ভূত ও মানুষ/বাঙ্গাল নিধিরাম/প্রথম অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে


বাঙ্গাল নিধিরাম

প্রথম অধ্যায়

পীড়িত পথিক

নিধিরাম দেবশর্ম্মার বাটী পূর্ব্বদেশ। নিধিরাম মহাকুলীন। কিন্তু বিবাহ করা তাঁহার ব্যবসায় নয়। একটির অধিক তিনি বিবাহ করেন নাই, বিবাহ করিয়া টাকা লন নাই। নিধিরামের পৈতৃক যৎকিঞ্চিৎ ভূমি-সম্পত্তি ছিল। সন্তান-সন্ততি হয় নাই। সেই ভূমি হইতেই ব্রাহ্মণব্রাহ্মণীর কোনওরূপে দিনপাত হইত।

 যখন নিধিরামের বয়স প্রায় ৪৫ বৎসর, তখন তাহার গৃহ শূন্য হইল। ব্রাহ্মণীর শোকে তিনি অধীর হইয়া পড়িলেন। কিন্তু, কি করিবেন? সকলই ভগবানের ইচ্ছা, পুনরায় বিবাহ করিতে অনেকেই তাঁহাকে অনুরোধ করিল। নিধিরাম সে কথা শুনিলেন না। বাকি কয়টা দিন ভগবানের আরাধনা করিয়া কাটাইবেন, মনে মনে এইরূপ স্থির করিলেন।

 এইরূপে কিছুদিন কাটিয়া গেল। একবার ত করিবার ইচ্ছা হইল। একাকী তিনি বাটী হইতে বাহির হইলেন, একাকী চণ্ডীপুরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বাসা লইয়া প্রাতে গঙ্গাস্নান, সন্ধ্যায় গঙ্গাদর্শন করিতে লাগিলেন। একদিন রাত্রিতে হঠাৎ তিনি বিসূচিকা রোগগ্রস্ত হইলেন। আসন্নকাল উপস্থিত জানিয়া, মা’র বক্ষে প্রাণ সমর্পণ করিবার অভিলাষে আস্তে আস্তে বুকে হাঁটিয়া তিনি গঙ্গা তীরে উপস্থিত হইলেন। বালুকাময় তটে পড়িয়া ছট্‌ফট করিতে লাগিলেন।

 প্রাতঃকাল হইল। বেলা দশটা বাজিল। প্রচণ্ড সূর্য্যকিরণে জগৎ ক্রমে অগ্নিময় হইতে লাগিল। নিধিরামের প্রাণ তবুও বাহির হয় না। উঠিবার শক্তি নাই, নড়িবার শক্তি নাই। কণ্ঠাগত প্রাণ, কিন্তু সে সামান্য প্রাণটুকু শরীর হইতে বাহির হইতে চায় না। তাহার জ্ঞান ছিল। “শীঘ্র লও মা! আর কেন মা?” ধীরে ধীরে মাকে ডাকিতে লাগিলেন।

 দুই জন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ গঙ্গাস্নান করিয়া সেই দিক দিয়া যাইতেছিলেন। নিধিরাম ধীরে ধীরে তাহাদিগকে বলিলেন— “মহাশয়! পিপাসায় আমার ছাতি ফাটিয়া যাইতেছে। কৃপা করিয়া যদি আমার মুখে একটু জল দেন, তাহা হইলে এই আসন্নকালে কিঞ্চিৎ শান্তিলাভ করি।”

 একজন জিজ্ঞাসা করিলেন,— “মহাশয়ের নিবাস?”

 নিধিরাম বলিলেন,— “আমার নিবাস পূর্ব্বদেশে।”

 পুনরায় সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ জিজ্ঞাসা করিলেন,— “মহাশয়ের নাম?”

 নিধিরাম উত্তর করিলেন, — “আমার নাম নিধিরাম দেবশর্ম্মা। কিন্তু মহাশয়! আমার কথা কহিবার শক্তি নাই। তৃষ্ণায় আমার বুক ফাটিয়া যাইতেছে। আমি এক্ষণে পরিচয় দিতে পারি না। মুখে যদি একটু জল দেন, তাহা হইলে বড় উপকার হয়।” পুনরায় সেই ব্রাহ্মণ জিজ্ঞাসা করিলেন,— “আপনার ব্যাতোন?”

 নিধিরাম বলিলেন, — “আমি চাকরি করি না। আমার বেতন নাই। যান, আপনার বাড়ী যান। আমার জলে কাজ নাই।”

 ব্রাহ্মণ, আপনার সঙ্গী অপর বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে বলিলেন,— “চল, হে, এককড়িা চল বাড়ী যাই বেলা হইল, রৌদ্রে এখানে দাঁড়াইয়া থাকিবার প্রয়োজন নাই।”

 এককড়ি কোনও উত্তর না করিয়া গঙ্গার জলে নামিয়া, এককোশা জল লইলেন!। নিধিরামের নিকট আসিয়া তাঁহার হাত-মুখ ধোয়াইতে লাগিলেন।

 এককড়ির সঙ্গী বলিলেন,— “ছি! এই বিদেশী ঘাটের মড়াকে ছুইয়া ফেলিলে? তোমাকে পুনরায় স্নান করিতে হইবে। আমি বাটী চলিলাম।” এই বলিয়া এককড়ির সঙ্গী সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।

 এককড়ি নিধিরামকে উত্তমরূপে ধোয়াইয়া-মুছইয়া জলপান করাইলেন। তাহার পর নিধিরামের নাড়ী দেখিলেন। অবশেষে তিনি বলিলেন,— “মহাশয়! আমি চিকিৎসা-শাস্ত্র কিঞ্চিৎ অবগত আছি। আপনার নাড়ী নাই সত্য; শরীর শীতল হইয়াছে সত্য। কিন্তু বোধ হয়, নাড়ী শীঘ্রই গছিবে, শরীর শীঘ্রই উষ্ণ হইবে। এ-যাত্রা আপনি রক্ষা পাইবেন।”

 নিধিরাম বলিলেন,— “রক্ষা পাইতে আমার কিছুমাত্র সাধ নাই। জীবনে আমার সুখ নাই। আজ মা'র তীরে দেহত্যাগ করিব, ইহার চেয়ে আর সৌভাগ্য কি আছে?”

 বৃদ্ধ এককড়ি সে কথায় কর্ণপাত করিলেন না। দুই-চারি জন প্রতিবাসীর সহায়তায় নিধিরামকে আপনার বাড়ী লইয়া যাইলেন। যথাবিধি চিকিৎসা করিতে লাগিলেন।

 এককড়ির বাড়ীতে কেবল স্ত্রী, একটি শিশুপুত্র। এককড়ি সদবংশ-জাত কুলীন ব্রাহ্মণ, কিন্তু দরিদ্র। কন্যার টাকা লাগে, সে জন্য আজ পর্যন্ত কন্যার বিবাহ দিতে পারেন নাই। দেখিতে কন্যাটির বয়স ষোল বৎসর হইয়া পড়িল। তাঁহাদিগের ঘরে কন্যা বড় হইলে কোনও ক্ষতি নাই। তা বলিয়া কন্যার বিবাহ বিষয়ে এককড়ি নিশ্চেষ্ট ছিলেন না। কুলমর্য্যাদায় আপনার সমান অনেকের নিকট গিয়া তিনি কত মিনতি করিয়াছিলেন, কিন্তু সকলেই এত টাকা চাহিয়াছিলেন যে, এককড়ির ভিটা-মাটি বিক্রয় করিলেও সে টাকা হয় না। এককড়ির কন্যার নাম হিরণ্ময়ী। হিরণ্ময়ী পরমা সুন্দরী। কিন্তু কুলীনের ঘরে সৌন্দর্য্যের গৌরব নাই।