ভারতে অলিকসন্দর/দ্বিতীয় ভাগ/দ্বিতীয় অধ্যায়
দ্বিতীয় অধ্যায়।
অলিকসন্দর, কোন স্থান দিয়া সিন্ধুনদ উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন; বর্ত্তমানকালে তাহা নিশ্চয় করিয়া বলা বড় সামান্য কথা নহে। কেহ বলেন বর্ত্তমান অটকের নিম্নে তিনি সসৈন্যে সিন্ধুর পর পারে গমন করিয়াছিলেন। এ স্থান অত্যন্ত সংকীর্ণ, এমন কি সন্তরণ পূর্ব্বক পরপারে গমন করা নিতান্ত কঠিন নহে। কিন্তু যদি কেহ দৃঢ়তাসহকারে, এ স্থান হইতে শত্রুর আগমন রোধ করিবার জন্য উপর হইতে প্রস্তর নিক্ষেপ করিয়া বাধা প্রদান করেন; তাহা হইলে সে বাধা অতিক্রম করিয়া ইহার তটে উঠা অত্যন্ত কঠিন হইয়া উঠে। পরবর্ত্তীকালে মুসলমানরা, এই স্থানে সিন্ধু পার হইয়া ভারতবর্ষ আক্রমণ করিয়াছিলেন। অপর কানিংহাম প্রভৃতি বলেন, প্রাচীন উদভাণ্ডপুর বর্ত্তমান ওহিন্দ নামক স্থানে মেসিদনপতি সিন্ধুনদ অতিক্রম করেন।
অলিকসন্দর সিন্ধুতটে আসিয়া দেখিলেন, হিপাস্তিয়ন নৌসেতু প্রস্তুত করিয়া তাঁহার আগমন অপেক্ষা করিতেছেন। নৌসেতু ব্যতীত তিনি বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র নৌকা এবং দুইখানি ৩০ দাঁড়ের বৃহৎ নৌকা প্রস্তুত করিয়াছিলেন। ইচ্ছা অনুরূপ কার্য্য সম্পন্ন হওয়াতে অলিকসন্দর অত্যন্ত প্রীত হইয়াছিলেন।
অলিকসন্দরের কৃপাভিখারী, তক্ষশিলার অধীশ্বর আম্ভি, মেসিদনাধিপের করুণাকণা পাইবার সুযোগ, অবহেলায় নষ্ট করেন নাই। তাঁহারা সিন্ধুতটে আসিবার পূর্ব্বেই, তিনি দুইশত রজত টালাণ্ট, তিন হাজার মেদ সম্পন্ন বৃষ, দশহাজার মেষ, প্রেরণ করিয়া অলিকসন্দরের সৎকার করেন। কিছুদিন পূর্ব্বে আম্ভির পিতৃ-বিয়োগ হইয়াছে, এই বৃষোৎসর্গ ব্যাপারে তাঁহার পিতৃপুরুষগণ কতদূর প্রসন্ন হইয়াছিলেন, তাহা জানিবার উপায় নাই; কিন্তু তাঁহার ইহালোকের দেবতা সুপ্রসন্ন হইয়াছিলেন, একথা ইতিহাস সাক্ষ্য প্রদান করিয়া থাকে।
অলিকসন্দর, সিন্ধুর তটে একমাস অবস্থান করিয়া, তাঁহার পথশ্রান্ত, যুদ্ধক্লান্ত সৈন্যগণকে আরাম করিবার অবকাশ প্রদান করেন। এই স্থানে অবস্থানকালে নানাপ্রকার উৎসবের অনুষ্ঠান করিয়া তিনি সৈন্যগণকে প্রফুল্লচিত্ত করিয়াছিলেন।
হিন্দুকোষ অতিক্রমণ করিয়া, সিন্ধুর তটে আগমন করিতে অলিকসন্দরের, প্রায় নয়মাস সময় অতিবাহিত হইয়াছিল। এই নয়মাসে অলিকসন্দর ও তাঁহার সৈন্যগণ যে প্রকার বিপদ-ক্লেশ ও নৈরাশ্যগ্রস্ত হইয়াছিলেন; গৃহ হইতে বহির্গত হইবার পর হইতে, তিনি কোথায়ও; এই সুদীর্ঘকালের মধ্যে, এরূপভাবে বিপন্ন হন নাই। ভারতের প্রান্তে, তিনি এরূপভাবে বিপন্ন হওয়াতে, ভারতের মধ্যে তিনি কিরূপভাবে গৃহীত হইবেন, সে বিষয় তাঁহার ঘোরতর সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছিল। তাই তিনি ক্লেশ জর্জ্জরিত সৈন্যগণকে, তিরিশ দিন বিশ্রাম করিবার সময় দিয়া, নূতন বলে তাহাদিগকে বলীয়ান করিয়াছিলেন।
৩২৬ খৃপূঃ বসন্তের প্ররম্ভে চৈত্রমাসের কোন এক দিবস প্রাতঃকালে, অলিকসন্দর সিন্ধুনদ অতিক্রমণ করিয়া, তক্ষশিলার রাজ্যে পদার্পণ করেন। এখন হইতে গ্রীকগণ, ভারতীয় মনুষ্য পশু, পক্ষী, এবং নানাজাতীয় উদ্ভিদ, দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন হন। এ দেশের সভ্যতা, জাগতিক উন্নতি সাধনে সুনিপুণ। গ্রীক সভ্যতা হইতে সম্পূর্ণ বিভিন্ন—এদেশের সুবৃহৎ বটাদি বৃক্ষা-বলী“মধুস্যন্দী” ইক্ষু “পশম” প্রদ কার্পাস বৃক্ষ, ময়ুরের নৃত্য, প্রভৃতি অভিনব বিষয় দর্শন করিয়া, তাহাদিগের হৃদয় কিরূপ অপূর্ব্বভাবে অভিভূত হইয়াছিল, তাহা আমাদের অনুমান করা সুকঠিন। অলিকসন্দর, ময়ুর দেখিয়া এরূপ মুগ্ধ হইয়াছিলেন যে, যে কেহ ইহা হত্যা করিবে সে কঠিন দণ্ডে দণ্ডিত হইবে এরূপ আজ্ঞা প্রচার করিয়াছিলেন।
সিন্ধুর পূর্ব্ব পারে, অলিকসন্দর, পুনরায় তাঁহার দেবতার উদ্যেশে পূজা প্রভৃতি সম্পন্ন করিয়া, তক্ষশিলা অভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। আম্ভি, অলিকসন্দরকে প্রত্যুদ্গমন করিবার জন্য, যুদ্ধ সজ্জায় সজ্জিত সৈন্যসহ নগর হইতে বহির্গত হন। অলিকসন্দর, দূর হইতে সুসজ্জিত শ্রেণীবদ্ধ হস্তী সমূহকে,গমনশীল মঞ্চ, এবং বহুসংখ্যক সৈন্য দেখিয়া আম্ভি কর্ত্তৃক প্রতারিত হইয়াছেন মনে করিয়া, তিনি তৎক্ষণাৎ সৈন্যগণকে যুদ্ধ সজ্জায় সঞ্চিত হইতে আদেশ দিয়া, শত্রু আক্রমণ জন্য প্রস্তুত হইলেন। আম্ভি, অলিকসন্দরের ভ্রম বুঝিতে পারিয়া, কতিপয় সহচর সহ তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া, সমস্ত বিবরণ বিবৃত করিয়া তাঁহার চরণতলে শরণ গ্রহণ করেন।
আম্ভি, এই বৈদেশিকগণের ভারতভূমে পদার্পণকালে কোনরূপ বাধা প্রদান না করিয়া সাহায্য প্রদান করিলেও, আমাদের দেশের পশুরাও কিন্তু তাহার ঘৃণিত উদাহরণ অনুসরণ করে নাই। তাহারা নিজের সামর্থ অনুসারে স্বদেশ রক্ষা করিবার জন্য, অলিকসন্দরের প্রতিকুলে দাঁড়াইতে কিছুমাত্র ভীত হয় নাই। ষ্টার্বো বলেন, অলিকসন্দর যখন সৈন্যগণ সহ অগ্রসর হইতেছিলেন, তখন বনের বানরেরা, মাসিদনপতির গতিরোধ করিবার জন্য, পাহাড়ের উপরিভাগে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া যুদ্ধ সজ্জায় সজ্জিত হইয়াছিল। ইহাদিগকে দেখিয়া, বৈদেশিক সৈন্যগণ মধ্যে বেশ আতঙ্কের সঞ্চার হইয়াছিল।
অলিকসন্দর, ইহাদিগকে যুদ্ধ করিবার জন্য উপস্থিত দেখিয়া, তিনিও সৈন্যগণকে, তাহাদিগকে আক্রমণ করিবার জন্য, আদেশ প্রদান করেন। পরে আম্ভির কথায়, তাঁহার ভ্রম অপনোদন হয়। অলিকসন্দরের ভ্রম দূর হইয়াছিল বটে, কিন্তু আম্ভির ভ্রম দূর হয় নাই,স্বদেশ রক্ষা করা পুরুষের অবশ্য কর্ত্তব্য; এ উপদেশ, আম্ভি বানরের নিকট প্রাপ্ত হইয়াও, তাহা গ্রহণ করিতে সমর্থ হয় নাই।
বর্ত্তমানকালে,সেই সুপ্রাচীন তক্ষশিলার ভগ্নাবশেষ,বহুক্রোশ ব্যাপ্ত হইয়া পতিত রহিয়াছে। যে নগরী, দশরথ তনয় ভরত, প্রতিষ্ঠা করিয়া স্বীয় পুত্রের নামে নামকরণ করেন। যে নগরীতে মহারাজ জনমেজয় নাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া নাগবংশ নির্ব্বংশ প্রায় করিয়াছিলেন, যে নগরীতে জনমেজয়ের সম্মুখে, ঋষিগণ মধ্যে মহাভারতের প্রথম প্রচার হইয়াছিল,যে নগরীর বিশ্ববিশ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ে, পাণিনি, জীবক,চাণক্য প্রভৃতি ছাত্রগণ অধ্যয়ন করিয়াছিলেন, যথায় অধ্যয়ন করিবার জন্য বারাণষী প্রভৃতি সুদূর স্থান হইতে ছাত্রগণ বহুক্লেশে গমন করিতেন, সে নগরী এক্ষণে কয়েকঘর হিন্দুবণিক ব্যতীত, সমস্ত ভুমি মুশলমানগণ কর্ত্তৃক অধিকৃত হইয়ারহিয়াছে। যে উন্নত পাহাড়ের উপর পুরাকালে রাজপ্রাসাদ প্রতিষ্ঠিত ছিল, সে স্থান এক্ষণে কৃষকের হল সংযোগে কর্ষিত হইতেছে। পাঠক ইহার উপরিভাগ হইতে যদি চতুর্দ্দিকের দৃশ্য অবলোকন করেন, তাহা হইলে, এখনওবৃটিশ মিউজিয়মে স্থিত মুর্ত্তির অনুরূপ
মাসিদনপতির সহিত, প্রথম সাক্ষাৎকালে শিষ্টাচার প্রদর্শনের পর আম্ভি বলিয়া ছিলেন, “আপনি যখন আমাদের অন্নোদক, অথবা জীবনধারণের অন্য কোন প্রয়োজনীয় দ্রব্য গ্রহণ করিতে আসেন নাই; তখন আমি কি কারণে আপনার সহিত যুদ্ধ করিবার জন্য অস্ত্র গ্রহণ করিব? সুবর্ণ রজতাদি, অন্য বৈষয়িক বিষয়ে, যদি আপনা অপেক্ষা ধনবান হই, তাহা হইলে আমি, আপনাকে তাহার অংশ প্রদান করিতে আহ্লাদের সহিত প্রস্তুত আছি। আমি দরিদ্র হইলে, আপনার বদান্যতার অংশ গ্রহণ করিতে কিছুমাত্র ইতস্ততঃ বোধ করি না”। অলিকসন্দর, আম্ভির কথায় প্রীত হইয়া তাঁহাকে যথেষ্ট সম্বর্দ্ধনা করিয়াছিলেন।
অলিকসন্দর, আম্ভি কর্ত্তৃক অভ্যর্থিত হইয়া, তক্ষশিলায় প্রবেশ করিলেন। গ্রীক গ্রন্থকার বলেন, সে কালে সে প্রদেশের সকল নগর অপেক্ষা, ইহা বৃহৎ এবং সমৃদ্ধিশালী ছিল। ইহার শাসনকার্য্যও সুচারুরূপে নির্ব্বাহ হইত। ইহার উর্ব্বরভূমি নানাপ্রকার ফল পুষ্পে সুশোভিত ছিল। মেসিদনাধিপ, আম্ভির ভক্তিতেপ্রীত হইয়া তাঁহাকে তাঁহার পৈত্রিক সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। ক্লীব আম্ভি ও, দস্যুরূপে সমাগত অলিকসন্দরের হস্তে, সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত হইয়া, নিজেকে কৃতকৃতার্থ বিবেচনা করিতে লাগিল। দুঃখের বিষয় অলিকসন্দরের ভারত পরিত্যাগের পর, স্বদেশ ভক্ত ভারতবাসীর কাছে, তিনি স্বদেশদ্রোহী বলিয়া বিবেচিত হইয়াছিলেন—স্বদেশকে যবন পদস্পর্শে কলঙ্কিত করিবার কারণ স্বরূপ হওয়াতে, তিনি, সকলের কাছে ঘৃণিত হইয়াছিলেন, এবং ইহার জন্য তাঁহাকে তাঁহার বৈদেশিক সম্মানের সহিত, অকালে ইহলোক পরিত্যাগ করিতে হইয়াছিল।
তক্ষশিলায় অবস্থান কালে অলিকসন্দর, আম্ভির আতিথ্যে সৎকৃত হইয়াছিলেন, নানাপ্রকার ভারতীয় ভোজ্য দ্রব্যে তাঁহার সামান্য সৈনিকগণও আপ্যায়িত হইয়াছিল। অলিকসন্দর, ও তাঁহার বন্ধুগগণকে, আম্ভি সুবর্ণমুকুটে সুশোভিত করিয়াছিলেন। ইহা ব্যতীত ৮০ টালাণ্টের রৌপ্য মুদ্রা, আম্ভি, অলিকসন্দরের চরণতলে অর্পণ করিয়াছিলেন। রাজনীতিক অলিকসন্দর, আম্ভি প্রেরিত উপহার দ্রব্য গ্রহণ না করিয়া, তাঁহার লুণ্ঠিত দ্রব্যের মধ্য হইতে, সহস্র টালাণ্ট, পারস্যদেশীয় নানাপ্রকার বহুমূল্য বস্ত্র, আর একটা সুসজ্জিত উত্তম অশ্ব, প্রদান করিয়া আম্ভিকে পাঠাইয়া দেন।
একটা“বর্ব্বরকে” এই সকল দ্রব্য প্রদান করায়,মাসিদনদিগের মধ্যে বেশ অসন্তোষের ভাব প্রকাশ পাইয়াছিল। এই সময় অলিকসন্দরের সহচর মিলেগার, প্রচুর মদ্য পান করিয়া, প্রাণ খুলিয়া বলিয়াছিলেন “এতদিতের পর অলিকসন্দর, ভারতে আসিয়া সহস্র টালণ্ট পুরস্কার পাইবার যোগ্য বক্তি যে প্রাপ্ত হইয়াছেন, এজন্য আমি তাঁহাকে অভিনন্দন করিতেছি।” অলিসন্দর এই শ্লেষ বাক্যে ক্রুদ্ধ হইয়াছিলেন, পাছে ক্লীতস কাণ্ডের পুনরায় অভিনয় হয়, এই আশঙ্কায় ক্রোধবেগ সম্বরণ করেন।
তক্ষশিলায় অবস্থানকালে অলিকসন্দরের কাছে, অভীসারের অধীশ্বর, তাঁহার ভ্রাতার সহিত কতকগুলি সম্ভ্রান্ত লোককে, পাঠাইয়াছিলেন। বশ্যতা স্বীকার অপেক্ষা, বিদেশীদের ভিতরকার অবস্থা দেখিবার জন্য, ইহারা প্রেরিত হইয়াছিলেন। অভীসার, অলিকসন্দরকে আক্রমণ করিবার জন্য, সৈন্যগণসহ প্রস্তুত হইতেছিলেন—ইনি পুরুর সহিত মিলিত হইয়া, বৈদেশিকগণকে ভারতের বহির্ভাগে বিতাড়িত করিবার জন্য, কল্পনা করিতেছিলেন—ইনি যে মেসিদনাধিপের সহিত মিলিত হইবার জন্য লোক প্রেরণ করিয়াছিলেন, তাহা বোধ হয় না। যাহা হউক, বুদ্ধিমান অলিকসন্দর, অভীসারপতিকে তাঁহার সহিত মিলিত হইবার জন্য আদেশ করিয়া পাঠান। এ সময় দোজারস (Doxares) দিগের নিকট হইতেও দূত আসিয়া অলিকসন্দরকে সম্বর্দ্ধনা করিয়াছিল। এই দোজার কাহারা? মহাভারতের সময়, যাহারা দ্বিগর্ত্ত নামে অভিহিত হইয়াছে; বর্ত্তমান কালে যাহারা দোগরা নামে কথিত হয়, তাহারাই সম্ভবতঃ গ্রীক কথিত দোজারস হইবে। বর্ত্তমান জম্বু প্রভৃতি প্রদেশ দোগরাদিগের নিবাস ভূমি।
অলিকসন্দরের কাছে, আম্ভির ক্ষাত্রতেজ সম্পূর্ণরূপে পরাভূত হইয়া পদবিদলিত হইলেও, তক্ষশিলাবাসী ব্রাহ্মণদের কাছে, তাঁহার দর্প, অহমিকা, চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া গিযাছিল। ইয়ুরোপীয়েরা, তক্ষশিলার নাগারিকদের সমৃদ্ধি ও সভ্যতা দেখিয়াও, ভারতরাসীকে “বর্ব্বর” এই সুনামে সম্বোধন করিতে বিস্মৃত হয় নাই। তাহারা, নাগরিকগণকে পাদদেশ পর্য্যন্ত আবৃত, অতি উৎকৃষ্ট পরিচ্ছদ ধারণ করিতে দেখিয়াছিল,—তাহারা বর্ত্তমান কালের ন্যায় পাকড়ি ব্যবহার—নানা প্রকার কারুকার্য্য শোভিত চর্ম্মপাদুকা—(ইহার তলায় পুরুচামড়া থাকায় পরিহিত ব্যক্তিকে একটু উঁচু দেখাইত) ব্যবহার করিত। ধনবানেরা কর্ণেকুণ্ডল,হস্তে সুবর্ণবলয়, ধারণ করিত। তাহারা মস্তকে দীর্ঘকেশ রক্ষা করিত, তাহা প্রায়ই কর্ত্তন করিত না; এজন্য সর্ব্বদা কঙ্কতিকা ব্যবহার করিত। কেহ কেহ দাড়ি রাখিয়া তাহা নানারঙ্গেরঞ্জিত করিত। বর্ত্তমানকালের ন্যায়, কেহ বা সমস্ত দাড়ি কাটিয়া,চিবুকের কাছে কিছু রাখিয়া দিয়া বাহার বাহির করিত।
রাজার জাঁক জমক ও বাহ্য আড়ম্বর, গ্রীকবাসীর চক্ষে বিসদৃশ বোধ হইয়া থাকিবে।—রাজা যখন বাহির হইতেন, তখন তাঁহার গমন পথ, সুগন্ধি দ্রব্যে আমোদিত করা হইত। তাঁহার অনুচরগণ রজত দণ্ড ধারণ করিয়া অনুগমন করিত। রাজা চতুর্দ্দিকে মুক্তাজড়িত সুবর্ণময় পাল্কীতে আরোহণ করিয়া গমন করিতেন। সুবর্ণ ভূষিত অতি উৎকৃষ্ট বস্ত্রে তাঁহার অঙ্গাভরণ প্রস্তুত হইত। পাল্কীর পশ্চাদভাগে অস্ত্রধারী অনুচরগণ অনুসরণ করিত। ইহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ বৃক্ষ শাখায় পক্ষী লইয়া গমন করিত। সেই সকল শিক্ষিত পক্ষী নানাপ্রকার সুমধুর শব্দ করিয়া শ্রোতৃবর্গের কার্য্যের ব্যাঘাত সম্পাদন করিত। রাজ ভবন সকল সময় সাধারণের নিকট উন্মুক্তদ্বার ছিল। রাজা যে সময়ে বস্ত্র পরিধান, অথবা কেশ প্রসাধনে নিযুক্ত থাকিতেন, সে সময় ও তিনি অভিযোক্তার আবেদন শ্রবণ করিতেন। রাজভবনের সুবর্ণ মণ্ডিত স্তম্ভে, সুবর্ণের দ্রাক্ষালতা বিজড়িত হইত, সেই লতার উপর নানাপ্রকার নয়নরঞ্জন রৌপ্যময় পক্ষী ও নানাপ্রকার কারুকার্য্য, দর্শকগণের বিস্ময় উৎপাদন করিত। পাঠক! সেকালের ইয়ুরোপীয় বর্ণিত, আমাদের দেশের রাজপ্রাসাদের ভগ্নাংশ কল্পনা চক্ষে দর্শন করুন। কি অতীত কালের অসভ্য, কি বর্ত্তমান কালের সভ্য, কোন সময়েই, ইয়ুরোপ আমাদের ভারতের দ্বিসহস্র বৎসর পূর্ব্বের সেই সমৃদ্ধিকে অতিক্রমণ করিতে সমর্থ হয় নাই। বর্ত্তমান কালে, একশ্রেণীর লোকের আবির্ভাব হইয়াছে, তাঁহারা আমাদের ভাস্কর কার্য্যের একটু কিছু ভাল দেখিলেই, তাহাতে “হেলেনিক” গন্ধ প্রাপ্ত হইয়াথাকেন।
মাসিদনরা, তক্ষশিলার রাজপথে এক শ্রেণীর লোক দেখিয়াছিলেন—তাঁহাদের শীত গ্রীষ্মে তিতিক্ষা—সুখদুঃখে বিগত স্পৃহা এবং উৎকট তপস্যা দেখিয়া, তাঁহারা পরমবিস্ময়ে অভিভূত হইয়াছিল। ইহাঁরা, নগরের বহির্ভাগে বনমধ্যে পর্ণকুটীরে অবস্থান করিতেন। বৃক্ষের ফলে, ও নির্ঝরণীর জলে তাঁদের ক্ষুৎপিপাসা দূর হইত। এই সকল ব্রহ্মচারী ও সন্ন্যাসী দিগের প্রভেদ বুঝিতে না পারিয়া, বৈদেশিকগণ সাধারণতঃ ইহাদিগকে “জিমনোসফিক্ট” বা নগ্ন জ্ঞানী নামে অভিহিত করিয়াছেন। ইহারা নগর মধ্যে আগমন করিলে, নাগরিকরা সম্ভ্রমের সহিত তাঁহাদিগকে অভ্যর্থনা করিতেন—উত্তম ভোজ্যে তাঁহাদিগকে আপ্যায়িত করিতেন—বাজারের দোকানিরা তাঁহাদিগকে বিনামূল্যে দ্রব্য দিত; ইহা দেখিয়া গ্রীকরা আশ্চর্য্য বোধ করিত। ভারতের পশুপক্ষী বৃক্ষ দেখিয়া গ্রীকবাসীরা, যেরূপ অবাক্ হইয়াছিল; সেইরূপ ব্রাহ্মণদের অদ্ভুত আচার ব্যবহার দেখিয়া, তাহারা অধিকতর বিস্ময়াপন্ন হইয়াছিল। গুণগ্রাহী অলিকসন্দর, ইহাদিগকে দেখিবার জন্য উৎকণ্ঠিত হইয়া ছিলেন। তাঁহার সহচর প্রাজ্ঞ অনিসিক্রিতস্কে, সেই ব্রাহ্মণ মণ্ডলীতে প্রেরণ করিয়া, তাঁহার কাছে একজনকে আসিবার জন্য অনুজ্ঞা করিয়া পাঠান। ব্রাহ্মণদিগের মধ্যে কল্যাণ নামক একজন ব্যক্তি, অনিসিক্রিতস্কে বলেন, আগে তোমার (অপবিত্র) বস্ত্র পরিত্যাগ কর, তবে তোমার সহিত কথা কহিব, অন্যথা তুমি সাক্ষাৎ জিউসের নিকট হইতে আগমন করিলেও, তোমার সহিত বাক্যালাপে প্রবৃত্ত হইব না। আমরা জানিনা, অনিসিক্রিতস্, কল্যাণের কথা কতদুর প্রতিপালন করিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁহার রাজ-আজ্ঞা প্রতিপালন করেন নাই, ইহা আমরা অবগত আছি। কল্যাণ যখন কোন রূপেই তাঁহার কাছে আসিলেন না; তখন অলিকসন্দর, তক্ষশিলার অধিশ্বরকে তাহার কাছে কল্যাণকে আনিবার জন্য অনুরোধ করিলেন। কল্যাণ, আম্ভি কর্ত্তৃক অনুরুদ্ধ হইয়া, অলিকসন্দর সকাশে গমন করেন। কল্যাণ একখানি শুষ্কচর্ম্মে, অলিকসন্দরের সাম্রাজ্য কল্পনা করিয়া, তাহার এক পার্শ্বে পদাঘাত করেন, ইহাতে চর্ম্মের অপর পা উঠিয়া পড়িল; এইরূপ অপর পার্শ্বে পদাঘাত করাতে, অপরদিক উঠিয়া পড়িল; কিন্তু যখন মধ্যস্থলে পদার্পণ করিলেন,তখন তাহা সমভাবে পড়িয়া রহিল। এইরূপে চতুর্দ্দিকে দৌড়াদৌড়ি করিয়া, না বেড়াইয়া, মধ্যস্থলে অবস্থান করিয়া রাজ্যশাসন করা উচিত। অলিকসন্দর, কল্যাণের শীত গ্রীষ্ম সহনের অদ্ভূত ক্ষমতা, এবং দার্শনিক আলাপে অত্যন্ত মুগ্ধ হইয়াছিলেন। তিনি কল্যাণকে অতি সম্মানের সহিত নিকটে রাখিয়াছিলেন। কল্যাণ, তাঁহার এই রাজভক্তির ফলে, সমস্ত ব্রাহ্মণ সমাজে নিন্দিত ও ধিক্কৃত হইয়াছিলেন। অলিকসন্দর, ব্রাহ্মণ সমাজের শীর্ষস্থানীয় মহামতি দণ্ডীকে, তাহার কাছে আনিবার জন্য অনিসিক্রিতসকে প্রেরণ করেন। তিনি দণ্ডীর কাছে গিয়া বলেন “যুপিটারের পুত্র মনুষ্যজাতির অধিশ্বর সম্রাট অলিকসন্দর, তোমাকে তাহার কাছে শীঘ্র যাইবার জন্য আদেশ করিয়াছেন; তাঁহার কাছে উপস্থিত হইলে, তিনি তোমাকে বহুল পুরস্কার প্রদান করিবেন।—যদি না যাও এই অবমাননার জন্য তোমার মস্তক স্কন্ধচ্যূত হইবে।”
তৃণশয্যায় শায়িত মহামতি দণ্ডীর কর্ণে, এই কথা প্রবেশ করিলে, তিনি শরীর পরিবর্ত্তন না করিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া প্রত্যুত্তরে বলিলেন, “মহামহিমান্বিত পরমেশ্বরের দ্বারা জগতে কাহারও অনিষ্ট হইতে পারে না—মৃত্যুমুখে পতিত হইলে তিনি সকলকে জীবন প্রদান করিয়া, পুনর্জীবিত করিয়া থাকেন। তিনিই আমার পরমেশ্বর, তিনি কখন হত্যার প্রশ্রয় বা যুদ্ধের প্রবর্ত্তনা করেন না। তোমার অলিকসন্দর কিছু পরমেশ্বর নহেন, তাহাকেও একদিন মরিতে হইবে। যিনি এখনও তীব্রবহা (Tyberobos) নদীর তট পর্য্যন্ত গমন করিতে সমর্থ হন নাই, যিনি এখনও গাধি (Gades) রাজ্যের (কান্যকুব্জদেশ) সীমান্ত প্রদেশ অতিক্রমণে সমর্থ হন নাই, তিনি কেমন করিয়া বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর হইতে ইচ্ছা করেন? আকাশ মণ্ডলে সূর্য্যদেব কোন পথ অবলম্বন করিয়া গমন করেন, যিনি এখনও তাহা অবগত হইতে সমর্থ হয় নাই, যাহার নাম, এখনও কত শত মনুষ্যজাতির শ্রুতিগোচরও হয় নাই; সে কোন সাহসে নিজেকে সর্ব্বজন স্বামী বলিতে সাহসী হয়? তিনি যে সকল রাজ্য জয় করিয়াছেন; তাহাতেও যদি তাহার অকুলান হয়, তাহা হইলে তাঁহাকে বলিও, তিনি যেন আমাদের নদী উত্তীর্ণ হইয়া গমন করেন, তাহা হইলে তিনি এরূপ ভূমি প্রাপ্ত হইবেন; যাহাতে তাঁহার আকাঙ্ক্ষা পরিপূর্ণ হইবে। অলিকসন্দর আমাকে যে পুরস্কারের কথা বলিয়াছেন, আমার কাছে সে সকল দ্রব্যের, কিছুই মূল্য নাই। আমার কুটীর ও শয্যার জন্য, প্রচুর পত্রপুঞ্জ রহিয়াছে,—বৃক্ষের ফল মূলে আমার ক্ষুধা, আর এই অঞ্জলী দ্বারা জলপান করিয়া তৃষ্ণা নিবারণ করিয়া থাকি। শ্রমলব্ধ দ্রব্য সকল যাহারা সংগ্রহ করে, তাহা তাহাদের দুঃখের কারণস্বরূপ হইয়া থাকে;—আমি এ সকল দ্রব্য কখন চিন্তা ও করি না, বরং ঘৃণাই করিয়া থাকি। স্বর্ণপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষার সহিত আমার সুনিদ্রা হইবে না। জননী যেরূপ সন্তানকে পোষণ করিয়া থাকেন, পৃথিবীও সেইরূপ আমার সমস্ত অভাব দূর করিয়া থাকেন। যথায় আমায় ইচ্ছা হয়, তথায় আমি গমন করিয়া থাকি, অভাবের তাড়নায়, আমাকে কোন স্থানে লইয়া যাইতে সমর্থ হয় না। যদি তোমার অলিকসন্দর, আমার মস্তক ছেদন করেন, তাহা হইলেও, তিনি আমার আত্মাকে আয়ত্বাধীন করিতে পারিবেন না। আমার ছিন্ন মস্তক অধিকার করিতে পারেন বটে; কিন্তু মানুষ যেমন জীর্ণবস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া থাকে; সেইরূপ আমার আত্মা, পৃথিবী হইতে উৎপন্ন শরীরকে, পৃথিবীর উপর পরিত্যাগ করিয়া, যিনি এই শরীর প্রদান করিয়াছিলেন সেই ঈশ্বর সকাশে গমন করিবে। পৃথিবীতে আগমন করিয়া, আমরা তাঁহার আজ্ঞানুবর্ত্তী থাকি কি না, ইহা পরীক্ষা করিবার জন্য, তিনি আমাদিগকে পৃথিবীতলে প্রেরণ করিয়াছেন; আবার ইহ জীবনের অন্তে, তিনি আমাদিগের সমস্ত কার্য্যের বিচারক। পীড়িতের আর্ত্তনাদ ও দীর্ঘনিশ্বাসই, পীড়াদায়কের শাস্তি স্বরূপ হইয়া থাকে। আমি যখন আমাদের সেই প্রধান বিচারকের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া আমাদের এই বিচার দেখিব, তখন আমি শান্তিলাভ করিব।”
“তুমি তোমার অলিকসন্দরকে গিয়া বলিও, যাহারা সুবর্ণ আকাঙ্ক্ষা করিয়া থাকে, যাহারা সম্পত্তিলাভের জন্য, অকার্য্যকে কার্য্য বলিয়া গ্রহণ করিয়া থাকে; অথবা যাহারা মৃত্যুভয়ে সর্ব্বদাই ভীত; তাহারাই তোমার এই ভীতি প্রদর্শনে বিভীষিকাগ্রস্ত হইতে পারে। ব্রাহ্মণের সুবর্ণপ্রীতি নাই, সুতরাং মৃত্যুভীতি তাহাদিগকে অবসন্ন করিতে কখনই সমর্থ হয় না। তুমি অলিকসন্দরকে গিয়া বলিবে যে, দণ্ডী তোমার নিকট হইতে রতীমাত্র জিনিষের আকঙ্ক্ষা রাখেনা; সুতরাং সে কখনই তোমার নিকট গমন করিবে না; তোমার যদি দণ্ডীর নিকট কিছু প্রার্থনা থাকে, তাহা হইলে তুমি তাহার নিকট আগমন করিতে পার।”
জীবনমুক্ত দণ্ডীর, এই উত্তর শ্রবণ করিয়া অবধি, অলিকসুন্দরের দণ্ডী দর্শন বাসনা অত্যন্ত বেগবতী হইয়াছিল। দণ্ডী দর্শনের জন্য অলিকসন্দর, বনভূমিতে গমন করিয়াছিলেন। অবশেষে দণ্ডীর দর্শন লাভ করিয়া কৃতকৃতার্থ হইয়াছিলেন। গ্রীক ম্যাগাস্থিনিস লিখিয়াছেন, অলিকসন্দর, অনিসিক্রেতিসের মুখে দণ্ডীর উত্তর প্রাপ্ত হইয়া, তাঁহাকে দেখিবার জন্য অত্যন্ত উৎসুক হইয়াছিলেন। এই দিগম্বর বৃদ্ধের কাছে, নানাজাতি বিজয়ী মহাবাহু অলিকসন্দর, অবশেষে পরাভব স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। অলিকসন্দরের কাছে আম্ভির ক্ষাত্র তেজ সম্পূর্ণরূপে পরাভূত হইয়া পদদলিত হইলেও, কিন্তু ভারতবর্ষের ব্রাহ্মণের পদতলে ইয়ুরোপীয় বীরকুলের অগ্রগণ্য জগ্বিজেতা অলিকসন্দরের দর্প—অহঙ্কার চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। যে দেশের ব্রাহ্মণরা অগ্নিতে প্রবেশ করিয়া জনগণ হৃদয় হইতে মৃত্যুভয় দূর করিয়া দিতেন; আম্ভি সেই দেশের লোক হইয়া, যবন নৃপতির একটু ধন্যবাদ লাভের জন্য কত শত স্বদেশবাসীর মৃত্যুর কারণ স্বরূপ হইয়াছিলেন। যে দেশবাসী অর্থকে অনর্থের কারণ বিবেচনা করিয়া দূরে তাহা ঘৃণার সহিত পরিত্যাগ করিতেন, হায়! আম্ভি সেই অর্থ লালসায় বিদেশীর পদতলে লুণ্ঠিত হইয়া স্বচ্ছন্দে তিনি স্বাজাতি ধ্বংস করিয়া স্বাধীনতারত্নে জলাঞ্জলি প্রদান করেন।
নগরে যে সকল ব্রাহ্মণেরা বাস করিতেন, তাঁহাদিগের মধ্যে অনেকে জ্যোতিষ শাস্ত্রের অনুশীলন করিতেন। তাঁহারা গ্রহ নক্ষত্রের গতি পর্য্যবেক্ষণ করিয়া বৈজ্ঞানিক প্রথায় ভবিষ্যৎ ঘটনা সকল গণনা করিতেন।” গ্রীকগণ, ইহারা সুধু কেন, পৃথিবীর অন্যান্য জাতীরা যখন সভ্যতার প্রথম সোপানেও আরোহণ করেন নাই, তাহাদের সভতার সেই অতি শৈশবকালে আমাদের ভারতবর্ষে আমাদের পূর্ব্বজেরা, জ্যোতিষ শাস্ত্র বিষয়ে যথেষ্ট উন্নতিলাভ করিয়াছিলেন। সেকালে আমাদের পূর্ব্বজগণের পদপ্রান্তে উপবেশন করিয়া পৃথিবীর, অন্যান্য জাতি এই শাস্ত্র অধ্যয়ন করিত। উদার প্রকৃতির ব্রাহ্মণগণ, গুণবান শিষ্যের গুণের আদর করিতে কখনও পশ্চাদ্পদ হইতেন না। ইহাই তাঁহাদিগের বিশেষত্ব, তাই তাঁহারা যবনগণকেও আচার্য্য পদবীতে উন্নীত করিতে কিছুমাত্র সঙ্কোচ প্রকাশ করেন নাই।
অলিকসন্দর, তক্ষশিলায় অবস্থান কালে পুরুর নিকট দূত প্রেরণ করিয়া, তাঁহাকে কর প্রদান করিতে, এবং রাজ্যের সীমান্তপ্রদেশে আগমন করিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য আদেশ করিয়া পাঠান। ক্ষত্র ধর্ম্মপরায়ণ মহাবাহু পুরু দূতের মুখে অলিকসন্দরের অভিপ্রায় শুনিয়া বলিয়া পাঠান যে “সীমান্ত প্রদেশে তরবারী হস্তে তোমার প্রভু অলিকসন্দরের সহিত আমি সাক্ষাৎ করিব।” অলিকসন্দর, পুরুর গর্ব্বিত উত্তরে বিষ্মিত হইলেন। মনে করিয়াছিলেন, পুরু, বিনা রক্তপাতে তাঁহার বশ্যতা স্বীকার করিবে, যখন তাহা হইল না, তখন তিনি পুরুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবার জন্য প্রস্তুত হইলেন। পুরুর রাজ্য আক্রমণ করিতে হইলে, বিস্ততা নদী[১] উত্তীর্ণ হইতে হইবে— নদী পার হইতে শত্রু যাহাতে না সমর্থ হয়; পুরু সে বিষয়ে চেষ্টা করিতে ত্রুটি করিবে না; এজন্য তিনি বিতস্তার নৌকা সকল ধ্বংস, অথবা হস্তগত করিয়া রাখিয়াছেন, এইরূপ সন্দেহ করিয়া, অলিকসন্দর, সিন্ধুনদে তাঁহার যে সকল নৌকা ছিল, তাহার মধ্যে বড় নৌকা দুখানিকে তিন ভাগে, এবং ছোট গুলিকে দুই ভাগেবিভক্ত করিয়া বিতস্তার তটে আনয়ন করিতে আজ্ঞা প্রদান করেন।[২]
অলিকসন্দর, তক্ষশিলা প্রদেশের শাসনভার তাঁহার নিজের দেশীয় লোকের হস্তে অর্পণ করিলেন। পাছে কিছু গোলযোগ উপস্থিত হয়, এই ভয়ে কিছু সৈন্য তথায় সংস্থাপন করিয়া, তাঁহার অবশিষ্ট সৈন্য, অধিকন্তু আম্ভি পরিচালিত পাঁচ হাজার ভারতীয় সৈন্যসহ, পুরুর উদ্দেশ্যে বিতস্তা অভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। তক্ষশিলা হইতে দুইটি রাস্তা বিতস্তা অভিমুখে গমন করিয়াছে। একটি রাওলপিণ্ডী, মানকেলা[৩] রোতস হইয়া ঝিলামে গিয়াছে। অপরটি অপেক্ষাকৃত দক্ষিণভাগে দুধিয়াল হইয়া বামভাগে টিলাপর্ব্বত রাখিয়া লবণ পাহাড়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদী অতিক্রমণ করিয়া ঝিলামের ২৮ মাইল দক্ষিণে জানালপুরে বিতস্তার সহিত মিলিত হইয়াছে। অলিকসন্দর, কোন রাস্তা অবলম্বন করিয়া বিতস্তার তটে গমন করিয়াছিলেন; সে বিষয় স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সুকঠিন। ক্যানিংহাম প্রভৃতি, জালালপুরে অলিকন্দর শিবির স্থাপন করিয়াছিলেন; সিদ্ধান্ত করিয়া থাকেন। অপরপক্ষে এবট প্রমাণ করেন যে, বর্ত্তমান ঝিলাম সহরের নিকট মেসিদনাধিপতি অবস্থান করিয়া পুরুর সহিত যুদ্ধ করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছিলেন এই মতটি বর্ত্তমানকালে ভিন্সেণ্টিস্মিথ গ্রহণ করিয়া, দৃঢ় করিবার প্রয়াস পাইয়াছেন। আবার কেহ কেহ বলেন, পিণ্ডদাদন খানার দক্ষিণে, আহমদাবাদ নামকস্থানে, অলিকসন্দর শিবিরসংস্থাপন করিয়া অপর পারে পুরুর সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। এমত সংস্থাপনের জন্য কেহ কেহ বড় কম আগ্রহ প্রকাশ করেন নাই। প্রাচীনকালের লেখকেরা, অলিকসন্দরের গমনপথ ও বিতস্তার বিষয় যেরূপ ভাবে বর্ণনা করিয়াছেন, তাহা ঠিক পূর্ব্বোক্ত কোন স্থানে বর্ত্তমানকালে প্রাপ্ত হওয়া যায় না। দুই হাজার বৎসরের মধ্যে বিতস্তার যথেষ্ট পরিবর্ত্তণ হওয়াতে ভৌগোলিক অবস্থার ও যে অনেক পরিবর্ত্তণ হইবে সে কথা বলাই বাহুল্য। ভিন্সেণ্ট স্মিথ, অন্যের প্রতি দোষারোপকালে, ভৌগোলিক অবস্থানের কথা উল্লেখ করিয়াছেন। কিন্তু তিনি যে স্থান নির্দ্দেশ করিয়াছেন, অলিকসন্দরের সময় তাহা যে বিতস্তার গর্ভে ছিল না, তাহার কোন প্রমাণ আছে? এক সময় পুরাতন ঝিলাম-সরাই ও নারাঙ্গাবাদের নিম্ন দিয়া বিতস্তা প্রবাহিত হইয়াছেন, এক্ষণে উক্ত স্থনে হইতে অনেক দূরে প্রবাহিত হইতেছেন। এই জন্য অলিকনন্দর, কোন স্থানে বিতস্তা পার হইয়াছেন তাহা নির্ণয় করা দুরূহ ব্যাপার।
অলিকসন্দর, সৈন্যগণ সহ বিতস্তার তটে উপস্থিত হইয়া যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহাদের অন্তরআত্মা অবসন্ন হইয়া পড়িল, বিষাদের রেখা বদনমণ্ডলে আবির্ভূত হইল; মনে করিয়াছিলেন, সহজেই সমস্তদেশ হস্তগত হইবে, এবং সকলেই বুদ্ধিমান আম্ভির ন্যায়, তাঁহার পদতলে পতিত হইয়া জয়গীতি গান করিবে। তাহা হইল না—দেখিলেন সকলে আম্ভির ধাতুতে গঠিত হয় নাই। তাঁহার প্রবল প্রতাপকে তুচ্ছ করিয়া ভারতবাসীরা তাঁহাকে বাধা দিবার জন্য নদীর অপর তটে যেন নগর নির্ম্মাণ করিয়া অবস্থান করিতেছে। সৈন্য শ্রেণীর মধ্য হইতে হাওদা সহ দুইশত হস্তী, যেন সমুন্নত শৌধ শিখরকে অনুকরণ করিয়াছে। ঘোটক চতুষ্টয় বাহিত, তিনশত রথ, যেন অলিকসন্দরের সৈন্যগণকে প্রতিস্পর্ধ করিয়া চতুর্দ্দিকে গমনাগমন করিতেছে, ৩০০০০ পদাতিক,যেন ভারতের সম্মান সংরক্ষণ জন্য,অটল অচল প্রাচীরের ন্যায় দুর্ভেদ্য হইয়া রহিয়াছে। পুরুর প্রায় সর্ব্ব শুদ্ধ পঞ্চাশ হাজার সৈন্য, বিজয় অথবা মৃত্যুর জন্য কৃত নিশ্চয় হইয়া নদীর অপর পারে অবস্থান করিতেছিল। শীঘ্রবহা সুবিস্তৃতা বিতস্তা, যেন পুরুর সহিত মিলিতা হইয়া, অলিকসন্দরের গমনপথে বাধাপ্রদান করিবার জন্য, সর্ব্বতোভাবে চেষ্টা করিতেছিলেন;—পদাতিক অশ্বারোহী ও হস্তী সহ মিলিত ইহার দুরারোহ তট, আগন্তুকগণের হৃদয়ে নৈরাশ্য উৎপাদন করিল—নদীমধধ্যে নিমজ্জিত পাষাণ সকল যেন, গুপ্তভাবে অবস্থিত সৈন্যগণের ন্যায়, শত্রু আক্রমণের জন্য সময় প্রতীক্ষা করিতেছিল। অলিকসন্দর, পুরুর ভয়াবহ হস্তীযুথ সহ সৈন্যগণ অপেক্ষা, সুবিস্তীর্ণা বিতস্তা দেখিয়া ইহার পরপারে কিরূপে গমন করিবেন, সেই চিন্তাতে বিশেষরূপে অবসন্ন হইয়া পড়েন। তিনি যে নৌকা আনয়ন করিয়াছেন; বিপক্ষ সৈন্যের সম্মুখে তাহাতে পার হওয়া আর বৈতরণীর অপর পারে গমন করা উভয়ই তুল্য। অলিকন্দর যে স্থানে শিবির সংস্থাপন করিয়াছিলেন, ঠিক তাহার অপর পারে পুরুর শোভায়মান শিবির সন্নিবেশিত হইয়াছিল। উভয়পক্ষ পরস্পরকে শব্দে সম্মোহিত করিবার জন্য, পরস্পর শব্দ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছিল, কিন্তু পুরুর সৈন্যের গর্জ্জনের সহিত হস্তীর বৃংহিত মিলিত হওয়াতে, তাহা মাসিদনদের হৃৎকম্প উপস্থিত করিল। কখন বা নদী মধ্যস্থিত চরে, উভয়পক্ষের সৈন্যগণ ভল্লাদি সহ সস্তুরণ করিয়া তথায় উপস্থিত হইয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইত। এরূপ যুদ্ধে কতকগুলি অতি সাহসী মাসিদন সৈন্য, ভারতীয় হস্তে নিহত হয়; যাহারা রক্ষা পাইল তাহারা বিতস্তার প্রবলবেগ হইতে নিস্তার পাইল না। নদীগর্ভে তাহারা নিমজ্জিত হইয়া মৎসাদির আহার্য্যে পরিণত হইয়াছিল। এইরূপ ক্ষুদ্র যুদ্ধের পরিণাম দেখিয়া উভয় তটে অবস্থিত নৃপতিদ্বয়, ভাবী জয় পরাজয়ের কাল্পনিক চিত্র অঙ্কন করিয়া আনন্দিত ও দুঃখিত হইতেন।
অলিকসন্দর, সরল উপায়ে কার্য্যসিদ্ধি অসম্ভব বুঝিয়া মায়া অবলম্বনে প্রবৃত্ত হইলেন। তিনি এরূপ প্রকাশ করিলেন যে, শীতকালে বিতস্তার জল হ্রাস হইলে; সেই সময় নদী পারে প্রবৃত্ত হইবেন, যাহাতে শত্রু তাঁহার কথার উপর বিশ্বাস স্থাপন করেন, সে জন্য তিনি দীর্ঘকালের উপযোগী খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করিবার জন্য চতুর্দ্দিকে লোক সকল প্রেরণ করেন। অপর দিকে, বহুল পরিমাণে চর্ম্মমধ্যে শুষ্কঘাস পূর্ণ করিয়া সেলাই করিয়া, একপ্রকার ভেলা প্রস্তুত করিতে আজ্ঞা দিলেন—নৌকা সকল এদিকে ওদিকে পাঠাইয়া নদীপারের ভাণ করিয়া, শত্রুগণকে ক্লান্ত করিতে লাগিলেন। নদী পার হইবার উদ্দেশে সমস্ত রাত্রি মশাল জ্বালাইয়া—সৈন্যগণকে নদীতটে শ্রেণীবদ্ধ করাইয়া, অলিকসন্দর, পুরুকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিলেন— শত্রু আগমন আশঙ্কা করিয়া, পুরু তাঁহার সৈন্যগণকে যুদ্ধের জন্য নদীতটে পাঠাইতে লাগিলেন। অলিকসন্দর, এইরূপ কার্য্য প্রতিরাত্রে অনুষ্ঠান করিয়া, পুরুকে প্রতারণা করিবার রাস্তা পরিস্কার করিলেন। পুরু, পাশ্চাত্য ধূর্ত্ততা বুঝিতে পারিয়া, নদীর বহুদূর পর্য্যন্ত স্থানে, চর সকল স্থাপন এবং প্রধান প্রধান স্থানে সৈন্য সকল সংস্থাপন করিয়া, মাসিদন ধূর্ত্ততার প্রতিক্রিয়া করেন।
অলিকসন্দর যখন অবগত হইলেন, অভীসারের অধিশ্বর প্রচুর সৈন্য লইয়া পুরুর সহায়তার জন্য ২২।২৩ ক্রোশ দূরে অবস্থান করিতেছেন, উভয়ের সম্মিলন হইবার পূর্ব্বেই তিনি তখন শত্রুকে আক্রমণ করিবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন।
অলিকসন্দর যে স্থানে শিবির সংস্থাপন করিয়াছিলেন, সে স্থান হইতে ১৫০ ষ্টেডিয়া (প্রায় ৮॥০ ক্রোশ) দূরে বিতস্তার তটে জঙ্গলে আবৃত খানিকটা উচ্চ ভূমি ছিল, এস্থানে বিতস্তা বাঁকিয়া গিয়াছেন, এই স্থানের সম্মুখে একটা বড় চর ছিল, তাহাতেও প্রচুর পরিমাণে বন থাকায়, ওপার হইতে নদীর এপারের কিছু দেখিতে পাওয়া যায় না। অলিকসন্দর, তাঁহার কার্য্য সিদ্ধির পক্ষে এই স্থান সুবিধাজনক বুঝিয়া, নৌকা সকল দ্বিখণ্ড করিয়া আনয়ন করিলেন। এবং এই স্থান হইতে পার হইবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলেন।
অতি শীঘ্র সংবাদ আদান প্রদানের জন্য, নদীরতটে পরস্পরের দৃষ্টির অন্তর্গত স্থানে, সৈন্য সকল শ্রেণীবন্ধ হইয়া থাকিতে আদিষ্ট হইল। প্রধান শিবিরে ক্রিতিরস, তাঁহার অধীনস্থ সৈন্যগণসহ, মাসিদন পদাতিক-অশ্বারোহী এবং তক্ষশিলা পরিচালিত ৫ সহস্র সৈন্য লইয়া অবস্থান করিলেন। অলিকসন্দর তাঁহাকে উপদেশ দিলেন যে, “পুরু তাঁহার সমস্ত সৈন্যসহ আমাকে আক্রমণ না করিলে, তিনি যেন কদাচ অপর পারে গমন না করেন। অথবা আমি বিজয়ী এবং পুরু পলায়ণ পর হইলে তিনি যেন নদী উত্তীর্ণ হন। নদী পার কালে হস্তীই ভয়ের কারণ; পুরু যদি কতকগুলি হস্তীসহ সৈন্য রাখিয়া আমার সহিত যুদ্ধ করিতে গমন করেন; তাহা হইলে ক্রিতিরস যে স্থানে আছেন, সেই স্থানেই থাকিবেন। আর যদি কেবল মাত্র সৈন্য রাখিয়া গমন করেন; তাহা হইলে তিনি অনতিবিলম্বে নদী পার হইয়া শত্রুর পশ্চাদ্ভাগ আক্রমণ করেন। চরভূমি ও প্রধান শিবিরের মধ্যবর্ত্তী স্থানে, মিলোগার—আতালস ও গরজিস, নামক সেনানী-ত্রয়ের অধীনতায় পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য প্রদান করিয়া তাঁহাদিগকে বলিলেন, যে সময় তাঁহার সহিত শত্রু সৈন্যের যুদ্ধ আরম্ভ হইবে, সেই সময় যেন তাঁহারা নদী উত্তীর্ণ হন। অলিকসন্দর স্বয়ং তাঁহার সহচর সৈন্য এবং হিপাইস্তিয়ন-পাদ্দিকা—দেমিত্রস পরিচালিত সৈন্যগণসহ শকবহ্লিক, প্রভৃতি দেশীয় পদাতিক ও আরোহী সৈন্য লইয়া, অতি গোপনে চরভূমির কাছে উপস্থিত হন। এই ভয়ঙ্কর রাত্রে জল ঝড় বজ্রাঘাত হইয়া, ইহার ভীষণতাকে অধিকতর বৃদ্ধি করিয়া অলিকসন্দরের “রাস্তা চুরীর” কার্য্যে সহায়তা সম্পাদন করিয়াছিল। লুক্কায়িত নৌকা সকল, জঙ্গল হইতে বাহির করিয়া আনিয়া সৈন্য সকল পরপারে যাইবার উদ্যোগ করিতে লাগিল—মেঘের গভীর গর্জ্জনে এবং মুষলধারে বৃষ্টিপাতজনিত শব্দে, সৈন্যগণের অস্ত্রের ঝনঝনা শব্দ এবং চালকগণের হুঙ্কার শব্দ, পরপারস্থিত ভারতীয় প্রহরীবৃন্দের শ্রুতিগোচর হইল না। সূর্য্যোদয়ের পূর্ব্বে জল ঝড় থামিয়া গেল, অলিকসন্দর তটের নিকটবর্ত্তী হইবার সময়ে, তিনি পুরুর প্রহরীগণের নয়নগোচর হইলেন। এরিয়ান বলেন, অলিকসন্দর বিতস্তার আর একটা ধারা অতিক্রমণ করিয়া তটে উঠিয়াছিলেন। রাত্রের বৃষ্টিতে জলপ্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়াতে ইহা অতিক্রমণ করিতে সৈন্যগণকে বড় কম ক্লেশ স্বীকার করিতে হয় নাই।
এরিষ্টোবুলস বলেন, অলিকসন্দর যে সময় নদী পার হন; সে সময় পুরুর পুত্ত্র, ৬০ খানা রথ লইয়া সে স্থানে উপস্থিত হইয়াছিল। তিনি রথ হইতে নামিয়া অনায়াসে বাধা প্রদান করিতে পারিতেন, কিন্তু তাহা করেন নাই, তাই অলিকসন্দর দুস্তর নদী কোনরূপে পার হইতে সমর্থ হইয়াছিলেন। অনন্তর উভয় পক্ষে ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হয়। ইহাতে রক্তপাত বড় কম হয় নাই। আবার কোন লেখক বলেন, পুরুর পুত্ত্র বহুসৈন্যসহ আগমন করিয়া অলিকসন্দরকে নদী পার হইবার সময় প্রচণ্ড বাধা প্রদান করেন। পুরুর পুত্ত্র, সকলের অগ্রবর্ত্তী হইয়া যুদ্ধ করিবার সময় স্বহস্তে অলিকসন্দরকে আহত এবং তাঁহার বুকেফেলাস নামক প্রসিদ্ধ অশ্ববরকে নিহত করিয়া মেসিদনদিগের হৃদয়ে ত্রাসোৎপাদন করিয়াছিলেন। লগস পুত্ত্র তুরময় বলেন, প্রহরী মুখে পুরু, অলিকসন্দরের আগমনবার্ত্তা অবগত হইয়া স্বীয় পুত্ত্রের অধীনতায় ১২০ খানি রথ এবং দুই হাজার সৈনিকসহ রঙ্গভূমিতে প্রেরণ করেন। এসময়ের পূর্ব্বেই অলিকসন্দর নদী পার হইয়াছিলেন—তিনি সৈন্যগণকে আগমন করিতে দেখিয়া মনে করেন যে পুরু স্বয়ং তাঁহাকে আক্রমণ করিতে আগমন করিয়াছেন, নিকটে যত অশ্বারোহী সৈন্য পাইলেন তাহাই লইয়া তিনি শত্রুগণকে আক্রমণ করিলেন; উভয় পক্ষে ঘোর যুদ্ধ হইল—পূর্ব্ব রাত্রের বৃষ্টিতে ভূমি পঙ্কিল হইয়াছিল, রথ সকল তাহার উপর দিয়া গমনাগমন করাতে পৃথিবী যেন রথচক্র গ্রাস করিয়া ফেলিলেন; রথ অকর্ম্মণ্য হওয়াতে শত্রুগণ প্রবল হইয়া পড়িল—পুরুর পুত্ত্র, সকলের অগ্রবর্ত্তী হইয়া সৈন্যগণকে পরিচালনা করিয়া, মসিদনগণকে, ভারতীয় শৌর্য্যের পরিচয় প্রদান করিতে লাগিলেন। এইরূপে যুদ্ধকালে তিনি শত্রুহস্তে সাংঘাতিকরূপে আহত হইয়া শূরলোকে গমন করেন—এই অল্পকালের যুদ্ধে ৪ শত ভারতীয় বীর স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করিবার জন্য রাজপুত্ত্রের অনুগমন করিয়াছিলেন।
পুরু প্রথমে মনে করিয়াছিলেন, অভীসারের অধিশ্বর তাঁহার সাহায্যের জন্য সৈন্যগণসহ আগমন করিতেছেন, কিন্তু যখন একে একে হতাবশিষ্ট অশ্বারোহীগণ উপস্থিত হইয়া অলিকসন্দরের আগমন,—ভয়ঙ্কর যুদ্ধে রাজকুমারের শৌর্য্য প্রদর্শনপূর্ব্বক স্বর্গলোক গমন, ইত্যাদি কথা নিবেদন করিল, তখন তাঁহার ভ্রম দূর হইল। বীরহৃদয় পুরু, পুত্ত্রের মৃত্যু কথা শ্রবণ করিয়া বিচলিত না হইয়া, শত্রুর সম্মুখীন হইবার জন্য প্রস্তুত হইলেন। মহাবীর পুরু, শত্রুর অকস্মাৎ আগমনে বুদ্ধিহারা না হইয়া, অপর পার হইতে শত্রু যাহাতে আগমন করিতে না পারে, সেই অভিপ্রায়ে কতকগুলি হস্তী, পদাতিক এবং অশ্বারোহী রাখিয়া দিয়া, অবশিষ্টসমস্ত সৈন্য লইয়া, স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করিবার জন্য অলিকসন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করেন। গমন কালে যে স্থান সুপ্রস্ত কর্দ্দমহীন এবং কঠিন বলিয়া বোধ করিলেন, তথায় ব্যুহ রচনা করিয়া শত্রু আক্রমণ জন্য অপেক্ষা করিলেন। সম্মুখভাগে দুইশত হস্তী শ্রেণীবদ্ধ করিয়া রাখিলেন—ইহাদের সম্মুখে গুরুভার বর্ম্মধারী পদাতিক সকল অবস্থান করিল—হস্তীর উভয় পার্শ্বে তিন শত রথ এবং ৪ হাজার অশ্বারোহী আর সর্ব্ব পশ্চাতে ৩০ হাজার পদাতিক সৈন্য অবস্থান করিয়া মেসিদনদিগের হৃদয়ে বিভীষিকা উৎপাদন করিলেন। এই হস্তী সৈন্য কর্ত্তৃক সুরক্ষিত পদাতিক সৈন্য যেন অটল অচলের ন্যায় পরিদৃষ্ট হইল। রথগুলিও যেন সচক্র ক্ষুদ্রদুর্গ, এই রথ, ছয় জন অশ্বারোহীকে বহন করিয়া, যখন ঘূর্ণি বায়ুর ন্যায় শত্রুগণ মধ্যে প্রবাহিত হয়, সে সময় ইহার বেগ সহ্য করা বড় সামান্য কথা নহে। ইহার ছয়জন আরোহীর মধ্যে দুইজন ধানুস্ক, শত্রুসৈন্য মধ্যে নিশিত শর নিক্ষেপ করিয়া তাহাদিগকে উদ্বেজিত করিয়া থাকে, দুইজন লোক ঢালের সাহায্যে ইহাদিগকে বিপক্ষ আক্রমণ হইতে রক্ষা করিয়া থাকেন, আর দুইজন সারথীর কার্য্যে নিযুক্ত থাকিয়া অশ্ব পরিচালনা করিয়া থাকেন। যখন রথ, শত্রুগণের অত্যন্ত নিকটবর্ত্তী হয়, তখন অশ্বচালনার প্রয়োজন হয় না, সে সময় সারথীদ্বয় অশ্বরশ্মি পরিত্যাগ করিয়া শত্রুগণের উপর মুষল প্রাস প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্র প্রহার করিয়া থাকে। বিদেশী গ্রন্থকারেরা বলেন, পুরুর সেনাদলের সর্ব্বাগ্রে শত্রু নিসুদন মহাবীরের (হরিকুলেশের) আকৃতিঅঙ্কিতপতাকা শোভিত হইতেছিল। মহাসংগ্রামে ও ইহা পরিত্যাগ করিয়া যাওয়া অত্যন্ত গর্হনীয় বলিয়া বিবেচিত হইত। তাই ভারতীয় বীরগণ প্রাণপণ করিয়াও তাহা রক্ষা করিত। অত্যুন্নত শরীর মহাবীর পুরু, প্রকাণ্ডকায় হস্তীর উপর আরোহণ করিয়া সকলের উপরিভাগে পরিশোভিত হইলেন। মাসিদনরা, পুরুপরিচালিত হস্তীসৈন্যকর্ত্তৃক সুরক্ষিত সৈন্যদেখিয়া যেরূপ ভীত হইয়াছিল, সেইরূপ প্রকাণ্ড শরীর পুরুকে দেখিয়া ও তাহারা কিয়ৎকালের জন্য সম্মোহিত হইয়াছিল। অলিকসন্দর, দূর হইতে পুরু ও তাঁহার সৈন্যগণকে দেখিয়া পার্শ্বের লোককে বলিয়াছিলেন, “এত দিনের পর আমি আমার সাহসের অনুরূপ বিপদের সম্মুখীন হইলাম। এখন ঐ বন্য জন্তু, আর অসাধারণ বীর্য্যসম্পন্ন যোদ্ধাগণের সহিত যুগপৎ যুদ্ধ করিতে হইবে। “এই বলিয়া তিনি, কৈনসের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন, যখন আমি তুরময়, পাদ্দিকা, এবং হিপাইস্তিয়ন সহ, শত্রুর বামভাগে আক্রমণ করিব, যখন আমাদিগকে আপনি ঘোরতর যুদ্ধে প্রবৃত্ত দেখিবেন, তখন আপনি শত্রুর দক্ষিণভাগ আক্রমণ করিয়া তাহাদিগকে অধিকতর চঞ্চল করিয়া তুলিবেন। এই বলিয়া অলিকসন্দর, এণ্টিজিনস্,—লিওনেটনস্ ও তুরময়ের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আর আপনারা শত্রুর মধ্যভাগ প্রবলবেগে আক্রমণ করিয়া সম্মুখবর্ত্তী সৈন্যগণকে বিভীষিকাগ্রস্ত করিয়া তুলিবেন। আমাদের সুদীর্ঘ বর্ষা, ঐ সকল প্রকাণ্ডকার হস্তী ও ইহার চালকগণকে বিদ্ধ করিবার পক্ষে যেরূপ উপযোগী হইবে, এরূপ আর কিছুই হইবে না। আপনারা ইহার সাহায্যে হস্তী, সকল বিদ্ধ এবং ইহার আরোহীগণকে ভূতলে নিপাতিত করিয়া নিহত করুন। এই সকল হস্তী, আহত হইয়া আমাদের অপেক্ষা আমাদের শত্রুগণের যথেষ্ট ভীতি ও অনিষ্ট সম্পাদন করিবে।”
এই উপদেশ দিয়া অলিকসন্দর, প্রবলবেগে ঘোড়াকে দৌড় করাইয়া সর্ব্বাগ্রে শত্রুরদিকে গমন করিলেন। অলিকসন্দর কে শত্রুসহ ঘোরতর যুদ্ধেপ্রবৃত্ত দেখিয়া, কৈনস আর বিলম্ব না করিয়া প্রচণ্ডপরাক্রমে বামভাগ, আর পদাতিকগণ বিপুলবিক্রমে পুরুরসৈন্যের মধ্যভাগ আক্রমণ করিলেন। এই আক্রমণে, পুরুর সৈন্যসকল বিভিন্ন হইয়া পড়িল,—সেই অবকাশে অলিকসন্দরের সৈন্য, যে,যে স্থানে অবকাশ প্রাপ্ত হইলেন, সে সেই স্থানে প্রবেশ করিয়া ঘোরতর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন।
পুরুর সৈন্য মধ্যে যে ঈষৎ চঞ্চলতা লক্ষিত হইয়াছিল; তাহা তাহাদিগের মৃত্যুভয় জনিত, অথবা তাহাদিগের বীরত্বের হীনতাবশতঃ উৎপন্ন হয় নাই। গ্রীক গ্রন্থকারেরা বলেন, পুরুর হস্তী সকলকে, অলিকসন্দরের দ্রুতগামী অশ্ব সকল আক্রমণ করাতে, আর ধনুধারীগণ ক্ষিপ্রকারিতা সহকারে তাহাদিগের ধনুকে জ্যা আরোপন করিতে সমর্থ না হওয়াতে, ভারতীয় সৈন্যগণ মধ্যে চঞ্চলতা পরিলক্ষিত হইয়াছিল। আমাদের ধানুষ্কগণ ভূমিতে ধনুক স্থাপন করিয়া জ্যা যোজনা করিত, দুর্ভাগ্য বশতঃ বৃষ্টির জন্য ভূমি অত্যন্ত পিচ্ছিল হওয়াতে, তাহারা ধনুকে গুণযোগ করিতে শীঘ্ৰ কৃতকাৰ্য্য হইতে পারে নাই। মাসিদনেরা, ভারতীয় শর শক্রর হৃদয়বিদারণে কিরূপ সমৰ্থ, তাহা তাহারা অনুভূত করিয়া সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছেন। তাঁহারা বলেন শক্রর সুদৃঢ় হৃদয়াবরণ এই শরের গতিরোধ করিতে সমর্থ হয় না, ইহার আঘাত এরূপ দারুণ, ও এরূপ সাংঘাতিক, যে ইহাতে আহত হইলে, মানুষকে যমপুরীর দ্বারদেশ অতিক্রণ করিতে হইয়া থাকে। দুর্ভাগ্য বসতঃ যুদ্ধের প্রাক্কালে, শক্র বিনিপাতন শর সকল, বিশেষ কাৰ্য্যকর হয় নাই। মহাবীর পুরু, তাঁহার সৰ্ব্বোন্নত হস্তীপৃষ্ঠ হইতে যখন দেখিলেন, সৈন্যগণ মধ্যে কিঞ্চিৎ চঞ্চলতা আর্বিভূত হইয়াছে; তখন তিনি ঘোরতর বিক্রমে শত্রুসৈন্যের অভিমুখে ধাবিত হইলেন; এখন যুদ্ধস্থল ভীষণ হইতে ভীষণতর হইয়া উঠিল। হস্তী সকল যখন, শত্রুগণকে কখন পদদলিত, কখন শুণ্ড সহযোগে উৰ্দ্ধে উত্তোলন করিয়া নিপীড়ন করিতে লাগিল, তখন শত্রুগণ হৃদয়ে ঘোরতর নৈরাশ্য আসিয়া তাহাদিগকে অভিভূত করিয়া ফেলিল,—তখন বিজয় আশায় জলাঞ্জলি দিয়া তাহারা পলায়ণে প্রবৃত্ত হইল। যখন তাহারা বুঝিল, এই শত্রুর মহাদেশ হইতে প্রাণ লইয়া পলায়ণকরা সম্পূর্ণ অবম্ভব, তখন তাহারা কোনরূপে হৃদয় স্থীর করিয়া, পুরুসৈন্য আক্রমণ করিতে অগ্রসর হইল। ইতিপূৰ্ব্বে শত্রুরআক্রমণে, পুরুর সৈন্যদল বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছিল, তাহাদিগের মধ্যে কেহ মনে করিল একত্র হইয়া যুদ্ধ করিব, কেহ বা পৃথকভাবে, কেহবা শত্রু আক্রমণ করিলে যুদ্ধ করিব, কেহ বা শত্রুর পশ্চাদভাগে গমন করিয়া তাহাদিগকে আক্রমণ পূর্ব্বক বিভীষিকাগ্রস্তু করিতে সঙ্কল্প করিল। এইরূপ নায়কগণ, বিভিন্ন মতাবলম্বী হইয়া দুৰ্ব্বল হইয়া পড়িলেন—পুরুর আদেশ তাঁহারা সম্যক প্রকারে অবগত হইতে পারিলেন না –সুতরাং সকলে যুগপৎ শত্রুগণকে আক্রমণ করিয়া বিজয়লক্ষ্মীকে অঙ্কগত করিতে সমর্থ হইলেন না।
সমস্ত সৈন্যের সাহায্য না পাইলেও; মহাবাহু পুরু, তাহার দেহের অনুরূপ সাহস লইয়া, শত্রুসৈন্য মন্থন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। মাসিদনীয় যোদ্ধাগণ পশ্চাদপদ হইলেও পূর্ব্ব বীৰ্য্য স্মরণ করিয়া, মৃত্যুর কথা ভুলিয়া গিয়া, আবার ভীমপরাক্রমে পুরুসৈন্যকে আক্রমণ করিল। ভীমকায় ভারতীয় হস্তীর ভীষণ গর্জনে, ও তাহাদিগের নিদারুণ শুণ্ডাঘাতে, অলিকসন্দরের অশ্বারোহীগণ অগ্রসর হইতে সমর্থ হইল না; অশ্ব সকল বিভীষিকাগ্রস্ত হইল, সহযোদ্ধাগণ সৰ্ব্বজন সমক্ষে শূন্যে উত্তোলিত হইয়া, যখন হস্তী কর্তৃক নিষ্পেষিত হইতে লাগিল, শত্রুগণমধ্যে তখন এরূপ কোন পুরুষ ছিল না, এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখিয়া, যাহার হৃদয় অবসন্ন হয় নাই। অলিকসন্দর, সৈন্যগণকে এইরূপ বারংবার পশ্চাদপদ হইতে দেখিয়া, তিনি সৈন্যগণকে, সৰ্ব্বজন লক্ষ্য পুরুকে, লক্ষ্য করিয়া অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োগ করিতে আদেশ করিলেন, আর কতকগুলি সৈন্যকে,দীর্ঘদণ্ডে আবদ্ধ কাস্তিয়ার ন্যায় তীক্ষ্ণধার অস্ত্ৰ দিয়া হস্তীসকল আক্রমণ করিবার জন্য প্রেরণ করিলেন, অলিকসন্দরের সৈন্যগণ, যুগপৎ শরাদি অস্ত্ৰ শস্ত্র, নিক্ষেপ করিতে লাগিল, তাহরাও হস্তীর উপরিস্থিত যোদ্ধাত্রয়ের আঘাতে, আহত হইতে লাগিল,যাহার উদ্দেশে পুরুর অস্ত্রনিক্ষিপ্ত হইল, সে তাহার বাহনসহ, অথবা পার্শ্ববর্তী জনগণসহ, অবিলম্বে যমপুরীর সংখ্যাবৰ্দ্ধন করিতে লাগিল । পুরুর এই লোকাতীত বল দেখিয়া, গ্রীকেরা বিমুঢ় হইয়া পড়িল। যে জয়শ্ৰী মাসিদনগণকে বারংবার পরি ত্যাগ করিয়া, পুরুকে ভজনা করিবার আগ্রহ প্রকাশ করিতেছিলেন, তিনি এক্ষণে তটস্থ ভাব অবলম্বন করিলেন, মাসিদনগণ, তাঁহাকে বলপূৰ্ব্বক আয়ত্ম করিবার জন্য উগ্ৰমূৰ্ত্তি ধারণ করিয়া, হস্তীর পা, শুঁড়, প্রভৃতি স্থান, কাস্তের দ্বারা কৰ্ত্তনকরিতে আরম্ভ করিল। মাসিদনগণ, মৃত্যুভয়ে বিভীষিকাগ্রস্ত হইয়া, কৰ্ত্তব্য ভুলিয়া না গিয়া, প্রবল শত্রুকে প্রচণ্ডরূপে আক্রমণ করিয়াছিলেন, বলিয়া আবার জয়যুক্ত হইলেন। হস্তী সকল শত্রুর দারুণ আঘাতে আহত হইয়া, সেই স্থানে প্রাণ পরিত্যাগ করিল, কতকগুলি ঘোরতর গর্জন করিয়া স্বপক্ষীয়গণ মধ্যে প্রবেশ করিয়া অনর্থ উৎপাদন করিতে লাগিল, সৈন্যগণ মধ্যে এইরূপ ঘোরতর বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হওয়াতে, মাসিদনেরা অধিকতর পরাক্রমের সহিত আক্রমণ করিল। সৈন্যগণকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিবার জন্য, পুরু যথেষ্টরূপে চেষ্টা করিলেন, তাহার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হইল। তিনি শত্রুর প্রহারে জর্জ্জরিত হইলেও, যেরূপ অদ্ভুত পরাক্রমের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলেন; তাহা তাঁহার শত্রুরা যদি লিপিবদ্ধ না করিতেন, তাহা হইলে তাহার পতিত স্বদেশবাসী তাহাতে বিশ্বাস সংস্থাপন করিতেন কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ উপস্থিত হইয়া থাকে। গ্ৰীক যোদ্ধারা, মুক্তকণ্ঠে ভারতীয় যোদ্ধার গুণকীৰ্ত্তণ করিয়াছেন। অলিকসন্দর যথার্থই বলিয়াছিলেন যে,“ভারতে তিনি তাঁহার সাহসের অনুরূপ প্রতিযোদ্ধা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।”
যে হস্তী, শত্রুগণকে মর্দ্দন করিবার জন্য প্রযুক্ত হইয়াছিল, অদৃষ্টক্রমে সেই হস্তীই স্বপক্ষের ধ্বংশের কারণ স্বরূপ হইয়া উঠিল,—যে ভূমি রক্ষা করিবার জন্য ভারতীয় বীরগণ, অকাতরে রুধিরধারা প্রবাহিত করিয়া পূজা করিয়াছিল - সেই ভূমিই রথচক্র গ্রাস করায়, এবং ধনুকে জ্যা যোজনার সাহায্য না করাতে, আজ ভারতবাসীরা বিদেশী শত্রুর সমুখ হইতে পলায়ণপর হইল। আহত হস্তী সকল, যাতনায় ভয়ঙ্কর চীৎকার করিয়া চতুর্দ্দিকে গমন করিলেও, মহাপ্রাণ পুরু, তখনও, সকলের অগ্রবর্ত্তী হইয়া যেন পুষ্পিত কিংশুকবৃক্ষের ন্যায় শোভা পাইতেছিলেন । কতিপয় সহচরসহ যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করিলেও তিনি শত্রুগণের দুদ্ধৰ্ষনীয় ছিলেন,—অদ্ভূত বীৰ্য্য পুরু, সকলের লক্ষ্যের বিষয়, এবং সকলের প্রহরণে জর্জ্জরিত হইলেও, তথাপি ও শত্রুগণ তাঁহার নিকটবর্ত্তী হইতে সাহসী হয় নাই। যখন নবধারায় শরীর হইতে অতিমাত্র শোণিত নিসৃত হওয়াতে তিনি দুৰ্ব্বল হইয়া পড়িলেন, যখন চেতনা তাহার শারীরিক দুঃখে অভিভূত হইয় পড়ে, তখন হস্তী চালক, সংগ্রাম স্থলে আর অবস্থান করা অবিবেচনার কার্য্য বিবেচনা করিয়া, স্বীয় প্রভুকে রক্ষা করিবার জন্য, যুদ্ধস্থল পরিত্যাগ করিয়া গমন করেন। অলিকসন্দর, পুরুকে হস্তগত করিবার জন্য দ্রুতবেগে অনুসরণ করিলেন কিন্তু তাঁহার ঘোটক, অত্যন্ত ক্ষতবিক্ষত হওয়াতে গমনকালে ভূপতিত হইয়া পঞ্চত্ব লাভ করে। অলিকসন্দর, তক্ষশিলার ভ্রাতাকে, পুরুর উদ্দেশে প্রেরণ করিয়া বলিয়া পাঠাইলেন, তিনি যেন স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আর যুদ্ধ না করিয়া বশ্যতা স্বীকার করেন। তক্ষশিলার ভ্ৰাতা, মহাবাহু পুরুর নিকট উপস্থিত হইয়া কথোপকথনে প্রবৃত্ত হইলে—পুরু, তাঁহার এই সুপরিচিত স্বর, কোন কণ্ঠ হইতে বহিৰ্গত হইতেছে, তাহা বুঝিতে পারিয়া বলিলেন, “ইহার ভ্রাতা, তক্ষশিলা-রাজ্য ও সিংহাসন বৈদেশিকদিগের চরণতলে অর্পণ করিয়াছে”, এই বলিয়া সেই শিথিল বাহু পুরু, তাহার পার্শ্বস্থিত অস্ত্র, তাহার উদ্দেশে নিক্ষেপ করিলে, গ্রীক গ্রন্থকারেরা বলেন, তক্ষশিলার ভ্রাতা যদি সরিয়া না যাইতেন, তাহা হইলে তাঁহার, হৃদয় ভেদ করিয়া সেই ভীষণ অস্ত্র বহির্গত হইত। পুরু যখন দেখিলেন, তাঁহার ন্যায় তাঁহার হস্তীও অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছে, এরূপ অবস্থায় কোন নিরাপদ স্থানে পৌঁছান দুরূহ ব্যাপার, তখন তিনি গমনে প্রবৃত্ত না হইয়া, অবশিষ্ট সৈন্য লইয়া বীরলোকে গমন করিবার জন্য প্রস্তুত হইলেন। নিৰ্ব্বানোন্মুখ প্রদীপ যেরূপ দীপ্তিপ্রকাশ করিয়া নিৰ্ব্বাণ লাভ করে; সেইরূপ মহাভাগ পুরু, ঘোরতর পরাক্রমে, যাহারা তাঁহার অনুসরণ করিতেছিল, তাহাদিগকে আক্রমণ করিলেন। আবার যেন প্রলঙ্কর যুদ্ধের অভিনয় আরম্ভ হইল। মৃত্যুভয় বিরহিত ভারতীয় যোদ্ধারা, কোনরূপ কাতরতা প্রকাশ না করিয়া, যুদ্ধ করিতে লাগিলেন— প্রতিক্ষণেই শত্রুগণ নিহত হইলেও, পশ্চাদ্বর্ত্তী সৈন্যগন আসিয়া তাহাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করিতে লাগিল, ইত্যবসরে অলিকসন্দর আগমন করিয়া, তাহদের সহিত মিলিত হইলেন । যুদ্ধ শেষ হইবার যত সমীপবৰ্ত্তী হইল, ততই যেন তাহা ঘোরতররূপে বৰ্দ্ধিত হইতে লাগিল। সকলেই পুরুকে চতুর্দ্দিক হইতে লক্ষ্য করিয়া ভীষণ অস্ত্রশস্ত্র নিক্ষেপ করিতে লাগিল। এই সময় একটি অনুকূল ঘটনায় যুদ্ধ অভিনয় যেন শেষ হইবার উপক্রম হইল। ক্ষত-বিক্ষতাঙ্গ মহাপ্রাণ পুরু, হস্তীপৃষ্ঠে উপবেশন করিতে সমর্থ হইলেন না, মাহুত মনে করিল, তিনি বুঝি নামিবার জন্য ঈঙ্গিত করিতেছেন। মাহুত হস্তীকে বসিতে আদেশ করিলেন—রাজহস্তীকে উপবেশন করিতে দেখিয়া, অন্যান্য সমস্ত হস্তী তাহাদের শিক্ষা অনুসারে সকলেই উপবেশন করিল-এই সুযোগে মাসিদনগণ ঘোরতররূপে আক্রমণ করিল। পুরু ভূপতিত হইলে, তাঁহার হস্তী বিশ্বস্ত চিকিৎসকের ন্যায় নিপুণতা সহকারে তাঁহার শরীর হইতে বিদ্ধ অস্ত্র সকল উত্তোলন করিতে লাগিল, এই সময় শত্রুরা পুরুকে নিহত বিবেচনা করিয়া তাঁহার শরীর হইতে বৰ্ম্ম ও বহুমুল্য রত্ন লুণ্ঠন করিবার জন্য অগ্রসর হইল। শত্রুগণকে আগমন করিতে দেখিয়া হস্তী শুণ্ড দ্বারা প্রভুকে পৃষ্ঠে স্থাপন করিয়া, বিপক্ষগণকে নিপীড়ন করিতে লাগিল। চতুর্দ্দিক হইতে সাংঘাতিকরূপে আহত হইয়া, পুরুর হস্তী মৃত্যুমুখে পতিত হইলে পর, অলিকসন্দর, পুরুর মুর্চ্ছিত শরীর হস্তগত করিতে সমর্থ হইলেন। অলিকসন্দর, পুরুকে হস্তগত করিয়া, তাঁহার শরীর ও মুখশ্ৰী দেখিয়া মুগ্ধ হইয়া, মূর্চ্ছা অবসানের পর জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি আমায় কাছে কিরূপ ব্যবহার প্রত্যাশা করেন।” তেজম্বি পুরু, দৰ্পের সহিত বলিলেন, “অলিকসন্দর! রাজার যোগ্য ব্যবহার করুন।” উত্তরে অলিকসদর প্রসন্ন হইয়া বলিলেন, “আমি আপনার সহিত সেইরূপ ব্যবহার করিব, কিন্তু আপনি আমার কাছে আর কি আকাঙ্খা করেন তাহা বলুন?” পুরু প্রত্যুত্তরে বলিলেন, আমার উত্তরে সমস্তই ব্যক্ত হইয়াছে। অলিকসন্দর, পুরুর বৰ্ত্তমান অবস্থাতেও তাঁহার বীরত্ব, হৃদয়ের দৃঢ়তা দেখিয়া বিস্মিত হইলেন। এবং তাঁহাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করিয়া স্বীয় মহত্ত্বের ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় প্রদান করিলেন।
৩২৬ খৃঃ পুঃ আষাড় মাষের শেষ ভাগে, পুরুর সহিত অলিকসন্দরের এই ঘোরতর যুদ্ধ সংঘটিত হইয়াছিল। ডিওডোরস বলেন, এই ঘোরতর সংগ্রামে ১২হাজার ভারতবাসী নিহত এবং ৯ হাজার বন্দী হইয়াছিল । অপর পক্ষে ২৮০ অশ্বারোহী এৰং শত পদাতিক নিহত হইয়াছিল। প্লুটার্ক বলেন, আট ঘণ্টা ধরিয়া এই ঘোরতর যুদ্ধ হইয়াছিল।
অলিকসন্দর, তাঁহার এই অসাধারণ বিজয়কে স্মরণীয় করিবার জন্য দুইটি নগর নিৰ্ম্মাণ করেন। যুদ্ধস্থলে যে নগর প্রতিষ্ঠা করেন তাহার নাম নিকাইয়া, (Nikaia) অপরটি তাহার ঘোটকের নামানুসারে বুকাফেলিয়া নামে অভিহিত করেন । যাঁহারা ঝিলামকে বুকাফেলিয়া, এবং সুকচানপুরকে, নিকাইয়া নামে অভিহিত করেন, তাঁহাদিগের প্রতি আমাদের জিজ্ঞাস্য এই যে, অলিকসন্দর, তাঁহার সেনানীকে উপদেশ দিয়াছিলেন যে, শত্রুগণকে পলায়ন পর দেখিলে নদী উত্তীর্ণ হইয়া তাহদিগকে অনুসরণ করিবে। ফল কথা ঝিলাম হইতে, সুকচানপুর কোনরূপে দৃষ্টিগোচর হয় না, অথচ জালালপুরের পাহাড় হইতে মঙ্গের যুদ্ধক্ষেত্র বেশ দেখিতে পাওয়া যায়। অপর মতে, প্রথমোক্ত স্থানটি বুকাফেলিয়া এবং শেষোক্ত স্থানটি নিকাইয়া, নামে অভিহিত হয়। মঙ্গের প্রাচীণত্ব সম্বন্ধে কথিত হয় যে, ঝিলাম খাল খননকালে এই স্থান হইতে অতি প্রাচীন তাম্র ও রৌপ্য মুদ্রা প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে; ইহা ব্যতীত এই স্থানের নিকটে বর্ত্তমাঙ্কালেও গ্রীক নিহত যোদ্ধাগণের সমাধিভূমি দর্শিত হইয় থাকে।
মহাবাহু পুরু, কোন বর্ণ উজ্জ্বল করিয়াছিলেন,বর্ত্তমান কালে তাহা নিশ্চয় করিয়া বলা বড় সামান্য কথা নহে। ভারতবর্ষে অতি প্রাচীন কালে ব্রাহ্মণ নরপতিগণ রাজত্ব করিতেন, একথা অতি পুরাতন গ্রন্থে উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। বিশেষতঃ অত্যাচার হইতে স্বদেশকে রক্ষা করিবারজন্য, বাৎস গোত্রের ব্রাহ্মণেরা যে প্রকার বাহু বলের পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন, ক্ষত্রিয়দিগের মধ্যেও সেরূপ উদাহরণ নিতান্ত সুলভ নহে। এক সময় কাবুল প্রভৃতি প্রদেশ ব্রাহ্মণ নরপতিগণ কর্তৃক শাসিত হইয়াছিল— বর্ত্তমান কালেও ভারতবর্ষে ক্ষত্রিয়ধর্ম্মা ব্রাহ্মণের অসদ্ভাব নাই। অনেকে মহাবাহু পুরু, মুজহাল ব্রাহ্মণ ছিলেন বলিয়া বিবেচনা করিয়া থাকেন। তাঁহাদিগের মধ্যে কেহ বলেন, তিনি কাশ্যপ, কেহ বলেন তিনি ভরদ্বাজ গোত্রজ ছিলেন। তিনি যে কোন বর্ণ বা গোত্রকে উজ্জ্বল করুন না কেন, তিনি ভারতবাসীর সাধারণ সম্পত্তি, তাঁহার উপর সকলেরই সমান অধিকার একথা বলাই বাহুল্য।
এই মহাযুদ্ধে যে সকল গ্ৰীক নিহত হইয়াছিল; মহাবীর অলিকসন্দর, মহা সমারোহের সহিত তাহদের সমাহিত করেন। গ্ৰীক দেবদেবীর উদ্দেশে, এ স্থানে নানাপ্রকার যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করিয়া কএক দিন উৎসবে অতিবাহিত করেন ।
- ↑ আমাদের ভারতীয় নাম বিদেশীর জড় জিহ্বায় কিরূপে উচ্চারিত হইয়াছে তাহা বিতস্তাতে কিছুমাত্র বুঝিতে পারা যায়। ইহা কখন হাইডাস পেগ, কখন বা বিডাসপেস ইত্যাদি শব্দে উচ্চারিত হইয়াছে। মুসলমানদের সময় হইতে ইহা ঝিলাম নামে কথিত হয়। পুরাতন ঝিলাম গ্রাম বর্ত্তমান ঝিলামের অপরপারে আগে ইহার নীচে নদী প্রবাহিত হইত।
- ↑ মহাভাষ্যকার পতঞ্জলি একস্থানে বলিয়াছেন “হলে শকটং নাবং বহতি জলে নৌ শকটং বহতি।” পররাজ্যস্থিত নদী প্রভৃতি আক্রমণ করিবার জন্য শকটে করিয়া নৌকা লইয়া যাইবার প্রথা ভারতবর্ষে বহুপূর্ব্বে প্রচলিত ছিল।
- ↑ ইহার প্রাচীন নাম মাণিক্যালয়, রেলপথে রাওলপিণ্ডীতে গমনকালে, এই স্থানের সুন্দর বৌদ্ধ স্তুপটি দেখিতে পাওয়া যায়।