ভগ্নহৃদয়/চতুর্থ সর্গ

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্থ সর্গ।

কবি।

(প্রথম গান।)


বিপাশার তীরে ভ্রমিবারে যাই,
প্রতিদিন প্রাতে দেখিবারে পাই
লতা-পাতা-ঘেরা জানালা মাঝারে
একটি মধুর মুখ।
চারিদিকে তার ফুটে আছে ফুল,
কেহবা হেলিয়া পরশিছে চুল,
দুয়েকটি শাখা কপাল ছুঁইয়া,

দুয়েকটি আছে কপোলে নুইয়া,
কেহবা এলায়ে চেতনা হারায়ে
চুমিয়া আছে চিবুক।
বসন্ত প্রভাতে লতার মাঝারে
মুখানি মধুর অতি!
অধর দুটির শাসন টুটিয়া
রাশি রাশি হাসি পড়িছে ফুটিয়া,
দুটি আঁখি পরে মেলিছে মিশিছে
তরল চপল জ্যোতি।





(দ্বিতীয় গান।


প্রতিদিন যাই সেই পথ দিয়া,
দেখি সেই মুখ খানি;
কুসুম মাঝারে রোয়েছে ফুটিয়া
কুসুমগুলির রাণী।
আপনাআপনি উঠে আঁখি মোর
সেই জানালার পানে,
আন-মন হোয়ে রহি দাঁড়াইয়া
কিছু খণ সেই খানে।
আর কিছু নহে, এ ভাব আমার
কবির সৌন্দর্য্য-তৃষা,
কলপনা-সুধা-বিভল কবির
মনের মধুর নেষা।
গোলাপের রূপ, বকুলের বাস,

পাপিয়ার বন-গান,
সৌন্দর্য্য-মদিরা দিবস রজনী
করিয়া করিয়া পান,
শিথিল হইয়া পোড়েছে হৃদয়,
নয়নে লেগেছে ঘোর,
বিকশিত রূপ বড় ভাল লাগে
মুগধ নয়নে মোর!




(তৃতীয় গান।)


প্রতিদিন দেখি তারে, কেন না দেখিনু আজি?
আলিঙ্গিতে গ্রীবা তার লতাগুলি চারিধার
আছে শত বাহু তুলি শত ফুল-হারে সাজি।
দূর-বন হোতে ছুটি আসিয়া প্রভাত-বায়
সে বয়ান না দেখিয়া, শূন্য বাতায়ন দিয়া
প্রবেশি আঁধার গৃহে করিতেছে হায় হায়!
কতখণ—কতখণ—কতখণ ভ্রমি একা,
গণিনু ফুলের দল, মাটিতে কাটিনু রেখা,
কতখণ—কতখণ—গেল চলি কতখণ
খণে খণে দেখি চাহি তবু না পাই দেখা!
ফিরিনু আলয় মুখে, চলিনু আপন মনে,
চলিতে চলিতে ধীরে ভূলে ভূলে ফিরে ফিরে
বার বার এসে পড়ি সেই—সেই বাতায়নে!
নিরাশ-আশার মোহে চেয়ে দেখি বারবার,

শূন্য—শূন্য—শূন্য সব বাতায়ন অন্ধকার,
ফুলময় বাহু দিয়া আঁধারকে বুকে নিয়া,
আঁধারকে আলিঙ্গিয়া রোয়েছে সে লতাগুলি,
তবু ফিরি ফিরি সেথা আসিলাম ভূলি ভূলি!
তেমনি সকলি আছে, বাতায়ন ফুলে সাজি,
দুলিছে তেমনি করি বাতাসে কুসুম-রাজি;
শুধু এ মনে আমার, এক কথা বার বার
এক সুরে মাঝে মাঝে উঠিতেছে বাজি বাজি—
“প্রতিদিন দেখি তারে কেননা দেখিনু আজি?”
“কেননা দেখিনু তারে কেননা দেখিনু আজি?”
অতিধীর পদক্ষেপে আলয়ে আসিনু ফিরি,
শতবার আন-মনে বলিলাম ধীরি ধীরি—
“প্রতিদিন দেখি তারে কেননা দেখিনু আজি?”


(চতুর্থ গান।)

কাল যবে দেখা হোল পথে যেতে যেতে চলি
মোরে হেরে আঁখি তার কেনগো পড়িল ঢলি?
অজানা পথিকে হেরি এত কি সরম হবে?
কি যেন গো কথা আছে, আটকিয়া রহিয়াছে,
আধ-মুদা দুটি আঁখি কি যেন রেখেছে ঢাকি,
খুলিলে আঁখির পাতা প্রকাশ তা হয় পাছে!
সরম না হয় যদি, এ ভাব কিসের তবে?
কাল তাই বোসে বোসে ভাবিয়াছি সারাক্ষণ,

স্বপনে দেখেছি তার ঢোলে-পড়া দুনয়ন!
প্রভাতে বসিয়া আজ ভাবিতেছি নিরিবিলি—
“মোরে হেরে আঁখি তার কেন গো পড়িল ঢলি?”


(পঞ্চম গান।)

সত্য কি তাহারে ভালবাসি?
ভুলি কি শুধু তার দেখে রূপরাশি?
স্বপনে জানি না তার হৃদয় কেমন,
সহসা আপনা ভুলে—শুধু কি রূপসী বোলে
জীবন্ত পুত্তলী পদে বিসর্জ্জিনু মন?


(ষষ্ঠ গান।)

মোর এ যে ভালবাসা রূপ-মোহ এ কি?
ভাল কি বেসেছি শুধু তার মুখ দেখি?
মুখেতে সৌন্দর্য্য তার হেরিনু যখনি
তখনি কি মন তার দেখিতে পাইনি?
মধুর মুখেতে তার আঁখি-দরপণে
মনচ্ছায়া হেরিয়াছি কল্পনা-নয়নে!
সেই সে মুখানি তার মধুর আকার
বেড়াতেছে খেলাইয়া হৃদয়ে আমার!
কত কথা কহিতেছে হরষে বিভোর,
কত হাসি হাসিতেছে গলা ধোরে মোর!
কি করিয়া হাসে আর কি কোরে সে কয়,

কি কোরে আদর করে ভালবাসাময়,
মুখানি কেমন হয় মৃদু অভিমানে,
সকলি হৃদয় মোর না জানিয়া জানে!
যেন তারে জানি কত বর্ষ অগণন,
এ হৃদয়ে কিছু তার নহে গো নূতন!
মুখ দেখে শুধু ভাল বেসেছি কি তারে?
মন তার দেখিনি কি মুখের মাঝারে?




(সপ্তম গান।)


দু জনে মিলিয়া যদি ভ্রমিগো বিপাশা-পারে!
কবিতা আমার যত সুধীরে শুনাই তারে!
দেহে মিলি এক প্রাণ গাহিতেছি এক গান,
দু জনের ভাবে ভাবে একেবারে গেছে মিশে,
দু জনে দুজন পানে চেয়ে থাকি অনিমিষে,
দু জনের আঁখি হোতে দু জনে মদিরা পিয়া
আসিবে অবশ হয়ে দোঁহার বিভল হিয়া!
মুখে কথা ফুটিবে না, আঁখি পাতা উঠিবে না,
আমার কাঁধের পরে নোয়াবে মাথাটি তার,
দু জনে মিলিয়া যদি ভ্রমি গো বিপাশা-পার!




(অষ্টম গান।)


শুনেছি—শুনেছি কি নাম তাহার—
শুনেছি—শুনেছি তাহা!

নলিনী—নলিনী—নলিনী—নলিনী—
কেমন মধুর আহা!
নলিনী—নলিনী—বাজিছে শ্রবণে
বাজিছে প্রাণের গভীর ধাম,
কভু আন-মনে উঠিতেছে মুখে
নলিনী—নলিনী—নলিনী নাম!
বালার খেলার সখীরা তাহারে
নলিনী বলিয়া ডাকে,
স্বজনেরা তার, নলিনী—নলিনী—
নলিনী বলে গো তাকে!
নামেতে কি যায় আসে?
রূপেতে কি যায় আসে?
হৃদয় হৃদয় দেখিবারে চায়
যে যাহারে ভালবাসে!
নলিনীর মত হৃদয় তাহার,
নলিনী যাহার নাম;
কোমল—কোমল—কোমল অতি
যেমন কোমল নাম!
যেমন কোমল, তেমনি বিমল
তেমনি সুরভ ধাম!
নলিনীর মত হৃদয় তাহার
নলিনী যাহার নাম!