মহাভারত (উপক্রমণিকাভাগ)/ত্রিংশ অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

ত্রিংশ অধ্যায়— আস্তীকপর্ব্ব।

উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, মহাবল বিহগরাজের পদস্পর্শমাত্র সেই তরুশাখা ভগ্ন হইল। ভগ্ন হইবামাত্র তিনি উহাকে ধারণ করিলেন, এবং শাখা ভগ্ন করিয়া বিস্ময়াবিষ্ট চিত্তে ইতস্ততঃ দৃষ্টিনিক্ষেপ করত, অধোমুখে লম্বমান তপঃপরায়ণ বালখিল্য ব্রহ্মর্ষিদিগকে দেখিতে পাইলেন। দেখিয়া এই চিন্তা করিতে লাগিলেন, ঋষিগণ এই শাখায় লম্বান আছেন, শাখা ভূতলে পতিত হইবামাত্র ইহাদিগের প্রাণবিনাশ হইবে। অনন্তর, গজ ও কচ্ছপকে নখর দ্বারা দৃঢ়তর রূপে ধারণ করিয়া ঋষিদিগের প্রাণবিনাশ আশঙ্কাতে চঞ্চপুট দ্বারা সেই শাখা গ্রহণ করিলেন। মহর্ষিগণ, গরুড়ের এইরূপ অতিদৈব[১] কর্ম্ম দেখিয়া, বিস্ময়াবিষ্ট চিত্তে হেতুবিন্যাস পূর্ব্বক তাঁহার এই নাম রাখিলেন যে, যেহেতু এই বিহঙ্গম গুরু ভার গ্রহণ পূর্বক উডৰ্ডীন হইয়াছে, এজন্য অদ্যাবধি ইহার নাম গরুড়[২] রহিল। অনন্তর তিনি পক্ষপবনবেগে পার্শ্ববর্তী পর্ব্বত সকল বিচলিত করিয়া প্রস্থান করিলেন।

এই রূপে পতগরাজ বালখিল্য ব্রহ্মর্ষিগণের প্রাণরক্ষার্থে গজ ও কচ্ছপ লইয়া নানা দেশে ভ্রমণ করিলেন। পরিশেষে, পর্বতশ্রেষ্ঠ গন্ধমাদনে উপস্থিত হইয়া, তপঃপরায়ণ স্বীয় পিতা কশ্যপের দর্শন পাইলেন। কশ্যপও সেই বলবীর্যতেজঃসম্পন্ন, মন ও আয়ুসম বেগবান, শৈলশৃঙ্গসমকায়, অচিন্তনীয়, অতণীয়, সর্ব্বভূতভয়ঙ্কর, মহাবীর্যাধর, ভীষণমুর্তি, অগ্নির ন্যায় প্রদীপ্ত, দেবদানবরাক্ষসের অধৃষ্য ও অজেয়, গিরিশৃঙ্গভেদনক্ষম, সমুদ্রশোষণসমর্থ, ত্রিলোকদলনক্ষম, সাক্ষাৎ কৃতান্ত, দিব্যরূপী বিহু ঈমকে সমাগত দেখিয়া ও তদীয় মনোগত অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া কহিলেন, বৎস! সহসা এরূপ অসংসাহসিক কর্ম্ম করিও না, এরূপ করিলে ক্লেশ পাইবে, মরীচিপ[৩] বালখিল্যগণ ক্রুদ্ধ হইয়া তোমাকে ভস্মসাৎ করিতে পারেন। অনন্তর তিনি পুত্রস্নেহপরবশ হইয়তপস্যা দ্বারা হতপাপ মহাভাগ বালখিল্যদিগকে এই বলিয়া প্রসন্ন করিলেন, হে তপোধনগণ! গরুড় লোকহিতার্থে মহৎ কার্যের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়াছে, তোমরা অনুজ্ঞা প্রদান কর। বালখিল্যগণ, ভগবান্ কশ্যপের অভ্যর্থনা শ্রবণ করিয়া, সেই শাখা পরিত্যাগ পূর্ব্বক তপস্যার্থে পরম পবিত্র হিমালয়ে প্রস্থান করিলেন।

 বালখিল্যগণ প্রয়াণ করিলে পর, বিনতাতনয় স্বীয় পিতা কশ্যপকে জিজ্ঞাসিলেন, ভগবন্! আমি কোন্ স্থানে এই তরুশাখা পরিত্যাগ করি, আপনি কোনও মানুষশূন্য দেশ নির্দেশ করুন। তখন কশ্যপ মানবসমাগমশূন্য, হিমাচ্ছন্ন, অন্য লোকের মনেরও অগোচর, এক পর্ব্বত নির্দেশ করিয়া দিলেন। মহাকায় মহাভারত। বিহঙ্গম তরুশাখা এবং গঞ্জ ও কচ্ছপ সহিত অতিবেগে সেই পর্বতোদ্দেশে গমন করিলেন। তিনি যে তরুশাখা লইয়া গমন করিলেন, তাহা এমন প্রকাণ্ড যে, শত গোর্মনির্ম্মিত অতি দীর্ঘ রজ্জু দ্বারাও তাহার বেন ও বন্ধন হইতে পারে না। পতগরাজ অনতিদীর্ঘকালমধ্যে সেই শতসহস্রযোজনান্তরস্থিত পর্বতে উপস্থিত হইয়া পিতৃবাক্যানুসারে তদুপরি তরুশাখা পরিত্যাগ করিলেন। শৈলরাজ তদীয় পক্ষপনে আহত হইয়া কম্পিত হইল, তত্রত তরুগণ বিচলিত হইয়া পুষ্পবর্ষণ করিতে লাগিল, যে সকল মণিকাঞ্চনশোভিত শৃঙ্গ সেই মহাগিরির শোভা সম্পাদন করিত, সে সমস্ত বিশীর্ণ হইয়া সমন্ততঃ পতিত হইল, বহুসংখ্যক বৃক্ষ গরুড়ানীত শাখা দ্বারা অভিহত হইয়া, সুবর্ণকুসুম দ্বারা, বিদ্যুৎসমূহুশোভিত জলধরগণের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল, বৃক্ষগণ ভূতলে পতিত ও ধাতুরাগে রঞ্জিত হইয়া সাতিশয় শোভমান হইল। তদনন্তর গরুড়, সেই গিরির শিখরদেশে অবস্থিত হইয়া গজ ও কচ্ছপ ভক্ষণ করিলেন। এই রূপে সেই কূর্ম্ম ও কুঞ্জর ‘অভ্যবহার করিয়া পর্ব্বতের শিখরাগ্রভাগ হইতে মহাবেগে উড্ডীন হইলেন।

 অতঃপর দেবতাদিগের ভয়সূচক উৎপাতারস্ত হইল। ইন্দ্রের বজ্র ভয়ে প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল, দিবাভাগে নলোমণ্ডল হইতে ধূম ও অগ্নিশিখা সম্বলিত উল্কাপাত হইতে লাগিল। বসু, রুদ্র, আদিত্য, সাধ্য, মরুৎ ও অন্যান্য দেবতাগণের অস্ত্র সকল পরস্পর আক্রমণ করিতে লাগিল। অধিক কি কহিব, দেবাসুরযুদ্ধকালেও এরূপ অভূতপূর্ব ব্যাপার ঘটে নাই। প্রচণ্ড বায়ু বহিতে লাগিল, সহস্র সহস্র বজ্রাঘাত ও উল্কাপাত হইতে লাগিল, আকাশে বিনা মেঘে ঘোতর গর্জ্জন হইতে লাগিল; যিনি দেবগণের দেব, তিনিও রক্তবৃষ্টি করিতে লাগিলেন; দেবতাদিগের মাল্য ম্লান ও তেজঃ নষ্ট হইয়া গেল; অতি ভীষণ প্রলয়জলধর সকল অজস্র শোণিত বর্ষণ করিতে লাগিল; ধূলিপ্রবাহ উত্থিত হইয়া দেবতাদিগের মুকুট মলিন করিল।

 দেবরাজ ইন্দ্র, এই সমস্ত দারুণ উৎপাত দর্শনে উদ্বিগ্ন হইয়া, বৃহস্পতিকে জিজ্ঞাসিলেন, ভগবন্! কি নিমিত্ত সহসা এই সকল ঘোরর উৎপাত আরম্ভ হইল? আমাদিগকে যুদ্ধে অভিভব করিতে পারে, এমন শক্র উপস্থিত দেখিতেছি না, তবে কি কারণে এ সকল ঘটিতেছে, বলুন। বৃহস্পতি কহিলেন, হে দেবেন্দ্র! তোমার অপরাধ ও অনবধান দোষে, মহাত্মা বালখিল্য মহর্ষিদিগের তপঃপ্রভাবে, বিনতাগর্ভে কশ্যপমুনির গরুড় নামে পক্ষিরূপী পুত্র জন্মিয়াছে; সেই,মহাবল পরাক্রান্ত কামরূপী বিহঙ্গম অমৃত হরণ করিতে আসিয়াছে। তাহার তুল্য বলবান আর নাই, সে অমৃতহরণে সমর্থ বটে, তাহার নিকট কিছুই অসম্ভব নয়, সে অসাধ্য সাধন করিতে পারে।

 ইন্দ্র সুরাচার্যের বচন শ্রবণ করিয়া • অমৃতরক্ষকদিগকে কহিলেন, মহাবল মহাবীর্য পক্ষী অমৃত হরণে উদ্যত হইয়াছে; অতএব তোমাদিগকে সাবধান করিতেছি, যেন সে বল পূর্ব্বক হরণ করিয়া না লয়; বৃহস্পতি কহিয়াছেন, তাহার অতুল বল। দেবগণ ইন্দ্রবাক্য শ্রবণে বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া যত্ন পূর্বক অমৃত বেষ্টন করিয়া অবস্থিত হইলেন, এবং দেবরাজও বহস্তে সেই স্থানে অবস্থান করিলেন। দিব্যাভরণভূষিত, উজ্জ্বলকায়, পাপসম্পৰ্কশূন্য, অনুপমবলবীর্যসম্পন্ন, অসুরসংহারকারী সুরগণ, কাঞ্চনময় বৈদূর্য্যবিনির্মিত মহামূল্য মহোজ্জল সুদৃঢ় বিচিত্র কবচ, বহুবিধ ভয়ঙ্কর অগণন তীক্ষ্ণ শস্ত্র, ধূম স্ফুলিঙ্গ ও অগ্নিশিখাসহকৃত চক্র, পরিঘ, ত্রিশূল, পরশু, বহুবিধ তীক্ষ শক্তি, উজ্জ্বল করাল করবাল, প্রচণ্ড গদা ইত্যাদি বিবিধ অস্ত্র গ্রহণ পূর্ব্বক অমৃতরক্ষণে তৎপর হইলেন। দেবগণ এই রূপে নানাবিধ অস্ত্র সহিত যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হইয়া, ভূতলে অকস্মাৎ আবির্ভূত সূর্যকিরণ প্রকাশিত আকাশমণ্ডলের ন্যায়, শোভা পাইতে লাগিলেন।

  1. দেবতাদিগেরও অসাধ্য।
  2. গুরু শব্দের অর্থ মহৎ ও ভী ধাতুর অর্থ উড়িয়া যাওয়া। এই উভয়েব যোগে গরুড় পদ সিদ্ধ হইয়াছে।
  3. মরীচি শব্দের অর্থ কিরণ, পা ধাতুর অর্থ পান। বালখিল্যরা সূর্যের কিরণমাত্র পান করিয়া প্রাণধারণ করেন, এজন্য তঁহাদিগকে মরীছিপ কহে।