বিষয়বস্তুতে চলুন

ভারতে অলিকসন্দর/দ্বিতীয় ভাগ/চতুর্থ অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্থ অধ্যায়।

 অলিকসন্দর, বিপাশার তটে বিজয়কীৰ্ত্তি সংস্থাপন করিয়া প্রত্যাগমনের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন । ইয়ুরোপীয়দের কাছে নূতন মহাদেশের আবিষ্কারের পর, স্প্যানিয়ার্ডরা যেরূপ সমস্ত ভূভাগ পরস্পর বিভাগ করিয়া লয়, সেইরূপ অলিকসন্দরও পঞ্জাবপ্রদেশ, আপনার অনুগত লোকদিগের মধ্যে বিভক্ত করিয়া দেন। পুরু, অদৃষ্টক্রমে বিপাশার পশ্চিম কূলের সমস্ত ভূভাগ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। অলিকসন্দর খৃঃপূঃ ৩২৬ অব্দে আশ্বিনমাসে চিরকালের জন্য বিপাশার তট পরিত্যাগ করিলেন। প্রত্যাবর্ত্তনকালে আবার ঐরাবতী অতিক্রমণ করিয়া, অসিক্নীর নিকটবর্ত্তী হইলেন। ইতিপূর্ব্বে তিনি হিপাস্তিয়নকে যে নগর সুদৃঢ় করিবার জন্য আদেশ করিয়াছিলেন—আসিয়া দেখিলেন যে, তাহা বেশ সুরক্ষিত ও সুদৃঢ় করা হইয়াছে। এ প্রদেশের যে সকল লোক এস্থানে অবস্থান করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিল, তাহারা তাহাতে বাস করিবার অনুমতি প্রাপ্ত হইল। যে সকল ভাড়াটে সৈন্য বিকলাঙ্গ হইয়া যুদ্ধকার্য্যে অকর্ম্মণ্য হইয়াছিল, তাহারাও নিজেদের ইচ্ছা অনুসারে এস্থানে বাস করিয়া ইহার জনসংখ্যাবৃদ্ধি করে। অনেকে মনে করেন, বর্ত্তমান উজিরাবাদ যে স্থানে রহিয়াছে, সেই স্থানে এই নগর স্থাপিত হইয়াছিল।

 অলিকসন্দর যে সময় অসিক্নীর তটে অবস্থান করিয়া, সমুদ্রভিমুখে গমন করিবার আয়োজন করিতেছিলেন, সে সময় অভীসারের নিকটবর্ত্তী, উরসের (অরসকি) অধিশ্বর নানাপ্রকার বহুমূল্য দ্রব্য সহ আগমন করেন। ইহাঁর সহিত অভীসারের ভ্রাতা ও, অন্যান্য আত্মীয়গণের সহিত ৩০টা হস্তী লইয়া অলিকসন্দরের নিকট আগমন করেন। অভীসারপতি অসুস্থতা নিববন্ধন স্বয়ং আসিয়া অলিকসন্দরের সম্বর্দ্ধনা করিতে পারেন নাই, যে দূত অভীসার সকাশে প্রেরিত হইয়াছিল, তিনি তাঁহার ব্যাধির কথা নিবেদন করিলে, তবে অলিকসন্দর, তাহাতে প্রত্যয় স্থাপন করেন। অভীসার নিজের দেশের রাজপদ প্রাপ্ত হইলেন, অধিকন্তু অরসকি বর্ত্তমান হাজারার নিকটবর্ত্তী প্রদেশ ও তাঁহার শাসনের অন্তর্গত হইল। কে কিরূপ কর প্রদান করিবেন, অলিকসন্দর তাহা নির্দ্ধারণ করিয়া তাহাদের অধীনতা সূত্রের বন্ধনটা দৃঢ় করিয়াছেন।

 অসিক্নীবা চন্দ্রভাগার তট পরিত্যাগ করিবার পূর্ব্বে অলিকসন্দর এস্থানে সমারোহের সহিত, তাঁহার দেবতার উদ্দেশে যাগ যজ্ঞ করিয়া নদী উত্তীর্ণ হন। এই স্থানে অবস্থানকালে, মাসিদন হইতে সমাগত ৫হাজার অশ্বারোহী, আর ৭হাজার পদাতিক, অলিকসন্দরের সহিত মিলিত হইয়াছিল। ইহাদের সহিত সুবর্ণ ও রজত মণ্ডিত ২৫ হাজার বর্ম্ম আনিত হইয়াছিল, সৈন্যসম্বন্ধে ডিত্তাডোরস বলেন, ৩০ হাজার পদাতিক এবং ছয়হাজার অশ্বারোহী আগমন করিয়াছিল, অনেকে এ কথার উপর বিশ্বাস স্থাপন করেন না। এই সকল দ্রব্যের সহিত এক শত টালাণ্টের ঔষধী ও মাসিদন হইতে আনীত হইয়াছিল। অলিকসন্দর, এই সকল দ্রব্য সৈন্যগণ মধ্যে বিতরণ করিয়া, প্রাচীনপরিচ্ছদ সকল মৃত্তিকা মধ্যে প্রোথিত করিতে আজ্ঞা প্রদান করেন।

 চন্দ্রভাগা অতিক্রমণ করিয়া আবার বিতস্তার তটে উপস্থিত হইলেন। তিনি যে নগর দ্বয় স্থাপন করিয়াছিলেন, দেখিলেন, অত্যন্ত বৃষ্টি হওয়াতে তাহার অনেক স্থান নষ্ট হইয়া গিয়াছে। অলিকসন্দর, নগরের এইপ্রনষ্টভাগ পুননির্ম্মাণ করাইয়া, যাহাতে না ভবিষ্যতে নদীর জলে ধুইয়া যায়, তাহার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন |

 অলিকসন্দর, বিতস্তার তটে অবস্থান করিয়া, সমুদ্র গমনের যখন উদ্যোগ করিতেছিলেন সেই সময় পার্র্মিনিওর জামাতা, বীরবর কৈনস, রুগ্ন হইয়া মানবলীলা সম্বরণ করেন। কিছুদিন পূর্ব্বে ইনি সৈন্যগণের পক্ষ অবলম্বন করিয়া, অলিকসন্দরকে স্বদেশে প্রত্যাগমনের জন্য অনেক কথা বলিয়াছিলেন। অলিকসন্দর ইহার মৃত্যুতে ব্যথিত হইয়া বলিয়াছিলেন, “এই কএক দিনের জীবনের জন্য এত বড় বর্ত্তৃতা”। সামরিক সমারোহের সহিত কৈনসকে সমাহিত করিয়া, অলিকসন্দর মৃত সেনাপতির সম্মাননা করিয়াছিলেন।

 মাসিদনপতি ও তাঁহার সৈন্যগণকে বহন করিবার জন্য, প্রায় দুই হাজার নৌকা প্রস্তুত হইয়াছিল। ইহার মধ্যে ৮০ খানা ৩০ দাঁড়ের বড় নৌকা, ঘোটকাদি বহনোপযোগী নানা আকারের অবশিষ্ট নৌকা প্রস্তুত হইয়াছিল। সমুদ্রের নিকটবর্ত্তী প্রদেশের নৌচলনায় সুদক্ষ যেসকল ব্যক্তি, সৈনিককার্য্যে ব্রতী হইয়াছিল, তাহারা এক্ষণে নাবিকরূপে পরিণত হইল। হিমালয়ের পাদদেশ হইতে অপর্য্যাপ্ত পরিমাণে কাষ্ঠ সংগৃহীত হইয়া এই সকল নৌবাহিনী প্রস্তুত হইয়াছিল। নিয়ার্কস, এই নৌবাহিনীর প্রধান অধ্যক্ষপদে বরিত হন। অনিসিক্রিতো নামক একব্যক্তি, এই অভিযানে অলিকসন্দরের সহিত গমন করিয়াছিলেন। তিনি এই অভিযানের একখানি ইতিবৃত্ত ও প্রণয়ন করিয়াছিলেন। সে গ্রন্থ কেবলমাত্র মিথ্যা কথা নহে, নানাপ্রকার গাঁজাখুরী গল্পে পরিপূর্ণ, নিজের মর্য্যাদা বৃদ্ধি করিবার জন্য এই বহরের তিনি সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারী বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। বাস্তবিকপক্ষে তিনি অলিকসন্দরের নৌকায় জল পরিমাণকার্য্যে নিযুক্ত ছিলেন।

 গমনের জন্য সমস্ত প্রস্তুত হইলে, অলিকসন্দর তাঁহার সহচরবৃন্দ ও সমাগত দূতগণ সমক্ষে,পুরুকে, দুইসহস্র নগর ও সপ্তজাতি সমন্নিত জনপদের অধীশ্বরপদে নিযুক্ত করেন। একজন সুরুচীসম্পন্ন পাশ্চাত্য লেখক দুইহাজার নগর, অলিকসন্দরের বিজিত ভারতে কথনই ছিল না স্থির করিয়া, ভারতবাসীর মিথ্যাপ্রীতির কথা উল্লেখ করিয়াছেন। তাঁহার বলিবার মর্ম্ম এই যে, সত্যব্রত ইয়ুরোপীয়গণ যেরূপ শুনিয়াছে, তাহারা সেইরূপ লিখিয়াছে। পুরুর সহিত তক্ষশিলাপতির যে বহুদিনের বিবাদ ছিল, অলিকসন্দরের অনুরোধে তাহার ভঞ্জন হইয়া গেল, উভয়ে বিবাহসূত্রে মিলিত হইলেন।

 অলিকসন্দর, তাঁহার গমন পথে, পাছে লবণপর্ব্বত প্রদেশের অধীশ্বর সোপিতিস্ (সৌভূতি) তাঁহাকে আক্রমণ করেন, এই আশঙ্কায় তিনি হিপাইস্তিয়ন ও ক্রিতিরস নামক সেনানীদ্বয়কে দ্রুতগতিতে তাঁহাকে অকস্মাৎ আক্রমণ করিবার জন্য প্রেরণ করেন। গ্রীকেরা বলেন, তিনি নাকি বিনা বাধায় বশ্যতা স্বীকার করেন।

 ৩২৬ খৃঃপূঃ কার্ত্তিকমাসের একদিন প্রাতঃকালে, অলিকসন্দর তাঁহার দলবল সহ, নৌকাযোগে যাত্রা করেন। একলক্ষ ২০ হাজার নানাদেশীয় সৈন্য, তাঁহার সহিত অনুগমন করিল। ইহার সহিত দুইশত হস্তী গমন করিয়া, ইহাঁর গৌরবকে বৃদ্ধি করিয়াছিল। ক্রিতিরস, কতকগুলি পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া বিতস্তার দক্ষিণ এবং হিপাইস্তিয়ন অধিকাংশ সৈন্য লইয়া পদব্রজে বামভাগ দিয়া গমন করিতে আদিষ্ট হইলেন |

 গমন করিবার পূর্ব্বে, অলিকসন্দর নৌকার সন্মুখভাগ হইতে স্বর্ণপাত্রে বিতস্তা, চন্দ্রভাগা, ও সিন্ধুর, উদ্দেশে পূজা করিতে লাগিলেন। তাঁহার পূর্ব্ব-পিতামহ হরিকুলেশ,ও পিতা আমন,এবং অন্যান্য দেবতারাও, এ সময়ের পূজা হইতে বঞ্চিত হইলেন না। বংশীর ধ্বনির সহিত সমস্ত নৌবাহিনী চলিতে আরম্ভ করিল। পাছে নৌকা সকল পরস্পর মিলিত হইয়া বিপন্ন হয়; এজন্য পরস্পর পরস্পরের দূরে অবস্থান করিয়া চালিত হইতে অনুজ্ঞাত হইল। এ নিয়মের যাহাতে না ব্যতিক্রম হয়, সে বিষয় চালকগণ বিশেষরূপে আদিষ্ট হইয়াছিল। সহস্র সহস্র ক্ষেপণির ক্ষেপন শব্দে, সৈন্যগণের যুদ্ধধ্বনি, ও চালকগণের আজ্ঞাবাক্যে, সে প্রদেশ মুখরিত হইয়াছিল। অলিকসন্দরের অনুগত ভারতবাসীরা তাঁহাকে গমন করিতে দেখিয়া, আহ্লাদে নৃত্যগীত ও বাদ্যধ্বনি করিয়া আনন্দ প্রকাশ করে। এইরূপ দুই দিবস গমন করিয়া এই নৌবাহিনী তৃতীয় দিবসে যে স্থলে হিপাই— স্তিয়ন ও ক্রিতিরস, শিবির সংস্থাপন করিয়া অবস্থান করিতে অনুজ্ঞাত হইয়াছিলেন, সেই স্থলে উপস্থিত হয়। এস্থানে সমস্ত সৈন্য দুই দিবস অবস্থান করে। ইতিমধ্যে ফিলিপো, আগমন করিয়া এই বাহিনীর সহিত মিলিত হন। এপ্রদেশের কতকগুলি লোক অলিকসন্দরের বশ্যতা স্বীকার করিলেও, জন সাধারণ ইহাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্রোত্তলন করিয়াছিল, পাছে তাহারা অকস্মাৎ আক্রমণ করিয়া, সৈন্যগণ মধ্যে বিভীষিকা উৎপাদন করে, এই আশঙ্কায় মাসিদনপতি অতি সতর্কতার সহিত অগ্রসর হইতে লাগিলেন। যে দিকে শত্রুর আক্রমণের আশঙ্কা ছিল না-যে দিকে তাঁহার অনুগত জনগণের বসতি ছিল, নদীর সেই দিকে তিনি অবস্থান করিয়া রাত্রি যাপন করিতেন। সেনানী ফিলিপো, পশ্চাদ্ভাগ রক্ষা করিয়া এতদিন আসিতেছিলেন, এস্থান হইতে তিনি নদীর তট দিয়া অগ্রেগমন করিতে অনুজ্ঞাত হইলেন। যে স্থানে অবস্থান করিয়াছিলেন, সেস্থান হইতে পঞ্চম দিবসে, বিতস্তা ও অলিকসন্দর নাশিনীর (চন্দ্রভাগা) সঙ্গম স্থলে উপস্থিত হন। গ্রীক গ্রন্থকারেরা লিখিয়াছেন, যে স্থলে এই নদীদ্বয়ের মিলন হইয়াছে, সে স্থানটি সংঙ্কীর্ণ হওয়াতে জলধারা অত্যন্ত প্রবলবেগে প্রস্তরে আহত হইয়া ঘোরতর আবর্ত্ত উৎপাদন করিয়া প্রবাহিত হইতেছে। বহুদূর হইতে ইহার গর্জন-শব্দ শ্রুতিগোচর হইয়া থাকে। নদীর এই ভয়াবহ সঙ্গমের কথা, অলিকসন্দর তাঁহার বন্ধু ভারতবাসীর মুখে অবগত হইয়া, অত্যন্ত সাবধানের সহিত অগ্রসর হইতে আরম্ভ করেন। সঙ্গমের নিকটবর্ত্তী হইলে, ক্ষেপকেরা যুগপৎ শত শত বজনিনাদের অনুকারী শব্দ শ্রবণ করিয়া মুগ্ধ হইয়া পড়ে, তাহারা প্রাণপণে সমস্ত শক্তির সহিত দাঁড় টানিলেও, নিরাপদে ইহা অতিক্রমণ করিতে সমর্থ হয় নাই। কতকগুলি পরস্পর সংঘর্ষণে ভগ্ন হইয়া যায়, কতকগুলি অতি বেগে তীরে নিক্ষিপ্ত হইয়া অকর্ম্মণ্য হইয়া পড়ে, কএকখানি ভীষণ আবর্ত্তে পতিত হইয়া দাঁড়ি মাঝির সহিত ডুবিয়া যায়। কুর্ত্তিয়স্ বলেন, অলিকসন্দর যে নৌকায় অবস্থান করিতেছিলেন, সেই নৌকাখানি আর একটু হইলে ডুবিয়া যাইত, অলিকসন্দর নদীতে লাফাইয়া পড়িবার জন্য কাপড় শরীর হইতে খুলিয়া ফেলেন, তাঁহাকে তুলিবার জন্য লোক সকল সাঁতার কাটিতে লাগিল, সৌভাগ্যক্রমে চন্দ্রভাগার অলিকসন্দর নাশিনী নাম সার্থক হয় নাই। এইরূপে বিপদ হইতে উত্তীর্ণ হইয়া অলিকসন্দর কোন নিরাপদ স্থানে নৌকা সকল তীরে লাগাইয়া; যে সকল নৌকা ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল, বা আঘাত প্রাপ্ত হইয়াছিল তাহার পুনঃ সংস্কার করান।

 এসময় হইতে ভারতবাসীরা, নূতন নীতি অবলম্বন করিয়া, অলিকসন্দরের সহিত যুদ্ধ করিতে আরম্ভ করেন। ইতিপূর্ব্বে একজনের পরাজয়ের সহিত সমস্ত দেশ পরাজিত হইয়াছে, একজনের কাপুরুষতায় সমস্ত জনবৃন্দ ক্লীবের ন্যায় বৈদেশিক নরপতির চরণতলে শরণাপন্ন হইয়াছে। একজনের দুর্ব্বলতায়, সমস্ত দেশ যে বৈদেশিক শ্ত্রুর বশ্যতা স্বীকার করিবে, ইহা সম্পূর্ণ অনুচিৎ এবং নীতিবিরুদ্ধ। বিশেষতঃ রাজন্যবর্গ সুখের কোমলক্রোড়ে লালিত, পালিত ও বর্দ্ধিত; কর্ত্তব্য অনুরোধে একবার যুদ্ধ করিয়া পরাজিত হইলে, তাঁহারা পুনরায় শস্ত্রগ্রহণ না করিয়া পৈত্রিক প্রাণ ও সম্পত্তি রক্ষা করিবার জন্য সন্ধিবন্ধন পাশে আবদ্ধ হইয়া, পরাধীনতা স্বীকার করিতে পারেন।—কিন্তু জন সাধারণ তাঁহাদের ভীরুতার জন্য, তাহাদের সুখ স্বচ্ছন্দতা লাভের জন্য, তাঁহাদের স্বার্থপরতার জন্য, নিজেদের সহজাত স্বাধীনতা রত্ন, কখনই বিসর্জ্জন প্রদান করিতে পারে না। তাই এসকল প্রদেশের কাশ্যপ, ভরদ্বাজ, বাৎস, প্রভৃতি গোত্রের কৌপিনধারী নিঃস্ব ব্রাহ্মণগণ, রাজারা, অলিকসন্দরের, শরণাপন্ন হইলেও, দেশের জন সাধারণকে সঙ্গে লইয়া, দেশের সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে, কৃপাণপানি হইয়া দণ্ডায়মান হয়। শত সহস্র ব্যক্তির নিধনেও, তাঁহাদিগের সাহসের মাত্রা হ্রাস না হইয়া, বরং যেন বর্দ্ধিত হইয়াছিল— অজস্রশোণিতপাতে সারপ্রাপ্ত উর্ব্বরভূমিতে শালবৃক্ষেরন্যায়, দেশ হইতে বীরগণের আবির্ভাব হইয়াছিল। যেপর্য্যন্ত না তাঁহারা জয় লাভ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, সে পর্য্যন্ত তাঁহারা মৃত্যুকে অবিকৃত বদনে আলিঙ্গন করিতে পশ্চাদ্‌পদ হন নাই। জনসাধারণের অধিকার, ধর্ম্মের ন্যায় সনাতন হইলেও, ইহাকে রক্ষা ও জয়যুক্ত করিবার জন্য আত্মত্যাগের আবশ্যক। সেকালের ভারতবাসীর আত্মত্যাগের কথা ভাবিলে শরীর সিহরিয়া উঠে, মাথা ঘুরিয়া যায়। শত শত ব্যক্তি যুদ্ধযজ্ঞে শরীর আহুতি প্রদান করিতেছেন, অথচ কাহারও মুখে কোনরূপ আতঙ্কের চিহ্ন লক্ষিত হইতেছে না-যাঁহারা প্রাণ দিয়াছেন, তাঁহাদিগকে সঞ্জীবিত করিবার জন্য, জয়লাভ করিয়া তাহাদের কীর্ত্তি অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য, শত শত, সহস্র সহস্র, ব্যক্তি একনিষ্ঠ হইয়া প্রাণ উৎসর্গ করিবার জন্য উত্থিত হইয়াছিলেন। অলিকসন্দরকে বাধা দিবার জন্য, তাঁহারা যেরূপ প্রচণ্ড উদ্যমে কার্য্য করিয়াছিলেন, তাহাতে তাঁহাকে বিব্রত হইতে হইয়াছিল;—সময় সময় তাহাকে বিমূঢ় হইতে হইয়াছিল। অলিকসন্দরের প্রবল পীড়নে ভারতবাসীরা প্রপীড়িত হইলেও, তাহারা আশাশূন্য হয় নাই; তাহারা সাধ্যানুসারে সর্ব্বতোভাবে আপনাদের স্বাধীনতা রক্ষা করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন।

 অলিকসন্দর, যে সময় বিপন্ন হইয়া বিতস্তা ও চন্দ্রভাগার মিলন স্থলে অবস্থান করিতেছিলেন; সে সময় তিনি অবগত হন যে, শিবি (Sebi) জনপদের অধিবাসীগণ, মাল (মহাভারতোক্ত জনপদ) (Malloi) দেশবাসীর সহিত মিলিত হইয়া তাঁহাকে বাধা দিবার জন্য প্রস্তুত হইতেছে। ইতিপূর্ব্বে এই মালদেশের অধিবাসীরা, ক্ষত্রিয়গণের সহিত মিলিত হইয়া অলিকসন্দরের গতিরোধ করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহাদের মিলন হইবার পূর্ব্বেই, অলিকসন্দর,ক্ষত্রিয়গণকে আক্রমণ করিয়া বিপর্য্যস্ত করেন। শিবিবাসীর সহিত মালবাসীর মিলন হইবার পূর্ব্বেই, অলিকসন্দর শিবিগণকে আক্রমণ করিয়া, শত্রুগণকে সম্মোহিত করিবার চেষ্টা করেন। শিবিদেরনগর নদীরতট হইতে প্রায় ২৫০ ষ্টেড়িয়া দূরে অবস্থিত। অলিকসন্দর, এই পথ অতিক্রমণ করিয়া, শিবিদের নগর আক্রমণ করেন। তাঁহার গমন পথে যে সকল গ্রাম পতিত হইল, তাহা অলিকসন্দরের ক্রোধে মরুভূমিতে পরিণত হইল, তাহাদের এই অপরাধ যে, তাহারা প্রবল প্রতাপ অলিকসন্দরের নামে সম্মোহিত না হইয়া তাঁহার বিরুদ্ধে আপনাদের স্বাধীনতা রক্ষা করিবার জন্য দাঁড়াইতে সাহসী হইয়াছিল।

 শিবি রাজধানী হস্তগত করিতে, অলিকসন্দরকে বড় কম ক্লেশ পাইতে হয় নাই। তাঁহার স্বয়ং গমন করাতেই ইহার গুরুত্ব অনুমিত হয়। নগর প্রাচীরের চতুর্দ্দিক অবরোধ করিয়া, তিনি ইহা অধিকার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। শিবি রাজ্যের পার্শ্বে আগালাসই (Agalassoi) নামে আর এক জাতি ছিল, তাহাদের সৈনিক বল নিতান্ত কম ছিল না। তাহারা যুদ্ধস্থলে ৪০ হাজার পদাতিক এবং ৩ হাজার অশ্বারোহী লইয়া যাইতে সমর্থ ছিল। অলিকসন্দরের আগমন কথা শুনিয়া ইহারা আর স্থির থাকিতে পারিল না;—সকলেই এক প্রাণে মিলিত হইয়া, নিদ্রোত্থিত সিংহের ন্যায় ঘোরতর পরাক্রমে বৈদেশিক শত্রুর আগমন পথ রোধ করিবার জন্য প্রস্তুত হইলেন। ইহারা নদীর তটে অবস্থান করিয়া, অলিকসন্দরের সহিত ঘোরতর যুদ্ধ করিয়াছিল। হনন ব্যাপারে কসাই যেরূপ সিদ্ধ হস্ত, সে যেরূপ নিপুনতা সহকারে হনন কার্য্য নিষ্পন্ন করিয়া থাকে;—সে যেরূপ অল্প সময়ে সমস্ত কার্য্য সাফ করিয়া থাকে, তাহা অপেক্ষা অধিকতর বলশালী, সাহসী ব্যক্তি, সেরূপ করিয়া কার্য্য সম্পাদন করিতে সমর্থ হয় না। অলিকসন্দর, আট দশ বৎসর নরহত্যার স্রোত প্রবাহিত করিয়া এবিষয়ে বিশেষ অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছিলেন। সুতরাং ভারতবাসী, বিশেষ বলবান ও সাহসী হইলেও, নরহত্যা কার্য্যে অনভিজ্ঞ হওয়াতে, অলিকসন্দরকে এবিষয় পরাস্ত করিতে সমর্থ হয় নাই। নদীর তটে, ভারতবাসীরা বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করিলেও, ইহার ফল তাঁহাদিগের পক্ষে শুভজনক হয় নাই, ফল অনুকুল হইয়াছিল কিনা, তাহা আমরা বৈদেশিক লেখকের নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছি, তাঁহারা কতদূর যথার্থ কথা বলিয়াছেন, সে বিষয় অনেক সময় ঘোরতর সন্দেহ উপস্থিত হইয়া থাকে। সে যাহাই হউক, তাঁহারা বলেন, অলিকসন্দর এ যুদ্ধে জয়লাভ করেন, শত্রুদিগকে তাড়াইয়া দিয়া নদী উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন। যাহারা নগরে গমন করিয়া পুনরায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইতেছিল, তাহাদিগকে নগরে অবরোধ করিয়া আক্রমণ করেন। কুর্ত্তিয়স্ বলেন, এই ঘোরতর যুদ্ধে মাসিদনদের শাণিত অস্ত্রের নিকট হইতে, কোন বয়ঃপ্রাপ্ত ব্যক্তি নিষ্কৃতি লাভ করিতে সমর্থ হয় নাই। যে সকল ব্যক্তি শাণিত অস্ত্র হইতে রক্ষা পাইয়াছিল, তাহারা দাসরূপে বিক্রিত হইয়াছিল। “বর্ব্বর” ভারতবাসীরা যুদ্ধে বিরত ব্যক্তির উপর কখন অস্ত্রোত্তলন, অথবা পরাজিতের স্ত্রী,বালক,বালিকাদিগকে, বিক্রয় করিয়া প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেন না;—সুসভ্য অলিকসন্দরের এই সদয় ব্যবহার, সেকালের ভারতবাসীর কাছে কিরূপ ভাবে গৃহীত হইয়াছিল, তাহা তাহাদের অসংখ্য সংখ্যায় মৃত্যুতে স্পষ্টরূপে প্রকাশ পাইয়া থাকে।

 কুর্ত্তিয়স্ আর একটি জাতির যুদ্ধের কথা কীর্ত্তন করিয়াছেন, তাহাদের নাম তিনি উল্লেখ করেন নাই। তাঁহাদের জিহ্বায় সে নাম উচ্চারণ করিতে কষ্ট হইয়াছিল বলিয়া কি তাঁহারা তাহার উল্লেখ করেন নাই, তাহা আমরা অবগত নহি। কিন্তু তাঁহারা মাসিদনপতির সহিত, কুপিত কৃতান্তের ন্যায় যুদ্ধ করিয়াছিল, যুদ্ধকালে তাঁহারা প্রাণের প্রতি মমতা কিছুমাত্র দেখান নাই, তাহা আমরা অবগত আছি। সেই সকল সুগৃহীতনামা যোদ্ধাগণ জন্মভূমি রক্ষা করিবার জন্য, ভৈরব বিক্রমে অলিকসন্দরের গতিরোধ করিয়াছিলেন। বহুসংখ্যক মাসিদনকে, তাঁহাদের ক্রোধবহ্নিতে ভষ্মীভূত হইতে হইয়াছিল। অলিকসন্দর ঘোরতর পরাক্রমে নগর আক্রমণ করিলেও, সহজে ইহা হস্তগত করিতে সমর্থ নাই। নগরবাসীরা যখন দেখিলেন, নগর রক্ষা করা সম্পূর্ণ অসম্ভব, তখন তাঁহারা নিজের নিজের গৃহে অগ্নি প্রদান করিয়া স্ত্রী পুত্ত্র কন্যাগণের সহিত সেই পবিত্র হব্যবাহনে শরীর আহুতি প্রদান করিয়া প্রায় বিংশতি সহস্র ভারতবাসী সুরলোকে গমন করেন[]

 যে সময় ভারতবাসী আপনাদিগের গৃহের পবিত্রতা, অগ্নি প্রদান করিয়া যবন স্পর্শ কলঙ্ক হইতে রক্ষা করিতেছিল, সে সময় অলিকসন্দর সেই সকল পবিত্র মন্দির অধিকার করিবার জন্য, অগ্নি নির্ব্বাপন করিতেছিলেন। নগর ভস্মীভূত হইলেও দুর্গের কোন ক্ষতি হয় নাই। অলিকসন্দর দুর্গ অধিকার করিয়া তথায় কিছু সৈন্য রাখিয়া দিয়া আবার যে স্থানে তাঁহার নৌবাহিনী অবস্থান করিতেছিল, তথায় উপস্থিত হইয়াছিলেন। অনেকে মনে করেন এই সকল ঘটনা বর্ত্তমান জঙ্গের নিকটবর্ত্তী প্রদেশে অনুষ্ঠিত হইয়াছিল। জাতিতে যখন মনুষ্যত্ব বর্ত্তমান থাকে, তখন সেই সকল জাতি পরস্পর মানুষের ন্যায় মিত্রতা, বা শত্রুতা সূত্রে আবদ্ধ হইয়া থাকে একবার বিবাদ হইয়াছে বলিয়া চিরকাল যে শত্রুতা করিতে হইবে, এরূপ তাহারা মনে করে না। যে স্থানে ইহার অন্যথা পরিলক্ষিত হয়, সেস্থানে মনুষত্বের পরিবর্ত্তে কাপুরুষত্ব ব্যঞ্জক কার্য্যসকল অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে। তথায় কাপুরুষগণ সামান্য অর্থের লোভে, গুপ্তভাবে অবস্থান করিয়া, স্বজাতির হৃদয়ে শানিতশূল নিক্ষেপ করিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হয় না; তথায় স্বদেশ-দ্রোহীরা কিঞ্চিৎমাত্র অর্থলাভ করিয়া স্বদেশের অনিষ্ট করিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হয় না। যে সময় অলিকসন্দর এ প্রদেশে আগমন করেন, সে সময়ের পূর্ব্বে ক্ষুদ্রক (Onydrakai) গণের সহিত মাল

দেশবাসীর অত্যন্ত বিবাদ বিসম্বাদ হইতেছিল। মধ্যে মধ্যে উভয়ের শোণিত ধারায় পৃথিবীও কর্দ্দমাক্ত হইত। এরূপ ঘোরতর শত্রুতা থাকিলেও, তাহারা কৌরবনীতি অনুসরণ করিয়া, স্বদেশের শত্রুর বিরুদ্ধে একত্র হইয়া অস্ত্রধারণ করিলেন। সসৈন্য অলিকসন্দরকে বিনাশ করিবার জন্য তাঁহারা আয়োজন করিতে লাগিলেন।

 অলিকসন্দর, চরমুখে শত্রুগণের অবস্থা অবগত হইয়া, যাহাতে তাহারা একত্র হইয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিতে সমর্থ না হয়, সে জন্য তিনি তাহাদিকে পৃথক পৃথক ভাবে আক্রমণ করিতে মনস্থ করিলেন।

 কোন অতিশয় দুস্কর কার্য্য করিতে হইলে, সমস্ত সৈন্যের মধ্য হইতে যাহারা অত্যন্ত সাহসী, সহিষ্ণু, কর্ম্মঠ, প্রাণের কথা না ভাবিয়া কার্য্য সাধনে যত্নশীল, অথচ বুদ্ধিমান, এরূপ বলবান ব্যক্তি নির্ব্বাচন করিয়া বিপদসঙ্কুল কার্য্য করিতে অগ্রসর হওয়া বিধেয়। কেন না এরূপ গুণযুক্ত ব্যক্তি, কার্য্য সম্পাদন না করিয়া কখন পশ্চাদ্‌পদ হন না। দুস্করকার্য্য সম্পাদিত হইলে, শত্রুগণ হৃদয়ে বিজাতীয় বিভীষিকা উপস্থিত হইয়া তাহাদিগকে অকর্ম্মণ্য করিয়া ফেলে। অলিকসন্দর, মাল-বাসীকে আক্রমণ করিবার জন্য, তাঁহার সেনা সমষ্টি হইতে নির্ভিক, যুদ্ধদুর্ম্মদ, অসাধারণ কার্য্য করিবার জন্য সদাই উৎসুক, এরূপ ব্যক্তিগণকে একত্র করিয়া শত্রু উদ্দেশ্যে যাত্রা করিলেন। বলা বাহুল্য যে পথে তাঁহারা গমন করিয়াছিলেন, সে পথের কথা মাসিদনদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল। ভারতবাসীর ভিতরকার, কোন কথাই তাঁহারা অবগত ছিলেন না। হায়! আমাদের ভারতবাসীরাই তাঁহার পথ পরিদর্শক, এবং উপদেষ্টার আসন গ্রহণ করিয়াছিল। একদিকে পুণ্যচরিত্রের ভারতবাসী পরস্পর বিষম শত্রুতা ভুলিয়া গিয়া স্বদেশের জন্য, প্রাণ বিসর্জ্জনের আয়োজন করিতেছিলেন। অপর পক্ষের কতকগুলি নারকীয় চরিত্রের, এদেশের আবর্জ্জনা, নিজেদের দুই দিনের সুখের জন্য, বালুকারউপর তাহাদের পাপময় গৃহের ভিত্তি স্থাপনের উদ্যোগ করিতেছিলেন।

 অলিকসন্দর, তাঁহার বাহিনী পরিচালনা করিয়া, অসিক্লী হইতে ২০ ষ্টেডিয়া দূরে, একটি ক্ষুদ্র নদীর তটে ভোজনাদি করিয়া কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম করেন। এখন তাঁহাদিগকে জলহীন মরুভূমি অতিক্রমণ করিয়া গমন করিতে হইবে। এজন্য তিনি প্রত্যেক সৈন্যকে যাহার যেরূপ জলপাত্র আছে, তাহা জল পরিপূর্ণ করিয়া লইতে আদেশ করিলেন। দিবার অবশিষ্টভাগ এবং সমস্ত রাত্রে ৪শত ষ্টেডিয়া অতিক্রণ করিলে, সূর্য্যোদয়ের সহিত একটি নগরের সম্মুখবর্ত্তী হইলেন। এইনগরে বহুসংখ্যক মালবাসী আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। সেই সকল লোককে হস্তগত করিবার জন্য অলিকসন্দর তথায় গমন করিয়াছিলেন। তাহারা স্বপ্নেও ভাবে নাই যে, মাসিদন পতি জলহীন দুস্তর মরুভূমি অতিক্রমণ করিয়া তাহাদিগকে আক্রমণ করিবেন, সুতরাং তাহারা অসন্দিগ্ধ চিত্তে তথায় অবস্থান করিতেছিলেন। যে সকল ব্যক্তি নগর প্রাচীরের বর্হিভাগে কার্য্যোপলক্ষে গমন করিয়াছিল, বীর প্রকৃতির মাসিদনগণ সেই সকল নিরস্ত্র ব্যক্তিকে অকস্মাৎ নিহত করিয়া বীরত্বপ্রকাশ করেন, এমন কি যাহারা শত্রুর আগমন কোনরূপে অবগত হয় নাই, ও অন্যমনস্ক ভাবে অবস্থান করিতেছিল, তাহারাও নরহন্তাদের হস্ত হইতে পরিত্রাণ পায় নাই। অপর কতকগুলি লোক, শত্রুর আগমন অবগত হইয়া, দ্রুতবেগে নগর মধ্যে গমন করিয়া সকলকে সতর্ক করিয়া দিয়া, নগর দ্বার রোধ করিয়া দিয়া আগমন পথ বন্ধ করিয়া দিল।

 অলিকসন্দর, অবরুদ্ধ নগরের চতুর্দ্দিকে, তাঁহার অশ্বারোহী সৈন্য সকল সন্নিবেশ করিলেন। অনতিবিলম্বে পদাতিকগণ উপস্থিত হইলে, তিনি স্বীয় অশ্বারোহীসৈন্য, পার্দিকার কর্ত্তৃত্বে নিকটবর্ত্তী অন্য নগর আক্রমণ করিবার জন্য প্রেরণ করেন। ইতিমধ্যে অন্যান্য মাসিদন সৈন্য উপস্থিত হইল। অলিকসন্দর এখন প্রচণ্ড পরাক্রমে নগর আক্রমণ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। পাছে কোন লোক গোপনে গমন করিয়া, তাহাদের বিপদের কথা বলিয়া অন্য জনপদবাসীকে সতর্ক করাইয়া দেয়, এবং তাহাদের সাহায্যের জন্য পাছে কেহ আগমন করে, এই আশঙ্কা করিয়া অলিকসন্দর, বিশেষ সতর্কতার সহিত নগর অবরোধ করেন। নগরবাসীরা আপনাদের পরাক্রমের পরাকাষ্ঠা প্রকাশ করিয়া, শত্রুর আক্রমণ রোধ করিতে লাগিলেন। ইহাতে তাহাদের মধ্যে অনেকে বীর লোক প্রাপ্ত হন। দুর্ব্বল নগর প্রাচীর, শত্রুর হস্তগত হইবার আর বিলম্ব নাই বুঝিয়া, নগরবাসীরা উন্নত ভূমিতে অবস্থিত তাহাদের দুর্গের মধ্যে প্রবেশ করিয়া স্বাধীনতা রক্ষা করিবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। অলিকসন্দর, নগর অধিকার করিয়াও নগরবাসীকে হস্তগত করিতে না পারাতে ক্ষিণ্ণ হইলেন। তিনি আরো অধিক পরাক্রমের সহিত দুর্গ অধিকার করিবার জন্য উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। অলিকলন্দর যেন বহুরূপ ধারণ করিয়া, সৈন্যগণকে উৎসাহিত করিতে লাগিলেন। অল্পসংখ্যক ভারতবাসীর সমস্ত উদ্যম বিতথ হইয়া গেল, তাহাদের রক্তপাত সে সময় বিফল হইলেও, ইহার প্রতিশোধ লইবার জন্য যেন, যুদ্ধ রঙ্গমঞ্চে সহস্র সহস্র ব্যক্তি আবির্ভূত হইল। যে দুই সহস্র ব্যক্তি দুর্গ মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিল; তাহারা শত্রু হস্তে নিহত হইয়া বীরলোক প্রাপ্ত হইলেন। অলিকসন্দরও শূন্য দুর্গ অধিকার করিয়া গৌরব পতাকা রোপণ করিলেন।

 একটি গ্রাম, বা একটি নগর, শত্রু হস্তে পতিত হওয়াতে এ যুদ্ধের বিরাম হইল না; বরং অধিকতর উৎসাহের সহিত বর্দ্ধিত হইল। ভারতবাসীরা বিবেচনা করিয়াছিলেন যে, ভাগ্যক্রমে স্বর্গদ্বার অনর্গল হইয়াছে, তাই তাঁহারা যিনি যথায় সুবিধাপ্রাপ্ত হইলেন, তিনি তথায় শত্রুগণকে ঘোরতর বাধা প্রদান করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। এই নরমেধ যজ্ঞে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, সকলেই একপ্রাণে এক উদ্দেশ্যে ব্রতী হইলেন। সকলেই যেন পরস্পর স্পর্দ্ধা করিয়া অভিষ্ট সাধনে যত্নবান হইলেন। কুর্ত্তিয়াস বলেন, শূদ্রক্‌রাও (Sudracae) এই যজ্ঞে যোগদান দিতে বিলম্ব করেন নাই। শূদ্রেরা সামরিক বিষয়ে অনভ্যস্ত হইলেও, দেশের বিপদে, ধর্ম্মের বিপদে, জাতির বিপদে নিশ্চেষ্ট ভাবে গৃহমধ্যে অবস্থান করিতে সমর্থ হইলেন না তাঁহারাও কৃতান্তের ন্যায় ক্রুদ্ধ হইয়া শাণিত অসিধারণ করিয়া, স্বদেশের শত্রুর বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইলেন।

 মাসিদনরা যাহার ভয়ে গাঙ্গেয় ভূমি পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, গৃহে প্রত্যাগমনকালে তাঁহাদের সেই ভয়ই উপস্থিত হইল। যখন তাঁহারা শুনিলেন, এ প্রদেশে তাহাদিগকে বাধা দিবার জন্য ৮০/৯০ হাজার পদাতিক, ১০ সহস্র অশ্বারোহী, এবং ৭ হইতে ৯ শত যুদ্ধ রথ অবস্থান করিতেছে, তখন তাহাদের হৃৎকম্প উপস্থিত হইল। তাহারা চতুর্দ্দিক অন্ধকার দেখিতে লাগিল। গাঙ্গেয় প্রদেশের পরিবর্ত্তে যেন যুদ্ধদেবী এ প্রদেশে আগমন করিয়াছেন। এদেশের অগণিত দুর্দ্দমনীয় জনগণ, যেন শোণিত নদী প্রবাহিত করিয়া, তাহাদিগকে সমুদ্রাভিমুখে লইয়া যাইবার প্রণালী প্রস্তুত করিতে উদ্যত হইয়াছে। এই অশ্রুতপূর্ব্ব অজ্ঞাত দেশে, শত্রুগণ নূতন বলে, নূতন তেজের সহিত, আবির্ভূত হইয়া তাহাদিগকে বাধাদিবার জন্য বদ্ধ পরিকর হইয়াছে। ইহারা পরাজিত হইলেও, মাসিদনগণ যে কি পুরস্কার প্রাপ্ত হইবেন, সে বিষয় ভাবিয়া তাঁহারা আকুলিত হইয়াছিলেন। তাঁহাদের জন্য, সমুদ্র মধ্যে কোন্ গভীর অন্ধকার, কুজ্ঝটিকা, এবং দীর্ঘ রাত্রি অবস্থান করিতেছে,—সেই সমুদ্রের ভীষণকায় ভীতিপ্রদ জীবজন্তু সকল, সে সময় তাহাদের চিন্তার বিষয়ী ভূত হইয়া তাহাদিগকে নৈরাশ্য সাগরে নিমজ্জিত করিয়াছিল।

 ডিওডোরস বলেন, একজন দৈবজ্ঞ, অলিকসন্দরকে কোন যুদ্ধ হইতে প্রতি নিবৃত্ত হইতে পরামর্শ প্রদান করেন। বলা বাহুল্য যে, সে পরামর্শে অলিকসন্দর বিচলিত হন নাই। পাছে সৈন্যগণ এই কথা শুনিয়া ভগ্নোৎসাহ হইয়া পড়ে, এইভয়ে তিনি তাহাকে যথেষ্টরূপে তিরস্কার করেন। এই ঘটনায় মাসিদনরা কিরূপ ভাবে বিভীষিকা গ্রস্ত হইয়াছিল, তাহা আমরা অবগত নহি।

 পার্দ্দিকা যে গ্রামের বিরুদ্ধে প্রেরিত হইয়াছিলেন, তাহার অধিবাসীরা, শত্রুর আগমণ কথা অবগত হইয়া, গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া গমন করে। পার্দ্দিকা, হঠাৎ সেই গ্রামের নিকটবর্ত্তী হইয়া কতকগুলি নিরস্ত্র, বিপদ বিষয়ে অনভিজ্ঞ, এরূপ কতকগুলি লোক নিহত করিতে সমর্থ হন, অবশিষ্ট লোক একটা জলা ভূমি অতিক্রমণ করিয়া প্রাণরক্ষা করেন।

 অলিকসন্দর, নগর অধিকার করিয়া, সৈন্যগণকে ভোজন করিবার অবসর এবং রাত্রির প্রথম ভাগ বিশ্রাম করিতে আদেশ দিয়া আবার তিনি গমন করিতে আরম্ভ করিলেন। রাত্রি মধ্যে বহু পথ অতিক্রমণ করিয়া প্রাতঃকালে তাঁহারা হাইদ্রায়োতের (ঐরাবতী বা রাবী) তটে উপস্থিত হন। এ স্থানে অবগত হইলেন, তাঁহার আগমনের পূর্ব্বেই, বহুসংখ্যক মালনিবাসী, নদী পার হইয়া অপর পারে গমন করিয়াছে, তখনও যাহারা গমন করিতেছিল, তাহাদের মধ্যে যাহারা শত্রু হস্তে পতিত হইল, তাহারা নির্দ্দয় ভাবে নিহত হইয়াছিল। ভারতবাসীরা যে স্থানে নদী পার হইয়াছিল, অলিকসন্দর সম্ভবতঃ তাহাদেরই নৌকায় নদী পার হইয়া দ্রুতবেগে অনুসরণ করিয়াছিলেন। অধিকাংশ মালবাসী, একটি সুদৃঢ় দুর্গ মধ্যে গমন করিয়া আশ্রয় গ্রহণ করে। এই স্থানের নিকটে ব্রাহ্মণ বহুল নগরে, বহু সংখ্যক মালবাসী গমন করিয়াছিল। অলিকসন্দর, এই সংবাদ অবগত হইয়া, সেনানী পিথনকে, প্রথমোক্ত স্থানের উদ্দেশে প্রেরণ করিয়া, স্বয়ং ব্রাহ্মণ গ্রামের অভিমুখে গমন করেন। অন্যান্য বর্ণ, বৈদেশিক শত্রুর বশ্যতা স্বীকার করিতে প্রস্তুত হইলেও, তাহারা ব্রাহ্মণদের প্ররোচনায় যুদ্ধ করিতেছিল, সুতরাং ব্রাহ্মণদিগকে বশীভূত করিতে পারিলে, মাসিদনদের গমন পথ নিরাপদ হইবে, এই স্থির করিয়া অলিক– সন্দর, প্রবল পরাক্রমের সহিত ব্রাহ্মণ জনপদ অবরোধ করেন। ব্রাহ্মণরাও নির্ভয়চিত্তে, অলিকসন্দরের আক্রমণ রোধ করিয়া ধর্ম্ম রক্ষার জন্য, প্রাণ প্রদানে প্রস্তুত হইলেন। মাসিদনেরা, প্রাচীরের নিম্নভাগ খনন করিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিবার উপক্রম করিল। অধিবাসীরা প্রাচীর পতনোন্মুখ বুঝিয়া দুর্গ মধ্যে গমন করিতে লাগিলেন। এই সময় কতকগুলি মাসিদন, তাহাদিগকে অনুসরণ করে। ব্রাহ্মণেরা প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া, তাহাদিগকে আক্রমণ করেন। মাসিদন বীরেরা, ব্রাহ্মণদিগের গতিরোধ করিতে পারিলেন না; বরং পলায়নপর হইলেন। এইক্ষণকালের যুদ্ধে, গ্রীক গ্রন্থকার বলেন, ২৫ জন মাসিদনবীর যমলোকের অতিথি হইয়াছিলেন। ইয়ুরোপীয় সেনার শোণিতপাতে, অলিকসন্দরের ক্রোধের সীমা রহিল না। তিনি প্রাচীর ভাঙ্গিয়া ফেলিতে, এবং মই লাগাইয়া উপরে উঠিবার জন্য সকলকে আদেশ করিলেন। দুর্গ প্রাচীরের নিম্নভাগ খনন করায় ইহা পড়িয়া গেল, অপর দিকে অলিকসন্দর সর্ব্ব প্রথমে প্রাচীরের উপর উঠিয়া সকলকে বিষ্মিত করিলেন। অলিকসন্দরকে সর্ব্বাগ্রে উঠিতে দেখিয়া সৈন্যগণ আর নিশ্চেষ্ট থাকিতে পারিল না, সকলেই প্রাচীর অতিক্রমণ করিয়া, শত্রুগণকে আক্রমণ করিবার জন্য ধাবিত হইল। কেহ বা প্রাচীরে উঠিয়া, কেহ বা ভগ্ন স্থান দিয়া, দুর্গ মধ্যে গমন করিল। দুর্গ মধ্যস্থ ব্রাহ্মণগণ, শত্রুগণকে দুর্গ অধিকার করিতে দেখিয়া, অবসন্ন না হইয়া ঘোরতর বিক্রমে তাহাদিগকে আক্রমণ করিলেন। কেহ বা আপন আপন গৃহে অগ্নি প্রদান করিয়া এই দৃশ্যকে অধিকতর ভীষণ করিয়া তুলিলেন। এরিয়ান বলেন, “ইহাঁদের অধিকাংশই যুদ্ধ করিয়া শরীর ত্যাগ করেন। প্রায় ৫ হাজার নিহত হইয়াছিলেন। ইহাঁরা তেজস্বী বলিয়া ইহাঁদের মধ্যে বন্দীয় সংখ্যা খুব কম হইয়াছিল।” যথার্থ ব্রাহ্মণ, কখন অর্থ লোভে মুগ্ধ, অথবা মৃত্যু ভয়ে কর্ত্তব্য ভ্রষ্ট হন না, তাই ব্রাহ্মণদের মধ্যে বন্দীর সংখ্যা খুব কম হইয়াছিল।

 পিথন, যাঁহাদের বিরুদ্ধে প্রেরিত হইয়াছিলেন, গ্রীক গ্রন্থকারেরা বলেন, তিনি ও কার্য্য সিদ্ধ করিয়া শিবিরে প্রত্যাগমন করিয়াছিলেন।

 অলিকসন্দর, ব্রাহ্মণ গ্রামে একদিবস অবস্থান করিয়া, সৈন্যগণকে বিশ্রাম করিবার অবকাশ প্রদান করেন। এই প্রদেশে অন্যান্য যে সকল গ্রাম ও নগর ছিল, সেই সকল স্থান অধিকার করিবার জন্য, তিনি আবার বহির্গত হইলেন। মহামারিভয় উপস্থিত হইলে, মনুষ্য সকল যেরূপ গৃহ দ্বার পরিত্যাগ করিয়া দূরতর নিরাপদ প্রদেশে গমন করে, সেইরূপ অলিকসন্দর রূপ মারিভয়ে ইহাঁরাও গ্রাম নগর পরিত্যাগ করিয়া দুর্গম মরু স্থানের আশ্রয় গ্রহণ করেন। অলিকসন্দর যখন অবগত হইলেন, এদেশের অধিবাসীরা গ্রামও নগর শূন্য করিয়া চলিয়া গিয়াছে; তখন তিনি ডেমিটাস ও পিথনকে, নদীর তটবর্ত্তী ভূভাগে, যে সকল জঙ্গল ছিল, সেই সকল স্থানে যদি কোন শত্রু গুপ্তভাবে অবস্থান করিয়া থাকে, তাহাদিগকে আক্রমণ করিবার জন্য প্রেরণ করেন। ইহাঁরা নাকি জঙ্গলের ভিতর কতকগুলি লোককে সংহার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।

 অলিকসন্দর, আর একটা বড় নগরের বিরুদ্ধে যাত্রা করিলেন। এস্থানে অনেক ভারতবাসী আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিল। নগরবাসীরা যখন অবগত হইল যে, বিদেশী শত্রু তাঁহাদের বিরুদ্ধে আগমন করিতেছে, তখন তাহারা নগরমধ্যে বন্দীর ন্যায় অবস্থান না করিয়া, অলিকসন্দরকে নদী পার হইবার সময় বাধা দিবার জন্য গমন করেন। ভারতবাসীরা, নদীর উচ্চতটের উপর যুদ্ধ সজ্জায় সজ্জিত হইয়া অবস্থান করিল। অলিকসন্দর, ভারতবাসী যুদ্ধের জন্য অবস্থান করিতেছে, এ সংবাদ অবগত হইয়া, তিনি স্বয়ং অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া, অগ্রে গমন, এবং পদাতিকগণকে তাঁহাকে অনুসরণ করিতে আদেশ করিলেন। অলিকসন্দর, নদীর পারে শত্রুগণকে অবস্থান করিতে দেখিয়া, অশ্বারোহীগণ সহ নদী পার হইতে লাগিলেন। ইনি নদীর মধ্যস্থলে আগমন করিলে, এরিয়ান বলেন, ভারতবাসীরা শীঘ্রতার সহিত পশ্চাৎ গমন করিলেও, তাহাদের মধ্যে বেশ সুশৃঙ্খলা পরিলক্ষিত হইয়াছিল। ভারতবাসীরা যখন বুঝিল, ইঁহার সহিত বড় বেশী সৈন্য নাই, তখন তাহারা যুদ্ধের জন্য পুনরায় প্রত্যাবর্ত্তণ করেন। অলিকসন্দর, গতিক ভাল নয়, বুঝিয়া ভারতবাসীর নিকটবর্ত্তী হইলেন না; দূরে অবস্থান করিয়া পর্য্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন। ইত্যবসরে অন্যান্য সৈন্যগণ আসিয়া উপস্থিত হইল, তাঁহার দল পরিপুষ্ঠ হইবার পূর্ব্বেই, গ্রীক লেখক বলেন, ভারতবাসীরা স্থান পরিত্যাগ করিয়া তাহারা তাহাদের সর্ব্বাপেক্ষ সুদৃঢ় ও দুর্গম দুর্গমধ্যে গমন করেন। ইহাদের গমন কালে কতকগুলি ভারতবাসী শত্রুহস্তে আপতিত হইয়া নিহত হইয়াছিল। গ্রীকরা, এই সকল ভারতবাসীর সংখ্যা কথনকালে কহিয়াছেন যে, ইহাদের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ হাজার হইবে। ইহা কতদূর সত্য সে বিষয় আমরা সন্দেহ করিলেও কোন প্রমাণ দিয়া ইহা মিথ্য প্রমাণ করিতে একেবারে অসমর্থ। অলিকসন্দর সত্বর গমন করিয়া, এই নগরের সকল দিকে সৈন্য সংস্থাপন করিয়া অবরোধ করিলেন। সমস্ত সৈন্য উপস্থিত না হওয়াতে এবং দিবা অবসানের আর বিলম্ব না থাকাতে, অলিকসন্দর দুর্গ আক্রমণ করিয়া তাহার ক্লান্ত সৈন্যগণের আর ক্লান্তিবর্দ্ধণ করিলেন না।

 পরদিবস প্রাতঃকালে সৈন্যগণকে দুইভাগে বিভক্ত করিলেন, এক ভাগ পার্দ্দিকাকে পরিচালনা করিতে দিয়া, তিনি স্বয়ং অপরভাগ লইয়া প্রাচীর আক্রমণ করিলেন। অলিকসন্দর কোনরূপে নগরের একটা ক্ষুদ্র দ্বার উদ্ঘাটন করিতে সমর্থ হন। পার্দ্দিকা অনেক ক্লেশে প্রাচীর অতিক্রমণ করিয়া নগরে প্রবেশ করেন, ভারতবাসীরা নগর পরিত্যাগ করিয়া, দুর্গমধ্যে গমন করেন এবং ইহা রক্ষা করিবার জন্য তাঁহারা সর্ব্বতোভাবে চেষ্টা করিয়াছিলেন।

 মাসিদনরা দুর্গ অধিকার করিবার জন্য, কেহ দুর্গের পাদদেশে উপযুক্ত স্থান অন্বেষণ করিতেছিল—কেহ বা প্রাচীরে উঠিবার উদ্যোগ করিতেছিল, কেহ বা মই লাগাইবার যোগাড় করিতেছিল। এইরূপ চেষ্টা করিলেও, কেহই প্রাচীরে উঠিতে সমর্থ হয় নাই। সৈন্যগণের চিরকারিতা, অলিকসন্দরের ভাল লাগিল না। নিকটবর্ত্তী একজন সৈনিকের নিকট হইতে একটি রজ্জু আরোহণী লইয়া প্রাচীরে সংলগ্ন করিয়া সর্ব্বপ্রথমে প্রাচীরের উপর আরোহণ করিলেন। অলিকসন্দর, যে মই চড়িয়া প্রাচীরে উঠিয়াছিলেন, সেই মই, বহুসংখ্যকসৈন্য উঠাতে ছিঁড়িয়া পড়িয়া গেল। সুতরাং আর কেহ সে সময় প্রাচীরে উঠিতে পারিল না। শত্রুকে প্রাচীরের উপর উঠিতে দেখিয়া, ভারতবাসীরা, উপরের মঞ্চ এবং পাশ্বের নিকটবর্ত্তী স্থান হইতে মুষলধারায় অস্ত্রশস্ত্র নিক্ষেপ করিতে লাগিল। অলিকসন্দরের প্রাণসংশয় জনক— বিপদে, সৈন্যগণ অত্যন্ত ভীত হইয়া পড়িল—কেহই তাঁহার নিকট গমন করিতে সমর্থ হইল না, তিনি লাফাইয়া পড়িলে তাঁহাকে গ্রহণ করিবার জন্য, প্রস্তুত হইয়া, লোকসকল তাঁহাকে লাফাইয়া পড়িতে অনুরোধ করিল, আরবেলার সেই প্রশান্তচিত্ত মহাবীর, এখন অতি সাহস অবলম্বন করিয়া দুর্গমধ্যে লম্ফ দিয়া পতিত হইলেন। সৌভাগ্যক্রমে তিনি দাঁড়াইয়া পড়িয়াছিলেন, এবং কোনরূপ আঘাতপ্রাপ্ত হন নাই। অলিকসন্দর যে স্থানে পতিত হইয়াছিলেন, সেই স্থানের অতি নিকটে ঘন পত্রাচ্ছাদিত একটা বৃক্ষ ছিল, পশ্চাদভাগে প্রাচীর, সম্মুখে ও পার্শ্বে বৃক্ষ ও শাখা, তাঁহাকে বন্ধুভাবে রক্ষা করিতে লাগিল। বৃক্ষ ও প্রাচীর শত্রুর অতি সাহসে মুগ্ধ হইয়া রক্ষা করিলেও, চতুর্দ্দিক হইতে দুর্গবাসীরা প্রস্তর, অস্ত্র,শস্ত্র, যে যাহা পাইল সে তাহা লইয়া প্রহার করিতে আরম্ভ করিল। অলিকসন্দর, অস্ত্রশস্ত্র ও প্রস্তর প্রহারে অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছিলেন, তাঁহার শিরস্ত্রাণ ছিন্নভিন্ন হইয়া পড়িল, ঢাল দিয়া আত্মরক্ষার সামর্থ রহিল না। এই সময় একটি দারুণ শরাঘাতে তিনি অবসন্ন হইয়া পড়েন। শত্রু হীনবীর্য্য হইয়া পড়িয়াছে দেখিয়া; নিকটের একজন লোক আসিয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিল, অলিকসন্দর তাঁহার শেষ দশা নিকটবর্ত্তী বুঝিতে পারিয়া, কোনরূপে তাঁহার মুর্চ্ছিত সমস্তশক্তি একত্র করিয়া, তাহাকে দারুণ প্রহার করিলেন। এক আঘাতে সেই লোক ভূপতিত হইয়া মৃত্যুলোকে গমন করে। এই ঘটনা দেখিয়া নিকটের লোক সকল স্তম্ভিত হইয়া পড়িল, কেহ আর নিকটে যাইতে সাহসী হইল না, সকলের চলৎশক্তি যেন রহিত হইল। দূর হইতে নিক্ষিপ্ত অস্ত্রশস্ত্রে, অলিকসন্দরের চতুর্দ্দিক পরিপূর্ণ হইয়া গেল। এখন তিনি বীরের ন্যায় কৃপাণ হস্তে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হইলেন,—তাঁহার সহজাত বন্ধু চরণযুগল, আর তাঁহাকে বহন করিতে সমর্থ হইল না—তিনি মৃত্তিকার উপর লুণ্ঠিত হইয়া পড়িলেন।

 এই সময় পিউকিস্‌তাস্‌, অন্যদিক দিয়া দুর্গ মধ্যে প্রবেশ করিয়া অলিকসন্দরের সমীপবর্ত্তী হইলেন। পাঠকের বোধ হয় স্মরণ আছে যে, অলিক সন্দর এসিয়া ভূমে পদার্পণ করিয়া ট্রয়ের যুদ্ধক্ষেত্রে এথিনা দেবীর মন্দিরে, নিজের একপ্রস্থ যুদ্ধ সজ্জা রাখিয়া, প্রাচীন বীরের যে একপ্রস্থ যুদ্ধসজ্জা গ্রহণ করিয়াছিলেন, এই পিউকিস্‌তাস্‌ সেই সকল পবিত্র দ্রব্য বহন করিয়া যুদ্ধের সর্ব্বাগ্রে গমন করিতেন। অলিকসন্দর, বিদেশে শত্রুগণমধ্যে মৃত্যুকালে স্বদেশবাসীকে দেখিতে পাইয়া আশ্বস্ত হইলেন। পিউকিসতাস, ঢালের আবরণে রাজাকে রক্ষা করিলেন; ইত্যবসরে আরও দুইজন মাসিদন যোদ্ধা, তাঁহার নিকট উপস্থিত হইল। দুর্গবাসীরা, যখন অবগত হইল যে, স্বয়ং অলিকসন্দর আহত হইয়া দুর্গমধ্যে পতিত রহিয়াছেন, তখন তাঁহাকে হস্তগত করিবার জন্য, ভারতীয় যোদ্ধারা সেই দিকে অগ্রসর হইল। যে তিনজন মাসিদন,অলিকসন্দরের নিকট উপস্থিত হইলেন, তাঁহারা প্রভুর জন্য, অটল অচলের ন্যায় দাঁড়াইয়া যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। একে একে তাঁহারা কেহবা সাংঘাতিক আঘাতে মুর্চ্ছিত হইয়া, কেহবা নিহত হইয়া অলিকসন্দরের পদপ্রান্তে পতিত হইলেন।

 দুর্গমধ্যে অলিকসন্দরের পতন সংবাদ, ইত্যবসরে মাসিদন সৈন্য মধ্যে প্রচারিত হইল। তাহারা কর্ত্তব্যবিমূঢ় না হইয়া, নিজেদের অধীশ্বরকে উদ্ধার করিবার জন্য, দুর্গ প্রাচীর অতিক্রম করিবার জন্য, দলে দলে পৃথক পৃথক উপায় অবলম্বন করিতে লাগিলেন। পৃথিবীতে এরূপ কোন বাধা নাই, যাহা দৃঢ়ব্রত ব্যক্তির গতিরোধ করিতে সমর্থ হয়। একবার মানুষের হৃদয়ে সেই পবিত্রবৃত্তি জাগরূক হইলে, জগতে তাহার আর কোন কার্য্য অসম্পন্ন থাকে না। মাসিদনরা সেই প্রবৃত্তির বশবর্ত্তী হইয়া, কেহ নগরদ্বায় ভাঙ্গিয়া প্রবেশ করিল, কেহ পরস্পরের স্কন্ধে আরোহণ করিয়া প্রাচীর লঙ্ঘন পূর্ব্বক দুর্গমধ্যে পতিত হইল, কেহবা দুর্গের মৃন্ময় প্রাচীরে কীলকবিদ্ধ করিয়া তাহার সহায়তায় দুর্গমধ্যে গমন করিল, কেহ বা কুঠার সহযোগে প্রাচীর ভগ্ন করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল। অলিকসন্দর, দুর্গবাসীর হস্তগত হইবার উপক্রমকালে, মাসিদনরা দানব বিক্রমে ঘোরতর হুঙ্কার করিতে করিতে আপনাদের বিপন্ন প্রভুর নিকট উপস্থিত হইল। এইবার দুর্গবাসীও দুর্গশত্রু, উভয়ের ঘোরতর যুদ্ধের আরম্ভ হইল। অলিকসন্দরের পার্শ্বে মাসিদন যোদ্ধার মৃতদেহ পুঞ্জীকৃত হইল। যিনি অন্য সময়ে গৃহ হইতে গৃহান্তরে গমন করেন না, কিন্তু উৎসব সময়ে সেই গৃহী গৃহের সর্ব্বত্র যেরূপ গমনাগমন করিয়া থাকেন, সেইরূপ ভারতীয় যোদ্ধাগণ, প্রসন্নবদনে সর্ব্বত্র বিচরণ করিয়াছিলেন। এই অতিথি সৎকারযজ্ঞে, হৃদয়ের উষ্ণশোণিত পাদ্যরূপে নিবেদিত হইয়াছিল। এই ঘোরতর যুদ্ধে কোন ভারতবাসী পলায়ণ বা কাহারও মুখে দীনতা ব্যঞ্জক লক্ষণ সূচিত হয় নাই। সকলেই অম্লানবদনে, শত্রুর আক্রমণ রোধ করিতে অশক্ত শরীর পরিত্যাগ করিয়া, নবীনশরীর গ্রহণ করিয়াছিলেন। মাসিদনদের শাণিত অসি, এই শরীর বিসর্জ্জন ব্যাপারে বৃদ্ধ, বালক, বালিকা ও অবলা, সকলেরও সহায়তা সম্পাদন করিয়াছিল। যুদ্ধের পর এই স্থানে কোন স্বদেশভক্ত ভারতবাসীকে আর জীবিত দেখিতে পাওয়া যায় নাই। গ্রীক গ্রন্থকার বলেন, নদীর তটে প্রায় ৫০ হাজার ভারতবাসী, অলিকসন্দরের গতিরোধ করিতে গমন করিয়াছিলেন। সেই সকল লোক নগরে প্রত্যাগমন করিয়াছিলেন, সুতরাং অনেক অধিক সংখ্যক ভারতবাসী যে যুদ্ধক্ষেত্রে এবং নির্দয় মসিদনদের তরবারীর প্রহারে ইহলোক পরিত্যাগ করিয়াছিল সে বিষয় সন্দেহ নাই।

 মাসিদন পক্ষে যে কতলোক হতাহত হইয়াছিল সে পক্ষে বিদেশী গ্রন্থকারেরা একেবারে নীরব। অলিকসন্দর সাংঘাতিক রূপে আহত হওয়াতে তাঁহারা বোধ হয় এ কথা লিখিতে ভুলিয়া গিয়াছেন।

 স্বাধীনতা সংরক্ষণ জন্য এই সকল দারুণ যুদ্ধ কোন স্থানে হইয়াছিল তাহা স্থির নিশ্চয় করা বড়ই কঠিন। বর্ত্তমান মণ্টগমরী জেলাতে কএকটি অতি প্রাচীন দুর্গের ভগ্নাবশেষ দেখিতে পাওয়া যায়। অনেকে মনে করেন কোটকমলীয়া ও হরপ্প নামক স্থানে, এই সকল অতীত ঘটনা সংঘটিত হইয়াছিল। কেহ কেহ মুলতানকে মাল দেশের রাজধানী বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। আবার কেহ গ্রীক মালোকে মালওয়া দেশ বলিয়া সিদ্ধান্ত করিয়া থাকেন, আমরা ইহা সঙ্গত বলিয়া বিবেচনা করি না।

 অলিকসন্দর, শিবিরে আনীত হইলেন। তাঁহার শোচনীয় দশা দেখিয়া সকলেই বিষাদসাগরে নিমগ্ন হইলেন। যে শরে তিনি বিদ্ধ হইয়াছিলেন তাহা বুকের ভিতর অনেকটা প্রবিষ্ট হইয়াছিল, আরো খানিকটা না কাটিলে তাহা বাহির করা দুষ্কর কিন্তু এ সময় অস্ত্রবৈদ্য কাটিতে সাহসী হইল না। পাছে তাহা হইতে আরো অধিক পরিমাণ রক্ত নির্গত হইয়া মৃত্যু হয়, এই ভয়ে তিনি এ কার্য্যে অগ্রসর হইলেন না। অলিকসন্দর এই অবস্থা অবগত হইয়া চিকিৎসককে স্বীয় কার্য্য করিতে ইঙ্গিত করেন। শল্য নির্গত হইলে তাহা হইতে আবার প্রচুর পরিমাণে রুধির ধারা বহির্গত হইতে লাগিল, অলিকসন্দর মুর্চ্ছিত হইয়া পড়িলেন। এই মুর্চ্ছা বহুক্ষণ স্থায়ী হইয়াছিল, অনেকে তাঁহার প্রাণবায়ু বহির্গত হইয়াছে মনে করিতে লাগিল, কোন কোন গ্রন্থকার বলেন, একজন সেনানী তরবারীর সাহায্যে ক্ষত করিয়া শর বাহির করিয়াছিলেন।

 অলিকসন্দরের এই ঘটনা, মৃত্যু সংবাদ রূপে চান্দ্রভাগার তটে প্রধান শিবিরে নীত হইল। তথায় সকলের দুঃখের সীমা রহিল না—দুঃখের প্রথম বেগ একটু কমিয়া আসিলে,নূতন নূতন ভাবনা আসিয়া তাহাদিগকে আকুলিত করিয়া তুলিল। কোন্ উপযুক্ত ব্যক্তি তাহাদের নায়কের পদে আসীন হইবে, কেই বা তাহাদিগের এই বিপদসাগরে কর্ণধার হইয়া দেশে লইয়া যাইতে সমর্থ হইবে। এখনও যুদ্ধে কৃত নিশ্চয় বহুসংখ্যক ভারতবাসী তাঁহাদিগের গমন পথ রোধ করিবার জন্য শস্ত্রপাণি হইয়া অবস্থান করিতেছে, যাহারা উদাসীন ভাব অবলম্বন করিয়াছিল, তাহারা অলিকসন্দরের মৃত্যু কথা শুনিয়া শীঘ্র শত্রুতা করিবেন, এই ভাবনা আসিয়া তাহাদিগকে অধিকতর বিপন্ন করিয়া তুলিল। অলিকসন্দরের হস্তাক্ষর সম্বলিত পত্র শিবিরে আনীত হইলেও, কেহ তাহাতে বিশ্বাস স্থাপন করিল না, তাহারা মনে করিল, সেনানীরা প্রকৃত ঘটনা গোপন করিয়া মিথ্যা সংবাদ প্রদান করিয়াছে।

 অলিকসন্দরের ক্ষত হইতে রক্ত রোধ করিবার জন্য, চিকিৎসকের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছিল। দীর্ঘকালের পর আপনা আপনি স্রাব বন্ধ হইয়া ধীরে ধীরে ক্ষত আরোগ্যোন্মুখ হয়। তিনি একটু বল প্রাপ্ত হইয়াই, রাভী নদীতে নৌকা করিয়া চন্দ্রভাগা তটস্থিত প্রধান শিবির অভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। অলিক সন্দরের নৌকা, প্রধান শিবিরের নিকটবর্ত্তী হইলেও, সৈন্যগণের সন্দেহ দূর হইল না। তাহারা মনে করিল, এ বুঝি অলিকসন্দরের মৃতদেহ আনীত হইতেছে, যখন নৌকা নিকটবর্ত্তী হইল, অলিকসন্দর যখন হস্তত্তোলন করিয়া সকলের নমস্কার গ্রহণ করিলেন, তখন জনসাধারণের আহ্লাদের সীমা রহিল না। আবার যখন তিনি তীরে অবতরণ করিয়া ঘোড়ায় চড়িয়া ধীরে ধীরে শিবিরে অশ্বপরিচালনা করিলেন, তখন সকলের আনন্দ সীমা অতিক্রমণ করিয়া বর্দ্ধিত হইল—কেহ তাঁহাকে প্রণাম করিল, কেহ তাঁহাকে স্পর্শ করিল, কেহ বা তাঁহার বসন প্রান্ত স্পর্শ করিল, কেহ বা তাঁহাকে দূর হইতে দেখিতে পাইয়া নিজেকে কৃতকৃতার্থ বিবেচনা করিতে লাগিল। অলিকসন্দরের এই অতি সাহসের জন্য, তাঁহার কতিপয় অন্তরঙ্গ বন্ধু অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করেন, সামান্য সৈনিকের ন্যায় তিনি যদি নিহত হইতেন, তাহা হইলে সমস্ত সেনাদলের কি দুর্দ্দিন উপস্থিত হইত, তাহা কল্পনা করিলেও শরীর আতঙ্কে শিহরিয়া উঠে, ভবিষ্যতে যাহাতে তিনি এরূপ অতি সাহসে প্রবৃত্ত না হন, সে জন্য তাঁহারা যথেষ্ট অনুনয় বিনয় করেন। কোন লেখক বলেন, অলিকসন্দর সেনানীদের এই সমালোচনায় বিরক্ত হইয়াছিলেন, অপরে বলেন, তিনি প্রসন্ন হইয়াছিলেন। অলিকসন্দরের জীবনী লেখকদিগের মধ্যে, এইরূপ পরস্পর মতভেদ অনেক স্থানে দেখিতে পাওয়া যায়। সেনানীরা যে সময় অলিকসন্দরকে এইরূপ অনুরোধ করিতেছিলেন,সে সময় একজন বিওসিয়া দেশীয় সৈনিক, তাহার গ্রাম্য ভাষায় “হে অলিকসন্দর। অসাধারণ পুরুষই অসাধারণ কার্য্য করিয়া থাকেন,” ইহা কহিয়া তিনি “যে মারে সেই মার খাইয়া থাকে” এই মর্ম্মের একটি শ্লোকার্দ্ধ উচ্চারণ করেন। অলিকসন্দর, লোকটির উপর প্রসন্ন হইয়াছিলেন, এবং ভবিষ্যতে সে তাঁহার সান্নিধ্য লাভ করিতে সমর্থ হইয়াছিল।

 যথেষ্ট চেষ্টা করিয়াও যদি কাম্যবস্তু লাভ করিতে না পারা যায়, তাহা হইলে সেই উদ্যোগী পুরুষ কখনই নিন্দনীয় হইতে পারেন না। যে ব্যক্তি মেষের মত পরাজিত না হইয়া, পুরুষের মতন পরাজিত হয়। সেই পুরুষ শ্রেষ্ঠ, পরাজিত হইয়াও প্রশংসিত হইয়া থাকেন। লক্ষ লক্ষ ভারতবাসী আপনাদের স্বাধীনতা রক্ষা করিবার জন্য অকাতরে যে আত্ম উৎসর্গ করিয়াছিলেন,তাহা চিরকার বিষ্ময়ের সহিত পঠিত হইবে। জয় বা পরাজয় যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী ফল,পরাজিত হইলেই কিছু নিন্দনীয় হইতে পারে না। পরাজিত ব্যক্তির যদি কার্য্য সাধনের জন্য ঐকান্তিক দৃঢ়তা,শরীর ত্যাগে অপরাঙ্মুখতা, এবং কর্ত্তব্য সম্পাদনে উৎসাহ না থাকে তাহা হইলে সে নিন্দনীয় হইতে পারে। তাই ভারতবাসীরা পরাজিত হইয়াও নিন্দিত হন নাই। আর এক কথা, ইয়ুরোপীয়দের সকল কথার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা যাইতে পারে না, তাঁহারা আমাদের বিষয় অনেক কপোলকল্পিত কথা বলিয়াছেন। তাই সন্দেহ হয় যে, সকল ক্ষেত্রেই কি ভারতবাসী পরাজিত হইয়াছে?

 বিদেশী গ্রন্থকারেরা বলেন, মালো এবং আকসিদ্রাকাইরা যুদ্ধ করিবার সঙ্কল্প পরিত্যাগ করিয়া, অলিকসন্দরের সহিত সন্ধি করিয়া নিষ্কৃতি লাভ করেন। অলিকসন্দর, প্রতিভু স্বরূপ তাঁহাদিগের মধ্য হইতে এক সহস্র প্রধান পুরুষকে, তাঁহার নিকট পাঠাইতে বলেন। এরিয়ন বলেন যে, ইহাঁদের সহিত ৫ শত যুদ্ধ রথ ও, অলিকসন্দরের নিকট প্রেরিত হইয়াছিল। যাহাদের সহিত যুদ্ধ কালে তিনি বিপন্ন হইয়াছিলেন, এক্ষণে তাহাদের উদারতায় মুগ্ধ হইলেন। মালো বাসীরা যে সকল দ্রব্য উপহার প্রদান করিয়াছিলেন, কুর্ত্তিয়স তাহার একটি তালিকা প্রদান করিয়াছেন। সেই তালিকা কতদূর সত্য সে বিষয় সন্দেহ হয়, তাহাতে আমরা দেখিতে পাই যে ৩ শত অশ্বরোহী ১০৩০টা চার ঘোড়ার রথ, ১ হাজার ভারতীয় ঢাল, শত টালাণ্ট মূল্যের ইস্পাত-লৌহ, প্রচুর পরিমাণে বস্ত্র, কএকটা পালিত অতিকায় সিংহ ও ব্যাঘ্র, বহু সংখ্যক গোধা চম্ম, এবং কচ্ছপের আবরণ। বলা বাহুল্য, অলিক সন্দর এ সকল দ্রব্য অপেক্ষা মালো বাসীর মিত্রতালাত করিয়া বিশেষ প্রীত হইয়াছিলেন। এই উপলক্ষে তাঁহাদের শিবিরে যথেষ্ট উৎসব অনুষ্ঠিত হইয়াছিল। অলিকসন্দর পারসীক বিলাস অনুকরণ করিয়া, সুবর্ণ জড়িত আসন সকল আমন্ত্রিত ব্যক্তিগণের জন্য ব্যবহার করিয়াছিলেন।

 অলিকসন্দর, সমাগত দূতগণকে বিদায় প্রদান এবং যে সকল নৌকা ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল, তাহার সংস্কার করিয়া পুনরায় অগ্রসর হইতে আরম্ভ করিলেন। এইরূপ ঐরাবতী সঙ্গম অতিক্রমণ করিয়া আবার অসিক্লীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বর্ত্তমান কালে এ সকল স্থানের যথেষ্ট পরিবর্ত্তন হইয়াছে, সুতরাং নদীর বর্ত্তমান কালের গতি দেখিয়া সে কালের জনপদ বা নগরের স্থান নির্দ্দেশ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। নদীর গতি ব্যতীত, বৈদেশিক জিহ্বায় আমাদের দেশের নাম এরূপ বিকৃত ভাবে উচ্চারিত হইয়াছে যে তাহা বোধগম্য হওয়া অত্যন্ত দুষ্কর।

 সিন্ধুর সহিত যে স্থানে চন্দ্রভাগা মিলিত হইয়াছে, সে স্থানে অলিকসন্দর কিছু দিন অবস্থান করিয়া একটি নগর পত্তন করেন। ইহাতে নৌকা থাকিবার স্থান নির্ম্মিত হইয়াছিল। ফিলিপের শাসিত স্থানের ইহা দক্ষিণ সীমা পরিকল্পিত হইয়াছিল। যাহাতে এ প্রদেশ তিনি অধীনে রাখিতে সমর্থ হন, সে জন্য তাঁহাকে যথেষ্ট পরিমাণে থ্রেসীয় এবং অন্য সৈন্য প্রদান করা হইয়াছিল। এ স্থানে অবস্থান কালে অজয় রথী, অলিকসন্দরের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসেন, কাবুল প্রদেশে যাহাকে নিযুক্ত করা হইয়াছিল, তাহার কার্য্য সন্তোষজনক না হওয়াতে তাহার পরিবর্ত্তে অলিকসন্দর, অজয় রথীকে সেই প্রদেশের শাসন ভার প্রদান করেন।

  1. গ্রীক গ্রন্থকারেরা, শিবিবাসীরা, তাঁহাদের হরিকুলেশের বংশধর বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। সম্ভবতঃ ইহারা আমাদের হরিকুলেশের বংশধর যাদবগণ হইবেন। পুরাকালে এ সকল ভূমি যাদবগণে অধ্যুষিত ছিল। বর্ত্তমানকালেও ইহার নিকটবর্ত্তী প্রদেশে বহুসংখ্যক যাদব অবস্থান করিয়া থাকেন। গ্রীকমহাশয়েরা আমাদের সহিত তাঁহাদের কোন সাদৃশ্য দেখিলেই, তাহাকে তাঁহারা নিজস্ব করিয়া লইতে চেষ্টা করিয়াছেন; তাঁহারা বলেন, হরিকুলেশ যে সময় ভারত আক্রমণ করেন, সে সময় তাঁহার যে সকল সৈন্য রুগ্ন ও অকর্ম্মণা হয় তাহারা এ দেশে বশতি করিয়াছিল।