ভারতভিক্ষা
৴১০ দেড় আনা।
কি শুনি রে আজ-পূরি আর্য্যদেশ
এ আনন্দধ্বনি কেন রে হয়?
বৃটিশ-শাসিত ভারত ভিতরে,
কেন সবে আজি বলিছে জয়?
গভীর গরজে ছুটিছে কামান
জিনি বজ্রনাদ, গিরি কম্পমান!
বিন্ধ্য, হিমালয়চূড়াতে নিশান
“রূল বৃট্যানিয়া” বলি উড়ায়।
শত শত শত উড়িছে পতাকা,
ভুবন-বিখ্যাত চিহ্ন অঙ্গে আঁকা,
নগরে নগরে কোটি অট্টালিকা
শোভিয়া, সুচারু অনন্ত-কায়।
ভাসিছে আনন্দে ভারত বেড়িয়া,
দেব-অট্টালিকা সদৃশ শোভিয়া,
অর্ণব-তরণী কেতনে সাজিয়া,
কৃষ্ণা, গোদাবরী, গঙ্গার গায়।
নদীনদকূল কেতনে সজ্জিত,
কোটি কোটি প্রাণী পুলকে পূরিত,
বিবিধ বসন ভূষণে ভূষিত,
চাতকের ন্যায় তীরে দাঁড়ায়।—
কন্যাঅন্তরীপ হৈতে হিমালয়
কেন রে আজি এ আনন্দময়?
(শাখা)
আসিছে ভারতে বৃটন-কুমার,
শুন হে উঠিছে গভীর বাণী
গগন ভেদিয়া, “জয় ভিক্টোরিয়া
রাজরাজেশ্বরী, ভারতরাণী!”
যেই বৃট্যানিয়া কটাক্ষে শাসিয়া
অবাধে মথিছে জলধি-জল,
অসুর জিনিয়া পৃথিবী ব্যাপিয়া
ভ্রমিছে যাহার সেনানীদল;
যে বৃটনবাসী আসি এ ভারতে
কামানে জ্বালিল বজ্রের শিখা,
যার দর্পতেজ ভারত-অঙ্গেতে
অনল-অক্ষরে রয়েছে লিখা;
জিনিল সমরে যে ভীম-প্রহরী
ক্ষত্রিয়রক্ষিত ভরত-গড়,
মুদকি, মুলতান করি খান্ খান্
শিকগলে দিল দৃঢ় নিগড়;
হেলায়ে তর্জ্জনী লইল অযোধ্যা,
রাজোয়ারা যার কটাক্ষে কাঁপে;
প্রচণ্ড সিপাহী-বিপ্লবে যে বহ্নি
নিবাইল তীব্র প্রচণ্ড দাপে;
যার ভয়ে মাথা না পারি তুলিতে
হিমগিরি হেঁট বিন্ধ্যের প্রায়
পড়িয়া যাহার চরণ-নখরে।
ভারত-ভুবন আজি লুটায়—
সেই বৃটনের রাজকুলচূড়া
কুমার আসিছে জলধি-পথে,
নিরখিয়া তায় জুড়াইতে আঁখি
ভারতবাসীরা দাঁড়ায়ে পথে।
(পূর্ণ কোরস্)
বাজারে আনন্দে গভীর মৃদঙ্গ,
মুরলী মধুর, সুরব সারঙ্গ
বীণ্, পাখোয়াজ্, মৃদু খরতাল,
মৃদুল এস্রাজ্ ললিত রসাল;
বাজা সপ্তস্বরা যন্ত্রী মনোহরা,
ভ্রমর গঞ্জিয়া বাজারে সেতারা,
বেহাগ, খাম্বাজে পূয়িয়া তান।
বৃটন-কুমার আসিছে হেথায়,
সাজ্ পোসোয়াজে পরির শোভায়,
ভূতল-রঙ্গিনী মোহিনী যতেক,
কিন্নর নিন্দিয়া শুনাও বারেক—
শুনাও বারেক মধুর সঙ্গীত,
আজি এ ভারতে ভূপতি অতিথ,
তান লয় রাগে পূরাও গান।
(আরম্ভ)
চারি দিক যুড়ি বাজিল বাদন,
বাজিল বৃটিশ দামামা কাড়া,
অৰ্দ্ধ ভূমণ্ডল করি তোল পাড়
ভারত-ভুবনে পড়িল সাড়া—
“কোথা নৃপকুল, নবাব আমীর,
রাজ-দরবারে হও হে হাজির,
করিয়া সেলাম নোয়াইয়া মাথা,
ছাড়ি সাঁচ্চা জুতা চুণী পান্না গাঁথা,
বিলাতি বুটেতে পদ সাজাও।
“জানু পাতি ভূমে হেলায়ে উষ্ণীষ,
পরশি সম্ভ্রমে কুমার বৃটিশ,
বরাভয়প্রদ চারু করতল
তুলিয়া তুণ্ডেতে হইয়া বিহ্বল
অধর অগ্রেতে ধীরে ছোয়াও।
“ভবে মোক্ষফল রাজ-দরশন,
ভারতে দেবতা বৃটন এখন,
সেই দেবজাতি মহিষীনন্দন
দরশনে পূর্ব্বপাপ ঘুচাও।
“কোথা কাশীরাজ, কোথা হে সিন্ধিয়া?
কোথা হলকার, রাণী ভোপালিয়া?
মানী উদিপুর, যোধমহীপাল
হিন্দু ত্রিবঙ্কুর, শিক্ পাতিয়াল?
মহম্মদি রাজা কোথা হে নিজাম্?
কোথা বিকানির? কোথা বা হে জাম্
ধোলপুর-রাণা, জাঠের রাও?
“পর শীঘ্র পর চারু পরিচ্ছদ;
অর্ঘ্যেতে সাজাবে আজি রাজপদ;
কর দিব্য বেশ হীরা মুকুতায়,
‘ভারত-নক্ষত্র’ বাঁধিয়া গলায়,
রাজধানী-মুখে ধাবিত হও।
“ঘোটকে চড়িয়া ফের পাছে পাছে,
কিরণ ছড়ায়ে থাক কাছে কাছে,
ছায়াপথ যথা নিশাপতি কাছে,
ঘেরি চারিধার শোভা বাড়াও।
কর রাজভেট নবাব আমীর,
রাজদরবারে হও হে হাজির”—
বাজিল বৃটিশ দামামা কাড়া,
করি তোলপাড় নগর পাহাড়
ভারত-ভুবনে পড়িল সাড়া।
মেদিনী উজাড়ি ছুটিল উল্লাসে
রাজেন্দ্র-কেশরী যত,
পারিষদ বেশে দাঁড়াইতে পাশে
শিরঃগ্রীবা করি নত;
দেখরে ইঙ্গিতে ছুটিল পাঠান
আফগানস্থান ছাড়ি,
ছুটিল কাশ্মীরি ক্ষত্রিয় ভূপতি
হিমালয়ে দিয়া পাড়ি;
দ্রাবিড়, কঙ্কণ, ভোট, মালোবার,
মহারাষ্ট্র, মহীসুর,
কলিঙ্গ, উৎকল, মিথিলা, মগধ,
অযোধ্যা, হস্তিনাপুর,
বুঁদেলা, ভোপাল, পঞ্চনদস্থল,
কচ্ছ, কোঠা, সিন্ধুদেশ,
চাম্বা কাতিয়ার, ইন্দোর, বিঠোর,
অরবলিগিরিশেষ,
ছাড়ি রাজগণ ছুটিল উল্লাসে,
রাজধানী দিকে ধায়,
পালে পালে পালে পতঙ্গের মত
নিরখি দীপশোভায়;
ছুটিল অশ্বেতে রাজপুত্রগণ
চন্দ্রসূর্য্যবংশবীর;
জলধি-বন্দর হিমাদ্রি ভূধর
দাপটে হয় অস্থির।—
কোথা বা পাণ্ডব কৈলা রাজসূয়
দ্বাপরে হস্তিনামাঝে!
রাজসূয় যজ্ঞ দেখ এক বার
কলিতে করে ইংরাজে!
(পূর্ণ কোরস্)
অপূর্ব্ব সুন্দর মোহন সাজ
সাধে কলিকাতা পরিল আজ;
দ্বারে দ্বারে দ্বারে গবাক্ষ গায়
রঞ্জিত বসন চারু শোভায়;
দ্বারে দ্বারে দ্বারে গবাক্ষ কোলে
তরুণ পল্লব পবনে দোলে;
ধ্বজা উড়ে চূড়ে বিচিত্র-কায়,
ঝক্ ঝক্ ঝকে কলস তায়;
কোটি তারা যেন একত্রে উঠে।
সৌধ চূড়ে চূড়ে রয়েছে ফুটে;
গৃহ, পথ, মাঠ, কিরণময়—
নিশিতে যেন বা ভানু উদয়!
উঠিছে আতশবাজী আকাশে—
নব তারা যেন গগনে ভাসে!
ধন্য কলিকাতা কলি-রাজধানী!
সুরপুরী আজি পরাজিলে মানি;—
হ্যাদে দেখ নিশি লাজে পলায়!
দেখ দেখ দেখ চতুরঙ্গ দলে
বাজীপৃষ্ঠে সাজি, রাণীপুত্র চলে;
পাছে পাছে কাছে ঘোটক’পর
চলে রাজগণ, জ্বলে জহর
শিরঃ শোভা করি, উজলি তাজ;
তবকে তবকে পথির মাঝ,
নগর দর্শনে করে গমন,
ঝমকে ঝমকে বাজে বাদন
বৃটিশের ভেরী শমন-দমন,—
“রূল বৃট্যানিয়া, রূল দি ওয়েভস্”
সঙ্গীততরঙ্গে নিনাদ ধায়।
(আরম্ভ)
উঠ মা উঠ মা ভারত-জননী
মহিষীনন্দন কোলেতে এল;
আঁধার রজনী এবার তোমার
বিধির প্রসাদে ঘুচিয়া গেল!
আদরে ধর মা কুমারে সম্ভাষি,
আশীর্ব্বাদবাণী উচ্চারি মুখে,
বহু দিন হারা হয়েছ আপন
তনয়ে না পাও ধরিতে বুকে!
ত্যজ শয্যা, মাতঃ অরুণ উঠিল
কিরণ ছড়াতে তোমার ভূমে;
কেঁদো না কেঁদো না আর গো জননী
আচ্ছন্ন হইয়া শোকের ধমে।
চির দুখী তুমি, চির পরাধীনা,
পরের পালিতা আশ্রিতা সদা,
তুমি মা অভাগী অনাথা, দুর্ব্বলা
ভজন-পূজন যোগমুগধা!
মহিষী তোমার, যাহার আশ্রয়ে
জগতে এখন(ও) আছ মা জীয়ে,
পাঠাইলা তব দুঃখ ঘূচাইতে
আপন তনয়ে বিদায় দিয়ে;
দেখাও, জননী, ধরিলা গো যত
রিপুপদদিহ্ন ললাট-ভাগে,
দেখাও চিরিয়া ক্ষত বক্ষস্থল
দিবা নিশি সেথা কি শোক জাগে।
উঠ মা উঠ মা ভারত-জননী,
প্রসন্ন বদনে বারেক ফের;
মহিষীনন্দনে কোলেতে করিয়া
প্রাতে শুক্রতারা উদিল হের!
(শাখা)
ত্যজি শয্যা-তল, ডাকি উচ্চৈঃস্বরে,
নিবিড় কুন্তল সরায়ে অন্তরে,
গভীর পাণ্ডুর বদন-মণ্ডল
আলোকে প্রকাশি, নেত্রে অশ্রুজল,
কহিল উচ্ছাসে ভারতমাতা—
“কেন রে এখানে আসিছে কুমার?
ভারতের মুখ এবে অন্ধকার!
কি দেখিবে আর—আছে কি সে দিন?
ভ্রূভঙ্গি করিয়া ছুটিত যে দিন
ভারত-সন্তান নৈঋত ঈশান,
মুখে জয়ধ্বনি তুলিয়া নিশান,
জাগায়ে মেদিনী গায়িত গাথা!
“ভারত-কিরণে জগতে কিরণ,
ভারত-জীবনে জগত-জীবন,
আছিল যখন শাস্ত্র আলোচন,
আছিল যখন ষড়দরশন—
ভারতের বেদ, ভারতের কথা,
ভারতের বিধি, ভারতের প্রথা,
খুঁজিত সকলে, পূজিত সকলে,
ফিনিক, সিরীয়, যূনানী মণ্ডলে,
ভাবিত অমূল্য মাণিক্য যথা।
“ছিল যবে পরা কিরীট, কুণ্ডল,
ছিল যবে দণ্ড অখণ্ড প্রবল—
আছিল রুধির আর্য্যের শিরায়
জ্বলন্ত অনল সদৃশ শিখায়,
জগতে না ছিল হেন সাহসী
যাইত চলিয়া দেহ পরশি,
ডাকিত যখন ‘জননী’ বলিয়া
কেন্দ্রে কেন্দ্রে ধ্বনি ছুটিত উঠিয়া,
ছিলাম তখন জগত-মাতা।
“পাব কি দেখিতে তেমতি আবার।
ক্রোড়েতে বসিয়া হাসিবে আমার,
ডাকিবে কুমার ‘জননী’ বলিয়া
ইউরোপ্, আম্রিক উচ্ছ্বাসে পূরিয়া,—
ভারতের ভাগ্যে, অহো বিধাতা!
“পূর্ব্ব সহচরী রোম সে আমার
মরিয়া বাঁচিয়া উঠিল আবার—
গিরীশেরও দেখি জীবন সঞ্চার!
আমি কি একাই পড়িয়া রব?
“কি হেন পাতক করেছি তোমায়,
বল্ অরে বিধি বল্ রে আমায়?
চিরকাল এই ভগ্ন দণ্ড ধরি,
চিরকাল এই ভগ্নচূড়া পরি,
দাস-মাতা বলি বিখ্যাত হব!
“হা রোম,—তুই বড় ভাগ্যবতী!
করিল যখন বর্ব্বরে দুর্গতি,
ছন্ন কৈল তোর কীর্ত্তিস্তম্ভ যত,
করি ভগ্নশেষ রেণু-সমাবৃত
দেউল, মন্দির, রঙ্গ-নাট্যশালা,
গৃহ, হর্ম্ম, পথ, সেতু, পয়োনালা,
ধরা হ’তে যেন মুছিয়া নিল।
“মম ভাগ্য দোষে মম জেতৃগণ
কক্ষ, বক্ষ, ভালে পদাঙ্ক স্থাপন
করিয়া আমার, দুর্গ, নিকেতন,
রাখিল মহীতে—কলঙ্ক-মণ্ডিত
কাশি, গয়াক্ষেত্র, চণ্ডাল ঘৃণিত,
(শরীরে কালিমা—দীনতা প্রতিমা)—
ধরণীর অঙ্গে যেন গাঁথিল!
“হায়, পানিপথ, দারুণ প্রান্তর
কেন ভাগ্য সনে হলি নে অন্তর?
কেন রে, চিতোর, তোর সুখ-নিশি
পোহাইল যবে, ধরণীতে মিশি
অচিহ্ন না হলি—কেন রে রহিলি?
জাগাতে ঘৃণিত ভারত-নাম?
নিবেছে দেউটি বারাণসি তোর,
কেন তবে আর এ কলঙ্ক ঘোর
লেপিয়া শরীরে এখনও রয়েছ?
পূর্ব্বকথা কিরে সকলি ভুলেছ
অরে অগ্রবন? সরযু পাতকী,
রাহুগ্রাস-চিহ্ন সর্ব্ব অঙ্গে মাখি,
কেন প্রক্ষালিছ অযোধ্যাধাম?
“নাহি কি সলিল, হে যমুনে-গঙ্গে,
তোদের শরীরে—উথলিয়া রঙ্গে
কর অপসৃত এ কলঙ্ক-রাশি,
তরঙ্গে তরঙ্গে অঙ্গ বঙ্গ গ্রাসি,
ভারতভুবন ভাসাও জলে?
“হে বিপুল সিন্ধু, করিয়া গর্জ্জন
ডুবাইলে কত রাজ্য, গিরি, বন,
নাহি কি সলিল ডুবাতে আমায়?
আচ্ছন্ন করিয়া বিন্ধ্য, হিমালয়,
লুকায়ে রাখিতে অতল-তলে?”
(পূর্ণ কোর্স)
কেঁদ না কেঁদ না আর গো জননি,
মহিষীনন্দন কোলেতে এল,
আঁধার রজনী এবার তোমার।
বিধির প্রসাদে ঘুচিয়া গেল;
মহিষী তোমার যাহার আশ্রয়ে
এ শোক সহিয়া আছ মা জীয়ে,
পাঠাইলা তব অশ্রু মুছাইতে
আপন নন্দনে বিদায় দিয়ে।
ত্যজ শয্যা, মাতঃ, অরুণ উঠিল
কিরণ ছড়াতে তোমার ভূমে;
কেঁদো না কেঁদো না আর গো জননি
আচ্ছন্ন হইয়া শোকের ধূমে।
(আরম্ভ।)
“এলো কি নিকটে,—এলো কি কুমার?”
বলিল ভারতজননী আবার,
“কই, কোথা, বৎস, আয় কোলে আয়,
অন্তর জ্বলিছে দারুণ শিখায়—
পরশি বারেক শীতল কর।
“ডাক্ একবার, ডাকিস্ যে ভাবে
আপনার মায়ে—ঘুচা সে অভাবে
শত বর্ষে যাহা নহিল পূরণ,
(ভারতের চির আশা আকিঞ্চন)
ভুলিয়া বারেক বৃটিশ-গর্জ্জন,
ভারতসন্তানে ক্রোড়েতে ধর।
“কৃষ্ণবর্ণ বলি তুচ্ছ নাহি কর,
নহে তুচ্ছ কীট—এদেরও অন্তর
দয়া, মায়া, স্নেহ, বাৎসল্য, প্রণয়,
মান, অভিমান, জ্ঞান, ভক্তি ময়—
এদেরও শরীরে শিরায় শিরায়
বহে রক্তস্রোত,—বাসনা-তৃষায়,
ঘৃণা, লজ্জা, ক্ষোভে হৃদয় দহে
“এই কৃষ্ণবর্ণ জাতি পূর্ব্বে যবে
মধুমাখা গীত শুনাইল ভবে,
স্তব্ধ বসুদ্ধরা শুনি বেদগান
অসাড় শরীরে পাইল পরাণ,
পৃথিবীর লোক বিস্ময়ে পূরিয়া
উৎসাহ-হিল্লোলে সে ধ্বনি শুনিয়া
দেবতা ভাবিয়া স্তম্ভিত রহে।
“এই কৃষ্ণবর্ণ জাতি সে যখন,
উৎসবে মাতিয়া করিত ভ্রমণ,
শিখরে শিখরে, জলধির জলে,
পদাঙ্ক অঙ্কিত করি ভূমণ্ডলে,
জগতব্রহ্মাণ্ড নখর-দর্পণে
খুলিয়া দেখাত মনুজ-সন্তানে;
সমর-হুঙ্কারে কাঁপিত অচল;
নক্ষত্র অর্ণব আকাশমণ্ডল—
তখন তাহারা ঘৃণিত নহে!
“যখন জৈমিনি, গর্গ পতঞ্জলি,
মম অঙ্কস্থল শোভায় উজলি,
শুনাইল ধীর নিগূঢ় বচন,
গাইল যখন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন;
জগতের দুঃখে সুকপিলবস্ত্যে
সাক্য সিংহ যবে ত্যজিলা গার্হস্থ্যে,
তখন(ও) তাহারা ঘৃণিত নহে!
“তাদেরই রুধিরে জনম এদের,
সে পূর্ব্ব গৌরব সৌরভের ফের
হৃদয়ে জড়ায়ে ধমনী নাচায়,
সেই পূর্ব্ব পানে কভু গর্ব্বে চায়—
এ জাতি কখন জঘন্য নহে।
“হে কুমার মনে রেখো এই কথা—
যে ভারতে তুমি ভ্রমিতেছ হেথা
পবিত্র সে দেশ—পূত-কলেবর—
কোটি কোটি জন শূর বীর নর,
কোটি কোটি প্রাণী, ঋষি পুণ্যধর,
কবি কোটি কোটি, মধুর-অন্তর,
রেণুতে তাহার মিশায়ে রহে।
“শুন হে রাজন্! বনের বিহঙ্গ—
পুষিলে তাহারে যতনের সঙ্গ,
পিঞ্জরে থাকিয়া সেই সুখ পায়!
প্রাণের আনন্দে কভু গীত গায়!
বনের মাতঙ্গ যতনে বশ!
“কোকিলের স্বরে জগত তুষ্ট;
বায়সের রবে কেন বা রুষ্ট?—
কি ধন বল সে কোকিলে দেয়?
কি ধন বল বা বায়সে নেয়?
একে মিষ্টভাষা হৃদয় সরল,
অন্যে তীব্রম্বর পরাণে গরল,
ধরা চায় সরল হৃদয়-রস।—
“আমি, বৎস, তোর জননীর দাসী,
দাসীর সন্তান এ ভারতবাসী,
ঘুচাও দুঃখের যাতনা তাদের,
ঘুচাও ভয়ের যাতনা মায়ের,
শুনায়ে আশ্বাস মধুর স্বরে।
“কি কব, কুমার, হৃদি বক্ষ ফাটে,
মনের বেদনা মুখে নাহি ফুটে,
দেখ দিবানিশি নয়ন ঝরে!—
“বৃটিশ সিংহের বিকট বদন
না পারি নির্ভয়ে করিতে দর্শন,
কি বাণিজ্যকারী, অথবা প্রহরী,
জাহাজী গৌরাঙ্গ, কিবা ভেকধারী,
সম্রাট্ ভাবিয়া পূজি সবারে!
“এ প্রচণ্ড তেজ নিবার কুমার,
নয়নের জল মুছা রে আমার,
ভারত সন্তানে লয়ে একবার
ভাই বলি ডাক্, হৃদি জুড়ায়!
“দেখ, বৎস, দেখ কি উল্লাস আজ,
নিরখি তোমারে এ ভুবন-মাঝ,
কোটি কোটি প্রাণী করি ঊর্দ্ধহাত
বলিছে সঘনে ‘আজি সুপ্রভাত’—
তপ্ত অশ্রুধারা নয়নে ধায়।
“ফিরিবে যখন জননী নিকটে,
বল’ বাছা, তাঁরে বল’ অকপটে—
ভারতব্রহ্মাণ্ড-প্রাণী এককালে
ডাকে তাঁর নাম প্রাতঃ সন্ধ্যাকালে—
তাদের পরাণ যেন জুড়ায়!”
(শাখা)
বলিয়া ভারত মুছিয়া নয়ন,
তুষি আশীর্ব্বাদে মহিষীনন্দন,
ঢাকিয়া বদন অদৃশ্য হয়।
(পূর্ণ কোরস্)
“ভারতে আজি রে বিরাজে কুমার!
ভারতে অরুণ উদিল আবার;”
বাজিল বৃটিশ দামামা সঘনে,
বাজিল বৃটিশ শিঙ্গা ঘনে ঘনে,
“জয় ভিক্টোরিয়া কুমার-জয়।”
- ↑ সন ১৮৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রিন্স অফ্ অয়েল্স কলিকাতায় আগমন করেন। তদুপলক্ষে এই কবিতা লিখিত হয়।
এই লেখাটি ১ জানুয়ারি ১৯২৯ সালের পূর্বে প্রকাশিত এবং বিশ্বব্যাপী পাবলিক ডোমেইনের অন্তর্ভুক্ত, কারণ উক্ত লেখকের মৃত্যুর পর কমপক্ষে ১০০ বছর অতিবাহিত হয়েছে অথবা লেখাটি ১০০ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে ।