মহাভারত (উপক্রমণিকাভাগ)/ঊনবিংশ অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

ঊনবিংশ অধ্যায়— আস্তীকপর্ব্ব।

উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, তদনন্তর সমুদায় দৈত্য দানব ঐকমত্য অবলম্বন পূর্বক নানাবিধ অস্ত্র শস্ত্র হস্তে লইয়া দেবতাদিগকে আক্রমণ করিল। মহাবীর্য ভগবান্ বিষ্ণু, নরদেৰ সমভিব্যাহারে দানবেন্দ্রদিগের নিকট হইতে অমৃত হরণ করিলেন। দেবগণ বিষ্ণুর নিকট হইতে অমৃত প্রাপ্ত হইয়া সৃষ্ট চিত্তে পান করিতে বসিলেন। দেবতারা অমৃত পান আর করিলে, রাহু নামে এক ধূর্ত্ত দানব অবসর বুঝিয়া দেবরূপ পরিগ্রহ পূর্বক ঐ সমভিব্যাহারে অমৃত পান করিল। অমৃত দানবের কণ্ঠদেশ মাত্র গমন করিয়াছে, এমন সময়ে চন্দ্র ও সূর্য দেবতাদিগের হিতার্থে ঐ গূঢ় ব্যাপার ব্যক্ত করিয়া দিলেন। ভগবান্ চক্রপাণি সুদর্শন চক্র দ্বারা দানবের শিরচ্ছেদন করিলেন। রাহুর শৈশৃঙ্গসম চক্রচ্ছিন্ন প্রকাণ্ড মস্তক তৎক্ষণাৎ নভোমণ্ডলে আরোহণ করিয়া অতি ভয়ঙ্কর শব্দ করিতে লাগিল। অবশেষে তাহার কবন্ধ, সবন, সপর্বত, সদ্বীপ, মহীমণ্ডল কম্পিত করিয়া, ভূতলে পতিত হইল। তদবধি চন্দ্র ও সূর্যের সহিত রাহুমুখের চিরন্তন বৈরনির্বন্ধ হইল। এই নিমিত্তই ঐ মুখ অদ্যাপি তাঁহাদিগকে মধ্যে মধ্যে গ্রাস করিয়া থাকে। ভগবান্ নারায়ণ নিরুপম নারীরূপ পরিহার করিয়া নানাবিধ আয়ুধ ধারণ পুর্ব্বক দানবদল আক্রমণ করিলেন।

 তদনন্তর লৰণার্ণবতীয়ে দেবদানবদলের খোতর সমর আর হইল। সহস্র সহস্র তীক্ষাগ্র প্রাস তোমর প্রভৃতি বিবিধ শস্ত্র সমস্ততঃ পতিত হইতে লাগিল। অসুরগণ খড়গ চক্র শক্তি গদ প্রভৃতি শাঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হইয়া শশাণিত বমন করিতে করিতে ভূতুলশায়ী হইল। তাহাদিগের তপ্তকাঞ্চনশোভিত মস্তক সকল অতি দারুণ পট্টিশপ্রহারে কলেবর হইতে পৃথভূত হইয়া অনবরত ধরাতলে পতিত হইতে লাগিল। সমরনিহত মহাসুরগণ রুধিরলিপ্তকলেবর হইয়া ধাতুরাগরঞ্জিত গিরিশিখরের ন্যায় ভূশয্যায় শয়ন করিল। পরস্পর শস্ত্র প্রহার দ্বারা রণক্ষেত্রে হাহ রব উথিত হইল। দূর হইতে লৌহময় তীক্ষ্ণ পরিঘের আঘাত ও সন্নির্ষে মুষ্টি প্রহার ইত্যাদি প্রকারে রণপ্রবৃত্ত দেবদানবদলের কোলাহল নভোমণ্ডল ব্যাপ্ত করিল। চারি দিকে কেবল ছিন্ধি, ভিন্ধি, ঘাতয়, পাতয় ইত্যাদি ঘোতর শব্দ শ্রত হইতে লাগিল।

 এই রূপে মহাভয়দায়ী তুমুল সংগ্রাম আরম্ভ হইলে, নর ও নারায়ণ যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হইলেন। ভগবান্ নারায়ণ, নরদেবের দিব্য ধনু অবলোকন করিয়া, দানবকুলবিলয়কারী স্বীয় চক্র স্মরণ করিলেন। সেই অরাতিনিপাতন, সূর্য্যসমপ্রভ, অপ্রতিহত প্রভাব, ভীষণমূর্ত্তি সুদর্শন চক্র স্মৃতমাত্র অন্তরীক্ষ হইতে অবতীর্ণ হইল। করিক দীর্ঘবাহু ভগবা, প্রজ্বলিতহুতাশনসম, পরপুরাবদারণ, মহাপ্রভ, চক্র বিপক্ষদলে প্রক্ষেপ করিলেন। ভগবৎপ্রেরিত চক্র মহাবেগে গমন করিয়া সহস্র সহস্র দৈত্য দানব সংহার করিল; কোনও স্থলে অতি প্রদীপ্ত দহনের ন্যায় প্রজ্জ্বলিত হইয়া অসুরদল নিপাত করিল; কোনও স্থলে ভূতলে ও নভোমণ্ডলে বিচরণ পূর্ব্বক পিশাচের ন্যায় তাহাদের শোণিত পনি করিতে লাগিল।

 নবজলধরকলেবর মহাবল পরাক্রান্ত অসুরেরাও গিরি নিক্ষেপ দ্বারা দেবদল দলন করিতে আরম্ভ করিল। তখন আকাশমণ্ডল হইতে অতি প্রকাণ্ড ভয়ানক ভূধর সকল পরম্পরাভিঘাত পূর্বক বহুবিধ জলধরের ন্যায় সমস্ততঃ পতিত হইতে লাগিল। এইরূপ অবিরত অদ্রিপাতে অভিহতা হইয়া সন্দ্বীপ সকাননা পৃথিবী বিচলিত হইল। তখন নরদেব স্বর্ণমুখ শিলীমুখ[১] সমূহ দ্বারা অসুরবিক্ষিপ্ত গিরিসমূহের শিখর বিদারণ পূর্বক গগনমণ্ডল আচ্ছন্ন করিলেন। মহাবল পরাক্রান্ত দুর্দান্ত অসুরদল ভগ্নল হইয়া ও নভোমণ্ডলে প্রজ্বলিতহুতাশনসম, সুদর্শনচক্রকে পরিকুপিত অবলোকন করিয়া ভয়ে ভূমধ্যে ও লবণার্ণবগর্ভে প্রবেশ করিল।

 দেবতারা এই রূপে জয় প্রাপ্ত হইয়া সমুচিতসৎকারবিধান পূর্বক মন্দর গিরিকে পূর্ব স্থানে স্থাপিত করিলেন। জলধরেরাও গগনমণ্ডল ও স্বর্গলোক নিনাদিত করিয়া যথাগত প্রতিগমন করিল। তদনন্তর দেবতারা আনন্দসাগরে মগ্ন হইয়া সেই অমৃতভাণ্ড সুরক্ষিত করিয়া নারায়ণের নিকট নিহিত করিলেন।

  1. বাণ।