ভূতের বিচার/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

 ডিটেকটিভ কর্ম্মচারীদ্বয়ের সহিত দারোগা বাবু সময়-মত সেই গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলেন। ঐ স্ত্রীলোকটীর বাড়ীতে গিয়া দেখিলেন, তাহার ঘর হইতে প্রকৃতই সিন্দুক, বাক্স ভাঙ্গিয়া দ্রব্যাদি কে চুরি করিয়াছে। আরও জানিতে পারিলেন, যে সকল গহনা ঐ স্ত্রীলোকটীর অঙ্গ হইতে অপহৃত হইয়াছে বলিয়া সে এজাহার দিয়াছে, সেই সকল অলঙ্কার সদা সর্ব্বদাই সে পরিধান করিত, এখন তাহার গাত্রে সেই সকল অলঙ্কার নাই।

 এই সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া ভূতের প্রকৃত ব্যাপারটা কি তাহা জানিবার নিমিত্ত তিনি সেই গ্রামের ও নিকটবর্ত্তী স্থানের অনেক লোককে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। তাঁহার কথার উত্তরে অনেকেই ভূতের অত্যাচারের কথা বলিল। কেহ বলিল, সে একদিন বাঁশ-বাগানের ভিতর একঝাড় বাঁশের গোড়ায় ভূতকে বসিয়া থাকিতে দেখিয়াছে। কেহ বলিল, একদিন সন্ধ্যার পর রাস্তা দিয়া গমন করিবার কালীন দেখিতে পায় যে, ভূতটী একটী গাছের উপর পা ঝুলাইয়া বসিয়া আছে। তাহাকে দেখিয়া যেমন ঐ ভূত সেই গাছ হইতে লাফ দিয়া তাহার ঘাড়ে পড়িবে, অমনি সে দৌড়াইয়া সেই স্থান হইতে পলায়ন করে। এইরূপ অনেকে ঐ ভূত সম্বন্ধে অনেক কথা কহিল। কেহ বা কহিল, সে ভাল করিয়া দেখিয়াছে যে, উহার আকৃতি হানিফ খাঁর মত, কিন্তু লম্বা লম্বা হস্ত, লম্বা লম্বা অঙ্গুলি, লম্বা লম্বা পা বাড়াইয়া চলে।

 উহাদিগের নিকট এই সকল বিষয় অবগত হইয়া, ঐ মকর্দ্দমার অনুসন্ধান উপলক্ষে দারোগা বাবু সেই ডিটেকটিভ কর্ম্মচারীদ্বয়ের সহিত সেই স্থানে প্রায় দশ পনের দিবস অবস্থিতি করিলেন। কিন্তু ঐ সময়ের মধ্যে ভূতের আর কোনরূপ অত্যাচারের কথা তাঁহার কর্ণগোচর হইল না, বা নিকটবর্ত্তী গ্রাম সমূহের কোন লোক ঐ ভূতকে দেখিতে পাইল না, বা তাহার কথাও শুনিতে পাইল না।

 দারোগা বাবু ঐ মকর্দ্দমার অনুসন্ধান করিলেন সত্য, কিন্তু তাহার কোনরূপ কিনারা করিতে না পারিয়া, সেইস্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক আপন থানায় গমন করিলেন। বলা বাহুল্য যে, ডিটেকটিভ কর্ম্মচারীদ্বয়ও তাঁহার সহিত সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।

 তাঁহাদিগের সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিবার পর পুনরায় সেই গ্রামে সেই ভূতের উৎপাত আরম্ভ হইল। অনেকেই আবার সেই ভূতকে মাঝে মাঝে দেখিতে পাইল; অনেকেই আবার তাহার অত্যাচারের কথা শুনিতে পাইল; অনেক স্থলেই পুনরায় সেই ভূতের দল ডাকাতি করিতে আরম্ভ করিল। কিন্তু ঐ ভূতের দলের একটী ভূতও ধরা পড়িল না, বা জানিতে পারা গেল না যে, উহারা কাহারা? এইরূপে ঐ গ্রামে পুনরায় অশান্তির আবির্ভাব হইল।

 এই সকল বিষয়ে ক্রমে জেলার প্রধান প্রধান কর্ত্তৃপক্ষীয়গণের দৃষ্টি আকর্ষিত হইল। যাহাতে ঐ সকল অত্যাচারের প্রতীকার হয়, সকলেই তাহার বিশেষরূপ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। গ্রামের প্রধান প্রধান লোকদিগকে ডাকাইয়া, যাহাতে তাঁহারা পুলিসকে উপযুক্তরূপে সাহায্য প্রদান করেন, তাহার নিমিত্ত অনুরোধ করিলেন, ও পুলিস কর্ম্মচারীদিগের মধ্য হইতে বাছিয়া বাছিয়া কয়েকজন কর্ম্মচারীকে ঐ কার্য্যে নিযুক্ত করিলেন। তাঁহাদিগের কার্য্যই হইল—ঐ ভূতের দলের অনুসন্ধান করা ও ইহার নিগূঢ় তত্ত্ব আবিষ্কার করা।

 কর্ম্মচারীগণ আপনাপন কার্য্যে নিযুক্ত হইয়া ছদ্মবেশে গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। নানা স্থানে নানা লোকের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, যাহাতে কোনরূপে ভূতের সন্ধান করিতে পারেন, তাহার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। যে প্রকারের লোক নিযুক্ত করিলে তাহাদিগের দ্বারা এই সকল বিষয়ের সন্ধান হইতে পারে, প্রচুর পরিমাণে সরকারী অর্থ ব্যয় করিয়া সেই সকল লোককে নিযুক্ত করিতে লাগিলেন। এইরূপে কিছুদিন অতিবাহিত হইয়া গেল, কিন্তু কেহই কোনরূপে কোন বিষয়ের বিশেষরূপ সন্ধান আনিয়া দিতে পারিল না।

 এই সকল কর্ম্মচারীগণের মধ্যে একজন কর্ম্মচারী তাঁহার কার্য্যে কৃতকার্য্য হইতে না পারিয়া মনে মনে বিশেষরূপ লজ্জিত হইলেন, কিরূপ উপায়ে তাঁহার অভিলষিত কার্য্য সমাপন করিতে পারেন, একাগ্রমনে কেবল তাহাই চিন্তা করিতে লাগিলেন। কিন্তু কোনরূপ উপায় স্থির করিতে না পারিয়া, একবার যে ব্যক্তি হানিফ খাঁকে ধরাইয়া দিয়াছিল, তাহার সাহায্য গ্রহণ করিতে মনস্থ করিলেন। তাহার ঠিকানা তিনি জানিতেন না, পুরাতন মকর্দ্দমার কাগজ-পত্র হইতে তিনি তাহার ঠিকানা বাহির করিলেন। তিনি যে ঐ ব্যক্তির সাহায্য গ্রহণ করিতে প্রস্তুত হইয়াছেন, এ কথা অপর কোন কর্ম্মচারীকে বা থানার দারোগাবাবুকে পর্য্যন্ত বলিলেন না। তিনি নিজেই নিজের অভিলষিত কার্য্যে প্রবৃত্ত হইলেন।

 বহু চেষ্টায় আবেদ আলির সন্ধান পাইলেন। যে ব্যক্তি হানিফ খাঁ সম্বন্ধে সংবাদ দিয়া একবার তাহাকে ধরাইয়া দিয়াছিল, তাহারই নাম আবেদ আলি। আবেদ আলি পূর্ব্বে হানিফ খাঁর ডাকাইত দলের একজন ডাকাত ছিল।

 হানিফ খাঁ মরিয়া গিয়াছে, মরিয়া সে ভূতই হউক, বা অপর কিছু হউক, তাহার সম্বন্ধে এখনকার সংবাদ যে আবেদের নিকট পাওয়া যাইবে না, তাহা সেই কর্ম্মচারী বেশ জানিতেন। কারণ হানিফ খাঁকে ধরাইয়া দিবার পর, আবেদ আলি আর ঐ দলের মধ্যে প্রবেশ করিতে সাহস করে নাই। কিন্তু কর্ম্মচারী ইহা জানিতেন যে, আবেদ আলি যে সময়ে ডাকাইত-দলভুক্ত ছিল, সেই সময়ে সেই দলে অপর যে সকল ডাকাইত ছিল, তাহাদিগকে নিশ্চয়ই সে চিনিত, ও যে যে স্থানে তাহারা বাস করিত, তাহাও সে জানিত। সুতরাং তাহার নিকট হইতে যদি ঐ সকল লোকের নাম ও ধাম অবগত হইতে পারা যায়, এবং যদি তাহাদিগকে কোন না কোন উপায়ে ধরিতে পারা যায়, তাহা হইলে সম্প্রতি যে সকল ডাকাইতি হইয়াছে, তাহার দুই একটীর কিনারা হইলেও হইতে পারে।

 মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, তিনি আবেদ আলিকে হস্তগত করিবার নিমিত্ত বিধিমতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। যতদিন পর্য্যন্ত আবেদ আলি তাহার নিজ গৃহকার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে না পারে, ততদিন পর্য্যন্ত তিনি তাহার ও তাহার পরিবারবর্গের ভার সরকারী অর্থ হইতে চালাইবেন এবং তদ্ব্যতীত সময় সময় আরও দশ কুড়ি টাকা দিয়া, তাহাকে সম্পূর্ণরূপে হস্তগত করিয়া লইবেন। আবেদ আলিও সাধ্যমত সেই কর্ম্মচারীকে সাহায্য প্রদান করিতে সম্মত হইয়া, কখন একা, কখন বা তাঁহাকে সঙ্গে লইয়া নানা স্থানে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল এবং সময় সময় পুরাতন দলের ডাকাইতদিগের মধ্যে কাহার কোথায় বাসস্থান তাহা সেই কর্ম্মচারীকে গোপনে দেখাইয়া দিতে লাগিল।