মহাভারত (উপক্রমণিকাভাগ)/অষ্টপঞ্চাশ অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টপঞ্চাশ অধ্যায়—আস্তীকপর্ব্ব।

উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, রাজা জনমেজয় আস্তীককে এই রূপে বরদানে উদ্যত হইলে, আমরা তাঁহার আর এই এক অদ্ভুত ব্যাপার শ্রবণ করিয়াছি। নাগরাজ তক্ষক ইন্দ্রহস্ত হইতে চ্যুত হইয়া নভোমণ্ডলেই থাকিল। তখন রাজা জনমেজয় অত্যন্ত চিন্তান্বিত হইলেন। ভয়ার্ত্ত তক্ষক সেই বিধি পূর্ব্বক হুত প্রদীপ্ত যজ্ঞীয় হুতাশনে পতিত হইল না। শৌনক কহিলেন, হে সুনন্দন! মনীষাসম্পন্ন ব্রাহ্মণদিগের মন্ত্র সকল কি নিস্তেজ হইয়াছিল, যে তক্ষক অগ্নিতে পতিত হইল না। উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, পন্নগরাজ ইন্দ্রহস্ত হইতে চ্যুত ও বিচেতন হইয়া পতিত হইতেছে, এমন সময়ে আস্তীক, তিষ্ঠ তিষ্ঠ, এই বাক্য তিন বার উচ্চারণ করিলেন, এবং তক্ষকও উদ্বিগ্ন চিত্তে অন্তরীক্ষে অবস্থিত হইল। তখন, রাজা সদস্যগণের উপদেশবশবর্তী হইয়া কহিলেন, অস্তীক যাহা কহিলেন, তাহাই হউক, এই কর্ম্ম সমাপিত হউক, নাগগণ নিরাপদ্ হউক, আস্তীক প্রীত হউন, এবং সূতের বাক্য সত্য হউক।

 রাজা আস্তীককে বর প্রদান করিবামাত্র, চারি দিকে প্রীতিপূর্ণ কোলাহল উখিত হইল, সর্পসত্র নিবৃত্ত হইল, ভরতকুলতিলক রাজা জনমেজয় প্রীতি প্রাপ্ত হইলেন, যে সমস্ত ঋত্বিক্ ও সদস্যগণ সেই সর্পসত্রে সমাগত হইয়াছিলেন, রাজা তাঁহাদিগকে অপর্য্যাপ্ত অর্থ প্রদান করিলেন, আর যে লোহিতনয়ন সূত যজ্ঞায়তননির্ম্মাণকালে কহিয়াছিলেন যে, এক ব্রাহ্মণকে উপলক্ষ করিয়া সর্পসত্র রহিত হইবেক, প্রীত হইয়া তাঁহাকেও প্রভূত অর্থ, অন্যান্য নানা দ্রব্য, এবং অন্ন বস্ত্র দান করিলেন। তদনন্তর যথাবিধি অবভূথক্রিয়া[১] সম্পাদন করিলেন। পরে প্রীত মনে যথোচিত সৎকার করিয়া কৃতকৃত্য মহাত্মা আস্তীককে স্বগৃহে প্রেরণ করিলেন, এং তাঁহার প্রস্থানকালে কহিলেন, ভগবন্! পুনর্ব্বার যেন আপনকার আগমন হয়। যৎকালে আমি অশ্বমেধ মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিব, আপনাকে সেই যজ্ঞে সদস্য হইতে হইবেক।

 আস্তীক, এই রূপে স্বকার্য্যসাধন ও রাজার সন্তোষসম্পাদন করিয়া, তথাস্তু বলিয়া হৃষ্ট চিত্তে স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন, এবং পরম প্রীত মনে মাতুলের ও জননীর সন্নিধানে গমন পূর্ব্বক, তদীয় পাদবন্দন করিয়া আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত নিবেদন করিলেন। যে সমস্ত নাগ সেই স্থানে উপস্থিত ছিল, শ্রবণমাত্র তাহাদের শোক ভয় ও মোহ দূর হইল। তাহারা সাতিশয় প্রীত হইয়া আস্তীককে কহিল, বৎস! অভিলষিত বর প্রার্থনা কর। তাহারা চারি দিক হইতে ভূয়োভূয়ঃ ইহাই কহিতে লাগিল, হে বিদ্বন্! আমরা তোমার কি প্রিয় কর্ম্ম করিব বল আমরা পরম প্রীত হইয়াছি, তুমি আমাদের সকলকে ঘোর বিপদ হইতে মুক্ত করিয়াছ; বৎস! আমরা তোমার কি অভীষ্ট সম্পাদন করিব বল। অস্তীক কহিলেন, যে সকল ব্রাহ্মণ অথবা অন্যান্য মানবগণ প্রসন্ন মনে সায়ং ও প্রাতঃকালে আমার এই উপাখ্যান পাঠ করিবেক, এই বর দাও, যেন তোমাদের হইতে তাহাদিগের কোনও ভয় থাকে না। নাগগণ প্রীত ও প্রসন্ন হইয়া কহিল, হে ভাগিনেয়। তুমি যে প্রার্থনা করিলে, আমরা প্রীত চিত্তে নিঃসন্দেহ তাহা সম্পাদন করিব।

 যে ব্যক্তি দিবাভাগে অথবা রাত্রি কালে অসিত, আর্ত্তিমান, ও সুনীথকে স্মরণ করিবে, তাহার সর্পভয় থাকিবে না। মহাভাগ নাগগণ! যে মহাযশস্বী মহাপুরুষ মহর্ষি জরৎকারুর ঔরসে নাগভগিনী জরৎকারুর গর্ভে জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন, এবং যিনি জনমেজয়ের সর্পসত্রে তোমাদিগের রক্ষা করিয়াছেন, আমি তাঁহাকে স্মরণ করিতেছি; অতএব তোমাদের আমাকে হিংসা করা উচিত নহে। হে মহাবিষ সর্প! অপসৰ্পণ কর, তোমার মঙ্গল হউক, চলিয়া যাও, জনমেজয়ের যজ্ঞান্তে আস্তীক যে বাক্য কহিয়াছিলেন, তাহা স্মরণ কর। যে সর্প আস্তীকবাক্য শুনিয়া নিবৃত্ত না হয়, তাহার মস্তক শিংশবৃক্ষফলের ন্যায় শত খণ্ডে বিদীর্ণ হইয়া যায়।

 উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, দ্বিজেন্দ্র আস্তীক সমাগত ভুজগগণ কর্ত্তৃক এই প্রকার উক্ত হইয়া, পরম প্রীতি প্রাপ্ত ও গমনাভিলাষী হইলেন। তিনি ভুজগগণকে সর্পসত্রভয় হইতে মুক্ত করিয়া পুত্র পৌত্র রাখিয়া যথাকালে কাল প্রাপ্ত হইলেন। হে ঋষিপ্রবর! আমি আপনার নিকট আস্তীকের উপাখ্যান যথাবৎ কীর্ত্তন করিলাম। এই উপাখ্যান কীর্ত্তন করিলে কখনও সপর্ভয় থাকে না। হে ভৃগুকুলাবতংস! আপনকার পূর্ব্ব পুরুষ ভগবান্ প্রমতি, স্বীয় পুত্র রুরু কর্ত্তৃক জিজ্ঞাসিত হইয়া, প্রীতিপ্রফুল্ল চিত্তে অস্তীকের পরম পবিত্র চরিত্র যেরূপ কীর্ত্তন করিয়াছিলেন, এবং আমিও তাঁহার নিকট যেরূপ শুনিয়াছিলাম, আপনকার নিকট আদ্যোপান্ত অবিকল বর্ণন করিলাম। আপনি ডুণ্ডুভবাক্য শ্রবণ করিয়া আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, আস্তীকের সেই পরমপবিত্র ধর্ম্মময় আখ্যান শ্রবণ করিলেন, এক্ষণে আপনকার অতি মহৎ কৌতূহল নিবৃত্ত হউক।

  1. যদি কোনও অংশে ন্যূনতা ঘটিয়া থাকে, এই আশঙ্কা করিয়া সম্ভাবিত ন্যূনতার পরিহারার্থে যে যজ্ঞ করিয়া প্রধান যজ্ঞের সমাপন করে, তাহার নাম অবভূথ।