ভারতে অলিকসন্দর/প্রথম ভাগ/পঞ্চম অধ্যায়
পঞ্চম অধ্যায়।
উদ্যোগী পুরুষসিংহ লক্ষ্মীকে প্রাপ্ত হইয়া থাকেন—আর হতভাগা কাপুরুষগণ দৈব অভিষ্ট অর্থ প্রদান করিবেন বলিয়া নিশ্চিন্তভাবে অবস্থান করিয়া থাকে। অলিকসন্দর এক বৎসর পূর্ব্বে যখন পৈত্রিক সিংহাসনে আরোহণ করেন, সে সময় তিনি ষাটটি মাত্র ট্যালেণ্ট মুদ্রা এবং কয়েকটি রৌপ্য পাত্র রাজকোয়ে প্রাপ্ত হন ইহার সহিত তিনি পাঁচশত ট্যালাণ্ট পৈত্রিক ঋণ ও প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। এরূপ অবস্থায় অন্য লোকে পতিত হইলে ঋণের দায়ে এবং শত্রুগণের আক্রমণে কিংকর্ত্তব্য বিমূঢ় হইয়া পড়ে। পুরুষ কিন্তু বিপদে পতিত হইলে, পশুর ন্যায় অবস্থান না করিয়া, মানুষের ন্যায় বিপদের সম্মুখীন হইয়া নিজের প্রাধান্য সংস্থাপন করিয়া থাকেন। অলিকসন্দর মানুষ ছিলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি দেশের লোককেও মানুষ করিয়াছিলেন। তাঁহার সঙ্গগুণে তাঁহার দেশবাসীও বিপদকালে কাপুরুষের ন্যায় অবস্থান না করিয়া, স্বদেশের গৌরব অর্জ্জন করিয়াছেন। অলিকসন্দর মানুষ ছিলেন বলিয়াই সমগ্র গ্রীসবাসীকে মানুষের ন্যায় পরিচালনা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। অনেক সময় মানুষ, পশু প্রকৃতি অনুসরণ করিয়া থাকে। একবার ভয় হৃদয়ে বদ্ধমূল হইলে, দেশশুদ্ধ লোক বিভীষিকাগ্রস্ত হইয়া থাকে। সে ভয়ের কারণ অতি সামান্য হইলেও তাহা দূর করিতে, তাহাদের প্রচুর শক্তি থাকিলেও, কিন্তু তাহার হস্তপদ শিথিল হইয়া পড়ে। বক্তৃতা বা লেখার জোরে মানুষ ত্রিভুবন কাঁপাইতে সমর্থ হইলেও, কিন্তু নিজের হৃৎকম্প দূর করিবার সময়, সে বিহ্বল হইয়া পড়ে। গ্রীসের অবস্থা ঠিক এইরূপ হইয়াছিল, যে গ্রীস সকলের গুরুস্থানীয় ছিল, যে এথেন্স সকল বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিয়াছিল, সেই গ্রীসবাসী, থেব ধ্বংসের পর যেন ক্লীবত্বকে প্রাপ্ত হইল। নিজেদের দৈর্ব্বল্য দূর করিতে সমর্থ হইল না। বিংশতি বর্ষীয় বালক পরিচালিত বর্ব্বরদের হস্তে লাঞ্ছিত হইল। যে গ্রীসবাসী, পারস্যপতির বিপুলবাহিনী রোধ করিতে সমর্থ হইয়াছিল, ভয়বিহ্বল চিত্ত সেই গ্রীকবাসী এক্ষণে একজন বালকের ইচ্ছা অনুসারে পুতুলের ন্যায় উঠীতে ও বসিতে লাগিল। বুদ্ধিমান অলিকসন্দর, এথেন্সবানীর স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ, বা ডিমস্থিনিস প্রমুখ বক্তাদের উপর কোনরূপ দণ্ডবিধান না করিয়া, তাঁহাদের হৃদয়রঞ্জন করিতে চেষ্টা করেন। এথেনীয়রা কিন্তু ভিতরে ভিতরে পারস্য পতির সহিত মিলিত হইয়া মাসিদনের সর্ব্বনাশ করিতে বড় কম চেষ্টিত ছিলেন না।
করিন্থের সভা হইতে অলিকসন্দর স্বীয় রাজধানীতে গমন করিয়া এসিয়া গমনের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। ৩৩৪ খৃঃ পূঃ বসন্ত কালের প্রথমভাগে অলিকসন্দরের উদ্যোগ পর্ব্বের সমাপ্ত হয়। এই অদ্ভুত বালকের এ সময়ের অবস্থা ভাবিলে শরীর লোমাঞ্চিত হইয়া উঠে। তাঁহার আকাশের ন্যায় উচ্চ আশা, চিন্তা করিলে স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ করিতেছি বলিয়া ভ্রম হইয়া থাকে। আমরা নিশ্চেষ্ট পঙ্গু, এবং স্বপ্নরাজ্যের অধিবাসী বলিয়াই, আমাদের এই মতিভ্রম হইয়া থাকে। বাস্তবিকপক্ষে ইহাতে বিস্মিত হইবার কিছুই কারণ নাই। শ্রীভগবান আমাদের প্রত্যেকেই সকল প্রকার সদ্গুণে বিভূষিত করিয়াছেন, আমরা তাহার সদ্ব্যবহার করি না বলিয়াই আমরা তাহার ফলভোগে বঞ্চিত হইয়াছি মাত্র।
অলিকসন্দর, এণ্টিপিটারকে মাসিদদের এবং গ্রীসের তত্ত্বাবধারক পদে নিযুক্ত করিলেন। আলেকসন্দর যে কার্য্যে ব্রতী হইলেন, সে কার্য্যের তুলনায় তাঁহার অর্থ বা লোকবল খুব কমই ছিল। অর্থবল সম্বন্ধে এরূপ কথিত আছে, এ সময় অলিকসন্দরের কাছে মোটে সত্তরটি মাত্র ট্যালাণ্ট বর্ত্তমান ছিল। অন্য একজন বলেন যে,এক মাস সৈন্যগণের ব্যয় নির্ব্বাহ করিতে সমর্থ হন, এরূপ মাত্র অর্থ তাঁহার নিকটে ছিল। অপর একজন, বলেন, অলিকসন্দর এসিয়া বিজয়ের জন্য দুইশত ট্যালেণ্ট ঋণ গ্রহণ করিয়া এই অদ্ভুত কার্য্যে ব্রতী হইয়াছিলেন। অলিকসন্দর দুই এক মাসের ব্যয় নির্ব্বাহ করিতে সমর্থ হন এইরূপ অর্থ লইয়া জন্মভূমি হইতে বহুদূরে বিদেশে একজন প্রবল পরাক্রান্ত নরপতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে যাত্রা করিলেন। অলিকসন্দরের জনবলও বড় বেশী ছিল না কেহ, বলেন ৩০ হাজার পদাতিক, ৪ হাজার ৫ শত অশ্বারোহী, অন্য কেহ বলেন ৩১ হাজার পদাতিক, এবং ৫ হাজার অশ্বারোহী, এসিয়া বিজয়ের জন্য অলিকসন্দরের অনুগমন করিয়াছিল। কি ধনবল, কি জনবল, অলিকসন্দর সকল বিষয়ে নগন্য হইলেও তিনি হৃদয়ের বলে সর্ব্বাপেক্ষা বলীয়ান ছিলেন। পারস্যপতি, ধনবলে বা জনবলে সর্ব্বাপেক্ষা বলীয়ান হইলেও, তিনি হৃদয়ের বলে মাসিদনপতির কাছে পরাভূত হইয়াছিলেন। তাহা না হইলে তিনি একদিনে মুষ্টিমেয় ইয়ুরোপায়কে এক ফুৎকারে ধুলির ন্যায় উড়াইয়া দিতে পারিতেন। হৃদয়ের বল না থাকিলে মানুষ পশু অপেক্ষা অধম হইয়া থাকে।
অলিকসন্দর যাত্রা করিবার পূর্ব্বে, তাঁহার সহচরগণের মধ্যে কাহাকে এ গ্রামের, কাহাকেও গ্রামের রাজস্ব প্রদান করেন। এইরূপে রাজ্যের প্রায় সমস্ত স্থান প্রদত্ত হইলে, অলিকসন্দরের একজন সহচর সেনানী তাঁহাকে জিজ্ঞসা করেন, সবইত আপনি দিয়া ফেলিলেন, নিজের জন্য কি রাখিলেন? প্রত্যুত্তরে অলিকসন্দর বলিলেন, “আশা”। বালকের এই কথা শুনিয়া বয়স্থ সৈনিক পুরুষের মস্তক লজ্জায় অবনত হইল। তাঁহার ভিতর দিয়া যেন এক অদ্ভুত শক্তি প্রবাহিত হইল—চৈতন্য প্রাপ্তির পর তিনি বলিলেন, “আমরা আপনার যুদ্ধযাত্রা জনিত ক্লেশের এবং জয় পরাজয় জনিত সুখদুঃখের ভাগগ্রাহী, অতএব আমাদিগকে আপনার আশার ভাগগ্রাহী করুন” ইহা বলিয়া তিনি স্বীয়বৃত্তি প্রত্যাখান করেন এইরূপে অনেকেই ভূমি সম্পত্তি প্রত্যর্পণ করিয়াছিলেন।
অলিকসন্দর আশা দেবীর এক নিষ্ঠ ভক্ত, একনিষ্ঠ না হইলে সফলতা লাভ অসম্ভব—অলিকসন্দর বিদেশে নানাপ্রকার প্রতিকুলতার মধ্যবর্ত্তী হইলেও প্রায় সর্ব্বত্র সাফল্যলাভ করিয়াছেন। কোন স্থানেই তাঁহাকে খাদ্যদ্রব্য, রাস্তা, ঘাট প্রভৃতির জন্য বিশেষ অসুবিধা ভোগ করিতে হয় নাই। অথচ তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী পারসীকগণকে নিজের দেশে, খাদ্যদ্রব্যের অভাব এবং রাস্তা ঘাট প্রভৃতির জন্য বিশেষ অসুবিধা ভোগ করিতে হইয়াছিল। যোগ্য সর্ব্বত্রই জয়যুক্ত এবং অযোগ্য নিজের গৃহেও নিগৃহীত হইয়া থাকে। ইতিহাস সকলকে যোগ্য হইতে শিক্ষা প্রদান করিয়া থাকেন। যিনি এ উপদেশ গ্রহণ করিতে বিলম্ব করেন মৃত্যু ও তাহাকে অবিলম্বে গ্রাস করিয়া থাকে। তাই পারসীকরা অযোগ্য হওয়ার জন্য নিন্দনীয় পরাভবকে প্রাপ্ত হহয়াছিল।
অলিকসন্দরের এ অভিযান, একটু ভাল করিয়া অধ্যয়ন করিলে দেখিতে পাওয়া যায় যে, নৌবলে হীনবল হইলেও স্থলযুদ্ধে প্রাধান্য প্রতিষ্টা করিতে সমর্থ হওয়া যাইতে পারে। সে সময় পারসীকেরা, অলিকসন্দর অপেক্ষা বহুগুণে নৌবলে বলীয়ান ছিলেন। তাঁহাদিগের নৌবল কোন কার্য্যেই আসে নাই। পারসীকেরা, জলপথে মেসিডোনিয়া আক্রমণ করিয়া অলিকসন্দরকে ব্যতিব্যস্ত করিতে পারিত, কিন্তু তাহা তাহারা করিতে পারে নাই। অলিকসন্দরের বাহুবলের কাছে পরাজিত হওয়াতে তাহারা বিভীষিকা গ্রস্ত হইয়াছিল, তাহাদের বাহুবল ও বুদ্ধিবল যেন লোপ পাইয়াছিল। স্থলযুদ্ধে যদি বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করা যায়, তাহা হইলে, শত্রু নৌবলে বিশেষ বলবান হইলেও সমুদ্রের উপকূলবর্ত্তী ভূভাগে সময় সময় কিছু উপদ্রব ব্যতীত বড় কিছু করিতে পারে না।
পারস্য জয়ে বহির্গত হইবার পূর্ব্বে অলিকসন্দরের গুরুজনবর্গ তাঁহাকে কিছুদিন বিলম্ব করিতে পরামর্শ প্রদান করেন। অলিকসন্দরের এ পর্য্যন্ত সন্তান সন্ততি জন্মগ্রহণ করে নাই। তাঁহারা বলেন, যদি যুদ্ধস্থলে দৈবক্রমে প্রাণ বিনষ্ট হয়, সে সময় সিংহাসনের উত্তরাধিকারী না থাকিলে রাজ্যমধ্যে ঘোরতর বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইবে, তখন তাঁহার জয়ের কোন মূল্য থাকিবে না। বিজিগীষু অলিকসন্দরের নিকট এ সকল যুক্তি কোনরূপ স্থান লাভ করিতে সমর্থ হইল না। যিনি স্বদেশের শত্রু ধ্বংস করিতে বদ্ধ পরিকর, তিনি নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ না করিয়া স্বদেশের গৌরব সাধনের জন্য দ্রুতবেগে অগ্রসর হইয়া থাকেন। আমাদের ভারতবর্ষের একজন দিগ্বিজয়ী রাজাকে সাংসারিক মায়া মমতার কথা স্মরণ করাইয়া গৃহে থাকিতে অনুরোধ করিলে, কবি তাঁহার মুখ দিয়া বলাইয়াছেন যে, “ভগবান সূর্য্যনারায়ণ সমস্ত জগৎ প্রদক্ষিণ না করিয়া যেরূপ সন্ধ্যাদেবীর উপাসনা করেন না, সেইরূপ অসমাপ্তক্রিয় বিজিগীষু মনস্বীর হৃদয়ে কখন স্ত্রী চিন্তা স্থানলাভ করিতে সমর্থ হয় না।”[১] মনুষ্য প্রকৃতি সকল দেশেই সমান। যে হৃদয়ে শত্রুকৃত অবমাননার প্রতিশোধ লইবার প্রবল বাসনা স্থান লাভ করিয়াছে, অথবা স্বদেশের গৌরব দিগান্তরে প্রতিষ্ঠা করিবার পবিত্র চেষ্টা যে হৃদয়কে ব্যাকুলিত করে, সে হৃদয়ে স্ত্রী পুত্রের ক্ষুদ্র চিন্তা স্থান লাভ করিয়া মনুষ্যকে কখন কর্ত্তব্য পথ হইতে বিচলিত করিতে সমর্থ হয় না। সে সময় স্ত্রী পুত্রের চিন্তা ক্ষণকালের জন্যও অলিকসন্দরকে কর্ত্তব্য পথ হইতে স্খলিত করিতে সমর্থ হয় নাই। অলিকসন্দর, এণ্টিপিটারের হস্তে রাজ্য রক্ষার জন্য ১২ হাজার পদাতিক এবং দেড় হাজার অশ্বারোহী সৈন্য রাখিয়া এসিয়া বিজয়ের জন্য বহির্গত হন।
একুশদিন পথ অতিক্রমণের পর, অলিকসন্দর, হেলিসপণ্ট বা দারদেনেলিসের তট ভুমিতে উপস্থিত হন। ইহার দৈর্ঘ প্রায় ৪০ মাইল এবং বিস্তার ৩/৪ হইতে ৪ ১/২ মাইল হইবে। ইহার তট উচ্চ না হওয়াতে পারাপারের পক্ষে বিশেষ অসুবিধাজনক নহে। যে স্থানে সেতু নির্ম্মাণ করিয়া পারস্যপতি জেরাকসাস ইয়ুরোপ আক্রমণ করিয়াছিলেন, অলিকসন্দরও সেইস্থান হইতে এসিয়াতে গমন করেন। চতুর্দ্দশ শতাব্দীতে এসিয়াবাসীরা এই স্থানে পার হইয়া দলে দলে গমন করিয়া ইয়ুরোপীয়গণকে পরাস্ত করিয়া ইয়ুরোপীয় ভূমি অধিকার করেন। গত শতাব্দীর প্রথম ভাগে ইংরেজ কবি বাইরণ ইহা সন্তরণ করিয়া পার হইয়াছিলেন। এই স্থান এইরূপ নানা কারণে পৃথিবীর সাহিত্যে স্মরণীয় স্থান লাভ করিয়াছে।
অলিকসন্দর, দারদেনেলিসের তটে বেদী নির্ম্মাণ এবং ইয়ুরোপের অধিষ্ঠাতৃ দেবতার পূজা করিয়া সৈন্যগণসহ যাত্রা করিলেন। সমুদ্র পার হইবার জন্য ১৬০ খানি যুদ্ধ জাহাজ ব্যতীত আরো কতকগুলি বাণিজ্য জাহাজও উপস্থিত হইয়াছিল। এথিনিয়নরা এই সকল জাহাজের মধ্যে কুড়ি খানি যুদ্ধ জাহাজ প্রেরণ করিয়া অলিকসন্দরের তুষ্টি সাধন করিয়াছিল। অলিকসন্দর, পারমিনিওর উপর সৈন্য পরিচালন ভার প্রদান করিয়া, স্বয়ং ট্রয়ক্ষেত্রে প্রাচীন যোদ্ধাদের সমাধিভূমি দর্শন এবং তাঁহাদিগের পূজা করিতে মনস্থ করিলেন। অলিকসন্দর, অস্ত্র শস্ত্রে বিভূষিত হইয়া সর্ব্বপ্রথমে নৌকা হইতে লম্ফপ্রদান করিয়া এসিয়ার ভূমিতে বর্ষা বিদ্ধ করিয়া অবতরণ করিলেন। এ স্থানেও তিনি নিজের গৌরব জ্ঞাপনের জন্য বেদী নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। এস্থান হইতে তিনি এচিলিসের সমাধি দর্শন করিয়া তাহা পত্র পুষ্পে শোভিত করিয়াছিলেন। যে মন্দিরে ট্রয়ের যোদ্ধাগণের অস্ত্র শস্ত্র রক্ষিত হইয়াছিল, অলিকসন্দর, নিজের এক প্রস্থ অস্ত্র শস্ত্র তথায় রাখিয়া দেন, এবং প্রাচীন অস্ত্র শস্ত্রেরও কিছু গ্রহণ করেন। এই সকল অস্ত্র শস্ত্র এক জন ব্যক্তি সকলের অগ্রে বহন করিয়া যুদ্ধস্থলে গমন করিত। ইহাতে তাঁহার অনুযাত্রীগণ বিবেচনা করিত অলিকসন্দর প্রাচীন যোদ্ধাদের ন্যায় অজেয় এবং সেই সকল স্বর্গীয় যোদ্ধাগণ তাঁহাকে যুদ্ধকালে রক্ষা করিয়া থাকেন। অলিকসন্দর যে সময় প্রাচীন যোদ্ধাগণের কীর্ত্তিকলাপ দর্শন, এবং তাঁহাদের বীরত্বব্যঞ্জক গাথা সকল আবৃত্তি করিয়া, তাঁহাদের পদানুসরণ করিবার জন্য অধীর হইতে ছিলেন, সেই সময়ে তাঁহার কাছে পারসীক সৈন্যের যুদ্ধের জন্য আগমন কথা আনীত হইয়াঁছিল। তিনি ক্ষণবিলম্ব না করিয়া তাঁহার সৈন্যগণের সহিত মিলিত হইলেন। দেখিলেন গেণিকস্ নামক একটী ক্ষুদ্র নদীর অপর পারে পারসীক গণ যুদ্ধ সজ্জায় সজ্জিত হইয়া অবস্থান করিতেছে।
পারসীকেরা এমনই রাজত্ব করিতেছিলেন যে, অলিকসন্দরের এসিয়া আক্রমণের কথা পূর্ব্বে কিছুমাত্র টের পান নাই। তাহা হইলে তাহারা সমুদ্রের তটে তাঁহাকে বাধা প্রদান করিত। তাহা হইল না, পারসীকেরা বিব্রত হইয়া পড়িল, তাহাদের মধ্যে মতভেদ উপস্থিত হইল, এক পক্ষ বলিলেন, শত্রুর পথের গ্রাম ও নগর অগ্নিযোগে ধ্বংস করিয়া ফেলা হউক, জলাশয় সকল দূষিত করা হউক, তাহা হইলে বিনাযুদ্ধে খাদ্য দ্রব্য এবং পানীয় অভাবে যখন শত্রুকুল অবসন্ন হইবে, তখন বরং তাহাদিগকে আক্রমণ করিয়া সমূলে উৎপাটিত করা যাইবে। অন্যপক্ষ বলিলেন, আমরা দেশের রক্ষক, আমরা যদি ভক্ষক হইয়া দেশকে মরুভূমিতে পরিণত করি, তাহা হইলে প্রজাদিগকে কে রক্ষা করিবে? প্রজাদিগের একটি তৃণও নষ্ট না করিরা যুদ্ধ করা তাঁহারা শ্রেয়স্কর জ্ঞান করিলেন। প্রথমোক্ত পক্ষের সদুপদেশ অগ্রাহ্য করিয়া অনীতিবিদের ন্যায় তাঁহারা যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত হইলেন। পারসীক সৈন্যসংখ্যা নিতান্ত কম ছিল না একজন (এরিয়ান) বলেন, তাহাদের প্রায় বিশ হাজার পদাতিক এবং এতগুলি অশ্বারোহী ছিল। ডিওডোরস সিকুলস নামক আর একজন ঐতিহাসিক বলেন, গ্রেণিকাসে পারসীকদিগের দশ হাজার অশ্বারোহী এবং এক লক্ষ পদাতিক সৈন্য অবস্থান করিতেছিল। আর একজন সত্যপ্রিয় ইতিহাস লেখক (যস্টিন) বলেন সর্ব্বশুদ্ধ ছয় লক্ষ পারসীক সৈন্য অলিকসন্দরের গতিরোধ করিবার জন্য গ্রেণিকস নদীর তটে সমবেত হইয়াছিল। এই সকল ঐতিহাসিক মহাশয়দিগের ধারণা, আমরা এসিয়াবাসী যেন পশুরদল। আমাদের জন সংখ্যা যতই কেন বেশী হউক না, আমাদিগকে ধ্বংস করিতে যেন কিছুমাত্র তাঁহারা ইতস্ততঃ বোধ করেন না। সেই জন্য তাঁহারা যুদ্ধস্থলে আমাদের এসিয়াবাসীর জনসংখ্যা অত্যন্ত অধিক মাত্রায় বর্ণন করিয়া নিজেদের ভুজবলও কল্পনাবলের পরিচয় প্রদান করিয়া থাকেন।
অলিকসন্দর যেন দেববলে বলীয়ান হইয়া, সেই দিনেই শত্রুসৈন্য আক্রমণ করিবার জন্য প্রস্তুত হইলেন। অলিকসন্দরের অন্যতম সেনানী, বহুদর্শী পারমিনিও এত শীঘ্র শত্রুগণকে আক্রমণ না করিয়া নদীর পারেই অবস্থান করিতে পরামর্শ প্রদান করেন। তিনি যুক্তি দেখাইয়া বলেন পারসীকদের পদাতিকের সংখ্যা কম, সুতরাং তাহারা আমাদের অতি নিকটে অবস্থান করিবে না। তাহারা চলিয়া গেলে আমরা অক্লেশে পরপারে যাইতে সক্ষম হইব। ইহা ব্যতীত নদীর তট অত্যন্ত উচ্চ, আর সকল স্থানে পার হওয়াও সুবিধাজনক নহে। এরূপ অবস্থায় আমরা দলবদ্ধ হইয়া পার হইতে পারিব না, পারসীক অশ্বারোহীরা, নদীর উচ্চ তট হইতে আমাদিগকে আক্রমণ করিলে, আমাদিগকে বিপন্ন হইতে হইবে। প্রথম আক্রমণে যদি আমরা বিফলকাম হই, তাহা হইলে আমাদের ভবিষ্যৎ কার্য্য কলাপের পরিবর্ত্তন করিতে হইবে। ফিলিপের বিজ্ঞ সেনানীর উপদেশ, অলিকসন্দরের ভাল লাগিল না, তিনি বলিলেন আমি আপনার কথা সমস্তই বুঝিলাম, যে ব্যক্তি অবলীলাক্রমে সমুদ্র উত্তীর্ণ হইয়া আগমন করিল, ঐ ক্ষুদ্র নদী যদি তাহার ক্ষণমাত্রও গতিরোধ করিতে সমর্থ হয়, তাহা হইলে ইহা অপেক্ষা লজ্জার কথা আর কি হইতে পারে? অনিবার্য্য গতি মাসিদন সৈন্যের, এবং বিপদ সমুদ্রে অবগাহন করিবার আমার উৎকট বাসনা! এই উভয়ের পক্ষেই ইহা প্রতিকূল উপদেশ। আর এক কথা, আমরা যদি অপেক্ষা করি, আমাদের ভীতি পারসীকদের হৃদয় হইতে চলিয়া যাইবে, আর আমাদিগকে তাহারা যুদ্ধে সমতুল্য বলিয়া গ্রহণ করিবে। সুতরাং অপেক্ষা না করিয়া যুদ্ধে জয়লাভ করিতে হইবে। তাহা হইলে আমাদের ভয়ে তাহারা বিভীষিকাগ্রস্ত হইবে।” অলিকসন্দারের কথা অনুসারে যুদ্ধ করাই স্থির হইল।
পারসীকরা প্রায় দুই শত বৎসর হইতে গ্রীকদিগের সহিত যুদ্ধ করিয়া তাহাদের রণনীতি বিষয়ক অভিজ্ঞতা যথেষ্ট লাভ করিয়াছিল। তাহারা বালক অলিকসন্দরের ভয়ে ভীত হইয়া দেশ ত্যাগ করিয়া পলায়ন করে নাই। পারসীক সৈন্যের মধ্যে গ্রীক ভাড়াটে সৈন্যের সংখ্যা বড় কম ছিল না। পারসীক অশ্বারোহী সৈন্য নদীর তটে শত্রুর গতিরোধ করিবার জন্য দৃঢ়তার সহিত অবস্থান করিতেছিল—ইহাদের পশ্চাৎভাগে পাহাড়ের কাছে গ্রীক ভাড়াটে সৈন্য ওমারীস নামক পারসীক সেনানীর অধীনে যুদ্ধের জন্য অবস্থান করিতেছিল।
মাসিদন সৈন্য আট ব্রিগেড বা ভাগে বিভক্ত ছিল। ইহার প্রত্যেক ভাগে দুই হাজার সৈন্য একজন সেনানী কর্ত্তৃক পরিচালিত হইত। এই আট জন সমান পদস্থ সেনানী, আবশ্যক অনুসারে কখন পৃথক ভাবে, কখন বা মিলিত হইয়া কার্য্য করিত। এই দুই হাজার সৈন্য দুই রেজিমেণ্টে বিভক্ত হইত। তাহাদের নায়কও দুইজন নিযুক্ত হইত। প্রত্যেক রেজিমেণ্ট আবার পাঁচ শত করিয়া দুই দলে বিভক্ত হইয়া দুই জন দলপতি কর্ত্তৃক পরিচালিত হইত। ইহার প্রত্যেক দল, আবার আটটি ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হইত, তাহাদের সেই আট দলে আটজন নায়ক অবস্থান করিত। সমস্ত সৈন্য দুই পক্ষে বিভক্ত হইত। অলিকসন্দর, প্রায় অধিকাংশ সময় দক্ষিণ পক্ষের শেষ ভাগে পরিচালনা করিতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে অনুসারে এই সকল ব্রিগেড কখন কখন বাম ভাগে কখন বা দক্ষিণ ভাগে রাখা হইত। সেনানী পারমিনিও বাম পক্ষের সেনাপতিত্বে নিযুক্ত হইলেন। স্বয়ং অলিকসন্দর, দক্ষিণ পক্ষ পরিচালনা করেন। নদীর উভয়পক্ষের সৈন্যগণ কিয়ৎক্ষণ নির্ব্বাক হইয়া পরস্পর নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। অলিকসন্দরের সেনানীগণ নদীর তটে বেশীক্ষণ অপেক্ষা না করিয়া সৈন্যগণসহ নদীমধ্যে অবতরণ করিলেন। তিনিও নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিতে পারিলেন না—চতুর্দ্দিকে রণবাদ্য বাজিয়া উঠিল, যুদ্ধ দেবতার নাম কীর্ত্তনে তুমুল কোলাহল উপস্থিত হইল। কাপুরুষগণের মধ্যে যেন অস্থায়ী উন্মত্ততা আসিয়া তাহাদের যুদ্ধভীতি দূর করিয়া দিল। যে স্থানে পারসীক সেনানীগণ সমবেত হইয়া যুদ্ধ পরিচালনা করিতেছিলেন, যে স্থানে পারসীকগণ দৃঢ়তার সহিত অবস্থান করিয়া শত্রুর আগমনের অপেক্ষা করিতেছিলেন, অলিকসন্দর, সেই দিকে গমন করিবার জন্য নদীমধ্যে অবতরণ করিলেন। পারসীকগণ তটের উপর হইতে শত্রু সৈন্যের উপর অজস্র অস্ত্রশস্ত্র লাঠি প্রভৃতি নিক্ষেপ করিতে লাগিল। মাসিদন সৈন্য দীর্ঘ ----আবরণে আত্মরক্ষা করিয়া ২৪ফিট লম্বা বর্ষা দ্বারা পারসীকগণকে আক্রমণ করিতে লাগিল। অলিকসন্দর ঘোরতর পরাক্রমে প্রচণ্ডবেগে সকলের অগ্রবর্ত্তী হইয়া পারসীকদিগকে আক্রমণ করিলেন। ইতিপূর্ব্বে যে মাসিদন সৈন্য একটু ইতস্ততঃ করিতে ছিল, তাহারা তাহাদের নেতার উদাহরণে অনুপ্রাণিত হইয়া,বজ্রবেগে পারসীকদিগকে আক্রমণ করিল। এই ঘোরতর যুদ্ধকালে শত্রুর প্রহারে মাসিদন পতির অস্ত্রশস্ত্র, ছিন্ন ভিন্ন হইয়া যায়। এই ঘোরতর যুদ্ধকালে অলিকসন্দর যে সময় অন্যের সহিত যুদ্ধে নিযুক্তছিলেন, সে সময় একজন পারসীক সেনানী শানিত খড়্গ উত্তোলন করিয়া তাঁহার মস্তক স্কন্ধচ্যূত করিবার উপক্রম করেন। এই ঘোর সঙ্কট সময়ে অলিকসন্দরের ক্লীভস্ নামক সহচর সৈন্য সেই পারসীককে দ্বিখণ্ড করিয়া প্রভুর প্রাণ রক্ষা করেন।
মাসিদন সৈন্যের ক্ষিপ্রকারিতা, ক্লেশসহিষ্ণুতা শূরতা ও ধীরতার প্রভাবে অলিকসন্দর নদীর তটে শত্রু সৈন্যকে স্থানচ্যুত করিয়া সমতল ভূভাগে গমন করিতে সমর্থ হইলেন। এরমধ্যে সমস্ত গ্রীক সৈন্য নদীপার হইয়া শত্রু সৈন্যের উভয় পক্ষ ঘোরতর বিক্রমে আক্রমণ করিল। পারসীক সৈন্য কোনরূপে তাহাদের প্রভাব সহ্য করিতে সমর্থ হইল না। দীর্ঘ ভল্লের ঘোরতর আঘাতে পারসীক অশ্ব ও অশ্বারোহী ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িল। অলিসন্দরের ভীষণ আক্রমণে পারসীক সৈন্যের মধ্যভাগ যুদ্ধে পরাংমুখ হইল। ইহাদের দুর্ব্বলতায় পার্শ্বদ্বয় অধিকতর দুর্ব্বল হইয়া পড়িল। আর তাহারা কোনরূপে যুদ্ধস্থলে অবস্থান করিতে সমর্থ হইল না। ধীরে ধীরে তাহারা পলায়নপর হইল। পারসীকদের যে সকল ভাড়াটে গ্রীক সৈন্য পশ্চাৎভাগে অবস্থান করিতেছিল, এইবার অলিকসন্দর তাহাদিগকে আক্রমণ করিলেন। আকাশের মেঘ যেরূপ অল্প সময়ের মধ্যে নানাপ্রকার দৃশ্য দেখাইয়া বিলীন হইয়া যায় সেইরূপ অল্প সময়ের মধ্যে পারসীক সৈন্যের নানা অবস্থায়, পারসীক গ্রীক সৈন্যের চিত্তভ্রংশ হইয়া পড়ে। তাহারা অলিকসন্দর ও তাহার সৈন্যগণ কর্ত্তৃক নিদারুণভাবে আক্রান্ত এবং তাহাদিগের সেনানীর মৃত্যুতে তাহাদের বুদ্ধিশুদ্ধি বিলুপ্ত হইয়া যায়। এই সকল স্বদেশদ্রোহী গ্রীক, অলিকসন্দরের হস্তে বিশেষরূপে নিগৃহীত হইয়াছিল। যাহারা মৃতদেহের মধ্যে লুকাইয়া প্রাণরক্ষা করিয়াছিল, তাহারাই জীবনরক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিল। এই সকল স্বদেশদ্রোহী জীবনলাভ করিলেও, লৌহ শৃঙ্খলে আবদ্ধ করিয়া অলিকসন্দর, তাহাদিগকে মাসিদনে প্রেরণ করিয়াছিলেন। যে সকল নরাধম স্বজাতী ও স্বদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে তাহাদের কি গতি হইয়া থাকে ইহারাই তাহার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই উদাহরণ দেখিয়া যাহাতে না অন্যগ্রীসবাসী স্বদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ না করে সে জন্য তাহাদিগকে তিনি মেসিদোনিয়াতে আবদ্ধ করিয়া রাখেন। যিনি স্বদেশের গৌরব বৃদ্ধির জন্য অস্ত্রগ্রহণ করেন সেই লোকোত্তর পুরুষের বিরুদ্ধে যে কোন স্বদেশবাসী বাধা প্রদান করিবে, তাহাকে নির্দ্দয়ভাবে শিক্ষা প্রদান করা উচিত। ইহা কোনরূপে দূষণীয় হইতে পারে না।
যুদ্ধের প্রথমভাগে বিজয় শ্রী, পারসীক দিগেরই পক্ষপাতী হইয়াছিলেন। কিন্তু অলিকসন্দরের একনিষ্ঠ উপাসনায় প্রসন্ন হইয়া অবশেষে তিনি তাঁহাকেই আলিঙ্গণ করিয়াছিলেন।
অলিকসন্দরের উদাহরণে অনুপ্রাণিত হইয়া তাঁহার সেনাও সেনানীগণ মৃত্যুভয় পরিত্যাগ করিয়া যেরূপভাবে যুদ্ধ করিয়াছিলেন, যদি পারসীকগণ সেইরূপ দৃঢ়তার সহিত যুদ্ধ করিতেন তাহা হইলে নদীর গর্ভ হইতে আর মাসিদুনিয়ানদিগকে উঠিতে হইত না কিন্তু তাহা না, হওয়াতে অলিকসন্দরের উত্থান এবং পারসীকদের পতন হইয়াছে।
সত্যপ্রিয় ইয়ুরোপীয় ঐতিহাসিকেরা বলেন এই ঘোরতর যুদ্ধে বালকবীরের ২৫জন সহচর সৈন্য ৬০জন অশ্বারোহী ৩০জন পদাতিক পঞ্চত্ব লাভ করিয়াছিল। অপরপক্ষে প্লুতার্ক বলেন পারসীকদের ২০হাজার পদাতিক এবং আড়াইহাজার অশ্বারোহী ইহলোক পরিত্যাগ করে। ডিওডোরস্ বলেন, দশহাজার পদাতিক ও দুই হাজার অশ্বারোহী, এবিয়ানের মতে, দুই হাজার ব্যতীত সমস্ত পদাতিক এবং এক হাজার অশ্বারোহী সৈন্য মৃত্যুমুখে পতিত হয়। ইয়ুরোপীয় লেখকদিগের বর্ণনা অতিরঞ্জিত হইলেও ইহাতে বুঝা যায় যে এসিয়াবাসীরা নেতার দোষে পরাজিত হইলেও তাহারা মৃত্যুভয়ে বিভীষিকাগ্রস্ত হয় নাই, বা যুদ্ধ না করিয়াই রণে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে নাই।
যুদ্ধে জয়লাভের সহিত অলিকসন্দরের অদৃষ্ট পরিবর্ত্তন হইল তাঁহার একমাত্র আশ্রয় আশার সফলতার সহিত, শূন্য ধনাগার পরিপূর্ণ, দুর্ভিক্ষ সুভিক্ষে পরিণত, এবং কুহেলিকা পরিপূর্ণ গন্তব্য পথ, যেন সুর্য্যরশ্মিতে উদ্ভাসিত হইল। ইতিপূর্ব্বে যাহারা তাঁহাকে বাধা দিবার জন্য অস্ত্রপাণি হইয়া উপস্থিত হইয়াছিল, এক্ষণে তাহারাই তাঁহাকে ধনজন দিয়া পরিপুষ্ট করিতে লাগিল। এইরূপে অল্প সময়ের মধ্যে অলিকসন্দর সে প্রদেশ হস্তগত করিয়া তথাকার প্রচলিত প্রথা অনুসারে শাসন ব্যবস্থা বিধি বদ্ধ করিলেন। রাজপরিবর্ত্তন হইল মাত্র, এ পরিবর্ত্তনে প্রজা সাধারণ নিজেদের ক্ষতিবৃদ্ধি কিছুই বুঝিতে পারিল না পারস্যরাজের পরিবর্ত্তে তাহারা মাসিদনের অধিশ্বরকে রাজস্ব প্রদান করিতে লাগিল। তাহারাই তাঁহার রসদ যোগাইতে লাগিল, অলিকসন্দরের কোন অভাব রহিল না। বিজয়লাভে উল্লসিত হইয়া তিনি অধিকতর উৎসাহের সহিত কার্য্য সকল সম্পন্ন করিবার জন্য অগ্রসর হইলেন।
অলিকসন্দর, পারীসকদের সহিত প্রথম যুদ্ধে অনন্যসাধারণ জয়লাভে আহ্লাদিত হইলেও তিনি নিজের দেশের কথা ভুলিয়া যান নাই। তিনি জানিতেন বাহিরের প্রবল শত্রু অপেক্ষা গৃহের দুর্ব্বল শত্রু ও অত্যন্ত ভয়ঙ্কর, সে মর্ম্মস্থানে সময়ে এবং অসময়ে দারুণ আঘাত করিবার যেরূপ সুযোগপ্রাপ্ত হইয়া থাকে, সেরূপ অন্যে কোনরূপে প্রাপ্ত হয় না। গ্রীসের বিভিন্ন জনপদের বিভিন্ন প্রকৃতির জনগণের হৃদয়, যাহাতে তাঁহার বিরুদ্ধ চিন্তায় কলুষিত না হয়, ইহার পরিবর্ত্তে যাহাতে জাতীয় শত্রুর বিমর্দ্দনজনিত গৌরবে সকলে নিজেকে গৌরবান্বিত বিবেচনা করেন, এজন্য বুদ্ধিমান অলিকসন্দর গ্রীক জনসাধারণের উদ্দেশে বিজয়লব্ধ পারসীকদিগের তিন শত যুদ্ধ সজ্জা এথেন্সে প্রেরণ করেন। তাহাতে লিখিত হইয়াছিল যে “এসিয়ায় অবস্থিত বর্ব্বরদিগের নিকট হইতে গৃহীত দ্রব্য সমূহ স্পার্টাবাসী ব্যতীত সমস্ত গ্রীকবাসীর উদ্দেশে ফিলিপ পুত্র অলিকসন্দর কর্ত্তৃক উৎসর্গীকৃত হইল।” অলিকসন্দর এই গুঢ়ার্থ পূর্ণ বাক্যে যেন প্রকাশ করিতেছেন বৃক্ষস্থিত পক্ষীর যেরূপ বৃক্ষেতে অধিকার নাই, ঠিক যেন সেইরূপ এসিয়ায় অবস্থানকারীর এসিয়ার উপর তাহাদের কোনরূপ স্বামিত্ব বা মমত্ত্ব নাই; সুতরাং সেই সকল বৈদেশিকদিগকে বলপূর্ব্বক দূর করিয়া, তাহাদের যথাসর্ব্বস্ব লুণ্ঠনে কোনরূপ পাপ নাই। ইহাতে যেন সকলের সমান অধিকার আছে। সেই জন্য সমস্ত গ্রীসবাসীর উদ্দেশে মৃত এসিয়াবাসীর যুদ্ধসজ্জা উৎসর্গীকৃত হইয়াছে। যে ফিলিপকে, এথেন্সবাসী বর্ব্বর, অসভ্য, বলিয়া উপেক্ষা করিত, তাহারই পুত্র অলিকসন্দর কর্ত্তৃক এসিয়ার ধন রত্ন যখন লুণ্ঠিত হইল, তখন গ্রীসের সুসভ্য এথেন্স প্রভৃতির অধিবাসীর দ্বারা কোন কোন্ কার্য্য না সাধিত হইতে পারে? অলিকসন্দর, এথেন্সবাসীর তুষ্টি সাধনে যত্নপর হইলেও, এথেনীয়রা মনে মনে পারস্য সম্রাটের অভ্যুদয় আকাঙ্ক্ষা করিতেছিল। তাহারা অলিকসন্দরের সাহায্যে জাহাজ প্রদান করিলেও, কিন্তু প্রথম সুযোগে তাঁহার পক্ষ পরিত্যাগ করিয়া পারস্যপতির সহিত সম্মিলিত হইবার জন্য সচেষ্ট ছিলেন।
অলিকসন্দর লুণ্ঠিত দ্রব্য প্রেরণ ব্যতীত এই যুদ্ধে তাঁহার যে সকল সহচর সৈন্য মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছিল, তাহাদিগের ধাতুময়ী মূর্ত্তি লাইসিপসের দ্বারা প্রস্তুত করাইয়া স্বদেশের দেবমন্দিরে সংস্থাপন করান। যাহাদের ভুজবলের উপর নির্ভর করিয়া অলিক সন্দর অপূর্ব্ব বিজয় শ্রীলাভ করিয়াছিলেন—অলিকসন্দর, যাহাদের ধাতুময়ী মূর্ত্তি, স্বীয় প্রধান শিল্পী দ্বারা প্রস্তুত করাইয়া গুণের সমাদর করিয়াছিলেন। তাহাদের আকৃতি ও প্রতিকৃতি কালক্রমে ধুলায় পরিণত হইলেও তাহাদের কীর্ত্তি চিরকাল নূতনভাবে, ইয়ুরোপ ও এসিয়া উভয় দেশের, অধিবাসীর কাছে স্মরণীয় বলিয়া গৃহীত হইবে। জনকতক মানুষ মৃত্যুভয় পরিত্যাগ করিয়া কর্ত্তব্যপথে অগ্রসর হইয়াছিলেন বলিয়া তাঁহারা অসাধারণ কার্য্য সকল সম্পন্ন করিয়াছিলেন। পৃথিবীর অদৃষ্ট চক্র যদৃচ্ছাক্রমে তাঁহারা পরিবর্ত্তণ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, এ কথা তাঁহাদের ইতিহাস যেন চিরকাল বজ্রনির্ঘোষে উপদেশ প্রদান করিবে।
- ↑
অসমাপ্ত জিগীষস্য স্ত্রীচিন্তা কা মনস্বিনঃ।
অনাক্রমা জগৎকৃস্নং নো সন্ধ্যাং ভজতি রবিঃ॥ ১৪৪
রাজতরঙ্গিণী চতুর্থস্তরঙ্গঃ॥