ভীষণ হত্যা/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
পর দিবস বেলা ৯টার সময় আমি পুনরায় সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া বাড়ীওয়ালী বেলার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম ও তাহাকে কহিলাম, তুমি সরলাকে বলিয়া দাও, সে যেন এক কি দেড় ঘণ্টার জন্য আমার সহিত গমন করে।
বেলা। কোথায় যাইবে?
আমি। আমি যেখানে যাইব, সে আমার সহিত গাড়ীতে যাইবে, পোষ্ট আফিসের সম্মুখে গাড়ীর ভিতর বসিয়া থাকিবে। অবিনাশ বাবু যে সময় ডাকঘরের মধ্যে প্রবেশ করিবেন, সেই সময় সে যেন আমাকে গাড়ীর ভিতর হইতেই দেখাইয়া দেয় যে, অবিনাশ বাবু কে?
বেলা। অবিনাশ বাবুকে কি আবশ্যক?
আমি। বহু পূর্ব্বে অবিনাশ বাবু চন্দ্রমুখীর ঘরে আগমন করিতেন, সুতরাং তিনি কৈলাসচন্দ্রকে জানিলেও জানিতে পারেন। অবিনাশকে চিনিতে পারিলে আমি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিব, ও তাহার নিকট হইতে আমার যাহা কিছু জানিবার আবশ্যক হয় আমি জানিয়া লইব।
আমার কথা শুনিয়া বেলা সরলাকে ডাকিল ও তাহাকে আমার সহিত গমন করিয়া অবিনাশ বাবুকে দেখাইয়া দিতে কহিল। প্রথমতঃ সে সেই সময় আমার সহিত যাইতে অসম্মত হইল, কিন্তু আমি ও বেলা তাহাকে বিশেষ করিয়া বুঝাইয়া বলায় সে আমার প্রস্তাবে সম্মত হইল ও আমার গাড়ীতে আসিয়া আরোহণ করিল।
আমি গাড়ী লইয়া লালদীঘির ধারে-যেস্থানে পোষ্ট আফিসের কর্ম্মচারীগণ ট্রামওয়ে গাড়ী হইতে অবতরণ করে, সেইস্থানে উপস্থিত হইলাম। গাড়োয়ানকে সেইস্থানে অপেক্ষা করিতে কহিয়া, আমি গাড়ী হইতে অবতরণ করিলাম ও গাড়ী ধরিয়া গাড়ীর নিকটেই দাঁড়াইয়া রহিলাম। সরলা গাড়ীর ভিতরেই বসিয়া রহিল। সে গাড়ীর দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া, খড়খড়ির ফাঁক দিয়া, রাস্তা ও ট্রামওয়ের দিকে দেখিতে লাগিল। এইরূপে সেইস্থানে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া ১০॥ টা বাজিয়া গেল; কিন্তু ইহার মধ্যে অবিনাশ বাবুকে দেখিতে পাওয়া গেল না। প্রায় ১১ টার সময় সরলা গাড়ীর দরজা একটু ফাঁক করিয়া আমাকে কহিল, “ঐ দেখুন, অবিনাশবাবু ট্রামগাড়ী হইতে অবতরণ করিয়া পোষ্ট আফিস অভিমুখে গমন করিতেছে। এই বলিয়া পেণ্টুলেন চাপকান-পরিহিত প্রায় ৪৫ বৎসর বয়স্ক এক ব্যক্তিকে দেখাইয়া দিয়া কহিল, উহারই কথা আমি বলিয়াছিলাম, উহার নামই অবিনাশবাবু!
সরলার কথা শুনিয়া আমি অবিনাশ বাবুর নিকট দ্রুত গমন করিয়া কহিলাম, “অবিনাশ বাবু!”
আমার কথা শুনিয়া অবিনাশ বাবু কহিলেন, “আমাকে ডাকিতেছন কি?”
“হাঁ মহাশয়, আমি আপনাকেই ডাকিতেছি, আমার সহিত আপনার আলাপ নাই, কিন্তু আপনার সহিত আমার একটু বিশেষ প্রয়োজন আছে। কোন্ সময়ে এবং কোথায় আপনার সহিত সাক্ষাৎ হইতে পারিবে, তাহা আমাকে বলিয়া দিন, সেই সময়ে সেইস্থানে গিয়া আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব।”
অবিনাশ। আপনার কি প্রয়োজন, বলিতে পারেন।
আমি। আপনাকে বলিবার অনেকগুলি কথা আছে; তাহাতে একটু সময়ের প্রয়োজন হইবে, ও আমি আপনাকে যাহা কিছু বলিতে চাহি, তাহা নির্জ্জনে হইলেই ভাল হয়। এখন আপনার আফিসের সময়, সুতরাং এ সময় আমি আপনাকে বিরক্ত করিতে চাহি না।
অবি। তাহা হইলে সন্ধ্যার পর আমার বাসায় গমন করিলে আপনার সহিত কথাবার্ত্তা হইতে পারিবে।
আমি। আপনার বাসা যে কোথায়, তাহা আমি জানি না, জানিলে এখানে না আসিয়া আপনার বাসায় গিয়াই আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতাম।
আমার কথা শুনিয়া অবিনাশ বাবু তাঁহার বাসার ঠিকানা আমাকে বলিয়া দিলেন। আমি তাঁহার ঠিকানা আমার পকেট বহিতে লিখিয়া লইয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। অবিনাশ বাবুও পোষ্ট আফিসের ভিতর প্রবেশ করিলেন।
যে গাড়ীতে সরলা বসিয়াছিল, আমি সেই গাড়ীতে উঠিলাম ও সরলাকে তাহার বাসায় পৌঁছাইয়া দিয়া আপন স্থানে প্রস্থান করিলাম।
সেই দিবস সন্ধ্যার পর অবিনাশ বাবুর বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। অবিনাশ বাবু আফিস হইতে আসিয়া বিশ্রাম করিতেছিলেন, এইরূপ সময়ে আমি সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইয়া অবিনাশ বাবুর নিকট সংবাদ পাঠাইয়া দেওয়ায় তিনি আমাকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন। আমি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলে তিনি আমাকে উপরে আসিতে কহিলেন, আমিও উপরে উঠিলাম দেখিলাম, এ বাড়ীতে অবিনাশ বাবু পরিবার লইয়া বাস করেন না, উহা একটী মেস্, অর্থাৎ তাঁহার সদৃশ কয়েকজন ভিন্ন ভিন্ন আফিসের কর্ম্মচারী একত্রে মিলিত হইয়া এইস্থানে বাস করিয়া থাকেন। সকলে মিলিয়া একটী ব্রাহ্মণ ও একটী ঝি রাখিয়াছেন, তাহারাই বাসার সকল কার্য্য নির্ব্বাহ করিয়া থাকে। এই মেস্ বা বাসায় যে কয়েকজন বাস করিয়া থাকেন, তাহাদিগের প্রত্যেকের সম্বলের মধ্যে এক একখানি কেওড়া কাঠের তক্তপোষ, তাহার উপর একটী করিয়া বিছানা, ও এক একটী টিনের বাক্স ও কাপড় রাখিবার নিমিত্ত দেওয়ালের গায়ে এক একটা করিয়া আন্লা আছে। এইরূপ আসবাব লইয়া ঘরের আয়তন অনুসারে কোন ঘরে একজন, কোন ঘরে দুইজন, কোন ঘরে তিনজন, ও কোন ঘরে বা চারিজন বাস করিয়া থাকেন।
আমি উপরে উঠিলে, অবিনাশ বাবু আমাকে সঙ্গে লইয়া যে ঘরে তিনি বাস করিয়া থাকেন, সেই ঘরে প্রবেশ করিলেন ও তাহার তক্তপোষের উপর আমাকে বসিতে কহিলেন। আমি সেই স্থানে উপবেশন করিলে, তিনি তক্তাপোষের একপ্রান্তে উপবেশন করিলেন, ও আমাকে কহিলেন, “মহাশয়! আপনি কে? কোথায় থাকেন? ও আমার নিকট আপনার প্রয়োজনই বা কি?”
আমি। আমি একজন পুলিসকর্ম্মচারী, একটি মোকদ্দমায় নিযুক্ত হইয়া আমি নানাস্থানে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি। সর্ব্বসাধারণের উপকারের নিমিত্ত এই মোকদ্দমার কিনারা হওয়া নিতান্ত আবশ্যক। কিন্তু এখন যদি আপনি আমাদিগকে একটু সাহায্য করেন, তাহা হইলে এই মোকদ্দমার অনায়াসেই কিনারা হইয়া যায়। এই নিমিত্তই আমি আপনার নিকট আগমন করিয়াছি।
অবি। এমন কি মোকদ্দমা আছে যে. আমি সাহায্য করিলে ঐ মোকদ্দমার কিনারা হইতে পারে। আমি ত এরূপ কিছুই মনে করিয়া উঠিতে পারিতেছি না।
আমি। আমি যাহার জন্য আপনার নিকট আসিয়াছি, তাহা আপনি সহজে মনে করিয়া উঠিতে পারিবেন না। ইহা বহু দিবসের ঘটনা, অথচ এরূপ কোন ঘটনা নাই যে, সহজে তাহা আপনার মনে হইতে পারে। সে যাহা হউক, আমি আপনাকে গোপনে গুটীকতক কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহি, আপনি অনুগ্রহ করিয়া যদি উহা আমাকে বলিয়া দেন, তাহা হইলে বিশেষ উপকার করা হয়। আমি আরও আপনাকে বলিতেছি, আপনি ঐ সম্বন্ধে আমাকে যাহা বলিবেন, তাহা আমি গোপন রাখিব, অপর আর কেহই তাহা অবগত হইতে পারিবে না, বা কোনরূপে আপনাকে সাক্ষ্যস্থানেও দণ্ডায়মান হইতে হইবে না।
অবিনাশ। বলুন, আমাকে কি বলিতে হইবে?
আমি। বহু দিবস অতীত হইল, চন্দ্রমুখী নাম্নী একটী স্ত্রীলোককে কৈলাসচন্দ্র দত্ত নামক এক ব্যক্তি বাহির করিয়া আনিয়াছিল, সেই সময় আপনি মধ্যে মধ্যে তাহার ঘরে গমন করিতেন। এখন আমার এই মাত্র জানিবার প্রয়োজন যে, চন্দ্র মুখী কোন্ দেশীয় স্ত্রীলোক বা তাহার আত্মীয় স্বজনের মধ্যে কেহ বর্তমান আছে কি না?
আমার কথা শুনিয়া অবিনাশ বাবু অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত চুপ করিয়া রহিলেন ও পরিশেষে কহিলেন, চন্দ্রমুখী কে— আমি তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না।
অবিনাশ বাবুর কথা শুনিয়া, চন্দ্রমুখী দেখিতে কিরূপ স্ত্রীলোক ছিল ও কোন্ স্থানে কাহার বাড়ীতে ও কিরূপ ঘরে বাস করিত, তাহা তাঁহাকে বিশেষ করিয়া বুঝাইয়া বলায়, তখন অবিনাশ বাবু কহিলেন, হাঁ, এখন আমার মনে হইতেছে। আমি তাহার ঘরে মধ্যে মধ্যে যাতায়াত করিতাম এ কথা সত্য, কিন্তু সে অনেক দিবসের কথা।
আমি। আমিতো সে কথা আপনাকে পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, উহা অনেক দিবসের ঘটনা। এখন স্মরণ করিয়া দেখুন দেখি, কৈলাসচন্দ্র দত্তকে আপনার মনে পড়ে কি না?
অবিনাশ। কৈলাসচন্দ্র দত্ত যে কে, তাহা আমার ঠিক মনে পড়িতেছে না, কিন্তু ইহা আমার বেশ মনে হইতেছে যে, আমি সেই স্ত্রীলোকটীর নিকট শুনিয়াছি যে, এক ব্যক্তি তাহাকে তাহার গৃহ হইতে বাহির করিয়া আনে, কিন্তু আমি যখন উহার ঘরে যাই; তখন-সে মরিয়া গিয়াছিল; আরও যেন মনে হইতেছে, যে তাহাকে বাহির করিয়া আনিয়াছিল, তাহার বাসস্থান ও ঐ স্ত্রীলোকটির বাসস্থান যেন একই গ্রামে।
আমি। কোন্ গ্রামে উহাদিগের বাসস্থান ছিল, তাহা চন্দ্রমুখী আপনাকে কোন দিন বলিয়াছিল কি?
অবিনাশ। তাহা মনে হয় না, যদি বলিয়া থাকে, তাহা হইলে আমি তাহা ভুলিয়া গিয়াছি।
আমি। গ্রাম মনে নাই, কিন্তু উহাদিগকে কোন্ দেশীয় লোক বলিয়া আপনার বিশ্বাস ছিল?
অবিনাশ। আমার বিশ্বায় কিছুই ছিল না, কিন্তু ঐ স্ত্রীলোকটী আমাকে বলিয়াছিল যে, উহার বাসস্থান মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত কোন গ্রামে, আমার যেন আরও মনে হয় যে, ঐ গ্রামটী দাঁতন নামক কোন প্রসিদ্ধ গ্রামের নিকটবর্ত্তী একটী ক্ষুদ্র পল্লী। বোধ হইতেছে, গ্রামের নামও যেন উল্লেখ করিয়াছিল, কিন্তু আমি মনে করিতে পারিতেছি না।
আমি। আপনি যতদূর মনে করিতে পারিয়াছেন, তাহাই যথেষ্ট। ইহা হইতে আমরা কার্য্য উদ্ধার করিয়া লইতে পারিব এরূপ ভরসা করি।
অবিনাশ। কেন মহাশয়, ঐ স্ত্রীলোকটীর সম্বন্ধে এত অনুসন্ধান? এসকল কথা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেই তো অনায়াসেই জানিতে পারেন?
আমি। স্ত্রীলোকটী জীবিত থাকিলে আর আপনার নিকট আমাকে আগমন করিতে হইত না। উহার সম্বন্ধে আমি কেন যে এত কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তাহা আর এক দিবস আগমন করিয়া আপনাকে বলিব। ইতি মধ্যে উহাদিগের সম্বন্ধে আরও যদি কোন কথা মনে করিতে পারেন, তাহা দেখিবেন।
এই বলিয়া আমি সেই দিবস তাহার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলাম।