ভারত পথিক/প্রেসিডেন্সি কলেজ (১)

উইকিসংকলন থেকে

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

প্রেসিডেন্সি কলেজ (১)

কলকাতা যে আমার পক্ষে শাপে বর হয়ে দাঁড়াবে এটা বাবা-মা কল্পনাও করতে পারেননি। কটকে আমারই মতো খেয়ালী একদল স্কুলের ছাত্রকে নিয়ে যে দল গড়ে তুলেছিলাম তাদের সংসর্গ থেকে দূরে রাখবার জন্যই আমাকে কলকাতায় পাঠানো হয়েছিল। কটকের বন্ধুদের সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ ঘটল, কিন্তু কলকাতায় এসে ওরকম একটি দল পাকাতে আমাকে মোটেই বেগ পেতে হল না, কারণ এখানে আমার মতো খেয়ালী ছেলের কোনো অভাব ছিল না। বুঝতেই পারছেন এসব দেখেশ‍ুনে বাবা-মা আমার সম্বন্ধে একেবারে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন।

কলকাতায় অবিশ্যি এই আমার প্রথম নয়। ছেলেবেলায় আরো অনেকবার কলকাতায় এসেছি—এবং প্রত্যেকবারই এই বিরাট শহরটি বিস্ময়ে আমাকে একেবারে অভিভূত করে দিয়েছে। কলকাতার চওড়া রাস্তাগ‍ুলি ধরে হাঁটতে কিংবা এখানকার বড় বড় বাগান ও যাদুঘরে ঘুরে বেড়াতে আমার খুব ভালো লাগত, মনে হত এসব কোনোদিনই পুরনো হবে না। এ যেন অনেকটা যাদুঘরে রক্ষিত অতিকায় একটি জলজন্ত‌ুর মতো-বাইরে থেকে যতোই দেখা যায় ভালো না লেগে লায় না। কিন্ত‌ু এবার তো আগেকার মতো কলকাতায় বেড়াতে আসিনি থাকতে এসেছি, কাজেই কলকাতার আসল রূপটির সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পেলাম। তখন কে জানত এই পরিচয়ের জের আমার সারা জীবন ধরেই চলবে।

অন্য যে কোনো বড় শহরের মতো কলকাতার জীবনও সকলের ঠিক সহ্য হয় না—অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে প্রতিভাবান ছেলেরা কলকাতায় এসে একেবারে বিগড়ে গেছে। আমি যদি আগে থেকেই বিশেষ একটা আদর্শ না নিয়ে কলকাতায় আসতাম তবে আমার অবস্থাও হয়তো তাই দাঁড়াত। স্কুল ছাড়বার পর থেকেই আমার মনে বড় রকমের একটা ওলটপালট চলছিল সত্যি, কিন্তু তার মধ্যেই আমার কর্তব্য আমি স্থির করে ফেলেছিলাম—ঠিক করেছিলাম বাধাবিপত্তি যাই আসুক না কেন গড্ডলিকাপ্রবাহে কখনো গা ভাসাবো না। জনসেবা ও আধ্যাত্মিক উন্নতিই হবে আমার জীবনের লক্ষ্য। জীবনের মূল সমস্যাগুলি যাতে সমাধান করতে পারি তার জন্য দর্শনশাস্ত্র বেশ ভালো করে পড়ব বলে স্থির করলাম। দৈনন্দিন জীবনে রামকৃষ্ণ এবং বিবেকানন্দ ছিলেন আমার আদর্শ। আমি যে অর্থোপার্জনের দিকে কখনো যাবো না সে সম্বন্ধে প্রায় নিশ্চিত ছিলাম। কলকাতায় আসবার সময়ে এই ছিল আমার দৃষ্টিভঙ্গী। এইসব সংকল্প কোনো ব্যক্তিবিশেষের উপদেশ বা এক রাত্রির চিন্তার ফল বলে মনে করলে ভুল করা হবে। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এইসব সিন্ধান্তে পৌছেচি। এজন্য কত বই যে পড়েছি, কত গ‍ুর‍ুর পদতলে বসেছি তার ইয়ত্তা নেই। এত সাধনার পর জীবনের সঠিক আদর্শটি খুঁজে পেয়েছিলাম। এতখানি বেগ পেতে হত না যদি আরো বড় বাধা আমার পথরোধ না করত। একদিকে পারিবারিক অনুশাসন, আর একদিকে পার্থিব ভোগসুখের প্রতি মনের স্বাভাবিক আকর্ষণ—এই দুয়ের প্রতিকুলতায় জীবনের আদর্শকে অক্ষুন্ন রাখা আমার পক্ষে প্রাণান্তকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষ করে স্কুল-জীবনের শেষের দিকটা তো আমাকে চুড়ান্ত মানসিক অশান্তি ভোগ করতে হয়েছে। অবিশ্যি কোনো একটা আদর্শকে জীবনে সফল করে তুলতে গেলে সকলকেই এই রকম অশাস্তি ভোগ করতে হয়। কিন্ত‌ু দুটো কারণে আমার বেলা অশাস্তির মাত্রাটা একটু বেশি হয়ে পড়েছিল। প্রথমত আমার বয়স ছিল অল্প। দ্বিতীয়ত সবগুলি বাধা যেন একসঙ্গে এসে আমাকে ঘিরে ধরেছিল। একই সঙ্গে দুটো বাধার সঙ্গে লড়তে না হলে বোধ হয় এত কষ্ট পেতে হত না। কিন্তু ভাগ্যের লিখনকে তো আর খণ্ডান যায় না।

এইভাবে দুদিক সামলাতে আমাকে যে কী পরিমাণ বেগ পেতে হয়েছে তা বলবার নয়। বিশেষ করে আমার মতো প্রখর-অনভূতিসম্পন্ন ছেলের পক্ষে এই সংঘাত প্রায় মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি যে ভেঙে পড়িনি সেটা বোধ হয় নেহাতই ভাগ্যের জোয় কিংবা নিয়তির নির্দেশ। জীবনের এই অগ্নিপরীক্ষায় আমি প্রায় অক্ষত অবস্থাতেই বেরিয়ে এসেছি। পিছনে ফেলে আসা দুঃস্বপ্নের মতো এই দিনগুলির কথা ভাবলে এখন বুঝতে পারি আমার জীবনে এই অভিজ্ঞতার দরকার ছিল। এই সংগ্রামে আমাকে বহু কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে সত্যি, কিন্তু তার পুরস্কার আমি পেয়েছি—আগের চেয়ে আমার আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গেছে, আর আমার জীবনের মূল কয়েকটি নীতিও আমি স্থির করতে পেরেছি। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বাপ-মা এবং অভিভাবকদের একটা বিষয়ে সাবধান করে দিতে চাই—অভিমানী এবং অনুভূতিসম্পন্ন ছেলেদের সঙ্গে তাঁদের ব্যবহার কখনো যেন র‍ূঢ় না হয়। কারণ, তাঁদের স্বাভাবিক ইচ্ছায় যতোই বাধা দেওয়া যায় ততোই তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, এবং শেষটায় একেবারে বেয়াড়া হয়ে যায়। বাপমায়েরা বরং যদি এ ধরনের ছেলেদের অস্বাভাবিকতাকে খানিকটা মেনে নিয়ে তাদের বুঝতে চেষ্টা করেন, তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন, তবে হয়তো তাদের খামখেয়াল, অস্বাভাবিকতা সব আস্তে আস্তে সেরে যাবে। ঈশ্বর, আত্মা এবং ধর্ম—এসবে বিশ্বাস করা যুক্তিসঙ্গত কি না সে প্রশ্নের জবাব আমার পক্ষে দেওয়া সহজ নয়, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি অল্প বয়স থেকে ধর্মচর্চা ও যোগসাধনায় মন দিয়ে আমি একটা বড় জিনিস লাভ করেছিলাম। জীবনধারণে দায়িত্ব যে কতখানি তা বেশ ভালো করেই বুঝতে শিখেছিলাম। কলেজ-জীবনে প্রবেশ করবার সময়ে জীবন সম্বন্ধে আমার মনে মোটামুটি একটা ধাৰণা জন্মে গিয়েছিল, বুঝেছিলাম জীবনের বিশেষ একটা উদ্দেশ্য আছে এবং এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য শরীর ও মনের নিয়মিত অনুশীলনের প্রয়োজন। স্কুল-জীবনে যদি শরীর মনকে এভাবে তৈরি না করতাম তবে আমার স্বাস্থ্য যে রকম খারাপ ছিল তাতে পরবর্তী জীবনের ঝড়ঝাপটা সামলে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব হত কি না সন্দেহ।

আগেই বলেছি প্রথমজীবনে আমি পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে নিজেকে বেশ খাপ খাইয়ে নিয়েছিলাম প্রচলিত—সমাজব্যবস্থা এবং নৈতিকবোধের সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ ঘটেনি। প্রত্যেকের জীবনেই এরকম হয়। তারপরই আসে সংশয়—ডেকার্টের বুদ্ধিমুলক সংশয় শ‍ুধু নয়, সমগ্র জীবন সম্বন্ধেই এই সংশয়। একে বলা চলে জীবনজিজ্ঞাসা। কেন এই পথিবীতে এসেছি? জীবনের উদ্দেশ্যই বা কী? মানুষ মাত্রেরই মনে তখন এইসব প্রশ্ন জাগে। যদি এই প্রশ্নের সঠিক কোনো সমাধান সে খুঁজে পায় তবে অনেক সময় দেখা যায় তার জীবনদর্শনে বড়রকমের পরিবর্তন ঘটেছে—সবকিছুই তখন সে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে দেখতে শুরু করে এবং প্রচলিত সামাজিক ও নৈতিক আদর্শগুলিকে যাচাই করে দেখবার জন্য স্বকীয় কতকগ‍ুলি মূল্যবোধ নিয়ে বাস্তবের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে। এই সংগ্রামে হয় সে নিজের আদর্শ অনুযায়ী পারিপার্শ্বিককে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়, কিংবা পরাজয় স্বীকার করে বাস্তবের কাছে আত্মসমর্পণ করে। জীবনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে মানুষের এই সংশয় তার জীবনদর্শনকে কতখানি প্রভাবান্বিত করে তা নির্ভর করে সম্পূর্ণ তার মনের গঠনের উপর। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা একান্ত ব্যক্তিগত ছাড়া আর কিছু নয়। তবে একটা জিনিস সকলের মধ্যেই দেখা যায়। বড় একটা কিছু করতে গেলে জীবনে বিপ্লবের স্থান অপরিহার্য। এই বিপ্লবের দুটি দিক। প্রথমে সংশয়, তারপর পুনর্গঠনের চেষ্টা। আমাদের ব্যবহারিক জীবনে বিপ্লবকে সফল করে তুলতে হলে যে জীবনের মূল সমস্যাগুলির সমাধান করতেই হবে এমন নয়, কারণ এইসব সমস্যাকে আমরা সাধারণত সৃষ্টির মুল রহস্যের অঙ্গীভূত বলেই মনে করি। অতি প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশে এবং পাশ্চাত্যে জড়বাদ ও অজ্ঞেয়তাবাদের উপর বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদ গড়ে উঠেছে। অবশ্য আমার ক্ষেত্রে ধর্মচর্চাটা ছিল নেহাতই ব্যবহারিক প্রয়োজনে। জীবনের প্রতিপদে যেসব দ্বিধা, যেসব সংশয় মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলতো, সুচিন্তিত একটি জীবনদর্শন ছাড়া আর কিছুতেই তাদের জয় করা সম্ভব ছিল না। বিবেকানন্দ এবং রামকৃষ্ণ আমাকে এই রকম একটি আদর্শের সন্ধান দিলেন। এই আদর্শকে জীবনের মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করার ফলে বহু সমস্যা, বহ‍ু সংকট আমি সহজেই পার হয়ে এসেছি। অবিশ্যি তাই বলে মনে করবেন না সব সংশয়েরই চিরকালের জন্য অবসান ঘটেছিল। দুঃখের বিষয়, আমার মনকে সম্পূর্ণ সংশয়মুক্ত করা কোনোকালেই সম্ভব হয়নি, হওয়ার কথাও নয়, কারণ সচেতনভাবে বাঁচতে হলেই পদে পদে সংশয় দেখা দেবে। মানুষের কাজই এই সংশয় জয় করা। অন্তর্দ্বন্দ্ব আমার মধ্যে সবচেয়ে প্রকট হয়ে উঠেছিল যৌনপ্রবৃত্তির ক্ষেত্রে। পার্থিব ভোগসুখে বর্জন করে কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে জীবন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্তে পৌঁঁছতে আমাকে মোটেই বেগ পেতে হয়নি। এই প্রকল্প জীবনের উপযুক্ত করে শরীর মনকে গড়ে তুলতেও আমাকে খুব বেশি কষ্ট করতে হয়নি। কিন্তু গোলমাল বেধেছিল যৌনপ্রবৃত্তি দমন করার বেলায়—মানুষের স্বাভাবিক একটি প্রবৃত্তিকে দমন করা কি মুখের কথা! কী প্রাণান্তকর দ্বন্দ্ব যে আমার সারাজীবন ধরে চলেছে তা বোঝানো যায় না।

যৌনসম্ভোগ বর্জন তো বটেই, যৌনকামনা দমন করাও আমার মতে তেমন দুঃসাধ্য নয়। কিন্তু আমাদের দেশের যোগীঋষিদের মতে আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য শুধু এই যথেষ্ট নয়। যে মানসিক আবেগ এবং সহজপ্রবৃত্তি থেকে যৌনকামনার উদ্ভব তাদের এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে যাতে সবরকম যৌন আকর্ষণের বিলুপ্তি ঘটে—শরীর মন যৌনচেতনার উর্ধ্বে ওঠে। কিন্তু এ কি কখনো সম্ভব, না এ শুধু কষ্টকল্পনা? রামকৃষ্ণ বলে গেছেন, এ সম্ভব, এবং শরীর মনকে এভাবে পবিত্র না করলে আধ্যাত্মিক উন্নতির চরমে পোঁছন যায় না। শোনা যায় অনেকেই রামকৃষ্ণের চরিত্রবল এবং আধ্যাত্মিক সিদ্ধি নানাভাবে পরীক্ষা করবার চেষ্টা করেছিলেন— কিন্তু যতবারই তাঁকে সুন্দরী স্ত্রীলোকদের মাঝখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দেখা গেছে নিষ্পাপ শিশ‍ুর মতোই তিনি তাদের প্রতি নির্বিকার, নিরাসক্ত ব্যবহার করেছেন। এসব ক্ষেত্রে তাঁর মনে সম্পূর্ণ অযৌনপ্রকৃতির প্রতিক্রিয়া দেখা যেত। রামকৃষ্ণ সর্বদা বলছেন সাধনার পথে সবচেয়ে বড় বিঘ্ন হচ্ছে কামিনী এবং কাঞ্চন। রামকৃষ্ণের এই বাণী আমি সত্য বলে মেনে নিয়েছিলাম।

গোড়ার দিকে রামকৃষ্ণের উপদেশ অনুযায়ী চলতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল—যৌনপ্রবৃত্তি দমন করবার জন্য আমি যত বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতাম প্রব‍ৃত্তির তীব্রতাও যেন ততই বেড়ে যেত। কতকগুলি যোগাসন এবং বিশেষ প্রক্রিয়ার ধ্যানের সাহায্যে যৌনসংযম আমার কাছে সহজসাধ্য হয়ে এসেছিল এবং আমি নিজেকে বেশ নিরাসক্ত করে এনেছিলাম। কিন্তু নিরাসক্তি বলতে রামকৃষ্ণ যাতে বিশ্বাস করতেন সে আমার কাছে একেবারে অসম্ভব বলে মনে হত। যাই হোক, হাল না ছেড়ে অসম্ভবকে সম্ভব করার চেষ্টা করেছিলাম। কখনো আসত হতাশা, কখনো অনুশোচনা। সে সময়ে একবারও মনে হয়নি যে যৌনপ্রব‍ৃত্তিটা মানুষের পক্ষে কতখানি স্বাভাবিক। রামকৃষ্ণের আদর্শকে জীবনের মুলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করে তখন আমি আজীবন ব্রহ্মচারী থাকবার সাধনায় রত।

মানুষের স্বাভাবিক যৌনপ্রবৃত্তিকে দমন করবার জন্য এত সময় ও শক্তির অপচয়ের কোনো সার্থকতা আছে কি না এ সম্বন্ধে আজকের সিনে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে। কৈশোর এবং যৌবনে ব্রহ্মচর্য পালনের অবশ্যই প্রয়োজন আছে, কিন্তু রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের মতে যৌনচেতনাকে চিরকালের মতন সম্পূর্ণভাবে দমন করা উচিত। আমাদের শরীর ও মনের বল তো আর অপর্যাপ্ত নয়। এক্ষেত্রে যৌনপ্রব‍ৃত্তি দমনের অসাধ্যসাধনে সময় ও শক্তির এত অপচয় সত্যিই কি সমর্থনযোগ্য? আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য যৌনপ্রবৃত্তি দমন কি একান্তই অপরিহার্য? দ্বিতীয়ত, আধ্যাত্মিক উন্নতির চাইতে জনসেবাই যার জীবনে বড় স্থান অধিকার করেছে তার পক্ষে ব্রহ্মচর্যের প্রয়োজনীয়তা কতখানি? এই দুটি প্রশ্নের জবাব যাই হোক না কেন, ১৯১৩ সালে আমি যখন কলেজে ঢুকলাম তখন আমার মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য যৌনপ্রবৃত্তি দমন একান্ত প্রয়োজন এবং আধ্যাত্মিক সাধনায় সিদ্ধিলাভ না করলে বেঁচে থাকারই কোনো অর্থ হয় না। কিন্তু মনে মনে এই সংকল্প থাকলেও তাকে কার্যে পরিণত কৱা আমার পক্ষে তখনো সুদূরপরাহত ছিল।

জীবনটাকে গোড়া থেকে যদি আবার শুরু করা যেত তবে বোধ হয় আমি কখনোই যৌনপ্রবৃত্তি দমনের প্রয়োজনীয়তাকে এতখানি বড় করে দেখতাম না। অবশ্য তাই বলে ভাববেন না আমি যা করেছিলাম তার জন্য অনুশোচনা করছি। যৌনপ্রবৃত্তি দমন করা নিয়ে বাড়াবাড়ি করে যদি আমি ভুল করেও থাকি তবে সে আমার পক্ষে শাপে বর হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কারণ এই কৃচ্ছসাধনের ফলে জীবনের সবরকম বাধাবিঘ্ন, দুঃখকষ্টের জন্য নিজেকে আমি প্রস্তুত করে তুলতে পেরেছিলাম।

পুরনো কথায় ফিরে আসা যাক। কলকাতায় আমি ভরতি হলাম প্রেসিডেন্সি কলেজে। প্রেসিডেন্সি ছিল সে সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সবচেয়ে ভালো কলেজ। গ্রীষ্মের বন্ধের পর কলেজ খোলবার তখনো তিনমাস বাকি। এই তিনমাস আমি বসে ছিলাম না। একবছর আগে কটকে যে ছেলেটির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছিল, তার দলটিকে খুঁজে বের করলাম। সাধারণত যোলো বছরের একটি ছেলে যদি একা কলকাতার মতো বড় শহরে আসে তবে প্রথম প্রথম সে দিশা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু আমার বেলা তা ঘটেনি—কলেজ খোলবার আগেই আমি কলকাতায় বেশ গ‍ুছিয়ে বসলাম, পছন্দমতো অনেক বন্ধুও জুটিয়ে ফেললাম।

কলেজে প্রথম কয়েকদিন ভারি মজায় কেটেছিল। যে কোনো বৃটিশ য়ুনিভার্সিটির চাইতে এদেশের কোনো য়ুনিভার্সিটির প্রবেশিকা পরীক্ষা অনেক সহজ বলে এদেশের ম্যাট্রিকুলেটরা ইংরেজ ছেলেদের চেয়ে একটু অল্প বয়সেই কলেজে ভরতি হয়। আমি যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হলাম তখন আমার বয়স ষোলোর সামান্য উপরে, তবু কলেজে ঢোকবার সময়ে মনে হল আমি যেন বড়দের পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। অনুভূতিটা বেশ সুখকর সন্দেহ নেই। প্রথম কয়েকটা দিন নতুন বন্ধুত্ব পাতাতেই কেটে গেল। প্রবেশিকা পরীক্ষায় যারা উঁচু স্থান অধিকার করেছিল তাদের দেখবার জন্য সকলেই ব্যঘ্র হয়ে হিল। মফঃস্বল থেকে আসার দর‍ুন আমি গোড়ার দিকে একটু লাজুক ও মুখচোৱা গোছের ছিলাম। কলকাতার হিন্দু এবং হেয়ার স্কুল জাতীয় আরো স্কুল থেকে কয়েকটি অত্যন্ত চালিয়াত এবং সবজান্তা ছেলে এসে আমাদের সঙ্গে ভরতি হয়েছিল। কিন্তু তাদের চালিয়াতি বেশিদিন টেকেনি, কারণ প্রবেশিকা পরীক্ষায় উঁচু স্থানগুলি বেশির ভাগই অধিকার করেছিল মফঃস্বলের ছাত্ররা, তাছাড়া আরও কিছুদিনের মধ্যেই শহুরে ছেলেদের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিতে শুরু করেছিলাম।

অল্পদিনের মধ্যেই আমি সহপাঠীদের মধ্য থেকে আমার মতোই একদল ছেলে জূটিয়ে ফেললাম। আমাদের এই দলের সকলেই বাইরে বেশ একটু গোঁড়াভাব নিয়ে চলাফেরা করতাম বলে সহজেই লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। কিন্তু লোকে কী ভাবে না ভাববে তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতাম না। তখনকার দিনে কলেজের ছাত্রদের মধ্যে এরকম অনেক বিভিন্ন ধরনের দল দেখা যেত। রাজা ও ধনীর দুলাল এবং তাদের মোসাহেবদের নিয়ে এমনি একটি দল ছিল। এরা সেজেগ‍ুেজ বেড়াত আর পড়া পড়া খেলত। আর একটি দল ছিল গ্রন্থকীটদের—পুরু কাচের চশমাপরা শান্তশিষ্ট, সবোধস‍ুশীল গোছের, এই ছেলেরা পড়া ছাড়া জগতে আর কিছুই জানত না। তৃতীয় একটি দলে ছিল অনেকটা আমাদের মতোই একদল পরম উৎসাহী ছেলে—নিজেদের তারা রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের মানসপুত্র বলেই বোধ হয় মনে করত। এই কটি দল ছাড়া একটি গুপ্ত বিপ্লবী দল ছিল। এদেৱ সম্বন্ধে বেশির ভাগ ছেলেই বিশেষ কিছু জানত না। আজকের প্রেসিডেন্সির সঙ্গে সেযুগের প্রেসিডেন্সি কলেজের অনেক প্রভেদ ছিল। অধ্যাপকমণ্ডলীতে সে সময়ে জগদীশচন্দ্র বসু এবং প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো মনীষীদের উপস্থিতি এর একটা কারণ। সরকারী কলেজ হলেও প্রেসিডেন্সির ছাত্ররা মোটেই সরকারভক্ত ছিল না। এর কারণ, লেখাপড়ায় ভালো হলেই যে-কোনো ছেলে প্রেসিডেন্সিতে ঢুকতে পারত। সি. আই. ডি. মহলে প্রেসিডেন্সির ছাত্রদের অত্যন্ত বদনাম ছিল বলে শোনা যায়। ইডেন হিন্দু হস্টেলকে তো বিপ্লবীদের প্রধান আড্ডা বলে ধরা হত। এজন্য পুলিশ প্রায়ই এসে হস্টেল খানাতল্লাসী করে যেত। কলেজে প্রথম দুবছর রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ ভক্তদের প্রভাব আমার উপর খুব বেশি ছিল। দলের অধিকাংশই ছিল ছাত্র এবং এদের নেতা ছিল মেডিক্যাল কলেজের দুজন ছাত্র—সূরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও যুগোলকিশোর আঢ্য। এরা রামকৃষ্ণ এবং বিবেকানন্দের আদর্শকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিল, তবে আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য একা জনসেবার উপরেই বেশি জোর দিত। জনসেবা বলতে এদের বিবেকানন্দের শিষ্যদের মতো হাসপাতাল বা দাতব্য চিকিৎসালয় ইত্যাদি স্থাপন করার উপরে বিশেষ আস্থা ছিল না—এদের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার প্রসারের মধ্য দিয়ে দেশের উন্নতি করা। এ ব্যাপারে এদের উপর খৃস্টান মিশনারিদের প্রভাব পড়া বিচিত্র নয়। বিবেকানন্দের শিষ্যরা অর্থাৎ রামকৃষ্ণ মিশনের কর্মীরা বিবেকানন্দের আদর্শ পুরোপুরি অনুসরণ করেননি। আমরা এই ত্র‌ুটি সংশোধন করতে এগিয়ে গেলাম। আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হল ধর্ম এবং জাতীয়তার সমন্বয় ঘটানো—শ‍ুধু চিন্তায় নয়, কাজেও। তখনকার দিনে কলকাতার রাজনৈতিক আবহাওয়ায় জাতীয়তাবাদ প্রায় অপরিহার্য ছিল।

১৯১৩ সালে যখন আমি কটক ছেড়ে আসি তখন পর্যন্ত আমার মনে জীবনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সুস্পষ্ট কোনো ধারণাই জন্মায়নি। শ‍ুধু জনসেবা সম্বন্ধে একটা অস্পষ্ট ধারণা আমার মনে ছিল, আর ছিল আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতি একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ। কলকাতায় এসে আমি ধীরে ধীরে সব বুঝতে শিখলাম। জানলাম জনসেবা যোগসাধনারই একটি অঙ্গ— এবং জনসেবার মধ্য দিয়েই দেশের উন্নতি সম্ভব। জনসেবা সম্বন্ধে আমাদের দলের ছেলেদের জ্ঞান এর বেশি তখনো অগ্রসর হয়নি—আমার মতোই তারা এ সম্বন্ধে আরো স্পষ্ট ধারণার জন্য অন্ধকার হাতড়ে বেড়াচ্ছিল। যাই হোক, আমাদের দলের একটা খুব বড় গুণ ছিল—দলের ছেলেরা সকলেই ছিল অত্যন্ত চটপটে এবং কর্মঠ এবং এদের মধ্যে অনেকে ভালো ছাত্র হিসেবেও খুব নাম করেছিল। এই দলের কার্যকলাপ তিনটি ধারায় বিভক্ত ছিল। প্রথমত, নতুন নতুন ভাবধারার সন্ধানে দর্শন, ইতিহাস এবং জাতীয়তাবাদের উপরে নতুন নতুন বই পড়া এবং এইভাবে যে জ্ঞান লাভ হত সেটা সকলের মধ্যে সঞ্চারিত করে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় এবং বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন সভ্য সংগ্রহ করাও আমাদের অন্যতম কাজ ছিল, ফলে অল্পদিনের মধ্যেই বহুলোকের সঙ্গে আমাদেৱ যোগাযোগ ঘটেছিল। আমাদের তৃতীয় কাজ ছিল নামকরা লোকদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করা। যদি কোনো সাধু সন্ন্যাসীর কাছে সত্যের সন্ধান মেলে সেই আশায় বারাণসী, হরিদ্বার ইত্যাদি তীর্থস্থান পরিদর্শন করে ছুটির দিনগুলি কাটানো হত। অনেকে আবার দেশের প্রকৃত ইতিহাসের সন্ধানে ঐতিহাসিক জায়গাগুলিতে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করত। আমি একবার এমনি একটি দলের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ গিয়েছিলাম। সাতদিন ধৱে পরিভ্রমণ করার ফলে প্রাক্-বৃটিশ যুগের বাঙলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ সম্বন্ধে বহু মূল্যবান তথ্য আমরা আবিষ্কার করেছিলাম—স্কুল-কলেজে মাসের পর মাস পড়লেও বা কখনোই সম্ভব হত না।

কতকগুলি সমস্যা তখনো পর্যন্ত আমরা ঠিকমতো সমাধান করে উঠতে পারিনি। পরিবারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী দাঁড়াবে বুঝতে পারছিলাম না। দলের নাম, আইনকানুন বা নিদিষ্ট একটি কর্ম্মপস্থা তখনো ঠিক হয়নি। অনেক আলাপ আলোচনার পর ভেবেচিন্তে শেষটায় ঠিক হল, সত্যিকারের ভালো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমরা গড়ে তুলবো। চতুর্দিকে এই প্রতিষ্ঠানের শাখা থাকবে। দলের কয়েকজন এই উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন এবং উত্তর ভারতের গ‍ুরুক‍ুল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সমসাময়িক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাব্যবস্থা পরিদর্শন করতে শুরু করল। বেছে বেছে ভালো ছাত্রদের আমাদের দলভুক্ত করা হত, যাতে ভবিষ্যতে আমাদের পরিকল্পিত প্রতিষ্ঠানে ভালো অধ্যাপকের অভাব না হয়। দলের সকলেই আমরা ব্রহ্মচর্যের ব্রত নিয়েছিলাম। দলের নেতৃস্থানীয়েরা সকলকে আগে থেকেই বলে দিতেন—এক সময়ে না এক সময়ে পরিবারের সঙ্গে বিরোধ ঘটবেই। তাই বলে অবিশ্যি গোড়া থেকেই পরিবারের বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হবার নির্দেশ দেওয়া হত না। কিন্তু আমরা যেভাবে চলাফেরা করতাম তাতে পরিবারের সঙ্গে বিচ্ছেদ প্রায় অনিবার্য ছিল। ছুটির দিনে প্রায়ই বাড়ি থাকতাম না, অভিভাবকদের অনুমতি নেবারও প্রয়োজন বোধ করতাম না। কখনো কখনো বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনের মঠ বা ঐ জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানে দল বেঁধে বেড়াতে যেতাম। কখনো নামকরা লোকদের সঙ্গে দেখা করতে যেতাম—১৯১৪ সালে আমরা কবি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে যাই, সে সময়ে তিনি পল্লীসংস্কার সম্বন্ধে আমাদের নানা উপদেশ দেন। কংগ্রেস তখনো পল্লীসংগঠনের কাজে হাত দেয়নি। আগেই বলেছি নানা জায়গায় আমাদের দলভুক্ত লোক ছিল। মাঝে মাঝে তাদের কাছ থেকে আমন্ত্রণ আসত। একটা দিন তাদের সঙ্গে কাটিয়ে আসতাম। কলেজের বাইরে আমার বেশি সময়ই কাটত দলের ছেলেদের সঙ্গে। বাড়ির প্রতি আমার কোনো আকর্ষণই ছিল না—আমার আদর্শের সঙ্গে বাড়ির ধারার কোনো মিল খুঁজে পেতাম না। ঘর ও বাইরের এই দোটানায় পড়ে চিরকালই আমি বড় অশান্তি ভোগ করেছি। বিশেষ করে আমার আদর্শ বা কার্যকলাপ সম্বন্ধে যখন বাড়িতে বির‍ূপ সমালোচনা হত মন বেদনায় ভরে উঠত। রাজনীতির দিক থেকে আমাদের দল সবরকম সন্ত্রাসবাদী বা ষড়যন্ত্রম‍ূলক কার্যকলাপের বিপক্ষে ছিল। এজন্য ছাত্রমহলে আমরা তেমন জনপ্রিয় ছিলাম না, কারণ তখনকার দিনে বাঙলাদেশের ছাত্রদের সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের প্রতি অদ্ভ‌ুত একটা আকর্ষণ ছিল। এমন কি যেসব ছেলেরা এই ধরনের সন্ত্রাসবাদী দলের ছায়া মাড়াতেও ভয় পেত তারাও মনে মনে সন্ত্রাসবাদীদের সম্বন্ধে খুব উঁচু ধারণা পোষণ করত। অনেক সময়ে নতুন সভ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সন্ত্রাসবাদী দলের সঙ্গে আমাদের দলের সংঘর্ষ লাগত। একবার বেশ একটা মজার ব্যাপার হয়েছিল। আমাদের কার্যকলাপ দেখে সি. আই. ডি.র কর্মকর্তাদের সন্দেহ হল ধর্মচর্চার ছদ্মবেশে আমরা হয়তো গোপনে অন্য কিছু করছি। এই সন্দেহে আমাদের দলের একটি সভ্যকে গ্রেপ্তার করার আয়োজন হল। সি. আই. ডি.র ধারণা ছিল এই সভ্যটিই দলের নেতা। এই সময়ে একটি সন্ত্রাসবাদী দলের দুজন সভ্যের চিঠিপত্র পুলিশের হাতে পড়ে—এই চিঠিগুলি থেকে পুলিশ জানতে পারে যে আমাদের দলের সেই সভ্যটিকে সন্ত্রাসবাদীরা পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলবার প্রস্তাব করছিল কারণ সে নাকি সন্ত্রাসবাদী দলের অনেক সভ্যকে আমাদের দলভুক্ত করে অহিংসা শিক্ষা দিচ্ছিল। এই চিঠি পড়ে আমাদের দলের প্রকৃত পরিচয় পেয়ে পুলিশ সেই সভ্যটিকে গ্রেপ্তারের হাত থেকে অব্যাহতি দেয়; আমাদেরও পুলিশের কোপদৃষ্টিতে পড়তে হয়নি। ১৯৯৩ সালে শীতের সময়ে আমরা কলকাতা থেকে ৫০ মাইল দূরে হ‍ুগলি নদীর ধারে অবস্থিত শান্তিপুর নামে একটি জায়গায় গিয়ে কিছুদিন গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী হয়ে বাস করছিলাম। হঠাৎ একদিন পুলিশ এসে আমাদের আস্তানা খানাতল্লাসী করে সকলের নামধাম লিখে নিয়ে চলে গেল। ব্যাপারটা এর বেশি আর গড়ায়নি।

তখনো আমি বি. এ. পাশ করিনি, সে সময়ে বাঙলাদেশের নেতাদের, ময্যে অরবিন্দ ঘোষই ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয়—যদিও ১৯০৯ সাল থেকে তিনি স্বেচ্ছায় বাঙলাদেশ ছেড়ে বিদেশে নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন। তাঁর নাম তখন লোকের মুখে মুখে। রাজনীতির জন্য তিনি জীবনের সবরকম সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়েছিলেন। কংগ্রেসের অন্য সব নেতাদের দৃষ্টি যখন ঔপনিবেশিক স্বায়ত্ত শাসনের গণ্ডীতে আবদ্ধ, একমাত্র তিনিই তখন নির্ভয়ে পূর্ণস্বরাজের দাবি জানিয়েছিলেন এবং মুক্তকণ্ঠে বামপন্থী আদর্শ প্রচার করেছিলেন। হাসিমুখে তিনি কারাবাসও করেছিলেন। লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার ফলে সারা ভারতেই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। লোকমান্য তিলক ‘বড়দাদা’ নামে পরিচিত ছিলেন এবং অরবিন্দ ছিলেন ‘ছোটদাদা’। তিলক ছিলেন বামপন্থীদের নেতা। অরবিন্দর ছোটভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ছিলেন সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের অগ্রদূত। পুলিশ সন্দেহ করত বারীন্দ্রের সঙ্গে অরবিন্দের গোপন যোগাযোগ আছে—এ সম্পর্কে নানারকম জনশ্রুতিও ছিল। এর ফলে অরবিন্দের প্রতি দেশের যুবসম্প্রদায়ের শ্রদ্ধার সীমা ছিল না। তাছাড়া তাঁর মধ্যে রাজনীতি ও আধ্যাত্মিকতার যে সমন্বয় ঘটেছিল তার জন্য ধর্মভাবাপন্ন লোকেদের কাছেও তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯১৩ সালে আমি যখন কলকাতায় আসি তথনই দেশ অরবিন্দকে মহাপুরুষ বলে স্বীকার করে নিয়েছে। তাঁর সম্বন্ধে জনসাধারণের মনে যে উৎসাহ, যে প্রীতি দেখেছি সে রকম আর কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। অরবিন্দ সম্বন্ধে সে সময়ে কত রকম জনশ্রুতি মে শোনা যেত তার ইয়ত্তা নেই, তার মধ্যে হয়তো কতক সত্যি, কতক মিথ্যা। একবার শুনলাম অরবিন্দ নাকি পেনসিল হাতে অর্ধ-সমাধিমগ্ন অবস্থায় নিজেরই সঙ্গে কথোপকথন লিপিবদ্ধ করতেন—এইসব স্বগতোক্তিতে তিনি তাঁর দ্বিতীয় সত্তার নাম দিয়েছিলেন ‘মানিক’। তাঁর বিচারের সময়ে পুলিশ অনেকগুলি কাগজপত্রে এই মানিকের সঙ্গে কথোপকথনের প্রতিলিপি পায়। যে পুলিশ প্রসিকিউটর এটি প্রথম আবিষ্কার করে সে যখন উত্তেজনায় অধীর হয়ে হঠাৎ একদিন কোর্টে দাঁড়িয়ে ‘মানিক’ নামধারী এই নবাবিষ্কৃত ষড়যন্ত্রকারীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা দাবি করেছিল সারা কোর্টে সেদিন হাসাহাসির ধুম পড়ে গিয়েছিল। তখনকার দিনে সকলেই বলাবলি করত যে অরবিন্দ বারো বছরব্যাপী ধ্যান করার জন্যই পণ্ডিচেরী গিয়েছেন। বারো বছর পূর্ণ হলে তিনি গৌতম বুদ্ধের মতো সিদ্ধিলাভ করে দেশ উদ্ধার করতে আবার কর্মজীবনে ফিরে আসবেন। অনেকেই এই কথা বিশ্বাস করত। বিশেষ করে যারা ভারত অলৌকিক শক্তি ছাড়া অন্য কোনোভাবে ইংরেজদের সঙ্গে পেরে ওঠা যাবে না তাদের কাছে এই কাহিনী তো প্রায় ধ্র‌ুবসত্যের মতো ছিল। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হবার পর যখন প্রবল আন্দোলন শ‍ুরু হয় সে সময়ে অনেক অদ্ভ‌ুত গল্প শোনা যেত। চারদিকে রটে গেল ইংরেজদের সঙ্গে যেদিন আমাদের যুদ্ধ শ‍ুর‍ু হবে সেদিন কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গে একদল কম্বলধারী সন্ন্যাসী প্রবেশ করবেন। এই সন্ন্যাসীদের অলৌকিক শক্তির প্রভাবে ইংরেজ সৈন্যৱা স্থাণ‍ুর মতো দাঁড়িয়ে থাকবে, আর বিনাবাধায় আমাদের হাতে ক্ষমতা চলে আসবে। এই ধরনের কত রকম অসম্ভর কল্পনা যে সে সময়ে আমাদের মাথায় ঘুরত তার ঠিক নেই। কলেজে পড়বার সময়ে অরবিন্দর লেখা এবং চিঠিপত্র পড়ে তাঁর প্রতি আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। সে সময়ে অরবিন্দ ‘আর্য' নামে একটি মাসিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। এই পত্রিকার মধ্য দিয়েই তিনি তাঁর আদর্শ প্রচার করতেন। বাঙলাদেশের বিশিষ্ট কয়েকজন লোকের কাছে তিনি চিঠিপত্রও লিখতেন। এইসব চিঠি লোকের হাতে হাতে ঘুরত। রাজনীতির সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়ে যারা বিশ্বাস করতেন তাঁদের কাছে চিঠিগ‍ুলির বিশেষ মূল্য ছিল। আমাদের হাতেও মাঝে মাঝে এই চিঠি আসত। সকলকে সেইসব চিঠি পড়ে শোনান হত। একটি চিঠিতে অরবিন্দ লিখেছিলেন, “আমাদের প্রত্যেককে আধ্যাত্মিক বিদ্যুৎশক্তির এক একটি ডাইনামো হতে হবে, যাতে আমরা যখন উঠে দাঁড়াব তখন চারপাশে হাজার হাজার লোকের মধ্যে আলো ছড়িয়ে পড়ে— তারা স্বর্গীয় আনন্দ লাভ করে।” চিঠি পড়ে আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে শ‍ুর‍ু করেছিলাম দেশের সেবা করতে হলে আধ্যাত্মিক শক্তির একান্ত প্রয়োজন।

কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি অরবিন্দর চমকপ্রদ এইসব বাণী আমাকে ততটা আকৃষ্ট করেনি যতখানি করেছিল তাঁর জীবন-দর্শন। শস্করাচার্যের মায়াবাদের প্রভাব আমি কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না, মনেপ্রাণে গ্রহণ করতেও বাধা ছিল। এই অবস্থা থেকে উদ্ধারের পথ খুঁজছিলাম। একের সঙ্গে বহ‍ুর, ব্রহ্মের সঙ্গে ব্রহ্মাণ্ডের একাত্মতার যে বাণী রামকৃষ্ণ এবং বিবেকানন্দ প্রচার করে গিয়েছিলেন তাতে আমার মন কিছুটা সংশয়মুক্ত হয়েছিল সত্যি, কিন্তু মায়াবাদের প্রভার পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এই সময়ে অরবিন্দ এলেন মুক্তির বার্তা নিয়ে। তিনি শ‍ুধু জড় ও চৈতন্য, ব্রহ্ম ও ব্রহ্মাণ্ডের একাত্মতা প্রমাণ করেই ক্ষান্ত হলেন না, বিভিন্ন যোগের একটি সময়ের সাহায্যে পরমজ্ঞান লাভের পথও নির্দেশ করলেন। হাজার হাজার বছর আগে ভগবদ্গীতা যোগসাধনার বিভিন্ন পথের সন্ধান দিয়েছিল। এই বিভিন্ন পথ হল-জ্ঞানের মধ্য দিয়ে আত্মোপলব্ধি বা জ্ঞানযোগ; ডক্তি এবং প্রেমের মধ্য দিয়ে আত্মোপলব্ধি বা ভক্তিযোগ; এবং নিষ্কাম কর্মের মধ্য দিয়ে আত্মোপলব্ধি বা কর্মযোগ। পরবর্তী কালে এদের সঙ্গে আরো দুটি মত যুক্ত হয়েছে—হঠযোগ এবং রাজযোগ। হঠযোগের উদ্দেশ্য শরীরকে সম্পূর্ণ নিজের কর্তৃত্বাধীনে আনা, আর রাজযোগের উদ্দেশ্য শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে মনকে নিজের কর্তৃত্বাধীনে আনা। বিবেকানন্দ বলতেন চরিত্র গঠন করতে জ্ঞান, ভক্তি এবং কর্ম— তিনেরই প্রয়োজন। বিভিন্ন যোগের একটি সুষ্ঠ‌ু সমন্বয় কী করে হতে পারে সে সম্বন্ধে অরবিন্দর ধারণায় বেশ আঙিনবত্ব ছিল। তিনি দেখাতে চেষ্টা করেছিলেন বিভিন্ন যোগের সাহায্যে কী ভাবে ধাপে ধাপে পরম সত্যে পৌঁছন যায়। বাঙলার তৎকালীন বৈষ্ণবদের কর্মএবং জ্ঞান-বিমুখতার তুলনায় অরবিন্দর এই নতুন দর্শন আমার কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছিল—আমি যেন প্রকৃত সত্যের সন্ধান পেলাম। অরবিন্দ শ‍ুধু যদি সে সময়ে কর্মজীবনে ফিরে আসতেন তবে বিনা দ্বিধায় তাঁকে মানবজাতির আদর্শগ‍ুর‍ু বলে মেনে নিতাম।

সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির লোক ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। তাঁকে এক সময়ে বাঙলার মুকুটহীন রাজা বলা হত। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতাদের তিনি অন্যতম। যতদূর মনে পড়ে ১৯১৩ সালের শেষে কিংবা ১৯১৪ সালের গোড়ায় দক্ষিণ আফ্রিকায় মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ সম্পর্কে কলকাতার টাউন হলে অনুষ্ঠিত একটি সভায় তাঁকে প্রথম দেখি। তখন পর্যন্ত সুরেন্দ্রনাথের অসাধারণ বাগ্মিতায় দেশ মুগ্ধ। সভার মধ্যেই তিনি প্রচুর টাকা তুলে ফেললেন। কিন্তু অত ভালো বক্তা হলেও সুরেন্দ্র নাথের মধ্যে সেই প্রাণস্পর্শ ছিল না যা অরবিন্দর অতি সাধারণ কথার মধ্যেও পাওয়া যেত; অরবিন্দ বলতেন, “আমি চাই তোমরা বড় হয়ে ওঠো, তোমাদের নিজেদের স্বার্থের জন্য নয়, স্বদেশের জন্য, যাতে জগতের অন্য সব স্বাধীন দেশের মাঝে ভারতবর্ষও সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে। তোমাদের মধ্যে যারা দীনদরিদ্র, আমি চাই শত দুঃখ দারিদ্র্যের মধ্যেও যেন তারা দেশের সেবা করতে না ভোলে। তোমাদের কাজের মধ্য দিয়েই দেশের উন্নতি, তোমাদেৱ বেদনাতেই দেশের মুক্তি।”

যতদিন পর্যন্ত রাজনীতিতে আমার ঝোঁক খায়নি ততদিন দুটো জিনিস নিয়ে আমি মত্ত ছিলাম—প্রথমত, ধর্মপ্রচারক দেখলেই নির্বিচারে তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা, দ্বিতীয়ত, জনসেবার শিক্ষানবিশী করা। কলকাতায় বোধ হয় এমন কোনো ধর্মপ্রতিষ্ঠান ছিল না যার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ না ছিল। জনসেবার ব্যাপারেও আমার বেশ বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সে সময়ে দক্ষিণ কলকাতায় অনাথ ভাণ্ডার নামে একটি দরিদ্র সেবা প্রতিষ্ঠান ছিল। জনসেবার উৎসাহে আমি এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। আমাদের কাজ ছিল প্রতি রবিবার বাড়ি বাড়ি ঘুরে অর্থ এবং চালডাল সংগ্রহ করে দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা। এই কাজটা সাধারণত ছাত্রকর্মীদের উপরে দেওয়া হত। আমি ওদের দলে ভিড়ে ভিক্ষা করে বেড়াতে লাগলাম। সাধারণত চালটাই পাওয়া যেত। নিয়ম ছিল দিনের শেষে প্রত্যেককে অন্তত একমন থেকে দুমন পর্যন্ত চাল এনে দিতে হবে। প্রথম যেদিন ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে পথে বেরোলাম, এ ধরনের কাজে অনভ্যস্ততার দর‍ুন লজ্জায় আমার প্রায় মাথা কাটা যাবার উপক্রম হয়েছিল। আমার এই ভিক্ষা করে বেড়ানোর কথা আজও বোধ হয় বাড়ির কেউ জানে না। বহুদিন পর্যন্ত এই লজ্জা আমি কাটিয়ে উঠতে পারিনি—যখনই চেনা কার‍ুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার ভয় থাকতো ভিক্ষার ঝুলিটা কাঁধে ফেলে ডাইনে বাঁয়ে না তাকিয়ে সটান এগিয়ে যেতাম।

কলেজে আমি পড়াশোনায় ফাঁকি দিতে শুরু করলাম। অধ্যাপকদের কাউকেই আমার ভালো লাগত না, তাঁদের পড়ানোতে কোনো রস পেতাম না। ক্লাসে অধ্যাপকের পড়ানোয় মন না দিয়ে বসে বসে ভাবতাম—লেখাপড়া করে কী লাভ? সবচেয়ে বিরক্ত লাগত অঙ্কের অধ্যাপকের একঘেয়ে বক্ত‌ৃতা। তাঁর কোনো কথা আমার কানে যেত না, গেলেও তার মানে বুঝতাম না। কলেজ-জীবনের এই একঘেয়েমি কাটাবার জন্য আমি জনহিতকর নানা কাজে মেতে থাকতাম। খেলাধুলায় আমার উৎসাহ ছিল না, আগেই বলেছি। আমার দৃষ্টি ছিল অন্য দিকে। নিজের থেকেই আমি বিখ্যাত রসায়নবিদ্ অধ্যাপক স্যর পি. সি. রায়ের সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। পি. সি. রায় অবিশ্যি আমাদের পড়াতেন না, কিন্তু তাঁর মহানুভবতার জন্য ছাত্র মহলে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা, বন্যা বা দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য টাকা তোলা, ছাত্রদের প্রতিনিধি হয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা বলা, সহপাঠীদের নিয়ে বাইরে বেড়াতে যাওয়া—এই ধরনের কাজ আমার খুব ভালো লাগত। এর ফলে কিছুদিনের মধ্যেই আত্মকেন্দ্রিকতা কাটিয়ে উঠে আমি বেশ সামাজিক হয়ে উঠলাম—মন থেকে যোগের প্রভাবও কেটে যেতে লাগল।

ভাবলে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয় মাঝে মাঝে মনের বিশেষ কোনো দুর্বল মুহুর্তে তুচ্ছতম ঘটনাও আমাদের জীবনকে কী ভাবে, প্রভাবান্বিত করে। কলকাতায় আমাদের বাড়ির সামনে প্রতিদিনই একটি বুড়ি ভিক্ষা করতে বসত। বাড়িতে ঢুকতে বা বাড়ি থেকে বেরোতে সর্বদাই ভিখিরীটি চোখে পড়ত। পরনে শতচ্ছিন্ন বস্ত্র, সেই বৃদ্ধার বেদনাক্লিষ্ট চেহারাটা যতবারই দেখতাম, যতবারই ওর কথা ভাবতাম বেদনায় আমার মন ভরে যেত। ওর অবস্থার সঙ্গে তুলনা করে দেখে নিজেকে কেমন যেন দোষী দোষী মনে হত। মনে প্রশ্ন জাগত—আমি তিনতলা বাড়িতে বসে আরামে দিন কাটাচ্ছি, আর এই বেচারীর না আছে খাওয়াপরার সংস্থান, না আছে মাথা গোঁজবার ঠাঁই—এ কি অবিচার নয়? জগতে যদি দুঃখদারিদ্র্য নাই ঘুচল, তবে যোগের সাথকতা কি? এইসব কথা ভাবলে সমাজব্যবস্থার বির‍ুদ্ধে। মন বিদ্রোহ করে উঠত। কিন্তু আমি কিই বা করতে পারতাম? সমাজব্যবস্থা বদলানো তো একদিনের কর্ম নয়। যাই হোক, যতদিন তা না হচ্ছে, এই দুঃখিনীর একটা উপায় করা দরকার। কলেজে যাতায়াতের জন্য ট্রামভাড়া বাবদ আমি যে পয়সা পেতাম, ঠিক করলাম এবার থেকে সেই পয়সা জমিয়ে গরিব দুঃখীদের দান করব। বাড়ি থেকে কলেজ প্রায় তিন মাইল দূর—প্রায়ই হেঁটে বাড়ি ফিরতাম, হাতে সময় থাকলে কখনো কখনো যেতামও হেঁটে। এতে বিবেকের দংশন থেকে খানিকটা মুক্তি পেয়েছিলাম।

কলেজে প্রথম বছর ছুটিতে বাবা-মার কাছে কটকে ফিরে গেলাম। এবার আর আমার পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করতে কোনো বাধা দিলেন না বাবা-মা, কারণ আমার কলকাতার কার্যকলাপের কথা তাঁদের অজানা ছিল না। কটকে থাকতে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যথেষ্ট ঘুরে বেড়িয়েছি, কিন্তু রাত্রিবেলা বাড়ি ফিরিনি, এমন কখনো হয়নি। কলকাতায় রাতের পর রাত বাইরে কাটিয়েছি—অভিভাবকদের অনুমতি নেবার কোনো প্রয়োজন বোধ করিনি। কটকে ফিরে আমি নিজেকে শুধরে নিলাম। একবার বাবা-মা কটকের বাইরে কোথায় গিয়েছেন, কয়েকজন বন্ধু এসে জানাল কাছেই একটি গ্রামে কলেরা লেগেছে, সেখানে শ‍ুশ্র‌ূষা করতে যেতে হবে। আমাদের দলে কোনো ডাক্তার ছিল না। শুধু আধা-ডাক্তার গোছের একজন ছিল। থাকাবার মধ্যে তার ছিল হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার একটি বই, এক বাক্স হোমিওপ্যাথি ওষুধ আর ছিল প্রচুর সাধারণজ্ঞান। আমি তখুনি রাজী হয়ে গেলাম। বাবার অবর্তমানে কাকা ছিলেন আমার অভিবাবক, তাঁকে বললাম কয়েকদিনের জন্য একটু বেড়াতে যাচ্ছি। আমি যে কলেরার রোগীর শ‍ুশ্র‌ূষা করতে যাচ্ছি তিনি টের পাননি, কাজেই সহজেই মত দিলেন। আমি সপ্তাহখানেক মাত্র বাইরে ছিলাম, কারণ আমাদের আর কয়েকদিন পরেই কাকা আমাদের আসল উদ্দেশ্য জানতে পেরে আমার আর এক কাকাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। বহু খোঁজাখুঁজি করে তবে তাঁরা আমাদের নাগাল পেয়েছিলেন।

তখনকার দিনে লোকে বিশ্বাস করতে চাইত না যে কলেরা সারানো যায়। কাজেই কলেরার রোগীর শ‍ুশ্র‌ূষা করতে সহজে কেউ এগিয়ে আসত না। এদিক থেকে আমাদের দলটি ছিল সম্পূর্ণ ভয়শূন্য। বলতে গেলে কলেরার ছোঁয়াচ এড়াবার জন্য আমরা কোনো রকম সাবধানতাই অবলম্বন করিনি—এক সঙ্গেই সবাই থাকতাম, খেতাম। রোগের চিকিৎসা আমরা সামান্যই করতে পেরেছিলাম। আমরা পৌঁছবার আগেই অনেক রোগী মারা গিয়েছিল এবং যাদের আমরা শ‍ুশ্র‌ূষা করেছিলাম তাদের মধ্যেও বেশির ভাগই রাঁচেনি। যাই হোক, এক সপ্তাহে আমি যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলাম তাতে ভারতের সত্যিকার রূপটি আমার চোখে ধরা পড়েছিল যে, ভারতের গ্রামে গ্রামে শ‍ুধু নিদারুণ দারিদ্র্য, মৃত্যুর তাণ্ডবলীল, আর নিরক্ষতার অভিশাপ। সঙ্গে আমাদের জামাকাপড় বা বিছানাপত্র বলতে বিশেষ কিছু ছিল না, কারণ বহুদূর পথ পায়ে হেঁটে আমাদের পার হতে হত। পথে যা পেতাম তাই খেতাম, যেখানে হোক কোনোরকমে মাথা গ‍ুঁজে রাত কাটাতাম। আমার সবচেয়ে আশ্চর্য লেগেছিল যখন দেখলাম গ্রামের লোকেরা আমাদের সহজভাবে গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নয়। তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না আমাদের আসল উদ্দেশ্যটা কি। সরকারী লোক যে আমরা নই সেটা তারা বুঝেছিল, কারণ সরকারী কর্মচারীরা কস্মিনকালেও তাদের অসুখবিসুখে শ‍ুশ্র‌ূষা করতে এগিয়ে আসেনি। শহরের ধনী লোকেরাও তাদের সম্বন্ধে কখনো মাথা ঘামায়নি। গ্রামের লোকেরা শেষ পর্যন্ত সাব্যস্ত করল, নাম কেনাই আমাদের উদ্দেশ্য। এই ধারণা আমরা কোনোমতেই তাদের মন থেকে দূর করতে পারিনি।

কলকাতায় ফিরে এসে আবার সাধুসন্ন্যাসীদের নিয়ে মেতে উঠলাম। কলকাতা থেকে প্রায় ষাট মাইল দূরে একটি ছোট শহরে নদীর ধারে পাঞ্জাব থেকে আগত এক তরণ সন্ন্যাসী বাস করতেন। আমার বন্ধু হেমন্তকুমার সরকারকে নিয়ে সুযোগ পেলেই আমি তার কাছে যেতাম। সন্ন্যাসীটি কখনো কার‍ুর বাড়িতে যেতে চাইতেন না। তাঁর আদর্শ ছিল বোধ হয়—

 আকাশটা ছাদ, ঘাসের বিছানা শয্যা;  ভাগ্যে যা জোটে, তাই দিয়ে রোজ উদয়ের পরিচর্যা। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম এই তরুণ সন্ন্যাসী কী ভাবে পার্থিব ভোগসুখের আকাঙ্ক্ষা এবং শীতগ্রীষ্মানুভূতি সম্পূর্ণ জয় করেছেন। দুপুরবেলা প্রচণ্ড রোদ্দুরের মধ্যে তিনি পঞ্চাগ্নি জ্বালিয়ে তার মাঝখানে বসে ধ্যান করতেন। রাত্রিবেলা নাকি অনেক সময়ে তাঁর গায়ের উপর দিয়ে সাপ চলে যেত, কিন্তু তাতে তাঁর নিদ্রার ব্যাঘাত হত না। তাঁর নির্মল চরিত্র এবং স্নেহশীলতা সকলেরই শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিল। তিনি কখনো কারুর কাছে কিছু চাইতেন না, লোকেরা নিজের থেকেই দলে দলে এসে তাঁকে খাদ্য দিয়ে যেত। ঠিক যতটুকু তাঁর প্রয়োজন তার বেশি তিনি কখনো গ্রহণ করতেন না। তাঁর দর্শনপ্রার্থীদের মধ্যে সি. আই. ডির লোকও ছিল—তারা অনুসন্ধান করত সন্ন্যাসী বাস্তবিকই নিরীহ কি না। তিনি যদি আর একটু মননশীল হতেন তবে সারাজীবনের জন্যই হয়তো আমি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতাম। এই তরুণ তপস্বীর সংস্পর্শে আসবার পর থেকে আমার মনে কোনো গুরুর কাছে দীক্ষা নেবার আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে উঠল। ১৯১৪ সালে গ্রীষ্মের ছুটিতে আমার বন্ধু হরিপদ চট্টোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে গ‍ুর‍ুর সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় খরচের জন্য এক সহপাঠীর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিলাম। বন্ধুটি তার স্কলারশিপের টাকা থেকে আমাকে ধার দিয়েছিল, আমিও পরে আমার স্কলারশিপ থেকেই এই ধার শোধ দিই। বলা বাহুল্য, বেরিয়েছিলাম বাড়িতে কাউকে না জানিয়েই, পরে পোস্টকার্ডে দু লাইন লিখে খবরটা দিয়েছিলাম। লমছমনঝোলা, হৃষীকেশ, হরিদ্ধা, মথুরা, বৃন্দাবন, বারাণসী, গয়া প্রভৃতি উত্তর ভারতের উল্লেখযোগ্য প্রায় সব কটি তীর্থেই আমরা গিয়ে ছিলাম। হরিদ্বারে আমাদের আর একটি বন্ধু এসে দলে ভিড়ে পড়ল। তীর্থ দর্শনের ফাঁকে আমরা দিল্লী, আগ্রা প্রভৃতি ঐতিহাসিক জায়গাগুলিও দেখে নিয়েছিলাম। সব জায়গাতেই সাধুসন্ন্যাসী যতজনের সঙ্গে পেরেছি দেখা করেছি। এ ছাড়া কয়েকটি আশ্রম এবং গ‍ুর‍ুকুল ও ঋষিকুল বিদ্যায়তনও পরিদর্শন করেছিলাম। শেষোক্ত বিদ্যায়তন দুটি প্রাচীন ভারতীয় আদর্শে পরিকল্পিত। এদের মধ্যে গ‍ুর‍ুকুলই একটু সংস্কারপন্থী, বিশেষ করে জাতিভেদের ক্ষেত্রে। হরিদ্বারের একটি আশ্রমে আমাদের বেশ মুশকিলে পড়তে হয়েছিল। আশ্রমবাসীরা আমাদের সহজভাবে গ্রহণ করতে ইতস্তত করছিলেন, কারণ তাঁরা বুঝতে পারছিলেন না আমরা বাস্তবিকই ধর্মভাবাপন্ন, না ধর্মের ছন্মবেশে একদল বিপ্লববাদী বাঙালী যুবক। দুমাস ধরে এইভাবে তীর্থে তীর্থে ঘুরে অনেক ধার্মিক পুর‍ুষের দেখা পেয়েছিলাম সত্যি, কিন্তু সেই সঙ্গে হিন্দু সমাজব্যবস্থার মূল গলদগুলিও আমার কাছে ধরা পড়েছিল। সাধুসন্ন্যাসীদের সম্বন্ধে আমার ধারণা একেবারে বদলে গিয়েছিল। প্রথম আমার চোখ খোলে যেবার হরিদ্বারের একটি ভোজনালয়ে আমাদের খেতে দিতে আপত্তি জানালো। বাঙালীরা মাছ খায়, কাজেই তারা খ‍ৃস্টানদের মতোই অপবিত্র—অতএব ভোজনালয়ে আর সকলের সঙ্গে বসে খাবার অধিকার তাদের নেই। আমাদের নিজের নিজের বাসনে ভোজনালয় থেকে খাবার নিয়ে এসে নিজেদের ঘরে বসে খেতে হত। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে একজন ছিল ব্রাহ্মণ, কিন্তু সেও এই ব্যবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পায়নি। বুদ্ধগয়ায়ও একই ব্যাপার। বারাণসীর রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষের পরিচয়পত্র নিয়ে আমরা একটি মঠে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলাম। খাওয়ার সময়ে আমাদের জিজ্ঞাসা করা হল আমরা আলাদা আলাদা বসে খাবো কি না, কারণ আমরা সকলে একজাতের ছিলাম না। প্রশ্ন শুনে আমি তো অবাক, কারণ এরা সকলেই ছিল শঙ্করাচার্যের ভক্ত। আমি চট্ করে শঙ্করাচার্যের একটি শ্লোক আউড়ে তাদের বুঝিয়ে দিলাম শঙ্করাচার্য নিজে সবরকম ভেদাভেদের একান্ত বিপক্ষে ছিলেন। হাতে হাতে যুক্তি পেয়ে আমার কথায় তারা প্রতিবাদ করতে পারল না। কিন্তু পরের দিন যখন আমরা কুয়োর ধারে স্নান করতে গিয়েছি, কয়েকটি লোক এসে বলে গেল আমৱা কুয়ো থেকে জল তুলতে পারবে না, কারণ আমরা ব্রাহ্মণ নই। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের ব্রাহ্মণ বন্ধুটির গলায় সে সময়ে পৈতে ছিল। সে তো সুযোগ বুঝে চাদরের তলা থেকে সেই পৈতে বের করে তাদের দেখিয়ে জল তুলে এক এক করে আমাদের দিতে শুরু করে দিল। বেচারাদের তখন যা অবস্থা!

মথুরায় আমরা এক পাণ্ডার বাড়িতে উঠেছিলাম। একদিন সেখান থেকে নদীর ওপারে এক সাধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। সাধুটি মাটির তলায় একটি ঘরে থাকতেন। তিনি আমাদের সংসার ত্যাগ করার মতলর ছেড়ে বাড়ি ফিরে যেতে উপদেশ দিলেন। একজন সন্ন্যাসী মে এই পরামর্শ কী করে দিতে পারে, ভেবে অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলাম আমি, এখনো মনে পড়ে। মথুরায় থাকতে একজন আর্যসমাজীর সঙ্গে আমাদের খুব ভাব হয়েছিল। ভদ্রলোক ছিলেন আমাদের নিকট-প্রতিবেশী। আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতা দয়ানন্দ সরস্বতী। আর্যসমাজীদের উদ্দেশ্য খাঁটি বৈদিক অনুশাসন অনুসারে হিন্দুধর্ম এবং সমাজব্যবস্থার সংস্কার করা। তাঁরা মুর্তিপুজা বা জাতিভেদ বিশ্বাস করেন না। এদিক থেকে ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে এদের মিল আছে। আর্যসমাজের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পাঞ্জাবে এবং যুক্তপ্রদেশে। আর্যসমাজের লোকের সঙ্গে আমাদের এত মেলামেশা করতে দেখে পাণ্ডা মহারাজ তো খেপে অস্থির। আমাদের সাবধান করে দিলেন, আর্যসমাজের লোকেরা মূর্তিপূজা মানে না, তাদের সঙ্গে মেলামেশা করা অত্যন্ত বিপজ্জনক।

মথুরায় বাঁদরের উৎপাতে টেঁকা দায় ছিল। এক মুহুর্তের জন্যও যদি দরজা কিংবা জানালা খোলা থাকত হতভাগাগ‍ুলি ভিতরে ঢুকে যা পেত নিয়ে যেত কিংবা ভেঙে ছিঁড়ে তচ্নচ্ করত। মথুরা থেকে বেরিয়ে আমরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এরপর গেলাম বৃন্দাবন। বৃন্দাবনে পৌঁছন মাত্র পাণ্ডাৱা এসে আমাদের ছেঁকে ধৱল। তাদের এড়াবার জন্য বললাম, আমরা গ‍ুর‍ুকুল বিদ্যালয় দেখতে এসেছি। এতে ফল হল কারণ, শোনা মাত্র তারা কানে আঙুল দিয়ে বলল আমাদের সেখানে যাওয়া মোটেই উচিত নয়, কোনো হিন্দু, সেখানে যায় না। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত তাদের কবল থেকে ছাড়া পাওয়া গেল।

বন্দাবন থেকে কয়েক মাইল দূরে কুসুম সরোবর নামে একটি জায়গা আছে। সেখানে ছোটো ছোটো কুঁড়েঘরে একদল বৈষ্ণবসাধক বাস করতেন। গাছপালা ঘেরা এই কুটিরগ‍ুলির আশেপাশে হরিণ, ময়ূর ইত্যাদি ঘুরে বেড়াত। ধর্মচর্চার পক্ষে জায়গাটা বাস্তবিকই অতি চমৎকার। আমরা ওখানে খুব আদরযত্নে কয়েকটা দিন কাটিয়ে এলাম। আখড়ায় মৌনীবাবা বলে একজন সাধক ছিলেন-তিনি দশ বছর যাবৎ মৌনীব্রত পালন করছিলেন। আধড়ার অধ্যক্ষ রামকৃষ্ণদাস বাবাজী ছিলেন হিন্দুশাস্ত্রে একঞ্জন সুপণ্ডিত, তিনি বললেন শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদের চেয়ে বৈষ্ণব দ্বৈতাদ্বৈতবাদ উন্নততর। সে সময়ে শঙ্করাচার্যের মতবাদকেই হিন্দুশাস্ত্রের সাৱরস্ত‍‌ু বলে আমি জানতাম। অবশ্য শঙ্করাচার্যের আদর্শকে নিজের জীবনে অনুসরণ করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি—রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের জীবনাদর্শই এক্ষেত্রে আমার কাছে অনেক সহজ এবং বাস্তবপন্থী বলে মনে হত। যাই হোক, শঙ্করাচার্য সম্বন্ধে বির‍ূপ সমালোচনা শুনে আমি মোটেই খুশি হতে পারলাম না। তবু যে কটা দিন কুসুমপুরে ছিলাম বেশ আনন্দেই কেটেছিল। বাবাজীদের সকলকেই আমার খুব ভালো লেগেছিল।

বারাণসীতে রামকৃষ্ণমিশন মঠে স্বামী ব্রহ্মানন্দ আমাদের সানন্দ অভ্যর্থনা জানালেন। স্বামীজী বাবাকে এবং আমাদের পরিবারের আরো অনেককেই ঘনিষ্ঠভাবে জানতেন। এখানে আমরা কয়েকদিন রইলাম। এদিকে বাড়িতে তখন হুলুস্থুল লেগে গেছে। আমার জন্য বহুদিন অপেক্ষা করে করে বাবা-মা একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। আমার কাকা দাদারাও একটা কিছু করবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন। কিন্তু কী করবেন তাঁরা? পুলিশে খবর দেওয়াটা তাঁদের মনঃপূত হল না, কারণ পুলিশ এসব ব্যাপারে সাহায্য করার চেয়ে নাজেহাল করে বেশি। শেষটায় তাঁরা এক গণৎকারের শরণাপন্ন হলেন। গণৎকার গণনা করে বললেন, আমি সুস্থ শরীরে কলকাতার দক্ষিণ-পশ্চিমে কোনো জায়গায় আছি, জায়গাটির নামের আদ্যাক্ষর ‘ব'। তৎক্ষণাৎ সাব্যস্ত হল, জায়গাটি নিশ্চয়ই বৈদ্যনাথ—বৈদ্যনাথে একজন নামকরা যোগীর আশ্রম ছিল। আমার এক কাকা তখনই ছুটলেন বৈদ্যনাথ। কিন্তু তাঁর ছোটাছুটিই সার হল, কারণ আমি তখন বসে আছি বারাণসীতে। হঠাৎ একদিন সবাইকে চমকে দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম বলে আমার মনে কোনো রকম অনুশোচনা ছিল না, কিন্তু যে জন্য বেরিয়েছিলাম সেই গ‍ুর‍ুই পেলাম না, কাজেই একটু মুশড়ে পড়েছিলাম। গ‍ুর‍ুর সন্ধানে তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়ানোর ফল হাতে হাতে পেলাম। কয়েকদিন পরেই টাইফয়েডে শয্যা নিতে হল। স্বাস্থ্যবিধির কাছে ধর্মের জারিজুরি খাটলো না। আমি যখন এইভাবে বিছানায় পড়ে আছি য়ুরোপে মহাযুদ্ধ শুরু হয়েছে।