ভারত পথিক/জন্ম ও শৈশব
প্রথম পরিচ্ছেদ
উনিশ শতকের শেষভাগে আমার পিতা শ্রীজানকীনাথ বসু বাংলাদেশ ছেড়ে উড়িষ্যায় গিয়ে আাইনজীবী হিসেবে কটক শহরে বসবাস করতে শুরু করেন। এই কটকে ১৮১৭ সালে ২৩শে জানুয়ারি শনিবার আমার জন্ম। আমার পিতা ছিলেন মহিনগরের বসু পরিবারের ছেলে, আর মা প্রভাবতী দেবী হাটখোলার দত্ত পরিবারের মেয়ে। আমি পিতামাতার নবম সন্তান এবং ষষ্ঠ পুত্র।
আজকাল কলকাতা থেকে কটকে যাওয়া অতি সহজ ব্যাপার। কলকাতা থেকে ট্রেনে পূর্ব তটরেখা ধরে দক্ষিণদিকে অগ্রসর হয়ে এক রাত্রের মধ্যেই কটকে পৌঁছন যায়। পথ অতান্ত নিরাপদ, কাজেই কোনোরকম বিপদ আপদের আশঙ্কাও নেই।কিন্তু বছর ষাটেক আগে অবস্থা মোটেই এরকম ছিল না। স্থলপথে গরুরগাড়িতে গেলে চোরডাকাতের কবলে পড়ার আশঙ্কা থাকত, আবার জলপথে ভয় থাকত ঝড়তুফানের। কিন্তু ভগবানের রোষ থেকে রেহাই মিললেও মানুষের হিংস্রতা এড়ানো প্রায় অসম্ভবই ছিল, তাই বেশির ভাগ লোকই জলপথে যাতায়াত করত। চাঁদবালি পর্যন্ত জাহাজেই যাওয়া যেত—চাঁদবালি থেকে স্টীমারে অনেকগুলি নদী খাল পেরিয়ে কটক। ছেলেবেলা থেকে মায়ের মুখে এই সমুদ্রযাত্রার যে ভয়াবহ বিবরণ শুনেছি তারপর আর কখনো আমার সমুদ্র ভ্রমণের ইচ্ছে হয়নি। তখনকার দিনে অত বিপদ আপদের মধ্যে আমার পিতা তাঁর পৈতৃক ভিটে ছেড়ে ভাগ্যান্বেষণ করতে যে এতদূর আসতে পেরেছিলেন তাতেই বোঝা যায় তাঁর বুকের পাটা কতখানি ছিল। এই দুঃসাহসিকতার পুরস্কারও তিনি পেয়েছিলেন, আমার যখন জন্ম হয় ততদিনে তিনি বেশ প্রতিপত্তি করে নিয়েছেন এবং উড়িষ্যার আইনব্যবসার ক্ষেত্রে বলতে গেলে তিনি শীর্ষ স্থানটি অধিকার করেছিলেন।
কটক শহরটি আয়তনে বিশেষ বড় নয়, লোকসংখ্যাও মাত্র ২০,০০০ হাজারের কাছাকাছি। কিন্তু তা হলেও কতকগুলি বিশেষত্বের জন্য কটক ভারতবর্ষের একটি প্রধান শহর। কলিঙের হিন্দুরাজাদের আমল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত কটকের ইতিহাস এক অবিচ্ছিন্ন মর্যাদার দাবি করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে কটকই ছিল উড়িষার রাজধানী এবং পুরীর বিখ্যাত জগন্নাথদেবের মন্দির, কোনারক, ভুবনেশ্বর ও উদয়গিরির জগৎবিখ্যাত শিল্পনিদর্শন কটকেরই দান। তাছাড়া কটক যে শুধু, উড়িষ্যার বৃটিশ সরকারেরই প্রধান দপ্তর ছিল তা নয়, উড়িষ্যার বহু সামন্তরাজাদেরও শাসনকেন্দ্র ছিল। সব মিলিয়ে এখানকার পরিবেশ শিশুমনের সুস্থ সবল হয়ে গড়ে ওঠার অনুকুলই ছিল। শহরের এবং গ্রাম্যজীবনের—দুয়েরই সুবিধে কটকে পাওয়া যেত।
ধনী না হলেও আমাদের পরিবারকে সঙ্গতিসম্পন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে ফেলা চলত। কাজেই অভাব অনটনের অভিজ্ঞতা কখনো আমার হয়নি, আর অভাবের তাড়নায় লোভ, স্বার্থপরতা ইত্যাদি যেসব চানসিক দুর্বলতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে সেসব সংকীর্ণতাও আমার মনে স্থান পায়নি। আবার মাথা বিগড়ে দেবার মতো বিলাসী বেহিসাবী অভ্যাসকেও কখনো বাড়িতে প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি। সত্যি কথা বলতে কি আমাদের বাপমা একটু বেশিরকম সাধাসিধে ভাবেই আমাদের শিক্ষাদীক্ষা দিয়েছিলেন।
মনে পড়ে ছেলেবেলায় নিজেকে কি রকম যেন তুচ্ছ মনে হত। বাবামাকে সাংঘাতিক ভয় করতাম। বাবা সাধারণত এমন গম্ভীর হয়ে থাকতেন যে আমরা কেউ তাঁর কাছে ঘেঁষতেই সাহস পেতাম না। আইনব্যবসা তো ছিলই, তার উপরে বাইরের আরো কত কাজ যে তাঁর থাকত তার ইয়ত্তা নেই, ফলে সংসারের দিকে নজর দেবার মতো অবসর তিনি সামান্যই পেতেন। এই সামান্য সময়টুকু তাঁকে সব সন্তানদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দিতে হত। সবচেয়ে ছোটো যে, তার ভাগে অবিশ্যি, আদর একটু বেশিই পড়ত, কিন্তু তাও বেশিদিন স্থায়ী হত না, ঘরে নতুন অতিথির আবির্ভাব হলেই বাড়তি ভাগটুকু নবাগতের জন্য বরাদ্দ হত। বড়দের ব্যাপারে বাবা এত নিরপেক্ষ ছিলেন যে ঘুণাক্ষরেও কখনো বোঝা যেত না তিনি কার সম্বন্ধে কী ভাবতেন। মাও ছিলেন তনেকটা বাবারই মতো। অবিশ্যি মন তাঁর স্বভাবতই বাবার চাইতে কোমল ছিল, এবং সময়ে সময়ে তাঁর পক্ষপাতিত্ব যে টের পাওয়া যেত না তা নয়, তা সত্ত্বেও আমরা সবাই মাকে দস্তুর মতো ভয় করে চলতাম। বাড়িতে কেউই তাঁর কথার উপর কথা বলতে সাহস করত না। সংসারের পূর্ণ কর্তৃত্বের ভার ছিল তাঁর উপর। তাঁর এই প্রতিপত্তির মূলে ছিল তাঁর অসাধারণ সাংসারিক বুদ্ধি আর প্রখর ব্যক্তিত্ব। ছেলেবেলা থেকেই বাবামাকে মনেপ্রাণে শ্রদ্ধা করে এসেছি সত্যি, কিন্তু তবু তাঁদের আরো ঘনিষ্ঠভাবে জানবার জন্য মন আকুল হয়ে উঠেছে—এজন্যই, যেসব ছেলেদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে তাদের বাপমায়ের সঙ্গে মিশতে দেখেছি তাদের মনে মনে হিংসে না করে পারিনি। আমার মন একটু স্পর্শকাতর, তাই বাপমায়ের এই আপাত নিস্পৃহতা আমাকে বেদনা দিয়েছে। শুধু যে বাপমায়ের কাছ থেকে ভয়ে ভয়ে দূরে থাকতে হত বলেই আমার দুঃখ ছিল তা নয়, আমার বড় অনেক ভাইবোন থাকায় নিজেকে খুঁজে পেতেই যেন কষ্ট হত। একদিক দিয়ে এতে অবিশ্যি ভালো বই মন্দ হয়নি। দাদাদের মতো হতে হবে—এই সংকল্প নিয়ে আমি বড় হয়ে উঠেছি। নিজের সম্বন্ধে বিশেষ উঁচু ধারণা আমার কখনো ছিল না, তাই সব কাজেই আমার অত্যন্ত সাবধানে চলা অভ্যাস। আর যত কঠিন কাজই হোক না কেন, কখনো ফাঁকি দেবার কথা আমার মনে হয়নি। তাছাড়া, আমার অবচেতন মনে এ ধারণাটা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে সাধারণ লোকের পক্ষে কৃতকার্যতা লাভের একমাত্র উপায় কঠিন পরিশ্রম ও নিষ্ঠা।
বড় পরিবারে মানুষ হওয়া অনেক দিক দিয়েই বিড়ম্বনা। ছেলেবেলায় যে জিনিসটি অত্যন্ত দরকার—ব্যক্তিগত মনোযোগ—বড় পরিবারের লোকারণ্যে সেটা কোনোমতেই সম্ভব হয় না। তার উপরে অনেকে একসঙ্গে থাকলে নিজের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে সজাগ থাকবার সুযোেগ ঘটে না, ফলে ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠতে পারে না। বড় পরিবারের সুবিধেও অবশ্য আছে। অনেকের মাঝে থাকার ফলে স্বভাব সহজেই সামাজিক হয়ে ওঠে—আত্মকেন্দ্রিকতা প্রশ্রয় পায় না। আমাদের বাড়িতে বেশি লোক বলতে শুধু আমার ভাইবোনেরাই নয়, খুড়তুতো, পিসতুতো, মামাতো ভাইবোন আর কাকা, মামা ইত্যাদি মিলে বেশ একটা বড় অঙ্ক দাঁড়াত। এর উপরে আত্মীয়স্বজনের ভিড় তো প্রায় লেগেই থাকত। আর ভালো হোটেলের অভাবেই হোক বা আমাদের অতিথিপরায়ণতার খ্যাতির জন্যই হোক কোনো গণ্যমান্য লোক কটকে এলে আমাদের বাড়িতেই তাঁর আতিথ্যের ব্যবস্থা হত।
আমাদের পরিবারের লোকের সংখ্যা বেশি বলেই যে সংসার এত বড় ছিল তা নয়, পোষ্যবর্গ ও চাকরঝির সংখ্যাও ছিল অগুনতি। তার উপরে গরু, ঘোড়া, ভেড়া, হরিণ, ময়ূর, বেজি ইত্যাদি মিলিয়ে ছোটোখাটো একটা চিড়িয়াখানার সামিল। বহুদিন থেকে কাজ করার ফলে আমাদের চাকরঝিরা ঘরের লোকের মতোই হয়ে গিয়েছিল। অনেকে তো আমার জন্মের বহু আগে আমাদের বাড়িতে কাজ করতে ঢুকেছিল। আমরা ছোটোরা স্বভাবতই এদের অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখতাম। বিশেষ করে আমাদের বুড়ি দাসীকে তো বাড়ির সকলেই বিশেষ শ্রদ্ধা করত। তখন পর্যন্ত চাকরঝির সঙ্গে আমাদের প্রভুভৃত্য সম্পর্ক দাঁড়ায়নি—তাদের আমরা পরিবারভুক্ত বলেই মনে করতাম। চাকরবাকরদের সম্পর্কে আমার ছেলেবেলার এই মনোভাব বড় হয়েও কখনো ক্ষুণ্ণ হয়নি।
বাড়ির এই অনুকূল আবহাওয়ায় আমার মন স্বভাবতই উদার হয়ে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সেই সঙ্গে কেমন একটা সংকোচের ডার মনকে অন্তর্মুখী করে তুলেছিল—আজ পর্যন্ত এই সংকোচ আমি পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারিনি।