ভারত পথিক/স্কুল-জীবন (২)

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

স্কুল জীবন (২)

নিজেদের সম্বন্ধে আমাদের ধারণা অন্যে আমাদের সম্বন্ধে কী ভাবে, তার উপর কতখানি নির্ভর করে, ভাবলে আশ্চর্য লাগে। ১৯০৯ সালের জানুয়ারি মাসে আমি যখন কটকের র‌্যাভেন‍্শ কলেজিয়েট স্কুলে ভরতি হলাম আমার মনের একটা বড়ো রকমের পরিবর্তন ঘটল। য়ুরোপীয় ও অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ছাত্রদের কাছে আমার বংশমর্যাদার কোনো মূল্য ছিল না, কিন্তু ভারতীয় ছেলেদের ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টোটাই দেখা গেল। তাছাড়া অন্য সকলের চাইতে আমার ইংরিজি জ্ঞান বেশি থাকার দরুন সকলেই আমাকে অত্যন্ত সমীহ করে চলত। এমন কি শিক্ষকেরা পর্যন্ত আমার পক্ষপাতিত্ব করতেন, কারণ তাঁরা সকলেই ধরে নিয়েছিলেন আমি ক্লাসে প্রথম হব—আর ভারতীয় স্কুলে লেখাপড়াই হল ভালোমন্দর মাপকাঠি। প্রথম ত্রৈমাসিক পরীক্ষায় আমি সত্যিই প্রথম হলাম। নতুন এই পরিবেশে এসে প্রথম অনুভব করলাম আমি নেহাত নগণ্য নই। এই মনোভাবকে অহঙ্কার না বলে আত্মপ্রত্যয় বললেই ঠিক বলা হবে। এতদিন পর্যন্ত আমার মধ্যে এই আত্মপ্রত্যয়েরই অভাব ছিল—যে আত্মপ্রত্যয়ের জোরে মানুষ জীবনে সফলতা লাভ করে।

এবার আমাকে আর ইনফ্যাণ্ট ক্লাসে ভরতি হতে হল না, আমি ভরতি হলাম গিয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে— কাজেই বড় ছেলেদের হিংসে করবার আর কোনো কারণ রইল না। চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্ররা নিজেদের উঁচু ক্লাসের ছাত্র বলেই মনে করত এবং বেশ একটা ভারিক্কী চালে চলাফেরা করত। আমিও তাদের দলেই ছিলাম। কিন্তু একটা ব্যাপার আমাকে একেবারে কাবু করে রেখেছিল। এই স্কুলে ভরতি হবার আগে আমি বাঙলা এক বর্ণও পড়িনি। এদিকে আমার সহপাঠীরা সকলেই বাঙলায় বেশ পাকা ছিল। মনে পড়ে প্রথম দিন আমি ‘গর‍ু’ (না ঘোড়া?) সম্বন্ধে বাঙলায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম, আর সেই রচনা নিয়ে ক্লাসে সে কি হাসাহাসি! ব্যাকরণ বা বানান সব কিছুতেই আমি দিগ‍্গজ ছিলাম। শিক্ষকমশাই যখন টীকাটিপ্পনি সহকারে ক্লাসের সকলকে আমার অপূর্ব রচনাখানি পড়ে শোনালেন তখন চারদিকে এমন হাসির ধুম পড়ে গেল যে লজ্জায় জামি প্রায় মাটিতে মিশে গেলাম। পড়াশোনার জন্য এভাবে আগে কখনো আমাকে বিদ্রুপ সহ্য করতে হয়নি, তার উপরে আমার আত্মসম্মানজ্ঞানও হালে একটু বেড়েছিল, কাজেই আমার অবস্থাটা কী দাঁড়িয়েছিল সহজেই বুঝতে পারবেন। এর পর বহুদিন পর্যন্ত বাঙলা ক্লাসের নামেই আমার জ্বর আসত। কিন্তু ভেতরে ভেতরে রাগে দুঃখে জ্বলে গেলেও প্রথম প্রথম টিট‍্কিরি সহ্য না করে উপায় ছিল না। মনে মনে তখন থেকেই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম বাঙলা আমি শিখবই। ধীরে ধীরে বাঙলায় বেশ উন্নতি করতে লাগলাম এবং বাৎসরিক পরীক্ষায় যখন বাঙলায় আমিই সবচেয়ে বেশি নম্বর পেলাম তখন আমার আনন্দ দেখে কে?

এই নতুন পরিবেশে আমার দিন খুব আনন্দেই কাটছিল। আগের স্কুলে সাত বছর কাটালেও সেখানে আমার বন্ধু বলতে কেউ ছিল না। কিন্তু এখানে এসে অনেক অন্তরঙ্গ বন্ধু জুটে গেল। আমার বন্ধুরাও আমার মতোই খেলাধুলা বিশেষ পছন্দ করত না। অবশ্য ড্রিলটা আমার মন্দ লাগত না। আমার নিজের উৎসাহের অভাব ছাড়াও আরো একটা কারণে খেলাধুলা নিয়ে মেতে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ছেলেরা সাধারণত স্কুল ছুটির পর বাড়ি গিয়ে জলখাবার খেয়ে খেলার মাঠে আসত। আমার বাবা মা এটা পছন্দ করতেন না। হয়তো তাঁরা ভাবতেন খেলাধুলা নিয়ে বেশি মাতলে পড়ার ক্ষতি হবে, নয়তো তাঁদের ধারণা ছিল খেলার মাঠের আবহাওয়াটা আমাদের পক্ষে ক্ষতিকর। সম্ভবত শেষেরটাই প্রকৃত কারণ। যাই হোক, কখনো খেলবার ইচ্ছে হলে বাড়িতে না জানিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। আমার ভাই ও কাকাদের মধ্যে অনেকে প্রায়ই এভাবে লুকিয়ে খেলতে যেত। ধরা পড়লে একচোট বকুনি জুটত কপালে। কিন্তু বাবা মা প্রায় রোজই বিকেলে বেড়াতে বেরোতেন, কাজেই তাঁদের চোখে ধূলো দেওয়া কঠিন ছিল না। আমার নিজের যদি তেমন ইচ্ছে থাকত তবে কি আর খেলতে পারতাম না! কিন্তু নিজেরই আমার চাড় ছিল না।

তাছাড়া আমি আবার একটু সুবোধ-সুশীল গোছের ছিলাম—প্রাণপণে সংস্কৃত নীতিকথা মুখস্থ করতাম। এইসব নীতিকথাতেই পেয়েছিলাম—‘পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্মঃ, পিতা হি পরমন্তপঃ’, জেনেছিলাম পিতার চেয়ে মাতা আরো বড়। এই জাতীয় সব নীতিকথা পড়ে আমি বাপমায়ের একান্ত বাধ্য হয়ে উঠেছিলাম।

খেলাধুলা ছেড়ে আমারই মধ্যে কয়েকটি সুবোধ-সুশীল ছেলেকে নিয়ে বাগান করায় মন দিয়েছিলাম। আমাদের বাড়িতে তরিতরকারি ও ফুলের বেশ বড় বাগান ছিল। মালীদের সঙ্গে আমরাও গাছে জল দিতাম, মাটি খুঁড়তাম, চষতাম। আমার খুব ভালো লাগত। বাগান করতে করতেই আমি প্রকৃতির সৌন্দর্য সম্বন্ধে বেশ সচেতন হয়ে, উঠেছিলাম। আমরা নিয়মিত ব্যায়ামও করতাম। বাড়ির ভিতরেই তার সব ব্যবস্থা ছিল।

অতীতের দিকে তাকিয়ে এখন ভাবি ছেলেবেলায় খেলাধুলা না করে কী ভুলটাই করেছি। মন আমার অকালেই পেকে গিয়েছিল, আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছিল। গাছপালাই হোক আর মানুষই হোক অকালে পেকে ওঠা কার‍ুর পক্ষেই মঙ্গলজনক নয়, এর কুফল একদিন না একদিন ভুগতেই হবে। ক্রমবৃদ্ধিই প্রকৃতির নিয়ম এবং তার ব্যতিক্রম হলে ফল কখনো ভালো হয় না, এজন্যই অপরয়সে যাদের অস্বাভাবিক প্রতিভা দেখা যায় বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রতিভার আর কোনো চিহ্নই থাকে না।

বছর দুয়েক এইভাবেই কেটে গেল। শিক্ষক এবং ছাত্রদের মধ্যে বাঙালী, উড়িয়া দুইই ছিল, এবং পরস্পরের মধ্যে যথেষ্ট সদ্ভাব ছিল। তখনকার দিনে প্রতিবেশী এই দুটি প্রদেশের মধ্যে কোনোরকম বিবাদ-বিসম্বাদের কথা শোনা যেত না, অন্তত আমরা তো কখনো শুনিনি। আমাদের পরিবারের কার‍ুর মধ্যেই এ ধরনের সঙ্কীর্ণ প্রাদেশিকতার ভাব ছিল না। এজন্য বাপমায়ের কাছে আমরা ঋণী। উড়িয়াদের সঙ্গে বাবার যথেষ্ট মেলামেশা ছিল এবং অনেক বিশিষ্ট উড়িয়া পরিবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এর ফলে স্বভাবতই তার দৃষ্টিভঙ্গী ছিল অত্যন্ত উদার ও সহানুভূতিশীল এবং তার প্রভাবে পরিবারের অন্য সকলের মনও একই ছাঁচে গড়ে উঠেছিল। উড়িয়াদের সম্বন্ধে, শ‍ুধু উড়িয়া কেন অন্য যে কোনো প্রদেশের লোক সম্বন্ধেই, বাবার মুখে কখনো কোনো কটুকথা শ‍ুনেছি বলে মনে পড়ে না। বাবার স্বভাব ছিল একটু চাপা ধরনের, সহজে কোনো উচ্ছ্বাস তার মধ্যে প্রকাশ পেত না, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর সংস্পর্শে যেই এসেছে তাঁকে ভালো না বেসে পারেনি। বাপমায়ের প্রভাব ছেলেমেয়েদের উপরে অলক্ষিতে কতখানি কাজ করে সেটা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতা বাড়লে ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারে।

শিক্ষকদের মধ্যে একজনই মাত্র আমার মনে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন। তিনি হলেন আমাদের প্রধান শিক্ষক বেণীমাধব দাস। প্রথম দর্শনেই তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্বে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তখন আমার বয়স বারোর কিছু বেশি হবে। এর আগে আর কাউকে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা করেছি বলে মনে পড়ে না। বেণীমাধব দাসকে দেখবার পর শ্রদ্ধা কাকে বলে মনেপ্রাণে অনুভব করলাম। কেন যে তাঁকে দেখলে মনে শ্রদ্ধা জাগত তা বোঝবার মতো বয়স তখনো আমার হয়নি। শ‍ুধু বুঝতে পারতাম তিনি সাধারণ শিক্ষকের পর্যায়ে পড়েন না। মনে মনে ভাবতাম, মানুষের মতো মানুষ হতে হলে ওঁর আদর্শেই নিজেকে গড়তে হবে। আদর্শের কথা বলতে গিয়ে পি. ই. স্কুলের একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। আমার বয়স তখন বছর দশেক হবে। বড়ো হয়ে আমরা কে কী হতে চাই সে সম্বন্ধে শিক্ষকমশাই আমাদের প্রবন্ধ লিখতে দিয়েছিলেন। আমার বড়দাকে জজ্, ম্যাজিস্ট্রেট, কমিশনার, ব্যারিস্টার, ডাক্তার, এঞ্জিনীয়ার, কার পদমর্যাদা কতখানি সে সম্বন্ধে প্রায়ই বলতে শুনতাম। শুনে শুনে এ সম্পর্কে আমার যা ধারণা জন্মেছিল তাই দিয়ে কোনোরকমে এক প্রবন্ধ খাড়া করলাম, তাতে বোধ হয় আমি কমিশনার আর ম্যাজিস্ট্রেট দুই-ই হতে চেয়েছিলাম। প্রবন্ধটি পড়ে শিক্ষকমশাই আমার ভুল ধরিয়ে দিয়ে বললেন প্রথমে কমিশনার হয়ে তারপর ম্যাজিস্ট্রেট হতে চাইলে লোকে পাগল বলবে। আমার বয়স তখন খুবই কম, কাজেই কোন পেশার কতখানি মর্যাদা কিছুই বুঝতাম না। তবে বাড়িতে সবাই যা বলাবলি করত তা থেকে বুঝেছিলাম আই. সি. এস্. এর মতো চাকরি আর হয় না।

প্রধান শিক্ষকমশাই দ্বিতীয় শ্রেণীর নিচে কোনো ক্লাস নিতেন না, তাই দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠে কবে তাঁর কাছে পড়তে পারবো সেই শুভদিনের অপেক্ষায় অধীরভাবে দিন কাটাতাম। অবশেষে সেইদিন এল, কিন্তু আমার ভাগ্যে তাঁর কাছে বেশিদিন পড়া ছিল না, কারণ কয়েকমাসের মধ্যেই তিনি বদলি হয়ে অন্য জায়গায় চলে গেলেন। কিন্তু অল্পদিনের জন্য পড়ালেও যাবার আগে তিনি আমার মনে মোটামুটি একটা নৈতিক মূল্যবোধ জাগিয়ে দিয়ে গেলেন— বুঝতে শিখলাম জীবনে নৈতিক আদর্শটাই সবচেয়ে বড়ো জিনিস। পাঠ্য বইয়ে পড়েছিলাম—

পদমর্যাদা—মোহরের পিঠে ছাপ তো শ‍ুধ‍ু,
আসল সোনা সে আর কেউ নয়, মানুষ নিজে।

এর মর্ম তিনিই আমায় বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। এতে আমার চরিত্রগঠনে কতখানি যে সাহায্য হয়েছিল বলবার নয়— কারণ তখন আমার মধ্যে যৌনচেতনার প্রথম উম্মেষ দেখা দিয়েছে— বয়ঃসন্ধির সঙ্গে সঙ্গে যেটা স্বাভাবিকভাবে সকলের মধ্যেই আসে।

প্রধান শিক্ষকমশাই তাঁর অনুগত ও গণমুদ্ধে ছাত্রদের কাছ থেকে যখন বিদায় নিলেন সেই দৃশ্য এখনো আমার চোখের সামনে ভাসছে। যখন ক্লাসে ঢুকলেন, পরিষ্কার দেখা গেল তিনি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েছেন। আন্তরিক আবেগে তিনি বলতে শুরু করলেন, “বেশি আমার কিছু বলবার নেই, শ‍ুধু, প্রার্থনা করি ভগবান তোমাদের মঙ্গল কর‍ুন...” এর পর আর কোনো কথা আমার কানে যায়নি। কাস্নায় আমার ভেতরটা গুমরে উঠছিল, চোখের জল যেন আর বাগ মানতে চায় না। কিন্তু চাৱদিকে অত ছেলে, কাঁদলে সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে, তাই অনেক কষ্টে কান্না চেপে গেলাম। ক্লাস ছুটি হয়ে গেলে, ছেলেরা দলে দলে বেরিয়ে যেতে লাগল। আমিও বেরোলাম। প্রধান শিক্ষকমশাইয়ের ঘরের পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছি দেখলাম তিনি বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। ক্ষণেকের জন্য দুজনের চোখাচোখি হল। ক্লাসে এতক্ষণ কোনোরকমে কান্না চেপে ছিলাম, এবার আর পারলাম না, চোখে জল এসে গেল। তিনি নেমে এসে আমাকে সান্ত্বনা দিলেন, বললেন আবার আমাদের দেখা হবে। জীবনে এই প্রথম আমি বিদায়ব্যথায় কেঁদেছিলাম এবং অনুভব করেছিলাম একমাত্র বিদায়ের সময়েই আমরা বুঝতে পারি প্রিয়জনদের আমরা কতখানি ভালবাসি।

পরের দিন ছাত্র ও শিক্ষকদের তরফ থেকে একটি বিদায় সভার ভায়োজন করা হল। বক্তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। আমার বক্তব্য আমি কী করে গ‍ুছিয়ে তুলতে পেয়েছিলাম জানি না, কারণ কান্নায় তখন আমার গলা বুজে আসছিল। একটা জিনিস দেখে আমি মনে বড় ব্যথা পেয়েছিলাম— ব্যাপারটা যে কত বড় দুঃখের তা যেন অনেকেই বুঝতেই পারছিল না। সকলের বলা হয়ে গেলে যখন প্রধান শিক্ষকমশাই তাঁর বক্তব্য বলতে শ‍ুর‍ু করলেন, তাঁর প্রত্যেকটি কথা আমার কানে পৌঁছেছিল। তিনি বলেছিলেন, তিনি যখন প্রথম কটকে আসেন, তিনি কল্পনাই করতে পারেননি যে তাঁর জন্য সকলের মনে এতখানি প্রীতি সঞ্চিত ছিল। তারপর তিনি কী বলেছিলেন জানিনে। আমি শ‍ুধু, তাঁর আবেগোজ্জ্বল মুখের দিকে আচ্ছন্নভাবে তাকিয়ে ছিলাম। সে মুখে এমন একটি দীপ্তি ছিল যা একমাত্র কেশবচন্দ্র সেনের ছবিতেই দেখেছি। এতে অবশ্য আশ্চর্য হবার কিছু ছিল না, কারণ তিনি কেশবচন্দ্রের একজন একান্ত অনুরক্ত শিষ্য ছিলেন। শ‍ুধু একজনের অভাবে স্কুলের আবহাওয়াটা যেন একেবারে নীরস, একঘেয়ে হয়ে গেল। কোনো আনন্দই রইল না। এরই মধ্যে ক্লাস, পড়াশোনা, পরীক্ষা সবই আগের মতো চলল। অনেক সময়ে দেখা যায় একজন আর একজনের কাছ থেকে দূরে সরে যাবার পর তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বেড়ে ওঠে। আমার বেলাতেও তাই হয়েছিল। প্রধান শিক্ষকমশাই চলে যাবার পর তাঁর সঙ্গে পত্রালাপ শ‍ুর‍ু করে দিলাম। বেশ কয়েক বছর এইভাবে তাঁর সঙ্গে আমার চিঠি লেখালেখি চলেছিল। তিনিই আমাকে শেখান কী করে প্রকৃতিকে ভালবাসতে হয়, প্রকৃতির প্রভাবকে জীবনে গ্রহণ করতে হয়—শ‍ুধু সৌন্দর্যবোধের দিক থেকে নয় নৈতিকবোধের দিক থেকেও বটে। তাঁর উপদেশ অনুযায়ী আমি দস্ত‌ুরমতো প্রকৃতিপজা শ‍ুর‍ু করে দিয়েছিলাম। নদীর ধারে কিংবা পাহাড়ের গায়ে অথবা অস্তগামী সূর্যের ছটায় রঙিন নির্জন কোনো মাঠে ভালো একটা জায়গা বেছে নিয়ে এসে ধ্যান অভ্যাস করতাম। তিনি লিখতেন, “প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বিলিয়ে দেবে, দেখবে প্রকৃতি তার অসংখ্য বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে তোমাকে প্রেরণা যোগাবে।” এইভাবে প্রকৃতির ধ্যান করে তিনি নিজেও নাকি মনে শান্তি ও একাগ্রতা লাভ করেছিলেন।

প্রকৃতির ধ্যান করে নৈতিক উন্নতি আমার কতখানি হয়েছিল জানি না। কিন্তু একটা লাভ হয়েছিল—প্রকৃতির বিচিত্র ও প্রচ্ছন্ন সৌন্দর্য আমার চোখে ধরা দিয়েছিল, তাছাড়া সহজেই মনে একাগ্রতা আনতে পেরেছিলাম। বাগানে গাছপালা ও ফুল দেখতে দেখতে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতাম। কখনো কখনো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কিংবা একাই নদীর ধারে বা মাঠে ঘুরে বেড়াতাম—খেয়ালী প্রকৃতির বিচিত্র প্রকাশে মন ভরে উঠত। তখন বুঝতে পারতাম কবি কেন বলেছেন:

ছোট্ট মেঠো ফুলটি নদীর তটে
তার কাছে তা হলদে ফুলই বটে,
তবু যেন একটু কিছু আরো।

ওয়ার্ডস‍্ওয়ার্থের কাব্য যেন নতুন করে উপভোগ করতে শিখলাম। আর মহাভারতে এবং কালিদাসের কাব্যে প্রকৃতিবর্ণনা না পড়ে যে কী আনন্দ পেতাম তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না—ইতিমধ্যে আমাদের পণ্ডিতমশাইয়ের দয়ায় সংস্কৃতটা মোটামটি আয়ত্ত করে নিয়েছিলাম বলে মূল সংস্কৃতর রসই উপভোগ করতে পারতাম। এই সময় থেকে আমার মনের মধ্যে এক বিষম ওলটপালট শ‍ুরু হল। প্রায় বছর দুয়েক সে যে কী অসহ্য মানসিক অশান্তিতে কেটেছিল তা বলবার নয়। বাইরে থেকে অবশ্য কিছু বোঝবার জো ছিল না। এক্ষেত্রে অন্তরঙ্গ বন্ধুবান্ধবের পক্ষেও কিছু করবার ছিল না। এ ধরনের উৎকট অভিজ্ঞতা সাধারণত সকলের হয় বলে আমার মনে হয় না, অন্তত প্রার্থনা করি কখনো কারও যেন না হয়। তবে আমাকে আর দশজনের মতো ভাবলে ভুল করা হবে, কারণ আমার মনের গড়নটা ছিল বেশ একটু অস্বাভাবিক ধরনের। আমি যে শ‍ুধু আত্মকেন্দ্রিকই ছিলাম তা নয়, অনেক দিক দিয়ে অকালপক্কও ছিলাম। এর ফলে, যে বয়সে আমার ফুটবলমাঠে সময় কাটাবার কথা সে সময়ে আমি বসে বসে গ‍ুর‍ুগম্ভীর নানারকম সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতাম। আমার তখনকার মানসিক দ্বন্দ্বের প্রকৃত র‍ূপটা এখন অনেকটা বুঝতে পারি। এর দুটো দিক ছিল—প্রথমত, জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করার স্বাভাবিক ইচ্ছার সঙ্গে নবজাগ্রত আধ্যাত্মিক চেতনার সংঘাত। দ্বিতীয়ত, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে যে যৌনচেতনা, আমার মধ্যে দেখা দিয়েছিল তাকে অস্বাভাবিক এবং দুর্নীতিমুলক ভেবে ক্রমাগত দমন করবার চেষ্টা।

যে প্রকৃতিপ‍ূজার কথা আগে বলেছি, তাতে মনের শান্তি যে খানিকটা ফিরে পাইনি, তা নয়, কিন্তু সে আর কতটুকু! এমন একটা আদর্শের তখন আমার প্রয়োজন ছিল, যার উপরে ভিত্তি করে আমার সমস্ত জীবনটাকে গড়ে তুলতে পারব—সবরকম প্রলোভন তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যাবে। এমন একটি আদর্শ খুঁজে বের করা সহজ ছিল না। মানসিক অশান্তি আমাকে ভোগ করতে হত না, যদি আমি আর দশজনের মতো জীবনের দাবিকে সহজভাবেই মেনে নিতাম কিংবা দৃঢ়ভাবে জীবনের সমস্ত প্রলোভনকে তুচ্ছ করে যে কোনো একটা আদর্শকে আঁকড়ে ধরতাম। কিন্ত‌ু কোনোটাই আমি পারিনি। জীবনের সাধারণ প্রলোভনে ধরা দিতে আমি রাজী ছিলাম না, কাজেই সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু মনের দিক থেকে আমি ছিলাম অত্যন্ত দুর্বল, তাই এই সংঘর্ষ আমার পক্ষে অত্যন্ত প্রাণান্তকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জীবনে একটা সঠিক আদর্শ খুঁজে না পাওয়ার জন্যই যে এ অবস্থা হয়েছিল তা নয়, কারণ আদর্শ আমি খুঁজে পেয়েছিলাম, কিন্তু সেই আদর্শকে একাগ্রভাবে জীবনে অনুসরণ করা আমার পক্ষে মোটেই সহজ হয়নি। আমার ভিতরকার বির‍ুদ্ধ ও বিদ্রোহী ভাবগুলোকে দমন করে মনে শান্তি ও শৃঙ্খলা আনতে দীর্ঘকাল সময় লেগেছিল, কারণ আমার শরীর মন দুইই ছিল দুর্বল।

হঠাৎ সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবেই যেন সমস্যার সমাধান খুঁজে পেলাম। আমাদের এক আত্মীয় (সুহৃৎচন্দ্র মিত্র) নতুন কটকে এসেছিলেন। আমাদের বাড়ির কাছেই থাকতেন। একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তাঁর ঘরে বসে বই ঘাঁটছি হঠাৎ নজরে পড়ল স্বামী বিবেকানন্দের বইগুলোর উপর। কয়েক পাতা উল্টেই বুঝতে পারলাম এই জিনিসই আমি এতদিন ধরে চাইছিলাম। বইগুলো বাড়ি নিয়ে এসে গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম। পড়তে পড়তে আমার হৃদয়মন আচ্ছন্ন হয়ে যেতে লাগল। প্রধান শিক্ষকমশাই আমার মধ্যে সৌন্দর্যবোধ, নৈতিকবোধ জাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন—জীবনে এক নতুন প্রেরণা এনে দিয়েছিলেন কিন্তু এমন আদশের সন্ধান দিতে পারেননি যা আমার সমগ্র সত্তাকে প্রভাবান্বিত করতে পারে। এই আদর্শের সন্ধান দিলেন বিবেকানন্দ। দিনের পর দিন কেটে যেতে লাগল, আমি তাঁর বই নিয়ে তন্ময় হয়ে রইলাম। আমাকে সবচেয়ে বেশি উদ্ব‌ুদ্ধ করেছিল তাঁর চিঠিপত্র এবং বক্ত‌ৃতা। তাঁর লেখা থেকেই তাঁর আদর্শের মূল সরটি আমি হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলাম। “আত্মনঃ মোক্ষার্থম্, জগদ্ধিতয়া”— মানবজাতির সেবা এবং আত্মার মুক্তি—এই ছিল তাঁর জীবনের আদর্শ। আদর্শ হিসেবে মধ্যযুগের স্বার্থসর্বস্ব সন্ন্যাসীজীবন কিংবা আধুনিক যুগের মিল ও বেন্থামের ‘ইউটিলিটারিয়ানিজ‍্ম’ কোনোটাই সার্থক নয়। মানবজাতির সেবা বলতে বিবেকানন্দ স্বদেশের সেবাও বুঝেছিলেন। তাঁর জীবনীকার ও প্রধান শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা লিখে গেছেন, “মাতৃভূমিই ছিল তাঁর আরাধ্য দেবী। দেশের এমন কোনো আন্দোলন ছিল না যা তার মনে সাড়া জাগায়নি।” একটি বক্ত‌ৃতায় বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “বল ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই, মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই।” তিনি বলতেন যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য, একে একে সকলেরই দিন গিয়েছে, এখন পালা এসেছে শ‍ূদ্রের—এতদিন পর্যন্ত যারা সমাজে শ‍ুধু অবহেলাই পেয়ে এসেছে। তিনি আরো বলতেন, উপনিষদের বাণী হল, ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ’—চাই শক্তি, নইলে সবই বৃথা। আর চাই নচিকেতার মতো আত্মবিশ্বাস। অলসপ্রকৃতির সন্ন্যাসীদের তিনি বলতেন, “মুক্তি আসবে ফুটবলখেলার মধ্য দিয়ে, গীতাপাঠ করে নয়।” বিবেকানন্দের আদর্শকে যে সময়ে জীবনে গ্রহণ করলাম তখন আমার বয়স বছর পনেরোও হবে কি না সন্দেহ। বিবেকানন্দের প্রভাব আমার জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিল। তাঁর আদর্শ ও তাঁর ব্যক্তিত্বের বিশালতাকে পুরোপুরি উপলব্ধি করার মতো ক্ষমতা তখন আমার ছিল না—কিন্তু কয়েকটা জিনিস একেবারে গোড়া থেকেই আমার মনে চিরকালের জন্য গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। চেহারায় এবং ব্যক্তিত্বে আমার কাছে বিবেকানন্দ ছিলেন আদর্শ পুরুষ। তাঁর মধ্যে আমার মনের অসংখ্য জিজ্ঞাসার সহজ সমাধান খুঁজে পেয়েছিলাম। প্রধান শিক্ষকমশাইয়ের আদর্শকে তখন আর খুব বড় বলে মনে করতে পারছিলাম না। আগে ভাবতাম প্রধান শিক্ষকমশাইয়ের মতো দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করব, তাঁর আদর্শে জীবনকে গড়ে তুলব। কিন্তু এখন স্বামী বিবেকানন্দের পথই আমি বেছে নিলাম।

বিবেকানন্দ থেকে ক্রমে তাঁর গ‍ুর‍ু, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রতি আমার মনোেযোগ আকৃষ্ট হল। বিবেকানন্দ বক্ত‌ৃতা দিয়েছেন, চিঠিপত্র লিখেছেন, অনেক বই লিখেছেন—সকলেই সেগুলি পড়তে পারে। কিন্তু রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এসব কিছুই করেননি, কারণ তিনি, বলতে গেলে, প্রায় নিরক্ষর ছিলেন। তিনি শ‍ুধু, তাঁর আদর্শ অনুযায়ী জীবনযাপন করে গেছেন—সেই আদর্শকে সাধারণের মধ্যে প্রচার করবার ভার নিয়েছেন তাঁর শিষ্যেরা। কথোপকথনের মধ্য দিয়ে তিনি যে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন তাঁর শিষ্যেরা তা বই বা রোজনামচার আকারে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। এইসব বইয়ের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ হল চরিত্রগঠন ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সম্পর্কে তাঁর সহজ সরল উপদেশাবলী। বারবার তিনি বলেছেন, আত্মসংযম বিনা আধ্যাত্মিক উন্নতি অসম্ভব, একমাত্র অনাসক্তির মধ্য দিয়েই মুক্তি আসতে পারে। রামকৃষ্ণ অবশ্য নতুন কিছু বলেননি—হাজার হাজার বছর আগে উপনিষদই প্রচার করেছে, পার্থিব প্রলোভন ত্যাগই অমরত্ব লাভের একমাত্র উপায়। রামকৃষ্ণের উপদেশাবলী এত জনপ্রিয় এবং হৃদয়গ্রাহী হবার কারণ, রামকৃষ্ণ যা উপদেশ দিতেন নিজের জীবনেও তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। তাঁর শিষ্যদের মতে তিনি এইভাবে আধ্যাত্মিক উন্নতির চরম শিখরে উঠেছিলেন।

রামকৃষ্ণদেবের উপদেশের সার কথা—কামিনীকাঞ্চন ত্যাগ। তিনি বলতেন এই দুটি প্রলোভন ত্যাগ করতে না পারলে আধ্যাত্মিক উন্নতি অসম্ভব। যৌনকামনাকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে যাতে সব স্ত্রীলোক সম্বন্ধেই মনে মাতৃভাব জাগে।

অল্পদিনের মধ্যেই আমি রামকৃষ্ণ এবং বিবেকানন্দের একদল ভক্ত জুটিয়ে ফেললাম। এদের মধ্যে সহৃৎচন্দ্র মিত্রও ছিলেন। স্কুলে বা স্কুলের বাইরে, যেখানেই হোক সুযোগ পেলেই আমরা এই বিষয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করে দিতাম। অনেক সময়ে দল বেঁধে দূরে কোথাও বেড়াতে চলে যেতাম, এতে বেশ খানিকক্ষণ আলোচনা করবার সযোগ পাওয়া যেত। ক্রমে আমাদের দল বেশ ভারি হয়ে উঠল। দলে একটি গাইয়ে ছেলেকে (হেমেন্দ্র সেন) পাওয়া গেল—বিশেষ করে ভক্তিমুলক গান সে চমৎকার গাইত। দেখা গেল ঘরে বাইরে সকলেই আমাদের, সম্বন্ধে বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। আমরা যে রকম খামখেয়ালী ছিলাম তাতে অন্যে যে আমাদের সম্বন্ধে কৌতূহল প্রকাশ করবে সে আর বিচিত্র কি? অবশ্য ছাত্ররা আমাদের নিয়ে ঠাট্টাতামশা করতে সাহস পেত না, কারণ আমাদের মধ্যে অনেকেই ছিল ক্লাসের সেরা ছাত্র। বাড়ির লোকদের নিয়েই হত যত মুশকিল। বাবা মা টের পেয়ে গিয়েছিলেন যে অন্য ছেলেদের সঙ্গে আমিও প্রায়ই বাইরে বেৱিয়ে যাই। প্রথম প্রথম তাঁরা ভালোকথায় আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, তারপর তাতে কোনো ফল না হওয়ায় আচ্ছা করে বকুনি দিলেন। কিন্তু বকুনি খেয়ে শোধরাবার মতো মনের অবস্থা তখন আমার ছিল না। আমি তো আর তখন বাপমায়ের একান্ত বাধ্য সুবোধ-সুশীল বালকটি নই। নতুন আদর্শে আমার দৃষ্টি গেছে বদলে। শ‍ুধু একটি চিন্তা মাথায় ঘুরছে—এই আদর্শকে কি করে আমার জীবনে সফল কয়ে তুলব—পার্থিব প্রলোভন, অন্যায় বাধা তুচ্ছ করে জনসেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেব। পিতামাতার প্রতি ভক্তিমূলক সংস্কৃত শ্লোকের পরিবর্তে তখন এমন সব শ্লোক মুখস্ত করতে শুরু করলাম যাতে পিতামাতার শাসন অমান্য করবারই মন্ত্রণা রয়েছে।

জীবনে আর কখনো এরকম সঙ্কটে বোধ হয় আমাকে পড়তে হয়নি। রামকৃষ্ণের আত্মসংযম ও কামিনীকাঞ্চন ত্যাগের আদর্শ অনুসরণ করতে গিয়ে স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগ‍ুলির সঙ্গে লাগল সংঘাত। আর বিবেকানন্দের আদর্শ মনকে সামাজিক ও পারিবারিক বাধানিষেধের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উদ্ব‌ুদ্ধ করল। আগেই বলেছি শরীর মন দুইই ছিল আমার দুর্বল, কাজেই এই মানসিক দ্বন্দ্বে জয়ী হতে আমাকে যে কী পরিমাণ কষ্ট করতে হয়েছে তা বলবার নয়। কখনো আশা কখনো নিরাশা, কখনো দুঃখ কখনো আনন্দ—এইভাবে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়েই আমার বহুদিন কেটেছে। মনের দ্বন্দ্বটাই বেশি পীড়াদায়ক ছিল, না বাইরের বাধাবিঘ্ন জয় করাটাই বেশি কষ্টকর ছিল তা বলা কঠিন। আমার মনের জোর যদি একটু বেশি থাকত কিংবা একটু স্থ‌ূলপ্রকৃতির হত তবে এত কষ্ট আমাকে পেতে হত না, অনেক সহজেই জয়ী হয়ে বেরিয়ে আসতে পারতাম। কিন্তু তা না হওয়াতে আমাকে মুখ বুজে সব সহ্য করতে হয়েছে। বাবামা যতোই আমাকে বাধা দিতে চেয়েছেন আমিও ততই বিদ্রোহী হয়ে উঠেছি। যখন অন্য কোনোভাবে আমাকে বাগে আনতে পারলেন না, মা কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। কিন্তু চোখের জলেও আমার মন ভিজল না। বরং বিরক্ত হয়ে আমি আরো বেশি অবাধ্য এবং খামখেয়ালী হয়ে উঠলাম, কোনোরকম শাসনই আমার উপর খাটল না। অবশ্য এজন্য মনে মনে আমি অত্যন্ত অশান্তি ভোগ করেছি। বাপমায়ের অবাধ্য হওয়া যে আমার পক্ষে কতখানি পীড়াদায়ক ছিল তা বলে বোঝানো যায় না, কারণ ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আমার স্বভাববিরুদ্ধ। কিন্তু আমার কাছে সবার উপরে তখন আদর্শ—সেই আদর্শের কাছে আর সবই তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। সবচেয়ে খারাপ লাগত যখন দেখতাম বাড়িতে কেউই আমাকে অন্তরঙ্গভাবে বুঝতে চেষ্টা করছে না, আমার ভিতরে যে অসহ্য দ্বন্দ্ব চলছে তার খোঁজ রাখছে না। একমাত্র সান্ত্বনা পেতাম বন্ধুদের কাছে—কাজেই যতক্ষণ বাড়ির বাইরে বন্ধুদের মাঝে থাকতাম অতটা কষ্ট হত না।

লেখাপড়ায় আর মন বসতে চাইত না। শ‍ুধু গোড়ার দিকে যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম বলেই কোনোরকমে মান রক্ষা হয়েছিল, নয়তো একেবারে তলিয়ে যেতাম। লেখাপড়া ছেড়ে এখন আমার একমাত্র কাজ হল যোগ অভ্যাস করা। যোগ শেখাতে পারে, এরকম গ‍ুর‍ু তখনো আমার জোটেনি, কাজেই বই পড়ে যতটুকু শেখা যায় তাই দিয়েই কাজ চালাতাম। পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছিলাম যে এজাতীয় বই অধিকাংশই বাজে লোকের লেখা, যাদের উপর কোনোমতেই নির্ভর করা চলে না। ব্রহ্মচর্য, যোগ, হঠযোগ ইত্যাদি সম্বন্ধে এই ধরনের অনেক বই বাজারে পাওয়া যেত। আমরা সাগ্রহে এইসব কিনে পড়তাম, এবং এগ‍ুলিতে যেসব নিয়মকানুন দেওয়া থাকত সেগুলি বিনাদ্বিধায় পালন করতাম। এ ছাড়া আরো কত রকমের বিচিত্র সব অনুষ্ঠান যে পালন করা হত তার একটা বিবরণ দিলে প্রচুর হাসির খোরক মিলবে। সে সময়ে আমাকে অনেকে কেন পাগল ভাবত, এখন সেটা বুঝতে পারি।

প্রথম যখন যোগ অভ্যাস করব বলে ঠিক করলাম তখন একটা সমস্যা দেখা দিল—ভেবেই পাচ্ছিলাম না লোকচক্ষু এড়িয়ে কী ভাবে কাজটা করা যায় এবং দুর্ভাগ্যক্রমে যদি কেউ আমাকে দেখে ফেলে তবে কী করে ঠাট্টাতামাশার হাত থেকে বাঁচা যাবে। ঠিক করলাম সন্ধ্যার পর বসা যাবে তাহলে অন্ধকারে সহজে আমাকে কেউ দেখতে পাবে না। কয়েকদিন বেশ নির্বিঘ্নেই কাটল, কিন্তু হঠাৎ একদিন ধরা পড়ে গেলাম। সে এক ভারি মজার ব্যাপার। অন্ধকার ঘরে বসে যোগ অভ্যাস করছি, এমন সময়ে ঝি বিছানা করবার জন্যে সেই ঘরে ঢুকে অন্ধকারে হুড়মড় করে একেবারে আমার ঘাড়ে এসে পড়ল। আলো জালাবার পর আমাকে ওভাবে দেখে বেচারা কি রকম হতভম্ব হয়েছিল, বুঝতেই পারেন।

যোগ অভ্যাসের নানারকম প্রক্রিয়া ছিল। সাধারণত যেটা অনসরণ করা হত সেটা এই—শাদা খানিকটা জায়গার ঠিক মাঝখানে একটা কালো বৃত্ত এঁকে সেই বৃত্তের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না মন সম্পূর্ণ সমাধিস্থ হয়। কখনো কখনো নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে মনকে সমাধিস্থ করা হত। সবচেয়ে কষ্টকর ছিল মধ্যাহ্নের প্রখর সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকার প্রক্রিয়া। নানারকম কৃচ্ছসাধনের ব্যবস্থাও ছিল—যেমন নিরামিষ আহার, প্রত্যূযে শয্যাত্যাগ, শরীরের শীতগ্রীষ্মানুভূতি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি।

এসবই অত্যন্ত গোপনে সমাধা করতে হত—সে ঘরের লোকের কাছেই হোক বা বাইরের কার‍ুর কাছেই হোক। রামকৃষ্ণের একটি প্রিয় উপদেশ ছিল: বনে বা নির্জন কোনো জায়গায়, ঘরে বা মনে মনে— যেখানেই হোক এমনভাবে যোগ অভ্যাস করবে যাতে বাইরে থেকে কেউ টের না পায়। জানবে শুধু তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধুরা যারা নিজেরা যোগ অভ্যাস করে, আর জানবে সহ-যোগীরা।

এইভাবে কিছুদিন যোগ অভ্যাস করবার পর আমরা পরস্পরের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দেখতে লাগলাম। রামকৃষ্ণ একটা জিনিস বিশেষ করে সকলকে বলতেন। যোগে সিদ্ধি লাভ করলে অনেকেই অলৌকিক শক্তির অধিকারী হন—কিন্তু সেইজন্য অহঙ্কারে আত্মহারা হয়ে কেউ যদি আত্মপ্রচার বা শক্তির অপব্যবহার করতে শ‍ুর‍ু করেন তবে তার ফল অত্যন্ত মারাত্মক হতে পারে। আধ্যাত্মিক উন্নতির চরমশিখরে উঠতে হলে এই প্রলোভন ভ্যাগ করতেই হবে। মাসের পর মাস যোগ করবার পরও আমার মধ্যে এই ধরনের কোনো অলৌকিক শক্তি অনুভব করিনি, তবে আগের চাইতে আমার আত্মবিশ্বাস ও আত্মসংযম অনেক বেড়ে গিয়েছিল, মানসিক শান্তিও অনেকটা ফিরে পেয়েছিলাম। কিন্তু এর বেশি কিছু নয়। ভাবলাম হয়তো একজন গ‍ুর‍ুর অভাবেই সাধনা আর এগোচ্ছে না—অনেককেই বলতে শ‍ুনতাম কিনা গ‍ুর‍ু বিনা যোগসাধনা কখনো সফল হয় না। অগত্যা গ‍ুর‍ুর সন্ধানে মন দিলাম। আমাদের দেশে সংসারত্যাগী যোগীরা অনেকেই পরিব্রাজকের জীবনযাপন করেন কিংবা তীর্থস্থানগুলিতে ঘুরে বেড়ান। কাজেই হরিদ্বার, বারাণসী, পুরী (বা জগন্নাথ) কিংবা রামেশ্বরম—যে কোনো তীর্থে এদের দেখা মেলে। পুরীর কাছাকাছি বলে কটকেও এই ধরনের সাধুসন্ন্যাসীর ভিড় লেগেই থাকত। এই সাধুসন্ন্যাসীদের মধ্যে আবার দুটো শ্রেণীবিভাগ আছে—একদল হল আশ্রম বা মঠবাসী, আর একদল তারা কোন দল বা সম্প্রদায়ভুক্ত নয়, সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত প্রকৃতির। আমাদের কাছে অবশ্য কোনো বাছবিচার ছিল না। শহরে কোনো সাধুসন্ন্যাসী এসেছে একবার খোঁজ পেলেই হল, সবাই ছুটতাম তার দর্শন নিতে। এইভাবে কত বিচিত্র ধরনের লোকের যে দেখা পেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। এদের মধ্যে আমার সবচেয়ে ভালো লাগত সত্যিকার সংসারবিমুখ নির্লিপ্তপ্রকৃতির সাধুদের। এরা কখনো চেলা খুঁজে বেড়ায় না, এবং কার‍ুর কাছ থেকে অর্থও কখনো গ্রহণ করে না। যদি কাউকে এরা শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করে তবে তাকে এদেরই মতে সংসারের সঙ্গে সম্পর্ক সম্পূর্ণ চুকিয়ে দিতে হবে। বিশেষ কোনো সম্প্রদায়ভুক্ত এবং বিবাহিত সাধুদের আমার মোটেই ভালো লাগত না। এদের প্রধান উদ্দেশ্যই হল ধনী ও সম্ভ্রান্ত লোকদের শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করা, যাতে দরকার মতো তাদের শোষণ করাও চলে। একবার এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসী এলেন কটকে। নব্বুই কি তারও বেশি তাঁর বয়স। ভারতবর্ষের একটি বিখ্যাত আশ্রমের অধ্যক্ষ তিনি। কটকের একজন নামকরা ডাক্তার এঁর শিষ্য ছিলেন। তাঁকে দেখবার জন্য সাৱা কটক শহরে যেন ধুম পড়ে গেল। দর্শনপ্রার্থীদের মধ্যে আমরাও ভিড়ে পড়লাম। যথাস্থানে পৌঁছে সাধুজীকে প্রণাম করবার পর আমরা সকলে তাকে ঘিরে বসলাম। অত্যন্ত প্রসন্নভাবে আমাদের সঙ্গে তিনি কথাবার্তা বললেন। তাঁর ব্যবহারে আমরা মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। পরে তাঁর কয়েকজন শিষ্য স্তোত্রপাঠ করলেন। পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে আমরা শুনলাম। বিদায় দেবার সময়ে তিনি আমাদের তাঁর ছাপানো উপদেশাবলী দিয়ে সেগ‍ুলো যথাযথভাবে পালন করতে বলে দিলেন। আর সকলের কথা জানিনা, আমি তো মনে মনে সংকল্প করলাম উপদেশগ‍ুলো ঠিকমতো পালন করব। প্রথম উপদেশ হল— মাছ, মাংস বা ডিজ্ঞ কোনোটাই খাওয়া চলবে না। আমাদের বাড়িতে আবার নিরামিষের চাইতে আমিষটাই বেশি চলত, কাজেই এই উপদেশ পালন করা খুব সহজ হয়নি-যথেষ্ট বাধা পেতে হয়েছে, বকুনি খেতে হয়েছে। কিন্তু শত বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও আমি উপদেশ পালন করেছিলাম। দ্বিতীয় উপদেশ, দৈনিক কতকগুলি স্তোত্র পাঠ করা। এটা সহজেই সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এর পরের উপদেশটাই ছিল একটু গোলমেলে—বাপমায়ের বাধ্য হওয়া। সকালে উঠে প্রথমেই বাবা মাকে প্রণাম করতে হবে। আগে কখনো বাবা মাকে এভাবে প্রত্যেক দিন প্রণাম করিনি। তাছাড়া নির্বিচারে বাপমায়ের সব কথাই মেনে নেওয়ার কোনো সার্থকতা আছে বলে আমি বিশ্বাস করতাম না। বরঞ্চ আমার আদর্শের পথে সব রকম বাধাকেই, সে বাপমায়ের কাহ থেকেই আসুক বা অন্য কোনো দিক থেকেই আসুক, তুচ্ছ করর বলে দৃঢ়সংকল্প ছিলাম। যাই হোক, উপদেশ মানতেই হবে, কাজেই একদিন সকালবেলা চোখমুখ বুজে কোনোৱকমে সটান গিয়ে বাবাকে প্রণাম করে ফেললাম। আজও পরিষ্কার মনে পড়ে—এই আকস্মিক ব্যাপারে বাবা কী রকম অপ্রস্ত‌ুত হয়ে পড়েছিলেন। আমার এই অদ্ভ‌ুত আচরণের কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলেন তিনি, কিন্তু আমি একটি কথাও না বলে ঠিক যেমন এসেছিলাম তেমনি মুখ বুজে বেরিয়ে এলাম। মায়ের বেলাতেও একই ব্যাপার ঘটল। আজ পর্যন্ত জানি না সে সময়ে বাবা কিংবা মা আমার সম্বন্ধে কী ভেবেছিলেন। প্রত্যেকদিন সকালে উঠে এই কর্তব্যটি সমাপন করতে আমাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। বাড়ির সকলেই, এমন কি চাকরবাকরেরা পর্যন্ত আমার মতো বেয়াড়া ছেলেকে হঠাৎ এরকম বাধ্য হয়ে যেতে দেখে নিশ্চয়ই খুব আশ্চর্য হয়েছিল। এই ব্যাপারটার পেছনে যে একজন সাধুর অলক্ষিত প্রভাব কাজ করছিল আশা করি কেউ ঘুণাক্ষরেও তা বুঝতে পারেনি। কিছুদিন পরে, যখন খতিয়ে দেখতে গেলাম উপদেশগলি পালন করে আমার কোনো লাভ হয়েছে কি না তখন নিরাশ হতে হল। অগত্যা এসব ছেড়েছুড়ে দিয়ে আবার রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দকে নিয়ে পড়লাম। মনকে বোঝলাম—সংসার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত হতে না পারলে মুক্তি অসম্ভব।

ধর্মচচা বলতে আমি শধু যোগ অভ্যাসকেই জানতাম—একথা বললে ভুল বলা হবে। অবশ্য কিছুদিন আমি যোগ নিয়ে একটু বেশি রকম মেতে উঠেছিলাম, কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিলাম আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য জনসেবা অপরিহার্য। এই ধারণা বিবেকানন্দই আমাকে দিয়েছিলেন, তিনিই জনসেবা তথা দেশসেবার আদর্শ প্রচার করেছিলেন। শুধু তাই নয়, দরিদ্রের সেবাকেও তিনি অবশ্য কর্তব্য বলে স্বীকার করেছিলেন। তিনি বলতেন দরিদ্রের মধ্য দিয়ে ভগবান আমাদের কাছে আসেন, কাজেই দরিদ্রের সেবা মানেই ভগবানের সেবা। মনে পড়ে বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি ভিক্ষুক, ফকির, সাধুসন্ন্যাসী—সকলের সঙ্গে অত্যন্ত অন্তরঙ্গ হতে চেষ্টা করতাম। বাড়িতে এরা কেউ এলে তাদের যথাসাধ্য দান করে মনে মনে অদ্ভ‌ুত আনন্দ পেতাম। তখনো আমার ষোল পূর্ণ হয়নি, সেই প্রথম পল্লীসংস্কারের অভিজ্ঞতা হল। কটকের প্রান্তে একটি গ্রামে দলবেঁধে এগিয়ে আমরা পল্লী সংস্কারের কাজ শ‍ুর‍ু করলাম। গ্রামের একটি স্কুলে ঢুকে কিছুটা শিক্ষকতা করা গেল। স্কুলের শিক্ষকেরা এবং গ্রামের লোকেরাও আমাদের সাদর অভিনন্দন জানাল। আমরা খুব উৎসাহ পেলাম। এর পর আর একটি গ্রামে গেলাম, কিন্তু আমাদের স্রেফ বোকা বনে যেতে হল। আমাদের গ্রামে ঢুকতে দেখেই গ্রামের লোকেরা দলবেঁধে আমাদের কাছ থেকে সরে পড়তে লাগল। তাদের সঙ্গে বন্ধুভাবে একটা কথা বলা দূরে থাক, তাদের নাগাল পাওয়াই দুষ্কর হয়ে উঠল। যখন দেখলাম তারা আমাদের শ‍ুধু যে স্বজন বলে মানতে রাজী নয় তা নয়, আমাদের তারা দস্ত‌ুরমতো শত্র‌ুপক্ষ বলেই মনে করে, তখন আমাদের হতাশার সীমা রইল না। তবে তাদের ব্যবহারে একটা কথা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম—আমাদের আগে তথাকথিত যত ভদ্রলোেকই এখানে এসে গেছেন তাঁরা হয় ট্যাক্স-কালেক্টর বা ঐ জাতীয় কোনো পেশা নিয়ে এসেছেন এবং গ্রামের লোকদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছেন যার ফলে আজ আমাদের ও গ্রামবাসীদের মধ্যে এই দ‍ুস্তর ব্যবধান দেখা দিয়েছে। কয়েক বছর পরে উড়িষ্যার আরো কয়েকটা গ্রামেও আমার একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল।

যতদিন স্কুলে ছিলাম অন্যান্য ব্যাপারে অকালপক্ক হলেও রাজনৈতিক জ্ঞান আমার সামান্যই ছিল। এর একটা বড় কারণ রাজনীতির দিকে আমার তেমন ঝোঁক ছিল না, বাড়িতেও রাজনীতির চর্চা বিশেষ হত না। তাছাড়া গোটা উড়িষ্যাটাই রাজনীতির দিক থেকে অত্যন্ত পেছিয়ে ছিল। দাদাদের মুখে কংগ্রেসের কার্যকলাপ সম্মন্ধে মাঝে, মাঝে কথাবার্তা শুনতাম, কিন্তু সে শোনা পর্যন্তই। ১৯০৮ সালে প্রথম যখন রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে বোমা ব্যবহার করা হয়, দেশের চারদিকেই বেশ একটা সাড়া পড়ে গিয়েছিল। আমাদের মধ্যেও সাময়িক উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। আমি তখন পি. ই. স্কুলে পড়ি। প্রধানশিক্ষয়িত্রী বোমা ছোঁড়ার বিরুদ্ধে আমাদের খুব উপদেশ শোনালেন। ব্যাপারটা অবশ্য অল্পদিনের মধ্যেই চাপা পড়ে গেল। সেই সময়ে বঙ্গবিভাগ নিয়ে খুব গোলমাল চলছিল। বঙ্গবিভাগের প্রতিবাদে শহরে মিছিল বেরোত। একই সঙ্গে স্বদেশী জিনিস ব্যবহারের জন্য আন্দোলনও চলেছিল। আমরা স্বভাবতই এসব ব্যাপারে কাজে না হোক মনে মনে খানিকটা ঝুঁকেছিলাম। কিন্তু আমাদের বাড়িতে রাজনীতির প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল, কাজেই রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। আমৱা করতাম কি, খবরের কাগজ থেকে বিপ্লবীদের ছবি কেটে কেটে পড়ার ঘরে টাঙিয়ে রাখতাম। একদিন আমাদের এক আত্মীয় আমাদের বাড়ি বেড়াতে এলেন। তিনি ছিলেন পুলিশ অফিসার। আমাদের ঘরে ঢুকে বিপ্লবীদের ছবি দেখে তিনি বাবাকে সাবধান করে দিলেন, ফলে স্কুল থেকে ফিরে এসে আমরা দেখলাম সেসব দুরি নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। আমাদের কী রকম খারাপ লেগেছিল বুঝতেই পারেন।

১৯১১ সালের ডিসেম্বর অবধি রাজনৈতিক চেতনা আমার এত কম ছিল যে সম্রাট পঞ্চম জর্জের রাজ্যাভিষেক সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে আমার মনে বিন্দুমাত্র দ্বিধাও জাগেনি। সাধারণত ইংরিজি রচনায় আমিই সবচেয়ে বেশি নম্বর পেতাম, কিন্তু এই প্রতিযোগিতায় আমার ভাগ্যে পুরস্কার জুটল না। বড়দিনের সময়ে পঞ্চম জর্জ কলকাতায় এলেন, বাড়ির আর সকলের সঙ্গে আমিও তখন সেই উপলক্ষে কলকাতায় বেড়াতে গেলাম। ফিরে এলাম যখন সম্রাটের দর্শন লাভ করে মন আনন্দে ভরপুর।

প্রথম রাজনৈতিক প্রেরণা পেয়েছিলাম আমি ১৯১২ সালে আমারই বয়সী একটি ছাত্রের (হেমন্তকুমার সরকারের) কাছ থেকে। ছেলেটি কটক ও পুরীতে বেড়াতে এসেছিল। প্রধানশিক্ষকমশাই বেণীমাধব দস তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। ছেলেটি কলকাতার একটি রাজনৈতিক দলের সভ্য ছিল—এই দলের আদর্শ ছিল আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং দেশসেবা। এই দলের নেতা ছিল সুরেশচন্দ্র বানাজি বলে একটি ছেলে। ছেলেটি ডাক্তারী পড়ত। সমাজ ও দেশের নানা সমস্যা নিয়ে মাত্র মাথা ঘামাতে শুরু করেছি এমনি সময়ে ছেলেটির আবির্ভাব। আমাদের দলে একজন ছেলে সে যোগের চেয়ে দেশসেবাতেই বেশি বিশ্বাস করত। আর একজন ছেলে বাঙালী যোদ্ধা সুরেশ বিশ্বাসের মতো হবার স্বপ্ন দেখত—কর্নেল সুরেশ বিশ্বাস দক্ষিণ আমেরিকায় (বোধ হয় ব্রাজিল) গিয়ে সেখানে যথেষ্ট নাম কিনেছিলেন। আমার বন্ধুটি সুরেশ বিশ্বাসের পদাঙ্ক অনুসরণ করবার জন্য খুব কুস্তি লড়ত—আমরা তখন যোগ অভ্যাস করতেই ব্যস্ত। আগন্তুক ছেলেটি একদিন সুযোেগ বুঝে দেশের প্রতি আমাদের কী কর্তব্য সে সম্বন্ধে আবেগের সঙ্গে বহ‍ু, উপদেশ দিল। তাদের কলকাতার দলের বিচিত্র কার্যকলাপ সম্বন্ধে অনেক খবরও তার কাছে পাওয়া গেল। সব শুনে আমি তো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কলকাতার মতো বড় শহরের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত হওয়ার মধ্যে যে গৌরব আছে তার লোভে আমরা সকলেই ছেলেটির আবির্ভাবকে ভগবানের আশীর্বাদ বলেই মনে করলাম। কলকাতায় ফিরে গিয়ে ছেলেটি তার দলের কাছে আমাদের সম্বন্ধে একটি বিবৃতি পেশ করেছিল। কিছুদিনের মধ্যেই সেই দলের প্রধানের কাছ থেকে সেই সুত্রে আমরা চিঠি পেলাম। এইভাবে দলটির সঙ্গে আমাদের যে মোগামোগ ঘটল বেশ কয়েক বছর তা টিঁকে ছিল।

স্কুল ছাড়ার সময় যতোই এগিয়ে আসতে লাগল, আমার মধ্যে ধর্মভাবও তেমনি তীব্রতর হয়ে উঠল। লেখাপড়ায় মন রইল না। আমাদের একমাত্র কাজ হল তখন দলবেঁধে বাইরে গিয়ে যতক্ষণ ইচ্ছে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করা। শিক্ষকদের দু-একজন বাদে কাউকেই আমাদের ভালো লাগত না। যে দু-একজনকে ভালো লাগত তাঁরা ছিলেন রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের ভক্ত। এই সময়ে বাবা মার গ‍ুর‍ুদেব কটকে এলেন। (ইনি বাবা মার প্রথম গ‍ুর‍ু, এর মত্যুর পর তাঁরা আর এক গ‍ুর‍ুর কাছে দীক্ষা নেন।) তিনি আমার মধ্যে ধর্মভাব আরো বেশি করে জাগিয়ে দিলেন। কিন্তু তাঁর প্রভাব আমার উপর খুব বেশি খাটল না, কারণ তিনি ‘সন্ন্যাসী’ ছিলেন না। শিক্ষকদের মধ্যে একজনেরই মাত্র রাজনৈতিক চেতনা কিছুটা ছিল। স্কুলের পড়া শেষ করে যখন আমি কলকাতায় আসার জন্য তোড়জোড় করছি, তিনি আমাকে অভিনন্দন জানালেন, বললেন কলকাতায় গেলে অনেক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে দেখা হবে, তাতে আমার রাজনৈতিক চেতনা বাড়বে।

ছেলেবেলায় আমাদের যেসব অভিজ্ঞতা হয় তার স্মৃতি বহুদিন পর্যন্ত টিঁকে থাকে এবং মনকে গভীৱভাবে প্রভাবান্বিত করে। মনে পড়ে ছোটোবেলায় চাকরবাকর বা বাড়ির বয়স্কদের কাছে খুব ভূতের গল্প শুনতাম। একটা বিশেষ গাছ ভূতের আস্তানা বলে পরিচিত ছিল। রাত্তিরে যখন ভূতের গল্প শুনতাম ভয়ে আমার হাতপা হিম হয়ে যেত। রাত্তিরে জমাট একটি ভূতের গল্প শুনে জ্যোৎস্নারাত্রের আলো-আঁধারে গাছের উপর ভূতের দেখা পাওয়া মোটেই আশ্চর্য ছিল না। আমাদের মুসলমান বাবুর্চি তো একদিন রাত্রে বলে বসল তাকে ভূতে পেয়েছে। কী করা যায়! শেষটায় ওঝা ডেকে সেই ভূত তাড়ানো হল। এই ধরনের ব্যাপার আরো কয়েকটা ঘটেছিল। আমাদের একজন মুসলমান কোচোয়ান নিজেকে একজন ওস্তাদ ভুতের ওঝা বলে জাহির করত। সে নাকি কব্জির কাছটায় চিরে ভূতকে সেই রক্ত খাইয়ে বিদায় করত। তার কথা কতখানি সত্যি বুঝতাম না, তবে একথা ঠিক যে তার কব্জির কাছে পুরনো ক্ষতচিহ্ন তো ছিলই, নতুন ক্ষতও প্রায়ই দেখতে পেতাম। সে একটু আধটু হাকিমিও জানতে এবং অজীর্ণ, পেটের অসুখ ইত্যাদি রোগের নানারকম ওষুধ তৈরি করত। ছেলেবেলার এইসব অভিজ্ঞতা সহজে মন থেকে লপ্ত হয়নি। বড় হয়ে প্রাণপণ চেষ্টায় আমি এদের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করেছি।

মনকে এইসব কুসংস্কার থেকে মুক্ত করতে বিবেকানন্দই আমাকে সাহায্য করলেন। তিনি যে ধর্মপ্রচার করতেন, যে যোগসাধনায় বিশ্বাস করতেন—সবেরই মূলভিত্তি ছিল বেদান্ত এবং বেদান্তকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে। তাঁর জীবনের একটা বড় আদর্শ ছিল ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের সময় ঘটানো। তার মতে এই সময় বেদান্তের মধ্য দিয়েই সম্ভব। শিশ‍ুশিক্ষা নিয়ে যাঁরা এদেশে গবেষণা করেন একটা জিনিস তাঁদের লক্ষ্য করা একান্ত দরকার; আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের মন অনেক প্রতিকূল প্রভাবের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে—যেমন ধরুন, শিশুকে ঘুম পড়াবার জন্য মা, মাসী পিসী বা কি—এরা যে সমস্ত ঘুমপাড়ানি, গান গেয়ে থাকে, শিশ‍ু খেতে না চাইলে তাকে জোর করে খাওয়াবার জন্য যেসব কথা বলে তাকে ভোলান হয়—প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় এসবের একমাত্র উদ্দেশ্য শিশুকে ভয় দেখিয়ে কাজ হাসিল করা। বাঙলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঘুমপাড়ানি গান হল—‘ঘুমপাড়ানি মাসীপিসী, বর্গী এলে দেশে...।’ বর্গীদস্যুদের নৈশ অভিযানের কাহিনী শিশ‍ুদের মনে আতঙ্কেরই সৃষ্টি করে এবং তার ফল যে ভালো হতে পারে না সে কথা বলাই বাহুল্য।

শিশ‍ুরা সাধারণত যেসব স্বপ্ন দেখে তাদের জাগ্রত জীবনেও তার প্রভাব খানিকটা থেকে যায়। মনস্তত্ত্ব ও স্বপ্নতত্ত্ব সম্বন্ধে জ্ঞান থাকলে অভিভাবক বা শিক্ষকের পক্ষে শিশ‍ুমন বোঝা অনেকটা সহজ হয়ে পড়ে এবং তখন সবরকম অবাঞ্ছিত প্রভাব থেকে শিশুদের রক্ষা করা সম্ভব হয়। ছেলেবেলায় আমি প্রায়ই সাপ, বাঘ, বাঁদর ইত্যাদি সম্বন্ধে অত্যন্ত ভয়াবহ সব স্বপ্ন দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে থাকতাম—এজন্যই এসব কথা তুললাম। বড় হয়েও যৌনবিষয়ক স্বপ্ন, য়ুনিভার্সিটির পরীক্ষার স্বপ্ন, গ্রেপ্তার এবং কারবালের স্বপ্ন—ইত্যাদি নানারকম দুঃস্বপ্ন প্রায়ই আমাকে কষ্ট দিত। পরে যখন যোগ অভ্যাস করি সে সময়ে বিশেষ একটি প্রক্রিয়ার সাহায্যে এই ধরনের দুঃস্বপ্নের হাত থেকে চিরকালের জন্য রেহাই পেয়েছিলাম।

একটা জিনিস একমাত্র ভারতবর্ষেই এবং বিশেষ করে রক্ষণশীল গোঁড়া পরিবারেই দেখা যায়। এদেশে ছেলেদের বয়স বাড়ে, তারা য়ুনিভার্সিটির ডিগ্রীও পায়, কিন্তু তাদের নাবালকত্ব আর ঘুচতে চায় না, মনের কোনো প্রসারই তাদের হয় না। অবিশ্যি সময়ে সময়ে যে অনেকে পরিবার ও সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে না, তা নয়। এদিক থেকে আমার ভাগ্যটা ছিল ভালো। আমাদের পরিবারে কোনো রকমের সংকীর্ণতা বা গোঁড়ামি ছিল না—ফলে আমার মন স্বভাবতই উদার হয়ে গড়ে উঠেছিল। ছেলেবেলায় প্রথমেই ইংরিজি শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেছিলাম, ইংরেজদের সঙ্গে মিশেছিলাম। এরপর আমার নিজের দেশের সংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচিত হলাম। যখন স্কুলে পড়ি তখন থেকেই বিভিন্ন প্রদেশের ছেলেদের সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় হয়েছিল—বাঙলাদেশে থাকলে যেটা হত কি না সন্দেহ। মুসলমানদের সম্বন্ধে আমার উদার মনোভাবের জন্যও ছেলেবেলার অভিজ্ঞতাই বহুল পরিমাণে দায়ী। আমাদের বাড়ি ছিল মুসলমান এলাকায়। প্রতিবেশীরাও প্রায় সকলেই ছিল মুসলমান। বাবাকে এরা সকলেই খুব শ্রদ্ধা করত। আমরাও মুসলমানদের মহরম ইত্যাদি উৎসব অনুষ্ঠানে যোগ দিতাম। আমাদের চাকদের মধ্যেও কয়েকজন ছিল মুসলমান, আর সকলের মতো তারাও আমাদের খুব অনুরক্ত ছিল। স্কুলে মুসলমান শিক্ষক এবং সহপাঠীদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। সত্যি বলতে কি মস‍্জিদে গিয়ে উপাসনা করা ছাড়া আর কোনো ব্যাপারেই আমি আমাদের সঙ্গে মুসলমানদের কোনো প্রভেদ দেখতাম না। তাছাড়া তখনকার দিনে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে রেষারেষি বা ঝগড়াঝাঁটি মোটেই হিল না। যে পরিবেশে আমি মানুষ হয়েছিলাম সেটা মোটামুটি উদারভাবাপন্ন হলেও অনেক ক্ষেত্রে সমাজ ও পরিবারের বিরুদ্ধে আমাকে বিদ্রোহ করতে হয়েছে। আমার বয়স যখন চোদ্দ কি পনেরো সে সময়কার একটি ঘটনার কথা বলি। প্রতিবেশী আমার এক সহপাঠী (দেবেন দাস) একদিন আমাদের কয়েকজনকে তার বাড়িতে খেতে বলে। মায়ের কানে কথাটা যেতেই তিনি স্রেফ আমাদের যেতে বারণ করে বসলেন। হয়তো বন্ধটি আভিজাত্যে আমাদের চাইতে ছোটো ছিল কিংবা আমাদের চেয়ে নিচু জাতের ছিল বলেই মা আপত্তি করেছিলেন, কিংবা হয়তো বাইরে খেলে অসুখবিসুখ হতে পাৱে এরকম আশঙ্কা করেছিলেন। আমরাও বাস্তবিকই বাইরে খুব কমই খেতাম। কিন্তু এক্ষেত্রে মায়ের আপত্তি আমার কাছে অত্যন্ত অসঙ্গত বলে মনে হল। আমি মায়ের নিষেধ অমান্য করেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেলাম—এবং এতে কেমন একটা অদ্ভ‌ুত আনন্দও যেন অনুভব করেছিলাম। পরে যখন ধর্মচর্চা ও যোগসাধনা উপলক্ষে অনেকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করার প্রয়োজন হয়ে পড়ত, অনেক জায়গায় যেতে হত—তখন প্রায়ই বাবা-মার নিষেধ অমান্য করতে হয়েছে। কিন্তু তার জন্য মনে কিছুমাত্র দ্বিধাও জাগেনি, কারণ তখন বিবেকানন্দের আদর্শ আমি মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছি—বিবেকানন্দ বলতেন আত্মোপলব্ধির জন্য সব বাধাকেই তুচ্ছ জ্ঞান করতে হবে। ভূমিষ্ঠ হয়েই শিশ‍ু যে কাঁদে, তার কারণ আর কিছুই নয়, যে বাধানিষেধের গণ্ডির মধ্যে সে ভূমিষ্ঠ হয় তার বিরদ্ধে তার স্বাধীনসত্তা বিদ্রোহ করে ওঠে।

আমার স্কুলজীবনের কথা ভাবলে বুঝতে পারি অনেকেই আমাকে সে সময়ে অত্যন্ত খামখেয়ালী, বেয়াড়া প্রকৃতির বলে মনে করতেন। আমার অভিভাবকেরা এবং স্কুলের শিক্ষকেরা সকলেই খুব আশা করেছিলেন প্রবেশিকা পরীক্ষায় আমি খুব ভালো করব, স্কুলের নাম রাখবো। কিন্তু আমি যখন লেখাপড়া ছেড়ে সাধুসন্ন্যাসীদের নিয়ে মেতে উঠলাম তখন তাঁদের নিরাশ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর রইল না। আমার উপর বাবা-মায়ের অনেক আশা-ভরসা ছিল, কাজেই আমার এই পরিবর্তনে তাঁদের অবস্থা কী রকম দাঁড়িয়েছিল সেটা সহজেই অনুমেয়। আমি এসব জিনিসকে মোটেই আমল দিতাম না, আমার কাছে আদর্শটাই তখন সবচেয়ে বড়। কোনোরকম বাধানিষেধই আমি মানতাম না। বাধা গেলে আমার জেদ আরো বেড়ে যেত। বাবা-মা ভাবলেন স্থানপরিবর্তন করলে হয়তো আমার এইসব খামখেয়ালী কমে যাবে। অতএব আমাকে কলকাতায় পাঠানো স্থির হল।

প্রবেশিকা পরীক্ষা দিলাম। যখন ফল বেরোলে দেখা গেল আমি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছি। বাবা-মা স্বভাবতই অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। এর পরই আমি কলকাতায় চলে এলাম।