বিষয়বস্তুতে চলুন

মতিয়া বিবি/সপ্তম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

 সময়মতে উচ্চ আদালতে পাঁচ জন জুরির সাহায্যে এই মোকর্দ্দমার বিচার হয়। মহম্মদ মসলিম নিতান্ত সাঙ্গিন অপরাধে অভিযুক্ত, সুতরাং বিচারকও জুরিগণের সাহায্যে বিশেষ বিবেচনার সহিত তাহার বিচার করিতে আরম্ভ করেন। তাহার উপর যে সকল প্রমাণ আমরা সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছিলাম, তাহাতে জজ ও জুরিগণের মনে বিশ্বাস হয় যে, মসলিম তারামণিকে হতা করিয়া তাহার সমস্ত দ্রব্যাদি অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে। আর ইহাও সাব্যস্ত হয় যে বিষ-প্রয়োগই তারামণির মৃত্যুর কারণ। কারণ, রাসায়নিক পরীক্ষকের নিকট হইতে যে রিপোর্ট প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহাতে জানিতে পারা যায় যে, তারামণির শবছেদকারী ডাক্তার তাঁহার নিকট যে নকল পদার্থ প্রেরণ করিয়াছিলেন, তাহার মধ্য হইতে বিষ প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। মসলিম হত্যাপরাধে অভিযুক্ত, কিন্তু বিচারালয়ে তাহার পক্ষ সমর্থন করিতে ব্যবহারজীবিগণের মধ্যে কেহই উপস্থিত ছিলেন না। মসলিমও তাহার নিজের পক্ষ সমর্থন করিবার নিমিত্ত কোন কথা কহিল না। তাহার বিপক্ষে প্রমাণ প্রয়োগ সমস্ত শেষ হইয়া গেলে, এ বিষয়ে তাহার কি বক্তব্য আছে, তাহা বিচারক তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন। উত্তরে মসলিম কেবল এইমাত্র কহিল, সে যে তারামণিকে হত্যা করে নাই, তাহারই কেবল একটীমাত্র প্রমাণ সে বিচারালয়ে উপস্থিত করিতে চাহে। যে ব্যক্তি ঐ প্রমাণ দিবে, তাহাকে দর্শন করিবামাত্রই বিচারক বুঝিতে পারিবেন যে, সে তারামণিকে হত্যা করিয়াছে, কি পুলিশ-কর্ম্মচারিগণ তাহার উপর এই মিথ্যা মোকদ্দমা আনিয়া তাহাকে চরমদণ্ডে দণ্ডিত করিবার চেষ্টা করিতেছেন। মসলিম আরও কহিল, সে যাহাকে এইস্থানে উপস্থিত করিতে বাসনা করিয়াছে, সে নিকটবর্ত্তী-একটী বাগানের ভিতর মহম্মদ কাছেম ও মহম্মদ হানেফের নিকট আছে। পুলিশ-কর্ম্মচারী ব্যতীত অপর কোন ব্যক্তিকে সেই স্থানে পাঠাইয়া দিয়া তাহাকে আনা হউক, এই তাহার প্রার্থনা।

 এই বলিয়া বাগানের নাম ও ঠিকানা সে বিচারককে বলিয়া দিল। মসলিমের নিকট হইতে তাহার ছাপাই সাক্ষীর নাম পাইয়া, বিচারক তাহাকে কহিলেন, “তুমি যখন অবগত আছ যে, কোন্‌ তারিখে তোমার মোকর্দ্দমার বিচার হইবে ও ইহাও তোমার অবিদিত নাই বে, মোকর্দ্দমার দিনে ছাপাই সাক্ষিগণকে হাজির করিবার বন্দোবস্ত তোমাকে পূর্ব্ব হইতেই করিতে হইবে, তখন তুমি সেরূপ বন্দোবস্ত পূর্ব্ব হইতে করিয়া রাখ নাই কেন? এরূপ অবস্থায় এখন তোমার প্রার্থনা কিরূপে মঞ্জুর করিতে পারি?”

 বিচারকের কথা শুনিয়া মসলিম কহিল, “ধর্ম্মাবতার! আমি ইহার সমস্তই অবগত আছি, কিন্তু পূর্ব্ব হইতে যদি আমি আমার সাক্ষীর নাম প্রকাশ করিতাম বা তাহাকে আপনার সম্মুখে উপস্থিত হইবার যদি কোনরূপ বন্দোবস্ত করিয়া রাখিতাম, তাহা হইলে পুলিশের অনুগ্রহে সেই সাক্ষী কখনই আপনার সম্মুখে উপস্থিত করিতে পারিতাম না! এই জন্য আমার প্রার্থনা যে, আমার সাক্ষীকে এইস্থানে এখন আনাইয়া দেখুন, তাহা হইল আমি জোর করিয়া বলিতে পারি যে, আপনি নিশ্চয়ই আমাকে অব্যাহতি প্রদান করিবেন। বিশেষ আমার ঐ সাক্ষী অতি নিকটেই আছে।”

 মসলিমের কথা শুনিয়া বিচারক একটু চিন্তা করিলেন ও পরিশেষে তাঁহার বিচারালয়ের একজন কর্ম্মচারী ও এক জন চাপরাসীকে সেই স্থানে প্রেরণ করিলেন। মসলিম যে বাগানের নাম বলিয়া দিয়াছিল, উহা বিচারালয় হইতে বহুদূরে স্থাপিত ছিল না। সুতরাং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ঐ বিচারালয়ের কর্ম্মচারী হানিফ, কাছেম ও একটী স্ত্রীলোকের সহিত সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

 ঐ স্ত্রীলোকটী আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইবামাত্র চতুর্দ্দিকে একটী ভয়ানক গোলযোগ উত্থিত হইল। কিসের গোলযোগ, তাহা প্রথমতঃ হঠাৎ বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না, কিন্তু যখন জানিতে পারিলাম, তখন একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলাম। ভাবিলাম, কি ভয়ানক কাণ্ড আসিয়া উপস্থিত হইল!

 কি ভয়ানক কাণ্ড উপস্থিত হইল, তাহার কিছুমাত্র পাঠকগণ অনুমান করিতে সমর্থ হইয়াছেন কি? মহম্মদ মসলিমের প্রার্থনামত ঐ স্ত্রীলোকটীকে সেই স্থানে আনীত হইলে, মসলিম বিচারককে কহিল, “ধর্ম্মাবতার! এই মোকর্দ্দমা তারামণির বাড়িওয়ালা ও তাহার প্রতিবেশিগণ যাহারা আমার বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছে, তাহাদিগকে আপনি একবার ডাকাইয়া জিজ্ঞাসা করুন, এই স্ত্রীলোকটী কে? তাহা হইলেই জানিতে পারিবেন, এই মোকর্দ্দমার আমি কতদূর দোষী।”

 মসলিমের কথা শুনিয়া বিচারক তারামণির বাড়ীওয়ালাকে ডাকাইলেন। তিনি সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন। আদেশমাত্র বাড়ীওয়ালা সেই স্থানে আসিয়া দণ্ডায়মান হইলে বিচারক মসলিমকে কহিলেন, “তুমি ইহাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিতে চাহ, তাহা জিজ্ঞাসা করিতে পার।”

 বিচারকের নিকট হইতে আদেশ প্রাপ্ত হইয়া মসলিম সেই বাড়িওয়ালাকে কহিল, “দেখুন দেখি মহাশয়, আপনি এই স্ত্রীলোকটাকে চিনিতে পারিতেছেন কি না?”

 বাড়ীওয়ালা। হাঁ, চিনিতে পারিতেছি।

 মসলিম। উহার নাম কি?

 বাড়ি। তারামণি।

 মসলিম। কোন্‌ তারামণি? যাহাকে হত্যা করা অপরাধে আমি অভিযুক্ত, সেই তারামণি, কি অপর কোন তারামণি?

 মসলিম। যে তারামণি মরিয়া গিয়াছে বলিয়া আমরা স্থির করিয়াছিলাম, এ সেই তারামণি।

 বাড়িওয়ালার কথা শুনিয়া বিচারক ও জুরিগণের মুখ দিয়া কিয়ৎক্ষণ' বাঙ্নিষ্পত্তি হইল না। কিয়ৎক্ষণ পরে বিচারক মহাশয় কহিলেন, “কি সর্বনাশ! যাহাকে হত্যাপরাধে দণ্ড দিতে আমরা প্রস্তুত হইতেছিলাম, এখন দেখিতেছি, সে সম্পূর্ণরূপে নির্দ্দোষ! যে ব্যক্তি হত হইয়াছে বলিয়া আমরা স্থির-সিদ্ধান্ত করিয়া লইয়াছিলাম, এখন দেখিতেছি, সে জীবিত! কি ভয়ানক!!”

 বিচারক সর্বসমক্ষে এইরূপ বলিয়া, অপরাপর ব্যক্তিগণ যাহারা তারামণিকে চিনিত, তাহাদিগের প্রত্যেককেই এক এক করিয়া ডাকাইলেন, ও প্রত্য়েককেই স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র রূপে জিজ্ঞাসা করিলেন। সকলেই একবাক্যে কহিল, “যে তারামণি মরিয়া গিয়াছে বলিয়া এই মোকর্দ্দমার অবতারণা, সেই তারামণি এই, সে মরে নাই।”

 সকলকে জিজ্ঞাসা করার পর বিচারক আর কাহাকেও কিছু না বলিয়া, মসলিমকে অব্যাহতি প্রদান করিলেন। মসলিম হাসিতে হাদিতে হানিফ ও কাছেমের সহিত সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। তারামণিও বাড়িওয়ালার সহিত আপন স্থানে প্রস্থান করিলেন।

 ইহার পর পুলিশ-কর্ম্মচারিগণ মহম্মদ মসলিম, মহম্মদ হানিফ, মহম্মদ কাছেম ও তাহাদিগের সহিত অপর যে সকল ব্যক্তি মতিয়া বিরির মৃতদেহ কবরস্থানে লইয়া গিয়াছিল, তাহাদিগের বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিলেন, কিন্তু কোন স্থানেই আর তাহাদিগকে প্রাপ্ত হওয়া গেল না। তাহারা যে কোথায় গমন করিল, তাহা কেহই বলিতে পারিল না।

 তারামণিকে হত্যা করা অপরাধে বিচারক যে কেবলমাত্র মহম্মদ মসলিমকে অব্যাহতি দিয়াই ক্ষান্ত হইয়াছিলেন, তাহা নহে; পুলিশ-কর্ম্মচারিগণের উপরও তিনি কঠোর সমালোচনা করিতে কিছুমাত্র ত্রুটী করেন নাই। যে সকল পুলিশ-কর্ম্মচারী এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলেন, তাঁহাদিগের বিপক্ষে পরিশেষে ভয়ানক অনুসন্ধান আরম্ভ হয়। ঐ অনুসন্ধান কোন আাদালত হইতে হয় নাই, পুলিশ-বিভাগের সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারী এই অনুসন্ধান করিয়াছিলেন। ঐ অনুসন্ধানের মূল উদ্দেশ্য এই ছিল যে, পুলিশ কর্ম্মচারিগণ ইচ্ছা করিয়া মহম্মৰ মসলিমকে বিপদগ্রস্ত করিবার মানসে, এই মোকর্দ্দমার অবতারণা করিয়াছে কি না, অথবা এই মিথ্যা মোকর্দ্দমা রুজু করিবার পুলিশ কর্ম্মচারিগণের কোন উদ্দেশ্য বা কোনরূপ স্বার্থ আছে কি না?

 অনুসন্ধানের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, তারামণির লোহার সিন্দুকের ভিতর যে একটা স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, তাহাই বা কাহার মৃতদেহ ও কিরূপেই বা উহা ঐ বাক্সের ভিতর কাহার দ্বারা আনীত হইল? ঐরূপ মৃতদেহ ঐরূপে ঐস্থানে আনয়ন করিবার পুলিশ কর্ম্মচারিগণের কোনরূপ উদ্দেশ্য বা স্বার্থ আছে কি না? বলা বাহুল্য, ক্রমান্বয়ে ১৫ দিবসকাল পুলিশের প্রধান কর্ম্মচারীর দ্বারা এই অনুসন্ধান চলিত হইল, কিন্তু তিনি পুলিশ-কর্ম্মচারিগণের বিপক্ষে এরূপ কিছুই প্রাপ্ত হইলেন না যে, যাহাতে তিনি তাহাদিগকে দণ্ড প্রদান করিতে পারেন। সুতরাং আমরা সকলেই তাঁহার নিকট হইতে অব্যাহতি পাইলাম। কিন্ত তখনও আমাদিগের উপর আদেশ রহিল, “লোহার সিন্দুকের ভিতর যে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সে কাহার মৃতদেহ, অনুসন্ধান করিয়া তাহার রহস্য উদ্ঘাটন কর।”

সমাপ্ত।


জ্যৈষ্ঠ মাসের সংখ্যা,

গুপ্ত-রহস্য।

(অর্থাৎ তারামণির প্রমুখাৎ ভয়ানক গুপ্ত-রহস্য প্রকাশ!)

যন্ত্রস্থ।