ভারত পথিক/প্রেসিডেন্সি কলেজ (২)

উইকিসংকলন থেকে

সপ্তম পরিচ্ছেদ

প্রেসিডেন্সি কলেজ (২)

কলকাতার রাজনৈতিক আবহাওয়া সে সময়ে বেশ গরম ছিল, তার উপরে সন্ত্রাসবাদীরাও ভিতরে ভিতরে ছাত্রদের মধ্যে খুব প্রচারকার্য চালাচ্ছিল। কিন্তু এসব সত্ত্বেও বিশেষ কয়েকটা ঘটনা না ঘটলে আমার রাজনৈতিক মতামত যে কোনদিকে মোড় নিত জানি না। কলেজে ও হস্টেলে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের কয়েকজন নেতার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হত—এরা যে সন্ত্রাসবাদী সে খবর অবশ্য আমি পরে পেয়েছিলাম। যাই হোক, এদের মতবাদ আমাকে কখনো আকৃষ্ট করেনি—এর কারণ এই নয় যে আমি মহাত্মা গান্ধীর অহিংসবাদে বিশ্বাস করতাম, আসল কারণ—তখন আমি নিজের সৃষ্ট এক জগতে বিচরণ করছিলাম এবং বিশ্বাস করতাম একমাত্র জাতীয় শিক্ষাসংস্কৃতির পুনঃসংগঠনের মধ্য দিয়েই আমাদের স্বাধীনতা আসবে। অবশ্য স্বীকার না করে উপায় নেই যে স্বাধীনতা কী ভাবে আসতে পারে আমাদের দলের কার‍ুরই সে সম্বন্ধে কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। ইংরেজদের হাতে দেশরক্ষার ভার দিয়ে নিজেরা আভ্যন্তরীণ শাসনভার চালালে কেমন হয়—এ প্রস্তাবও আমরা এক সময়ে আলোচনার যোগ্য বলে মনে করেছি।

দুটো ব্যাপার, পরোক্ষে আমাকে নিজস্ব একটি রাজনৈতিক মতামত, গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল—কলকাতার শ্বেতাঙ্গদের ব্যবহার এবং মহাযুদ্ধ।

১৯০৯ সালে জানুয়ারি মাসে পি. ই. স্কুল ছাড়বার পর থেকে ইংরেজদের সঙ্গে আমার বিশেষ সম্পর্ক ছিল না। ১৯০৯ থেকে ১৯১৩ সালের মধ্যবর্তী সময়টুকুর মধ্যে স্কুলের পরিদর্শক বা ঐজাতীয় দু-একজন সরকারী কর্মচারী ছাড়া ইংরেজ খুব কমই আমার চোখে পড়েছে। কটক শহরেও ইংরেজ বেশি দেখা যেত না, কারণ কটকে ইংরেজের সংখ্যাই ছিল অতি অল্প, তার উপরে তারা থাকতোও শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে। কিন্তু কলকাতায় এসে ঠিক এর উল্টো ব্যাপার হল। প্রতিদিন কলেজে যেতে এবং কলেজ থেকে ফিরতে সাহেবপাড়ার মধ্য দিয়ে আমাকে যাতায়াত করতে হত। ট্রামগাড়িতে প্রায়ই নানারকম অপ্রিয় ব্যাপার ঘটত। ইংরেজরা ভারতীয়দের সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করত। কখনো কখনো দেখা যেত ইংরেজযাত্রীদের সামনের সীটে ভারতীয় বসে থাকলে নির্বিকারচিত্তে তারা সেই সীটে জুতোশ‍ুদ্ধ পা তুলে দিয়েছে, ভারতীয় যাত্রীটির গায়ে হয়তো জুতো ঠেকত, কিন্তু তাতে ইংরেজদের কোনো ভ্র‌ূক্ষেপই ছিল না। অনেক ভারতীয় বিশেষ করে গৱিব কেরানীর দল এসব অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে যেত, কিন্তু সকলের পক্ষে তা সম্ভব হত না। আমি তো এসর একেবারেই সহ্য করতে পারতাম। ট্রামে যেতে প্রায়ই ইংরেজদের সঙ্গে আমার বচসা লাগত। কচিৎ কখনো সাহেবদের সঙ্গে ভারতীয়দের মারামারি করতে দেখা যেত। রাস্তায়ও একই ব্যাপার ঘটত। ইংরেজরা চাইত তাদের দেখলেই ভারতীয়েরা যেন পথ ছেড়ে দেয়, না ছাড়লে ধাক্কা দিয়ে, ঘুষি মেরে তাদের পথ থেকে সরিয়ে দিত। ইংরেজ সৈন্যগুলি ছিল আর এক কাঠি সরেস—বিশেষ করে গর্ডন হাইল্যাণ্ডরগ‍ুলির তো কথাই নেই। আত্মসম্মান বজায় রেখে রেলে যাতায়াত করাও ভারতীয়দের পক্ষে বেশ কঠিন ছিল। রেলকর্তৃপক্ষ বা পুলিশ এসব ক্ষেত্রে ভারতীয়দের কোনোরকম সাহায্যই করত না, কারণ, দেখা যেত তারা নিজেরাই হয়তো ইংরেজ, কিংবা অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান। ভারতীয় কর্মচারীরা আবার উপরওয়ালার কাছে ইংরেজদের বির‍ুদ্ধে নালিশ করতে ভয় পেত। কটকের একটি ঘটনা মনে পড়ে। আমি তখন খুব ছোটো। আমার এক কাকার কোথায় যাবার কথা ছিল, কিন্তু তিনি স্টেশন থেকে ফিরে এলেন, কারণ উচু শ্রেণীর কামরাগুলিতে কতকগুলি ইংরেজ ছিল, তারা ভারতীয়দের কোনোমতেই সেই কামরায় ঢুকতে দিতে রাজী হয়নি। রেলে এই ধরনের ব্যাপারে ইংরেজদের সঙ্গে উচ্চপদস্থ ভারতীয়দের প্রায়ই ঝগড়া লাগত বলে শোনা যেত। এইসব কাহিনী স্বভাবতই লোকের মুখে মুখে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ত।

যখনই এই জাতীয় কোনো ঘটনা ঘটত, আমার স্বপ্ন যেত ভেঙে, শঙ্করাচার্যের মায়াবাদে তখন আর সান্ত্বনা খুঁজে পেতাম না। বিদেশীর হাতে অপমানিত হয়ে তাকে মায়া বলে উড়িয়ে দেওয়া আমার পক্ষে কোনোমতেই সম্ভব হয়নি। কলেজে কোনো ইংরেজ অধ্যাপক যদি আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন আমার মেজাজ সাংঘাতিক বিগড়ে যেত। দুঃখের বিষয় এ রকম ব্যাপার প্রায়ই ঘটত। আমাদের আগের যুগে অনেক ইংরেজ অধ্যাপককেই এজন্য ছাত্রদের হাতে মার খেতে হয়েছে। কলেজে প্রথম বছর আমারও এই জাতীয় অভিজ্ঞতা কয়েকবার হয়েছিল, তবে সে তেমন গুরুতর নয়। অবশ্য মেজাজ বিগড়ে দেবার পক্ষে তাই যথেষ্ট ছিল। ইংরেজ ও ভারতীয়দের মধ্যে সংঘর্ষ লাগলে আইনের দিক থেকে ভারতীয়রা কখনো সুবিচার পেত না। এর ফলে শেষটায় অন্য কোনো উপায় না দেখে তারাও পাল্টা আক্রমণ শুরু করে দিল। রাস্তায়, ট্রামে, রেলে তারা ইংরেজদের অত্যাচার অবিচার আর মুখ বুজে সহ্য করত না। মনে পড়ে আমাদের কলেজের একটি ছেলে ভালো বক্সিং জানত, সে সেধে সেধে সাহেবপাড়ায় গিয়ে টমিদের সঙ্গে মারামারি করে আসত। ভারতীয়দের এই পরিবর্তিত মনোভাবের ফল হাতে হাতে পাওয়া গেল। ইংরেজরা ভারতীয়দের সমীহ করে চলতে শুরু করল। লোকে বলাবলি করতে লাগল ইংরেজ শক্তের ভক্ত, নরমের যম। এই মনোভাবই বাঙলাদেশে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের ভিত্তি। উপরোক্ত ঘটনাগুলি স্বভাবতই আমার রাজনৈতিক চেতনাকে জাগিয়ে তুলেছিল, কিন্তু তখনো আমার মনে সঠিক কোনো মত গড়ে ওঠেনি। এজন্য মহাযুদ্ধের অভিজ্ঞতার দরকার ছিল।

১৯১৪ সালের জুলাই মাসে অসুখে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে আছি। কাগজে যুদ্ধের খবর পড়ি। আর যোগীঋষিদের সম্বন্ধে আমার নবলব্ধ অভিজ্ঞতার কথা ভাবি। এ অবস্থায় আমার নিজের এতদিনের সব ধারণা এবং প্রচলিত মতবাদগ‍ুলি ভালো করে খতিয়ে দেখবার সুযোগ পেলাম। নিজের মনকে প্রশ্ন করলাম—দেশের শাসনভার দুভাগে ভাগ করে, এক ভাগ বিদেশীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে, আর এক ভাগ নিজেদের হাতে রাখা—এ কি সম্ভব? না, আমাদের কর্তব্য শাসনভার সম্পূর্ণ নিজেদের হাতে রাখা, কিংবা সম্পূর্ণ অন্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া? এ প্রশ্নের জবাবের জন্য আমাকে বিশেষ ভাবতে হয়নি। ভারতবর্ষকে যদি অন্য সব সভ্যদেশের সমকক্ষ হতে হয় তবে তাকে তার মূল্যও বহন করতে হবে, দেশরক্ষার গুরুদায়িত্ব এড়িয়ে গেলে চলবে না। দেশের স্বাধীনতার জন্য যারা সংগ্রাম করছেন, সামরিক অসামরিক, দু রকম শাসনভারের জন্যই তাঁদের প্রস্তুত থাকতে হবে। স্বাধীনতাকে কখনো ভাগ করা চলে না, স্বাধীনতার অর্থই হল বিদেশী শাসনের হাত থেকে সর্বাঙ্গীণ মুক্তি। মহাযুদ্ধে আমরা দেখেছি সামরিক শক্তি না থাকলে যে কোনো দেশের পক্ষেই স্বাধীনতা বজায় রাখা কঠিন।

অস‍ুখ থেকে সেরে উঠে আমি আবার আমার কাজকর্ম শ‍ুর‍ু করে দিলাম। আগের মতো বন্ধুদের সঙ্গেই বেশির ভাগ সময় কাটাতাম। কিন্তু ইতিমধ্যে ভিতরে ভিতরে আমার মধ্যে অনেক পরিবর্তন হয়েছিল। সভ্যসংখ্যা এবং কাজকর্মের দিক থেকে আমাদের দলের দ্রুত উন্নতি হচ্ছিল। দলের বিশিষ্ট সভ্য উদীয়মান একটি ডাক্তারকে (যুগলকিশোর আঢ্য) বিলেতে পাঠানো হল, যাতে বিলেত থেকে ফিরে এসে সে দলের এবং দেশের সত্যিকারের সেবা করতে পারে। আমাদের এই প্রচেষ্টা অবশ্য সফল হয়নি, কারণ ডাক্তাৱটি বিলেতে একটি ফরাসী মেয়েকে বিয়ে করে সেখানেই চিরকালের জন্য থেকে গিয়েছিলেন। যাই হোক, যার যথাসাধ্য ডাক্তারকে বিলেতে পাঠাবার জন্য দিল, আমিও আমার স্কলারশিপের খানিকটা দিলাম। দলের আর একজনও ইণ্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিস-এ নাম লেখাল। আমরা সকলেই ভাবলাম যুদ্ধে গেলে ওর অভিজ্ঞতা তো বাড়বেই, উপরন্ত‌ু কিছু টাকা হাতে আসবে।

দুটো বছর নানারকম উত্তেজনার মধ্য দিয়েই কেটে গেল, পড়াশোনা মাথায় উঠল। ১৯১৫ সালে ইণ্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় যদিও আমি প্রথম বিভাগেই পাশ কৱাম আমার স্থান ছিল একেবারে নিচের দিকে। ক্ষণেকের জন্য আমার মনে একটু অনুশোচনা দেখা দিল, ঠিক করলাম বি.এ.তে ভালো ফল করতেই হবে।

বি.এ.তে দর্শনে অনার্স নিলাম—আমার বহুকালের ইচ্ছা এইবার পূর্ণ হল। লেখাপড়ায় এবার সত্যিই খুব মনোেযোগ দিলাম। আমার কলেজ-জীবনে এই বোধ হয় প্রথম পড়ায় রস পেলাম। দর্শন পড়ে আমি যা লাভ করলাম তার সঙ্গে দর্শন সম্বন্ধে আমায় ছোটোবেলার ধারণার কোনো মিল ছিল না। স্কুলে পড়বার সময়ে ভাবতাম দর্শন পড়লে জীবনের মূল সমস্যাগুলির সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে। দর্শন অধ্যয়নকে সে সময়ে আমার কাছে এক ধরনের যৌগিক প্রক্রিয়া বলেই মনে হত। দর্শন পড়ার ফলে কোনোরকম তত্ত্বজ্ঞান লাভ না করলেও আমার মনন-ক্ষমতা আগের চাইতে বেড়ে গেল, সব কিছুই বিচার করে দেখতে শুরু করলাম। পাশ্চাত্য দর্শনের গোড়ার কথাই সংশয়বাদ—কেউ কেউ বলেন এর শেষও সংশয়ে। পাশ্চাত্য দর্শন কোনো কিছুকেই নির্বিবাদে গ্রহণ করতে রাজী নয়— যুক্তিতর্কের সাহায্যে তার দোষগণ বিচার করে তবে গ্রহণ করে— এক কথায়, মনকে সংস্কারমুক্ত করে। এতকাল বেদান্তকে অভ্রান্ত বলে মেনে এসেছি, এখন মনে প্রশ্ন জাগল, বাস্তবিকই বেদান্ত অভ্রান্ত কি না। মননচর্চার খাতিরে জড়বাদের স্বপক্ষে প্রবন্ধ লিখতে শ‍ুরু করলাম। কিছুদিনের মধ্যেই দলের অন্য সকলের সঙ্গে আমার বিরোধ লাগল। এই প্রথম আমার খেয়াল হল ওরা কতখানি গোঁড়া ও সংস্কারাচ্ছন্ন। অনেক জিনিসই ওরা নির্বিবাদে মেনে নেয়—কিন্তু যে সত্যিকারের সংস্কারমুক্ত সে কখনোই ভালো করে যাচাই না করে কোনো জিনিসকে সত্য বলে মানবে না।

প্রচুর উৎসাহ নিয়ে পড়াশোনা করছিলাম, হঠাৎ ছন্দপতন ঘটল।

১৯১৬ সালের জানুয়ারি মাস তখন। সকালে কলেজ লাইব্রেরিতে বসে পড়ছি এমন সময়ে খবর পেলাম জনৈক ইংরেজ অধ্যাপক আমাদের ক্লাসের একটি ছেলেকে মারধোর করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, আমাদের ক্লাসের কয়েকটি ছেলে মিঃ ওটেনের ঘরের সামনের বারান্দায় পায়চারি করছিল, এতে বিরক্ত হয়ে মিঃ ওটেন তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে কয়েকজন ছেলেকে জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন। ক্লাসের প্রতিনিধি হিসেবে আমি তৎক্ষণাৎ অধ্যক্ষ মিঃ এইচ. আৱ. জেমসের কাছে গিয়ে প্রতিবাদ জানালাম, বললাম— যে-ছেলেদের মিঃ ওটেন অপমান করেছেন তাঁদের কাছে তাঁকে ক্ষমা চাইতে হবে। অধ্যক্ষ বললেন, তাঁর পক্ষে মিঃ ওটেনকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা সম্ভব নয়, কারণ মিঃ ওটেন ইণ্ডিয়ান এডুকেশনল সার্ভিস-এর লোক। তাছাড়া, তিনি বললেন, মিঃ ওটেন তো কাউকেই মারধোর করেননি, শ‍ুধ‍ু হাত ধরে সরিয়ে দিয়েছেন—এতে অপমানিত বোধ করার কিছু নেই। জবাবদিহি শুনে আমরা মোটেই খুশি হতে পারলাম না। পরের দিন ছাত্ররা ধর্মঘট করল। অধ্যক্ষ বহু চেষ্টা করেও ধর্মঘট ভাঙতে পারলেন না, এমন কি মৌলবী সাহেবের প্রাণপণ চেষ্টাতেও মসলমান ছেলেৱা ধর্মঘট থেকে বিরত হল না। স্যর পি. সি. রায় এবং ডক্টর ডি. এন. মল্লিক—এদের অনুরোধেও কেউ কর্ণপাত করল না। যেসব ছেলেরা ক্লাসে অনুপস্থিত ছিল অধ্যক্ষ তাদের প্রত্যেককে জরিমানা করলেন।

প্রেসিডেন্সির মতো কলেজে এ রকম জোরালো একটি ধর্মঘটের খবর শহরের চতুর্দিকে খুব উত্তেজনার সৃষ্টি করল। ধর্মঘটের ঢেউ যখন আস্তে আস্তে আরো কয়েক জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল কর্তৃপক্ষ সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। একজন অধ্যাপক আমাকে খুব স্নেহু করতেন, তিনি ভয় পেলেন ধর্মঘটের পাণ্ডা হিসেবে আমাকে হয়তো অনেক লাঞ্ছনা সহ্য করতে হবে। আড়ালে ডেকে নিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ধর্মঘটের ফল কী হতে পারে আমি ভেবে দেখেছি কি না। জবারে আমি যখন বললাম, ভেবে দেখেছি, তিনি আর কথা বাড়ালেন না। ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিন পূর্ণ হলে কর্তৃপক্ষ মিঃ ওটেনের উপর চাপ দিলেন। মিঃ ওটেন তখন ছাত্র প্রতিনিধিদের ডেকে তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ব্যাপারটা ভালোভাবেই মিটমাট করে ফেললেন। দুপক্ষেরই সম্মান বজায় রইল। পরের দিন ক্লাস বসল। যা হবার হয়ে গেছে—এই মনোভাব নিয়ে ছেলেরা যে যার ক্লাস করতে লাগল। সকলেই আশা করেছিল ব্যাপারটা যখন মিটমাটই হয়ে গেছে তখন ধর্মঘটের সময়ে যেসব শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছিল এবার সেগুলি রদ করা হবে। কিন্তু তাদের ভুল ভাঙতে দেরি হল না। অধ্যক্ষমহাশয় জরিমানা মাপ করতে কোনোমতেই রাজী হলেন না। তবে, গরিব বলে কেউ ওজর দেখালে, তিনি তাকে মাপ করতে রাজী ছিলেন। ছাত্র, অধ্যাপক কারুর অনুরোধেই তিনি কর্ণপাত করলেন না। ছেলেদের মেজাজ গেল বিগড়ে, কিন্তু তখন আর কিছু করবার ছিল না।

মাসখানেক পরে আবার ওইরকম একটি ব্যাপার ঘটল। খবর পাওয়া গেল—মিঃ ওটেন আবার একটি ছেলের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন, এবারকার ছেলেটি প্রথম বার্ষিকের ছাত্র। ছাত্ররা চট করে বুঝে উঠতে পারল না, এ অবস্থায় কী করা দরকার। আইনসম্মতভাবে ধর্মঘট ইত্যাদি করলে কর্তৃপক্ষ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন, আর অধ্যক্ষের কাছে নালিশ করলে কোনো ফলই হবে না। অগত্যা কয়েকজন ছেলে স্থির করল তারা নিজেরাই এর ব্যবস্থা করবে। ফলে মিঃ ওটেন ছাত্রদের হাতে বেদম মার খেলেন। খবর পেয়ে খবরের কাগজের অফিস থেকে শুরু করে লাটভবন পর্যন্ত সর্বত্র ভীষণ উত্তেজনা দেখা দিল।

ছাত্রদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তার নাকি মিঃ ওটেনকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরে সিঁড়ি দিয়ে ফেলে দিয়েছে। এ অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। পেছন থেকে একবারই মাত্র তাঁকে আঘাত করা হয়েছিল, কিন্তু সেও এমন কিছু মারাত্মকভাবে নয়। তাঁকে যারা ঘায়েল করেছিল তারা সকলেই ছিল তাঁর সামনে। ব্যাপারটা আমি স্বচক্ষে দেখেছিলাম, কাজেই ছাত্রদের বিরুদ্ধে যে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়েছিল জোর গলায় তার প্রতিবাদ করছি।

এই ঘটনার পরেই বাঙলা সরকার এক বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে আমাদের কলেজ বন্ধ রাখবার হুকুম দিলেন এবং কলেজে ক্রমাগত কেন গোলমাল হচ্ছে সে সম্বন্ধে তদন্ত করবার জন্য একটি তদন্ত-কমিটি গঠনেরও নির্দেশ দিলেন। সরকারপক্ষ স্বভাবতই সাংঘাতিক খেপে গিয়েছিল, এবং এমনও শোনা গেল প্রয়োজন বোধ করলে চিরকালের জন্য কলেজ বন্ধ করে দিতেও তারা পেছপা হবে না। বলা বাহুল্য, সরকারের তরফ থেকে কলেজ-কর্তৃপক্ষ সবরকম সাহায্যই পেতে পারতেন, কিন্তু একটা গোলমাল হয়ে গেল। সরকারী বিজ্ঞপ্তি নিয়ে আমাদের অধ্যক্ষের সঙ্গে সরকারপক্ষের বিরোধ দেখা দিল। অধ্যক্ষ মনে করলেন কলেজ বন্ধ রাখবার আদেশ জারি করবার আগে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ না করে সরকার তার আত্মসম্মানে ঘা দিয়েছেন। এ নিয়ে তিনি শিক্ষাবিভাগের মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এক হুলুস্থ‌ূল কাণ্ড বাধিয়ে দিলেন। পরের দিনই আর একটি সরকারী বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশ পেল— মান্যবর মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে অত্যন্ত অভদ্র ব্যবহারের অভিযোগে আমাদের অধ্যক্ষকে অনির্দিষ্টকালের জন্য 'সাস‍্পেণ্ড' করা হয়েছে। এদিকে অধ্যক্ষমহাশয় ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবার আগেই তাঁর যথাকর্তব্য সেরে ফেললেন। যেসব ছেলে তাঁর কুনজরে ছিল সবাইকে তিনি ডেকে পাঠালেন। এদের মধ্যে আমিও ছিলাম। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে আমাকে তিনি বললেন—“বোস, তোমার মতো বেয়াড়া ছেলে কলেজে আর নেই, তোমাকে আমি সাসপেণ্ড করলাম।” কথাগ‍ুলো আজও আমার স্পষ্ট মনে আছে। জবাবে আমি শুধু বলেছিলাম, “ধন্যবাদ!” তারপর বাড়ি চলে এলাম। শঙ্করাচার্যের মায়াবাদের ঘোর মন থেকে কেটে গেল।

এর কয়েকদিন পরেই কলেজের পরিচালক-সমিতির একটি অধিবেশনে অধ্যক্ষ মহাশয়ের নির্দেশকে সমর্থন জানানো হল। ফলে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আমি বিতাড়িত হলাম। অগত্যা, অন্য কোনো কলেজে ভরতি হবার অধিকার দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করলাম। কিন্তু আমার আবেদন অগ্রাহ্য হল। দেখা গেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আমি বিতাড়িত হয়েছি।

এ অবস্থায় কর্তব্য ঠিক করে উঠতে পারছিলাম না। কয়েকজন রাজনীতিক বললেন, তদন্ত-কমিটির হাতে যখন সমস্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তখন অধ্যক্ষের নির্দেশ সম্পূর্ণ বেআইনী। তদন্ত-কমিটি কী রায় দেয় তার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইলাম।

কমিটির সভাপতি ছিলেন হাইকোর্টের বিচারপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভাইস্ চ্যান্সেলর স্যর আশুতোষ মুখার্জি। কাজেই, সুবিচার হবে বলেই আশা হল। ছাত্রপ্রতিনিধিদের মধ্যে আমিও ছিলাম। আমাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করা হল—মিঃ ওটেনকে মারা উচিত হয়েছিল বলে আমি মনে করি কি না। জবাবে আমি বললাম, অবশ্যই অন্যায় হয়েছে, কিন্তু ছাত্রদের উপর যথেষ্ট অত্যাচার হয়েছিল বলেই তারা অন্যায়টা করেছিল। এরপর গত কয়েক বছর ধরে প্রেসিডেন্সি কলেজে শ্বেতাঙ্গ অধ্যাপকদের অত্যাচারের কাহিনী ধারাবাহিকভাবে বলে গেলাম। আমার অভিযোগ অকাট্য হলেও, অনেকেই মনে করলেন, মিঃ ওটেনকে মারা যে অন্যায় হয়েছে একথাটা বিনাশর্তে মেনে না নিয়ে আমি নিজের ক্ষতি করলাম। আমার কিন্তু মনে হল, ফলাফল যাই হোক না কেন আমি উচিত কাজই করেছি।

শেষ পর্যন্ত সুবিচার পাওয়া যেতে পারে, এই আশায় তখনকার মতো কলকাতায় থেকে গেলাম। যথাসময়ে কমিটি রিপোর্ট পেশ করল। রিপোর্টে ছাত্রদের স্বপক্ষে একটা কথাও ছিল না—এবং তাতে একমাত্র আমার নামই উল্লেখ করা হয়েছিল। আমার শেষ ভরসাটুকুও গেল। ইতিমধ্যে কলকাতার রাজনৈতিক আবহাওয়া বেশ ঘোরালো হয়ে উঠেছিল। বহুলোককে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। এদের মধ্যে প্রেসিডেন্সি কলেজের কয়েকজন বিতাড়িত ছাত্রও ছিল। আমার দাদারা এইসব দেখে অত্যন্ত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। আলাপ-আলোচনার পর তারা মত দিলেন কোনো উপলক্ষ ছাড়া কলকাতায় থাকা মানেই বিপদ ডেকে আনা, কাজেই আমার কটকে চলে যাওয়াই ভালো—সেখানে গোলমালের আশঙ্কা অনেক কম, জায়গাটাও নিরাপদ। রাত্রে ট্রেনে বাঙ্কের উপর শ‍ুয়ে গত কয়েক মাসের ঘটনাবলীর কথা ভাবছিলাম। লেখাপড়া তো এখানেই শেষ, ভবিষ্যৎও অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ঢাকা। কিন্তু এজন্য আমি যে দুঃখিত ছিলাম তা নয়, আমি যা করেছি তার জন্য আমার মনে বিন্দুমাত্রও অনুশোচনা ছিল না। বরং কর্তব্য পালনের আনন্দে আমার মনটা ভরে ছিল। একটা মহৎ উদ্দেশ্যে আমার স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছি এবং আত্মসম্মান বজায় রাখতে পেরেছি, এই কথা ভেবে মনে গভীর আত্মপ্রসাদ অনুভব করছিলাম। আমি যে অন্যায় কিছু করিনি সে সম্বন্ধে আমার কোনো সংশয়ই ছিল না।

১৯১৬ সালের এই ঘটনাবলীর অন্তর্নিহিত ইঙ্গিতটি সে সময়ে আমার কাছে ধরা পড়েনি। আমাদের অধ্যক্ষ কলেজ থেকে আমাকে বিতাড়িত করলেন বটে, কিন্তু ঘটনাচক্রে ব্যাপারটা আমার পক্ষে শাপে বর হয়ে দাঁড়াল। আমার ভবিষ্যৎ পন্থা পরোক্ষে তিনিই বাতলে দিলেন। সংকটের সময়ে আমি নির্ভয়ে আমার কর্তব্য পালন করেছি—এই কথা ভেবে নিজের প্রতি আমার বিশ্বাস জন্মাল। এই আত্মবিশ্বাসের জোরেই ভবিষ্যতে বহু সংকট, বহু, সমস্যা আমি পার হয়েছি। তাছাড়া এই ঘটনা উপলক্ষেই প্রথম আমি নেতৃত্বের স্বাদ পেলাম। এবং নেতাদের যে কী পরিমাণে আত্মত্যাগ করতে হয় সে সম্বন্ধেও খানিকটা ধারণা হল। এক কথায়, জীবনযুদ্ধের জন্য আমি বেশ তৈরি হয়ে উঠলাম।