বিষয়বস্তুতে চলুন

ভীষণ হত্যা/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

 পরদিবস অপরাহ্ণ ৪টার সময় ঐ চৌকিদারের সহিত বিমলাচরণ দত্ত আসিয়া থানায় উপস্থিত হইল। তাঁহাকে লইয়া আমি ও দারোগা বাবু নির্জ্জনে কথাবার্ত্তা কহিতে আরম্ভ করিলাম।

 আমি। মহাশয়, আমরা আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করিবার অভিপ্রায়ে এই স্থানে ডাকাইয়া আনিয়াছি, যে সকল কথা আমরা আপনাকে জিজ্ঞাসা করিব, তাহা আপনার পক্ষে বিশেষ লজ্জাস্কর কথা হইলেও আপনি কোন কথা গোপন না করিয়া উহার প্রকৃত উত্তর প্রদান করেন, ইহাই আমাদিগের অভিলাষ; গোপনীয় কথা গোপনে জিজ্ঞাসা করিব বলিয়। আমরা আপনার বাড়ীতে না গিয়া আপনাকে এই স্থানে ডাকাইয়া আনিয়াছি।

 বিমলা। কি জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন করুন, আমি কোন কথা গোপন করিব না। যাহা জিজ্ঞাসা করিবেন, তাহার যথাযথ সত্য উত্তর প্রদান করিব।

 আমি। আপনাদিগের গ্রামে কৈলাসচন্দ্র দত্ত নামে এক ব্যক্তি বাস করিত?

 বিমলা। হাঁ, করিত, কিন্তু সে মরিয়া গিয়াছে, তাহার পিতা ও ভ্রাতারা এখনও আমাদিগের গ্রামে বাস করিতেছে।

 আমি। উহারা আপনাদিগের জাতীয়।

 বিমলা। হাঁ, আমাদিগের স্বজাতীয়।

 আমি। ঐ কৈলাসচন্দ্র দত্ত আপনার একটা বিশেষ সর্ব্বনাশ করে না?

 বিমলা। হাঁ, তাহার উপর আমাদিগের সন্দেহ হইয়াছিল।

 আমি। সন্দেহ হইয়াছিল যে, সেই আপনার কন্যাকে বাহির করিয়া লইয়া যায়?

 বিমলা। হাঁ।

 আমি। আপনার সেই কন্যার নাম কি?

 বিমলা। তাহাকে আমরা গিরিবালা বলিয়াই ডাকিতাম।

 আমি। কৈলাসচন্দ্র দত্ত তো মরিয়া গিয়াছে, কিন্তু গিরিবালা এখন কোথায় আছে তাহা বলিতে পারেন?

 বিমলা। শুনিয়াছি, সে কলিকাতায় আছে, কিন্তু কোন্ স্থানে যে আছে, তাহা আমি অবগত নহি।

 আমি। গিরিবালা যখন আপনার বাড়ী হইতে চলিয়া যায়, সেই সময় সে সধবা কি বিধবা ছিল?

 বিমলা। তাহার প্রায় দুই বৎসর পূর্ব্বে সে বিধবা হয়।

 আমি। তাহার কোন সন্তান-সন্ততি হইয়াছিল?

 বিমলা। হাঁ. একটী পুত্রসন্তান হয়।

 আমি। সে পুত্রটী এখন কোথায়?

 বিমলা। সে তাহার পিতার বাটীতেই আছে, উহার ঠাকুরদাদা কখন তাহাকে এখানে পাঠায় না।

 আমি। তাহার বয়ঃক্রম এখন কত হইবে?

 বিমলা। বোধ হয়, ১৯১৭ বৎসর হইবে। মহাশয়! আপনি গিরিবালা সম্বন্ধে এতদুর অনুসন্ধান করিতেছেন কেন? আপনি কি বলিতে পারেন, গিরিবালা এখন কোথায় আছে?

 আমি। পারি।

 বিমলা। যদি এখন তাহার ঠিকানা আমাকে বলিয়া দেন, তাহা হইলে আমার বিশেষ উপকার করা হয়। আমি তাহার অনেক অনুসন্ধান করিতেছি, কিন্তু কোনরূপেই তাহার সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

 আমি। বহুবৎসর হইল, সে আপনার বাটী হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছে; এত দিবস তাহার কোনরূপ সন্ধান করেন নাই; কিন্তু এখন তাহার সন্ধান করিবার প্রয়োজন কি? আমি জানি, সে এখন কোথায় আছে; যদি আপনি আমাকে সমস্ত কথা কহেন, তাহা হইলে আমি গিরিবালার সন্ধান আপনাকে বলিয়া দিতে প্রস্তুত আছি।

 পাঠকগণকে বোধ হয় বলিয়া দিতে হইবে না যে, যে চন্দ্রমুখী ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে, তাহারই নাম গিরিবালা। সে ঘর হইতে বাহির হইয়া কলিকাতায় আসিবার পর আপনার নাম পরিবর্ত্তন করিয়া, নূতন নাম চন্দ্রমুখী ধারণ করিয়াছিল। উহার নাম গিরিবালা, ও কলিকাতার নাম চন্দ্রমুখী। কলিকাতার মধ্যে এখন যে সকল বেশ্যা দেখিতে পাওয়া যায়, তাহার মধ্যে যাহারা নিজে বাহির হইয়া আসিয়াছে, তাহাদের প্রায় সকলের নাম পরিবর্ত্তন হইয়া গিয়াছে।

 আমার কথা শুনিয়া বিমলাচরণ দত্ত কহিলেন, মহাশয়, আমি যে কেন গিরিবালাকে অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছি, তাহা আপনার নিকট সমস্তই প্রকাশ করিতেছি, তাহা হইলে আপনি সমস্তই অবগত হইতে পারিবেন।

 প্রায় ছয় মাস হইল, আমার স্ত্রী ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে; তাহার মৃত্যুর প্রায় ছয় মাস পূর্ব্বে সে একটী মূল্যবান জমীদারী প্রাপ্ত হয়। তাহার পিতার বংশের কোন ব্যক্তির ঐ জমীদারী ছিল। তাঁহার মৃত্যু হওয়ায় আমার স্ত্রী ব্যতীত তাঁহার আর কোন উত্তরাধিকারী ছিল না, সুতরাং স্ত্রীই সেই অগাধ বিষয়ের উত্তরাধিকারিণী হয়। যিনি ঐ বিষয়ের স্বত্তাধিকারী ছিলেন, হঠাৎ তাঁহার মৃত্যু হওয়ায়, তিনি ঐ বিষয়ের জন্য উইল বা অপর কোনরূপ বন্দোবস্ত করিয়া যাইতে পারেন নাই। সুতরাং আমার স্ত্রী বিষয়ের স্বত্তাধিকারিণী হইয়া আদালত হইতে সার্টিফিকেট প্রভৃতি গ্রহণ করিয়া উহা দখল করিয়া লয়; কিন্তু ঐ জমিদারীর প্রজাগণের সহিত বন্দোবস্ত করিয়া খাজনাপত্র আদার হইবার পূর্ব্বেই কোথা হইতে কাল আসিয়া আমার স্ত্রীকে গ্রাস করে।

 আমার স্ত্রী ঐ বিষয়ের উত্তরাধিকারিণী হইয়া ইহজীবন পরিত্যাগ করে, সুতরাং আইনানুসারে ঐ বিষয়ের উত্তরাধিকারিণী তাহার কথা। কিন্তু গিরিবালা ব্যতীত আমার আর কন্যা নাই, সুতরাং গিরিবালাই এখন সেই অগাধ বিষয়ের অধিকারিণী। এই নিমিত্তই আমি গিরিবালার অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছি। সে ঘরের বাহির হইয়া গিয়াছে সত্য, কিন্তু এখন তাহার সন্ধান পাইলে সমাজের দিকে দৃষ্টিপাত না করিয়াও আমি তাহাকে ঘরে লইয়া আসিব।

 বিমলাচরণ দত্তের কথা শুনিয়া আমি এখন বেশ বুঝিতে পরিলাম যে, কি নিমিত্ত বিমলাচরণ দত্ত তাহার কন্যার বর্ত্তমান ঠিকানা জানিতে এত ব্যস্ত হইয়াছেন। আরও বুঝিতে পারিলাম, চন্দ্রমুখী ওরফে গিরিবালাকে হত্যা করিবার কারণ কি, ও গিরিবালার অবর্ত্তমানে তাহার অগাধ সম্পত্তির অধিকারী কে হইবে?

 গিরিবালা যখন কুলের বাহির হইয়া যায়, সেই সময় তাহার একটী পুত্র ছিল, ঐ পুত্রটি তাহার পিতামহের দ্বারা প্রতিপালিত হইয়া এখন ১৬।১৭ বৎসরের হইয়াছে। কিন্তু একদিনের নিমিত্ত ও সে তাহার মাতামহের নিকট আগমন করে নাই। গিরিবালার অবর্তমানে ঐ বিষয়ের উত্তরাধিকারী তাহার সেই একমাত্র পুত্রই হইবে।