বিষয়বস্তুতে চলুন

ভারতে অলিকসন্দর/দ্বিতীয় ভাগ/তৃতীয় অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় অধ্যায়

 অধ্যবসায়ের অবতার মহাভাগ অলিকসন্দর জন্মভূমি হইতে শত শত ক্রোশ দূরে, নানাপ্রকার প্রতিকূল ঘটনার মধ্যবর্ত্তী হইয়াও, প্রচণ্ডবীৰ্য্য শক্রগণকে পরাজয় করিয়া জয়যুক্ত হইলেন। যে পুরুষে, নীতি, উৎসাহ, অধ্যবসায়, প্রাণপাত করিয়াও কার্য্য সাধনের জন্য উদ্যোগ, প্রভৃতি পুরুষজনোচিৎ গুণ সকল বৰ্ত্তমান থাকে, তিনি যে অবস্থাতে থাকুন না কেন, সেই অবস্থাতেই আপনার অদৃষ্টের সহিত দেশের ভাগ্যচক্রও পরিবর্ত্তন করিয়া থাকেন। অলিকসন্দর, এই সকল সদ্‌গুণের আধার হওয়াতে মরণে কৃত নিশ্চয় ভারতীয়গণকেও পরাজয় করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।

 ভারতে আগমনের পূৰ্ব্বে, অলিকসন্দর, স্ত্রীধৰ্ম্মা পুরুষগণের নিকট, ভারতের ধনরত্ন প্রচুর পরিমাণে, অরক্ষিত অবস্থায় পতিত রহিয়াছে, ক্লেশ করিয়া তথায় গমন করিলেই তাহা হস্তগত হয়, এইরূপ ভাবের কথা বলিয়া, তিনি সৈন্যগণকে উৎসাহিত করিয়াছিলেন। এখন প্রত্যক্ষ করিয়া যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহাদের সে মোহ অপগত হইল। এতদিন তাঁহারা যে সকল যুদ্ধ করিয়াছিলেন, ভারতীয় যুদ্ধের তুলনায়, তাহা বালকদিগের ক্রীড়া যুদ্ধ মাত্র। সে সকল যুদ্ধে, অলিকসন্দরের গর্ব্বের মাত্রা বৰ্দ্ধিত হইয়াছিল—এইরূপ যুদ্ধে জয়যুক্ত হইয়া তিনি জগ্বিজেতা নামে অভিহিত হইবেন, এই আশায় স্ফীত হইয়াছিলেন। ভারতে তাঁহার যে যুদ্ধ হইয়াছিল, তাহাতে তাঁহাকে পূৰ্ব্বের উপার্জ্জিত সুনামকে রক্ষা করিবার জন্য যুদ্ধ করিতে হইয়াছিল—কোন রূপে প্রাণরক্ষা করিয়া স্বদেশে প্রত্যাগমন করিতে সমর্থ হইবেন, এইরূপ ভাবিয়া তাঁহাকে যুদ্ধ করিতে হইয়াছিল।

 সুদক্ষ সেনাপতিরা, সকল সময় সৈন্যগণকে প্রকৃত কথা অবগত করান না, প্রকৃত কথা অবগত হইলে পাছে তাহাদের মধ্যে বিভীষিকা উপস্থিত হয়, পাছে তাহাদের দ্রোহ বুদ্ধি উৎপন্ন হয়, এই আশঙ্কায় তাঁহারা যথার্থ বিযয় গোপন করিয়া, সহজ সাধ্য বিষয় অবগত করাইয়া, সৈন্যগণকে উৎসাহিত করিয়া থাকেন। সুবিচক্ষণ অলিকসন্দর, তাঁহার সেনানী ও সৈন্যগণকে আহবান করিয়া তাহাদের বীরত্বের যথেষ্ট প্রশংসা করিয়া বলিলেন, “আমাদের যুদ্ধক্লেশের অবসান হইবার সময় উপস্থিত হইয়াছে, আর একটু দক্ষতার সহিত কাৰ্য্য করিলেই আমরা ভাবীযুদ্ধ সমুহে জয়যুক্ত হইব। আমাদিগকে বাধা দিবার ভারতবাসীর সমস্ত শক্তি, গত যুদ্ধে নিঃশেষ প্রায় হইয়াছে। এখন ভারতের মহামূল্য দ্রব্যসমূহ সংগ্রহ কওরাই আমাদিগের প্রধান কার্য্যে পরিগণিত হইয়াছে; আমরা এখন যে দেশের দিকে গমন করিতেছি, সেই দেশ চিরপ্রসিদ্ধ ধনরত্নের আধার ভূমি। পারস্যদেশে, যে সকল দ্রব্য দুর্লভ বলিয়া আমরা সংগ্রহ করিয়াছি, সে সকল দ্রব্য এপ্রদেশে সুলভ ও সর্ব্বত্র প্রচুর পরিমাণে প্রাপ্ত হওয়া যাইতেছে। এক্ষণে আমরা মণি, মুক্তা, স্বর্ণ, হস্তীদন্ত প্রভৃতি নানাপ্রকার বহুমূল্য পদার্থের দ্বারা কেবল মাত্র আপন আপন বাসগৃহ সুশোভিত করিব এরূপ নহে, পরন্তু সমস্ত মাসিদন ও গ্রীসভূমি এই সকল ধনরত্নে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিবে।”

 অলিকসন্দরের এই প্রলোভন পূর্ণ কথা শুনিয়া তাঁহার লুণ্ঠনপ্রিয় সৈন্যগণের লুণ্ঠন প্রবৃত্তি প্রবর্দ্ধিত হইল! তাহারা তাঁহার সহিত লুটপাট করিবার জন্য সর্ব্বত্র গমন করিতে প্রস্তুত হইল।

 যুদ্ধে পরাজিত হইলে প্রত্যাগমন পথে পাছে বাধা প্রাপ্ত হন, এই আশঙ্কায় দূরদর্শী অলিকসন্দর, তক্ষশিলার দুর্গে যেরূপ কতকগুলি তাঁহার স্বদেশী সৈন্য রাখিয়াছিলেন, সেইরূপ তিনি এস্থলেও ক্রিতিরসকে দুর্গ নির্ম্মাণ করিয়া অবস্থান করিতে আদেশ প্রদান করেন। নিকটবর্ত্তী পর্ব্বতে জাহাজ নির্ম্মাণোপযোগী প্রচুর পরিমাণে কাষ্ঠ প্রাপ্ত হওয়া যায়। অলিকসন্দর, হিমালয় হইতে প্রকাণ্ডকায় বৃক্ষ সকল কর্ত্তন করিবার জন্য লোক প্রেরণ করেন—গ্রীকগণ প্রকাণ্ডকায় সর্প, অদ্ভুত দর্শন গণ্ডার, প্রভৃতি দেখিয়া আশ্চর্য্যান্বিত হইয়াছিল। এই সকল কাষ্ঠে বহুসংখ্যক সমুদ্র গমনোপযোগী নৌকা প্রস্তুত হইয়াছিল।

 যে সকল সেনা ও সেনানী গতযুদ্ধে বীরত্ব ও রণপাণ্ডিত্য দেখাইয়াছিল, অলিকসন্দর, তাহাদিগের গুণানুসারে কাহাকে সুবর্ণমুকুট ও অর্থ দিয়া সম্মানিত করিয়াছিলেন। মহাবাহুপুরু আরোগ্য লাভ করিলে, অলিকসন্দরের নিকট হইতে, তাঁহার পূর্ব্বরাজ্য ব্যতীত আরো অনেক প্রদেশ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। অভীসারের অধিশ্বর স্বয়ং আগমন না করিয়া কিছু উপহার প্রেরণ করিয়া অলিকসন্দরের বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিলেন। অলিকসন্দর, অভীসার পতিকে তাঁহার কাছে স-শশীরে আগমন করিতে আদেশ করিয়া পাঠান, আদেশপালিত না হইলে, তিনি স্বয়ং গমন করিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন, বলিয়া ভয় দেখান, আমরা জানিনা পার্ব্বতীয় প্রদেশের অধীশ্বর অভীসার, যবন পতি অলিকসন্দরের আজ্ঞা কতদূর প্রতিপালন করিয়া ছিলেন।

 অলিকসন্দর, পুরুর রাজ্যে একমাস কাল অবস্থান করিয়াছিলেন। পুরুর রাজ্যশাসন প্রণালী, প্রজা সকল সমৃদ্ধিসম্পন্ন, এবং সুখে সময় অতিবাহিত করিতেছে, দেখিয়া তাঁহারা মুগ্ধ হইয়াছিলেন। আমাদের শাসনপ্রণালী, যবনদের শাসন প্রণালী অপেক্ষা অনেক অংশে শ্রেষ্ঠ হইলে ও আমরা কিন্তু তাহাদের কাছে “বর্ব্বর” আখ্যায় অভিহিত হইয়াছি।

 পুরুপরাজিত হইলেও, অথবা শত শত ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষা করিবার জন্য প্রাণ পরিত্যাগ করিলেও, পুরুর রাজ্যের পার্শ্ববর্ত্তী রাজন্যবর্গ, অলিকসন্দরের আক্রমণ ভয়ে বিভীষিকাগ্রস্ত হইলেন না। তাঁহারা সকলে আপনার সামর্থ অনুসারে স্বদেশ রক্ষা করিবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলেন। অলিকসন্দর, চন্দ্রভাগা বা চিনাব, গ্রীক কথিত অকিসিনি বা সংস্কৃত অসিকী, পার হইবার পূর্ব্বে এরিষ্টোবোলস কথিত গ্লৌক—অনিকোই, বা তুরময় কথিত গ্লউসাই[] আক্রমণ করিবার জন্য প্রত্যেক সৈন্যদল হইতে কর্ম্মঠ, সাহসী এবং অসাধারণ কার্য্য করিবার জন্য সর্ব্বদা উৎসাহযুক্ত, এরূপ কতকগুলি সৈন্য নির্ব্বাচন করিয়া অগ্রসর হন। এইরূপ নির্ব্বাচিত সৈন্য লইয়া, অলিকসন্দরের স্বয়ং গমন করাতে বোধ হয়, কোন দুর্দ্ধর্ষজাতিকে জয় করিবার জন্য গমন করিয়াছিলেন। কিন্তু গ্রীক গ্রন্থকার বলেন, অধিবাসীরা সর্ব্বত্র বশ্যতা স্বীকার করিয়া আত্মরক্ষা করিয়াছিল। কেহ বলেন, এইরূপে ৩৭টি নগর, অলিকসন্দর অধিকার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। এই সকল নগরের অধিকাংশের জনসংখ্যা দশ হাজারেরও অধিক ছিল। কোন নগরে ৫ হাজারের ন্যূন সংখ্যক অধিবাসী ছিল না। এই সকল নগর ব্যতীত বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রাম ও তাঁহার অধিকার ভুক্ত হইয়াছিল।

 অলিক সন্দর যে সময় ঘোরতর অশান্তির কারণস্বরূপ হইয়া ভারতবাসীকে ব্যতিব্যস্ত করিতেছিলেন; সেই সময় অশ্বকগণ তাঁহার অধীনতা পাশ ছিন্ন ভিন্ন করিয়া, আপনাদিগের স্বাতন্ত্রের পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁহাদের এই স্বাধীনতা সংস্থাপন যজ্ঞে অলিকসন্দরের গ্রীক শাসনকর্ত্তাকে, জীবন আহুতি প্রদান করিতে হইয়াছিল। অলিকসন্দর, শশীগুপ্তের নিকট এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া কিছু সৈন্য প্রেরণ করেন। তাহারা সে প্রদেশে শান্তিস্থাপন করিতে কতদূর সমর্থ হইয়াছিলেন। সে বিষয় আমরা অবগত নহি, সম্ভবতঃ বিদেশীগণের বহিষ্কারের সহিত অশান্তি ও বিদুরিত হইয়া থাকিবে। অলিকসন্দর, এই সময় তক্ষশিলার অধীশ্বরকে স্বীয় রাজধানীতে প্রেরণ করিয়াছিলেন। কি জন্য তিনি এ সময় স্বদেশে প্রেরিত হইয়াছিলেন, তাহার কারণ প্রকাশিত নাই, স্বদেশদ্রোহী আম্ভি, স্বদেশবাসী অশ্বকগণের বিরুদ্ধে কোনরূপ আচরণ করিয়াছিলেন কি না, তাহাও অবগত হইবার উপায় নাই। “বিভাগ করিয়া জয় কর”, ইয়ুরোপীয়েরা এই নীতির উপাসক, আম্ভির সাহায্যে কি মাসিদনপতি, অশ্বকগণকে বিভক্ত করিতে চেষ্টা পাইয়াছিলেন?

 অলিকসন্দর, চন্দ্রাভাগা অভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। ইহার পারে গমন করিতে তাঁহাকে বড় কম ক্লেশ পাইতে হয় নাই। এই বেগবতী নদীর অপর পারে গমনকালে জলমধ্যে নিমজ্জিত প্রস্তরের আঘাতে, অলিকসন্দরের অনেকগুলি নৌকা চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়াছিল, অনেকে জলে ডুবিয়া প্রাণ হারাইয়াছিল। চন্দ্রভাগা, প্রস্তরে আহত হইয়া গভীর গর্জ্জন করিয়া ক্রোধে ফেন উদ্গীরণ করিতে করিতে যেন অলিকসন্দরকে গ্রাস করিবার জন্য অতি দ্রুতবেগে গমন করিতেছিলেন। এই প্রচণ্ডগতি চন্দ্রভাগা, অলিকসন্দরের যেরূপ প্রতিপক্ষতা করিয়াছিলেন, ভারতে সেরূপ আর কোন নদনদী করিতে সমর্থ হয় নাই; এই জন্য গ্রীকগণ ইহাকে আলেক্সান্দ্রোফেগস্ অর্থাৎ অলিকসন্দর-নাশিনী নামে অভিহিত করিয়াছেন। সৈন্যগণ কতকগুলি নৌকা করিয়া, কতকগুলি দৃতি সাহায্যে অপর পারে গমন করিয়াছিল। ল্যাগস পুত্ত্র তুরময় বলেন, অলিকসন্দর যে স্থানে নদী উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন সে স্থানে ইহার বিস্তার ১৫ ষ্টেডিয়া হইবে।

 অলিকসন্দর, চন্দ্রভাগা পার হইয়া মনে করিয়াছিলেন এ প্রদেশের অধিশ্বর পুরু, তাঁহার নিকট আগমন করিয়া বশ্যতা স্বীকার করিবেন, কিন্তু কার্য্যতঃ তাহা হয় নাই। এ পুরু পূর্ব্বোক্ত পুরুর আত্মীয় বলিয়া, গ্রীকেরা বর্ণনা করিয়াছেন। বাহুবলে আপনার রাজ্য রক্ষা করিতে সমর্থ হন নাই বলিয়া, মহাভাগ পুরু, বৈতসবৃত্তি অবলম্বন করিয়া অলিকসন্দরের শরণাপন্ন হন নাই। তিনি বিদেশীর অধীতনায় সুখস্বচ্ছন্দে থাকা অপেক্ষা,বনে, পর্ব্বতে অবস্থান করিয়া আত্মরক্ষা করা শ্রেয়ঙ্কর বিবেচনা করিয়াছিলেন। তাই তিনি নগর পরিত্যাগ করিয়া, আত্মীয় বন্ধুবান্ধবগণ সহ দূরতর দুর্গম প্রদেশে গমন করিয়াছিলেন। বলা বাহুল্য, তাঁহার এ উদাহরণ, তাঁহার প্রজাগণ মধ্যে ও অনুকৃত হইয়াছিল। বাধা প্রদান করিতে না পারিলে ও, তাহারা অলিকসন্দরকে কোনরূপ সাহায্য প্রদান করেন নাই। আক্রান্ত দেশবাসীরা, এরূপ নীতি অবলম্বন করিলে, অনেক সময় আক্রমককে বিপন্ন করা যায়। অভিনব পুরু, এই অভিনব উপায় অবলম্বন করিয়া আত্মমর্য্যাদা রক্ষা করিয়াছিলেন। গ্রীকদের লিখন ভঙ্গীতে বোধ হয়, অলিকসন্দর এ প্রদেশে আহার্য্য দ্রব্য সংগ্রহ করিতে সমর্থ হন নাই। তাই তিনি পুরুর রাজ্যে সৈন্যগণের আহার্য্য সংগ্রহের জন্য লোক প্রেরণ করেন।

 অলিকসন্দর, ভারতবাসীর বাহুবলের পরিচয় ইতিপূর্ব্বে বেশ‍ই প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তাই তিনি ভারতবাসীর সাহায্যে এক্ষণে ভারতবাসীকে পরাজয় করিতে মনস্থ করিলেন। তিনি পুরুকে তাঁহার সমস্ত হস্তী,এবং যতদূর সম্ভব তত অধিকপরিমাণে যোদ্ধা সংগ্রহ করিতে তাঁহার রাজধানীতে প্রেরণ করেন। বনমধ্যে স্বাধীনভাবে বিচরণশীল হস্তীকে পরাধীন করিবার জন্য, যেরূপ মনুষ্য পদতলে বিলুণ্ঠিত হস্তীর সাহায্য গ্রহণ করা হয়, সেইরূপ অলিকসন্দরের পদপ্রান্তে অবনতমস্তক ভারতবাসীর সহায়তায়, স্বাধীন ভারতবাসী পরাধীন হইয়া ছিল। বৈদেশিকগণ যখনই ভারত আক্রমণ করেন, তখন এই সুগম নীতির অনুসরণ করিয়া হস্তীমূর্খ ভারতবাসীকে করতলগত করিয়াছেন।

 অলিকসন্দর, পুরুকে হস্তগত করিবার জন্য দ্রুতবেগে গমন করিতে করিতে ঐরাবতীতটে উপস্থিত হন। গ্রীকদের জিহ্বায় ইহা হাইদ্রোতিস নামে উচ্চারিত হইয়াছিল। অলিকসন্দরকে চন্দ্রভাগা উত্তীর্ণ হইবার সময় যেরূপ বিপন্ন হইতে হইয়াছিল, ইহার পারে গমনকালে সেরূপ কষ্ট পাইতে হয় নাই । দেশের অভ্যন্তরভাগে গমন করিলে, পাছে পশ্চাদভাগে বিপ্লব উপস্থিত হয়, এই আশঙ্কায় স্থানে স্থানে কিছু সৈন্য রাখিয়া, অলিকসন্দর এ প্রদেশ,অধীন পুরুকে প্রদান করেন। অলিকসন্দরের এ উদারতা নিঃস্বার্থভাবে প্রণোদিত হয় নাই। এই সকল বিস্তৃত প্রদেশ একজন বিদেশীর পক্ষে, স্ববশে রাখা বড় সাধারণকথা নহে; তাই তিনি তাঁহার শত্রুকে, পুরুর শত্রুরূপে পরিণত করিয়া, সেই শত্রুকে দমন করিবার জন্য পুরুকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন।

 অলিকসন্দর, ঐরাবতীর পূর্ব্ব পারে গমন করিয়াও বাধা বিহীন হন নাই, নিঃসহায় কোন কোন গ্রামের লোক বশ্যতা স্বীকার করিলেও, অনেকে অলিকসন্দরের আগমন পথে বাধা প্রদান করিয়াছিল। যাহারা বাধা প্রদানে অসমর্থ, অথচ বশ্যতা স্বীকারে অনিচ্ছুক এরূপ লোকসমষ্ঠী, লোকালয় পরিত্যাগ করিয়া দূরতর প্রদেশে গমন করিয়া স্বাধীনতা রক্ষা করে।

 অলিকসন্দর, ঐরাবতীর (রাবী) পরপারে গমন করিয়া শ্রবণ করিলেন যে, এ প্রদেশের সমরপ্রিয় জাতিসকল তাঁহাকে বাধা দিবার জন্য প্রস্তুত হইতেছে। এ সংবাদ অবগত হইয়া অলিকসন্দর আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। তাহারা অপর জাতির সহিত মিলিত হইবার পূর্ব্বেই, তাহাদিগকে আক্রমণ করিবার জন্য বহির্গত হইলেন। রাবীর তট পরিত্যাগ করিয়া দ্বিতীয় দিবসে তিনি অদরইস তাই, বা অরতরিত্তই নামক জাতির রাজধানী পিমপ্রমা নামক স্থানে উপস্থিত হন। এ স্থানের লোকেরা, অলিকসন্দরের অধীনতা স্বীকার করিয়া আত্মরক্ষা করিয়াছিল। এস্থানে একদিন সৈন্যগণ সহ বিশ্রাম করিয়া অলিকসন্দর, সাংগালা অভিমুখে গমন করেন। সাংগলা রক্ষা করিবার জন্য খতিয়ান বীর গণ,অন্যান্য বীরগণের সহিত মিলিত হইয়া, নগরের নিকটবর্ত্তী নাতিউচ্চ ক্ষুদ্র পর্ব্বতে যুদ্ধ করিবার জন্য শিবির সংস্থাপন করিয়া অবস্থান করিতেছিল। শিবিরের সম্মুখে শকটের তিনটাশ্রেণী স্থাপন করিয়া শত্রুর অশ্বারোহীর আগমন পথ রোধ করিয়া রাখিয়াছিল। অলিকসন্দর, ভারতবাসীর অবস্থান দেখিয়া সৈন্যগণকে বিভক্ত করিয়া ভারতবাসীকে আক্রমণ করিতে প্রেরণ করেন। অলিকসন্দর মনে করিয়াছিলেন, তাঁহাকে অগ্রসর হইতে দেখিলে ভারতীয় যোদ্ধাগণ শকটের বহির্ভাগে আগমন করিয়া আক্রমণ করিবে, কিন্তু তাহা না করিয়া খতিয়ান বা ক্ষত্রিয় বীরগণ শকটের উপরিভাগে অবস্থান করিয়া মাসিদনদের আগমন পথে বাধা দিতে আরম্ভ করিল— ক্ষত্রিয়েরা শকট হইতে শকটান্তরে লম্ফ দিয়া গমন করিয়া শত্রুগণের প্রতি শরজাল বর্ষণ করিতে লাগিল। অলিকসন্দর দেখিলেন, অশ্বারোহীদের দ্বারা বিশেষ কিছু কার্য্য হইতেছেনা, এজন্য ঢালীপদাতিকগণকে, ঘোরতর বিক্রমে আক্রমণ করিতে প্রেরণ করেন। গ্রীক গ্রন্থকারেরা বলেন, ক্ষত্রির বীরেরা শকটের প্রথম শ্রেণীর সম্মুখ ভাগ পরিত্যাগ করিয়া, দ্বিতীয় শ্রেণীর সম্মুখ ভাগে অবস্থান করিয়া শত্রুগণকে আক্রমণ করেন। ইহাতে মাসিদনগণের পক্ষে অত্যন্ত অসুবিধা হইয়াছিল। ভারতীয়বীরেরা ঘোরতর পরাক্রমে শত্রুগণের প্রতি অজস্র অস্ত্রপাত করিতে লাগিল। মাসিদনগণ কোন উপায় দেখিতে না পাইয়া সম্মুখের শকট সকল টানিয়া দূরে নিক্ষেপ করিয়া ক্ষত্রিয়গণকে ঘোরতররূপে আক্রমণ করেন। অলিকসন্দরের স্বদেশবাসী গ্রন্থকারেরা বলেন, ভারতীয় যোদ্ধারা এ স্থানে অবস্থান না করিয়া নগর মধ্যে প্রবেশ করিয়া দ্বাররোধ করিয়াছিল। অলিকসন্দর সেই দিনেই নগর প্রাচীরের সম্মুখে শিবির সংস্থাপন করিয়া যতদূর পারিলেন, ততদূর নগর প্রাচীর অবরোধ করিলেন। এই নগরের অনতিদূরে একটি হ্রদ ছিল, পাছে শত্রুগণ তাহা অতিক্রমণ করিয়া পলায়ন করে, এজন্য তাহার চতুঃপার্শ্বে রাত্রিকালে অশ্বারোহী প্রহরী সকল রক্ষিত হইল। নগর বা দুর্গ মধ্যে অবরুদ্ধ হইয়া থাকা, আর শত্রুহস্তে বন্দী হইয়া থাকা, উভয়ই প্রায় সমতুল্য! এরূপ অবস্থায় অনেক সময় শত্রু ও দুর্ভিক্ষ উভয়েরই সম্মুখীন হইতে হয়। আর এক কথা যে সকল যোদ্ধা অবরুদ্ধ হইয়া অকর্ম্মণ্যের ন্যায় সময় অতিবাহিত করে, তাহারা দুর্গের বহির্ভাগে থাকিতে পাইলে শত্রুর যথেষ্ট প্রতিকুলাচরণ করিতে সমর্থ হন। এই ভাবিয়া ভারতীয় যোদ্ধাগণ, দুর্গ মধ্যে বন্দীরন্যায় অবস্থান না করিয়া রাত্রিকালে স্থান পরিত্যাগ করিতে মনন করেন। নিশীথ রাত্রে যখন চতুর্দ্দিক নিস্তব্ধ ভাব ধারণ করিল, সেই সময় ভারতীয়েরা হ্রদ অতিক্রমণ করিয়া গমন করে। ভারতীয়েরা পাছে পলায়ন করে, এই আশঙ্কায় অলিকসন্দর, সৈন্য ও সেনানীগণকে সতর্ক করিয়া রাখিয়াছিলেন। ক্ষত্রিয় যোদ্ধাগণকে আগমন করিতে দেখিয়া বংশীধ্বনি করিয়া মাসিদনগণ তাহাদিগকে ঘোরতর বিক্রমে আক্রমণ করিল। এই ঘোরা রজনীতে দারুণ যুদ্ধের অভিনয় হইল, নগর ত্যাগ করিয়া যাওয়া সুবিধা জনক নহে বলিয়া আবার সকলে প্রত্যাগমন করিল।

 রাত্রির অবসানের সহিত, অলিকসন্দর ঘোরতর পরাক্রমে নগর আক্রমণ করিলেন। অলিকসন্দরের সৌভাগ্যবশতঃ তাঁহার সাহায্যের জন্য পুরু এই সময় স্বীয় হস্তী বাহিনী ও ৫ হাজার ভারতীয় যোদ্ধা সহ আগমন করেন। হায়! যে হস্ত ইতি পূর্ব্বে স্বদেশবাসীকে বিদেশীর অত্যাচার হইতে রক্ষা করিবার জন্য অস্ত্রধারণ করিয়াছিল, যে ব্যক্তি ইতিপূর্ব্বে আপনার শরীর হইতে উত্তপ্ত শোণিতধারা প্রদান করিয়া, জন্মভূমির যবন পদ স্পর্শ জনিত কলঙ্ক ধৌত করিয়াছিলেন, আজ তিনি যবন সম্রাট অলিকসন্দরের তুষ্টির জন্য স্বদেশবাসীর কোমল হৃদয়ে তীক্ষ্ণ অস্ত্র বিদ্ধ করিতে হস্তোত্তলন করিলেন;—হায়! আজ সেই ব্যক্তি নশ্বর জাগতিক উন্নতি লাভের জন্য, পবিত্র জন্মভূমিকে অধীনতা পাশে আবদ্ধ করিবার জন্য, সকলের অগ্রবর্ত্তী হইলেন। বৈদেশিক শত্রুর হস্তে আপতিত বন্দীর, কোন রূপেই স্বদেশের বিরুদ্ধাচরণ করা ন্যায়ানুমোদিত হইতে পারেনা। আর স্বদেশের বিরুদ্ধাচরণ না করিলে, কখনই কোন রূপে সে, বিজেতার কাছে দণ্ডণীয় হইতে পারেনা। পুরু যদি তটস্থ ভাব অবলম্বন করিতেন, তাহা হইলে তিনি স্বদেশবাসী অথবা বিদেশবাসী উভয়েরই কাছে প্রশংসনীয় হইতেন তাহাতে সন্দেহ নাই।

 অলিকসন্দর, ইষ্টক প্রাচীরের নিম্নদেশ খনন করিয়া প্রাচীর ভাঙ্গিয়া ফেলিবার উপক্রম করিলেন, কোন স্থানে প্রাচীর উল্লঙ্ঘন করিয়া নগর মধ্যে গমন করিবার চেষ্টা করিতে লগিলেন। এইরূপে নগর মধ্যে গমন করিলে, উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধের প্রারম্ভ হইল। এই দারুণ সংগ্রামে, ভারতবাসীরা প্রাণের মমতা পরিত্যাগ করিয়া, স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য, যেরূপ কালান্তক কৃতান্তের ন্যায় প্রচণ্ড বিক্রমে যুদ্ধ করিয়াছিলেন—অকাতরে তাঁহারা যেরূপ এই পবিত্র যুদ্ধযজ্ঞে প্রাণ উৎসর্গ করিয়াছিলেন, তাহা চিরকাল বিস্ময়ের সহিত পঠিত হইবে। বিদেশী লেখকেরা, হিন্দুবীরগণের অলৌকিক অবদান পরম্পরার কথা, বড় লিপিবদ্ধ করেন নাই; কিন্তু তাঁহারা, অলিকসন্দরের সৈন্যগণ মধ্যে যেরূপ শোণিত স্রোত প্রবাহিত করিয়াছিলেন, অলিকসন্দরের ক্রোধ বহ্ণিকে যেরূপ ভাবে সন্ধুক্ষিত করিয়াছিলেন, তাহাতে তাঁহাদের অধ্যবসায়, দৃঢ়তা, এবং স্বদেশ রক্ষার জন্য প্রাণপাতে অকাতরতা, প্রভৃতি অনুমান করা যাইতে পারে। এই অল্পকালস্থায়ী ভয়ঙ্কর যুদ্ধে, অলিকসন্দরের পক্ষে, এরিয়ন বলেন, একহাজার দুইশত ব্যক্তি আহত হইয়াছিল! এই আহত সংখ্যার মধ্যে প্রধান প্রধান সেনানীরা ও অন্তর্গত ছিলেন আর একশত মাসিদন যোদ্ধা নিহত হইয়াছিল। ইয়ুরোপীয় ঐতিহাসিক মহাশয়েরা এই সংখ্যা প্রদান কালে কতদূর সত্যপথ অনুসরণ করিয়াছিলেন, তাহা আমরা অবগত নহি, কিন্তু তাঁহারা অনেক সময়, স্বদেশবাসীর বাহুবলের উৎকর্ষ দেখাইবার জন্য, সত্য কথা সংগোপন করিতে সঙ্কোচ বোধ করেন নাই এ কথা আমরা অবগত আছি। পাঠক! এই এরিয়ান, আমাদের ভারতবাসীর কথা কিরূপ মুক্ত হস্তে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন তাহাও জানিবার বিষয়, তিনি বলেন, ১৭হাজার হিন্দু নির্দদয়তাসহকারে নিহত হইয়াছিল, আর ৭০ হাজার বন্দী হইয়াছিল। ইহার সহিত ৫ শত অশ্বারোহী, ৩ শত শকট অলিকসন্দরের হস্তে পতিত হইয়াছিল। কুর্ত্তিয়স্ তাঁহার গ্রন্থে এক স্থলে লিখিয়াছেন যে, শত্রুপক্ষে ৮ সহস্র ব্যক্তি নষ্ট হইয়াছিল। ইহার মধ্যে কাহার কথা ঠিক তাহা আমাদের জানিবার আবশ্যক নাই। কিন্তু একথা খুব ঠিক যে, এ পর্য্যন্ত অলিকসন্দরের এত অধিক সংখক্য সৈন্য এরূপ ভাবে কোথাও নিগৃহীত হয় নাই; এই হতাহতের ফল দেখিয়া আমরা অনুমান করিতে পারি, যথার্থ ক্ষত্রিয়দিগের হস্তে, অলিকসন্দর উত্তম শিক্ষাই প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। গ্রীকরা যেরূপ ভাবে এই যুদ্ধের কথা বর্ণনা করিয়াছেন, তাহাতে কোন রাজা কর্ত্তৃক এই সকল ক্ষত্রিয়গণ পরিচালিত হইয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয় না। ধনবানেরা অনেক সময় আপনাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য, সাধারণের স্বার্থের দিকে দৃকৃপাত না করিয়া, নিজের সুখ স্বচ্ছন্দতা রক্ষা করিবার জন্য, ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়েন;এই জন্য প্রায়ই তাঁহারা ঘৃণিতভাবে বৈদেশিক দিগের চরণতলে আপতিত হইয়া স্বদেশবাসীর শত্রুতা সাধন করিয়া থাকেন।

 অলিকসন্দর সাংগালা অধিকার করিয়া, তাঁহার অন্যতম কর্ম্মচারী ইউমিনিস্ সহ তিনশত অশ্বারোহী প্রদান করিয়া, যে সকল ভারতবাসী সাংগলার সহিত মিলিত হইয়া তাঁহার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইয়াছিল; তাহাদিগকে সাংগলার অদৃষ্ট কথা জানাইবার জন্য প্রেরণ করেন; দুঃখের বিষয়, তাঁহারা স্বদেশবাসীর শোচনীয় পরিণাম অবগত হইয়া, দেশত্যাগ বা প্রাণত্যাগ এই উভয়ের জন্য প্রস্তুত হইয়াও, তাঁহার বশ্যতা স্বীকার করিতে প্রস্তুত হইল না। অলিকসন্দর, ভারতবাসীর সঙ্কল্প অবগত হইয়া আর ক্ষণ বিলম্ব করিলেন না। তাহাদিগকে হস্তগত করিবার জন্য তিনি দ্রুতবেগে গমন করিলেন। অলিকসন্দেরের আগমনের পূর্ব্বেই ভারতবাসীরা, দূরতর প্রদেশে গমন করিয়া স্বাধীনতা রক্ষা করেন। যে সকল হতভাগা ভারতবাসী, মানবজাতির এই দারুণ শত্রুর হস্তে পতিত হইল,তাহারা নির্দ্দয়তাসহকারে নিহত হইয়াছিল, ইহাদের সংখ্যা পঞ্চশতের কম হইবেনা। অলিকসন্দর যখন যুঝিলেন,এরূপ ভাবে অনুসরণ করিলে কোন শুভফল প্রসব করিবে না, তখন তিনি অগত্যা সাংগলাতে প্রত্যাগমন করিতে বাধ্য হইলেন।

 অলিকসন্দর যখন ভারতবাসীর বড় কিছু করিতে পারিলেন না; তখন তাঁহার ক্রোধ, জনশূন্য সাংগলার উপর পতিত হইল। সাংগালার অধিবাসীর হস্তে লাঞ্ছিত মাসিদনগণ, সাংগলার ঘর বাড়ি চুর্ণ বিচূর্ণ করিয়া ফেলিল—তথায় মনুয্যের বাসভূমি ছিল বলিয়া কোনচিহ্ণ রহিল না। অলিকসন্দর তাঁহার রোষানলে দগ্ধ এই ভূমিকে, যে ভারতবাসী স্বেচ্ছাপূর্ব্বক তাঁহার পদতলে পতিত হইয়াছিল, সেইরূপ এপ্রদেশের কোন লোককে, ইহা প্রদান করিয়া তাহার সম্মান বৃদ্ধি করিয়াছিলেন।

 যে কয়েকটি নগর আত্মপ্রদান করিয়া অলিকসন্দরের কৃপালাভ করিয়াছিল, সে সকল নগর অধিকার এবং তাহাতে সৈন্য রক্ষা করিবার জন্য,বুদ্ধিমান মেসিদনপতি সসৈন্য পুরুকে প্রেরণ করেন। অলিকসন্দর বুঝিয়াছিলেন যে, দেশের যেরূপ অবস্থা তাহাতে মাসিদন সৈন্য, সে সকল স্থানে প্রেরণ করিলে তিনি দুর্ব্বল হইয়া পড়িবেন, আর বহুসংখ্যক ভারতবাসী কর্ত্তৃক তাহারা আক্রান্ত হইলে আত্মরক্ষা করা তাহাদের পক্ষে সামান্য বিষয় হইবেনা। এই জন্য দুরদর্শী অলিকসন্দর, পুরুকে সেই সকল স্থানে প্রেরণ করিয়া “যা শত্রু পরে পরে” নীতির অনুসরণ করিয়াছিলেন।

 অলিকসন্দর, সাংগালা পরিত্যাগ করিয়া, তাঁহার রণতৃষ্ণা পরিতৃপ্ত করিবার জন্য, আবার পূর্ব্বাভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। এইরূপ কয়েকদিন গমন করিয়া, তাঁহারা হাইপাসিস নদীর তটভূমে উপস্থিত হন। একমাত্র এই বিদেশী নামে নদী নির্ণয় করা বড়ই সুকঠিন, ইহা অন্য কোন নদী নহে ইহা আমাদের বিপাশা, পুত্ত্রশোকাভিভূত মহর্ষি বশিষ্ঠ, হস্ত পদ পাশবদ্ধ করিয়া উরুঞ্জিরা নদীতে নিমগ্ন হইলে, তিনি নদীর স্রোতে পাশছিন্ন হইয়া তটে নিক্ষিপ্ত হন, তদবিধি উরুঞ্জিরা পূর্ব্বনাম পরিত্যাগ বিপাশা নামে অভিহিত হন।[]

 বিপাশা বা বর্ত্তমান ব্যাসানদীর তটে মহাবাহু অলিকসন্দর শিবির সংস্থাপন করিয়া অবস্থান করিলেন।

এস্থানে অবস্থান করিয়া মসিদনগণ অপর পারের কথা যাহা শুনিলেন, তাহাতে তাঁহাদের দিগ্বিজয় বাসনা অন্তর্হিত হইল,—ভারতের অমূল্যধন রত্ন সংগ্রহকামনার পরিবর্ত্তে, স্বদেশে প্রত্যাগমনের উৎকট ইচ্ছা, তাহাদিগকে আকুলিত করিতে লাগিল। তাহারা শুনিল বিপাশার অপর পার অত্যন্ত উর্ব্বর, তথাকার জনগণ কৃষিকার্য্যে যেরূপ সুনিপুণ, যুদ্ধস্থলেও সেইরূপ রণপাণ্ডিত্য ও সাহসিকতা দেখাইয়া থাকে। তাহাদের রাজ্যশাসন প্রণালী অতি সুচারুরূপে নির্ব্বাহ হইয়া থাকে। ন্যায় ও মৃদুতার সহিত সম্ভ্রান্ত জনগণ, জনসাধারণকে শাসন করিয়া থাকেন। অন্যান্য রাজ্য অপেক্ষা এ রাজ্যের হস্তীবল অনেক বেশী, এসকল হস্তী অত্যন্ত দীর্ঘকায় এবং সাহসী, তার পর গাঙ্গেয় প্রদেশ, সে দেশের অধীশ্বর, যুদ্ধক্ষেত্রে ২লক্ষ পদাতিক, ২০ হাজার অশ্বারোহী এবং ৩হাজার হস্তী, লইয়া যাইতে সমর্থ। পুরুর হস্তীর কাছে ইতিপূর্ব্বে তাহাদের যে শোচনীয় দশা হইয়াছিল সেই সকল কথা মাসিদনদের স্মরণ পথে উদিত হইল। অপর পারে পূর্ব্ব অপেক্ষা অধিক সংখ্যক বীর্য্যবান হস্তী তাঁহাদের অভ্যর্থনার জন্য অপেক্ষা করিতেছে, পুরুর মুখে এ কথা শুনিয়া, মাসিদনবাসীর হৃৎকম্প উপস্থিত হইল। গ্রীক গ্রন্থকার ইঙ্গিতে বলিয়াছেন, “অপর পারের অধিবাসীরা, সুচারুরূপে সুশাসিত হইতেছে”। সুতরাং অলিকসন্দর, অগ্রসর না হইলেও দোষভাগী হইতে পারেন না, যেহেতু ইয়ুরোপীয় মহাশয়েরা, কোন রাজ্যঅধিকার ভুক্ত করিবার জন্য, কোন অছিল না পাইলে, তাঁহাদের রাজ্য অপেক্ষা সুশাসিত হইলেও, রাজ্যশাসন ভাল হইতেছে না, এইরূপ দোষারোপ করিয়া পররাজ্য আক্রমণ করিয়া থাকেন। সেই জন্য এরিয়ান লিখিয়াছেন, “অপর পার সুশাসিত হইতেছে,” সুতরাং অলিকসন্দরের অপর পারে গমন করিবার প্রয়োজন হয় নাই। যাই হউক,অলিকসন্দর যখন শুনিলেন, তাঁহার সেনানীগণ তাঁহার সহিত অপর পারে গমন করিতে সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক, তখন তিনি তাঁহাদিগকে সমবেত করিয়া বলিয়াছিলেন যে, “হে মাসিদন ও বন্ধুগণ! আপনাদের স্বভাব সুলভ উৎসাহের সহিত, আর কি আপনারা আমাকে বিপদ মধ্যে অনুসরণ করিবেন না। অগ্রে গমন করিবার জন্য, আপনারা আমা কর্ত্তৃক অনুরুদ্ধ হইবেন, অথবা প্রত্যাগমনের জন্য আমি আপনাদের দ্বারা অনুরুদ্ধ হইব, ইহার জন্যই এই সভা আহুত হইয়াছে। আপনারা যে সকল শ্রমসাধ্য কার্য্য করিয়াছেন, তাহার বিরুদ্ধে,অথবা আমার নায়কত্বের বিরুদ্ধে, যদি কোন অভিযোগ থাকে, তাহা হইলে আমার সে বিষয় কিছুই বলিবার নাই। আপনাদের সেই অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের ফলে, যোনদেশ—হেলিসপণ্ট—ফাইগিয়াদ্বয়, ক্যাপাডোসিয়া, প্যাফলাগোনিয়া, লিডিয়া, কেরিয়া, লাইকিয়া, প্যামফিলিয়া,ফিনিসিয়া, ইজিপ্ট,লাইবিয়া, আরবের কিয়দংশ, সিরিয়া, মোসোপাটামিয়া; ব্যাবিলন, সুসা, পারস্য ও মিডিয়া, ইহাদের অধীন এবং ইহারা যাহা অধিকার করিতে পারে নাই, এরূপ প্রদেশ সকল ও আমরা পদাক্রান্ত কারিয়াছি, ইহা ব্যতীত কাষ্পীয়নঘাটি, কাষ্পীয়নের তটবর্ত্তী ভূভাগ, বহ্লীক, ককেসস প্রদেশ, এবং ভারতের সিন্ধু, বিতস্তা, চন্দ্রভাগা, বিপাশা, প্রভৃতি নদনদীর মধ্যবর্ত্তী রাজ্য সকল এখন আমাদের অধিকারভুক্ত হইয়াছে। এই বিপাশা অতিক্রমণ এবং ঐ সম্মুখবর্তী রাজ্য সকল মেসিদুদিয়া সাম্রাজ্যের অন্তর্গত করিতে কেন তোমরা ইতস্ততঃ করিতেছ? বর্ব্বররা তোমাদিগকে বাধা প্রদান করিতে সমর্থ হইবে, এই ভয়ে কি তোমরা বিভীষিকাগ্রস্ত হইয়াছ? ইহাদিগকে আপনারা পরাজিত, দেশচ্যুত, এবং অধীনতাপাশে আবদ্ধ করিয়াছেন, কেহ বা স্বেচ্ছাপূর্ব্বক শরণাপন্ন হইয়াছে। এই সকল দেশ, আমাদের ইচ্ছা অনুসারে আমাদের বন্ধুগণমধ্যে, অথবা স্বয়ং প্রবৃত্ত হইয়া যাহারা আমাদেরসহিত মিলিত হইয়াছে, তাহাদিগের মধ্যে প্রদত্ত হইবে। আমার ধারণা, উৎসাহশীল পুরুষের অধ্যবসায় ও পরিশ্রম; যশস্কর কার্য্য সম্পাদনের দিকেই লক্ষ্য করিয়া থাকে। যদি কেহ জানিতে ইচ্ছা করেন, এই যুদ্ধ, কোথায় শেষপ্রাপ্ত হইবে, তাঁহার জানা উচিৎ যে, গঙ্গা এবং পূর্ব্ব সমুদ্র, এস্থান হইতে বড় বেশী দূর নহে, আর আমার দৃঢ় ধারণা যে, সমুদ্রের সহিত হাইরকানিয়ান সমুদ্র মিলিত হইয়াছে পৃথিবীর চতুর্দ্দিকে সমুদ্র প্রবাহিত হইতেছে। ইহা ব্যতীত মাসিদন ও তাহাদের বন্ধুগণের কাছে আমি সপ্রমাণ করিব যে, ভারত উপসাগর হাইরকানিয়ন সমুদ্র ও পারস্য ও উপসাগরের সহিত মিলিত রহিয়াছে। পারস্য উপসাগর হইতে আমাদের অর্ণবযান সকল আফ্রিকা প্রদক্ষিণ করিয়া, হারকুলিসের স্তম্ভের কাছে উপস্থিত হইবে। এরূপ করিলে আফ্রিকার অভ্যন্তরভাগ এবং সমস্ত এশিয়া আমাদের অধিকারভুক্ত হইবে। দেবতারা পৃথিবীর যে সীমানির্দ্দেশ করিয়াছেন, সেই সীমাই আমাদের সম্রাজ্যের সীমা বলিয়া পরিগণিত হইবে। এ সময় যদি আমরা প্রত্যাবর্ত্তন করি, তাহা হইলে বিপাশা ও সমুদ্রের মধ্যবর্ত্তী ভুভাগের অধিবাসীবৃন্দ, আর উত্তরে হিরকানিয়া প্রদেশের জনগণ, অপরাজিত অবস্থায় রহিয়া যাইবে। আর এক কথা, এ সময় যদি আমরা প্রত্যাগমন করি, তাহা হইলে যাহাদিগকে আমরা জয় করিয়াছি, যাহাদের বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে সন্দেহ হইয়া থাকে; তাহাদিগকে স্বাধীন জাতিরা বিদ্রোহের জন্য উত্তেজিত করিতে পারে। তাহা হইলে আমাদের সমস্ত শ্রম বিফল হইয়া যাইবে—আমাদিগকে আবার নূতন বিপদ ও অভিনব পরিশ্রমের সম্মুখীন হইতে হইবে। হে বন্ধুগণ! এবং মেসিদনবাসী! আপনারা ধৈর্য্য অবলম্বন করুন,—যাঁহারা বিপদ ও শ্রমসাধ্য কার্য্য সম্পাদনের জন্য অগ্রবর্ত্তী হন, তাঁহারা ঋদ্ধি ও সিদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়া সুখ্যাতি লাভ করিয়া থাকেন। যে জীবনে অদ্ভুত কার্য্য সম্পন্ন হইয়াছে, সেই জীবনই আনন্দময়, তাহার মৃত্যুতে ও সুখ অনুভূত হইয়া থাকে; আর পশ্চাতে চিরস্মরণীয় নাম থাকিয়া যায়। আপনারা তো জানেন আমাদের পূর্ব্বজগণ যে অলোক সামান্য খ্যাতি এবং দেবত্বকে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তাহা কিছু আরগস,—ফিলপনিস, অথবা থেবে, গৃহে অবস্থান করিয়া প্রাপ্ত হন নাই। হিরাক্লিসের অপেক্ষা ক্ষমতাশালী, দিত্তনিসিস্‌কেও বড় কম পরিশ্রম করিতে হয়নাই। তপস্যা না করিয়া কেকোথায় দেবত্বকে প্রাপ্ত হইয়াছে? আমরা নিসা অতিক্রম করিয়া বহুদূর অগ্রসর হইয়াছি—মহাবীর হিরাক্লিস যে দুর্গম দুর্গ অধিকার করিতে সমর্থ হন নাই, আমরা সেই অরনসের গিরিদুর্গ অধিকারভুক্ত করিয়াছি। এখন অবশিষ্ট এসিয়া আমাদের পদানত হইবে,—অধিকাংশের সহিত অবশিষ্ট অল্পটুকু মিলিত হইবে।”

 “একবার ভাবিয়া দেখুন যদি আমরা মাসিদনে বসিয়া থাকিতাম, তাহা হইলে কি এই সকল স্মরণীয় কার্য্য সম্পন্ন করিতে সমর্থ হইতাম? বেশী কিছু করিলে, আমরা কি মনে করিতাম না যে, পার্শ্ববর্তী থ্রেসস্, ইলিরিয়াবাশী, অথবা শত্রুভাবাপন্ন গ্রীক আক্রমণ হইতে স্বদেশকে রক্ষা করিলেই, আমাদের কার্য্য সকল সম্পূর্ণ হইয়াছে?

 “আপনাদিগকে বিপদসঙ্কুল স্থানে পরিচালনা করিবার সময় আমি কি সেই বিপদ, বা শ্রমজনক কার্য্য হইতে, বিমুখ হইয়া আপনাদিগকে কি তাহার সম্মুখীন করিয়াছি? যদি তাহাই হইয়া থাকে, তাহা হইলে বটে নূতন কার্য্যে আপনাদিগের উৎসাহ না থাকিবারই কথা। আপনারা পরিশ্রম করিবেন, আর অপরে বিনাপরিশ্রমে তাহার ফলভোগ করিবে? আমরা কিন্তু সকলে সমানভাবে পরিশ্রম করিয়া থাকি, আমি সমানভাবে আপনাদের বিপদের অংশ গ্রহণ করিয়া থাকি—ইহার ফল, সকলের সাধারণ সম্পত্তি, যে ভূমি আমরা জয় করিয়াছি, আপনারা তাহার অধিশ্বর; যে ধন আমরা লুণ্ঠন করিয়াছি, তাহার অধিক অংশই আপনাদিগের মধ্যে বিতরিত হইয়াছে। যখন সমগ্র এশিয়া আমাদিগের অধিকারভুক্ত হইবে, তখন ভগবানের কৃপায় আমি আপনাদিগকে কেবলমাত্র সন্তুষ্ট করিব না, কিন্তু আপনাদিগের প্রত্যেকের, আশার অতিরিক্ত দ্রব্য প্রদান করিয়া পুলকিত করিব। আপনাদিগের মধ্যে যিনি, দেশে প্রত্যাগমন করিতে ইচ্ছা করেন, তাঁহাদিগকে আমি দেশে পাঠাইয়া দিব, অথবা আমিই তাঁহাদিগকে সঙ্গে করিয়া দেশে লইয়া যাইব। কিন্তু যাঁহারা এস্থানে অবস্থান করিবেন, তাঁহাদিগকে আমি, যাঁহারা গমন করিবেন, তাঁহাদের স্পৃহনীয় বিষয়ে পরিণত করিব।”

 অলিকসন্দরের এই উদ্দীপনা পূর্ণ অনুরোধ বাক্যে, অবসন্ন হৃদয় সেনানীদের মধ্যে কোন প্রকার উত্তেজনা পরিলক্ষিত হইল না। এক সময় অলিকসন্দরের সামান্য ইঙ্গিতে, যে সৈন্যগণ দলে দলে প্রাণ প্রদানের জন্য অগ্রসর হইত; এক্ষণে তাহারা নির্ব্বাক হইয়া অধোবদনে অবস্থান করিতে লাগিল। বহু সময় অতীত হইলেও, যখন কেহ অলিকসন্দর কর্ত্তৃক অনুরুদ্ধ হইয়া কোন কথা কহিল না, তখন বৃদ্ধ সেনানী কৈনস, সাহসে বুক বাঁধিয়া বলিতে আরম্ভ করিলেন।

 “হে রাজন্! আপনি যখন মাসিদনগণকে তাহাদের ইচ্ছার প্রতিকূলে, অগ্রে বলপূর্ব্বক লইয়া যাইতে অনিচ্ছুক, আপনি যখন তাহাদের অনুরোধ রক্ষা করিতে স্বীকৃত হইয়াছেন, এরূপ অবস্থায়ায় আমি দুই একটি কথা বলিব,—এ কথা আমি আমার পক্ষ হইতে, অথবা যে সকল সেনানী এস্থানে উপস্থিত হইয়াছেন, তাঁহাদের হইয়াও কথিত হইবেন না— আমরা, আপনার কাছে বিশেষরূপে সম্মানিত হইয়াছি, আমাদের মধ্যে অনেকেই আপনার কাছে প্রচুর পরিমাণে পুরষ্কৃত হইয়াছেন। অপরের উপর প্রভুত্ব করিবার ক্ষমতা, আপনার কাছে আমরা যথেষ্টরূপে প্রাপ্ত হইয়াছি, আমরা যে, আপনার কার্য্য সাধনের জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করিব, ইহা কিছু বিচিত্র নহে। কিন্তু অধিকাংশ সৈনিকগণের পক্ষ হইয়া কয়েকটি কথা কহিব, এ সকল কথা যে, একমাত্র তাহাদের পক্ষেই হিতজনক, এরূপ আমি মনে করিনা, বর্ত্তমান কালে আমি মনে করি, ইহা আপনার পক্ষেও সুবিধাজনক এবং ভবিষ্যতে ও মঙ্গলপ্রদ হইবে।

 “আমার প্রাচীন বয়সের জন্য, আপনি আমাকে যে প্রচুরক্ষমতা প্রদান করিয়াছেন সেইজন্য, আর সকলপ্রকার বিপদজনককার্য্যে সকলের অগ্রবর্ত্তী হই বলিয়া, যাহা ভাল বুঝিয়াছি তাহা বলিতে আমি সাহসী হইয়াছি। আপনার আজ্ঞায়, আমরা যে সকল কার্য্য সম্পাদন করিয়াছি, তাহা আমি যতই স্মরণ করি, আর আমরা সর্ব্ব সর্ব্বপ্রথমে মাসিদন ও গ্রীস হইতে যতগুলি লোক আগমন করিয়াছিলাম, এবং বর্ত্তমানেই বা আমাদের সংখ্যা কিরূপ পরিমাণে হ্রাসপ্রাপ্ত হইয়াছে, সে সকল বিষয় যখন আমি তুলনা করি, তখন মনে হয় যে, আমাদের বিপদের এবং ক্লেশের একটা সীমা নির্দ্ধারিত হওয়া উচিত। থেসেলিবাসীরা যখন আর সাহসীকতার সহিত যুদ্ধ করিত না, তখন আপনি ব্যাক্ত্রিয়া হইতে তাহাদিগকে দেশে পাঠাইয়া বিজ্ঞের ন্যায় কার্য্য করিয়াছিলেন। আপমি যে সকল নগর প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন, তাহাতেও অনেক গ্রীকবাসীকে, তাহাদের অনিচ্ছায় রাখিয়া আসিয়াছেন। আর অবশিষ্ট কতকগুলি, বর্ত্তমান কালে ও আমাদের ক্লেশের অংশ গ্রহণ করিতেছে; আমাদের কতকগুলি স্বদেশবাসী যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাণ ত্যাগ করিয়াছে; কতকগুলি আহত হইয়া অকর্ম্মণ্য হইয়াছে; কতকগুলি আমাদের বিজিত দেশের স্থানে স্থানে রক্ষিত হইয়াছে; আর কতকগুলি রোগে মৃত্যু মুখে পতিত হইয়াছে; সেই বহু লোক সমষ্ঠির মধ্যে, আমরা অতি অল্পসংখ্যক মাত্র জীবিত রহিয়াছি। ইহাদের শরীরে আর পূর্ব্বের ন্যায় শক্তিসামর্থ নাই;—ইহাদের উৎসাহ যেন ক্ষীণ হইয়া আসিতেছে; যাহাদের পিতামাতা এখনও জীবিত আছেন, তাঁহাদিগকে দেখিবার জন্য তাহারা উৎসুক হইয়াছে,—সকলেই তাহাদিগের স্ত্রী,পুত্র,বাড়ি ও জন্মভূমি, দেখিবার জন্য অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইয়াছে। যাহারা আপনার কৃপায়, দরিদ্র হইতে প্রচুর ধনের অধীশ্বর হইয়াছে, অতি সামান্য অবস্থা হইতে প্রখ্যাত নামা হইয়াছে, তাহাদের বর্ত্তমান অভিলাষ ক্ষমার যোগ্য সন্দেহ নাই। আপনি তাহাদিগকে, ইচ্ছার প্রতিকূলে লইয়া যাইবেন না। শত্রুর সহিত যুদ্ধকালে, বিপদের সম্মুখীন হইবার সময়, ইহারা যদি পূর্ণ হৃদয়ে কার্য্য না করে, তাহা হইলে তাহাদের দ্বারা কোন কার্য্য সাধিত হইবেনা। আমাদের সহিত যদি আপনারমতের মিলন হয়, তাহা হইলে আপনি গৃহে প্রত্যাগমন করুন; মাকে দর্শন করুন; গ্রীসের রাজকার্য্যের সুব্যবস্থা করুন, এবং পিতার গৃহ, জয়লব্ধ দ্রব্যে পরিপূর্ণ করুন। এ সকল কার্য্য সমাধার পর, যদি ইচ্ছা হয়, পুনরায় আপনি নূতন বলে ভারতের ঐ পূর্ব্বদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করুন, অথবা ইউক্সইন সাগর, কিম্বা কার্থেজের বিরুদ্ধে, অথবা আফ্রিকা, কিম্বা কার্থেজের পরে যে দেশ, সে দেশের বিরুদ্ধে যাত্রা করুন। আপনি কর্ত্তব্য স্থির করিলে, আমাদের ন্যায় শীর্ণ বৃদ্ধের পরিবর্ত্তে, তেজস্বীও যুবক মাসিদন এবং গ্রীকবাসী আপনার সহিত অনুগমন করিবে। যুদ্ধ বিষয়ে অনভিজ্ঞ সেই সকল যুবকবৃন্দ, প্রাণের মমতা না করিয়া, পুরষ্কার লোভে প্রলুব্ধ হইয়া বিপদের সম্মুখীন হইবে, তাহারা যখন দেখিবে, আপনার সহচরবৃন্দ নির্ধনতার পরিবর্ত্তে প্রচুর ধনশালী, উচ্চপদস্থ, ও প্রখ্যাত নামা হইয়া নানাপ্রকার বিপদ ও ক্লেশ জাল অতিক্রমণ করিয়া নির্ব্বিঘ্নে গৃহে প্রত্যাগমন করিয়াছে, তখন তাহারা অধিকতর উৎসাহের সহিত বিপদের সম্মুখীন হইবে। হে রাজন! এসকল কথা ব্যতীত, অভ্যূদয়ের সময় সমতা অবলম্বনের ন্যায় উৎকৃষ্ট নীতি আর কিছুই নাই, আপনি এরূপ সাহসী সৈন্যের মধ্যবর্ত্তী থাকিলে, মানবীয় শত্রু আপনার কোন অপকার করিতে সমর্থ হইবেনা। কিন্তু দৈবঘটনা মনুষ্য বুদ্ধির অগম্য, সুতরাং তাহা হইতে রক্ষা পাওয়া মানুষের সাধ্যের অতীত বিষয় সন্দেহ নাই।”

 কৈনসের, মনের মতন কথা শুনিয়া, অনেকে আনন্দের উচ্ছাস প্রকাশ করিয়া তাঁহাকে অনুমোদন করিল, অপরে গৃহে প্রত্যাগমনের কথায় দরদরিত ধারায় অশ্রুবারি প্রবাহিত করিয়া, বিপদ সমুদ্রে আর অবগাহন না করিয়া স্বদেশে প্রত্যাগমনের জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করিল। অলিকসন্দর, কৈনসের বাক্যের স্বাধীনতায়, এবং সমাগত জনগণের ব্যবহারে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইলেন। সভার অবস্থা দেখিয়া তিনি তাহা ভঙ্গ করিয়া দিলেন। তাঁহার ক্রোধের উপশম হইল না, আবার পর দিবস সেই সকল প্রধান কর্ম্মচারীকে আহ্বান করিয়া বলিলেন, “তিনি নদীর অপর পারে গমন করিবেন, বলপূর্ব্বক তিনি কোন মাসিদনকে সঙ্গে লইয়া যাইবেন না, স্বেচ্ছাপূর্ব্বক তাহাদের রাজাকে অনুগমন করিবায় বহুসংখ্যক লোক তিনি প্রাপ্ত হইবেন। যাহারা, দেশে প্রত্যাগমন করিবে, তাহারা যেন তাহাদের বন্ধুবান্ধবগণকে বলেন, তাহারা তাহাদের রাজাকে, তাঁহার শত্রুগণের মধ্যে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া আসিয়াছে।” এই বলিয়া অলিকসন্দর,স্বীয় শিবিরমধ্যে প্রবেশ করেন; তাঁহার বিশেষ প্রণয়ভাজন ও, তাঁহার শিবিরে প্রবেশ করিতে নিষিদ্ধ হইল। এইরূপে তিন দিন অতিবাহিত হইল, সমস্ত শিবির নিস্তব্ধ ভাব ধারণ করিল; অলিকসন্দর মনে করিয়াছিলেন, তাঁহার ক্রোধে সৈন্যগণের মত পরিবর্ত্তন হইবে, কিন্তু তাহা হইল না। সকলেই গৃহে প্রত্যাগমনের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইল। অলিকসন্দর এই বিষম সমষ্যায় স্বীয় মর্য্যাদা অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য, নিম্নের উপায় অবলম্বন করিলেন। দেবোদ্দেশে পূজা করিয়া তিনি বুঝিলেন যে, বিপাশা তাঁহার পক্ষে পাশ স্বরূপ হইয়াছে, ইহার পরপারে গমন তাঁহার পক্ষে মঙ্গলজনক হইবেনা। এই কথা তিনি তাঁহার হৃদয়জ্ঞ-বন্ধুর সভায় প্রকাশ করিয়া, তাঁহার স্বদেশে প্রত্যাগমন বাসনা সৈন্যগণমধ্যে প্রচার করিতে আদেশ করেন। এই কথা অবগত হইয়া, সৈন্যগণ মধ্যে আনন্দের অবধি রহিল না; অনেকে অলিকসন্দরের শিবিরের চতুঃপার্শ্বে আনন্দধ্বনি করিয়া, কেহ বা অশ্রু বিসর্জ্জন করিয়া আনন্দ প্রকাশ করিতে লাগিল।

 ডিওডোরস বলেন, ভগতা বা ফিগস, নামক একজন রাজা, অলিকসন্দরের বশ্যতা স্বীকার করেন। এই লোকটা প্রচুর উপহার ও ভারতীয় নানাপ্রকার উপাদেয় ভোজ্য প্রদান করিয়া, মেসিদনপতির কৃপা কণালাভ করেন। অলিকসন্দর ইহার আনুগত্যে এবং ইহার নিকট দেশের ভিতরকার তথ্য অবগত হইয়া প্রীত হইয়াছিলেন। ইহার নিকট তিনি নদীর অপর পার, ও পূর্ব্বদেশীয় রাজ্য সম্বন্ধে, অবগত হইলেন যে, নদীর অপর পারে একটা সুবিস্তৃত মরুভূমী আছে, তাহা অতিক্রমণ করিতে দ্বাদশ দিবস অতিবাহিত হইয়া থাকে। তাহার পর গঙ্গা প্রবাহিত হইতেছেন, ইহা ভারতের অন্যান্য নদ নদী অপেক্ষা অধিক গভীর ইহার বিস্তৃতি প্রায় ৩২ ষ্টেডিয়া হইবে। ইহার পরে প্রাচ্যদেশ, ও গঙ্গারাড় (গান্দারী দাই) প্রদেশ, এদেশের রাজার নাম চন্দ্রমা—চন্দ্রগুপ্ত, ইহার অধীনতার ২০ হাজার অশ্ব, ২ লক্ষ পাতিক, ২ হাজার রথ, এবং ৪হাজার হস্তী, অবস্থান করিতেছে। অলিকসন্দর, ফিগসের, কাছে, একথা শুনিয়া অসম্ভব বলিয়া বিবেচনা করিলেন। তিনি সন্দেহ দূর করিবার জন্য, পুরুকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন, পুরু উক্ত কথা সমর্থন করিয়া, অধিকন্তু বলিলেন, গঙ্গারাড়ের অধীশ্বর অকর্ম্মণ্য, সে নাপিত পুত্র বলিয়া, জন সাধারণ তাহাকে শ্রদ্ধার চক্ষে অবলোকন করে না। এই লোকটার পিতা, একজন সাধারাণ লোক ছিল—ইহার প্রতি রাণী আসক্ত হইয়া, স্বীয় বৃদ্ধপতিকে হত্যা করিয়াছিল, তার পর এর পুত্র রাজদণ্ড অধিকার করে।

 প্রায় সত্তর দিন ধরিয়া মুষলধারে ও প্রচণ্ড বেগে জল ঝড় ও বজ্রপাত হওয়াতে, অলিকসন্দরের সৈন্যগণের ক্লেশের অবধি ছিলনা। তাহারা ক্ষিন্ন ও রুগ্ন হইয়াছিল, ইহার উপর আরো বিপদের মধ্যবর্ত্তী হওয়া তাহাদের পক্ষে অসম্ভব হইয়া উঠিল। সুতরাং আর কেহই অগ্রসর হইতে স্বীকৃত হইলনা। অলিকসন্দর যখন অগ্রসর হইবার সঙ্কল্প পরিত্যাগ করিলেন তখন সৈন্যগণের আহ্লাদের সীমা রহিলনা।

 অলিকসন্দর, বিজিত দেশের সীমা নির্দ্ধারণ করিবার জন্য, বিপাশার তটে দ্বাদশটি বেদী প্রতিষ্ঠা করেন। উত্তরকালের লোকগণকে প্রতারিত ও মুগ্ধ করিবার জন্য, প্রকৃত প্রস্তাবে যত টুকু স্থানে শিবির সংস্থাপন করিয়াছিলেন; তাহা অপেক্ষা অনেক বেশী ভূমি অধিকার করিয়া, শিবিরের গড় খাই খনন করাইয়াছিলেন। তাঁহারা বৃহদাকার পর্য্যঙ্কপ্রস্তুত করাইয়া, তাঁহারা যে অত্যন্ত দীর্ঘাকৃতির লোক ছিলেন, তাহা জানাইবার জন্য এইরূপ নানাবিধ উপায় অবলম্বন করিয়া, ভবিষ্যৎ পুরুষদিগকে সম্মোহিত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। তিনি ভারতবাসীকে যেরূপ নির্ব্বোধ মনে করিয়াছিল, বাস্তবিকপক্ষে তাহারা তত নির্ব্বোধ নহে। অলিকসন্দরের এই বিজয়চিহ্ণ কতদিন বিতস্তার তটে মস্তক উন্নত করিয়া অবস্থান করিয়াছিল, তাহা আমরা বলিতেপারি না। একজন ইয়ুরোপীয় পরিব্রাজক, খৃষ্টের দ্বিতীয় শতাব্দীতে তারতবর্ষে আসিয়াছিলেন, তিনি এই বিজয়স্তম্ভ তখন ও দেখিয়াছিলেন এবং তখনও তাহাতে লিখিত অক্ষরগুলি তিনি স্পষ্টরূপে পাঠ করিয়াছিলেন। আবার প্লটার্ক লিখিয়াছেন, গঙ্গার তটে অলিকসন্দর যে বিজয়স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করেন, প্রাচ্যদেশের রাজা, প্রতিবৎসর গঙ্গা পার হইয়া গ্রীক প্রথায় এস্থানে পূজা করিতেন। প্লটার্কের এ কথার কোন মূল্য নাই, গঙ্গা তো দূরের কথা, যখন অলিকসন্দর বিপাশা উত্তীর্ণ হইতে সক্ষন হন নাই, তখন গঙ্গার তটে স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ অসম্ভব। মিগাস্থিনিমস্, ভারতবর্ষে অনেক দিন ছিলেন, তাঁহার ভারত বর্ণনা আমরা যেরূপ অবস্থায় প্রাপ্ত হইয়াছি, তাহাতে তিনি অলিকসন্দরের বিজয়বেদীর কথা কোনরূপ উল্লেখ করেন নাই। তিনি পাঞ্জাব অতিক্রমণ করিয়া পাটলিপুত্রে গমনাগমন করিয়াছেন, তিনি ইহা প্রত্যক্ষ অথবা এ দেশের রাজাকে তথায় পূজা করিতে দেখিলে, অবশ্যই বর্ণনা করিতেন। অলিকসন্দরের প্রত্যাগমনের পর, তাঁহার পক্ষীয়েরা যেরূপভাবে নিগৃহীত ও বিড়ম্বিত হইয়াছিল; সম্ভবতঃ পূণ্যনদীর তটস্থিত তাঁহার কীর্ত্তিও সেইরূপ, কোনরূপে রক্ষণীয় নহে, তাঁহার অত্যাচারে প্রপীড়িত ভারতবসীরা,এইরূপ বিবেচনা করিয়া উৎখাত করিয়া থাকিবে। এই স্মরণীয় স্তম্ভগুলি কোথায় স্থাপিত হইয়াছিল, তাহা জানিবার জন্য ইয়ুরোপীয় মহাশয়েরা বড়ই ভাবিত হইয়াছেন। কেহ রিবেচনা করেন, গুরুদাসপুরে বিপাশারতটে ইহা নির্ম্মিত হইয়া থাকিবে। বিপাশার কোনপারে ইহা নিৰ্ম্মিত হইয়াছিল, সে বিষয়ে মতভেদ দেখিতে পাওয়া যায়। অধিকাংশ লেখক ইহা পশ্চিম তটে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল সিদ্ধান্ত করিয়া থাকেন।

 এ সকল বেদী প্রতিষ্ঠার সময় যথেষ্ট পরিমাণে নৃত্যগীত ঘোড়দৌড় কুস্তি প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হইয়াছিল। এস্থানে তিনি বড় বেশীদিন ছিলেন বলিয়া বোধ হয় না । অল্পকালের ভিতর, তাঁহার যে সকল বিজয়কীৰ্ত্তি প্রস্তুত হইয়াছিল, তাহা কতদূর দৃঢ় হইয়াছিল, সে বিষয় ও সন্দেহ হইয়া থাকে। অলিকসন্দরের মৃত্যুর পর, প্রবল প্রতাপ চন্দ্রগুপ্ত যখন অলিকসন্দরের অধিকৃত পাঞ্জাব, স্বীয় রাজ্যের অন্তর্গত করেন—যখন তিনি স্বদেশদ্রোহীগণকে উগ্ৰদণ্ড প্রদান করিয়া তাহাদিগের গুরুতর পাপের কথঞ্চিৎ প্রায়শ্চিত্যবিধান করেন, সে সময় যে তিনি যবন, নরপতির বিজয় চিহ্ন অক্ষুন্ন অবস্থায় থাকিতে দিয়াছিলেন, সে বিষয় সন্দেহ উপস্থিত হইয়া থাকে। সম্ভবতঃ তাহা আমূল উৎপাটিত হইয়া থাকিবে ।

  1. বিতস্তা ও চন্দ্রভাগার মধ্যবর্ত্তী এই জনপদটির আমাদের স্বদেশী নাম যে কি, তাহা নির্দ্ধারণ করা বড় কঠিন। গ্রীক বা ল্যাটিন গ্রন্থে এ প্রদেশের কোনরূপ প্রাকৃতিক বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয় নাই। সম্ভবত ইহা বর্ত্তমান কাশ্মীর রাজ্যের অন্তর্গত ভীমবর রাজোরী হইতে পারে। ঝিলামের নিকটবর্ত্তী দন্তীবাসা হইতে এই রাস্তায় বহুসংখ্যক প্রাচীন জনপদের চিহ্ন দেখিতে পাওয়া যায়।
  2. পাশা অস্যাং বিপাশ্যন্ত বশিষ্ঠস্য মুমূর্ষতঃ তস্মাৎ বিপাড্ উচ্যতে পূর্ব্বমাসীদুরুঞ্জিরা। যাস্ক।