ভানুসিংহের পত্রাবলী/৫০

উইকিসংকলন থেকে

৫০

 আজ বুধবারে সকালে মন্দিরের কাজ শেষ ক’রে যেই আমার কুটীরের সাম্‌নে উত্তরদিকের বারান্দায় ব’সেচি অম্‌নি নানাবিধ চিঠি ও খবরের কাগজের সঙ্গে তোমার চিঠি এসে পৌঁচলো। এর আগে দু-এক দিন খুব ঘন বৃষ্টি হ’য়ে গিয়েছিলো, আজও স্তূপাকার কালো মেঘ আকাশক্ষেত্রের এদিকে ওদিকে ভ্রূকুটি ক’রে ব’সে আছে; এখনি তা’রা বৃষ্টিবাণ বর্ষণ ক’র্‌বে ব’লে ভয় দেখাচ্চে। কিন্তু আজ প্রথম সকালের মেঘের ফাঁক দিয়ে অরুণোদয় খুব সুন্দর হ’য়ে দেখা দিয়েছিলো। আমি তখন পূবদিকের বারান্দায় ব’সেছিলুম, আমার মনের সঙ্গে যেন তা’র মুখোমুখি কথা চ’ল্‌ছিলো। মন যেদিন তা’র চোখ মেলে, সেদিন প্রত্যেক সকালবেলাটিই তা’র কাছে অপূর্ব্ব হ’য়ে দেখা দেয়। বিশ্বলক্ষ্মী তাঁর অন্দরের দ্বারের কাছে রোজই দাঁড়িয়ে থাকেন, যেদিন আমরা প্রস্তুত হ’য়ে তাঁর কাছে গিয়ে হাত পাতি, সেদিন তাঁর দান মুঠো ভ’রে পেয়ে থাকি। পৃথিবী থেকে যাবার সময় আমি এই কথা ব’লে যেতে পার্‌বো-যে, এমন দান আমি অনেক পেয়েচি।

 সেপ্টেম্বরের আরম্ভে আমার বোম্বাই যাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেন না, সেপ্টেম্বরের ১৫ই তারিখে ক’ল্‌কাতায় আমাদের শারদোৎসবের পালা ব’স্‌বে—আমাকে সাজ্‌তে হবে সন্ন্যাসী। আমার এই সন্ন্যাসী সাজ্‌বার আর কোনো অর্থ নেই—অর্থ-সংগ্রহ ছাড়া। শুনে তোমরা বিস্মিত হ’য়ো না, তোমাদের বারাণসীধামে এমন অনেক লোক আছেন আছেন যাঁরা সন্ন্যাসী সেজেছেন অর্থের প্রত্যাশায়, আর যাঁদের প্রত্যাশা নিরর্থক হয়নি।

 এল্‌ম্‌হার্ষ্ট সাহেব এসেচেন। তাঁর কাছে শুন্‌লুম তুমিও নাকি আসক্তি-বন্ধন ছেদন ক’রে সন্ন্যাসিনী হবার চেষ্টায় আছো। সেইজন্যেই কি লজিক-পড়া সুরু ক’রেচো? কিন্তু লজিক জিনিসটা হ’চ্চে কাঁটাগাছের বেড়া, তা’তে ক’রে মানসক্ষেত্রের ফসলকে নির্ব্বোধ গরু-বাছুরের উৎপাত থেকে রক্ষা করা চলে; কিন্তু আকাশ থেকে যে-সব বর্ষণ হয়, রৌদ্রই বলো, বৃষ্টিই বলো, তা’র থেকে নিরাপদ হবার উপায় তোমার ঐ ন্যায়শাস্ত্রের বেড়া নয়। তুমি আমাকে ভয় দেখিয়েচো-যে, এবার আমার সঙ্গে দেখা হ’লে তুমি আমার লজিকের পরীক্ষা নেবে। আমি আগে থাক্‌তেই হার মেনে রাখ্‌চি। পৃথিবীতে দুই জাতের মানুষ আছে। একদলকে লজিকের নিয়ম পদে পদে মিলিয়ে চ’ল্‌তে হয়, কেন না তা’রা পায়ে হেঁটে চলে,—আর একদল ন্যায়শাস্ত্রের উপর দিয়ে চ’লে যায়, উনপঞ্চাশ বায়ু তাদের বাহন, তা’রা এপক্ষ ওপক্ষের বিরোধ খণ্ডন ক’র্‌তে ক’র্‌তে নিজের পথ খুঁজে মরে না,—তা’রা এককালে নিজেরই দুই পক্ষ বিস্তার ক’রে সেই পথ দিয়ে চ’লে যায়, যে-পথ হ’চ্চে রবি-কিরণের পথ।

 এই প্রসঙ্গে, এই পত্র-লেখক কোন্ জাতের লোক তা’র একটু আভাসমাত্র যদি দিই তা হ’লে তুমি ব’লে ব’স্‌বে—তিনি ভারি অহঙ্কারী। যারা লজিকের অহঙ্কার ক’রে তাল ঠুকে বেড়ায়, তারাই নন্‌লজিক্যালদের ব্যোমপথ-যাত্রার পক্ষ-বিধূননের মাহাত্ম্য খর্ব্ব কর্‌বার চেষ্টা করে। কিন্তু সে-মহিমা তো মুক্তির দ্বারা আত্মসমর্থনের অপেক্ষা করে না;—সে আপন অচিহ্নিত পথে আপন গতিবেগের দ্বারাই সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়।

 আজ এইখানেই ইতি। ১৩ই ভাদ্র, ১৩২৯।