ভানুসিংহের পত্রাবলী/২২

উইকিসংকলন থেকে

২২

শান্তিনিকেতন

 মাদ্রাজের দিকে যে-দিন যাত্রা ক’রেছিলুম সে-দিন শনিবার এবং সপ্তমী, অন্যান্য অধিকাংশ বিদ্যারই মতো দিনক্ষণের বিদ্যা আমার জানা নেই। ব’ল্‌তে পারিনে আমার যাত্রার সময় লক্ষকোটি যোজন দূরে গ্রহনক্ষত্রের বিরাট্ সভায় আমার এই ক্ষুদ্র মাদ্রাজ ভ্রমণ সম্বন্ধে কী রকম আলোচনা হ’য়েছিলো, কিন্তু তা’র ফলের থেকে বোঝা যাচ্চে জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর মধ্যে ঘোরতর মতভেদ হ’য়েছিলো। সেই জন্যে আমার ভ্রমণ-পথের হাজার মাইলের মধ্যে ছ-শো মাইল পর্য্যন্ত আমি সবেগে সগর্ব্বে এগোতে পেরেছিলুম। কিন্তু বিরুদ্ধ জ্যোতিষ্কের দল কোমর বেঁধে এম্‌নি অ্যাজিটেশন্ ক’র্‌তে লাগ্‌লো-যে, বাকি চারশো মাইলটুকু আর পেরোতে পারা গেল না। জ্যোতিষ্ক-সভায় কেবলমাত্র আমারই যাত্রা সম্বন্ধেই-যে বিচার হ’য়েছিলো তা নয়—বেঙ্গল-নাগপুর রেললায়ে লাইনের যে-এঞ্জিনটা আমার গাড়ি টেনে নিয়ে যাবে, মঙ্গল, শনি এবং অন্যান্য ঝগড়াটে গ্রহেরা তা’র সম্বন্ধেও প্রতিকূল মন্তব্য প্রকাশ ক’রেছিলো— যদি বলো সে-সভায় তো আমাদের খবরের কাগজের কোনো রিপোর্টার উপস্থিত ছিল না। তবে আমি খবর পেলুম কোথা থেকে, তবে তা’র উত্তর হচ্চে এই যে, আইনকর্ত্তারা তাঁদের মন্ত্রণা-সভায় কী আইন পাশ ক’রেচেন তা তাঁদের পেয়াদার গুঁতো খেলেই সব চেয়ে পরিষ্কার বোঝা যায়। যে-মুহূর্ত্তে হাওড়া স্টেশনে আমার রেলের এঞ্জিন বাঁশি বাজালে, সে-বাঁশির আওয়াজে কত তেজ, কত দর্প। আর রবীন্দ্রনাথ ওরফে ভানুদাদা নামক যে-ব্যক্তি তোরঙ্গ বাক্স ব্যাগ বিছানা গাড়িতে বোঝাই ক’রে তা’র তক্তর উপরে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হ’য়ে ইলেক্‌ট্রিক্ পাখার চলচ্চক্র-গুঞ্জন-মুখর রথ কক্ষে একাধিপত্য বিস্তার ক’র্‌লেন, তা’রই বা কত আশ্বস্ততা। তা’র পরে কত গড়্ গড়্, খড়্ খড়্, ঝর্ ঝর্, ভোঁ ভোঁ, ঢং ঢং, ষ্টেশনে ষ্টেশনে কত হাঁক্-ডাক্, হাঁস্‌ফাঁস্, হন্ হন্, হট্ হট্, আমাদের গাড়ির দক্ষিণে বামে কত মাঠ বাট বন জঙ্গল নদী নালা গ্রাম সহর মন্দির মসজিদ কুটীর ইমারত—যেন বাঘে তাড়া করা গোরুর পালের মতো ঊর্দ্ধশ্বাসে আমাদের বিপরীত দিকে ছুটে পালাতে লাগ্‌লো। এম্‌নি ভাবে চ’ল্‌তে চ’ল্‌তে যখন পিঠাপুরমে পৌঁছতে মাঝে কেবল একটা ষ্টেশন মাত্র আছে, এমন সময় এঞ্জিনটার উপরে নক্ষত্রসভার অদৃশ্য পেয়াদা তা’র অদৃশ্য পরোয়ানা হাতে নিয়ে নেবে প’ড়্‌লো, আর অম্‌নি কোথায় গেল তা’র চাকার ঘুর্‌নি, তা’র বাঁশির ডাক, তা’র ধূমোদ্গার, তা’র পাথুরে কয়লার ভোজ! পাঁচ মিনিট যায়, দশ মিনিট যায়, বিশ মিনিট যায়, এক ঘণ্টা যায়, ষ্টেশন থেকে গাড়ি আর নড়েই না! সাড়ে পাঁচটায় পিঠাপুরমে পৌঁছবার কথা কিন্তু সাড়ে ছ-টা, সাড়ে সাতটা বাজে তবু এমনি সমস্ত স্থির হ’য়ে রইলো-যে, “চরাচরমিদং সর্ব্বং”-যে চঞ্চল, এ কথাটা মিথ্যা ব’লে বোধ হ’লো। এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে ধক্ ধক্ ধুক্ ধুক্ ক’র্‌তে ক’র্‌তে আর একটা এঞ্জিন এসে হাজির। তা’র পরে রাত্রি সাড়ে আট্‌টার সময় আমি যখন পিঠাপুরমে রাজবাড়িতে গিয়ে উঠ্‌লুম তখন আমার মনের অবস্থাটা দেখি ঠিক সেই এঞ্জিনেরই মতো। মনকে জিজ্ঞাসা ক’র্‌লুম, “কেমন হে, মাদ্রাজে যাচ্চো তো? সেখান থেকে কাঞ্চি মদ্র অন্ধ পৌণ্ড্র প্রভৃতি কত দেশ দেশান্তর দেখ্‌বার আছে, কত মন্দির কত গুহা, কত তীর্থ ইত্যাদি ইত্যাদি”,—“আমার মন সেই এঞ্জিনটার মত চুপ ক’রে গম্ভীর হ’য়ে রইলো, সাড়াই দেয় না। স্পষ্ট বোঝা গেল, দক্ষিণের দিকে সে আর এক পাও বাড়াবে না। মনের সঙ্গে বেঙ্গল-নাগপুরের এঞ্জিনের একটা মস্ত প্রভেদ এই-যে, এঞ্জিন বিগ্‌ড়ে গেলে আর একটা এঞ্জিন টেলিফোন্ ক’রে আনিয়ে নেওয়া যায়, কিন্তু মন বিগ্‌ড়োলে সুবিধামতো আর একটা মন পাই কোথা থেকে? সুতরাং মাদ্রাজ চারশো মাইল দূরে প’ড়ে রইলো আর আমি গতকল্য শনিবার মধ্যাহ্নে সেই হাবড়ায় ফিরে এলুম। যে-শনিবার একদা তা’র কৌতুক-হাস্য গোপন ক’রে আমাকে মাদ্রাজের গাড়িতে চড়িয়ে দিয়েছিলো সেই শনিবারই আর একদিন আমাকে হাওড়ায় নামিয়ে দিয়ে তা’র নিঃশব্দ অট্টহাস্যে মধ্যাহ্ন আকাশ প্রতপ্ত ক’রে তুল্‌লে। এই তো গেল আমার ভ্রমণ-বৃত্তান্ত। কিন্তু তুমি যখন হিমালয়-যাত্রায় বেরিয়েছিলে তখন নক্ষত্র-সভায় তোমার সম্বন্ধেও তো ভালো রেজোল্যুশন্ পাস্ হয়নি। আমরা সবাই স্থির ক’র্‌লুম, গিরিরাজের শুশ্রূষায় তুমি সেরে আস্‌বে। কিন্তু তারাগুলো কেন কুমন্ত্রণা ক’র্‌তে লাগ্‌লো। আমার বিশ্বাস কী জানো, অনেকগুলো ঈর্ষাপরায়ণ তারা আছে, তা’রা তোমার ভানুদাদাকে একেবারেই পছন্দ করে না। প্রথমত, আমার নামটাই তাদের অসহ্য বোধ হয় এই জন্যে বদ্‌নাম কর্‌বার সুবিধা পেলে ছাড়ে না। তা’রপরে দেখেচে আমার সঙ্গে আকাশের মিতার খুব ভাব আছে সেইজন্যে নক্ষত্রগুলো আমাকে তাদের শত্রুপক্ষ ব’লে ঠিক ক’রেচে। যাই হোক্, আমি ওদের কাছে হার মান্‌বার ছেলে নই। ওরা যা কর্‌বার করুক্‌, আমি দিনের আলোর দলে রইলুম। তোমাকে কিন্তু কুচক্রী নক্ষত্রগুলোর উপরে টেক্কা দিতে হবে। বেশ শরীরটাকে সেরে নিয়ে, মনটাকে প্রফুল্ল ক’রে হৃদয়টাকে শান্ত করো, জীবনটাকে পূর্ণ করো। তা’রপরে লক্ষ্যকে ঊর্দ্ধে রেখে অপরাজিত চিত্তে সংসারের সুখ-দুঃখের ভিতর দিয়ে চ’লে যাও— কল্যাণ লাভ করো এবং কল্যাণ দান করো। নিজের বাসনাকে উদ্দাম ক’রে না তুলে মঙ্গলময়ের শুভ-ইচ্ছাকে নিজের অন্তরে বাহিরে সার্থক করো। ইতি ২০ অক্টোবর, ১৯১৮।