মহুয়া/বাপী

উইকিসংকলন থেকে

বাপী

একদা বিজনে যুগল তরুর মূলে
তৃষ্ণার জল তুমি দিয়েছিলে তুলে।
আর কোনোখানে ছায়া নাহি দেখি,
শুধালেম, কাছে বসিতে দিবে কি?
সেদিন তোমার ঘরে ফিরিবার বেলা
ব’হে গেল বুঝি, কাজে হ’য়ে গেল হেলা॥

অদূরে হোথায় ভাঙা দেউলের ধারে
পূর্ব্বযুগের পূজাহীন দেবতারে
প্রভাত অরুণ প্রতিদিন খোঁজে,
শূন্য বেদীর অর্থ না বোঝে,
দিন শেষ হ’লে সন্ধ্যাতারার আলো
যে-পূজারী নাই তা’রে বলে “দীপ জ্বালো”॥

একদিন বুঝি দূরে কোন্ রাজধানী
রচনা ক’রেছে দীর্ঘ এ পথখানি।
আজি তা’র নাম নাই ইতিহাসে,
জীর্ণ হ’য়েছে বালুকার গ্রাসে,
প্রান্তর-শেষে শীর্ণ বনের কোলে
জনপদবধূ জল নিয়ে যায় চ’লে॥

লুপ্তকালের শুষ্ক সাগর ধারে
বহু বিস্মৃতি যেথা হয় স্তূপাকারে,
অতি পুরাতন কাহিনী যেথায়
রুদ্ধ কণ্ঠে শূন্যে তাকায়,
হারানো ভাষার নিশার স্বপ্ন ছায়ে
হেরিনু তোমায় আসিনু ক্লান্ত পায়ে॥

শুধু দুটি তরু মরুর প্রাণের কথা,
লুকানো কী রসে বাঁচে তা’র শ্যামলতা।
সেদিন তাহারি মর্ম্মের সনে
কী ব্যথা মিশানু, জানে দুইজনে;
মাথার উপরে উড়ে গেল কোন্ পাখী
হতাশ পাখার হাহাকার রেখা আঁকি’॥

তপ্ত বালুরে ভর্ৎসিয়া মুহু মুহু
তাপিত বাতাস চিৎকারি’ উঠে হুহু;
ধূলির ঘূর্ণি, যেন বেঁকে বেঁকে
শাপ-লাগা প্রেত নাচে থেকে থেকে;
রূঢ় রুদ্র রিক্তের মাঝখানে
দুইটি প্রহর ভ’রেছিনু প্রাণে গানে॥

দিন শেষ হ’লো, চ’লে যেতে হ’লো একা,
বলিনু তোমারে, আরবার হবে দেখা,
শুনে হেসেছিলে হাসিখানি ম্লান,
তরুণ হৃদয়ে যেন তুমি জানো
অসীমের বুকে অনাদি বিষাদখানি
আছে সারাখন মুখে আবরণ টানি’॥

তার পরে কত দিন চ’লে গেল মিছে
একটি দিনের দলিয়া পায়ের নীচে।
বহু পরে যবে ফিরিলাম, প্রিয়ে,
এ-পথে আসিতে দেখি চমকিয়ে
আছে সেই কূপ, আছে সে যুগলতরু
তুমি নাই, আছে তৃষিত স্মৃতির মরু॥

এ কূপের তলে মোর যক্ষের ধন
একটি দিনের দুর্লভ সেইক্ষণ
চিরকাল ভরি’ রহিল লুকানো,
ওগো অগোচরা জানো নাহি জানো;
আর কোনো দিনে অন্য যুগের প্রিয়া
তা’রে আর কারে দিবে কি উদ্ধারিয়া?

১৬ ভাদ্র, ১৩৩৫