ময়ূখ/দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
দরবার আম শেষ হইল, বাদশাহ্ সিংহাসন হইতে উঠিলেন। দেওয়ান-ই-আমের পশ্চাদ্ভাগে দ্বিরদরদনির্ম্মিত সুবর্ণমণিমুক্তাখচিত বিচিত্র নাল্কী লইয়া আটজন তাতারী অপেক্ষা করিতেছিল, বাদশাহ্ তাহাতে আরোহণ করিয়া প্রস্থান করিলেন। অন্যান্য সভাসদ্গণ নাকারাখানার ফটক দিয়া প্রস্থান করিলেন, কেবল উজীর আসফ্ খাঁ, শাহ্নওয়াজ খাঁ, আসদ্ খাঁ, কাসেম খাঁ, ইনায়েৎ উল্লা খাঁ, বহাদর খাঁ কাম্বোহ ও দেওয়ান হরেকৃষ্ণ রায়, দেওয়ান-ই-আমের পশ্চাৎস্থিত দ্বার দিয়া দেওয়ান-ই-খাসের চত্বরে প্রবেশ করিলেন। শ্বেতমর্ম্মরনির্ম্মিত দেওয়ান-ই-খাসের পশ্চাতে গোসলখানা। গোসল্খানা মোগল সাম্রাজ্যের মন্ত্রগৃহ, দরবার আমের পরে বাদশাহ্ এইখানে বসিয়া প্রধান অমাত্যগণের সহিত পরামর্শ করিতেন, ভিন্ন ভিন্ন সুবার শাসন সম্বন্ধে আদেশ দিতেন এবং রাজ্যতন্ত্রের গোপনীয় কার্য্যের ব্যবস্থা করিতেন।
সকলে গোসলখানায় প্রবেশ করিয়া দ্বারের দুই পার্শ্বে সারি দিয়া দাঁড়াইলেন, বাদশাহের নাল্কী আসিয়া দুয়ারে দাঁড়াইল, বাদশাহ্ নামিলেন। সমস্ত সভাসদ্ এক সঙ্গে কুর্ণীশ করিলেন। বাদশাহ্ গদীতে উপবেশন করিলে, উজীর আসফ্ খাঁ ও শাহ্নওয়াজ খাঁ তাহার নিকটে উপবেশন করিলেন, অপর সকলে তাহাদিগকে বেষ্টন করিয়া দাঁড়াইলেন। উপবেশন করিয়াই বাদশাহ আসফ্ খাঁকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সাহেব, নূতন মন্সবদার কোথায়?” আসফ্ খাঁ বিপদে পড়িলেন, মন্ত্রণা সভায় উপস্থিত সভাসদগণের মধ্যে ময়ূখের কথা প্রকাশ করিবার ইচ্ছা থাকিলেও, তাহা তাঁহার পক্ষে অসম্ভব। বৃদ্ধ উজির অনায়াসে একটা মিথ্যা কথা বলিলেন, তিনি কহিলেন, “জহাঁপনা, নূতন হাজারী মনসবদার ময়ূখ নারায়ণকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না।” বাদশাহ্ অত্যন্ত বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “সে কি কথা সাহেব? যে ব্যক্তি কল্য রাত্রিতে আমার নিকটে আসিয়াছিল, অদ্য প্রভাতে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না? আসদ্ খাঁ! কোতোয়ালকে তলব কর।”
আসদ্ খাঁ কুর্ণীশ করিয়া গোসলখানা পরিত্যাগ করিলেন, তখন বাদশাহ্ করতালিধ্বনি করিলেন। একজন তাতারী প্রতিহারী আসিয়া অভিবাদন করিল, বাদশাহ তাহাকে রঙ্গমহলের দারোগা গুলশের খাঁ ও বখ্শী হিম্মৎ খাঁ য়াকুতকে তলব করিতে আদেশ করিলেন। তাতারী অভিবাদন করিয়া প্রস্থান করিলে, বাদশাহ্ আসফ্ খাঁকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সাহেব, সুরটের আংরেজ সর্দ্দার ও বাঙ্গালী গওয়াহ্ হাজির আছে?” আসফ্ খাঁ কহিলেন, “জনাবে আলা, সকলেই উপস্থিত আছে।”
আসফ্ খাঁ করতালিধ্বনি করিলেন, খাওয়াস্ আমানৎ খাঁ অভিবাদন করিল, উজীর তাহাকে খাস্ চৌকীর মনসবদার শায়েস্তা খাঁকে ডাকিতে আদেশ করিলেন। মুহূর্ত্ত পরে শায়েস্তা খাঁ আসিয়া কুর্ণীশ করিলেন। আসফ্ খাঁ পুত্রকে সুরট কুঠীর আংরেজ প্রধান ওয়াইল্ড, তর্করত্ন মহাশয় ও চৈতন্যদাস বাবাজীকে গোসলখানায় আনিতে আদেশ করিলেন। শায়েস্তা খাঁ অভিবাদন করিয়া প্রস্থান করিলেন, তখন আগ্রার কোতোয়াল জফর খাঁ গোসলখানায় প্রবেশ কুরিয়া কুর্ণীশ করিলেন।
জফর খাঁকে দেখিয়া বাদশাহ্ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন, “জফর খাঁ, তুমি খাজা আবুলহসনের পুত্র; সেই জন্য তোমাকে আগ্রার কোতয়াল করিয়াছিলাম, কিন্তু এখন দেখিতেছি যে তুমি নিতান্ত অকর্ম্মণ্য। কল্য রাত্রিতে একজন বাঙ্গালী আমীর, হাজারী মনসব্দার নিযুক্ত হইয়াছে। কল্য রাত্রিতে সে প্রথম প্রহরের শেষ পর্য্যন্ত দেওয়ান-ই-খাসে উপস্থিত ছিল, কিন্তু তাহার পর সে গৃহে ফিরে নাই। তুমি কি কোন সংবাদ পাইয়াছ?” জফর খাঁ অবনত মস্তকে কহিলেন, “না।”
“অদ্য রজনীতে দেওয়ান-ই-খাসে তাহার সংবাদ আনিতে না পারিলে তোমাকে আগ্রা হইতে দূর করিয়া দিব। গর্দ্দভের পৃষ্ঠে চড়াইয়া আউরতের পোষাক পরাইয়া বাহির করিয়া দিব।”
জফর খাঁ কেতিয়াল কাঁপিয়া উঠিলেন এবং অভিবাদন করিয়া প্রস্থান করিলেন। তখন আসফ্ খাঁ বাদশাহের কর্ণমূলে কহিলেন, “জহাঁপনা, জফর খাঁর অপরাধ নাই। বখ্শী হিম্মৎ খাঁ য়াকুৎ, দারোগা গুল্সের্ খাঁ ও সরদারণী মেহেদি বিবি নূতন হাজারী মনসব্দারের খবর দিতে পারিবে।” বাদশাহ্ বিস্মিত হইয়া আসফ্ খাঁর মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
এই সময়ে শায়েস্তা খাঁ, ওয়াইল্ড ও তর্করত্ন মহাশয়ের সহিত গোসল্খানায় প্রবেশ করিলেন। তাঁহাদিগের পশ্চাতে দুইজন খোজা চৈতন্যদাস বাবাজীকে ধরিয়া লইয়া আসিল। চৈতন্যদাস দাঁড়াইতে না পারিয়া বসিয়া পড়িল। বাদশাহ্ বিস্মিত হইয়া তাহার দিকে চাহিলেন, তাহা দেখিয়া শাহ্নওয়াজ খাঁ কহিলেন,“জনাব্ আলি, পর্ত্তুগীজ পাদ্রী ইহার দেহের সমস্ত অস্থি চূর্ণ করিয়া দিয়াছে, ইহার দাঁড়াইবার শক্তি নাই।” বাদশাহ্ জিজ্ঞাসা করিলেন, “নবাব সাহেব, পর্তুগীজ পাদ্রী ইহার অস্থি চূর্ণ করিল কেন?”
“শাহনশাহ্, তাহা ঐ হিন্দু ফকীরের মুখ হইতেই শুনিবেন।”
আসফ্ খাঁর আদেশে দেওয়ান হরেকৃষ্ণ রায় বাদশাহের প্রশ্ন ও চৈতন্যদাসের উত্তর তর্জ্জমা করিতে লাগিলেন। বাদশাহ্ জিজ্ঞাসা করিলেন, “ফকীর, পর্ত্তুগীজ পাদ্রী তোমার উপর অত্যাচার করিয়াছিল কেন?”
“সে আমার বন্ধু সেই জন্য।”
“সে তোমার বন্ধু?” “মহারাজ, যে পথভ্রান্তকে পথ নির্দ্দেশ করে সেই বন্ধু।”
“তুমি কি পথ ভুলিয়া হুগলী গিয়াছিলে?”
“না, ইচ্ছা করিয়াই গিয়াছিলাম।”
“তবে পথ ভুলিয়াছিলে কোথায়?”
“বৈরাগী হইয়া যখন অর্থের লোভ হইয়াছিল তখনই পথ ভুলিয়াছিলাম।”
“পর্ত্তুগীজ পাদ্রী তোমার উপরে অত্যাচার করিল কেন?” “গোবিন্দের আদেশে।”
“গোবিন্দ কে?”
“গোবিন্দ অখিল বিশ্বের রাজচক্রবর্ত্তী, বাদশাহের বাদশাহ, আপনার ও আমার প্রভু।”
বাদশাহ্ হাসিলেন, কহিলেন, “ফকীর, খোদা কি তোমার উপর অত্যাচার করিতে পর্ত্তুগীজ পাপীকে আদেশ করিয়াছিলেন?”
“নিশ্চয়, তাহা না হইলে মানুষের সাধ্য কি যে মানুষের অঙ্গে হস্তক্ষেপ করে?”
“ফকীর, তুমি কি পাগল?”
“মহারাজ, লোভ ও মোহ যখন আমাকে আক্রমণ করিয়াছিল, তখন পাগল হইয়াছিলাম, এখন মদনমোহন দয়া করিয়াছেন, এখন আর পাগল নই।”
এই সময়ে আসদ্ খাঁ কহিলেন, “শাহান শাহ্ এই ব্রাহ্মণ সেই স্থানে উপস্থিত ছিল, ইহাকে জিজ্ঞাসা করিলে সকল কথা জানিতে পারিবেন।”
বাদশাহের আদেশ অনুসারে তর্করত্ন চৈতন্যদাসের প্রতি পাদ্রীর অত্যাচারের কথা বলিলেন, তাহা শুনিয়া বাদশাহ, শিহরিয়া উঠিলেন এবং ওয়াইল্ডকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আংরেজ, সমস্ত খৃষ্টান পাদ্রী কি এইরূপ অত্যাচার করিয়া থাকে?” ওয়াইল্ড অবনত বদনে কহিলেন, “জহাঁপনা, খৃষ্টান সমাজে কেবল পর্ত্তুগীজ ও স্পেনীয় পাদ্রীই এইরূপ অত্যাচার করিয়া থাকে। ভারতবর্ষে এইরূপ অত্যাচার নূতন, ইহারা স্বদেশে অন্য মতালম্বী খৃষ্টানদিগের উপরেও এইরূপ অত্যাচার করিয়া থাকে।”
“তাহা হইলে আমার রাজ্যে ইহাদিগকে বাস করিতে দেওয়া উচিত নহে।”
ওয়াইল্ড। শাহনশাহের দরবারে বহুবার আমাদিগের প্রতি পর্ত্তুগীজদিগের অত্যাচারের কথা নিবেদন করিয়াছি। জহাঁপনার হুকুম পাইলে আমরা এত দিন পর্ত্তুগীজ পাদ্রী ও দস্যুর অত্যাচার নিবারণ করিতে পারিতাম।
বাদশাহ্। দেখ আংরেজ, তুমিও ফিরিঙ্গি পর্ত্তুগীজও ফিরিঙ্গি। তোমরা উভয়েই বাণিজ্য করিতে এ দেশে আসিয়াছ। আমরা মনে করিতাম যে ঈর্ষাবশতঃ তোমরা পর্ত্তুগীজ বণিকদিগকে অপবাদ দিয়া থাক। আমার প্রজার উপরে অত্যাচারের কথা আমি ইহার পূর্ব্বে শুনি নাই।
ওয়াইল্ড। জহাঁপনা হিন্দুস্থানের সকল সংবাদ কি বা শাহের কর্ণগোচর হয়?
আসফ্ খাঁ। জহাঁপনা, ওয়াচীয়ানবীশগণ যে সমস্ত সংবাদ প্রেরণ করে তাহা শুনিতে গেলে বাদশাহের অন্য কার্য্যের সময় থাকিবে না বলিয়া খাসদবীর বাছিয়া বাছিয়া কতকগুলি পত্র রঙ্গ মহলে পাঠাইয়া দেয়।
বাদশাহ্। সাহেব, ইহার পূর্ব্বে কি পর্ত্তুগীজ ফিরিঙ্গির অত্যাচারের কথা কোন ওয়াচীয়ানবীশ লিখিয়া পাঠাইয়াছিল?
আসিফ্। হাঁ, আহমদাবাদ, সাতগাঁও, ও জহাঙ্গীর নগরের ওয়াচীয়ানবীশ দুই তিন বার এই সংবাদ দিয়াছিল।
বাদশাহ্। ইহার পরে সুবা বাঙ্গালা ও সুবা গুজরাতের সমস্ত ওয়াচীয়ানবীশের সমস্ত পত্র যেন আমার নিকট উপস্থিত করা হয়।
আসফ্। জহাঁপনার হুকুম তামীল হইবে।
বাদশাহ্। শুন ওয়াইল্ড, কাশেম খা বাঙ্গালার সুবাদার হইয়া যাইতেছে। আমি বাঙ্গালা ও গুজরাতে পর্ত্তুগীজদিগকে শাসন করিব। তোমাদিগের সহিত পর্ত্তুগীজদিগের বিবাদ আছে?
ওয়াইল্ড। শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধ চলিতেছে।
বাদশাহ্। তোমাদের জাহাজ পর্ত্তুগীজ সমস্ত জাহাজ ইরাণে এবং সুরট অঞ্চলে আটকাইয়া রাখিতে পারিবে?
ওয়াইল্ড। পারিবে।
এই সময়ে শায়েস্তা খাঁ গোসলখানায় প্রবেশ করিয়া কহিলেন, “জহাঁপনা, এক হিন্দু ফকীর নাকারাখানায় অপেক্ষা করিতেছে, সে বাদশাহের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করে। তাহার নিকট শাহনশাহের নামাঙ্কিত অঙ্গুরীয়ক ও পঞ্জা আছে।” বাদশাহ্ শায়েস্তা খাঁর কথা শুনিয়া বিচলিত হইয়া উঠিলেন, তিনি শায়েস্তা খাঁকে কহিলেন, “খাঁ সাহেব, আমার নামাঙ্কিত অঙ্গুরীয় কেবল একজন হিন্দু ফকীরের নিকট আছে; তিনি আমার ও নবাব আলিয়া বেগমের পরম মিত্র, তুমি সত্বর তাঁহাকে লইয়া আইস।”
শায়েস্তা খাঁ অভিবাদন করিয়া প্রস্থান করিলেন। বাদশাহ্ তখন আংরেজ প্রধান ওয়াইল্ডকে কহিলেন, “ওয়াইল্ড, তুমি সুরটে ফিরিয়া যাও। যুদ্ধের বন্দোবস্ত কর।”
ওয়াইল্ড কহিলেন, “জহাঁপনা, আমি এতদিন চলিয়া যাইতাম, কেবল উজীরের হুকুম পাই নাই বলিয়া যাই নাই।”
মোগল সাম্রাজ্যের বন্দরশ্রেষ্ঠ সুরটের আংরেজ কুঠীর প্রধান ওয়াইল্ড অভিবাদনান্তে প্রস্থান করিলেন, তখন শায়েস্তা খাঁ গৈরিকধারী এক দীর্ঘাকার গৌরবর্ণ সন্ন্যাসীকে লইয়া প্রবেশ করিলেন। দূর হইতে তাঁহাকে দেখিয়া বাদশাহ, সিংহাসন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তাহা দেখিয়া আসফ্ খাঁ এবং শাহ্নওয়াজ খাঁও উঠিয়া দাঁড়াইলেন। সন্ন্যাসী গোসলখানায় প্রবেশ করিলে, বাদশাহ্ স্বয়ং অগ্রসর হইয়া তাঁহাকে অভিবাদন করিলেন। তাহা দেখিয়া উজীর আসফ্ খাঁ ও নবাব শাহ্ নওয়াজ খাঁ সন্ন্যাসীকে অভিবাদন করিলেন। সন্ন্যাসী বাদশাহকে অভিবাদন না করিয়া আশীর্ব্বাদ করিলেন। এই সময়ে অন্যান্য মুসলমান সভাসদগণ সন্ন্যাসীকে অভিবাদন করিলেন, কেবল দেওয়ান হরেকৃষ্ণ রায় তাঁহার পদধূলি লইয়া প্রণাম করিলেন। একজন খোজা বাদশাহের মসনদের সম্মুখে একখানা গালিচ বিছাইয়া দিল। সন্ন্যাসী উপবেশন করিলে, বাদশাহ্ শাহ্ নওয়াজ খাঁ ও আসফ খাঁ উপবেশন করিলেন। সন্ন্যাসী কহিলেন, “জহাঁপনা, অদ্য বাদশাহের দরবারে ভিক্ষা করিতে আসিয়াছি।”
বাদশাহ্ হাসিয়া কহিলেন, “আপনাকে অদেয় আমার কিছুই নাই। আপনি হুগলীতে আমার জান ও ইজ্জৎ রক্ষা করিয়াছিলেন, সেই অবধি আমি আপনার হুকুম তামিল করিতে বাধ্য।”
“জহাঁপনা, হুগলী বন্দরের কথা মনে আছে?”
“ফকীর সাহেব, আমি জলাল্উদ্দীন আকবর বাদশাহের পৌত্র, নুরউদ্দীন জহাঙ্গীর বাদশাহের পুত্র, আমার সকল কথাই স্মরণ আছে।”
“শীঘ্রই হুগলীতে পর্ত্তুগীজ ফিরিঙ্গির সহিত আপনার যুদ্ধ হইবে।”
“কোন কথাই আপনার অবিদিত নাই।”
“জনাবে আলী, গঞ্জালীস্ ফিরিঙ্গিকে স্মরণ আছে?”
“আছে, সে কথা কখনও বিস্মৃত হইব না।”
“শীঘ্রই আপনার সেনা হুগলী দখল করিবে, তাহার পরে গঞ্জালীস্ যদি বন্দী হয়, তাহা হইলে তাহাকে আমার হস্তে সমর্পণ করিবেন।”
বাদশাহ্ আসফ্ খাঁর দিকে ফিরিয়া কহিলেন, “সাহেব, এখনই ফরমাণ লিখিয়া আনিতে আদেশ করুন।”
সন্ন্যাসী কহিলেন, “জহাঁপনা, আর একটি নিবেদন আছে।”
বাদশাহ্ বলিলেন, “অনুমতি করুন।”
“হুগলীতে যত পর্ত্তুগীজ রমণী বন্দী হইবে তাহাদিগকে রক্ষা করিবার ভার যেন আমার উপর ন্যস্ত হয়।”
“আপনি যাহা ইচ্ছা করিবেন তাহাই হইবে।”
খাসদবীর আসিলেন, ফরমাণ লিখিত হইল, বাদশাহ্ তাহাতে মোহর অঙ্কিত করিলেন। সন্ন্যাসী ফরমাণ পাইয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন। আসফ্ খাঁর আদেশে শায়েস্তা খাঁর চর তাঁহার পশ্চাৎ অনুসরণ করিতে গিয়া নগরমধ্যে সন্ন্যাসীকে আর খুঁজিয়া পাইল না।”
সন্ন্যাসী প্রস্থান করিলে, আসফ্ খাঁ জিজ্ঞাসা করিলেন, “জহাঁপনা, এই কাফের ফকীর কে?”
বাদশাহ্ ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “সাহেব, ইনি কে তাহা বলিতে পারি না। হুগলীতে ফিরিঙ্গি হার্ম্মাদ যখন আমার যথাসর্ব্বস্ব লুঠিয়া লইয়াছিল, তখন এই মহাত্মা আপনার কন্যার ইজ্জৎ রক্ষা করিয়াছিলেন এবং আমার প্রাণ রক্ষা করিয়াছিলেন। অন্য পরিচয় অনাবশ্যক। কাশেম খাঁ, আপনি বাঙ্গালার সুবাদার নিযুক্ত হইলেন, এক বৎসরের মধ্যে সুবা বাঙ্গালা হইতে পর্ত্তুগীজ ফিরিঙ্গি দূর করিতে হইবে।”
কাশেম খাঁ অভিবাদন করিয়া প্রস্থান করিলেন। তখন বাদশাহ, বিকলাঙ্গ বৈষ্ণবের নিকট আসিয়া, তাহার অঙ্গে হস্তাপর্ণ করিয়া কহিলেন, “ফকীর, আমার রাজ্যে বাস করিয়া তুমি অনেক যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছ, তুমি কি চাহ?”
চৈতন্যদাস নয়ন মুদিয়া ছিল, সে নয়ন মেলিয়া কহিল, “মহারাজ, গোবিন্দের মন্দিরপ্রান্তে বাস করিতে চাহি।”
“আর কিছু চাহ না ফকীর?”
“আর কি চাহিব?”
তখন বাদশাহ্ অনামিকা হইতে বহুমূল্য হীরক অঙ্গুরীয়ক খুলিয়া চৈতন্যদাসের হস্তে দিয়া কহিলেন, “ফকীর, এই চিহ্নটি রাখিও, যদি কখন কোন প্রয়োজন হয়, তখন এই চিহ্ন দেখাইও। আমি যখন যে স্থানে থাকিব তোমাকে বাদশাহী কর্ম্মচারিগণ সেই স্থানে লইয়া আসিবে।”
বাদশাহ্ নাল্কীতে আরোহণ করিয়া মহল্সরায় প্রবেশ করিলেন।