মাঝির ছেলে/বারো

উইকিসংকলন থেকে

বারো

 সারাদিন টিপি টিপি বৃষ্টি পড়েছে আর মাঝে মাঝে ঝাপটী-মারা এলোমেলো বাতাস বয়েছে, -অলস নিজীবি বাতাস। এখন লঞ্চকে প্রাণপণে বন্দরের আশ্রয়ের দিকে ছুটতে দেখেই বোধ হয় বাতাস ধীরে ধীরে সজীব হয়ে উঠতে লাগল।

 যাদববাব জিজ্ঞাসা করলেন, “মন কি কয়, ভিমনা?”

 ভিমন কতকটা স্বন্তির সঙ্গেই জবাব দিল, “বন্দরে ভিড়ামু কর্তা। হঠাৎ বাড়বে না।”

 শুধু বাতাস নয় লঞ্চকে জোরে জোরে দোলা দিয়ে সমুদ্রও জানিয়ে দিতে থাকে ঝড় উঠছে। লিঞ্চের ওঠা-নামা কত হওয়ায় আগে একটা ছন্দ * ছিল, ক্রমে ক্রমে ছন্দ ভেঙ্গে সব যেন বেতালা হয়ে, উঠতে থাকে। এতক্ষণে অন্ধকারের জন্য আপসোস হতে লাগিল নাগার। নাগা ভাবে, হায়, এমুন্ন উত্তাল হয়ে উঠছে সমুদ্র তার কল্পনার সমুদ্রের মত কিন্তু শুধু অনুভব করা ছাড়া চোখ মেলে চেয়ে দেখবার উপায় নেই। দিনের বেলা যদি এই পোড় উঠত। আর চোখ মেলে যতদূর দৃষ্টি যায় এখানকার সমুদ্রের চেহারা সি দেখতে পারত! বন্দরের আলো যখন চোখে পড়ল, জলকন্যা মোচার },খালার মত নাচতে নাচতে কোনমতে এগিয়ে চলেছে। ডেকের উপর দাড়িয়ে থাকা রীতিমত কসরতে দাড়িয়ে গেছে। কখনো সামনের ডেক যেন মুখে এসে ধাক্কা দেবার জন্য উঠে আসছে, পরীক্ষণে আছড়ে পড়ছে ঢেউয়ের পিছনের ঢালু গহবরে। ছোট নৌকায় নাগা নদীতে ঝড়েৰু মুখে পড়েছে, মনে হয়েছে জল আর বাতাসে মিলে যে ভয়াবহ পাগলামি আরম্ভ করেছে, জগতে কি তার তুলনা আছে আর? আজি ছোট একটি জাহাজে তাকে নিয়ে সেই পাগলামির বৃহত্তর অভিনয় শুরু হয়েছে। হায়, পাগলা সাগরের পাগলামি যদি সে চোখে দেখতে পারত আজ।

 কিছুক্ষণ থেকে পঞ্চ ভয়ে প্রায় আধমরা হয়েছিল। কানের কাছে মুখ নিয়ে চীৎকার করে কথা না বললে এখন শোনা যায় না, পঞ্চ বা আপসোসের কথাগুলি নাগার কানে পোছবার আগেই বাতাস গর্জাতে গর্জাতে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। বন্দরের আলো দেখে বোধ হয় পঞ্চুর ভরসা হল যে প্রাণটা আজ আর তার সমুদ্রে রেখে যেতে হবে না। ডেকের মাঝখানে নীচে নামবার সিঁড়ির মুখের কাছে লোহার রড জড়িয়ে বসে থাকার বদলে সে টলতে টলতে রেলিংএর ধারে নাগার কাছে এসে দাঁড়াল। নাগা ভাবল, এভাবে রেলিং ঘেষে দাড়ানো যে বিপজ্জনক এতক্ষণে সেটা খেয়াল হওয়ায় পঞ্চু বুঝি তাকে সরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে। বন্দরের একেবারে কাছে এসে পরের বিপদ সম্বন্ধে সচেতন হওয়াটা পঞ্চুর পক্ষে স্বাভাবিক,— এতক্ষণ নিজের ভাবনাই বেচারী ভাবছিল, করবে কি।

 কিন্তু পঞ্চু তাকে কিছু বলল না, এক হাতে রেলিং ধরে দাড়িয়ে আরেক হাত উঁচুতে তুলে প্রকাণ্ড একটা টর্চের আলো একবার জালিয়ে আবার নিভিয়ে দিতে লাগল।

 তখন পঞ্চুর হাতে টর্চে যেমন ঝলক মেরে আলো জেলে উঠেছিল তেমনিভাবে নাগার মনে পড়ে একটি দৃশ্য-সদরের জেটির এক কোণে বসে পঞ্চু হাত তুলে রুমাল নাড়ছে।

 'তুমি পুলিশ ডাকছ!'—নাগা চীৎকার করে উঠল।

 পরেশ তার কানের কাছে মুখ এনে চেঁচিয়ে বলল, ‘তর ভয় নাই নাগা। আমি কইয়া দিমু—”

 চোখের পলকে তার হাত থেকে টর্চটি ছিনিয়ে নিয়ে নাগা একমুহূর্ত হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সঙ্গেত করা হয়ে গিয়েছে, জলকন্যা বন্দরের কাছে এগিয়ে যাওয়া মাত্র পুলিশ ছেকে ধরবে। এগিয়ে যাওয়ার জন্যও হয়তো তারা অপেক্ষা করবে না, লঞ্চ নিয়ে পুলিশ হয়তো তৈরী হয়েই ছিল, পঞ্চুর সঙ্কেত পেয়ে তারাই হয়তো এগিয়ে এসে জলকন্যাকে পাকড়াও করার জন্য রওনা হয়ে গিয়েছে। কি করা যায় এখান?

 পঞ্চকে তুলে সমুদ্রে ছুড়ে দেওয়া যায়।

 কিন্তু তার চেয়ে আগে ভিমনা আর যাদববাবুকে খবরটা জানানই বোধ হয় উচিত। হামাগুড়ি দিয়ে, কেবিনের দেওয়াল ধরে নাগা যত তাড়াতাড়ি পারে এগিয়ে গেল। ভিমনা দু’হাতে সজোরে হুইল চেপে ধরে আছে, কাছে দাঁড়িয়ে আছেন যাদববাবু।

 'ফেরাও ভিমনা, জাহাজ ফেরাও। পঞ্চু পুলিশরে ইশারা করছে।’

 'পুলিশ?'

 ভিমনার মাথা ঠিক যথাস্থানেই রইল, বন্দরের সীমানায় ঢুকে তীরের এত কাছে এসে অসতর্ক হলে চলবে না। নাগা আর যাদববাবুর মাথা তার মাথার কাছে ঘেঁসে এল। টর্চটা দেখিয়ে সংক্ষেপে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়ে নাগ। বলল, ‘এখন উপায় করেন।’

 ভিমনা তাকাল যাদববাবুর দিকে। যোদববাবু বাহির সমুদ্রের দিকে হাত বাড়িয়ে প্রয়োজনের চেয়ে জোরালো আওয়াজে বললেন, ‘লঞ্চ ফোরাও ভিমনা।’

 'লঞ্চ বাঁচবো না কর্তা।’

 যাদববাবু নীরবে আবার বন্দরের বিপরীত দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। একমুহুর্তের জন্য তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ভিমনা হঠাৎ তার ঝকঝকে দাঁত মেলে হাসল। মাথা হেলিয়ে সায় দিয়ে আরও জোরে হুইলটা চেপে ধরল।

 তারপর জলকন্যার মুখ বন্দরের দিক থেকে দ্রুতবেগে ঘুরে যেতে লাগল। ভিমনা কি সঙ্কেত পাঠাল নাগার অজানা উপায়ে, লঞ্চের সমস্ত আলো হঠাৎ নিভে গেল। অল্পক্ষণের মধ্যে দেখা গেল বন্দরের আলো পিছনে ফেলে লঞ্চ পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলেছে।

 ডেনিস বোধ হয় কেবিনে ছিল। একটু পরেই গলার আওয়াজে বোঝা গেল সে কাছে এসে দাড়িয়েছে।

 'কি ব্যাপার?'

 ভিমনা তখন লঞ্চ সামলাতে ব্যস্ত, কথা বলার সময় নেই। যাদববাবু ডেনিসকে ব্যাপার বুঝিয়ে দিলেন। সমস্ত শুনে ডেনিস বলল, ‘রাইট। দশ বছর জেলে থাকার চেয়ে সমুদ্রের কবর অনেক, ভাল।’

 ভিমনা বলেছিল আসল ঝড় আরম্ভ হওয়ার আগেই বন্দরে পৌছতে পারবে। নাগা তার কথার অর্থ বুঝতে পারে নি। ঝড়ের বেগ আর সমুদ্রের উন্মত্ততা ক্রমে ক্রমে বাড়ছে বুঝতে পারছিল, কিন্তু বন্দরের কাছে পৌছবার সময় যে অবস্থায় পৌছেছিল, ঝড় যে তার চেয়ে ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে কি করে সে কল্পনা করতে পারে নি। আধঘণ্টা পরে নিজেকে যখন তার লঞ্চের সঙ্গে বেঁধে রাখবার দরকার হল, তখন সে বুঝতে পারল ঝড়ের ভূমিকা আর আসল ঝড় বলতে ভিমনা কি বুঝাতে চেয়েছিল।

 পাহাড় সমান ঢেউ লঞ্চের ওপর আছড়ে পড়তে থাকে, লঞ্চের সঙ্গে নাগা তলিয়ে যায় ফেনিল জলের নিচে, মনে হয় আর ভেসে উঠবে না। তারপর আবার লঞ্চ ভেসে ওঠে কয়েক মুহূর্তের জন্য, দম না নিতে নিতে আরেকটি জলের পাহাড় তাকে গ্রাস করে। ভিমনার হুকুমে ডেনিস আর যাদববাবু নিচে চলে গেছেন, সেখানে তাঁরা হয়ে আছেন বন্দী। ডেকের চেয়ে সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে থাকা অনেক নিরাপদ বটে, কিন্তু ওভাবে বন্দী অবস্থায় লঞ্চ ডোবার প্রতীক্ষা করে থাকার চেয়ে ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া নাগার কাছে অনেক ভাল। কোনদিকে লঞ্চ চলেছে কে জানে! ইঞ্জিন কি চলছে, না জলকন্যা শুধু ভেসে চলেছে ঝড়ের ঠেলায়? ভিমনা কি করছে জানতে পারলে নাগা খুশী হত। লঞ্চ বাঁচবে না জেনেও যাদববাবুর হুকুমে এতগুলি মানুষের প্রাণের দায়িত্ব নিয়ে বন্দরের আশ্রয় সে ছেড়ে এসেছে, কোথায় যাবে কি করবে কিছু কি সে ঠিক করে নি?

 তারপর এক সময় নাগা বুঝতে পারল, সে যেখানে আছে সেখানে থাকলে লঞ্চ না ডুবলেও সে কয়েক মিনিটের মধ্যেই দম আটকে মরে যাবে। নাগা নিজের বাঁধনটা খুলে ফেলল, ভাবল, মরতেই যদি হয় নিচে গিয়ে সকলের সঙ্গে মিলে একসাথেই মরা যাক। পরমুহুর্তে বড় একটা ঢেউ এসে লাইফ বেল্ট আটা নাগাকে লঞ্চ থেকে তুলে নিয়ে চলে গেল।

 নাগার মনে হ’ল, এতক্ষণে সে কি আসল সমুদ্রযাত্রা শুরু করেছে, একেবারে সমুদ্রের সঙ্গে মিশে গিয়ে?