মণিপুরের সেনাপতি (শেষ অংশ)/কিন্তু কি হইল?

উইকিসংকলন থেকে

কিন্তু কি হইল?

 সকলের চেষ্টা ব্যর্থ হইল। সমগ্র পৃথিবী যাঁহার জীবন রক্ষার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতেছিল, ইংরাজ-জাতী-গৌরবস্থল মহামতি লর্ড-বংশধরগণ যাঁহার জীবন রক্ষার জন্য অবিরত চেষ্টা করিতেছিলেন, রাজসভা পার্লিয়ামেণ্টে প্রায় দুইমাস যাবৎ যাহার জীবন রক্ষার জন্য বাদ প্রতিবাদে বিরত ছিলেন, আজ সেই আন্দোলনের ফল কি হইল? বলিতে বুক বিদীর্ণ হয়! স্মরণে হৃদয় কাঁপিয়া উঠে!! আজ বড়লাট লর্ড ল্যান্সডাউনের বিচারে তোমার জীবনলীলা সম্বরণ করিতে হইল। টিকেন্দ্র! তুমি নির্দ্দোষী বলিয়া যে এত করুণ আর্তনাদ করিয়াছ, ইংরেজ কর্ম্মচারীদিগের জীবন রক্ষা করিবার জন্য যে সাধ্যমত চেষ্টা করিয়াছ, পরিশেষে সমস্ত পরিত্যাগ করিয়া যে রাজাধিরাজ ইংরাজের নিকট প্রাণভিক্ষা চাহিয়া, আজ রাজাধিরাজ ইংরেজরাজ-প্রতিনিধি লর্ড ল্যান্সডাউনের হৃদয় তাহাতে গলিল না। স্বজাতি-প্রাণঘাতক বলিয়া তোমার প্রতি তাঁহার হৃদয়ে দয়ার সঞ্চার হইল না। তিনি সর্ব্বময় কর্ত্তা হইয়াও তোমার জীবন-দান দিতে পারিলেন না। তোমার আশা-তরু শুকাইল, জীবন-প্রদীপ নির্ব্বাণ হইল। তুমি রাজাধিরাজ ইংরেজরাজের মঙ্গলার্থে যে কণ্ঠ নাগা, কুকী প্রভৃতি অসভ্য শক্রর শাণিত তরবারির অধোভাগে স্থাপন করিতে কুণ্ঠিত ছিলে না, আজ সেই মহাপ্রতাপান্বিত ইংরেজের আদেশেই তোমার কণ্ঠ ফাঁসী-রজ্জুতে দোলায়মান হইল। টিকেন্দ্র তোমাকে আর কি বলিব? তোমার কর্মদোষেই আজ তুমি, আপন রাজ্যে—যে রাজ্যে শত শত নরঘাতক তোমার আদেশে জীবন বিসর্জ্জন দিয়াছে, আজ তুমি সেই রাজ্যে সামান্য নরঘাতকের ন্যায় ফাঁসীকাষ্ঠে আপন জীবন বিসর্জ্জন দিলে! তুমিত এ জন্মের মত চলিলে, কিন্তু করিলে কি? তোমার অঙ্কলক্ষ্মী—যে আটটী রমণীকে তুমি অঙ্কলক্ষ্মী বলিয়া হাস্যমুখে বাম পার্শ্বে বসাইয়াছিলে, আজ তাঁহাদের কি ব্যবস্থা করিলে? নবমবর্ষীয় অবোধ বালক চৌবা-ই তোমার একমাত্র পুত্র। ক্ষণমাত্র চক্ষের অন্তরাল হইলে, তুমি পৃথিবী অন্ধকার দেখিতে; রাজপদ তোমার নিকট তুচ্ছ বলিয়া বোধ হইত; যাহার পরিচর্যার ত্রুটী হইলে পরিচারকগণ তোমার কোপনেত্রে পতিত হইত, আজ সে চৌবাকে কাহার হতে সমর্পণ করিয়া চলিলে? যে কথায় অপমান বোধ করিয়া সর্ব্বাগ্রজ মহারাজ সুরাচন্দ্র বাহাদুরকে সিংহাসনচ্যুত করিলে, আজ তোমার সেই সাধের সিংহাসন, সাধের মণিপুররাজ্য, সাধের প্রজাবর্গ কাহার হতে সমর্পণ করিয়া চলিলে? বীরবর! তুমিত চলিলে, কিন্তু তোমার বীরত্ব তোমার সঙ্গে চলিল না। যতদিন চন্দ্রসূর্য্য থাকিবে, যতদিন দিবারাত্রি হইবে, যতদিনে প্রলয়ে সসাগরা পৃথিবী ধবংস না হইবে, ততদিন তোমার বীরত্ব-কাহিনী, তোমার দয়া-দাক্ষিণ্য, তোমার সৌজন্যতা, তোমার ক্ষত্রিয়োচিত-ধর্ম্ম দিঙ্মণ্ডল ব্যাপিয়া ঘোষিত হইবে। এখন ভগবানের নিকট এই প্রার্থনা, তুমি শান্তিময়ীর শান্তিময় ক্রোড়ে স্থান লাভ করিয়া পরলোকে শান্তি লাভ কর।

 আর আমাদের রাজাধিরাজ ইংরেজ রাজ-প্রতিনিধিকেও বলি,—তুমি সাক্ষাৎ সম্বন্ধে আমাদের দেবতা। প্রাণাধান ও প্রাণদণ্ড তোমার কণ্ঠস্বরে সম্পন্ন হইতে পারে। সুতরাং তুমি একটি সর্বশক্তিমান্ মহাপুরুষ! যাহার এতদূর ক্ষমতা, পঞ্চবিংশতি কোটী লোকের জীবন যাহার সামান্য প্রশ্বাসের উপর নির্ভর করে, সেই সর্বশক্তিমান তোমার নিকট সামান্য কীটাণুকীট মণিপুর-যুবরাজ টিকেন্দ্রজিতের জীবন রক্ষা পাইল না। তুমি পালনকর্তা পিতা। পঞ্চবিংশতি- কোটী লোকের পালনভার তোমার প্রতি যুক্ত আছে; এই পঞ্চবিংশতি কোটী লোকই তোমার সন্তান। সন্তান দুর্ব্বত্ত, নৃশংস বা অত্যাচারী হইলেও পিতার নিকট ক্ষমা পাইবার বোগ্য। সকল সন্তান কিছু সমান সদ্ব্যবহার হয় না। কিন্তু তা বলিয়া পিতা স্বহস্তে সন্তানের উচ্ছেদ সাধন করিতে পারে না। ঘোরতর মমতা-বন্ধন! আজ তুমি টিকেন্দ্রজিতের জন্য নির্মম হইলে! তোমার এক সন্তানের জীবনের জন্য, অপর সন্তানের জীবন লইলে!! ভাবিয়া দেখ; তোমারই সন্তান তোমার হাতে উচ্ছন্ন হইল।