বিষয়বস্তুতে চলুন

ভীষণ হত্যা/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

 মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত দাঁতন নামক স্থানটী যে কোথায় তাহা আমিপূর্ব্ব হইতেই জানিতাম। উহা একটি প্রসিদ্ধ স্থান ও ঐ স্থানে ইতিপূর্ব্বে আমি অনেকবার গমন করিয়াছিলাম। অবিনাশ বাবুর কথায় বিশ্বাস করিয়া আমি সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। বেঙ্গল নাগপুর রেলের কল্যাণে এখন ঐ স্থানে গমনাগমন করিতে আর কোনরূপ কষ্টই হয় না, ঐ স্থানে এখন একটি ষ্টেসনও হইয়াছে। কিন্তু আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি, তখন রেলওয়ে ছিল না; খাল বাহিয়া ষ্টিমার মেদিনীপুর গমন করিত ও সেই স্থান হইতে পদব্রজে অথবা শকটারোহণে দাঁতন গমন করিতে হইত। যে বহু পুরাতন রাস্তা পুরুষোত্তমে গমন করিয়াছে, ঐ রাস্তার উভয় পার্শ্বে দাঁতন গ্রাম, অর্থাৎ দাঁতন গ্রামকে দুই ভাগে বিভক্ত করিয়া ঐ প্রশস্ত রাস্তা সোজা দক্ষিণমুখে চলিয়া গিয়াছে। ঐ দাঁতন গ্রামের একটু অবস্থা এই স্থানে বর্ণন করা বোধ হয় আমার কর্ত্তব্য কর্ম্ম। এই স্থানে সামলেশ্বর নামক মহাদেবের পুরাতন মন্দির এখনও বর্ত্তমান ঐ মন্দিরের সম্মুখে কাল প্রস্তর-নির্ম্মিত একটি বৃহৎ বৃষমূর্ত্তি শুইয়া আছে, উহার সম্মুখের দুইখানি পদ কাটা। কথিত আছে, উহার এইরূপ অবস্থা সেই ভয়ানক কালাপাহাড় কর্ত্তৃক হইয়াছিল। মন্দিরের গাত্রে বর্ত্তমান রুচিবিরুদ্ধ দুই একটি অশ্লীল মূর্ত্তি এখনও দেখিতে পাওয়া যায়। ঐ সকল অশ্লীল মূর্ত্তি পবিত্র দেব মন্দিরের গায়ে যে কেন স্থাপিত হইয়াছিল, তাহার কারণ এখনও অবগত হইতে পারা যায় না। কথিত আছে যে, ভোজরাজ কর্ত্তৃক ঐ মন্দির প্রস্তুত ও তাঁহা কর্ত্তৃকই ঐ সামলেশ্বর মূর্তি স্থাপিত হয়। ঐ মন্দিরের চতুস্পার্শ্বে আম্রবৃক্ষ সকল ও ময়দান ধূ ধূ করিতেছে। পুরুষোত্তম যাত্রীগণের মধ্যে অনেকেই যে ঐ স্থানে গান করিয়া সামলেশ্বর মহাদেব দর্শন ও তাঁহার পূজাদি করিয়া গমন করিতেন, তাহার আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু ঐ মন্দিরের বর্ত্তমান অবস্থা নিতান্ত শোচনীয়, একজন পূজারির হস্তে ঐ মন্দিরের ভার এখন ন্যস্ত আছে; তাঁহার ইচ্ছামত একবার তিনি ঐ স্থানে আগমন করিয়া সামলেশ্বরের পূজা করিয়া মন্দিরের তালা বন্ধ করিয়া চলিয়া যান, তাহার পর যদি কেহ ঐ মূর্ত্তি দর্শন বা পূজা করিবার নিমিত্ত সেই স্থানে আগমন করেন, তাহা হইলে তাহার অদৃষ্টে ঐ মূর্ত্তি দর্শন প্রায়ই ঘটে না। পূজারি ব্রাহ্মণকে প্রায় খুঁজিয়া পাওয়া যায় না।

 এই স্থানের নাম যে কেন দাঁতন হইল, সে বিষয়ে অনেক কিম্বদন্তী আছে। কেহ কহেন, চৈতন্যদেব পুরুষোত্তম গমনকালে ঐ স্থানে দাঁতন করিয়া হস্তমুখাদি প্রক্ষালন করিয়াছিলেন বলিয়া, ঐ স্থান দাঁতন নাম প্রসিদ্ধ হইয়াছে। কেহ কহেন, ভগবান মনুষ্যরূপ ধারণ করিয়া যে সময় ঐ স্থান দিয়া পুরী গমন করিতেছিলেন, সেই সময় তিনিই ঐ স্থানে দাঁতন করিয়া হস্তমুখাদি প্রক্ষালন করেন বলিয়া, ঐ স্থানকে দাতন কহে। কিন্তু প্রায় ২৫০ বৎসর পূর্ব্বে যদুনন্দন যে দাঁতনের ইতিহাস লিখিয়া গিয়াছেন, তাহা পাঠ করিলে স্পষ্টই জানিতে পারা যাইবে যে, চৈতন্যদেবের বহুপূর্ব্ব হইতেই এই দাঁতন নাম বিদ্যমান আছে।

 এই স্থানে দুইটী বৃহৎ পুষ্করিণী আছে। উহার একটীর নাম বিদ্যাধর, ও অপরটীর নাম শশাঙ্ক। বিদ্যাধরের প্রায় ১২০০ ফিট লম্বা ১০০০ ফিট প্রস্থ জলকর। উহার জল অতি গভীর ও নির্ম্মল। উহার ঠিক মধ্যস্থলে জলের মধ্যে একটী দেবমন্দির প্রতিষ্ঠিত আছে। গ্রীষ্মকালে জল কমিয়া গেলে এখনও পর্য্যন্ত ঐ মন্দিরের চূড়া দৃষ্টিগোচর হইয়া থাকে। কথিত আছে, রাজা তেলিঙ্গা মুকুন্দদেবের মন্ত্রী বিদ্যাধর কর্ত্তৃক এই পুষ্করিণী খোদিত হইয়াছিল।

 শশাঙ্ক নামক পুষ্করিণী অতিশয় বৃহৎ, উহার জলকরের পরিমাণ দৈর্ঘে ৫০০০ ফিট, ও প্রস্তে ২৫০০ ফিট। রাজা শশাঙ্কদের জগন্নাথগমনকালীন এই পুষ্করিণী খোদিত করিয়াছিলেন। এরূপ কথিত আছে যে, উভয় পুষ্করিণী প্রস্তর নির্ম্মিত ৭॥ ফিট উচ্চ ও ৪॥ ফিট প্রস্থ একটী সুড়ঙ্গ দ্বারা সংযোজিত ও উভয় পুষ্করণীর জলের উচ্চতা একরূপই দেখিতে পাওয়া যায়।

 আমি দাঁতন গ্রামে অবস্থিতি করিতে লাগিলাম, এই স্থানে আমাকে অষ্টাহকাল বাস করিতে হইল। বলা বাহুল্য, আমি দাঁতনথানাতেই অবস্থিতি করিয়া সেই স্থানের ভারপ্রাপ্ত কর্ম্মচারীর সাহায্যে গোপনে অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম।

 পাঠকগণের মধ্যে সকলেই অবগত আছেন যে, প্রত্যেক থানার অধীনে যতগুলি গ্রাম আছে, সেই সকল গ্রামের প্রত্যেক চৌকিদারকে সপ্তাহে এক দিবস থানায় আসিয়া উপস্থিত হইতে হয়; ও তাহাদিগের এলাকাভুক্ত স্থানে যে সকল নূতন সংবাদাদি ঘটিয়াছে, তাহার সংবাদ প্রদান করিতে হয়।

 ঐ চৌকিদারগণের মধ্যস্থিত একজন পুরাতন চৌকিদারের নিকট হইতে অবগত হইতে পারিলাম যে, দাঁতনের প্রায় ৬৷৭ ক্রোশ দূরে একখানি গ্রাম আছে। ঐ গ্রামে কৈলাসচন্দ্র দত্ত নামক এক ব্যক্তি বাস করিত, ও কলিকাতার কোন স্থানে চাকরি করিত। ঐ গ্রামের বিমলাচরণ দত্ত নামক তাহার একজন কুটুম্বের কন্যাকে সে বাহির করিয়া লইয়া যায়। ঐ স্ত্রীলোকটীর যে কি নাম ছিল, তাহা সে বলিতে পারে না, কিন্তু সেই সময় হইতে সেই কন্যাটী বা কৈলাসচন্দ্র দত্ত আর দেশে প্রত্যাগমন করে নাই। কিন্তু লোকপরম্পরায় শুনিতে পাওয়া যায় যে, অনেক দিবস হইল, কৈলাসচন্দ্র দত্ত মরিয়া গিয়াছে, ও সেই স্ত্রীলোকটী কলিকাতার কোন স্থানে বেশ্যাবৃত্তি করিতেছে। চৌকিদারের নিকট হইতে এই সংবাদ অবগত হইয়া বুঝিতে পারিলাম, যে বিষয় অবলম্বন করিয়া আমি তথায় আগমন করিয়াছি, তাহাতে কৃতকার্য্য হইবার পন্থা প্রাপ্ত হইতে পারা যাইবে সন্দেহ নাই। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি সেই চৌকিদারকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ঐ স্ত্রীলোকটীর পিতা বিমলাচরণ দত্ত, এখন কোথায়?

 চৌকিদার। তিনি বৃদ্ধ হইয়াছেন, কোন স্থানে গমনাগমন করেন না, বাড়ীতেই থাকেন। গতকল্য আমি তাঁহাকে তাঁহার বাড়ীতেই দেখিয়াছি।

 আমি। এ স্ত্রীলোকটীর কোথায় বিবাহ হইয়াছিল তাহা বলিতে পার?

 চৌকি। তাহা আমি বলিতে পারি না, কিন্তু সে বিধবা হইয়া তাহার পিতার আলয়ে বাস করিতেছিল। সেই স্থান হইতেই সে বাহির হইয়া যায়।

 আমি। বিমলাচরণ দত্ত কি প্রকার লোক, তাহাকে ডাকিলে সে এখানে আসিবে কি?

 চৌকি। তিনি খুব ভদ্রলোক, সামান্য বিষয় আদিও আছে, দারোগা বাবু তাহাকে ডাকিয়াছেন বলিলে তিনি নিশ্চয়ই এখানে আসিবেন।

 আমার সহিত যখন চৌকিদারের কথাবার্ত্তা হইতেছিল, সেই সময় সেই থানার দারোগা বাবুও সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন। চৌকিদারের কথা শুনিয়া তিনি একখানি আদেশনামা লিখিয়া ঐ চৌকিদারের হস্তে প্রদান করিলেন ও আগামী কল্য সন্ধ্যার পূর্ব্বেই বিমলাচরণ দত্তকে সঙ্গে লইয়া থানায় প্রত্যাগমন করিতে আদেশ দিলেন। আরও বলিয়া দিলেন, যদি কোন কারণে বিমলাচরণ দত্ত কল্য আসিতে না পারেন, তাহা হইলে ঐ চৌকিদার আসিয়া সেই সংবাদ যেন প্রদান করিয়া যায়। তাহা হইলে উপস্থিতমত যে কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার প্রয়োজন বিবেচিত হইবে, তাহা তখনই করা যাইতে পারিবে।

 দারোগা বাবুর আদেশ অবগত হইয়া ও আদেশনামা সঙ্গে লইয়া চৌকিদার সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। চৌকিদার প্রস্থান করিবার পর এ বিষয় অনেক চিন্তা করিলাম, ও ভাবিলাম, যদি বিমলাচরণ দত্ত চৌকিদারের সমভিব্যহারে কল্য আগমন না করে, তাহা হইলে আমাদিগকেই সেই স্থানে গমন করিতে হইবে, ও সেই স্থানে গিয়া অনুসন্ধান করিলে যদিচ সকল বিষয় অবগত হইতে পারিব সত্য, কিন্তু এ সম্বন্ধে যদি তাহার পিতার কোনরূপ স্বার্থ থাকে, তাহা হইলে সে পূর্ব্ব হইতেই অনেকটা সতর্ক হইয়া যাইবে। আর যদি শ্বশুর-বাড়ীর সম্পর্কীয় কোন লোকের দ্বারা ঐ কার্য্য হইয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার পিতার দ্বারা অনেকটা সাহায্য পাইলেও পাইতে পারিব। মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিয়া সে দিবস অতিবাহিত করিলাম।