মহাভারত (উপক্রমণিকাভাগ)/দ্বিতীয় অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় অধ্যায়—পর্ব্বসংগ্রহ।

ঋষিগণ কহিলেন, হে সূতনন্দন! তুমি যে সমন্তপঞ্চক তীর্থের উল্লেখ করিয়াছ, আমরা তাহার স্বরূপ ও সবিশেষ বিবরণ জানিতে বঞ্ছা করি। উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, হে সাধু ব্রাহ্মণগণ! আমি সমন্তপঞ্চকবৃত্তান্ত ও অন্যান্য নানা শুভ কথা কীর্ত্তন করিতেছি, আপনারা শ্রবণ করুন। সকলশস্ত্রধারিশ্রেষ্ঠ পরশুরাম ত্রেতা ও দ্বাপরের সন্ধিতে পিতৃবধক্রোধে অধীর হইয়া ভূয়ো-ভূয়ঃ ক্ষত্রিয়কুল ধ্বংস করিয়াছিলেন। সেই অনলতুল্য তেজস্বী ঋষি নিজ বীর্য্যে সমস্ত ক্ষত্রিয়কুল উৎসন্ন করিয়া সমন্তপঞ্চকে পঞ্চ রুধিরহ্রদ করেন। আমরা শুনিয়াছি, তিনি ক্রোধে অন্ধ হইয়া সেই সেই রুধিরহ্রদের রুধির দ্বারা পিতৃলোকের তর্পণ করিয়াছিলেন। অনন্তর ঋচীক প্রভৃতি পিতৃগণ তাঁহার নিকটে আসিয়া কহিলেন, হে মহাভাগ রাম! আমরা তোমার এইরূপ পিতৃভক্তি ও বিক্রমাতিশয় দর্শনে সাতিশয় প্রসন্ন হইয়াছি, ইচ্ছানুরূপ বর প্রার্থনা কর। রাম কহিলেন, হে পিতৃগণ! যদি আপনারা আমার প্রতি প্রসন্ন হইয়া থাকেন ও আমাকে অনুগ্রহ করিতে ইচ্ছা করেন, তবে এই বর দেন যে, আমি রোষবশে ক্ষত্রিয়কুল সংহার করিয়া যে পাপ গ্রস্ত হইয়াছি, যেন তাহা হইতে মুক্ত হই, এবং যেন এই সকল হ্রদ তীর্থরূপে ভূমণ্ডলে বিখ্যাত ও পরিগণিত হয়। পিতৃগণ যথাপ্রার্থিত বর প্রদান পূর্ব্বক ক্ষমস্ব বলিয়া তাঁহাকে নিষেধ করিলেন, তখন তিনি প্রতিজ্ঞাত ক্ষত্রিয়কুলসংহারক্রিয়া হইতে বিরত হইলেন।

 সেই পঞ্চ রুধিরহ্রদের অদূরে যে পরম পবিত্র দেশ আছে, তাহাকে সমন্তপঞ্চক কহে। পণ্ডিতেরা কহেন, যে দেশ যে চিহ্ণে চিহ্নিত, তদ্দারাই সে দেশের নাম নির্দ্দেশ হওয়া উচিত। কলি ও দ্বাপরের অন্তরে সমন্তপঞ্চকে কুরু পাণ্ডব সৈন্যের যুদ্ধ হইয়াছিল। অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সেনা যুদ্ধবাসনায় সেই ভূদোষ[১] বর্জ্জিত ক্ষেত্রে সমাগত ও নিধন প্রাপ্ত হয়। হে ব্রাহ্মণগণ! সেই দেশের নামের এই ব্যুৎপত্তি? সে দেশ পবিত্র ও রমণীয়। হে ব্রতপরায়ণ মহর্ষিগণ! উক্ত দেশ ত্রিলোকে যে রূপে বিখ্যাত, তৎসমুদায় নিবেদন করিলাম।

 ঋষিগণ কহিলেন, হে সূতনন্দন! তুমি যে অক্ষৌহিণী শব্দ প্রয়োগ করিলে আমরা তাহার যথার্থ অর্থ শ্রবণের বাসনা করি। তোমার অবিদিত কিছুই নাই, অতএব কত পদাতি, কত অশ্ব, কত রথ, ও কত গজে এক অক্ষৌহিণী হয়, তাহার সবিশেষ বর্ণনা কর। উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, এক রথ, এক গজ, পাঁচ পদাতি, তিন অশ্ব, ইহাতে এক পত্তি হয়, তিন পত্তিতে এক সেনামুখ, তিন সেনামুখে এক গুল্ম, তিন গুল্মে এক গণ, তিন গণে এক বাহিনী, তিন বাহিনীতে এক পৃতনা, তিন পৃতনাতে এক চমূ, তিন চমূতে এক অনীকিনী, আর দশ অনীকিনীতে এক অক্ষৌহিণী হয়। সমুদায়ে এক অক্ষৌহিণীতে ২১৮৭০ এক বিংশতি সহস্র অষ্টশত সপ্ততি সংখ্যক রথ, তাবৎ সংখ্যক গজ, ১০৯৩৫০ এক লক্ষ নয় সহস্র তিন শত পঞ্চাশ পদাতি, আর ৬৫৬১০ পঞ্চশটি সহস্র ছয় শত দশ অশ্ব থাকে। আমি আপনাদিগকে যে অক্ষৌহিণীর কথা কহিয়াছিলাম, সংখ্যাতত্ত্ববেত্তারা তাহার এইরূপ সংখ্যা নির্দ্দেশ করিয়াছেন। কৌরব ও পাণ্ডবদিগের সংগ্রামে এইরূপ অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সমন্তপঞ্চকে একত্র হইয়াছিল, এবং কৌরবদিগকে উপলক্ষমাত্র করিয়া অদ্ভুতশক্তি কাল প্রভাবে সেই স্থানেই নিধন প্রাপ্ত হয়; পরমাস্ত্রবেত্তা ভীষ্মদেব দশ দিবস যুদ্ধ করেন; তৎপরে দ্রোণাচার্য্য পাঁচ দিন কুরুসৈন্য রক্ষা করেন; শত্রুঘাতী কর্ণ দুই দিন যুদ্ধ করেন; শল্য অর্দ্ধ দিবস মাত্র; তৎপরেই ভীম ও দুর্য্যোধনের অর্দ্ধদিনব্যাপী গদাযুদ্ধ; সেই দিবসের নিশাগমে অশ্বত্থামা কৃতবর্ম্মা ও কৃপাচার্য্য তিন জনে পরামর্শ করিয়া বিশ্বস্ত চিত্তে নিদ্রাগত সমস্ত যুধিষ্ঠিরসৈন্য সংহার করেন।

 হে শোনক! আমি আপনার যজ্ঞে যে ভারত কীর্ত্তন আরম্ভ করিতেছি, ব্যাসশিষ্য ধীমান্ বৈশম্পায়ন জনমেজয়ের যজ্ঞে তাহার কীর্ত্তন করিয়াছিলেন। এই ইতিহাসের আদিভাগে মহানুভাব নরপতিগণের যশঃ ও বীর্য্যের সবিস্তর বর্ণনা নিমিত্ত পৌষ্য, পৌলম, ও আস্তীক এই তিন পর্ব্ব আছে। এই গ্রন্থ বিচিত্র অর্থ, পদ, আখ্যান, ও বহুবিধ আচার নিয়মে পরিপূর্ণ। যেমন মোক্ষার্থীরা একমাত্র উপায় বোধে বৈরাগ্য অবলম্বন করিয়া থাকে, সেইরূপ প্রাজ্ঞ নরেরা একমাত্র শ্রেয়ঃ- সাধন বোধ করিয়া এই পরম পবিত্র ইতিহাস গ্রন্থের উপাসনা করেন। যেমন সমুদায় জ্ঞাতব্য পদার্থ মধ্যে আত্মা এবং সমস্ত প্রিয়বস্তুমধ্যে জীবন শ্রেষ্ঠ, সেইরূপ এই পরম পবিত্র ইতিহাস সর্ব্বশাস্ত্রমধ্যে শ্রেষ্ঠ। যেমন আহার ব্যতিরেকে শরীর ধারণের আর উপায় নাই, সেইরূপ এই ইতিহাসগ্রন্থোক্ত কথা ব্যতিরিক্ত ভূমণ্ডলে আর কথা নাই। যেমন অভ্যুদয়াকাঙ্ক্ষী ভৃত্যেরা সৎকুলজাত প্রভুর সেবা করে, সেইরূপ কবিগণ জ্ঞানলাভবাসনায় এই মহাভারতের সেবা করিয়া থাকেন। যেমন সমুদায় লৌকিক ও বৈদিক বাক্য স্বর ও বাঞ্জনে অর্পিত, সেইরূপ এই উৎকৃষ্ট ইতিহাস গ্রন্থে শ্রেয়ঃসাধনী বুদ্ধি অর্পিত আছে।

 এক্ষণে আপনারা সেই অশেষ প্রজ্ঞার আকর, সুচারু রূপে রচিত, অতর্কণীয় বিষয়ের মীমাংসাযুক্ত, বেদার্থভূষিত, ভারতাখ্য ইতিহাসের পর্ব্বসংগ্রহ শ্রবণ করুন। সর্ব্বপ্রথম অনুক্রমণিকা পর্ব্ব, দ্বিতীয় পর্ব্বসংগ্রহপর্ব্ব, তৎপরে পৌষ্য, পৌলোম, আস্তীক, ও আদিবংশাবতারণ পর্ব্ব, তৎপরে পরমাদ্ভুত সম্ভব পর্ব্ব, তৎশ্রবণে শরীরে রোমাঞ্চ হয়; তৎপরে জতুগৃহদাহ, তৎপরে হিড়িম্ববধ, তৎপরে বকবধ, তৎপরে চৈত্ররথ, তৎপরে দ্রৌপদীস্বয়ংবর, তৎপরে বৈবাহিক পর্ব্ব, তৎপরে বিদুরাগমন ও রাজ্যলাভ পর্ব্ব, তৎপরে অর্জ্জুনবনবাস, তৎপরে সুভদ্রাহরণ, সুভদ্রাহরণের পর যৌতুকাহরণ পর্ব্ব, তৎপরে খাণ্ডবদাহ ও ময়দানবদর্শন পর্ব্ব, তৎপরে সভাপর্ব্ব, তৎপরে মন্ত্রণাপর্ব্ব, তৎপরে জরাসন্ধ বধ, তৎপরে দিগ্বিজয়পর্ব্ব, দিগ্বিজয়ের পর রাজসূয় পর্ব্ব, তৎপরে অর্ঘাভিহরণ, তৎপরে শিশুপালবধ, তৎপরে দ্যূতপর্ব, তৎপরে অনুদ্রুত পর্ব্ব, তৎপরে অরণ্যপর্ব্ব, তৎপরে কির্ম্মীরবধপর্ব্ব, তৎপরে অর্জ্জুনাভিগমনপর্ব্ব, তৎপরে কিরাত পর্ব্ব, এই পর্ব্বে মহাদেবের সহিত অর্জ্জুনের যুদ্ধ বর্ণিত আছে; তৎপরে ধীমান্ যুধিষ্ঠিরের তীর্থযাত্রাপর্ব্ব, তৎপরে জটাসুরবধ পর্ব্ব, তৎপরে যক্ষযুদ্ধ, তৎপরে ইন্দ্রলোকাভিগমন, তৎপরে নলোপাখ্যান পর্ব্ব, তৎশ্রবণে ধর্ম্মলাভ ও করুণরসের উদয় হয়; তৎপরে পতিব্রতামাহাত্ম্য, তৎপরে পরমাদ্ভুত সাবিত্রীমাহাত্ম্য, তৎপরে নিবাতকবচ যুদ্ধ, তৎপরে অজগর পর্ব্ব, তৎপরে মার্কণ্ডেয় সমস্যা, তৎপরে দ্রৌপদী সত্যভামা সংবাদ, তৎপরে ঘোষযাত্রা, তৎপরে মৃগস্বপ্ন, তৎপরে ব্রীহিদ্রৌণিক, তৎপরে ইন্দ্রদ্যুম্ন পর্ব্ব, তৎপরে জয়দ্রথ কর্ত্তৃক বন হইতে দ্রৌপদীহরণ, তৎপরে রামোপাখ্যান, তৎপরে কুণ্ডলাহরণ, তৎপরে অরণীহরণ পর্ব্ব, তৎপরে বিরাট পর্ব্ব, তৎপরে পাণ্ডবপ্রবেশ, তৎপরে সময়পালন, তৎপরে কীচকবধ, তৎপরে গোগ্রহণ, তৎপরে অভিমন্যু ও উত্তরার বিবাহ পর্ব্ব, তৎপরে পরমাদ্ভুত উদ্যোগ পর্ব্ব, তৎপরে সঞ্জয়যাত্রা, তৎপরে চিন্তাপ্রযুক্ত ধৃতরাষ্ট্রের জাগরণ, তৎপরে পরমগুহ্য সনৎসুজাত পর্ব্ব, ইহাতে আত্মজ্ঞানের কথা আছে; তৎপরে যানসন্ধি, তৎপরে ভগবদযাত্রা, তৎপরে মাতলীয়োপাখ্যান, তৎপরে গালবচরিত, তৎপরে সাবিত্রী উপাখ্যান, বামদেবোপাখ্যান, বৈণ্যোপাখ্যান, জামদগ্ন্যোপাখ্যান, তৎপরে ষোড়শরাজিক পর্ব্ব, তৎপরে কৃষ্ণের সভা প্রবেশ, তৎপরে বিদুলাপুত্র দর্শন, তৎপরে কৃষ্ণ প্রত্যাখ্যান ও বিদুলাপুত্র দর্শন, তৎপরে সৈন্যোদ্যোগ ও শ্বেতোপাখ্যান, তৎপরে মহাত্মা কর্ণের বিবাদ, তৎপরে মন্ত্রনিশ্চয় পূর্ব্বক কার্য্যচিন্তন, তৎপরে সেনাপতিনিয়োগাখ্যান, তৎপরে শ্বেত বাসুদেব সংবাদ, তৎপরে কুরু পাণ্ডব সৈন্য নির্যাণ, তৎপরে সৈন্যসংখ্যা, তৎপরে অমর্ষবর্দ্ধক উলক নামক দূতের আগমন, তৎপরে অম্বোপাখ্যান, তৎপরে অদ্ভুত ভীষ্মাভিষেক পর্ব্ব, তৎপরের জম্বুদ্বীপ সন্নিবেশ পর্ব্ব, তৎপরে ভূমিপর্ব্ব, তৎপরে দ্বীপবিস্তার কথন পর্ব, তৎপরে ভগবদ্গীতাপর্ব্ব, তৎপরে ভীষ্মবধপর্ব্ব, তৎপরে দ্রোণাভিষেক, তৎপরে সংশপ্তক সৈন্যবধ, তৎপরে অভিমন্যুবধ পর্ব্ব, তৎপরে প্রতিজ্ঞাপর্ব্ব, তৎপরে জয়দ্রথবধ, তৎপরে ঘটোৎকচবধ, তৎপরে পরমাদ্ভুত দ্রোণবধ, তৎপরে নারায়ণাস্ত্রত্যাগ পর্ব্ব, তৎপরে কর্ণপর্ব্ব, তৎপরে শল্যপর্ব্ব, তৎপরে হ্রদ প্রবেশ, তৎপরে গদাযুদ্ধপর্ব্ব, তৎপরে অতিবীভৎস সৌপ্তিক পর্ব্ব, তৎপরে অতি নিদারুণ ঐষীকপর্ব্ব, তৎপরে জলপ্রদানিকপর্ব্ব, তৎপরে স্ত্রীবিলাপপর্ব্ব, তৎপরে কুরুবংশীয়দিগের ঔর্দ্ধদেহিক ক্রিয়াপর্ব্ব, তৎপরে ব্রাহ্মণবেশধারী চার্ব্বাক রাক্ষসের নিগ্রহপর্ব্ব, তৎপরে শান্তিপর্ব্ব, এই পর্ব্বে রাজধর্ম্মানুশাসন ও আপদ্ধর্ম্ম উক্ত হইয়াছে; তৎপরে মোক্ষ ধর্ম্ম পর্ব্ব, তৎপরে শুকপ্রশ্নাভিগমন, ব্রহ্মপ্রশ্নানুশাসন, দুর্ব্বাসার প্রাদুর্ভাব ও মায়াসংবাদপর্ব্ব, তৎপরে আনুশাসনিক পর্ব্ব, তৎপরে ধীমান্ ভীষ্মের স্বর্গারোহণ পর্ব্ব, তৎপরে সর্বপাপক্ষয়কারী অশ্বমেধপর্ব্ব, তৎপরে অধ্যাত্মবিদ্যাপ্রতিপাদক অনুগীতাপর্ব্ব, তৎপরে আশ্রমবাসপর্ব্ব, তৎপরে পুত্রদর্শনপর্ব্ব, তৎপরে নারদাগমনপর্ব্ব, তৎপরে অতি দারুণ মৌষল পর্ব, তৎপরে মহাপ্রস্থান, তৎপরে স্বর্গারোহণ পর্ব্ব, তৎপরে খিলনামক হরিবংশপর্ব্ব, ইহাতে বিষ্ণুপর্ব্ব, শিশুচর্য্যা, কংসবধ, ও পরমাদ্ভুত ভবিষ্যপর্ব্ব উক্ত হইয়াছে। মহাত্মা ব্যাসদেব এই শত পর্ব্ব কীর্ত্তন করিয়াছিলেন; পরে লোমহর্ষণপুত্র উগ্রশ্রবাঃ নৈমিষারণ্যে যথাক্রমে অষ্টাদশ পর্ব্ব কীর্ত্তন করেন। ভারতসংক্ষেপরূপ পর্ব্বসংগ্রহ উক্ত হইল।

 পৌষ্য, পৌলোম, আস্তীক, আদিবংশাবতরণ, সম্ভব, জতুগৃহ, হিড়িম্ববধ, বকবধ, চৈত্ররথ, দ্রৌপদীস্বয়ংবর, বৈবাহিক, বিদুরাগমন, রাজ্যলাভ, অর্জ্জুনবনবাস, সুভদ্রাহরণ, যৌতুকানয়ন, খাণ্ডবদাহ, ময়দর্শন, এই সমস্ত আদিপর্ব্বের অন্তর্গত। পৌষ্যপর্ব্বে উতঙ্কের মাহাত্ম্য ও পৌলোমে ভৃগুবংশের বিস্তার বর্ণিত আছে। আস্তীকপর্ব্বে সমুদায় সর্পকুল ও গরুড়ের উৎপত্তি, ক্ষীরসমুদ্রমথন, উচ্চৈঃশ্রবার জন্ম, রাজা জনমেজয়ের সর্পসত্রানুষ্ঠান প্রতিজ্ঞ ও ভরতবংশীয় মহাত্মাদিগের কীর্ত্তন আছে। সম্ভবপর্ব্বে অশেষ রাজকুল, অন্যান্য বীরপুরুষ, ও মহর্ষি দ্বৈপায়নের উৎপত্তি, দেবতাগণের অংশাবতার, সর্প, গন্ধর্ব্ব, পক্ষী, ও অন্য অন্য নানা জীবের উদ্ভব, যে ভরতের নামানুসারে লোকে ভারতকুল প্রসিদ্ধ হইয়াছে, তপঃপরায়ণ কণ্বমুনির আশ্রমে দুষ্মন্তের ঔরসে শকুন্তীর গর্ভে তাঁর জন্ম গ্রহণ, শান্তনুগৃহে গঙ্গাগর্ভে মহাত্মা! বসুদিগের পুনর্জন্ম ও তাঁহাদিগের স্বর্গারোহণ, তদীয় তেজোগসমষ্টি, ভশ্নের জন্য, তাঁহার রাজপরিত্যাগ, ব্রহ্মচর্যাবলম্বন, প্রতিজ্ঞালন, স্বীয় ভ্রাতা চিত্রাঙ্গদের রক্ষা, চিত্রাঙ্গদের মৃত্যু হইলে কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যের রক্ষা ও তাঁহাকে রাজ্য প্রতিপাদন, অনীমাণ্ডব্যশাপে ধর্ম্মের নরলোকে উৎপত্তি ও বরদানলে দ্বৈপায়নের ঔরসে জন্ম, ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ড, ও প বদিগের উৎপত্তি, দুর্যোধনের বারণাবতমাত্রামন্ত্রণা, ধীমান্ যুধিষ্ঠিরের হিতার্থে পথে তাহাকে ম্লেচ্ছভাষায় বিদুরের হিতোপদেশপ্রদান, বিয়ের পর মর্শে সুরঙ্গনির্ম্মাণ, জতুগৃহে পঞ্চপুত্র সহিত নিদ্রিত। নিষাদীর ও পুরোচননামক স্নেচ্ছের দাহ, ঘোর অরণ্যে পাণ্ডবদিগের হিড়িম্বাদর্শন ও সেই স্থানে মহাবল ভীম কর্তৃক হিড়িম্ববধ, ঘটোৎকচের জন্ম, মহাতেজস্বী মহর্ষি ব্যাসদেবের সন্দর্শন, তদীয় আদেশানুসারে একচক্র। নগরে ব্রাহ্মণগৃহে পাণ্ডবদিগের অজ্ঞাতবাস, বরাক্ষসবধ ও তদ্দর্শনে নগরবাসী লোকের বিস্ময়, দ্রৌপদী ও ধৃষ্টদ্যুম্নের জন্ম, ব্রাহ্মণমুখে দ্রৌপদীর পরমাদ্ভূত জন্মবৃত্তান্ত শ্রবণে কৌতুহলক্রান্ত হইয়া ব্যাসের উপদেশানুসারে দ্রৌপদীলাভাভিলাষে স্বয়ংবর দশক্ষার্থে পাণ্ডবদিগের পাঞ্চাল দেশ, যাত্রা, গঙ্গাতীরে গন্ধরাজ, অঙ্গারপর্ণকে পরাজিত করিয়া তাহার সহিত মৈত্রী স্থাপন ও তৎসমীপে তপতী, বশিষ্ঠ, ও ঔর্ব্বের উপাখ্যান শ্রবণ পূর্ব্বক ভ্রাতৃসহিত অর্জ্জুনের পাঞ্চালাভিমুখে গমন, পাঞ্চাল নগরে সমাগত সর্ব্বনৃপতিসমক্ষে লক্ষ্যভেদ পূর্ব্বক অর্জ্জুনের দ্রৌপদীলাভ, তদ্দর্শনে জাতক্রোধ রাজগণের এবং শল্য ও কর্ণের ভীমার্জ্জুন কর্ত্তৃক যুদ্ধে পরাজয়, ভীম ও অর্জ্জুনের তাদৃশ অপ্রমেয় অমানুষ বীর্য্য দর্শনে পাণ্ডব বোধ করিয়া কৃষ্ণ বলরামের তৎসাক্ষাৎকারার্থ ভার্গবগৃহগমন, পাঁচ জনের এক ভার্য্যা হইবেক এই নিমিত্ত দ্রুপদের বিমর্ষ, তদুপলক্ষে পরমাদ্ভুত পঞ্চেন্দ্রোপাখ্যান কথন, দ্রৌপদীর দেববিহিত অলৌকিক বিবাহ, ধৃতরাষ্ট্রের পাণ্ডবসমীপে বিদুর প্রেরণ, বিদুরের উপস্থিতি ও কৃষ্ণ দর্শন, পাণ্ডবদিগের খাণ্ডবপ্রস্থে বাস ও রাজ্যার্দ্ধ প্রাপ্তি, নারদের আজ্ঞায় পঞ্চ ভ্রাতার দ্রৌপদী বিষয়ে নিয়ম ও প্রতিজ্ঞা, দ্রৌপদী সহিত নির্জনোপবিষ্ট যুধিষ্ঠিরসমীপে গমন ও তথা হইতে অস্ত্র গ্রহণ পূর্ব্বক শরণাগত ব্রাহ্মণের অপহৃত গোধন প্রত্যানয়ন করিয়া পূর্ব্ব প্রতিজ্ঞানুসাৱে অর্জ্জুনের বন প্রস্থান, বনবাস কালে উলপী নাম্নী নাগকন্যার সহিত সমাগম, তীর্থ পর্য্যটন ও বভ্রুবাহনজন্ম, তপস্বিব্রাহ্মণশাপে গ্রাহযোনি প্রাপ্ত পঞ্চ অপ্সরার শাপমোক্ষণ, প্রভাস তীর্থে কৃষ্ণের সহিত সমাগম, দ্বারকাতে কৃষ্ণের সম্মতিক্রমে সুভদ্রা প্রাপ্তি, যৌতুক প্রদানার্থে কৃষ্ণের খাণ্ডবপ্রস্থাগমনের পর সুভদ্রাগর্ভে মহাতেজাঃ অভিমন্যুর জন্ম, দ্রৌপদীর পুত্ত্রোৎপত্তি, কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন জলবিহারার্থ যমুনা গমন করিলে তথায় উভয়ের চক্র ও ধনুপ্রাপ্তিঃ, খাণ্ডবদাহ এবং ময়দানব ও ভুজঙ্গের অগ্নিদাহ হইতে মোক্ষণ, মন্দপালনামক মহর্ষির শার্ঙ্গীগর্ভে তনয়োৎপত্তি। বহুবিস্তৃত আদিপর্ব্বে এই সকল বিষয় বর্ণিত আছে। মহর্ষি ব্যাসদেব এই পর্ব্ব দুই শত সপ্তবিংশতি অধ্যায়ে বিভক্ত করিয়াছেন। মহাত্মা মুনি ইহাতে আট সহস্র আট শত চতুরণীতি শ্লোক কহিয়াছেন।

 বহুবৃত্তান্তযুক্ত সভা নামক দ্বিতীয় পর্ব্ব আরম্ভ হইতেছে। পাণ্ডবদিগের সভা নির্ম্মাণ, কিঙ্কর দর্শন, দেবর্ষি নারদ কর্ত্তৃক ইন্দ্রাদি লোকপাল সভা বর্ণন, রাজসূয় যজ্ঞারম্ভ, জরাসন্ধবধ, গিরিব্রজনিরুদ্ধ রাজগণের কৃষ্ণ কর্ত্তৃক উদ্ধার, পাণ্ডবদিগের দিগ্বিজয়, উপঢৌকন লইয়া রাজাদিগের রাজসূয় মহাযজ্ঞে আগমন, রাজসূয়ের অর্ঘ্য দান প্রস্তাব কালে শিশুপালবধ, যজ্ঞে যুধিষ্ঠিরের তাদৃশ ঐশ্বর্য্য সর্শনে দুর্য্যোধনেয় বিষাদ ও ঈর্ষ্যা, সভামণ্ডপে ভীমকৃত দুর্য্যোধনোপহাস, দুর্য্যোধানের ক্রোধ, দ্যূতক্রীড়ার অনুষ্ঠান, দ্যূতকার শকুনি কর্ত্তৃতৃক দ্যূতে যুধিষ্ঠিরের পরাজয়, দ্যূতাবর্ণমগ্না পরম দুঃখিতা স্নুষা দ্রৌপদীর মহাপ্রাজ্ঞ ধৃতরাষ্ট্র কর্ত্তৃক উদ্ধার, পাণ্ডবদিগের উদ্ধার দর্শনে দুর্য্যোধন কর্ত্তৃক পুনর্বায় দ্যূতক্রীড়ার্থে তাঁহাদিগের আহ্বান ও পরাজয় পূর্ব্বক বনপ্রেষণ। মহাত্মা দ্বৈপায়ন সভাপর্ব্বে এই সমস্ত ব্যাপার কীর্ত্তন করিয়াছেন। এই পর্ব্বে অষ্ট সপ্ততি অধ্যায় আছে। হে দ্বিজোত্তমগণ! সভাপর্ব্বে দ্বিসহস্র পঞ্চশত একাদশ শ্লোক আছে জামিবেন।

 অতঃপর অরণ্যনামক তৃতীয় পর্ব্ব। মহাত্মা পাণ্ডবেরা বন প্রস্থান করিলে পুরবাসিদের যুধিষ্ঠিরানুগমন, অনুগত দ্বিজগণের ভরণ পোষণ নির্ব্বাহার্থ ধৌম্যমুনির উপদেশানুসারে মহাত্মা যুধিষ্ঠিরের সূর্য্যারধনা, সূর্য্যপ্রসাদাৎ অন্নলাভ, ধৃতরাষ্ট্র কর্ত্তৃক হিতবাদী বিদুরের পরিত্যাগ, ধৃতরাষ্ট্রপরিত্যক্ত বিদুরের যুধিষ্টিরাদিসমীপগমন, ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে তাঁহার পুনরাগমন, কর্ণের পরামর্শক্রমে দুর্ম্মতি দুর্যোধনের বনস্থ পাণ্ডব বিনাশ মন্ত্রণা, তাঁহার দুষ্ট অভিপ্রায় জানিতে পারিয়া ব্যাসের সত্বর আগমন, ব্যাস কর্তৃক দুর্য্যোধনাদির বনগমন নিবারণ, সুরভির উপাখ্যান, মৈত্রেয়ের ধৃতরাষ্ট্রসমীপে আগমন, মৈত্রেয়ের ধৃতরাষ্ট্রকে উপদেশ দান, মৈত্রেয়ের রাজা দুর্য্যোধনকে শপ প্রদান, ভীমসেন কর্তৃক সংগ্রামে কিষ্মীর রাক্ষস বধু, শকুনি ছল পূর্বক দ্যূত পাবদিগকে পরাজিত করিয়াছে শুনিয়া বৃষ্ণিবংশীয় ও পাঞ্চালদিগের আগমন, জাতক্রোধ কৃষ্ণের অর্জুন কর্তৃক সান্ত্বনা, কৃষ্ণের নিকট দ্রৌপদীর বিলাপ ও পরিতাপ, দুঃখাত্তা দ্রৌপদীকে কৃষ্ণের আশ্বাস প্রদান, সৌভপতি শাল্বের বধ কীর্ত্তন, কৃষ্ণ কর্তৃক সপুত্র সুভদ্রার দ্বারকানয়ন, ধৃষ্টদ্যুম্ন কর্তৃক দ্রৌপদীতনয়দিগের পাঞ্চাল নগর নয়ন, পাণ্ডবদিগের রমণী দ্বৈতবনে প্রবেশ, তথায় দ্রৌপদী ও ভীমের সহিত যুধিষ্ঠিরের কথোপকথন, ব্যাসদেবের পাণ্ডবসমীপে আগমন ও যুধিষ্ঠিরকে প্রতিস্মৃতিনামক বিদ্যাদান, যাদের অন্তর্ধানের পর পাণ্ডবদিগের কাম্যকবন প্রস্থান, অলাভার্থে মহাবীর্য অর্জুনের প্রবাস গমন, কিরতিরূপী মহাদেবের সহিত যুদ্ধ, ইন্দ্রাদি লোকপাল দর্শন, অস্ত্র লাভ, অস্ত্র শিক্ষার্থে ইন্দ্রলোক গমন, পাণ্ডববৃত্তান্ত শ্রবণে ধৃতরাষ্ট্রের চিন্তা, পাণ্ডবদিগের পরম জ্ঞানী মহর্ষি বৃহদশের দর্শন, দুখার্ত যুধিষ্ঠিরের বিলাপ ও পরিতাপ, ধর্ম ও করুণরসজনক নলোপাখ্যান, দময়ন্তী ও নলের চরিতকীর্ত্ত, যুধিষ্ঠিরের বৃহদ হইছে হৃদয়নামক বিদ্যা প্রাপ্তি, স্বর্গ হইতে লোমণ ঋষির পাণ্ডবদিগের নিকটে আগমন, বনবাসগত মহাত্মা পাণ্ডবদিগের নিকটে লোমশ কর্তৃক স্বর্গবাসী অর্জুনের বৃত্তান্তকথন, অর্জুনবাক্য আছে। এ পাণ্ডবদিগের তীর্ঘাষ্ঠিগম, তীর্থের ফল ও পবিত্রত্ব কীর্ত্তম, মহর্ষি নারদের পুলস্ত্যতীর্থ যাত্রা মহাত্মা পাণ্ডবদিগের তীর্থযাত্রা, কুণ্ডলদ্বয় দান দ্বারা কর্ণের ইন্দ্রহস্ত হইতে মুক্তি, গয়াসুরের যজ্ঞবর্ণন, অগস্ত্যেপাখ্যান ও বাতাপিভক্ষণ, সন্তান লাভার্থে অগস্ত্য মুনির লোপামুদ্রাপরিগ্রহ, কৌমারব্রহ্মচারী ঋষ্যশৃঙ্গের চরিতর্কীর্ত্তন, অতিতেজস্বী জামদগ্ন্য রামের চরিতকীর্ত্তন, কার্ত্তবীর্য ও হৈহয়দিগের বধবর্ণন, প্রভাসতীর্থে যদুবংশীয়দিগের সহিত পাণ্ডবদিগের সমাগম, সুকন্যার উপাখ্যান, শর্য্যাতি রাজার যজ্ঞে চ্যবনমুনি কর্তৃক অশ্বিনীকুমার যুগলের সোমপীপিকার্যে বরণ, অশ্বিনীকুমার যুগলের অনুগ্রহে চ্যনের যৌবনপ্রাপ্তি, মান্ধাতার উপাখ্যান, জন্তুনামক রাজপুত্রের উপাখ্যান, সমধিক পুলভি বাসনায় সোমক রাজার জনামক পুত্রের প্রাণবধ পূর্বক যজ্ঞানুষ্ঠান ও শতপুত্রপ্রাপ্তি, অত্যুৎকৃষ্ট শ্যেনকপোতোপাখ্যান, ইন্দ্র ও অগ্নির শিবি রাজাকে ধর্ম্ম জিজ্ঞাসা, অষ্টাবক্রাপাখ্যান, জনকশজ্ঞে নৈয়ায়িকশ্রেষ্ঠ বরুণপুত্র বন্দির সহিত অষ্টাবক্র মুনির বিবাদ, অষ্টাবক্রের বন্দি পরাজয় পূর্ব্বক সাগরজলমগ্ন পিতার উদ্ধার, যবক্রীত ও মহাত্মা রেভ্যের উপাখ্যান, পাণ্ডবদিগের গন্ধমাদন যাত্রা ও নারায়ণাশ্রমে বসি, গন্ধমাদনে অবস্থানকালে পুষ্পহরণার্থে দ্রৌপদীর ভীমপ্রেরণ, গমনকালে ভীম কর্তৃক কদলীবনমধ্যস্থ মহবল হনুমানের দর্শন, পুষ্পহরণার্থে ভীমের সরোবরাবগাহন, মহাবল পরাক্রস্তি রাক্ষসগণের ও মূর্ণিমা প্রভৃতি মহাবীর্য্য যক্ষদিগের সহিত ভীনের যুদ্ধ, ভীম কর্তৃক জটাসুর নামক রাক্ষসের বধ, রাজর্ষি বৃষপর্ধার অভিগমন, পাণ্ডবদিগের আষ্টিযেণের আশ্রমে গমন ও বাস, দ্রৌপদীর মহাত্মা ভীমসেনকে উৎসাহ প্রদান, ভীমের কৈলাসারোহণ, তথায় মণিমা প্রভৃতি মহাবল পরাক্রান্ত যক্ষগণের সহিত যুদ্ধ, পাণ্ডবদিগের কুবেরের সহিত সমাগম, দিব্যাস্ত্র লাভানন্তর অর্জুনের ভ্রাতৃগণের সহিত সমাগম, হিরণ্যপুরবাসী নিবাতকবচগণের ও পুলোমপুল কালকেয়দিগের সহিত অর্জুনের যুদ্ধ, অৰ্জ্জুন কর্তৃক তাহাদিগের রাজার প্রাণবধ, যুধিষ্ঠিরসমীপে অর্জুনের অস্ত্র সন্দর্শনের উপক্রম, দেবর্ষি নারদ কর্তৃক প্রতিষেধ, গন্ধমাদন হইতে পাণ্ডবদিগের অবতরণ, গহনবনে পর্বততুল্য প্রকাগুকায় মহাবল ভুজপেন্দ্র কর্তৃক ভীম গ্রহণ, প্রশ্ন কথন পূর্বক যুধিষ্ঠিরের ভীমোদ্ধার, মহাত্মা পাণ্ডবদিগের পুনর্বার কাম্যকবনে আগমন, কাম্যকস্থিত নরশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবদিগের পুনর্দর্শনার্থে কৃষ্ণের আগমন, মার্কণ্ডেয় সমস্যা, মার্কণ্ডেয় কর্তৃক বেণপুত্র পৃথুরাজার উপাখ্যানকীর্ত্তন, সরস্বতী ও তাক্ষ মুনি সংবাদ, তদনন্তর মৎস্যোপাখ্যানকথন, ইন্দ্রদ্যুম্নোপাখ্যান, ধুন্ধুমারোপাখ্যান, পতিব্রতার উপাখ্যান, অঙ্গিরার উপাখান, দ্রৌপদী সত্যভামা সংবাদ, পাণ্ডবদিগের দ্বৈতবনে পুনরাগমন, ঘোষধাত্রা, গন্ধর্ব্বগণ কর্তৃক দুর্যোধনের বন্ধন, অর্জুন কর্তৃক গন্ধর্ববন্ধন হইতে দুর্যোধনের মোচন, যুধিষ্ঠিরের মৃগস্বপ্নদর্শন, কামাকবনে পুনর্গমন, বহুবিস্তৃত ব্রীহি দ্রৌণিক উপাখ্যান, দুর্বাসার উপাখ্যান, আশ্রম মধ্য হইতে জয়দ্রথ কর্তৃক দ্রৌপদী হরণ, মহাবল মহাবেগ ভীম কর্তৃক জয়দ্রথের পঞ্চশিখীকরণ, বহুবিস্তৃত রামায়ণোপাখ্যান, যুদ্ধে রাম কর্তৃক রাবণবধ, সাবিত্রীর উপাখ্যান, কুলদ্বয় দান দ্বারা ইন্দ্র হইতে কর্ণের মুক্তি, সন্তুষ্ট ইন্দ্রের কর্ণকে এক পুরুষঘাতিনী শক্তি দান, অরণেয় উপাখ্যান, ধর্ম্মের স্বপুত্রানুশাসন, বরপ্রাপ্তি পূর্ধক পাণ্ডবদিগের পশ্চিম দিক প্রস্থান। আরণ্যকপর্বে এই সমস্ত বৃত্তান্ত কীর্তিত আছে। এই পর্বে দুই শত কোনসপ্ততি অধ্যায় ও একাদশ সহস্র ছয় শত চৌষট্টি শ্লোক আছে।  হে মুনিগণ! অতঃপর বহুবিস্তৃত বিরাটপর্ব শ্রবণ করুন। পাণ্ডবেরা বিরাটনগরে গমন পূর্ব্বক শ্মশানে অতি প্রকা শমীতরু দৃষ্টিগোচর করিয়া তাহাতে স্ব স্ব অস্ত্র স্থাপন করিলেন, এবং নগরে প্রবেশ করিয়া ছাবেশে বাস করিতে লাগিলেন। তথায় ভীমসেন দ্রৌপদীসম্ভোগাভিলাষী কামান্ধ দুরাত্মা কীচকের প্রাণদও করেন। রাজা দুর্য্যোধন পাণ্ডবদিগের অন্বেষণার্থ চতুর্দিকে সুচতুর চরমগুলী প্রেরণ করেন; তাহারা মহাত্মা পাণ্ডবদিগের সন্ধান করিতে পারিল না। প্রথমতঃ ত্রিগর্ত্তেরিা বিরাট রাজার গোন হরণ করে। তাহাদিগের সহিত বিরাটের ঘোরতর যুদ্ধ হয়। ত্রিগর্ত্তরা বিরাটকে বন্ধন করিয়া লইয়া যাইতেছিল, ভীম তাঁহাকে মুক্ত করেন। পাণ্ডবেরা ত্রিগদিগকে পরাভূত করিয়া বিরাটের অপহৃত গোধন উদ্ধার করিলেন। তৎপরে কৌরবেরা তাহার গোপন হরণ করেন। অর্জুন নিজ বিক্রমে সমস্ত কৌরবদিগকে রণে পরাজিত করিয়া গোন প্রত্যাহরণ করিলেন। বিরাট রাজা সুভদ্রাগর্ভসস্তৃত শত্রুঘাতী অভিমন্যুকে উদ্দেশ করিয়া অর্জুনকে নিজ কন্যা উত্তরা সম্প্রদান করিলেন। অতি বিস্তৃত বিরাটনামক চতুর্থ পর্ব বর্ণিত হইল। এই পর্বে মহর্ষি সপ্তধষ্ঠি অধ্যায় গণনা করিয়াছেন। এক্ষণে শ্লোকসংখ্যা নির্দেশ করিতেছি, শ্রবণ করুন; এই পার্শে বেবেত্তা মহর্ষি দ্বিসহস্র পঞ্চাশৎ শ্লোক কীর্ত্তন করিয়াছেন।

 অতঃপর উদ্যোগনামক পঞ্চম পর্ব প্রবণ করুন। পাণ্ডবেরা বিপক্ষ জয়ার্থ উৎসুক হইয়া উপপ্লব্যনামক স্থানে অবস্থিত হইলে দুর্য্যোধন ও অর্জুন বাসুদেবসন্নিধানে উপস্থিত হইলেন, এবং উভয়েই প্রার্থনা করিলেন, তুমি এই যুদ্ধে আমার সহায়তা কর। মহামতি কৃষ্ণ উত্তর করিলে, এক পক্ষে এক অক্ষৌহিণী সেনা, পক্ষান্তরে আমি একাকী, কিন্তু আমি যুদ্ধ করিব না, কেবল মন্ত্রিস্বরূপ থাকিব; তোমরা ইহার কে কি প্রার্থনা কর, বল। হিতাহিতবিবেকানভিজ্ঞ দুর্ম্মতি দুর্যোধন সৈন্য প্রার্থনা করিলেন, অর্জুন যুদ্ধবিমুখ কৃষ্ণকে মন্ত্রিত্বে বরণ করিলেন। মদ্ররাজ শল্য পাণ্ডবদিগের সাহায্যার্থ যাইতেছিলেন; দুর্যোধন পথে তাঁহার দর্শন পাইয়া উপহার প্রদান দ্বারা বশীভূত করিয়া এই প্রার্থনা করিলেন, তুমি আমার সাহায্য কর। শল্য অঙ্গীকার করিয়া পাণ্ডবদিগের নিকট প্রস্থান করিলেন, এবং তথায় উপস্থিত হইয়া শান্তু বাক্যে রাজা যুধিষ্ঠিরকে ইন্দ্রের’ বৃত্রাসুরজয়বৃত্তান্ত শ্রবণ করাইলেন। পাণ্ডবের কৌরসমীপে পুরোহিত প্রেরণ করিলেন। প্রতাপবান্ মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবপ্রেরিত পুয়োহিতের বাক্য শ্রবণ করিয়া শান্তিস্থাপন বাসনায় সঞ্জয়কে পাণ্ডবদিগের নিকট দূতস্বরূপ প্রেরণ করিলেন। বাসুদেবের ও পাণ্ডবদিগের বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া চিন্তায় ধৃতরাষ্ট্রের নিদ্রাত্যাগ হইল। বিহুর মহাপ্রাজ্ঞ রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে বহুতর অদ্ভুত হিতবাক্য শ্রবণ করাইলেন। মহর্ষি সনৎজাতও রাজাকে মনস্তাপান্বিত ও শোকবিহ্বল দেখিয়া পরমোৎকৃষ্ট অধ্যাত্ম শাস্ত্র শুনাইলেন। সঞ্জয় প্রকাতে রাজসভায় উপস্থিত হইয়া কৃষ্ণ ও অর্জুন একাত্মা বলিয়া বর্ণনা করিলেন। মহামতি কৃষ্ণ কৃপাপরতন্ত্র হইয়া বিরোধভঞ্জন ও শাস্তিস্থাপনার্থে হস্তিনাপুরে গমন করিলেন। রাজা দুর্যোধন উভয় পক্ষের হিতাকাঙক্ষী কৃষ্ণের অনুরোধ রক্ষা করিলেন না। এই স্থলে দম্ভোব রাজার উপাখ্যান, মহাত্মা মাতলির নিজ কন্যার্থে বরান্বেষণ, মহর্ষি গালৰের চরিত ও বিদুলার স্বপুত্রানুশাসন কীর্তিত আছে। কৃষ্ণ, কর্ণ, দুর্যোধন প্রভৃতির দুষ্ট মন্ত্রণ জ্ঞাত হইয়া সমস্ত রাজাদিগকে স্বীয় যোগেশ্বরত্ব প্রদর্শন করিলেন। অনন্তর কর্ণকে নিজ রথে আরোহণ করাইয়া তাহার সহিত অশেষবিধ পরামর্শ করিলেন। কর্ণ গান্ধতা প্রযুক্ত তদীয় পরামর্শ গ্রাহ্য করিলেন। শত্রুঘাতী কৃষ্ণ হস্তিনা হইতে উপপ্লব্যে প্রত্যাগমন করিয়া পাণ্ডবদিগের নিকট আদ্যোপান্ত অবিকল বর্ণনা করিলেন। তাহারা তদীয় বাক্য শ্রবণ করিয়া হিতাহিত মন্ত্রণ পূর্বক সংগ্রামের সমুদায় সজ্জা করিলেন। তদনন্তর সমুদায় পদাতি, অশ্ব, রপ, গজ, যুদ্ধার্থে হস্তিনানগর হইতে নির্গত হইল। রাজা দুর্যোধন যুদ্ধারম্ভের পূর্ব দিবসে উলূকনামক এক ব্যক্তিকে দৌত্যকার্যে নিযুক্ত করিয়া পাণ্ডবদিগের নিকট প্রেরণ করিলেন। তৎপরে সৈন্যসংখ্যা ও কাশিরাজদুহিতা অম্বার উপাখান। বহুবৃন্তযুক্ত সন্ধিৰি গ্রহবিশিষ্ট উদ্যোগনামক ভারতীয় পঞ্চম পর্ব নির্দিষ্ট হইল। মহর্ষি উদ্যোগপলে এক শত যড়শীতি অধ্যায় নির্দেশ করিয়াছেন। হে তপোধনগণ! উদারমতি মহাত্ম। ব্যাসদেব এই পর্বে ষটসহস্র যশত অষ্ট মবতি শ্লোক রচনা করিয়াছেন।

 অতঃপর অদ্ভুত ভীষ্মপর্ব বর্ণিত হইতেছে। এই পর্বে সঞ্জয় জখ নিৰ্মাণ বর্ণনা করেন। যুধিষ্ঠিরসৈন্য অত্যন্ত বিষাদ প্রাপ্ত হয়। দশাহ ঘোরতর যুদ্ধ হয়। মহামতি বাসুদেব অধ্যাত্ম বিদ্যা সম্বদ্ধ হেতুবাদ দ্বারা অর্জুনের মায়ামমাহজনিত বিষাদ নিরাকরণ করেন। যুধিষ্ঠিরহিতাকাঙক্ষী উদারমতি কৃষ্ণ বিশেষ পর্যালোচনা করিয়া সত্বর রথ হইতে লক্ষ প্রদান পূর্বক অতি দ্রুত গমনে প্রতোদহস্তে নির্ভয় চিত্তে ভীষ্মকে সংহার করিতে যান, এবং সকলশস্ত্রধারিশ্রেষ্ঠ অর্জুনকে বাক্যরূপ দণ্ড দ্বারা তাড়না করেন। অর্জুন শিখণ্ডিকে সম্মুখে স্থাপন করিয়া তীক্ষ্ণতর শর প্রহার দ্বারা ভীষ্মকে রথ হইতে ভূতলে পাতিত করেন। ভীষ্ম শরশয্যায় শয়ন করিলেন। বহুবিস্তৃত ভারতীয় ষষ্ঠ পর্ব কথিত হইল। বেদ বেত্তা ব্যাস ভীষ্মপর্বে এক শত সপ্তদশ অধ্যায় ও পঞ্চ সহস্র অষ্ট শত চতুরশীতি শ্লোক কীর্ত্তন করিয়াছেন।

 তদনন্তর বহু বৃত্তান্তু যুক্ত বিচিত্র দ্রোণপর্ব আরব্ধ হইতেছে। প্রতাপবান্ মহাস্ত্রবেত্তা দ্রোণাচার্য সেনাপতিপদে অভিষিক্ত হইয়া দুর্যোধনের প্রত্যর্থে প্রতিজ্ঞা করিলেন, ধীমান্ ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে যুদ্ধে বদ্ধ করিয়া আনিব। সংশপ্তকেরা অৰ্জ্জুনকে রণক্ষেত্র হইতে অপসারিত করে। সংগ্রামে শক্রতুল্য মহারাজ ভগদত্ত সু প্রতীক নামক স্বীয় হস্তীর পরাক্রমে যুদ্ধে অতি দুর্ধর্ষ ও ভয়ানক হইয়া উঠেন। অর্জ্জুন সুপ্রতীকের প্রাণ সংহার করেন। জয়দ্রথ প্রভৃতি অনেক মহারথের একত্র হইয়া অতি পরাক্রান্ত অপ্রাপ্তযৌবন শিশু প্রায় অভিমনুর প্রাণবধ করেন। অভিমন্যু হত হইলে অর্জ্জুন ক্রুদ্ধ হইয়া সমরে সপ্ত অক্ষৌহিণী সেন। সংহার পূর্বক জয়দ্রথের জীবন নাশ করেন। মহাবাহু ভীম ও মহারথ সাত্যকি রাজা যুধিষ্ঠিরের আদেশানুসারে অর্জ্জুনের অন্বেষণার্থ দেবতাদিগেরও দুৰ্দ্ধৰ কৌরবসৈন্য মধ্যে প্রবেশ করেন। হাবশিষ্ট সংশপ্তকেরা সংগ্রামে নিঃশেষ হয়। দ্রোণপর্বে অলম্বুষ, শ্রুতায়ু, বীর্য্যবান্ জলসন্ধ, সোমদত্ত, বিরাট, মহারথ দ্রুপদ, ঘটোৎকচ, ও অন্যান্য বীরপুরুষেরা নিহত হয়েন। দ্রোণাচার্য যুদ্ধে নিপাতিত হইলে অশ্বথামা অমর্ষপরবশ হইয়া অতি ভয়ঙ্কর নারায়ণাস্ত্র প্রয়োগ করেন। এই পর্বে উৎকৃষ্ট রুদ্রমহাত্ম, ব্যাসদেবের আগমন, এবং কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের মাহাত্ম্য কীর্ত্তিত হইয়াছে। ভারতের সপ্তম পর্ব্ব উদাহৃত হইল। দ্রোণপর্বে যে সকল পরাক্রান্ত পুরুষশ্রেষ্ঠ পৃথিবীপাল নির্দিষ্ট হইয়াছেন, প্রায় সকলেই নিধন প্রাপ্ত হয়েন। তত্ত্বদশী মহর্ষি পরাশরসূনু সবিশেষ পর্যালোচনা করিয়া দ্রোণপর্বে এক শত সপ্ততি অধ্যায় ও অষ্ট সহস্র নব শত নব শ্লোক সংখ্যা করিয়াছেন।

 অতঃপর পরমাস্তুত কর্ণপর্ব উক্ত হইতেছে। ধীমান্ শল্যের সারথিকার্য্যে নিয়োগ, ত্রিপুরনিপাত বর্ণন, প্রস্থান কালে কর্ণ ও শল্যের পরস্পর কলহ, কর্ণ তিরস্কারার্থ শল্যর হংসকাকীয় উপাখ্যান কথন মহাত্মা অশ্বত্থামা কর্তৃক পাণ্ড্যরাজার বধ, তৎপরে দগুসেন ও দণ্ডের বধ, সর্ব্বধনুর্দ্ধর সমক্ষে কর্ণের সহিত দ্বৈরথ যুদ্ধে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের প্রাণ সংশয়, যুধিষ্ঠির ও অর্জ্জুনের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের কোপ। কৃষ্ণ অনুনয় দ্বারা অর্জ্জুনের কোপ শান্তি করিলেন। ভীম প্রতিজ্ঞা পূর্বক রণক্ষেত্রে দুঃশাসনের বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ করিয়া তদীয় শোণিত পান করেন। অর্জ্জুন দ্বৈরথ যুদ্ধে মহারথ কর্ণের প্রাণসংহার করেন। মহাভারতের অষ্টম পর্ব নির্দিষ্ট হইল। কর্ণপর্বে একোনসপ্ততি অধ্যায় ও চারি সহস্র নয় শত চতুঃষষ্টি শ্লোক কীর্তিত হইয়াছে।

 অতঃপর বিচিত্র শল্যপর্ব্ব আরব্ধ হইতেছে। কৌরবসৈন্য বীরশূন্য হইলে মদ্রেশ্বর শল্য সেনাপতি হইলেন। শল্যপর্ব্বে যাবতীয় সুখযুদ্ধ ও কৌরবপক্ষীয় প্রধান বীরদিগের বিনাশ কীর্তিত হইয়াছে। মহাত্মা যুধিষ্ঠিরের হস্তে শস্যের ও সহদেবইস্তে শকুনির প্রাণবধ হয়। দুর্য্যোধন স্বীয় সৈন্য অল্পমাত্রাবিশিষ্ট দেখিয়া হ্রদ প্রবেশ পূর্বক জলস্তম্ভ করিয়া অবস্থিতি করিতে 'জাগিলেন। ব্যাধেরা ভীমকে তাঁহার সন্ধান বলিয়া দিল। অত্যন্ত অভিমানী দুর্য্যোধন ধীমান্ ধর্ম্মরাজের তিরস্কারবাক্য সস্থ করিতে না পারিয়া হ্রদ হইতে গাত্রোত্থান পূর্বক ভীমসেনের সহিত গদাযুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। গদাযুদ্ধকালে বলরাম তথায় উপস্থিত হইলেন। তৎপরে সরস্বতী দেবীর ও অশেষ তীর্থের পবিত্রত্ব কীর্ত্তন ও তুমুল গদাযুদ্ধ বর্ণন। ভীম অতি প্রচণ্ড গদাঘাতে যুদ্ধে রাজা দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করিলেন। অদ্ভুত নবম পর্ব্ব নির্দিষ্ট হইল। এই পর্বে বহু বৃত্তান্ত সম্বলিত ঊনষষ্টি অধ্যায় সংখ্যাত হইয়াছে। এক্ষণে শ্লোকসংখ্যা কথিত হইতেছে, কৌরবদিগের কীর্তিকীর্ত্তক মুনি নবম পর্বে তিন সহস্র দুই শত বিংশতি শ্লোক রচনা করিয়াছেন।

 অতঃপর অতি দারুণ সৌতিকপর্ব্ব বর্ণন করিব। পাণ্ডবেরা রণক্ষেত্র হইতে প্রস্থান করিলে পর, কৃতবর্মা, কৃপাচার্য ও অশ্বত্থামা এই তিন মহারথ সায়ংকালে রুধিরাক্তসৰ্বাঙ্গ ভগ্নোরু অভিমানী রাজা দুর্যোধনের নিকট গমন করিলেন। উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, রাজা রণক্ষেত্রে পতিত আছেন। দৃঢ়ক্রোধ মহারথ অশ্বথামা প্রতিজ্ঞা করিলেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি সমুদায় পাঞ্চাল ও অমাত্য সহিত সমস্ত পাণ্ডবদিগের প্রাণ সংহার না করিয়া গাত্র হইতে তনুত্রাণ উদঘাটন করিব না। রাজাকে এইরূপ কহিয়া তিন মহারথেই তথা হইতে অপব্রুান্ত হইয়া সূর্যাস্ত সময়ে বনমধ্যে প্রবেশ পূর্ব্বক গতি প্রকাণ্ড বটবিটপিতলে উপবিষ্ট হইলেন। অশ্বত্থামা তথায় রাত্রিকালে এক পেচককে অনেক কাকের প্রাণসংহার করিতে দেখিয়া পিতৃবধ স্মরণে কোপাবিষ্ট হইয়া নিদ্রান্বিত পাঞ্চালদিগের প্রাণবধ সংকল্প করিলেন। তদনুসারে শিবিরম্বারে উপস্থিত হইলেন এবং দেখিলেন, এক বিকটাকার অতি প্রকাণ্ড ভয়ানক রাক্ষস আকাশ পর্যন্ত রোধ করিয়া তথায় অবস্থিত আছে। অশ্বত্থামা যত অস্ত্র প্রয়োগ করিলেন, রাক্ষস সমুদায় ব্যর্থ করিল। তখন তিনি সন্বর মহাদেবের আরাধনা করিয়া কৃতবর্মা ও কৃপাচার্যের সহযোগে নিদ্রাগত ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি পাঞ্চাল ও দ্রৌপদীনন্দনদিগের প্রাণবধ করিলেন। কৃষ্ণের বলাশ্রয় প্রভাবে কেবল পঞ্চ পাণ্ডব ও সাত্যকি রক্ষা পাইলেন; অবশিষ্ট সকলেই নিধন প্রাপ্ত হইল। ধৃষ্টদ্যুম্নের সারথি পাণ্ডবদিগকে সংবাদ 'দিল, অশ্বত্থামা নিদ্রাভিভূত পাঞ্চালদিগের প্রাণবধ করিয়াছে। দ্রৌপদী পুত্রশোকে আর্ত্তা ও পিতৃ ভ্রাতৃ বধ শ্রবণে কাতরা হইয়। অনশন সংকল্প করিয়া ভক্তগণসন্নিধানে উপবিষ্ট হইলেন। মহাপরাক্রান্ত বীর্যবান্ ভীমসেন দ্রৌপদীর মনস্তুষ্টি সম্পাদনার্থে তদীয় বচনানুসারে গদাগ্রহণ পূর্বক কুপিত চিত্তে গুরুপুত্রের পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। অশ্বত্থামা ভীমভয়ে অভিভূত, কোষপরবশ ও দৈবপ্রেরিত হইয়া, পৃথিবী অপাণ্ডব হউক, এই বলিয়া অস্ত্র ত্যাগ করিলেন। কৃষ্ণ, এরূপ করিও না, বলিয়া অশ্বত্থামাকে নিষেধ করিলেন। পাপমতি অশ্বথামার অনিষ্টীচরণে এইরূপ অভিনিবেশ দেখিয় অর্জ্জুন অস্ত্র দ্বারা সেই অস্ত্রের নিবারণ করিলেন। অশ্বথামা দ্বৈপায়ন প্রভৃতি পরস্পর শপ প্রদান করিলেন। পাণ্ডবের। মহারথ দ্রোণপুত্রের নিকট হইতে মণিগ্রহণ করিয়া হৃষ্ট চিত্তে দ্রৌপদীহস্তে সমর্পিলেন। সৌপ্তিকনামক দশম পর্ব উদাহৃত হইল। উত্তমভেজা ব্রহ্মবাদী মহাত্মা মুনি সৌপ্তিকপর্বে ষ্টাদশ অধ্যায় ও অষ্ট শত সপ্ততি শ্লোক সংখ্যা করিয়াছেন। ঐষীকপ এই পর্বের অন্তর্গত।

 অতঃপর করুণরসোদ্বোধক স্ত্রীপর্ব্ব আরব্ধ হইতেছে। এই পর্বে পুত্রশোকসন্তপ্ত প্রজ্ঞাচক্ষুঃ রাজা ধৃতরাষ্ট্র মনে মনে ভীমসেনের প্রাণবধ সংকল্প করিয়া কৃষ্ণানীত লৌহময়ী ভীমপ্রতিমূর্তি ভগ্ন করেন। বিদুর অধ্যাত্ববিদ্যাসম্বদ্ধ হেতুবাদ দ্বারা শোকাভিভূত ধীমান্ ধৃতরাষ্ট্রের সাংসারিক মায়া মোহ নিরাকরণ ও তাহাকে আশ্বাস প্রদান করেন। শোকার্ত্ত ধৃতরাষ্ট্র অন্তঃপুরিকাগণের সহিত রণক্ষেত্র দর্শনার্থ গমন করেন। বীরপত্নীদিগের অতি করুণ বিলাপ এবং গান্ধারী ও ধৃতরাষ্ট্রের কোপাবেশ ও মোহ। ক্ষত্রিয়নারীগণ যুদ্ধে অপরায়ুখ পঞ্চত্বপ্রাপ্ত পিতা ভ্রাতা ও পুদিগকে দেখিতে লাগিলেন। কৃষ্ণ পুত্রপৌত্রশোককাতরা গান্ধারীর কোপ শান্তি করিলেন। পরমধার্ম্মিক মহাপ্রাজ্ঞ রাজা যুধিষ্ঠির যথাশাস্ত্র রাজাদিগের শরীরদাহ করাইলেন। প্রেততপণ আরব্ধ হইলে কুন্তী কর্ণকে স্বীয় গৃঢ়ৎপন্ন পুত্র বলিয়া অঙ্গীকার ও প্রকাশ করিলেন। মহর্ষি ব্যাস এই একাদশ পর্ব্ব রচনা করিয়াছেন। এই পর্ব শ্রবণ ও অধ্যয়ন করিলে সজ্জনদিগকে শোকে অভিভূত ও অশ্রুজলে আকুলিত হইতে হয়। ধীমান্ ব্যাসদেব স্ত্রীপর্ব্ব সপ্তবিংশতি অধ্যায় ও সপ্ত শত পঞ্চ সপ্ততি শ্লোক কীর্ত্তন করিয়াছেন।

 অতঃপর শান্তিপর্ব্ব; ইহার অধ্যয়নে বুদ্ধিবৃদ্ধি হয়। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির পিতৃ ভ্রাতৃ পুত্র মাতুল প্রভৃতির সংহার করাইয়া যৎপরোনাস্তি নিৰ্বেদ প্রাপ্ত হয়েন। শরশয্যারূঢ় ভীষ্মদেব রাজা যুধিষ্ঠিরকে রাজধর্ম্ম শ্রবণ করান। ঐ সমুদায় ধর্মজ্ঞানাভিলাষী রাজগণের অবশ্যজ্ঞেয়। ভীষ্মদেব কাল ও কারণ প্রদর্শন পূর্ব্বক আপদ্ধর্ম্ম কীর্ত্তন করেন। ঐ সকল ধর্ম্ম অবগত হইলে নর সর্বজ্ঞ প্রাপ্ত হয়। অনন্তর বিচিত্র মোক্ষধর্ম্মও সবিস্তর ব্যাখ্যাত হইয়াছে। প্রাজ্ঞজনপ্রীতিপ্রদ দ্বাদশ পর্ব নির্দিষ্ট হইল। হে তপোবনগণ! শান্তিপর্বে ত্রিশত উনচত্বারিংশৎ অধ্যায় আছে জানিবেন। ধীমান্ পরাশরনন্দন এই পর্বে চতুর্দশ সহস্র সপ্ত শত সপ্ত শ্লোক রচনা করিয়াছেন।

  হে মহর্ষিগণ! ইহার পরেই অতি প্রশস্ত অনুশাসনপর্ব। কুরুরাজ যুধিষ্ঠির ভগীরথীপুত্র ভীষ্মের নিকট ধর্ম্মনির্ণয় শ্রবণ করিয়া হতশোক ও স্থিরচিত্ত হইলেন। এই পর্বে ধর্ম ও অর্থের অনুকূল যাবতীয় ব্যবহার প্রদর্শন, অশেষবিধ দানের পৃথক পৃথক ফল নির্দেশ, সদসৎ পাত্র বিবেক, দানবিধি কথন, আচারবিধি নির্ণয়, সত্যস্বরূপ নিরূপণ, গো ব্রাহ্মণের মাহাত্ম্য কীর্ত্তন, দেশকালানুসারে ধর্ম্মরহস্য মীমাংসা, ও ভীষ্মদেবের স্বর্গারোহণ কীর্ত্তন আছে। ধর্ম্মনির্ণয়যুক্ত বহুবৃত্তান্তালব্ধত অনুশাসন নামক ত্রোয়োদশ পর্ব নির্দ্দির্ষ্ট হইল। এই পর্বে এক শত ষট্চত্বারিংশৎ অধ্যায় ও অষ্ট সহ শ্লোক সংখ্যাতি আছে।

 তৎপরে আমেধিক নামক চতুর্দশ পর্ব। সংবর্তমুনি ও মরুরাজার উপাখ্যান, যুধিষ্ঠিরের হিমালয়স্থিত সুবর্ণরাশি প্রাপ্তি ও পরীক্ষিতের জন্ম। পরীক্ষিৎ অশ্বত্থামার অস্ত্রানলে দগ্ধ হইয়াছিলেন; কৃষ্ণ পুনর্বার তাঁহাকে জীবন দান করেন। উৎকৃষ্ট যজ্ঞীয় অশ্ব রক্ষার্থ তদনুগামী অর্জুনের নানা স্থানে কুপিত রাজপুত্রগণের সহিত যুদ্ধ। চিত্রাঙ্গদাগর্ভসস্তৃত নিজপুত্র ববাহনের সহিত সংগ্রামে অর্জুনের প্রাণসংশয় ঘটে। অশ্বমেধষজ্ঞে নকুলবৃত্তান্ত কীর্ত্তন। পরমাদ্ভূত আমেধিকপর্ব উক্ত হইল। তত্ত্বদর্শী মহর্ষি এই পর্বে এক শত তিন অধ্যায় ও তিন সহস্র তিন শত বিংশতি শ্লোক নির্দ্দেশ করিয়াছেন।

 তৎপরে আশ্রমবাস নামক পঞ্চদশ পর্ব্ব। রাজা ধৃতরাষ্ট্র রাজ্য পরিত্যাগ করিয়া বিদুর ও গান্ধারী সমভিব্যাহারে অরণ্য প্রবেশ পূর্বক ঋষিদিগের আশ্রমে বাস করেন। গুরুশুশ্রূষাপরায়ণা কুন্তী তাঁহাকে প্রস্থান করিতে দেখিয়া পুত্ররাজ্য পরিত্যাগ পূর্বক তদনুগামিনী হইলেন। রাজা ধৃতরাষ্ট্র যুদ্ধহত লোকান্তরগত পুত্র পৌত্রগণ ও অন্যান্য পার্থিবদিগকে জীবিত পুনরাগত অবলোকন করিলেন। তিনি মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের প্রসাদাৎ এইরূপ অত্যুৎকৃষ্ণ আশ্চর্য সন্দর্শন করিয়া শোক পরিত্যাগ পূর্বক সস্ত্রীক পরম সিদ্ধি প্রাপ্ত হইলেন। বিদুর ও মহামাত্য বিদ্বান্ জিতেন্দ্রিয় সঞ্জয় ধর্ম্মপথ আশ্রয় করিয়া সদগতি পাইলেন। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির নারদের সন্দর্শন পাইয়া তাহার প্রমুখাৎ যদুবংশীয়দিগের কুলক্ষয়বার্তা শ্রবণ করিলেন। অত্যদ্ভুত আশ্রমবাসখ্য পর্ব উক্ত হইল। তত্ত্বদর্শী ব্যাস এই পর্বে দ্বিচত্বারিংশৎ অধ্যায় ও এক সহস্র পাঁচ শত ছয় শ্লোক গণনা করিয়াছেন।

 হে মহর্ষিগণ! অতঃপর অতি দারুণ মৌষলপব জানিবেন। এই পর্বে ব্রহ্মপনিগৃহীত পুরুষশ্রেষ্ঠ যাদবেরা আপানে[২] সুরাপানে মত্ত ও দৈবপ্রেরিত হইয়া এরকারূপী[৩] বজ্র দ্বারা পরস্পর প্রহার করেন। রাম ও কেশব কুলক্ষয় করিয়া পরিশেষে উভয়ে সর্ব্বসংহারকারী উপস্থিত কালাকে অতিক্রম করিলেন না। 'নরশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুন আসিয়া দ্বারকা যাদৰশূন্য নিরীক্ষণ করিয়া যৎপরোনাস্তি বিষাদ ও মনঃপীড়া প্রাপ্ত হইলেন। তিনি আত্মমাতুল নরশ্রেষ্ঠ বসুদেবের সংস্কার করিয়া কৃষ্ণ, বলরাম, ও অন্যান্য প্রধান প্রধান যাদবদিগের ও সংস্কার করিলেন। অনন্তর দ্বারকা হইতে বালক ও বৃদ্ধদিগকে সমভিব্যাহারে লইয়া যাইতে যাইতে বিপৎকালে গাণ্ডীবের পরাক্রমক্ষয় ও দিব্যাস্ত্র সমুদায়ের অস্ফূর্ত্তি অবলোকন করিলেন, এবং যাদবরমণীদিগের অপহরণ এবং প্রভুত্ব ও ঐশ্বর্যের অনিত্যতা দর্শনে সাতিশয় নিবেদ প্রাপ্ত হইয়া ধর্ম্মরাজসন্নিধানে প্রত্যাগমন পূর্বক সন্ন্যাসাবলম্বনের বাসনা করিলেন। মৌষল নামক যোড়শ পর্ব পরিকীর্তিত হইল। তত্ত্বদর্শী দ্বৈপায়ন এই পর্বে আট অধ্যায় ও তিন শতবিংশতি শ্লোক সংখ্যা করিয়াছেন। | তৎপরে মহাপ্রস্থানিক নামক সপ্তদশ পর্ব। এই পর্বে পুরুষশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবেরা রাজ্য পরিত্যাগ করিয়া দ্রৌপদী সমতিব্যাহারে মহাপ্রস্থান গমন করেন। তাঁহাৱা লৌহিত্যসাগরতীরে উত্তীর্ণ হইয়া অগ্নির সাক্ষাৎকার লাভ করিলেন। অর্জুন মহাত্মা অগ্নির আদেশানুসারে পূজা পূর্বক তাহাকে সর্বধনুঃশ্রেষ্ঠ দিব্য গাণ্ডীব প্রদান করিলেন। যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণ ও দ্রৌপদীকে ক্রমে ক্রমে নিপতিত ও নিধনপ্রাপ্ত দেখিয়া তাঁহাদিগের প্রতি দৃষ্টিপাত না করিয়া মায়া পরিত্যাগ পূর্বক প্রস্থান করিলেন। মহাপ্রস্থানিক নামক সপ্তদশ পর্ব নির্দিষ্ট হইল। তত্ত্বদশী ঋষি এই পর্বে তিন অধ্যায় ও তিন শত বিংশতি শ্লোক নিরূপণ করিয়াছেন[৪]

 তৎপরে অলৌকিক অত্যাশ্চর্য স্বর্গপর্ব। মহাপ্রাজ্ঞ ধর্ম্ম রাজ দয়াহৃদয়তা প্রযুক্ত স্বসমভিব্যাহারী কুকুরকে পরিত্যাগ করিয়া দেবলোকাগত দিব্য রথে আরোহণ করিতে সম্মত হইলেন না। ধর্ম্ম, মহাত্মা যুধিষ্ঠিরের এইরূপ অবিচলিত ধর্ম্মনিষ্ঠা দর্শনে পরম প্রীত হইয়া, কুকুররূপ পরিত্যাগ পূর্বক তাহাকে দর্শন দিলেন, যুধিষ্ঠির তৎসমভিব্যাহারে সুর্গারোহণ করিলেন। দেবদূত দুলক্রমে তাঁহাকে নরক দর্শন করাইল ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির সেই স্থানে অবস্থিত আজ্ঞানুবর্তী ভ্রাতৃগণের কাতর শব্দ শ্রবণ করিলেন। ধর্ম্ম ও ইন্দ্র ভঁহার ক্ষোভ নিরাকরণ করিলেন। অনন্তর ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির আকাশগঙ্গায় অবগাহন করিয়া মানবদেহ পরিত্যাগ পূর্বক স্বর্গে স্বধর্ম্মার্জিত স্থান প্রাপ্ত হইয়া ইন্দ্রাদি দেবগণ সমভিব্যাহারে পরমাদরে ও পরমানন্দে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন, ব্যাসদেবপ্রোক্ত স্বর্গারোহণ নামক অষ্টাদশ পর্ব নির্দিষ্ট হইল। মহাত্মা ঋষি এই পর্ব্বে পাঁচ অধ্যায় ও দুই শত নয় শ্লোক সংখ্যা করিয়াছেন।

 এই রূপে অষ্টাদশ পর্ব সবিস্তর উক্ত হইল। তৎপরে হরিবংশ ও ভবিষ্যপর্ব কীর্তিত হইয়াছে। মহর্ষি হরিবংশে দ্বাদশ সহস্র শ্লোক গণনা করিয়াছেন।

 মহাভারতীয় পর্ব্বসংগ্রহ কীর্ত্তিত হইল[৫]

যুদ্ধাভিলাষে অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী একত্র সমাগত হইয়াছিল। অষ্টাদশ দিবস ঐ মহাদারুণ যুদ্ধ হয়।

 যে দ্বিজ অঙ্গ[৬] ও উপনিষদ্ সহিত চারি বেদ জানেন, কিন্তু এই আখ্যান গ্রন্থ জানেন না, তিনি কখনই বিচক্ষণ নহেন। অমিতবুদ্ধি ব্যাসদেব এই গ্রন্থকে অর্থশাস্ত্র, ধর্ম্মশাস্ত্র, ও কামশাস্ত্র স্বরূপ নির্দেশ করিয়াছেন। যেমন পুংস্কোকিলের কলরব শ্রবণ করিয়া কর্কশ কাশব্দ শ্রবণে অনুরাগ হয় না, সেইরূপ এই উপাখ্যান শ্রবণ করিয়া শাস্ত্রান্তর শ্রবণে অভিরুচি থাকে না। যেমন পঞ্চভূত হইতে ত্রিবিধ লোকসৃষ্টি নিষ্পন্ন হয়, সেইরূপ এই সর্বোত্তম ইতিহাস গ্রন্থ হইতে কবিগণের বুদ্ধি উৎপন্ন হয়। যেমন চতুর্ব্বিধ[৭] প্রজা অন্তরীক্ষের অন্তর্গত, হে দ্বিজগণ সেইরূপ যাবতীয় পুরাণ এই উপাখ্যানের অন্তর্বর্তী। যেমন মনের ক্রিয়া সমস্ত ইন্দ্রিয়ের আশ্রয়, সেইরূপ এই আখ্যান শাস্ত্র অশেষবিধ ক্রিয়া[৮] ও গুণের[৯] আশ্রয়। যেমন হার ব্যতিরেকে শরীরধারণের অন্য উপায় নাই, সেইরূপ এই উপাখ্যানের অন্তর্গত কথা ব্যতিরিক্ত ভূমণ্ডলে আর কথা নাই। যেমন অভুয়াকাঙক্ষী ভূতেরা সৎকুলজাত প্রভুর সেবা করিয়া থাকে, সেইরূপ, সমস্ত কবিগণ এই উপাখ্যানের উপাসনা করেন। যেমন গৃহস্থাশ্রম অন্যান্য সমস্ত আশ্রম অপেক্ষা উৎকৃষ্ট, সেইরূপ এই কাব্য অন্যান্য কবিকৃত যাবতীয় কাব্য অপেক্ষ। উৎকৃষ্ট।

 তোমাদিগের সর্বদা ধর্ম্মে মতি হউক, পরলোকগত ব্যক্তির ধর্ম্মই একমাত্র বন্ধু। অর্থ ও স্ত্রী সাতিশয় নৈপুণ্য সহকারে উপসিত হইলেও কোন কালে আত্মীয় ও স্থায়ী হয় না।

 যে ব্যক্তি দ্বৈপায়নের ওষ্ঠপুটবিগলিত অপ্রমেয় পরম পবিত্র পপির মঙ্গলকর ভারতপাঠ শ্রবণ করে, তাহার পুস্কর[১০] জলাভিষেকের প্রয়োজন কি? ব্রাহ্মণ দিবাভাগে ইন্দ্রিয়সেবা দ্বারা যে পাপ সঞ্চয় করেন, মহাভারত কীন করিলে সায়ংকালে সেই পাপ হইতে মুক্ত হয়েন। তার রাত্রিকালে কায়মনোবাক্যে যে পাপানুষ্ঠান করেন, ভারত কীর্তন করিলে প্রাতঃকালে তাহা হইতে মুক্ত হয়েন। যে ব্যক্তি বহুত বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে স্বর্ণশৃঙ্গসমন্বিত গোশত দান করে, আর যে ব্যক্তি পরম পবিত্র ভারতকথা নিত্য শ্রবণ করে, সেই দুই জনের তুল। ফল লাভ হয়। যেমন বিস্তীর্ণ সমুদ্র তরণীযোগে অনায়াসগম হয়, সেইরূপ অগ্ন পরসংগ্রহ শ্রবণ করিলে এই অতুংকৃষ্ট মহৎ আখ্যানশাস্ত্র মনুষ্যের পক্ষে সুগম হয়।

  1. হিংসা স্তেয় মিথ্যা প্রতারণা প্রভৃতি।
  2. যে স্থানে উপবিষ্ট হইয়া সুরাপন করে।
  3. এরা তৃণবিশেষ, খড়ী।
  4. (৩৬) শ্লোকনাঞ্চ শতত্রয়ম্। বিংশতিশ্চ তথা শ্লোক সংখ্যাতাসুহৃদর্শিনা। এই স্থলে যথাশ্রুত অর্থ লিখিত হইল। কিন্তু মহাপ্রস্থানপর্বে এক শত এয়োবিংশতি শ্লোকের অধিক নাই। এই নিমিত্ত টীকাকার নীলকণ্ঠ-সমাসবলে শতত্রয় এই শব্দে এক শত তিন এই অর্থ করিয়া বিংশতি সহযোগে এক শত এগোবিংশতি এই ব্যাখ্যা করিয়াছেন।
  5. পর্বসংগ্রহে যেরূপ অধ্যায় ও শ্লোকসংখ্যা লিখিত হইল, প্রতিপর্বেই তাহার নূনাধিক্য দেখিতে পাওয়া যায়। তন্মধ্যে বনপর্ব্বে ও হরিবংশে অত্যস্থ অসঙ্গত। প্রতিজ্ঞাত সংখ্যা অপেক্ষা বনপর্ব্বে প্রায় ছয় সহস্র শ্লোক অধিক, হরিবংশে নানাধিক চারি সহস্র। পণ্ডিতেরা মীমাংসা করেন লিপিকরপ্রমাদবশতঃ এইরূপ সংখ্যাগত ন্যূনাধিক্য ধটিয়াছে।
  6. শিক্ষা, কল্প, নিরু, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, ছন্দঃ, এই ছয়, বেদের উচ্চারণনিয়মবোধক শাস্ত্রের নাম শিক্ষা, যে শাস্ত্রে বৈদিক ক্রিয়ার বিবরণ আছে, 'তাহাকে কল্প কহে, আর বেদান্ত দুরূহ শব্দের ব্যাখাকারক শাস্ত্রের নাম নিরুক্ত।
  7. জরায়ুজ, অগুন্স, স্বেদজ, উদ্ভিজ্জ।
  8. অধ্যয়ন, দান, যজন প্রভৃতি।
  9. শম, দম, ধৈর্য, ক্ষমা, সত্য প্রভৃতি।
  10. পরম পবিত্র তীর্থ বিশেষ।