মহাভারত (উপক্রমণিকাভাগ)/ঊনপঞ্চাশ অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

ঊনপঞ্চাশ অধ্যায়— আস্তীকপর্ব্ব।

শৌনক কহিলেন, রাজা জনমেজয় নিজ মন্ত্রীদিগকে আত্মপিতার স্বর্গারোহণ বিষয়ে যাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, তাহা তুমি আমার নিকট পুনর্বার সবিস্তর বর্ণন কর। উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, হে ব্রহ্মন্! রাজ। মন্ত্রীদিগকে যেরূপ জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, এবং মন্ত্রীরা পরীক্ষিতের পরলোেকপ্রাপ্তির বিষয় যেরূপ বর্ণন করিয়াছিলেন, শ্রবণ করুন। জনমেজয় কহিলেন, হে অমাত্যগণ! আমার ভুবনবিখ্যাত অভিযশস্বী পিতা কালবশ হইয়া যে রূপে নিধন প্রাপ্ত হইয়াছেন, তাহা তোমরা সবিশেষ জান, এক্ষণে তোমাদিগের নিকট পিতৃবৃত্তান্ত আদ্যোপান্তু শ্রবণ করিয়া তদীয় হিতসাধনে যত্নবান্ হইব, কিন্তু তদুপলক্ষে কদাচ অন্যের অহিচরণ করিব না।

 ধর্ম্মবেত্তা প্রজ্ঞাগুণসম্পন্ন মন্ত্রিগণ, মহাঙ্গা নৃপতিকর্ত্তৃক ক এই রূপে জিজ্ঞাসিত হইয়া, নিবেদন করিলেন, মহারাজ! আপনকার মহাত্মা রাজাধিরাজ পিতার যেরূপ চরিত্র ছিল 'ও যে রূপে তাঁহার লোকাত্তর প্রাপ্তি হয়, তৎসমুদায় শ্রবণ করুন। আপনকার ধর্মাত্মা মহাত্মা প্রজাপালনতৎপর পিতা যাদৃশ গুণসম্পন্ন ছিলেন, তাহা বর্ণন করিতেছি। সেই ধর্ম্মবো রাজা মুর্তিমান্ ধর্ম্মের স্যায় ধর্ম্মতঃ প্রজাপালন করিয়াছিলেন। ভঁহাজধকারকালে চারি বর্ণ স্ব স্ব ধর্ম্মে রত ছিল। সেই অতুলবিক্রমশালী মান্ ভূপতি পৃথ্বীদেবীকে ন্যায়ানুসারে রক্ষা করিয়াছিলেন। তাঁহার কেহ দ্বেষ্টা ছিল না, তিনিও কাহারও দ্বেষ করিতেন না, প্রজাপতির ন্যায় সর্ব ভূতে সমদর্শী ছিলেন। তদীয় অপ্রতিহত শাসনপ্রভাবে ব্রাহ্মণ, ক্ষক্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র স্ব স্ব কর্ম্মে রত ছিল। তিনি বিধবা, অনাথ, বিকলাঙ্গ, ও দীন দরিদ্র গণের ভরণ পোষণ করিতেন। সেই সত্যবাদী, দৃঢ়বিক্রম, সর্বতোষক, সর্ব্বপোষক, শ্রীমান্ রাজা দ্বিতীয় শশধরের ন্যায় সর্ব ভূতের নয়নরঞ্জন ও সর্ব্বলোকপ্রিয় ছিলেন। তিনি শারদ্বতের নিকট ধনুর্বেদ শিক্ষা করেন, কৃষ্ণের অতি প্রিয় ছিলেন। কুরুকুল পরিক্ষীণ হইলে, অভিমন্যুর ঔরসে উত্তরার গর্ভে তাঁহার জন্ম হয়, এই নিমিত্ত তাহার নাম পরীক্ষিৎ। তিনি রাজধর্ম্মনিপুণ, সর্বগুণসম্পন্ন, জিতেন্দ্রিয়, মনস্বী, মেধাবী, ধর্ম্মপরায়ণ, ষড়বর্গ[১] জয়ী, মহাবুদ্ধি, ও অদ্বিতীয় নীতিশাস্ত্রবেত্তা ছিলেন; ষাটি বৎসর[২]প্রজাপালন করেন। পরে সকলকে দুঃখাবে নিক্ষিপ্ত করিয়া পরলোকযাত্রা করিয়াছেন। তদনন্তর আপনি সহস্র বৎসরের এই কুলক্রমাগত রাজ্য ধর্ম্মত প্রাপ্ত হইয়াছেন; আপনি শৈশব কালেই অভিষিক্ত হইয়া সর্বভূতের পালন করিতেছেন।

 জনমেজয় কহিলেন, ধর্ম্মপরায়ণ পূর্ব্বপুরুষদিগের চরিত্র অনুশীলন করিয়া বোধ হইতেছে, এই কুলে কোনও কালে এমন আস্তীকপর্ব। রাজা হয়েন নাই যে, তিনি প্রজাদিগের প্রিয় ও হিতকারী ছিলেন না। আমার পিতা তথাবিধ রাজা হইয়া কেন অকালে কালগ্রাসে পৱিক্ষিপ্ত হইলেন বল, আমি আদ্যোপান্ত অবিকল শুনিতে বাসনা করি। প্রিয়কারী হিতৈষী মন্ত্রিগণ এই রূপে জিজ্ঞাসিত হইয়া পরীক্ষিতের মৃত্যুবৃত্তান্ত যথাবৎ বর্ণন করিতে আরম্ভ করিলেন। মন্ত্রিগণ কহিলেন, মহারাজ! আপনকারু পিতা রাজাধিরাজ পাণ্ডুর ন্যায় শস্ত্রবিদ্যায় অদ্বিতীয় ও সতত মৃগয়াশীল ছিলেন। একদা, তিনি আমাদিগের হস্তে সমস্ত সাম্রাজ্যের ভার সমর্পণ করিয়া মৃগয়ায় গিয়াছিলেন। অরণ্যে প্রবেশ করিয়া শর দ্বারা এক মৃগ বিদ্ধ করিলেন। বিদ্ধ মৃগ পলায়ন করিল। রাজা তৎপশ্চাৎ ধাবমান হইলেন, কিন্তু পলায়িত মৃগকে আর দেখিতে পাইলেন না। তিনি ষষ্টিবর্ষবয়স্ক ও জরাগ্রস্ত হইয়াছিলেন, এজন্য ত্বরায় পরিশ্রান্ত ও ক্ষুধা হইলেন। সেই নিবিড় অরণ্যে এক মুনি মৌনব্রত অবলম্বন পূর্বক সমাধি করিতেছিলেন, রাজা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন। মুনি কিছুই উত্তর দিলেন না। রাজা অত্যম্ভ ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত ছিলেন, মুনিকে মৌমাবলম্বী দেখিয়া তৎক্ষণাৎ রোষবশ হইলেন। তিনি তাঁহাকে মৌনব্রতী বলিয়া জানিতেন না, এই নিমিত্ত্ব কোপাবিষ্ট হইয়া, অটনী দ্বারা ধরাতল হইতে এক মৃত সর্প উদ্ধৃত করিয়া, সেই শুদ্ধচিত্ত ঋষির স্কন্ধে নিক্ষিপ্ত করিলেন। ঋষি এই রূপে অবমানিত হইয়াও কুপিত হইলেন না, রাজাকে ভাল মন্দ কিছুই বলিলেন না, স্কন্ধে মৃত সর্প ধারণ পূর্ব্বক অবস্থিতি করিতে লাগিলেন।

  1. কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য্য।
  2. রাজা পরীক্ষিৎ ষাটি বৎসর বয়সে তক্ষকের দংশনে প্রাণত্যাগ করেন, সুতরাং তাঁহার ষাটি বৎসর প্রজাপালন সম্ভব ও সঙ্গত হয় টীকাকার নীলকণ্ঠ কহেন, মূলে যে ষাটি বৎসর নির্দেশ আছে, তাহা জন্ম অবধি গণনা অভিপ্রায়ে, রাজ্যলাভাবধি গুণনা অভিপ্রায় নহে, কারণ পরীক্ষিৎ ছাব্বিশ বৎসর বয়সে রাজ্যলাভ করিয়া চব্বিশ বৎসর মাত্র প্রজাপালন করেন।