বিষয়বস্তুতে চলুন

ভীষণ হত্যা/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

 বেলার কথা শুনিয়া আমি তাহার ঘরের দিকে দৃষ্টিপাত করিলাম, দেখিলাম, ঘরের দরজায় তালাবদ্ধ আছে। ঘরের ঐরূপ অবস্থা দেখিয়া, আমি বেলাকে কহিলাম, ঘরের চাবি সে কোথায় রাখিত?

 বেলা। বিশ্বাস করিয়া কখন তাহার ঘরের চাবি অপরকে দিতে দেখি নাই।

 আমি। উহার ঘরটা খুলিয়া একবার দেখিবার প্রয়োজন, অপর কোন চাবি দ্বারা কি ঐ তালা খোলা যাইবে না?

 “যাইলেও যাইতে পারে?” এই বলিয়া বেলা ঐ বাড়ীতে যাহার যে সকল চাবি ছিল, তাহা সংগ্রহ করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিল ও কহিল, দেখুন দেখি, ইহার কোনটীর দ্বারা যদি ঐ তালা খোলা যায়।

 চাবিগুলি আমি হস্তে লইয়া একটী একটী করিয়া দেখিতে আরম্ভ করিলাম যে, উহার কোন চাবি দ্বারা তাহার ঘরের তালা খোলা যায় কি না। দেখিতে দেখিতে একটী চাবি ঐ তালায় লাগিয়া গেল, উহার দ্বারা তাহার ঘরের দরজা খুলিয়া আমরা উহার মধ্যে প্রবেশ করিলাম।

 বেলা যাহা বলিয়াছিল, দেখিলাম, তাহা প্রকৃত, উহার ঘরের সংলগ্ন একটী ছোট বারান্দা আছে; ঐ স্থানে দণ্ডায়মান হইলে রাস্তা দিয়া যে সকল লোক যাত্তায়াত করে, তাহাদিগকে দেখিতে পাওয়া যায় ও ইচ্ছা করিলে তাহাদিগের সহিত কথাও কহা যাইতে পারে।

 উহার ঘরের ভিতর যে সকল আলমারি বাক্স ছিল, তাহার কোনটী বা অপর চাবি দিয়া খুলিয়া, কোনটী বা ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া দেখিলাম, উহার যে সকল গহনা ছিল, ও যে সকল গহনা সে সদা সর্ব্বদা পরিধান করিত, তাহার একখানিও অপহৃত হয় নাই। পূর্ব্বকথিত আলমারির একটা দেরাজের ভিতর তাহার সমস্ত রহিয়াছে। ঐ সকল অলঙ্কার দেখিয়া বেলা কহিল, তাহার যে সমস্ত গহনা ছিল, তাহার সমস্তই আছে, যে সকল গহনা সে তাহার অঙ্গ হইতে কখন খুলিত না, তাহাও দেখিতেছ, সে খুলিয়া রাখিয়া গিয়াছে। ইহা বড়ই আশ্চর্য্য বিষয়!

 ইতিপূর্ব্বে আমরা মনে মনে একরূপ সিদ্ধান্তই করিয়াছিলাম যে, চন্দ্রমুখির অলঙ্কারগুলিই তাহার কাল হইয়াছে। এখন কিন্তু বেলার কথা শুনিয়া আমাদের সে অনুমান দূরে পলায়ন করিল। এখন বুঝিতে পারিলাম, কোন চোর বা অলঙ্কার-লোলুপ কোন ব্যক্তি দ্বারা এ কার্য্য সম্পন্ন হয় নাই। এ হত্যার অভিষদ্ধি  বেলার নিকট হইতে জানিতে পারিয়াছিলাম যে, সরলার সহিত চন্দ্রমুখীর প্রণয় ছিল, সেই তাহার নিকট সদা সর্ব্বদা যাতায়াত করিত। তাহার নিকট হইতে যদি কোন কথা অবগত হইতে পারি, এই ভাবিয়া সরলাকে ডাকাইলাম। সরলা আমার নিকট আগমন করিলে আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “সরলা, আমি তোমাকে যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিব, তুমি তাহার প্রকৃত উত্তর প্রদান করিবে, কি তোমাদিগের ন্যায় স্ত্রীলোকগণ যেমন প্রথম হইতেই মিথ্যা কথা কহিয়া থাকে, সেইরূপ করিবে।”

 সরলা। মিথ্যা কথা কহিবার তো আমি কোন কারণ দেখি না। চন্দ্রমুখী মরিয়া গিয়াছে, আপনার নিকট শুনিতে পাইতেছি যে, কেহ তাহাকে হত্যা করিয়াছে, এখন যাহাতে হত্যাকারী ধৃত হয়, সেই বিষয়ে আমাদিগের চেষ্টা করা আবশ্যক। আপনি আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিবেন, আমি তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিব। আমি কোন কথা গোপন করিব না। আমাকে কি বলিতে হইবে বলুন? আমি। তুমি অবগত আছ যে, চন্দ্রমুখী আজ কয়দিবস হইতে এ স্থান হইতে চলিয়া গিয়াছে?

 সরলা। সে যে দিবস চলিয়া গিয়াছে তাহা আমি জানি, সেই দিবস হইতে আর তাহাকে দেখি নাই, সে এ বাড়ীতে আর ফিরিয়া আসে নাই।

 আমি।সে কোন্ সময় চলিয়া গিয়াছে?

 সরলা। দিবা ৩।৪ টার সময়।

 আমি। দিবা না রাত্র?  সরলা। রাত্রিতে নহে, দিবাভাগে।

 আমি। কাহার সহিত ও কিরূপ অবস্থায় সে বাহির হইয়া যায়?

 সরলা। কয়েক দিবস হইতে দুইটী লোক তাহার নিকট আগমন করিত, সে তাহাদিগের সহিতই বাহির হইয়া যায়।

 আমি। এ দুইটী লোক যে কে তাহা তুমি বলিতে পার?

 সরলা। না, তাহা আমি বলিতে পারি না।

 আমি। কত দিবস হইতে চন্দ্রমুখীর ঘরে উহাদিগের যাতায়াত ছিল?

 সরলা। ঘরে যাতায়াত শব্দের আমরা যেরূপ অর্থ করিয়া থাকি, তাহারা কিন্তু সেরূপ ভাবে আসিত না। উহাদিগের সহিত চালরা বাইবার ৩।৪ দিবস পূর্ব্ব হইতে উহারা চন্দ্রমুখীর ঘরে আসিত। তাহাদিগকে দেখিয়া ও তাহাদিগের কথা শুনিয়া অনুমান হইত যে, তাহারা চন্দ্রমুখীর কোনরূপ আত্মীয় বা দেশ ব্যক্তি হইবে। রাত্রিকালে উহারা প্রায়ই আসিত না, যখন আসিত, তখনই তাহারা দিবাভাগে আসিত ও দুই এক ঘণ্টার অধিক প্রায়ই তাহারা থাকিত না।

 আমি। উহাদিগের সন্মুখে চন্দ্রমুখী কিরূপ ভাবে চলিত?

 সরলা। উহাদিগকে দেখিয়া চন্দ্রমুখী বিশেষরূপ লজ্জা করিয়া চলিত।

 আমি। যখন চন্দ্রমুখী তাহাদিগের সহিত বাহির হইয়া বায়, তাহা তুমি দেখিয়াছ কি?

 সরলা। যাইবার সময় যদিও আমি তাহার ঘরে ছিলাম না, তথাপি আমি দেখিয়াছি।  আমি। সেই সময় চন্দ্রমুখীর অঙ্গে কোনরূপ অলঙ্কারআদি ছিল কি?

 সরলা। সে কোন অলঙ্কার পরিধান করিয়া যায় নাই। কেবলমাত্র একখানি বস্ত্র তাহার পরিধানে ছিল।

 আমি। সদাসর্ব্বদা তাহার অঙ্গে যে সকল অলঙ্কার থাকিত, তাহা পর্য্যন্ত খুলিয়া রাখিয়া উহাদিগের সহিত গমন করিবার কারণ কি বলিতে পার?

 সরলা। কারণ যে কি, তাহা আমি বলিতে পারি না, কিন্তু তাহারা যে সময় উহার নিকট আগমন করিত, তাহার পূর্ব্ব হইতেই সে তাহার অঙ্গের গহনা সকল খুলিয়া রাখিত।

 আমি। এরূপ করিবার তাৎপর্য্য কি?

 সরলা। তাহা আমি বলিতে পারি না, আমি একথা এক দিবস তাহাকে জিজ্ঞাসাও করিয়াছিলাম।

 আমি। তাহাতে সে কি উত্তর প্রদান করে?

 সরলা। সে কহে, উহারা আমার গুরুজন, আর আমি বিধবা, সুতরাং উহাদিগের সন্মুখে গহনা পরিয়া বাহির হইতে যেন কেমন কেমন বোধ হয় বলিয়াই উহাদিগের সম্মুখে গহনা পরিয়া আমি বাহির হই না।

 আমি। উহারা গুরুজন! কিরূপ গুরুজন, তাহা তুমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে?

 সরলা। এক দিবস তাহাও আমি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম।

 আমি। তাহার উত্তর সে কি প্রদান করে?

 “সে সকল কথা আর তোমার শুনিবার আবশ্যক নাই”, এই বলিয়া সরলা আমার কথার উত্তর প্রদান করে।  আমি। উহারা যখন চন্দ্রমুখীর ঘরে আসিত, সেই সময় তুমিও সেই স্থানে থাকিতে?

 সরলা। না, আমাকে প্রায়ই সেই সময়ে সেই স্থানে থাকিতে দিত না। কোন না কোনরূপ ছল করিয়া আমি সময় সময় সেই স্থানে গমন করিলে, সেও কোন না কোনরূপ হল অবলম্বন করিয়া আমাকে সেই স্থান হইতে বিদায় করিয়া দিত। উহা দিগের মধ্যে যে সকল কথাবার্ত্তা হইত, তাহা আমি প্রায়ই শুনিতে পাইতাম না।

 আমি। তুমি সময় সময় উহাদিগের মধ্যে যে সকল কথাবার্ত্তা হইতে শুনিয়াছ, তাহা যতদূর মনে করিতে পার, আমাকে বল দেখি?

 সরলা। বিশেষ কোন কথা আমার মনে হয় না, তবে এক দিবস উহাদিগের এক ব্যক্তি যেন কহিয়াছিল, “ইহাতে তোমার বিশেষরূপ লাভ হইবার সম্ভাবনা,” কিন্তু কি লাভ, তাহা আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই।

 আমি। আর কোন কথা মনে হয়?

 সরলা। আরও যেন একদিন বলিতে শুনিয়াছিলাম, ‘ছেলেটী বড় বুদ্ধিমান, ও বিশেষরূপ বিবেচক হইয়াছে, ও এখন এখানেই আছে, তাহার সহিত একবার কোনরূপে দেখা করিতে পারিলে তাহার কোনরূপ কষ্ট থাকিবে না, সে নিশ্চয়ই তোমার মাসহারার বন্দোবস্ত করিয়া দিবেন।’

 আমি। ইহা ব্যতীত আর কোন কথা তোমার মনে হয়?

 সরলা। আর কোন কথা আমি শুনিয়াছি বলিয়া মনে করিতে পারিতেছি না।  আমি। সরলা, তুমি আমাদিগের বিশেষরূপ উপকার করিলে, যে দুইটী কথা তুমি বলিলে, ইহাতেই বোধ হয় আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে। আর আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইলে তুমিও যে গবর্ণমেণ্টের নিকট হইতে কোনরূপ উপকৃত হইবে না, তাহাও নহে। সে যাহা হউক, আর তুমি যদি কোন কথা মনে করিতে পার, তাহাও আমাদিগের নিকট প্রকাশ করিতে সঙ্কোচিত হইও না।

 সরলা। আর যদি কোন কথা আমার মনে হয়, তাহা তৎক্ষণাৎ আপনাকে বলিব, সে বিষয়ে আপনি কোনরূপ চিন্তা করিবেন না।

 আমি। এখন আমার আর একটী বিষয় জানিবার বিশেষ আবশ্যক, তাহাতে যদি আমাকে কোনরূপে সাহায্য করিতে পার, তাহা হইলেই জানিব যে আমাদিগের সকল কার্য্য সফল হইয়াছে।

 সরলা। সে কার্য্যটী কি?

 আমি। চন্দ্রমুখী কোন্ দেশীয় লোক, তাহার পিতা মাতার বা স্বামীর নাম কি, ও কোন্ স্থানে তাহাদিগের বাসস্থান, এই কয়েকটী বিষয় অবগত হইতে পারিলেই বুঝিতে পারিব যে, আমাদিগের এত পরিশ্রমের ফল ফলিয়াছে।

 সরলা। আমি ত তাহা বলিতে পারিব না, কিন্তু শুনিয়াছি, তাহার বাসস্থান মেদেনীপুর জেলার অন্তর্গত কোন একটী গ্রামে। কিন্তু কোন্ গ্রামে তাহা আমি বলিতে পারি না।

 আমি। উহার দেশস্থ লোকের মধ্যে কখন কাহাকেও এখানে আসিতে দেখিয়াছ?  সরলা। না।

 আমি। তুমি এই বাড়ীতে কত দিবস আছ?

 সরলা। বহু দিবস।

 আমি। চন্দ্রমুখী যখন প্রথম এই বাড়ীতে আগমন করে, তখন তুমি কোথায় বাস করিতে?

 সরলা। সেই সময়েও আমি এই বাড়ীতে থাকিতাম।

 আমি। যে ব্যক্তি চন্দ্রমুখীকে বাহির করিয়া আনিয়াছিল, তাহা হইলে তাহাকেও তুমি দেখিয়াছ?

 সরলা। সে প্রায় বৎসরাবধি এই বাড়ীতে যাতায়াত করিয়াছিল, তাহার পর সে মরিয়া যায়।

 আমি। তাহার নাম তোমার মনে হয় কি?

 সরলা। আমার বোধ হইতেছে, তাহার নাম ছিল কৈলাসচন্দ্র দত্ত।

 আমি। কলিকাতায় সে কোথায় থাকিত তাহা বলিতে পার?

 সরলা। তাহা আমি জানি না।

 আমি। সে কি কাজ করিত শুনিয়াছিলে?

 সরলা। কোন আফিসে কাজ করিত, কিন্তু কোন আফিস বা কি কার্য্য করিত তাহা আমি শুনি নাই।

 আমি। যে সময় কৈলাসচন্দ্র দত্ত চন্দ্রমুখীর ঘরে আসিত, সেই সময় অপর কোন ব্যক্তি তাহার সহিত আসিত কি?

 সরলা। অনেক দিবসের কথা, তাহা এখন ঠিক মনে হয় না। অবিনাশ বাবু নামক এক ব্যক্তি বহুদিবস পূর্ব্বে কখন কখন উহার ঘরে আসিত। তিনি বড় ডাকঘরে চাকরি করেন, কিন্তু কোথায় যে থাকেন, তাহা আমি বলিতে পারি না। কৈলাসচন্দ্র দত্তের সঙ্গে তিনি আসিতেন, কি অপর কাহার সঙ্গে বা একাকী আগমন করিতেন, তাহা এখন আমার ঠিক মনে হয় না; তবে তিনি যে বহু পূর্ব্বে উহার সঙ্গে আসিতেন তাহা কিন্তু আমার বেশ মনে হয়। অবিনাশ বাবু এখনও বর্ত্তমান আছেন, বোধ হয় ১৫ দিবস হইবে আমি তাঁহাকে দেখিয়াছি।

 আমি। ১৫ দিবস পূর্ব্বে তুমি অবিনাশ বাবুকে কোথায় দেখিয়াছ?

 সরলা। আমি গঙ্গা স্নান করিবার নিমিত্ত ট্রামগাড়ীতে গমন করিতেছিলাম। অবিনাশ বাবুও সেই ট্রামে ছিলেন, তিনি ট্রাম হইতে নামিয়া বড় ডাকঘরের মধ্যে প্রবেশ করেন, ইহা আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি।

 আমি। যখন তিনি ডাকঘরের মধ্যে প্রবেশ করেন, তখন তাঁহার কিরূপ পোষাক ছিল ও বেলা কত?

 সরলা। বেলা তখন অনুমান ১০॥০ টা, তাঁহার পরিধান পেণ্টুলন ও চাপকান ছিল।

 আমি। তুমি বলিতে পার, অবিনাশচন্দ্রের পদবী কি, বা তিনি কোন্‌ জাতি?

 সরলা। তাহা আমি বলিতে পারি না, কিন্তু তাঁহাকে উত্তম রূপে চিনি, দেখিলেই চিনিতে পারিব।

 আমি। যে দুই ব্যক্তির সহিত চন্দ্রমুখী সকালে এই বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছে, তাহাদিগকে দেখিলে ত চিনিতে পারিবে?

 সরলা। খুব পারিব।

 সরলার নিকট এই সকল বিষয় অবগত হইয়া সেই দিবসের নিমিত্ত সেই স্থান হইতে বিদায় গ্রহণ করিলাম, কিন্তু যাইবার সময় বলিয়া গেলাম, কল্য প্রাতঃ ৮৷৯ টার সময় আমি পুনরায় তোমার নিকট আগমন করিব।