মহাভারত (উপক্রমণিকাভাগ)/ঊনত্রিংশ অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

ঊনত্রিংশ অধ্যায়— আস্তীকপর্ব্ব।

উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, এক ব্রাহ্মণ সস্ত্রীক গরুড়ের কণ্ঠে প্রবিষ্ট হইয়। জ্বলন্ত অঙ্গারের ন্যায় দাহ করিতে লাগিলেন। তখন বিহগরাজ তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, হে দ্বিজোত্তম! অমি মুখব্যাদান করিয়াছি, তুমি স্বরায় নির্গত হও; ব্রাহ্মণ সদা পাপ কর্ম্মে রত হইলেও আমার বধ্য নহেন। গরুড়বাক্য শ্রবণ করিয়া ব্রাহ্মণ কহিলেন, আমার ভার্য্যা নিষাদীও আমার সমভিব্যাহারে নির্গত হউক। গরুড় কহিলেন, তুমি নিষাদীকে লইয়া অবিলম্বে বহির্গত হও; বিলম্ব করিলে আমার জঠরানলে ভস্ম হইয়া যাইবে। তখন বিপ্র নিষাদী সহিত নিষ্ক্রান্ত হইয়া গরুড়ের সমুচিত সংবর্ধনা করিয়া স্বাভিমত প্রদেশে প্রস্থান করিলেন।

 এই রূপে সস্ত্রীক বিপ্র নিষ্ক্রান্ত হইলে, বিহগরাজ দুই পক্ষ বিস্তৃত করিয়া অন্তরীক্ষে আরোহণ করিলেন। তিনি কিয়ৎ ক্ষণ পরে নিজ পিতা কশ্যপের দর্শন পাইলেন। কশ্যপ জিজ্ঞাসিলেন, বৎস! তোমার সর্ব্বাঙ্গীন মঙ্গল কি না, আর নরললকে তুমি পর্যাপ্ত ভোজন পাইতেছ কি না। গরুড় কহিলেন, পিতঃ! আমার মাতা ও ভ্রাতা কুশলে আছেন, আর আমিও শারীরিক ভাল আছি, কিন্তু পর্যাপ্ত ভোজন পাই না। সর্পেরা আমাকে অমৃত আহরণে প্রেরণ করিয়াছে, আমি জননীর দাসীভাববিমোচনার্থে অমৃত আহরণ করিব। জননী নিষাদভক্ষণের আদেশ দিয়াছিলেন, আমি তদনুসারে সহস্র সহস্র নিষাদ ভক্ষণ করিয়াছি, কিন্তু ক্ষুধানিবৃত্তি হয় নাই। অতএব, যাহা আহার করিয়া অমৃত আহরণ করিতে পারি, আপনি এরূপ কোনও ভক্ষ্য দ্রব্য নির্দেশ করুন। কশ্যপ কহিলেন, বৎস! সম্মুখে সরোবর অবলোকন করিতেছ, ঐ পবিত্র সরোবর দেবলোকেও বিখ্যাত। তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিতে পাইবে, এক হস্তী অম্মুখে কূর্ম্মরূপী স্বীয় জ্যেষ্ঠ সহোদরকে আকর্ষণ করিতেছে। আমি তাহাদিগের পূর্ব জন্মের বৈরকারণ ও আকারের পরিমাণ সবিস্তর বর্ণন করিতেছি, শ্রবণ কর।

 বিভাবসু নামে অতি ক্রোধাবিষ্ট মহর্ষি ছিলেন। তাহার কনিষ্ঠ সহোদরের নাম সুপ্রতীক। সুপ্রতীকের এরূপ অভিলাষ নহে যে, পৈতৃক ধন অবিভক্ত থাকে; এজন্য তিনি জোষ্ঠের নিকট সর্ব্বদাই বিভাগের কথা উত্থাপন করেন। এক দিন বিভাবসু বিরক্ত হইয়া সুপ্রতীককে কহিলেন, দেখ, অনেকেই মোহন্ধি হইয়া সর্বদাই বিভাগ করিতে বাঞ্ছা করে; কিন্তু বিভক্ত হইয়াই অর্থমোহে বিমোহিত হইয়া পরস্পরে বিরোধ আরম্ভ করে। স্বার্থপর মূঢ় ভ্রাতারা ধনার্থে পৃথগৃভূত হইলে, শত্রুরা মিত্রভাবে প্রবিষ্ট হইয়া তাহাদের মনোভঙ্গ জন্মাইয়া দেয়; এবং ক্রমে ক্রমে ভগ্নস্নেহ হইলে, তাহারা পরস্পরের নিকট পরস্পরের দোষারোপ করিয়া বৈর বৃদ্ধি করিয়া দিতে থাকে; এইরূপ হইলে অবিলম্বেই তাহাদিগের সর্বনাশ ঘটে। এই নিমিত্ত ভ্রাতৃবিভাগ সাধুর্দিগের অনুমোদিত নহে। তুমি নিতান্ত মূঢ় হইয়া ধনবিভাগ প্রার্থনা করিতেছ, কোনও ক্রমেই আমার বারণ শুনিতেছ না; অতএব হস্তিয়োনি প্রাপ্ত হইবে। সুপ্রতীক এই রূপে অভিশপ্ত হইয়া বিভাবসুকে কহিলেন, তুমিও কচ্ছপযযানি প্রাপ্ত হইবে। বুদ্ধিভ্রষ্ট সুপ্রতীক ও বিভাবসু এই রূপে পরস্পরদত্ত শাপ প্রভাবে গজত্ব ও কচ্ছপ প্রাপ্ত হইয়াছে। এক্ষণে তাহারা পশুযযানি প্রাপ্ত হইয়াও রোষদোষ বশতঃ পরস্পর দ্বেষরত এবং শরীরগুরুতা ও বলদৰ্পে দর্পিত হইয়, পূর্ব্ববৈরানুসরণ পূর্ব্বক, এই সবোবরে বস্থিতি করিতেছে। তীরস্থিত গজের শব্দ শুনিতে পাইয়া জলমধ্যবাসী কচ্ছপ সমস্ত সরোবর আলোড়িত করিয়া উখিত হইয়াছে, এবং মহাবীর্য গজও কচ্ছপকে উত্থিত দেখিয়া ও কুণ্ডলীকৃত করিয়া জলে অবতীর্ণ হইয়াছে; তদীয় দন্ত, শুণ্ড, লাঙ্গল ও পদচতুষ্টয়ের বেগে সবোবর বিচলিত হইয়াছে, কচ্ছপও মস্তক উদ্যত করিয়া যুদ্ধার্থে সম্মুখীন হইয়াছে। গজের আকার ছয় যোজন উন্নত ও দ্বাদশ যোজন বিস্তৃত; কচ্ছপ তিন যোজন উন্নত, তাহার শরীরের মণ্ডল দশযোজনপ্রমাণ। উহারা পরস্পর প্রাণবধে কৃতসংকল্প হইয়া যুদ্ধোন্মত্ত হইয়াছে; তাহাদিগকে ভক্ষণ করিয়া কার্য সাধন কর।

 কশ্যপ গরুড়কে ইহা কহিয়া এই আশীর্ব্বাদ করিতে লাগিলেন, দেবতাদিগের সহিত যুদ্ধকালে তোমার মঙ্গল হউক; আর পূর্ণকুশু, গো, ব্রাহ্মণ ও আর যে কিছু মঙ্গলকর বস্তু আছে, সে সমস্ত তোমার শুভদায়ক হউক। হে মহাবল পরাক্রান্ত! যৎকালে তুমি দেবতাদিগের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইবে, তখন ঋক, যজুঃ, সাম, এই ত্রিবিধ বেদ, পবিত্র যজ্ঞীয় হবিঃ, সমস্ত রহস্যশাস্ত্র ও সমস্ত বেদ, তোমার বলাধান করিবেন। গরুড় পিতার আশীর্বাদ শ্রবণ করিয়া তৎক্ষণাৎ তথা হইতে প্রস্থান করিলেন, এবং অনতিদূরে সেই নির্মল সলিলপূর্ণ পক্ষিকুলসমাকুল হ্রদ দেখিতে পাইলেন। অনন্তর পিতৃবাক্য স্মরণ পূর্ব্বক এক নখে গজ ও অপর নখে কচ্ছপ গ্রহণ করিয়া আকাশমণ্ডলে অধিৱেহণ করিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে অলম্বনামক তীর্থে উপস্থিত হইয়া দেবৃক্ষগণের উপরি আরোহণের উপক্রম করিলে, তাহারা তদীয় পক্ষপবনে আহত হইয়া সাতিশয় কম্পিত হইল, এবং এই আশঙ্কা করিতে লাগিল, পাছে গরুড়ভরে ভগ্ন হই। গরুড়, সেই অভিলষিতফুল প্রদ দেবমদিগকে ভঙ্গভয়ে কম্পিত দেখিয়া, অন্যান্য অতি প্রকাণ্ড বৃক্ষ সমীপে উপস্থিত হইলেন। ঐ সমস্ত মহাম কাঞ্চনময় ও রজতময় ফলে পরিপূর্ণ ও সতত সাতিশয় শোভমান; তাহাদের শাখা সকল প্রবালকল্পিত, মুলদেশ অনবরত সাগরসলিলে ক্ষালিত হইতেছে। তন্মধ্যে অত্যুচ্চ অতি প্রকাণ্ড বটবৃক্ষ গরুড়কে প্রবল বেগে আগমন করিতে দেখিয়া কহিল, অহে বিহগরাজ! তুমি আমার এই শতযোজনবিস্তৃত মহাশাখায় অবস্থিত হইয়া গজ ও কচ্ছপ ভক্ষণ কর।পৰ্বততুল্যকলের বেগবান্ বিনতাতনয়ের স্পর্শমাত্র, বহুসহস্রবিহগসেবিত বটবৃক্ষ বিচলিত ও সেই নির্দিষ্ট শাখ। ভগ্ন হইল।