ভগ্নহৃদয়/একবিংশ সর্গ

উইকিসংকলন থেকে

একবিংশ সর্গ।

অনিল।

কেমন? এখন তোর ঘুচেছে ত ভ্রম?
ভেঙ্গে দিলি হাল তুই, তুলে দিলি পাল তুই,
করিলি প্রবৃত্তি-স্রোতে আত্ম-বিসর্জন,
ভেবেছিল যাবি ভেসে কোন ফুলময় দেশে
চাঁদের চুম্বনে যেথা ঘুমায়ে গোলাপ
সুখের স্বপনে কহে সুরভি প্রলাপ!
কিন্তুরে ভাঙ্গিলি তরি কঠিন শৈলের পরি,
কিছুতেই পারিলিনে সামালিতে আর!
এখন কি করবিরে ভাব্ একবার!
ভগ্নকাষ্ঠ বুকে ধরি, উন্মত্ত সাগর পরি
উলটিয়া পালটিয়া যাবি ভেসে ভেসে;
নাই দ্বীপ, নাই তীর, উনমত্ত জলধির
ফেন-জটা উর্ম্মি যত নাচে অট্ট হেসে।
কেমন? এখন তোর ঘুচেছে ত ভ্রম?
এই ত নলিনী তোর? প্রাণের দেবতা তোর?
ছিছিরে কোথায় গিয়ে ঢাকিবি সরম?
নীচ হোতে নীচ অতি—হীন হোতে হীন—
পথের ধূলার চেয়ে অসার মলিন,

এই এক ধূলি-মুষ্টি কিনিয়া রাখিতে
সমস্ত জগৎ তোর চেয়েছিলি দিতে!
রাজ পথে মনের দোকান খুলিয়াছে—
রঙ্গ মাখাইয়া কত ঝুঁটা মন শত শত
সাজাইয়া রেখেছে সে দুয়ারের কাছে;
যে কোন পথিক আসে ডাকি তারে কয় পাশে,
হৃদয়ের ব্যবসায় করে সে রমণী—
আমারেও প্রতারণা কোরেছে এমনি!
যে মন কিনিয়াছিনু কিছুই সে নয়,
রঙ্গ-করা দুটা হাসি দুটা কথা-ময়!
প্রতি পিপাসিত আঁখি যে হাসি লুটিছে,
প্রতি শ্রবণের কাছে যে কথা ফুটিছে,
যে হাসির নাই বাস, নাই অন্তঃপুর,
চরণে যে বেঁধে রাখে মুখর নুপূর,
যে হাসি দিবস রাতি ভিক্ষার অঞ্জলি পাতি
প্রতি পথিকের কাছে নাচিয়া বেড়ায়,
অনিলরে! তারি তরে কেঁদেছিল হায়!
যে কথা, পথের ধারে পঙ্কের মতন,
জড়াইয়া ধরে প্রতি পান্থের চরণ,
সেই একটি কথা তরে হৃদয় আমার,
দিবানিশি ছিলি পোড়ে দুয়ারে তাহার!
হৃদয়ের হত্যা করা বার ব্যবসায়
সেই মহা পাপিষ্ঠার তুলনা কোথায়?
শরীর ত কিছু নয়, সে শুধু ধূলা—

ধুলির মুষ্টির সাথে হয় তার তুলা,
সমস্ত জগৎ তুল্য হৃদয়ের পাশে
সাথ কোরে হেন হৃদি যেন বিনাশে—
তোর মাথা পরশিল তাহারি চরণ!
তারেই দেবতা বোলে করিলি বরণ!
তারি পদতলে তুই সঁপিলি হৃদয়—
তোর হৃদি—যার কাছে কিছুই সে নয়!
শতেক সহস্র হেন নলিনী আসুক্ কেন
মনের পথের তোর ধূলিও না হয়।
বিধাতা, এ সৃষ্টি তব সব বিড়ম্বনা,
সত্য বোলে যাহা কিছু পরশিতে গেছি পিছু
ছুঁয়েছি যেমনি আর কিছুই রহেনা!
হৃদে হৃদে ভালবাসা কোরেছ সঞ্চার
অথচ দাওনি লোক ভাল বাসিবার!
সমস্ত সংসার এই খুঁজিয়া দেখিলে
দুটি হৃদি এক রূপ কেন নাহি মিলে?
ওই যে ললিতা হেথা আসিছে আবার।
কোরেছে সমস্ত মুখ বিষন্ন আঁধার!
কেন? তার হোয়েছে কি ভেবেত না পাই
যা’ লাগি বিষণ্ন হোয়ে রোয়েছে সদাই!
চায় কি সে দিন রাত্রি বুকে তারে রাখি,
অবাক্ মুখেতে তার তাকাইয়া থাকি?
দিবানিশি বলি তারে শত শত বার
“ভাল বাসি—ভাল বাসি প্রেয়সী আমার!”

তবেই কি মুখ তার হইবে উজ্জ্বল?
তবেই মুছিবে তার নয়নের জল?
এত ভাল কত জন বাসে এ ধরায়?
নিঃশব্দে সংসার তবু চোলে কি না যায়!
ঘরে ঘরে অশ্রুবারি ঝরিত নহিলে,
জগৎ ভাসিয়া যেত নয়ন সলিলে!
দিনরাত অশ্রুবারি আর ত সহিতে নারি;
দুর হোক-হেথা হোতে লইব বিদায়,
অদৃষ্টের অত্যাচার সহা নাহি যায়।
(অনিলের প্রস্থান।)

ললিতার প্রবেশ।


ললিতা।—এমনি করেই তোর কাটিবে কি দিন? 

ললিতারে—আর ত সহেনা!
এ জীবন আর ত রহেনা!
বিধাতা, বিধাতা, তোর ধরিরে চরণ—
বল মোরে কবে মোর হইবে মরণ?
নাইক সুখের আশা—চাইনাকো ভালবাসা—
সুখ সম্পদের আশা দুরাশা আমার,—
কপালে নাইক যাহা চাইনা তা আর!
এক ভিক্ষা মাগি ওরে—তাও কি দিবিনে মোরে?
সে নহে সুখের ভিক্ষা–মরণ—মরণ!—
মরণ—মরণ দেরে—কিছু চাহিনেরে

আর কোন আশা নাই—মরণ মরণ!—
এখনি মুদিলে আঁখি যদিরে আর না থাকি,
অমনি বায়ুর স্রোতে মিশাইয়া যাই—
এখনি এখনি আহা হয় যদি তাই!

অনিলের প্রবেশ।


ললিতা।—কোথা যাও, কোথা যাও, সখা তুমি কোথা যাও— 
একবার চেয়ে দেখ এই দিক পানে,
কহি গো চরণ ধোরে—ফেলিয়া যেওনা মোরে
আর ত যাতনা সখা সহেনা এ প্রাণে।
ভালবাসা চাইনা ত সখা গো তোমার,
একটুকু দয়া শুধু কোরো একবার!
একটুকু কোরো সখা মুখের যতন—
মুহূর্তের তরে সখা দিও দরশন,
নিতান্ত সহিতে নারি যবে পা দুখানি ধরি
আঘাত করি সখা ফেলিও না দূরে—
এই টুকু দয়া শুধু কোরো তুমি মোরে!
কোথা যাও বল বল, কোথা যাও চোলে!
যেতেছ কি হেথা হ’তে আমি আছি বোলে?
গভীর রজনী—এবে-ঘুমেতে মগন সবে
বল সখা কোথা যাও চাও কি করিতে?
অনিল।—মরিতে! মরিতে বালা! যেতেছি মরিতে! 
ললিতা, বিধবা তুই আজ হোতে হলি,
ফেল্ অনিলের আশা মন হোতে দলি!

আর তুই সাথে সাথে আসিস্‌ নে মোর,
হেথা বহি যাহা ইচ্ছা করিস্‌রে তোর?
আবার——আবার।
থাক্ ওই খেনে তুই এগোস্‌নে আর!
শত শত বার করে বলিতে কি হবে তোরে?
বাড়া হোথা, এক পদ আসিসনে আর!
আসি নে, বলি তোরে বলি বার বার!
শান্তিতে মরিব যে রে তাও তুই দিবিনে রে?
মরিতে যেতেছি, তবু রাহুর মতন
পদে পদে সাথে সাথে করিবি গমম?
দাড়া হোথা, সাথে সাথে আসিসনে আর,
এই তোর পরে শেষ আদেশ আমার।


(অনিলের প্রস্থান ও ললিতার মুচ্ছিত হইয়া পতন।)