মণিপুরের সেনাপতি (শেষ অংশ)/ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ।


টিকেন্দ্র-সম্বন্ধে দুই একটি কথা।

 টীকেন্দ্রজিৎ সিংহের বয়ঃক্রম এখন ৩৭ বৎসর মাত্র। এই সামান্য বয়সের মধ্যে তিনি না করিয়াছেন কি? যখন তাঁহার বয়ঃক্রম ২৫ বৎসর, সেই সময়ে তিনি প্রথম পরিণয়-সূত্রে আবদ্ধ হন, ও ক্রমে ক্রমে আটটী দার-পরিগ্রহ করেন। তাঁহার একটী পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেন। সেই পুত্রের নাম চৌবা। তাঁহার বয়স এখন ৯ বৎসর মাত্র। এখন টীকেন্দ্র এই নাবালক পুত্র ও বিধবা স্ত্রীগণকে পরিত্যাগ-পূর্ব্বক গমন করিতেছেন, ইহা কি কম কষ্টের ও দুঃখের কথা!

 টীকেন্দ্র তুমি ইংরাজের জন্য না করিয়াছ কি? সেই ভীষণ নাগা-যুদ্ধে যদি তুমি, আপনার প্রাণের মায়া পরিত্যাগ না করিয়া, দেড় মাস কাল সেই ভীষণ সমরার্ণবে সন্তরণ না করিতে, তাহা হইলে ইংরাজের কি দশা হইত? তুমি মিউডের একজন প্রাণের বন্ধু ছিলে; তাহার নিমিত্ত তুমি কোন কার্য্য করিতেই পরাজুখ হইতে না; মান-অপমানের দিকেও দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে। কেবল গ্রিমউডের কেন, তুমি যে সকলেরই প্রিয় ছিলে; তুমিই ইংরাজকে সন্তুষ্ট করিবার নিমিত্ত আপনার জাতীর দিকে, আপনার ধর্মের দিকে দৃকপাতও না করিয়া মণিপুরী স্ত্রীলোকদিগের ফটোগ্রাফ লওয়ায় সহায়তা করিয়াছিলে!

 তুমি মণিপুরকে যে কতবার বিপদ হইতে উদ্ধার করিয়াছ, আপন জন্মভূমির দুরবস্থা যে তুমি কতবার মোচন করিয়াছ, তাহা বর্ণন করিতে কে পারে? তোমার পরাক্রমেই বড় চৌবার দুর্গতি হইয়াছে; তুমিই বন্ধোরাপোর সর্বনাশ সাধন করিয়াছ; তুমিই কুকিদিগের সহিত যুদ্ধ করিয়া কুকি সর্দ্দার তমহুকে বন্ধন করিয়াছ, ও এইরূপ কত ভয়ানক ভয়ানক কার্য্য তোমা হইতে যে হইয়াছে, তাহার ইয়ত্তা কে করে! আজ তুমি সেই সকল অতীত কার্য্যের পুরস্কার পাইতেছে।  আমরা হিসাব করিয়া দেখিয়াছি, টীকেন্দ্র তোমার নিজের উপার্জন মাসে তিন হাজার টাকার অধিক ছিল না, কিন্তু তাহার তিন পয়সা কি তুমি রাখিতে পারিতে? তোমার যে অসাধারণ দান ছিল, বৃন্দাবন যাত্রী মণিপুরীমাত্রেই যে তোমার দানের উপর নির্ভর করিয়া গমন করিত, অনাথ-অসহায় স্ত্রীলোেকগণের যে তুমিই একমাত্র সম্বল ছিলে, মাতৃ-পিতৃহীন বালকের পিতাই যে তুমি ছিলে! আজ তুমি ভয়ানক ঋণজালে আবদ্ধ হইয়া মণিপুর পরিত্যাগ করিতেছ! পরের উপকারের নিমিত্তই যে আজ তুমি ঋণজালে আবদ্ধ। পরকেই যে তুমি সর্বস্ব খাওয়াইতে ভালবাসিতে। আজ তোমার স্ত্রী-পুত্রের কি উপায় করিলে? কে তাহাদিগকে ভরণ-পোষণ করিবে? টীকেন্দ্রের স্ত্রী ও পুত্র হইয়া এখন কি তাহার দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিবে?  টীকেন্দ্রে! আজ তোমার বিহনে মণিপুর হাহাকার করিতেছে, পশু-পক্ষী প্রভৃতি সকলেই তোমার দুঃখে অশ্রুবারি বিসর্জন করিতেছে। তুমি রাজা ছিলে না, তথাপি তোমার দুঃখে সকলে এরূপ দুঃখিত কেন? কেন, এ উত্তর কে দিবে?

 টিকেন্দ্র! তুমি বলবান, তুমি ক্ষমতাশালী, তুমি সকলের প্রিয়, তুমি দাতা, তুমি পোপকারী—এই নিমিত্তই আজ তোমার জন্য মণিপুর রোদন করিতেছে—সমস্ত বাঙ্গালা হাহাকার করিতেছে। সমস্ত ভারত তোমার পক্ষ সমর্থন করিয়া তোমাকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতেছে। রিপণ প্রভৃতি মহাত্মাগণ পালিয়ামেণ্টে চীৎকার আরম্ভ করিয়াছেন, এবং সমস্ত পৃথিবী তোমার দুঃখে যোগদান করিয়া কেবল তোমার ইষ্টের চেষ্টায় মনঃসংযোগ করিতেছে।