মহাভারত (উপক্রমণিকাভাগ)/একষষ্টিতম অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

একষষ্টিতম অধ্যায়—ভারতসূচনা।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, প্রথমতঃ গুরুদেবকে ভক্তি শ্রদ্ধা সহকারে একাগ্র চিত্তে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিয়া এবং সমস্ত ব্রাহ্মণগণ ও অন্যান্য বিদ্বান ব্যক্তিদিগের সম্মান ও সৎকার করিয়া, সর্ব্বলোকবিখ্যাত ধীমান্ মহর্ষি ব্যাসদেবের অশেষ মত বর্ণন করিব। মহারাজ! আপনি এই ভারতীয় কথা শ্রবণের যোগ্য পাত্র, এবং গুরুদেবের আদেশ পাইয়া আমারও এই মহতী কথার কীর্ত্তনে উৎসাহ জন্মিতেছে।

 মহারাজ! শ্রবণ করুন। রাজ্যের নিমিত্ত দ্যূতক্রীড়া দ্বারা যে রূপে কৌরব ও পাণ্ডবদিগের আত্মবিচ্ছেদ, পাণ্ডবদিগের বনবাস ও সর্ব্বসংহারকারী সংগ্রাম ঘটিয়াছিল, তাহা আমি আপনার নিকট বর্ণন করিব। যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চ বীর, পিতার পরলোক প্রস্থানের পর, অরণ্য হইতে আলয়ে প্রত্যাগমন করিলেন, এবং অচিরকালমধ্যেই বেদে ও ধনুর্ব্বেদে কৃতবিদ্য হইয়া উঠিলেন। কৌরবেরা পাণ্ডবদিগকে এইরূপ শ্রী, কীর্ত্তি, রূপ, বল, বীর্য্য ও ঔদার্য্য সম্পন্ন এবং পুরবাসিগণের প্রিয় দেখিয়া অত্যন্ত ঈর্ষাপরবশ হইলেন। ক্রুরস্বভাব দুর্য্যোধন, কর্ণ ও সৌবল, একমতাবলম্বী হইয়া, পাণ্ডবদিগের নানা নিগ্রহ করিতে ও তাঁহাদিগের উপর যৎপরোনাস্তি অত্যাচার করিতে আরম্ভ করিল। পাপাত্মা দুর্য্যোধন ভীমকে অন্নের সহিত বিষপান করাইয়াছিল; কিন্তু ভীম তাহা জীর্ণ করিয়াছিলেন। ভীম গঙ্গাতটে নিদ্রিত ছিলেন, দুরাত্মা দুর্য্যোধন সেই অবস্থায় তাঁহাকে বন্ধ করিয়া গঙ্গাপ্রবাহে প্রক্ষেপ পূর্ব্বক গৃহে আসিয়াছিল। পরে কুন্তীনন্দন জাগরিত হইয়া বাহুবলে বন্ধনচ্ছেন পূর্বক গঙ্গাপ্রবাহ হইতে উত্থান করেন। একদা ভীমকে নিদ্রিত দেখিয়া, দুর্য্যোধন অতি তীক্ষ্ণবিষ কৃষ্ণসর্প দ্বারা তাঁহার সর্বাঙ্গে দংশন করায়, তথাপি তাঁহার প্রাণনাশ হয় নাই।

 এই রূপে দুর্য্যোধন পাণ্ডবদিগের যে সকল নিগ্রহ করিত, মহামতি বিদুর তৎপ্রতীকার ও তৎসমুদায় হইতে তাহাদের রক্ষণবিষয়ে সতত অবহিত ছিলেন। স্বর্গবাসী দেবরাজ ইন্দ্র যেমন জীবলোকের সুখপ্রদ, বিদুর পাণ্ডবদিগের নিয়ত সেইরূপ সুখপ্রদ ছিলেন।

 যখন দুরাত্মা দুর্য্যোধন, কি গুপ্ত কি প্রকাশিত, কোনও উপায়েই পাণ্ডবদিগের বিনাশ করিতে পারিল না, তখন কর্ণ দুঃশাসন প্রভৃতি সচিবগণের সহিত মন্ত্রণা করিয়া এবং ধৃতরাষ্ট্রের অনুজ্ঞা লইয়া জতুগৃহ নির্ম্মাণ করাইল। পুত্রের চিত্তরঞ্জনকারী রাজা ধৃতরাষ্ট্র রাজ্যভোগাভিলাষে পাণ্ডবদিগকে নির্ব্বাসিত করিলেন। তাঁহারা পঞ্চ ভ্রাতা ও জননী ছয় জনে হস্তিনাপুর হইতে প্রস্থান করিলেন। মহাপ্রাজ্ঞ বিদুর মহাশয় প্রস্থানকালে তাঁহাদের মন্ত্রিস্বরূপ হইয়াছিলেন; তাহারই মন্ত্রণাপ্রভাবে তাঁহারা নিশীথ সময়ে জতুগৃহদাহ হইতে মুক্ত হইয়া বন প্রস্থান করিতে পারিয়াছিলেন। পাণ্ডবেরা বারণাবতনগরে উপস্থিত হইয়া জননীসহিত অথায় অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। তাঁহারা ধৃতরাষ্ট্রের আদেশানুসারে, অত্যন্ত সাবধান ও সতর্ক হইয়া, জতুগৃহে সংবৎসর বাস করিলেন। অনন্তর বিদুরের উপদেশ ক্রমে প্রথমতঃ সুরঙ্গ প্রস্তুত করিলেন; পরে সেই জতুগৃহে অগ্নি প্রদান করিয়া এবং দুরাচার পুরোচনকে দগ্ধ করিয়া জননীসহিত গুপ্ত ভাবে পলায়ন করিলেন।

 কিয়ৎ দূর গমন করিয়া পাণ্ডবেরা এক বননির্ঝর সমীপে হিড়িম্বনামক এক মহাভয়ানক রাক্ষস দেখিতে পাইলেন, এবং ঐ রাক্ষসরাজের প্রাণবধ করিয়া প্রকাশভয়ে তথা হইতে পলায়ন করিলেন। ভীমসেন এই স্থলে হিড়িম্বা রাক্ষসীর পাণিগ্রহণ করেন। এই হিড়িম্বার গর্ভে ঘটোৎকচের জন্ম হয়। অনন্তর পাণ্ডবেরা একচক্রানামক নগরীতে উপস্থিত হইলেন, এবং ব্রহ্মচারিবেশ পরিগ্রহ পূর্ব্বক বেদাধ্যয়নরত ও ব্রতপরায়ণ হইয়া, কিছু কাল এক ব্রাহ্মণের আলয়ে অবস্থিতি করিলেন। তথায় এক মহাবল পরাক্রান্ত বকনামক ভয়ানক ক্ষুধার্ত্ত রাক্ষস ছিল; মহাবাহু ভীমসেন তাহার নিকটে গিয়া, নিজ বাহুবীর্য্য প্রভাবে তাহার প্রাণবধ করিয়া, নগরবাসীদিগের ভয় নিরাকরণ ও শোক নিবারণ করিলেন।

 কিয়ৎ দিন পরে পাণ্ডবেরা শ্রবণ করিলেন, পাঞ্চালদেশে দ্রৌপদী নামে এক কন্যা স্বয়ংবরা হইয়াছেন। স্বয়ংবরবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া তাঁহার তথায় গমন করিলেন, এবং দ্রৌপদী লাভ করিয়া সংবৎসর কাল পাঞ্চালদেশে অবস্থান করিলেন। অনন্তর তাঁহাদিগকে সকলে পাণ্ডব বলিয়া জানিতে পারিতে, পুনর্ব্বার তাঁহারা হস্তিনাপুর প্রত্যাগমন করিলেন।

 রাজা ধৃতরাষ্ট্র ও ভীষ্মদেব পাণ্ডবদিগকে কহিলেন, হে বৎসগণ! কিসে তোমাদিগের ভ্রাতৃবিরোধ না হয়, এই বিষয় বিবেচনা করিয়া আমরা স্থির করিয়াছি, তোমাদিগকে খাণ্ডবপ্রস্থে বাস করিতে হইবেক; অতএব তোমরা খাণ্ডবপ্রস্থ প্রস্থান কর। ঐ নগর পরম রমণীয়, বাসের উপযুক্ত স্থান। তাঁহারা, তাঁহাদিগের দুই জনের বচনানুসারে, আপনাদিগের সমুদায় সম্পত্তি গ্রহণ পূর্ব্বক সমস্ত সুহৃজ্জন সমভিব্যাহারে খাণ্ডবপ্রস্থ প্রস্থান করিলেন।

 পাণ্ডবের তথায় বহু বৎসর বাস করিলেন, এবং শস্ত্রবলপ্রভাবে অন্যান্য নরপতিদিগকে বশীভূত করিলেন। এই রূপে তাঁহারা ধর্ম্মনিষ্ঠ, সত্যব্রতপরায়ণ, সর্ব্ব বিষয়ে সাবধান ও ক্ষমাশীল হইয়া অনেকানেক বিপক্ষগণকে বশীভূত করিতে লাগিলেন। মহাযশস্বী ভীমসেন পূর্ব্ব দিক্‌ জয় করিলেন, মহাবীর অর্জ্জুন উত্তর দিক্, নকুল পশ্চিম দিক্, বিপক্ষপক্ষক্ষয়কারী সহদেব দক্ষিণ দিক্ জয় করিলেন। এই রূপে তাঁহারা সকলে সমস্ত পৃথিবীকে আপনাদিগের বশীভূত করিলেন। সূর্য্যদেব স্বভাবতঃ সতত বিরাজমান আছেন, এক্ষণে যথার্থ বিক্রমশালী পঞ্চ পাণ্ডব সূর্য্যদেবের ন্যায় বিরাজমান হওয়াতে, পৃথিবী ষট্‌সূর্য্যসম্পন্নার ন্যায় হইল।

 অনন্তর, যথার্থবিক্রমশালী তেজস্বী ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির, কোনও প্রয়োজনবশতঃ প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয়, পুরুষশ্রেষ্ঠ, স্থিরমতি, সর্ব্বগুণালঙ্কৃত অর্জুনকে বনপ্রেরণ করিলেন। তিনি পূর্ণ সংবৎসর ও এক মাস বনবাস করিয়া, কৃষ্ণের সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত, দ্বারকা গমন করিলেন। তথায় তিনি বাসুদেবের অনুজা রাজীবলোচনা মধুরভাষিণী সুভদ্রার পাণিগ্রহণ করিলেন। যেমন ইন্দ্রের শচী, নারায়ণের লক্ষী, সেইরূপ সুভদ্রা পাণ্ডুনন্দন অর্জুনের সহধর্ম্মিণী হইলেন।

 কুন্তীতনয় অর্জ্জুন, বাসুদেবের সহায়তা প্রাপ্ত হইয়া, খাণ্ডবদাহে হব্যবাহনের তৃপ্তি সম্পাদন করিলেন। বাসুদেব সহায় থাকাতে খাণ্ডবদাহ অর্জ্জুনের কষ্টসাধ্য হইল না। অগ্নি প্রীত হইয়া অর্জ্জুনকে ধনুঃশ্রেষ্ঠ গাণ্ডীব অক্ষয়বাণপুর্ণ দুই তুণ, এবং কপিধ্বজরথ প্রদান করিলেন। অর্জ্জুন খাণ্ডবদাহকালে ময়নামক অসুরকে মুক্ত করেন, এই নিমিত্ত ময়াসুর রাজসূয়যজ্ঞকালে সর্ব্বরত্নালঙ্কৃত দিব্য সভা নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। নিতান্ত দুর্ম্মতি হীনবুদ্ধি দুর্য্যোধন সেই সভা দর্শনে লোভাক্রান্ত হইলেন; তৎপরে শকুনির সহিত পাশক্রীড়াতে যুধিষ্ঠিরকে বঞ্চনা করিয়া দ্বাদশ বৎসরের নিমিত্ত বনপ্রেরণ করিলেন। পাণ্ডবেরা দ্বাদশ বৎসর বনবাসের পর এক বৎসর অজ্ঞাতবাসে থাকিলেন।

 পাণ্ডবেরা, এই রূপে ত্রয়োদশ বৎসর অতিক্রম করিয়া, যখন চতুর্দ্দশ বর্ষে স্বীয় রাজ্যাধিকার প্রার্থনা করিয়াও প্রাপ্ত হইলেন না, তখন যুদ্ধারম্ভ হইল। তাঁহারা সেই যুদ্ধে ক্ষত্রিয়কুলের ধ্বংস ও রাজা দুর্য্যোধনের প্রাণবধ করিয়া পুনরায় রাজ্যাধিকার লাভ করিলেন।

 মহাত্মা পাণ্ডবদিগের পুরাবৃত্ত, রাজ্যাধিকারের নিমিত্ত ভ্রাতৃভেদ ও যুদ্ধজয়ের বৃত্তান্ত এই।