ভূত ও মানুষ/বাঙ্গাল নিধিরাম/চতুর্থ অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে


চতুর্থ অধ্যায়

তুমুল ঝড়

নিধিরাম নৌকা করিয়া আসিতেছেন, এমন সময় একদিন অতিশয় দুর্য্যোগ আরম্ভ হইল। সমস্ত দিন পূর্ব্ব-বাতাস চলিতে লাগিল, টিপটপ করিয়া জল পড়িতে লাগিল, নদীতে ঘোরতর তরঙ্গ

উঠিল। অতি ক্লেশে মাঝিরা নৌকা চালাইতে লাগিল। ঝড় ও তুফান ক্রমেই বাড়িতে লাগিল। আর অগ্রসর হইতে না পারিয়া মাঝিরা একস্থানে নৌকা লাগাইল। সে স্থানে তিনখানি বড় নৌকা বাঁধা ছিল। ক্রমে সন্ধ্যা হইল, ক্রমে রাত্রি হইল, বায়ু ও ঢেউ ক্রমেই বাড়িতে লাগিল। একখানি চাদর মুড়ি দিয়া নিধিরাম নৌকার ভিতর শুইয়া হিরণ্ময়ীর রূপ মনে মনে ধ্যান করিতে লাগিলেন। অল্পক্ষণ পরেই তিনি নিদ্রায় অভিভূত হইয়া পড়িলেন। কতক্ষণ নিদ্রিত ছিলেন, তাহা ঠিক বলিতে পারেন না। হঠাৎ তিনি জাগরিত হইলেন। জাগরিত হইয়া দেখিলেন যে, তুমুল ঝড় উঠিয়াছে। নিবিড় অন্ধকার, কোলের মানুষ দেখা যায় না। ঝড় ও তরঙ্গের শব্দে কানে তালা লাগে। ছাঁইয়ের ভিতর হইতে যেই একটু মুখ বাহির করিয়াছেন, আর জলের ঝাপটা তাঁহার মুখে লাগিল। বারিকণাগুলি যেন সূচের মত তাহার মুখে বিঁধিয়া যাইল। মাঝিরা বলিল, “মহাশয়! এরূপ ঝড়-তুফান তো কখন দেখি নাই। বাতাস এখন উত্তরে হইয়াছে, আমরা নদীর উত্তর ধারে রহিয়াছি। নৌকা রাখা ভার হইয়াছে।”

 নিধিরাম একবার ভাবিলেন,— “নৌকা হইতে উঠিয়া গ্রামে গিয়া আশ্রয় লই।” কিন্তু দিনের বেলা। তিনি দেখিয়াছিলেন যে, নদীর উপরেই প্রায় একক্রোশ মাঠ, তাহার পর গ্রাম; সে অন্ধকারে, সে প্রবল ঝড়ে, সে জলের ঝাপটে, একক্রোশ মাঠ পার হইয়া গ্রামে যায় কার সাধ্য? তাই তিনি নৌকাতেই বসিয়া রহিলেন! ঝড়ের বেগে পটপট করিয়া নৌকার কাছি ছিড়িতে লাগিল, লগি উঠিয়া পড়িতে লাগিল। সকলের ভয় হইল, কাছি ছিঁড়িয়া নৌকা পাছে নদীর মাঝখানে চলিয়া যায়। যতবার কাছি ছিঁড়িয়া যায়, মাঝিরা ততবার কাছি বাঁধিয়া দেয়, যতবার লাগি উঠিয়া পড়ে, মাঝিরা ততবার পুনরায় পুঁতিয়া দেয়। নিধিরামও মাঝিদিগের বিশেষ সহায়তা করিতে লাগিলেন। বড় নৌকাগুলির ছিড়িয়া একে একে নদীমধ্যে চলিয়া গেল। অন্ধকারে ভালরূপ কিছু দেখিবার যো ছিল না। ঝড়ের শব্দের মাঝখানে একটু মনুষ্য- কোলাহল শব্দ পান, চাহিয়া দেখেন, বড় নৌকার আলোটি মাঝখানের দিকে যাইতেছে। মুহূর্ত্তমধ্যে নৌকার লণ্ঠনের আলোটি নিবিয়া যায়। মাঝিরা বলে,— “মহাশয়, ঐ একখানি নৌকা ডুবিয়া গেল।” এইরূপে একে একে দুইখানি বড় নৌকা নদীর মাঝখানে গিয়া ডুবিয়া গেল। কেবল একখানি বড় নৌকা রহিল। নদীর উচ্চ পাড়ের নীচে নিধিরামের নৌকা ছিল। তাঁহার নৌকাখানি ছোট, সে জন্য ঝড়ের প্রবল বেগ সম্পূর্ণভাবে তাঁহার নৌকায় লাগিতেছিল না। তাঁহার নৌকাখানি হয়তো বাঁচিয়া যাইবে, নিধিরামের এই একটু ভরসা ছিল।

 কিন্তু সে ভরসা মিথ্যা হইল। অবশিষ্ট বড় নৌকাখানি কাছি ছিঁড়িয়া, তাহার নৌকার উপর আসিয়া পড়িল। তাঁহার নৌকার হালটি উচ্চভাবে ছিল। বড় নৌকার লোকেরা সেই হালটি ধরিয়া ফেলিল। নিধিরামের নৌকার সমস্ত কাছিগুলি তৎক্ষণাৎ ছিড়িয়া গেল। দুইখানি নৌকাই তীরের মত নদীর মাঝখানে দৌঁড়িল। অল্পক্ষণ মধ্যেই দুইখানি নৌকা ছাড়াছাড়ি হইয়া গেল। বড় নৌকাখানি ডুবিয়া গেল। নিধিরামের নৌকাখানিও জলমগ্ন হইল। নিধিরাম নদীর মাঝখানে ভাসিতে লাগিলেন। সাঁতার তিনি উত্তমরূপে জানিতেন। কিন্তু পর্ব্বতপ্রমাণ ঢেউ, ঘোর অন্ধকার, দিকের ঠিক নাই। কাহার সাধ্য সাঁতার দেয়, আর সাঁতার দিয়াই বা কোনদিকে যাইবেন? অল্প অল্প হাত-পা নাড়িয়া তিনি কেবল ভাসিয়া থাকিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্তু ভাসিয়া থাকাও দুঃসাধ্য কথা। পর্ব্বতসদৃশ তরঙ্গরাশি তৃণবৎ তাঁহাকে তুলিতে-ফেলিতে লাগিল। ঢেউয়ের আঘাতে তা তাঁহার শরীর চূর্ণ-বিচূর্ণ হইতে লাগিল। একবার তরঙ্গের শিখরদেশে উঠিয়া যখন তিনি পুনরায় নামিতে থাকেন, সেই সময়ে ঢেউয়ের মাথাটি ভাঙ্গিয়া যায় ও জলের ঝাপটা তাঁহার নাকে-মুখে প্রবেশ করিয়া শ্বাসরোধের উপক্রম হয়। ক্রমে তাহার হাত-পা অবশ হইয়া পড়িতে লাগিল। আসন্নকাল উপস্থিত জানিয়া নিধিরাম ভগবানকে স্মরণ করিতে লাগিলেন। “হা, হিরণ্ময়ি! তোমার পিতাকে উদ্ধার করিতে পারিলাম না, তোমার সে মধুমাখা মুখখানি আর দেখিতে পাইলাম না। হে করুণাময় জগদীশ্বর! তুমি আমার হিরণ্ময়ীকে সুখী করিও।” আসন্নকালে নিধিরাম মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিতে লাগিলেন।

 হাত-পা নাড়িতে না পারিয়া নিধিরাম জলে ডুবিলেন। প্রাণের মায়া সহসা কেহ ছাড়িতে পারে না। জলে ডুবিয়াই পুনরায় একটু হাত-পা নাড়িতে চেষ্টা করিলেন। তাহাতে আর একবার উপরে ভাসিয়া উঠিলেন। কিন্তু আর বল নাই। শরীর অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছে। ঘোর কালনিদ্রা তাঁহাকে ক্রমে ঘিরিতেছে। পুনরায় ডুবিলেন। ডুবিতে না ডুবিতে তাঁহার পায়ে কি ঠেকিল। আমনি তাঁহার একটু চমক হইল। পায়ে যে দ্রব্য ঠেকিল, তাহা তিনি ধরিলেন, একটু বল প্রকাশ করিয়া পুনরায় উপরে ভাসিয়া উঠিলেন। মনকে প্রবোধ দিয়া নিদ্রাবেশ দূর করিলেন। পুনরায় তাহার চেতনা হইল। জীবনের আশা হইল, তাহাতে শরীরে কিঞ্চিৎ শক্তিরও সঞ্চার হইল। দেখিলেন যে, একগাছি কাছি তাহার পায়ে ঠেকিয়াছিল। টানিয়া দেখিলেন যে, সেই কাছি অতি দূরে কিছুতে বাধা আছে। নিধিরাম ভাবিলেন, কাছির অপরদিক হয় জলমগ্ন নৌকায় বাধা আছে, না হয় নদীর কিনারায় খোঁটায় বাধা আছে। বায়ুর প্রবলবেগে কাছি ডুবিয়া যায় নাই, সরলভাবে ভাসিতেছিল। তিনি সেই কাছিটি ধরিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন। পর্ব্বতাকার তরঙ্গের ভিতর দিয়া অগ্রসর হওয়া সহজ কথা নহে। যাহা হউক, অতি কষ্টে কিছু দূর গিয়া তিনি মাটি পাইলেন। ক্রমে কোমার জলে গিয়া দাঁড়াইলেন। তখনও ঢেউ তাহার মাথার উপর দিয়া যাইতেছিল। ক্রমে কিনারায় গিয়া উঠিলেন। দেখিলেন যে, কাছিগাছাটি একটি খোটায় বাঁধা আছে। শরীর একবারে অবশ হইয়া পড়িয়াছিল। সেই খোঁটাটি ঠেশ দিয়া কিছুক্ষণ বসিয়া রইলেন। উপর হইতে চারিদিকে পাড় ভাঙ্গিয়া পড়িতেছিল। নিধিরাম ভাবিলেন, যদি প্রাণরক্ষা হইল, শেষে কি আবার মাটি-চাপা পডিয়া মরিব না কি!

 নিধিরাম দাঁড়াইলেন। অনেক পরিশ্রম করিয়া পাড়ের উপর গিয়া উঠিলেন। পাড়ের উপর দাঁড়াইতে না দাঁড়াইতে বাতাসে তাঁহাকে ঠেলিয়া লইয়া যাইতে লাগিল। ঘোর অন্ধকার! কোন দিকে লইয়া যাইতে লাগিল, তাহা তিনি বলিতে পারেন না। মনে করিলেন যে, “যদি একটি গাছ পাইতো ধরিয়া বসিয়া থাকি; তাহার পর সকাল হইলে গ্রাম অনুসন্ধান করিব।” একবার একটি গাছ পাইলেন, কিন্তু সেটি চারা বাবলাগাছ। আগ্রহের সহিত ধরিতে গিয়া, তাহার সমস্ত হাতে কাটা ফুটিয়া গেল। বাতাসে পুনরায় তাঁহাকে ঠেলিয়া লইয়া যাইতে লাগিল। একবার তাহাকে পাড় হইতে নদীর ভিতর ফেলিয়া দিল। অতি কষ্ট পুনরায় তিনি উপরে উঠিলেন। পুনরায় বাতাসে তাঁহাকে ঠেলিয়া লইয়া যাইতে লাগিল, পাছে পুনরায় নদীর ভিতর ফেলিয়া দেয়, এই ভয়ে তিনি বুকে হাঁটিয়া যাইতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ পরে একটি ঝোঁপের নিকট উপস্থিত হইলেন। ঝোঁপের ভিতর প্রবেশ করিবার মানসে যেই অগ্রসর হইয়াছেন, আর অমনি ফোঁস করিয়া একটি শব্দ হইল। নিধিরাম ভাবিলেন,— “মন্দ কথা নয়! সর্পাঘাতটিই বা বাকি থাকে কেন?” অপরদিকে গিয়া একটি গাছ পাইলেন। গাছটি ধরিয়া বসিলেন। অল্পক্ষণ বিশ্রাম করিয়া মনে মনে ভাবিলেন,— “চারদিক জলে ডুবিয়া গিয়াছে।” এই স্থানটি উচ্চ। এখানে অনেক সাপ আসিয়া আশ্রয় লইয়া থাকিবে। মাটিতে এরূপভাবে বসিয়া থাকা ভাল নয়।

গাছের উপর বসিয়া থাকি। আস্তে আস্তে গাছে উঠিয়া একটি খুব বড় ডালের উপর বসিয়া শীতে কাঁপিতে লাগিলেন। ক্রমে ঝড় থামিল, বৃষ্টি থামিল, দুই-একটি নক্ষত্র দেখা দিল, অন্ধকারের ঘোর নিবিড়তা অনেকটা ঘুচিল। কিন্তু এখনও আর কত রাত্রি আছে, নিধিরাম তাহা বুঝিতে পারিলেন না। প্রাতঃকালের প্রতীক্ষায় তিনি গাছের উপর বসিয়া রহিলেন।