ভানুসিংহের পত্রাবলী/৫৬

উইকিসংকলন থেকে

৫৬

বোম্বাই

 তুমি লিখেচো, তোমার সব কথার জবাব দিতে; অতএব তোমার চিঠি সাম্‌নে রেখে জবাব দিতে ব’সেচি—এবারে বোধ হয় পুরো মার্ক পাবো। তোমার প্রথম প্রশ্ন—আমি এখন কোথায় আছি। ছিলুম নানা জায়গায়, প্রধানতঃ কাঠিয়াবাড়ে, তা’রপরে আমেদাবাদে, তা’রপরে বরোদায়, আজ সকালে এসেচি বোম্বাইয়ে। এতকাল ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম ব’লে সমস্ত চিঠি এখানে জমা হ’চ্ছিলো, তা’র মধ্যে তোমার দু-খানা চিঠি। লেফাফার সর্ব্বাঙ্গে নানাপ্রদেশের নানা ডাকঘরের কালো কালো চাকা চাকা ছাপ। এখানে বেশিদিন থাকা হবে ব’লে বোধ হ’চ্চে না, কারণ ৭ই পৌষ নিকটবর্ত্তী। অতএব দু-চার দিনের মধ্যে সুজলাং সুফলাং মলয়জ শীতলাং বঙ্গভূমিকে প্রণাম ক’র তে যাত্রা ক’র্‌বো। ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হ’য়ে প’ড়েচি, যাই হোক, খৃষ্টমাসের পূর্ব্বেই ফির্‌বো। তোমার বাবাকে লিখে দিয়েচি, তোমাকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আস্‌তে। এই পর্য্যন্ত তোমায় উত্তর দিয়ে তোমার চিঠি খুঁজে দেখ্‌লুম, আর কোনো প্রশ্ন নেই।

 এল্‌ম্‌হার্ষ্ট্ আমার সঙ্গে ঘুর্‌তে ঘুর্‌তে বরোদায় এসে জ্বরে প’ড়েছিলো। সেখানে তিন দিন বিছানায় প’ড়েছিলো, এখানে এসে সেরে উঠেচে। আর আমার সঙ্গে আছে গোরা। এবারে সাধুচরণের সঙ্গ ও সেবা থেকে বঞ্চিত আছি। বনমালী নামধারী উৎকলবাসী সেবক বৌমার আদেশক্রমে এসেচে। সে সর্ব্বদাই ভয়ে ভয়ে আছে। সবচেয়ে ভয় আমাকে, অথচ আমি বিশেষ ভয়ঙ্কর নই। দ্বিতীয় ভয়, পাছে রাজবাড়ির অন্নপানে বিদেশে গঙ্গাতীর হ’তে দূরবর্ত্তী দেশে অকালমৃত্যু ঘটে। তৃতীয় ভয়, রেলগাড়িতে বিদেশীয় জনতাকে,—তা’রা ওর সঙ্গে হিন্দী বলে, ও বলে বাংলা—তাতে কথোপকথন উভয় পক্ষেই দুর্ব্বোধ হ’য়ে ওঠে। ওর বিশ্বাস, এ জন্য বিদেশীরাই দায়িক। ওর আর-একটা বিশেষ গুণ এই-যে, ওকে যদি কোনো কাপড় বের ক’রে দিতে বলি তা হ’লে সিন্দুক থেকে একে একে সব কাপড় বের ক’রে তবে সেটা নির্ব্বাচন ক’র্‌তে পারে, আবার সবগুলো তাকে একে একে ফিরে গোচাতে হয়। মানুষের আয়ু যখন অল্প, সময় যখন সীমাবদ্ধ, তখন এরকম চাকর নিয়ে মর্ত্ত্যলোকে অসুবিধায় প’ড়্‌তে হয়। ওর একটা মস্ত গুণ এই-যে, ও ঠাট্টা ক’র্‌লে বুঝ্‌তে পারে, ঠিক সময়ে হাস্‌তে জানে; আমার late lamented সাধুচরণের সে-বালাই ছিল না। আমার আবার স্বভাব এমন-যে, ঠাট্টা না ক’রে বাঁচিনে, তাই ও যতক্ষণ কাপড় বের ক’র্‌চে আর গোচাচ্চে, আমি ততক্ষণ সেই সুদীর্ঘ সময় ঠাট্টা ক’রে অতিবাহন করি। যাই হোক্, ওকে বিদেশী হাওয়া, বিদেশী খাওয়া, বিদেশী ভিড় থেকে ফিরে নিয়ে গিয়ে কোনোমতে বৌমার হাতে আস্তটি ফিরে দিতে পার্‌লে নিরুদ্বিগ্ন হই। আমার যে কতবড়ো দায়িত্ব, সে ওকে না দেখ্‌লে ভালো করে অনুধাবন কর্‌তেই পার্‌বে না। একে আমার বিশ্বভারতী, তার উপর বনমালী। ভাবনার আর অন্ত নাই।

 আমি বোধহয় দুই তিন দিনের মধ্যেই রওনা হবো, অতএব যদি চিঠি লেখো তো শান্তিনিকেতনের ঠিকানায় লিখো। ইতি, বোধ হ’চ্চে ১০ই ডিসেম্বর।