মাধবীকঙ্কণ/আট
নরেন্দ্র সেইদিনই পীড়াক্রান্ত হইলেন, গ্রামের একজন ভদ্রলোক তাহার চিকিৎসা করাইতে লাগিলেন, কিন্তু অনেকদিন তাঁহার জীবনের আশা ছিল না। অনেকদিন পর নরেন্দ্র ক্রমে আরোগ্যলাভ করিতে লাগিলেন। যখন চলিবার শক্তি হইল, তখন সেই ভদ্রলোককে যথেষ্ট ধন্যবাদ দিয়া নরেন্দ্র সে গ্রাম ত্যাগ করিলেন।
প্রথম শোক ও নৈরাশ্যের বেগ তখন শান্তু হইয়াছে, নরেন্দ্র হেমলতাকে ফিরিয়া পাইবার উপায় চিন্তা করিতে লাগিলেন। অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া স্থির করিলেন যে, সুবাদারের নিকট আপন বিষয় পাইবার আবেদন করিব। পৈতৃক জমিদারী আমার হইলে স্বার্থপর নবকুমার অবশ্যই আমাকে কন্যাদান করিবেন।
এই উদ্দেশ্যে নরেন্দ্র সুবাদার সুজার রাজধানীতে পৌছিলেন। সম্রাট শাজাহানের পুত্র সুজা বঙ্গদেশের শাসনকার্যে নিযুক্ত হইয়া রাজধানী ঢাকা হইতে রাজমহলে স্থানান্তরিত কবিয়াছিলেন এবং বিংশতি বৎসর সুশাসন দ্বারা বঙ্গদেশে যথেষ্ট সুখ্যাতি লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহার শাসনকালে দেশে প্রায় যুদ্ধ বা কোনরূপ উপদ্রব হয় নাই, প্রজাবর্গ নিরুদ্বেগে কালযাপন করিতেছিল। ইতিহাসে তাহার অনেক সুখ্যাতি দেখিতে পাওয়া যায়। তিনি যুদ্ধে যেরূপ বিক্রমশালী ছিলেন, অন্য সময়ে সেইরূপ ন্যায়পরায়ণ ও দয়ালু ফিলেন। তাহার দয়া ও ন্যায়পরতা দেখিয়া সমগ্র বঙ্গদেশে কি জমিদার, কি জায়গীরদার সকলেই তাহাকে ভালবাসিত। কথিত আছে, তাহার মুত্যুর সময়ে আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই তাহার জন্য খেদ করিয়াছিল; কিন্তু তাহার উদারস্বভাব দুই একটি দোষে কলঙ্কিত ছিল। যুদ্ধের সময় তিনি যেরূপ সাহসী, অন্য সময়ে তিনি সেইরূপ বিলাসী। সুজা নিরতিশয় সুশ্রী পুরুষ ছিলেন এবং সর্বদাই সুন্দরী রমণীমণ্ডলীতে পরিবৃত থাকিতে ভালবাসিতেন। তাহার প্রধানা রাজ্ঞী প্যারীবানু বঙ্গদেশে রূপে, গুণে ও চতুরতায় অদ্বিতীয়া বলিয়া খ্যাতা ছিলেন। তিনি বাক্পটুতা ও সুমধুর কৌতুকে সর্বদাই সুবাদারের হৃদয় প্রেমরসে সিক্ত করিয়া রাখিতেন। কিন্তু প্যারীবানুও সুজার একমাত্র প্রণয়ভগিনী ছিলেন না, শত শত বেগম উদ্যানস্থিত পুষ্পের ন্যায় সুজার রাজমন্দির আলো করিয়া থাকিত। তাহাদের রূপে বিমোহিত হইয়া সুজা রাজকার্য বিস্মৃত হইতেন, কখন কখন দুই তিন দিন ক্রমান্বয়ে মদ্যপান ও আমোদে অতিবাহিত করিতেন।
নরেন্দ্রনাথ সুবাদারের নিকট আবেদন করিতে যাইলেন। এরূপ সুবাদারের নিকট উচিত বিচার প্রত্যাশা সম্ভব নহে। গঙ্গাতীরে সুন্দর রাজমহল নগরী এখনও দেখিতে মনোহর, কিন্তু যখন বঙ্গদেশের রাজধানী ছিল, তখন রাজমহলের শোভা অতুলনীয় ছিল। সুবারের উচ্চ প্রাসাদ ও রাজবাটা, ওমরাহ ও জায়গীরদারদিগের সুদৃশ্য হর্ম্যাবলী এবং বঙ্গদেশের সমস্ত ধনাঢ্য লোকের সমাগমে রাজমহল যথার্থ রাজপুরী বোধ হইত। স্বয়ং গঙ্গা সহ ধন্য বণিকের সহস্র পোত বক্ষে ধারণ করিয়া নগরের শোভা ও সমৃদ্ধি বর্ধন করিত। প্রশস্ত রাজপথে যুদ্ধবিলাসী গর্বিত ওমরাহ ও মুসলমান জমিদারগণ সর্বদাই অশ্ব, হস্তী অথবা শিবিকায় গমন করিত। হিন্দু বণিক ব্যবসায়ী লোক শান্তভাবে নগরের একপার্শ্বে বাস করিত ও নিজ নিজ ব্যবসায়ে রত থাকিত।
এ সমস্ত দেখিবার জন্য নরেন্দ্রনাথ রাজমহলে যান নাই, এ সমস্ত দেখিয়া তিনি শান্ত হইলেন না; কিরূপে সুবাদারের নিকট আবেদন জানাইবেন, তাহাই চিন্তা করিতে লাগিলেন। অনেক ধনাঢ্য হিন্দুবণিক নরেন্দ্রের পিতাকে চিনিতেন, কিন্তু নরেন্দ্র এক্ষণে দরিদ্র, দরিদ্রের জন্য কে চেষ্টা করে? নরেন্দ্র যাঁহার নিকট যাইলেন, তিনিই বলিলেন “হাঁ বাপু, তোমার পিতা মহাশয় লোক ছিলেন, তাঁহার পুত্রকে দেখিয়া বড় সন্তুষ্ট হইলাম, কয়েকদিন এইস্থানে অবস্থিতি কর, পরে দেখা যাইবে,” ইত্যাদি। নরেন্দ্র বিফল প্রযত্ন হইয়া রহিলেন।
অনেকদিন পর ঘটনাক্রমে এর্ফান খাঁ নামক কোন মোগল জায়গীরদারের সহিত নরেন্দ্রের পরিচয় হইল। এর্ফান খাঁ বীরেন্দ্রের পরম বন্ধু এবং যথার্থ মহাশয় লোক ছিলেন, তিনি সাদরে নরেন্দ্রকে আহ্বান করিয়া সত্বর তাঁহার জন্য সুবাদারের নিকট যাইতে প্রতিশ্রুত হইলেন। তথাপি দরিদ্রের আবেদন বিচারাসন পর্যন্ত যায় না, অনেক যত্নে, অনেকদিন পরে এর্ফান খা বহু অর্থে সুবাদার ও তাঁহার মন্ত্রিবর্গের মন পরিতুষ্ট করিয়া একদিন নরেন্দ্রনাথের আবেদন সুজার সম্মুখে উপস্থিত করিলেন।
সুন্দর রৌপ্য ও স্বর্ণখচিত সিংহাসনে সুবাদার বসিয়াছেন, রাজবেশ সে সুন্দর অবয়বে বড় সুন্দর শোভা পাইতেছে। চারিদিকে অমাত্য ও বড় বড় আফগান ও মোগল যোদ্ধাগণ শির নত করিয়া দণ্ডায়মান রহিয়াছেন ও বহুবিধ লোকে বিস্তীর্ণ বিচার প্রাসাদ পরিপূর্ণ রহিয়াছে। প্রস্তরবিনির্মিত সারি সারি স্তম্ভের উপর চারুখচিত ছাদ শোভা পাইতেছে, সিংহাসনের দুইদিকে পরিচারক চামর দুলাইতেছে। প্রাসাদের বাহিরে যতদূর দেখা যায়, লোকে সমাকীর্ণ সুবাদার সর্বদা দেখা দেন না, সেইজন্য অন্য সকলেই দেখিতে আসিয়াছে।
সুবাদারের সম্মুখে বৃদ্ধ এর্ফান খাঁ উঠিয়া আবেদন করিলেন, জাঁহাপনা, এ দাস প্রায় বিংশতি বৎসর সম্রাটের কর্ম করিয়াছে, সুবাদারের কার্যে আমার কেশ শুক্ল হইয়াছে, ললাট খড়ে্গ ক্ষত হইয়াছে। গোলামের কিঞ্চিৎ আবেদন আছে।”
সুবাদার বলিলেন, “এর্ফান, তুমি আমাদের প্রধান অনুচর ও অতিশয় প্রিয়পাত্র, তোমার এমন কি যাঞা আছে, যাহা আমাদের অদেয়?”
এর্ফান ভূমি পর্যন্ত শির নোয়াইয়া পুনরায় বলিলেন, জাঁহাপনা! বঙ্গদেশবাসিগণ অতি দুর্বল; তাহাদের মধ্যে সময়ে সময়ে যে পরাক্রান্ত জমিদারগণ আমাদিগের যুদ্ধে সাহায্য করে, তাহার সুবাদারের প্রীতিভাজন সন্দেহ নাই। জমিদার বীরেন্দ্র সিংহ একজন সেইরূপ লোক ছিলেন।”
সুবাদার বলিলেন, “হাঁ, আমি সেই হিন্দুর নাম শুনিয়াছি, পাঠানদিগের সহিত আমাদের যুদ্ধে সে সাহায্য করিয়াছিল।”
এর্ফান পুনরায় তসলীম করিয়া বলিল, জাঁহাপনা! যাহা কহিলেন, যথার্থ। এই দাস যখন উড়িষ্যার যুদ্ধে গিয়াছিল, স্বচক্ষে বীরেন্দ্রের যুদ্ধ-কৌশল ও রাজভক্তি দেখিয়াছিল। এই রাজসভায় অনেক পরাক্রান্ত পাঠান ও মোগল যোদ্ধা আছেন; কিন্তু বীরেন্দ্র অপেক্ষা অধিক সাহসী পুরুষ এ গোলাম এ পর্যন্ত দেখে নাই।”
সভাস্থদিগের কোষে অসি ঝন্ ঝনার শব্দ হইল, মুসলমানদিগের মুখ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল; কিন্তু সুজা সহাস্যবদনে বলিলেন “এর ফান, তুমি কাফেরের অত্যন্ত প্রশংসা করিয়াছ, তা অযথার্থ নহে, সে হিন্দু যথার্থ সাহসী ছিল শুনয়াছি। এক্ষণে তাহার জন্য কি বলিবার আছে বল, তোমার উপরোধে আমি তাহাকে যে-কোন পুরস্কার দিতে প্রস্তুত আছি।”
এর্ফান গম্ভীর স্বরে বলিলেন, “যিনি সুবাদারের উপর সুবাদার বাদশাহের উপর বাদশাহ, তিনিই কেবল এক্ষণে বীরেন্দ্রকে পুরস্কার বা শাস্তি দিতে পারেন। আমি তাঁহার অনাথ বালকের জন্য আবেদন করিতেছি। বালক এক্ষণে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিতেছে, কানঙ্গু মহাশয়ের যোগে এক শঠ তাহার পৈতৃক জমিদারি কাড়িয়া লইয়াছে।”
ভ্রূ-কুঞ্চিত করিয়া সুবাদার কানঙ্গুকে সবিশেষ জিজ্ঞাসা করিলেন। সে সময় সমস্ত খাজনা ও জমিদারীর বিষয় কানঙ্গু মহাশয়ের হস্তে থাকিত; এমন কি, বঙ্গদেশের সুবাদার যে সমস্ত কাগজপত্র দিল্লীতে পাঠাইতেন, তাহাও কানঙ্গুর সহি না হইলে গ্রাহ্য হইত না। কানঙ্গু মহাশয় নবকুমারের অর্থভোগী বিনীতভাবে তিনি বলিলেন “সুবাদার মহাশয়ের আদেশ আমাদের শিরোধার্য; বীরেন্দ্রের মৃত্যুর পর কয়েক বৎসর খাজনা আদায় না হওয়ায় জাঁহাপনা সেই জমিদারি নবকুমারকে দিতে আদেশ দিয়াছিলেন।”
সুজাকে কোন বিষয় বুঝাইয়া দেওয়া কঠিন ছিল না, কানঙ্গু মহাশয় যাহা বুঝাইলেন, সুবাদার তাহাই বুঝিলেন, এর্ফানের আবেদন ফাঁসিয়া গেল। এর্ফান রোষে নতশির হইয়া রহিলেন, তাঁহার দক্ষিণ পাশে দণ্ডায়মান হইয়া নরেন্দ্র কানঙ্গু মহাশয়ের দিকে তীব্রদৃষ্টি করিতেছিলেন।
সুবাদার শেষে বলিলেন, “এর্ফান খাঁ। সূর্য যে রশ্মি জগতে দান করেন, তাহা ফিরাইয়া লন না, জমিদারী স্বয়ং দান করিয়া ফিরাইয়া লওয়া রাজধর্ম নহে; বীরেন্দ্রের বালক তেজস্বী দেখিতেছি, বীরেন্দ্রের মত যুদ্ধব্যবসায় শিক্ষা করুক অবশ্যই উৎকৃষ্ট পুরস্কার ও অন্য জমিদারী এনাম পাইবে।”
সভাস্থ সকলে “কেরামৎ” “কেরামৎ” বলিয়া সুবাদারের কথার প্রশংসা করিল; এরফান অগত্যা তাহাতে সম্মত হইয়া সেইদিন হইতেই নরেন্দ্রকে নিকটে রাখিয়া যুদ্ধব্যবসায় শিখাইতে লাগিলেন।