম করিতে পারি। আমরা যেমন পাপ হইতে মুক্ত হইতে থাকি, পাপকে অতিক্রম করিবার বলও প্রাপ্ত হইতে থাকি, আবার বলও যেমন বৃদ্ধি হয়, বিমুক্তিও তেমনি সহজে লাভ করিতে থাকি। আমরা জীবদ্দশাতেই মুক্তির আস্বাদ প্রাপ্ত হই।

 আমরা এখান হইতে সেই মুক্তির সোপানে পদ নিঃক্ষেপ করিতেছি। ঈশ্বরকে এখানেই উপভোগ করিতেছি। আমাদের জ্ঞানজ্যোতিঃ যত উজ্জ্বল হইতেছে, তাঁহার মহিমা আমাদিগের নিকটে ততই বিকশিত হইতেছে; আমাদের পবিত্রতা ও সাধু-ভাবের যত উন্নতি হইতেছে, তাঁহার মঙ্গলভাব সেই পরিমাণে গ্রহণ করিতেছি। আমরা বিষয়ের প্রতিকূলতা, অবস্থার প্রতিশ্রোত, যত অতিক্রম করিতেছি; সেই অমৃতের দিকে ততই অগ্রসর হইতেছি এবং ব্রহ্মানন্দের ততই আস্বাদ পাইতেছি। দেবলোকে দেবতারা যে আনন্দরস পান করিতেছেন, তাহা এই ব্রহ্মানন্দের উন্নত ভাব। প্রাতঃকাল কি কোন প্রশন্ত সময়ে আমাদের চিত্ত ঈশ্বরে সন্নিবেশিত হইয়া যখন আমাদের লোম হর্ষণ হয়, হৃদয় কম্পিত হয়, আমরা গভীর পবিত্র স্বগীয় আনন্দ উপভোগ করি; তখন সেই প্রেমানন্দেরই আস্বাদন পাই। এখানে আমরা চাতক পক্ষির ন্যায় ঈশ্বরের প্রেম বিন্দুর প্রতি নিরীক্ষণ করিয়া রহিয়াছি, সেই বিন্দু ক্রমে সাগর হইয়া উঠিবে। আমরা যখন সেই অনন্ত প্রেমসাগরে নিমগ্ন হইব, তখন আমাদের হৃদয়ে শোক মোহ; বিলাপ ক্রন্দন; পাপ তাপ আর কিছুই থাকিরে না; কেবল যোগানন্দের উৎস, প্রেমানন্দের উৎস, ব্রহ্মানন্দের উৎস, নিরন্তর উৎসারিত হইতে থাকিবে।