ভারতবর্ষে/সিংহলে বৌদ্ধধর্ম্ম

উইকিসংকলন থেকে

সিংহলে বৌদ্ধধর্ম্ম।

(৩)

 ফরাসিস্‌ পর্য্যটক আন্দ্রে শেভ্রিয়োঁ সিংহলবাসী বৌদ্ধদিগের আচার ব্যবহার ও ধর্ম্মানুষ্ঠানের বিষয় যাহা বর্ণনা করিয়াছেন, তাহা হইতে বৌদ্ধধর্ম্মের সারাংশ বেশ অল্পের মধ্যে জানা যায়। তিনি বলেন, “এই কান্দি সিংহলের একটী পুরাতন নগর—সিংহল-রাজদিগের পুরাতন রাজধানী। এই স্থানে বড় বড় তালবৃক্ষের নীচে কৃষ্ণাভ সলিল একটি সরোবর আছে—তাহার ধারে রাজাদিগের পুরাতন প্রাসাদ অবস্থিত। প্রাসাদের সন্নিকট, সেই মরাল-প্রতিবিম্বিত কৃষ্ণ সরোবরের ধারে একটি পুরাতন বৌদ্ধ মন্দির প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরের দ্বারদেশে যে তিনটি বিকট অদ্ভূত মূর্ত্তি রহিয়াছে তাহার অর্থ কি? আর, এই বৌদ্ধ পুরোহিতেরা, যাহারা মন্দিরের মর্ম্মর-শোভিত দালানের উপর দিয়া ক্রমাগত যাতায়াত করিতেছে, ইহারা না-জানি সমস্ত দিন কি চিন্তা করে? মুণ্ডিত-মস্তক, খালি-পা, গেরুয়া বসনের মধ্য হইতে একটি হাত বাহির করা, এই বৌদ্ধ পুরোহিতেরা মন্দিরের বাহির-দালানে নিঃশব্দে গমনাগমন করিতেছে। ইহাদের মুখে একটি রহস্যময় অবর্ণনীয় মধুর হাস্য সর্ব্বদাই বিরাজমান। আমার পাণ্ডা আমাকে মন্দিরের কেন্দ্রবর্ত্তী একটি বৃহৎ প্রাঙ্গনে লইয়া গেল। যে ‘বো’-বৃক্ষ ধ্যানমগ্ন শাক্যমুনিকে পাঁচ বৎসর কাল ছায়া দান করিয়াছিল, তাহারই একটি চারা এই প্রাঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত। এই বৃক্ষের তলদেশে আমি নীত হইলাম। সুধীরে মস্তক ঈষৎ অবনত করিয়া সেই পাণ্ডা আমাকে সেই বৃক্ষ হইতে একটি পাতা ছিঁড়িয়া দিল। কান্দি-মঠের মঠধারী আচার্য্য শ্রীসুমঙ্গল অত্যন্ত বিজ্ঞ ও সুপণ্ডিত; ইনি আমাদের যুরোপের সমস্ত বিষয় জানিবার জন্য উৎসুক এবং আমাদের চিন্তাশীল লেখকদিগের বিজ্ঞানবাদ এবং দর্শন ও নীতিতন্ত্রের ভাব দেখিয়া মনে করেন যে, তাঁহারা বৌদ্ধধর্ম্মের অনেকটা নিকটবর্ত্তী হইয়াছেন। আধঘণ্টা কাল ইনি আমার সহিত বাক্যালাপ করিলেন ও বৌদ্ধধর্ম্মের প্রধান প্রধান গ্রন্থসকলের উল্লেখ করিলেন। বৌদ্ধেরা কিরূপে জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করে তাহার কতকটা ভাব তাঁহার কথাবার্ত্তায় জানিতে পারা গেল।

 বৌদ্ধদিগের মধ্যে দুই শ্রেণী; এক অভিনবব্রতী সামান্য ভিক্ষু, আর এক বৌদ্ধপুরোহিত শ্রমণ—এই শ্রমণেরা আপনার ইচ্ছাকে বশীভূত করিতে শিখিয়াছে। এই আত্মবশীকরণ-রূপ চরম লক্ষ্য সাধন করিবার জন্য ইহারা ‘পিতৃমোক্ষ’ নামক গ্রন্থের উপদেশ অনুসরণ করিয়া থাকে। ইহা বৌদ্ধধর্ম্মের একটি পুরাতন গ্রন্থ। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা আটটি বস্তু গ্রহণ করিতে পারে; তিনখানি পরিধান বস্ত্র, একটি কটীবন্ধ, একটি কমণ্ডলু, একটি ক্ষুর, একটি ছুঁচ, পানীয় হইতে কীটাদি জীব ছাঁকিয়া ফেলিবার জন্য একটি ছাঁকুনি। মঠের অভ্যন্তরে এই দারিদ্র্য-ব্রতের খুঁটিনাটি সমস্ত নিয়ম যথাশাস্ত্র পরিপালিত হয়। নবব্রতী ভিক্ষু অরুণোদয়ের পূর্ব্বে শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করে, নিজ পরিধানবস্ত্র ধৌত করে, মন্দিরের দালান ও বোধী বৃক্ষের (বট) চতুষ্পার্শ্বস্থ ভূমি ঝাঁট দেয়, সমস্ত দিনের পানীয় জল উত্তোলন করিয়া তাহা ছাঁকিয়া রাখে; অবশেষে একটি নির্জ্জন স্থানে গিয়া ধ্যান করে। পবিত্র বোধী-বৃক্ষের সম্মুখে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করিয়া বুদ্ধদেবের মহৎ গুণসকল এবং নিজের ক্রট ও দোষের বিষয় চিন্তা করে; পরে, কমণ্ডলু হস্তে লইয়া, নিজ গুরুর সমভিব্যাহারে ভিক্ষার্থ বহির্গত হয়। উহারা মুখ ফুটয়া কিছুই চাহে না—কেবল লোকের দ্বারে স্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া থাকে। গৃহে প্রত্যাগত হইয়া, নবব্রতী ভিক্ষু গুরুর চরণ প্রক্ষালন করে, কমণ্ডলু ধৌত করে, চাউল সিদ্ধ করে এবং বুদ্ধের বিষয়—বুদ্ধের দয়া ও ঔদার্য্যের বিষয় চিন্তা করে। এক ঘণ্ট। পরে, একটি প্রদীপ জ্বালাইয়া শিক্ষাগৃহে প্রবেশ করে—পুরাতন পাণ্ডুলিপির নকল করে, কিম্বা গুরুর পদতলে বসিয়া তাঁহার উপদেশ-বাক্য শ্রবণ করে এবং দিনের মধ্যে যে সকল দোষ করিয়াছে তাহা তাঁহার নিকট প্রকাশ করে। পুরোহিত-শ্রেণীর বৌদ্ধদিগকে কোনপ্রকার শারীরিক শ্রম করিতে হয় না; তাঁহারা ধ্যান ধারণায় অনেকটা সময় নিয়োগ করিতে পারে; কিন্তু তাহারা প্রার্থনা করে না; কারণ, বৌদ্ধধর্ম্ম, কোন দেবতার সাহায্য চাহে না। দুঃখকষ্ট হইতে অব্যাহতি পাইবার জন্য উহারা নিজের উপরেই নির্ভর করে। স্পিনোজা ও ষ্ট্রোয়িক-সম্প্রদায় যে উপায় অবলম্বন করিতে উপদেশ দিয়াছেন ইহারাও সেই উপায় অবলম্বন করিয়া থাকে। সর্ব্বপ্রকার জীবের সমষ্টিকে ধ্যান করিবার জন্য ইহারা ক্ষণস্থায়ী ‘আমি’-কে ভুলিয়া যায়। পাঁচ প্রকার ধ্যানের দ্বারা ইহারা সমস্ত জগৎকে চিন্তা করে। প্রথম ধ্যান, ‘মুক্তি-ভাবনা’। সমস্ত কষ্ট, রিপুর উদ্বেগ, অসৎ বাসনা হইতে মুক্ত হইলে আমি যেমন নিজে সুখী হইতে পারি বলিয়া মনে করি, সেইরূপ সমস্ত জগতের জীব ঐ প্রকারে সুখী হউক্ এই কামনা করা প্রথম ধ্যানের বিষয়। এমন কি, শক্র হইলেও কেবল তাহার গুণের ভাগ গ্রহণ করিয়া, আমি যে সুখ নিজে চাহি, সে সুখ যেন সেও পায় এইরূপ কামনা অকপট ভাবে করিতে হইবে।

 দ্বিতীয় ধ্যান—‘করুণা ভাবনা’। সমস্ত জীব যে কষ্টযন্ত্রণা ভোগ করিতেছে তাহা মনে করিয়া, আপনার অন্তরে সেই কষ্ট জাগ্রত করিয়া তুলিতে হইবে—ইহাই দ্বিতীয় ধ্যানের বিষয়।

 তৃতীয় ধ্যান—‘মুদিত-ভাবনা’। যে সকল জীব সুখী, কিম্বা মনে করে তাহারা সুখী, তাহাদের বিষয় চিন্তা করিয়া এইরূপ কামনা করিতে হইবে যাহাতে অন্যেরাও তাহাদের মত সুখী হয়, এবং তাঁহাদের সুখে যাহাতে আপনাকেও সুখী মনে করিতে পারি এইরূপ চেষ্টা করিতে হইবে।

 চতুর্থ ধ্যান—‘অশুভ-ভাবনা’। শরীরের হীনতা, অশুচিতা, রোগের ভীষণ যন্ত্রণা-সকল মনে করিয়া এইরূপ ভাবিতে হইবেঃ—সাগর-সম্ভূত ফেনপুঞ্জের ন্যায় এ সমস্ত দুঃখকষ্ট তিরোহিত হয়, অনন্ত জন্মমৃত্যুর পারম্পর্য্য বশতই উহাদের অস্তিত্ব, এই জন্মমৃত্যুর পারম্পর্য্যে বাস্তবিকতা কিছুই নাই—উহা অলীক আবির্ভাব মাত্র। শেষ ধ্যান—‘উপেক্ষা-ভাবনা’। যাহা কিছু মানুষ ভালমন্দ বলিয়া মনে করে, যাহা কিছু ক্ষণস্থায়ী,—স্বতন্ত্রতা, পরতন্ত্রতা, প্রেম দ্বেষ, ঐশ্বর্য্য দারিদ্র্য, যশ অপযশ, রূপযৌবন, জ্বরা ও রোগ, এই সমস্ত, নিতান্ত উপেক্ষার সহিত, সম্পূর্ণ প্রশান্তভাবে চিন্তা করিবে। ... ... ... কান্দি নগরের যতই নিকটবর্ত্তী হইতে লাগিলাম ততই দেখি পথ লোকে লোকাকীর্ণ। রাত্রিকালে, স্ত্রীপুরুষ দলে দলে নগরাভিমুখে আগ্রহের সহিত গমন করিতেছে। নিস্তব্ধতার মধ্যে বৌদ্ধ পুরোহিত এক প্রকার সুর করিয়া জঙ্গলের ও ঘরের লোকদিগকে ডাকিতেছে, আর অমনি লোকসকল পিল্‌পিল্‌ করিয়া কোথা হইতে যে বাহির হইতেছে বোঝা যায় না—বড় বড় গাছে ঢাকা, ঝোপ্‌ঝাপের মধ্যে যে সকল গৃহ ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত রহিয়াছে, মনে হয়, যেন তাহা হইতেই তাহারা নির্গত হইতেছে। যে সকল ভক্তের দল নিস্তব্ধ ভাবে পুষ্পভার হস্তে লইয়া চলিতেছিল, সেই গভীর অন্ধকার রাত্রে আমিও অদৃশ্যভাবে তাহদের সঙ্গে মিশিয়া গেলাম। কাঁসর ঘণ্টার রবে নগর পরিপূর্ণ—তা’ ছাড়া আর কোন শব্দ শোনা যায় না। সেই কৃষ্ণ সরোবরের ধারে, মন্দিরের বৃহৎ দ্বারের নীচে সেই বিকট মূর্ত্তিগুলি চিরজাগ্রত, এবং মন্দিরস্থিত উদ্যানের প্রবেশ-পথে পুরোহিতেরা নিস্তব্ধভাবে দণ্ডায়মান ও কোনপ্রকার অঙ্গভঙ্গী না করিয়া নীরবে ভক্তদিগের পুষ্পাঞ্জলি গ্রহণ করিতেছে। একটা রৌপ্যময় গরাদের নীচে দিয়া আমরা চলিলাম এবং তৎপরেই একটা ছায়াময় বড় দালানের মধ্যে গিয়া পড়িলাম। সেখানে ছোট ছোট পবিত্র দীপসকল একপ্রকার রহস্যময় অস্ফুট আলোক বিকাশ করিতেছে। শত শত ধূপাধার হইতে সুগন্ধী নীলাভ ধূমরাশি উর্দ্ধে প্রসারিত হইয়া স্থিরভাবে উপরে ভাসিতেছে। এই গুরুভার, নিদ্রাকর্ষক ধূপধূমের প্রভাবে সমস্ত দৃশ্যটি কেমন একপ্রকার অবাস্তব অলৌকিক আকার ধারণ করিয়াছে। অন্ধকারের মধ্যে বুদ্ধদেবের বিবিধ মূর্ত্তি হইতে ছায়া পড়িয়া ইতস্ততঃ অৰ্দ্ধস্ফুট ভাবে দেখা যাইতেছে। কোন বুদ্ধমূর্ত্তি শয়ান, কোন বুদ্ধমূর্ত্তি আসীন—সকলের তলদেশে পুষ্পরাশি বিকীর্ণ। আমরা একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন সিঁড়ি দিয়া উঠিলাম, তাহার ধারসকল অগ্নিকুণ্ড-নিক্ষিপ্ত কোলাহলময় দানবদৈত্যের চিত্রে চিত্রিত। উপরে একটি রৌপ্যময় গরাদের পশ্চাতে পুরোহিতেরা দণ্ডায়মান—ভক্তেরা তাহাদের পুষ্পোপহার একটি বেদীর উপর রাখিতেছে, আর সেই পুষ্পোপহার পুরোহিতেরা গ্রহণ করিতেছে। সেই নীরব ভক্তদলের সম্মুখে, একটি সুন্দর যুবক পুষ্পোপহার হস্তে স্থিরভাবে দণ্ডায়মান। মূর্ত্তির সম্মুখে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করিয়া সে অনেকবার নতশির হইল। এইবার অর্দ্ধনত হইয়া বক্ষের উপর হস্তযুগল স্থাপন করিয়া খানিকটা স্থিরভাবে রহিল। তাহার সুবক্র সুন্দর ওষ্ঠে ও তাহার দীর্ঘায়ত সুন্দর নেত্রে, রহস্যময় মধুর প্রশান্ত হাস্য বিরাজমান। ... ... ... নিস্তব্ধতা আরও যেন গুরুভার হইয়া উঠিল; কিয়ৎকাল পরেই সহসা তুরী ভেরীর গভীর নিনাদে সেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হইল। কিন্তু জনতার মধ্য হইতে কোন শব্দ নাই। পবিত্র দীপাবলীর নিম্নে, পুষ্পরাশির পশ্চাতে, পুরোহিতেরা গম্ভীর ভাবে দণ্ডায়মান।

 মন্দিরের বিজন অন্তরতম প্রদেশে, পুরোহিতদিগের পশ্চাতে পবিত্র স্থানে, যোগাসনে উপবিষ্ট একটি বৃহৎ স্ফটিকমূর্ত্তি স্থাপিত—তাহার অবয়ব-রেখাসকল অস্পষ্ট। মূর্ত্তিটি এরূপ স্বচ্ছ যে, উহাকে উপছায়া বলিয়া মনে হয়—মনে হয় যেন জড়ভাব হইতে মুক্ত কোন অশরীরী আত্মা। যে মহাপুরুষ কঠোর সমাধিবলে আপন রক্তমাংসের বন্ধন, কামনার বন্ধন সকল ছিন্ন করিয়াছিলেন, ইহা তাঁহারই উপযুক্ত মূর্ত্তি বটে। এই মূর্ত্তি জনসাধারণকে শাসন করিতেছে, অথচ কোলাহলময় মনুষ্যের জনতা হইতে দূরে অবস্থিত—এবং ইহার স্বচ্ছ ওষ্ঠাধরে যে অনন্ত মধুর হাস্য বিরাজমান তাহাতে মনে হয়, যাহার এই মূর্ত্তি তিনি চিরকালের মত শান্তি-ধামে প্রবেশ করিয়াছেন।

 যতই আমি এই দেশ ও দেশের লোকদিগকে দেখিতেছি ততই যেন আমি এই ধর্ম্ম ও ধর্ম্মনীতি বুঝিতে পারিতেছি। আজ যাহা আমাদের যুরোপীয় পণ্ডিতেরা বলিতেছেন, ত্রয়োবিংশতি শতাব্দী হইতে বৌদ্ধমুনিরা তাহাই শিক্ষা দিয়া আসিতেছেন। তাঁহারা বলেন, কিছুই নাই—সকলই হইতেছে। এই জগৎ ক্ষণস্থায়ী আবির্ভাবের প্রবাহমাত্র—পরিবর্ত্তন ব্যতীত ইহাতে আর কিছুই স্থায়ী নহে। পৃথিবী, আকাশ, অষ্টাদশ নরক, দানবগণ ও তাহাদের নিবাসভূমি নিকৃষ্ট লোক-সকল, সকলই নদীর জলের ন্যায় প্রবহমান। একটার পর আর একটা—এইরূপ ক্রমান্বয়ে এক কালচক্রের পর আর এক কালচক্র, এক যুগের পর যুগান্তর পুনরাবৃত্ত হইতেছে। এই শ্রেণীপরম্পরা অনন্ত—ইহা কস্মিন্‌ কালেও আরম্ভ হয় নাই, এবং কস্মিন্‌ কালেও ইহার শেষ হইবে না। এই জগতের মধো ‘মনুষ্য’ পদার্থ টা কি?—চিন্তাশীল জীব বটে, কিন্তু অন্যান্য জীবেরই মত, অর্থাৎ কিছুকালের জন্য কতকগুলি শক্তি একাধারে সমবেত হইয়াছে—কিছুকাল পরেই উহা বিক্ষিপ্ত ও বিলীন হইয়া যাইবে। ‘মনুষ্য’ কি?—এমন কতকগুলি বৃত্তি, ভাব, কামনা, ইচ্ছা, ও সংস্কারের সমষ্টিমাত্র যাহাদিগের মধ্যে কিছুকালের জন্য যোগ ও শৃঙ্খলা রক্ষিত হইতেছে। শরীরের মধ্যেও এইরূপ কোষাণু সকল অনুক্ষণ মরিতেছে, জন্মিতেছে, অথচ সমগ্র শরীরের গঠন কিছুকাল সমান ভাবেই থাকিতেছে। মনুষ্যের মধ্যে কিছুই স্থায়ী নহে। জীবনের ঘটনাসকল—যাহা কোন নির্দ্দিষ্ট নিয়মানুসারে একত্র হইতেছে ও পরস্পরকে অনুসরণ করিতেছে এবং যাহা লইয়াই মনুষ্যের ব্যক্তিত্ব,—সেই ঘটনাগুলিও স্থায়ী নহে; কিম্বা যে নির্দ্দিষ্ট নিয়মে এই ঘটনাগুলি ঘটতেছে তাহারও বৃদ্ধি হ্রাস হইয়া ধীরে ধীরে পরিবর্ত্তন হইতেছে। যে সকল উপাদানের সমষ্টি লইয়া প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব তাহা পঞ্চস্কন্ধে বিভক্ত; এবং বৌদ্ধের তন্ন তন্ন করিয়া দেখাইয়া দেন যে, এই স্কন্ধগুলির মধ্যে কোন স্কন্ধই অথবা কোন উপাদানই স্থায়ী নহে। প্রথম স্কন্ধে ভৌতিক পদার্থের গুণসমূহ—যথা বিস্তৃতি, গভীরতা, বর্ণ ইত্যাদি; ইহারা সাগরোৎপন্ন ফেনরাশির ন্যায় উৎপন্ন হইতেছে ও উৎপন্ন হইয়াই পুনর্ব্বার তিরোহিত হইতেছে। দ্বিতীয় স্কন্ধে ইন্দ্রিয়বোধসমূহ—ইহারাও জলোপরি-নৃত্যশীল বিশ্ববৎ। তৃতীয় স্কন্ধে জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তি; ইহারাও দক্ষিণ প্রদেশের অনিশ্চিত মৃগতৃষ্ণিকাসম। চতুর্থ স্কন্ধে মানসিক ও নৈতিক সংস্কারসমূহ—ইহা কদলীকাণ্ডের ন্যায় অসার। শেষ কথা, চিন্তাসকল উপছায়ামাত্র—ঐন্দ্রজালিক মায়ামাত্র। ‘গৌতম বলিলেন, হে ভিক্ষুগণ, ভিন্ন ভিন্ন মতাবলম্বী পণ্ডিতেরা যে ভাবেই আত্মাকে চিন্তা করুন না কেন, এই পঞ্চ স্বন্ধের অন্যতম স্কন্ধকে, কিম্বা তাহদের সমষ্টিকেই তাহারা আত্মা বলিয়া কল্পনা করেন। এই প্রকারে, হে ভিক্ষুগণ, যাহারা বৌদ্ধ হয় নাই, কিম্বা যাহারা বৌদ্ধধর্ম্ম বুঝিতে পারে না, তাহারা কখন মনে করে, আত্মা ও ভৌতিক গুণ একই; কখনও বা মনে করে, আত্মা ও ইন্দ্রিয়-বোধ একই; এই প্রকারে আত্মাকে অপর শেষ তিনটি স্কন্ধরূপেও কল্পনা করিয়া থাকে। এই প্রকারে, একটার পর আর একটা স্কন্ধ কল্পনা করিয়া, অবশেষে এই সংস্কারটিতে উপনীত হয়—সে কি?—না, আমি আছি, আমার আত্মা আছে; আমি থাকিব কিম্বা আমি থাকিব না; আমার ভৌতিক গুণ থাকিবে কিম্বা থাকিবে না; আমার সংস্কার সকল থাকিবে কিম্বা থাকিবে না। কিন্তু বুদ্ধের জ্ঞানবান শিষ্যেরা, পঞ্চেন্দ্রিয়ের অধিকারী হইলেও তাঁহারা অজ্ঞান হইতে মুক্ত এবং তাহারা সত্যে উপনীত হইয়াছেন। সেইজন্য তাঁহাদের সংস্কার অন্যরূপ;—আমি আছি, আমার আত্মা আছে, আমি থাকিব কিম্বা থাকিব না, এবম্বিধ সংস্কার তাহাদের মানসক্ষেত্রে উপস্থিত হয় না।’ ডেকার্ট বলিয়াছেন, আমি চিন্তা করিতেছি, অতএব আমি আছি। কিন্তু বুদ্ধদেব হইলে এইরূপ বলিতেন;—আমি চিন্তা করিতেছি, অতএব আমি নাই। কারণ, চিন্তা কাহাকে বলে? কতকগুলি পরিবর্তনপরম্পরা—বিভিন্ন ঘটনার পারম্পর্য্য ভিন্ন ইহা আর কিছুই নহে। আধুনিক মনস্তত্ত্ববিৎ পণ্ডিতদিগের ত এই মত। ইংলণ্ডের জন ষ্টুয়ার্ট মিল এবং ফ্রান্সের টেন এই বিষয় অনুশীলন করিয়া এই স্থির করিয়াছেন যে, ইহা এক প্রকার কল-কৌশল যাহাতে করিয়া ‘আমি’ বলিয়া একটা পদার্থ আমাদের মধ্যে আছে এইরূপ বিভ্রম উৎপন্ন হয়। বৌদ্ধেরা বলেন, এই ভ্রমটি সর্ব্বাপেক্ষা হানিজনক, আমাদের ফাঁদে ফেলিবার একটি প্রধান উপায়; কারণ এই বন্ধনেই আমরা বিষয়ের সহিত আবদ্ধ আছি—এই মৃগতৃষ্ণাই আমাদিগকে শান্তি ও উপেক্ষা হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া কার্য্যক্ষেত্রে নিক্ষেপ করে ও আমাদিগকে ক্রমাগত সম্মুখে ঠেলিয়া লইয়া যায়। বৌদ্ধেরা ইহাকে ব্যক্তিত্বরূপ বিভ্রম বলেন।

 একবার যদি স্বীকার করা যায় যে, এই জগৎ কেবল ইন্দ্রিয়াভাসের প্রবাহমাত্র, আমাদের অন্তরে কিম্বা বাহিরে কোন পদার্থই স্থায়ী নহে, তখন আমাদের কর্ত্তব্যও সহজে স্থিরীকৃত হইতে পারে। যে ‘আমি’ এত গুরুতর বলিয়া আমার নিকট প্রতীয়মান হইত এক্ষণে আমি তাহাকে বিভ্রম বলিয়া জানিতেছি। ইহা জানিবামাত্র মনুষ্য মুক্তিলাভ করে—এই ‘আমি’ চিরকাল পুষিয়া রাখিবার জন্য সে আর লালায়িত হয় না—সে আর কোন চেষ্টা করে না, কামনা করে না, তাহার জীবন-তৃষ্ণা চলিয়া যায়, সে দুঃখ হইতে মুক্ত হয়।—কারণ, দুঃখ কি?—ব্যক্তিগত অস্তিত্ব হইতেই দুঃখ উৎপন্ন হয়। আর, জন্ম, বাৰ্দ্ধক্য, রোগ, মৃত্যু প্রভৃতি ঘটনাগুলি লইয়াই আমাদের ব্যক্তিত্ব। আচ্ছা, এই সকল ঘটনায় কেন আমাদের দুঃখ উৎপন্ন হয়? কারণ, আমিরূপ বিভ্রম হইতেই আমাদের বাঁচিবার ইচ্ছা হয়, ভয় ও আকাঙ্ক্ষা উৎপন্ন হয়, জরা মৃত্যু প্রভৃতি দূরীকৃত করিয়া তাহার বিপরীত বিষয় লাভের অভিলাষ হয়। এই অস্তিত্বের অনুরাগ যদি আমাদের অন্তর হইতে নির্ম্মূল করিয়া ফেলিতে পারি; ইচ্ছা কর্ম্ম চিন্তা হইতে বিরত হইয়া পরিবর্ত্তনের সার্ব্বভৌমিক নিয়মের হাত হইতে যদি এড়াইতে পারি, তাহা হইলে পরিবর্ত্তনমূলক দুঃখ আর আমাদিগের নিকট আসিতে পারে না। “যে ব্যক্তি এই ঘৃণিত জীবন-তৃষ্ণাকে দমন করিতে পারে, পদ্মপত্রস্থ জলবিন্দুবৎ দুঃখ তাহা হইতে সহজে অপসারিত হয়।’

 এই পূর্ণ অবস্থা লাভের পন্থাগুলি এই;—প্রথম, আত্মবিভ্রম ও ক্রিয়াকলাপ অনুষ্ঠানের বিশ্বাসকে বিনাশ করা। দ্বিতীয়, সমস্ত রিপু, সমস্ত বিদ্বেষ, সমস্ত মায়া-মোহ বিনাশ করা; তৃতীয়, আত্মানুরাগের কোন চিহ্নমাত্র না রাখা; চতুর্থ, ধ্যানবলে মুক্তিলাভ করিয়া ভৌতিক ও আধ্যাত্মিক সর্ব্বপ্রকার অস্তিত্বের কামনা হইতে বিরত হওয়া। এই স্থলে উপনীত হইতে পারিলেই মনুষ্য মুক্ত হয়। আপনার উপর তাহার আর আস্থা থাকে না, আকর্ষণ থাকে না, অন্যের কাজে আপনাকে সমর্পণ করিতে পারে; ঔদার্য্য, পরদুঃখকাতরতা তাহার মনকে অধিকার করে। যেমন, মাতা, আপনার প্রাণ পর্য্যন্ত পণ করিয়া আপনার একমাত্র সন্তানকে রক্ষা করে, সেইরূপ সে বিশ্বজনীন প্রেমের—অসীম পরানুরাগের অনুশীলন করে। এই প্রেম তাহার চতুর্দ্দিকে, তাহার উর্দ্ধে, তাহার নিম্নে বিকশিত হইয়া উঠে—সেই বিশুদ্ধ প্রেম যাহার সহিত স্বার্থের কোন সম্পর্ক নাই। জাগিয়া থাকুক, দাঁড়াইয়া থাকুক, বসিয়া থাকুক, কার্য্য করুক, অথবা শয়ন করুক, সকল অবস্থাতেই সকল সময়েই এই ভাবটি তাহার মনে দৃঢ়রূপে নিবদ্ধ থাকে।’—‘তাহার ইন্দ্রিয় সকল প্রশান্ত হইয়াছে; বশীভূত অশ্বের ন্যায়, সে গর্ব্ব হইতে মুক্ত—তার অজ্ঞান-মলা বিধৌত—দেহের উত্তেজনা, জীবনের উত্তেজনা তাহার আর অনুভব হয় না, দেবতারাও তাহার অবস্থাকে ঈর্ষা করেন।’ ‘যাহার চরিত্র সবল, সে ধরার ন্যায় অচল—স্তম্ভের ন্যায় অটল—স্ফটিক-স্বচ্ছ সরোবরের ন্যায় প্রশান্ত— তাহার আর পুনর্জন্ম নাই।’ ‘যাহারা জ্ঞান-যোগে মুক্ত হইয়াছে, প্রশান্ত তাহাদের বাক্য, প্রশান্ত তাহদের কার্য্য। তাহারা পরজন্মের জন্য আকাঙ্ক্ষা করে না। জীবনের আকর্ষণ তিরোহিত হওয়ায় এবং অন্য কোন কামনা মনে উদিত না হওয়ায়, জ্ঞানীরা তৈলবিরহিত দীপের ন্যায় নির্ব্বাণ প্রাপ্ত হন।’ ইহাই বৌদ্ধদিগের চরম সুখের অবস্থা। শাক্যমুনি তাঁহার পূর্ব্ববর্ত্তী ব্রাহ্মণ আচার্য্যদিগের ন্যায়, জগৎকে তলাইয়া দেখিবার চেষ্টা করিয়াছেন—যতই তলাইয়া দেখেন হাতে কিছুই ঠেকে না—হস্ত হইতে যেন সব সরিয়া যায়, গলিয়া যায়; অবশেষে তাঁহার দৃঢ়মুষ্টিতে কতকটা শূন্য সাপটিয়া ধরিলেন। চারিদিকেই মায়া বিভ্রম বিভাসিত—চারিদিকেই ঘটনা সকলের চঞ্চল আবর্ত্ত—কিছুই স্থায়ী নহে। প্রকৃতি আপন উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিবার জন্য অজ্ঞান মনুষ্যকে প্রবঞ্চনা করিতেছে—কিন্তু জ্ঞানী তাহাতে ভুলেন না। তিনি নির্ব্বাণশান্তির আশ্রয় লইবার জন্য এই ক্ষণস্থায়ী বিষয়-বিভ্রম হইতে দূরে পলায়ন করেন। তাঁহার অন্তরে তিনি এক মহাশূন্য স্থাপন করিয়াছেন—কিছুতেই তাঁহাকে আর বিচলিত করিতে পারে না। তাঁহার ওষ্ঠাধরে যদি কখন চাঞ্চল্যের রেখা দেখা যায়, সে কেবল বিশ্বজনীন ঔদার্য্য ও মানব-দুঃখের জন্য অনুকম্পা-জনিত মধুর প্রশান্ত হাস্যের ঈষৎ বিস্ফুরণ মাত্র।”