মহুয়া/বরণ

উইকিসংকলন থেকে

বরণ

পুরাণে ব’লেছে
একদিন নিয়েছিলো বেছে
স্বয়ম্বর সভাঙ্গনে দময়ন্তী সতী
নর-নরপতি,—
ছদ্মবেশী দেবতার মাঝে।
অর্ঘ্যহারা দেবতারা চ’লে গেল লাজে।
দেবমূর্ত্তি চিনেছে সে দিন,
তা’রা-যে ফেলে না ছায়া, তা’রা অমলিন।
সেদিন স্বর্গের ধৈর্য্য গেল টুটি’,
ইন্দ্রলোক করিল ভ্রূকুটি॥


তাই শুনে কত দিন একা ব’সে ব’সে
ভেবেছিনু বালিকা বয়সে,
আমি হবো স্বয়ম্বরা বিশ্ব সভাতলে,—
দেবতারি গলে
দিব মালা তপস্বিনী,
মানবের মাঝখানে একদিন লবো তা’রে চিনি’
তারি লাগি সর্ব্ব দেহে মনে
দিনে দিনে বরমাল্য গাঁথিব যতনে॥

কঠিন সে পণ,
ভাবিনি কেমনে তা’রে করিব সাধন।
মানুষ-যে দেশে দেশে
কত ফেরে দেবতার ছদ্মবেশে;
ললাটে তিলক কারো লেখা,
দেখিতে দেখিতে তা’র কালো হ’য়ে ওঠে স্বর্ণরেখা।
কারো বা কটিতে বাঁধা শরশূন্য তূণ,
কেহ করে বজ্রধ্বনি, নাহি তাহে বজ্রের আগুন।
বাতায়নে ব’সে থাকি,
কতদিন কী দেখিয়া আশ্বাসে চমকি’ উঠে আঁখি;
চেয়ে চেয়ে দ্বিধা লাগে শেষে
বৃষ্টি হ’তে হ’তে দেখি শিলা পড়ে এসে॥


একদিন রৌদ্রের বেলায়
মধ্যাহ্ণের জনতার মুখর মেলায়
রাজপথ পাশে
দাঁড়াইনু,—দেখিলাম যারা যায় আসে
তাহাদের কায়া
সম্মুখে ফেলিয়া চলে দীর্ঘতর ছায়া।

শুনিলাম স্পৰ্দ্ধা-তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর
ছিন্ন ক’রে দিতে চাহে দেবতার অখণ্ড অম্বর।
উজ্জ্বল সজ্জায়
দীন অঙ্গ সমাচ্ছন্ন ধনের লজ্জায়।
ছুটে চলে অশ্বরথ
তা’র চেয়ে আড়ম্বরে সঙ্গে ওড়ে ধূলির পর্ব্বত


যখন সেদিন সেই ঊৰ্দ্ধশ্বাস লুব্ধ ঠেলাঠেলি
নানাশকে উঠিছে উদ্বেলি’
তুমি দেখি পথ প্রান্তে একা হাস্যমুখে
নিঃশব্দ কৌতুকে
চেয়ে আছ—হৃদয় আছিল জনস্রোতে,
মন ছিল দূরে সবা হ’তে।
তুমি যেন মহাকাল-সমুদ্রের তটে
নিত্যের অসীম চিত্রপটে
দেখেছিলে চঞ্চলের চলমান ছবি,
শুনেছিলে ভৈরবের ধ্যানমাঝে উমার ভৈরবী।
ব’হে গেল জনতার ঢেউ,—
কে-যে তুমি কোথা আছ দেখে নাই কেউ

একা আমি দেখেছি তোমারে—
তুমিই ফেলোনি ছায়া ছায়ার মাঝারে।
মালা হাতে গেনু ধেয়ে,
হাসিলে আমার পানে চেয়ে।
মোর স্বয়ম্বরে
সেদিন মর্ত্ত্যের মুখ ভ্রূকুটিল অবজ্ঞার ভরে।

১০ ভাদ্র, ১৩৩৫